
রবীন্দ্রনাথ আমার চর্চায় চর্যায় এবং বিপন্নতায়
সাবিনা ইয়াসমিন
‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা আর সমস্ত থাক পড়ে/রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে’ এবং একই সাথে ‘পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে/ মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে’ —– সঞ্চয়িতা থেকে এই দুটো কবিতা আগামী পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আবৃত্তি করার জন্য বেছে নিয়ে আমার দিদুন (নানি) আমার হাতে কবিতার বইটি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, বাড়িতে ভর্তি লোকজন তুমি ছাদের ঘরে আড়ালে গিয়ে মুখস্ত করো একমনে। মুখস্ত হয়ে গেলে মাসিরা তখন শিখিয়ে দেবে কী করে আবৃত্তি করতে হবে। বয়স আমার তখন বড়জোর চার কি পাঁচ। তারও আগে থেকে আমার রবীন্দ্র কবিতা ও গান এর চর্চা শুরু হয়েছিল অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে প্রবেশ করেছিলেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই। কথা বলতে শেখা থেকেই। যেমন সুকুমার রায় ঢুকে পড়েন আমাদের জীবনে ঠিক তেমনই।
তবে আমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বীজটা বুনে দিয়েছিলন প্রথম আমার দিদুনই। রবীন্দ্রসংগীত নয়, রবীন্দ্র কবিতা নিয়ে অদম্য উন্মাদনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার মননে ও চর্চায় তারপর থেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময় আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয় ও অবলম্বন হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমি কথা বলছি প্রায় পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের বাংলার মুর্শিদাবাদের একটি অজ পাড়া গাঁয়ের। গ্রামটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও পাশাপাশি বাস করতেন এবং ছিলেন একইরকমভাবে সমসংস্কৃতিমনোভাবসম্পন্ন। তাই রবীন্দ্র নজরুল চর্চা ও জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া থেকে শুরু করে তার বাস্তবায়নে উভয় সম্প্রদায়েরই যৌথ ভাবনা ও তাগিদ থেকেই হত। আজ বিস্ময় জাগে, সেই গ্রাম এলাকাগুলোতে এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে বেঁচে রয়েছেন তা কিছুটা অনুধাবন করতে পেরে! আদৌ বেঁচে রয়েছেন কী রবীন্দ্রনাথ এখনকার মানুষজন ও ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সন্দেহ হয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ওইসব এলাকায় এখন রবীন্দ্র বলতে তাঁরা ঠিক কী বোঝেন সেটা জানার আগ্রহ নিয়েই আমি বেশ কয়েকবার ছুটে গিয়ে যা দেখেছি তা খুবই হতাশাজনক।
দিদুন চলে গেছে ক’বছর হল। প্রতিবারই, যতবার দিদুনের কবরের কাছে যাই ততবারই কথা দিয়ে আসি এই গ্রামে অনেক কিছু করার। এই গ্রামে আমার রিসার্চ অরগানাইজেশন শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা গান নয়, তাঁর গ্রাম ভাবনা, সমাজ সংস্কৃতি চেতনা বোধ নিয়ে কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বড়ো আকারে অনেক কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে। একটু সময় লাগছে ঠিকই কিন্তু আমি থেমে নেই। আমি করব এবং আমি পারব দিদুনকে দেওয়া আমার এটিই সর্বশেষ কথা ।
দিদুনের পর আমার কলেজের বাংলার অধ্যাপক ডক্টর শ্যামল রায় স্যার আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এলেন একেবারে অন্যরকমভাবে। সহজ সাবলীল পরিশীলিত রবীন্দ্রনাথকে আমি পেলাম আমার অন্তরাত্মা জুড়ে। মফঃস্বলের একটি গ্রামে দিদুনের হাত ধরে শুরু হওয়া কবিতা আবৃত্তির চর্চাটি আরও গুরুত্বের সাথে শেখা শুরু হল আমার কলেজের শ্যামল স্যারের কাছে। উচ্চারণ ছন্দ স্বর প্রক্ষেপন ইত্যাদি শুরু হল সঠিক ব্যাকরণ মেনেই এবং তা চলতেও থাকল। উচ্চশিক্ষার জন্য আজ থেকে ২৩ বছর আগে যখন কোলকাতায় রবীন্দ্রভারতীতে পড়তে এলাম তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার কাছে আমার কথা বলার যন্ত্রণার রাগ অভিমানের একটি জলজ্যান্ত সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠলেন।
কলকাতায় এসেও আমার রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি চর্চা বজায় রাখার পথটিও মসৃণ হয়ে গেছিল পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ এর সান্নিধ্যে এসে। সেই সময় বিশেষ করে পার্থ ঘোষের মুখ থেকে যখন রবীন্দ্রনাথ এর কবিতা বিষয়ক তাঁর অগাধ পড়াশুনো এবং অভিজ্ঞতার কথা বিশদে শুনতাম তখন আমি অজান্তেই রবীন্দ্রনাথের কতখানি গভীরে পৌঁছে যেতাম তার কোন হদিশ পেতাম না নিজেই। রবীন্দ্র কবিতার গভীরতার অতল খাদে নিমজ্জিত হতে থাকলাম ক্রমশ আমি। পরে কবিতার সীমারেখা ভেদ করে ঢুকে পড়লাম গল্প ছোটগল্প উপন্যাস প্রবন্ধে। রবীন্দ্রসংগীত শোনার অভ্যেস তো তৈরী হয়ে গেছিল ছোট থেকেই।
এবার রবীন্দ্রনাথকে আমার একেবারেই নগ্ন করে পেতেই হবে এমন একটি বোধের তাড়নায় আমি আমার সেলফ স্টাডি শুরু করে দিলাম। একই সাথে রবীন্দ্র বিষয়ক বহু বিশিষ্টদের লেখা ও সাক্ষাতকার পড়তে ও শুনতে থাকলাম। রবীন্দ্রনাথ চারিয়ে যেতে থাকল আমার জীবনে যাপনে। এমনটাই স্বাভাবিক। হয়ত কমবেশি সবার কাছেই রবীন্দ্রনাথ একরকম এভাবেই ধরা দেন।
রবীন্দ্র চর্চা গত কয়েক বছরে অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের থেকে বয়সে অনেক ছোটোরাও রবীন্দ্র চর্চায় আরও বেশি করে মনোযোগী হয়েছে যদিও তা খুবই সামান্য আকারে এবং বস্তুত তা শহর কিংবা শহরতলীকেন্দ্রিক। গ্রাম কিংবা মফঃস্বল এলাকায় রবীন্দ্র চর্চার কোন ধার ধারেই না কেউ। সব থেকে বেশি দুঃখজনক যে আগে সরকারি স্কুল হোক কিংবা বেসরকারি সকাল সাতটা থেকে প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু হত রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন, চলত দশটা এগারোটা পর্যন্ত। কোনও কোনও স্কুলে তো দিনভর অনুষ্ঠান হত। সেমিনার আলোচনা বক্তব্য গান কবিতা ক্যুইজ ছবি আঁকা নাটক যাত্রা আরও কত কী! পড়ুয়াদের মগজে ঢুকে পড়তেন রবীন্দ্রনাথ এভাবেই। এখন এসবের বালাই নেই। কেন নেই তাঁর কোনও উত্তরও নেই। এখন ২৫ বৈশাখ দিনটিতে স্কুলগুলোয় ঝোলে তালা। শিক্ষক শিক্ষিকারা বাড়িতে ছুটি উপভোগ করে। ছাত্র ও ছাত্রীরা ফেসবুকেই সেরে নেয় জন্ম জয়ন্তী।
গ্রামের সরকারি স্কুলগুলোয় কিংবা পাড়া মহল্লায় আগের মতো এই যে রবীন্দ্র চর্চা নেই, কেন নেই তাঁর কোন যেমন সদুত্তর নেই, এই নেই’এর সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়েই উঠছিলাম। ব্যক্তিগত স্তরে চর্চা ও পড়াশুনোটুকু যেহেতু বজায় আছে তাই এই নেই’ বিষয়টি সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের দীনতা টের পেলেও বিপন্ন বলে নিজেদের ভাবতে শুরু করব।
আজকের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সামাজিক জীবনে যেভাবে দুটো শব্দ আমাদের মূল্যবোধের জায়গায় বার বার অনবরত আঘাত করছে তা হল হিন্দু এবং মুসলিম এই দুটো শব্দ। এখন ভারতবর্ষে ধর্ম বিষয়টি এভাবেই জাঁকিয়ে বসছে সবকিছুতেই এবং আমাদের প্রতিদিনের সুস্থতার জায়গাটিকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। এ পর্যন্ত যদিও বা আমরা সহনশীলতার বাজি রেখে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি আমাদের আশ্রয় আবেগ এবং অবলম্বন তাঁকেও যখন সেই একই কাঠ গড়ায় তুলে দিয়ে বলার চেষ্টা করা হয় খুব সচেতনভাবেই যে রবীন্দ্রনাথ একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ এবং তিনি অন্য সম্প্রদায় অর্থাৎ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন তখন আসলে বিপন্ন বোধ নয়, আমাদের দৈন্য দশাই প্রকট হয় বলতে হবে।
যখনই যতবার আমি এইরকম দীনতার মধ্যে পড়েছি, ততবারই আমি ‘এবার ফিরাও মোরে’ এই কবিতাটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। নৈবদ্য কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মধ্যে দিয়ে আমি বহুবার হেঁটে গিয়েছি কারণ সেখানেই আমি খুঁজে পেয়েছি আমার দিশা ও মুক্তি।
আমাদের চেতনার নাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিশ্বজনীন হতে পেরেছিলেন তাঁর এই চিন্তা চেতনার জাগরণের উত্তরণের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হিন্দু মুসলিম এই দুই শব্দের নিরিখে মেপে তাঁকে সংকীর্ণ করে দেওয়ার চেষ্টা হোক কিংবা অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার দায়ও সেই আমাদের ওপরেই বর্তায়। আমরা অর্থাৎ যারা সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার ‘বেস্ট প্রাক্টিস’ শুরু করেছি শুধু তাই নয়, সাহস রেখেছি বুকে তা উচ্চারণেরও।
আমার জীবনে যাপনে ও বিপন্নতায়, ‘ভজন পূজন সাধন আরাধনায়’ থাকুক আমার ‘ব্যাক্তিগত রবীন্দ্রনাথ’ এমনিভাবেই।