হৃদিস্থিতেন <br />  কস্তুরী সেন

হৃদিস্থিতেন
কস্তুরী সেন

‘ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে…’

সে এই যে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতার একটি কৈফিয়ত খুঁজে নিতে চায় এতখানি বয়সে এসে, কলমে একছত্র অক্ষরও নেই যখন অথচ দরজাটির খিল পাকাপোক্ত বন্ধ, নিরালার ঘরটুকুতে কেমন চতুর অধিকার, কেননা লেখা এক ছদ্মবেশ। সে লিখতে বসেছে প্রায়ই আর গলির ওপারে পাটলবর্ণ পুরনো বাড়ির ছাদে রোদ্দুরে কেউ মেলে দিয়ে গিয়েছে বেগনি রঙের শাড়ি, রং কি বেগনিও আসলেই, নাকি সে এই রং বানিয়ে নিল, নিচ্ছে এইমাত্র? সমাজমাধ্যমে প্রশ্ন ঘোরে যেমন, প্রথম কবে দ্যাখা, কবে প্রথম — তার গুলিয়ে যাচ্ছে শিশুভবন ইশকুল নাকি হাঁস সিলোনো সাদা জামা পরে কবেকার আরেক রোদ এসে পড়া লাল মেঝেয় বসে সে কিছুতেই গিলছে না মুখভর্তি অন্ন, নিজে নিজেই দুলছে ‘ভাত আনো বড় বৌ, ভাত আনো বড় বৌ—
সে এক বালিকাস্কুলপ্রধান সময়, তখনও দ্যাখাশোনার প্রথম পর্ব, গানের ঘরে ‘এ রি আ লি পিয়াবিনা’ তার ভাল লাগছে না কেননা ইন্দ্রাণী দিদিমণিটি চশমা নামিয়ে বলছেন ‘এঃ এর তো স্বরভঙ্গ, হচ্ছে না হচ্ছে না, গলা এত চিরে গেলে চলে?’ ফলে ‘নাও আবার’ বলার পর ফের শুরুর আগে সে পিছিয়ে আসছে, বাকিরা ভিড় করুক হারমোনিয়ামের সামনে। বরং আরেকবার যখন সবাই মিলে ‘শৃঙ্খলে বারবার ঝন্ ঝন্ ঝঙ্কার’ বলে গমগম করে উঠছে, সেও গলা তুলছে দলে মিশে। সে মোটেই পছন্দ করেনি গানের দলে তার অক্ষমতাকে চিহ্নিত করে সকলের সামনে এমন তুচ্ছু করা, তার রাগ হয়েছে, হতে হতেই সে শিখে নিচ্ছে এর উত্তরে মুখে কিছু বলার দরকার হয় না সবসময়, এই তো কেউ একজন পথ করে রেখেছেন তার জন্য ‘নয় এ তো তরণীর ক্রন্দন শঙ্কার’ বলে বুকে বল ফিরে পাবার। পিয়াবিনা নিখুঁত করতেই হবে কেন তাকে? ‘বন্ধন দুর্বার সহ্য না হয় আর’ সহ্য না হয়। ততদিনে অবশ্য সে এও দেখেছে ‘ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর’ অথবা ‘এসো করো স্নান নবধারাজলে’ বলে গান আরম্ভ হবে যেই আর সবুজ শাড়ি হলুদ ওড়না উঁচু ক্লাসের মেয়েরা পাক খেয়ে বিচিত্র মুদ্রায় ঊর্ধ্বমুখী করবে হাত, তখনই প্রত্যেকবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে তাদের বহুমুখী রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের মাঠে, নামবেই। ব্যত্যয় নেই কোনওবছর এ নিয়মের। তখন সম্পূর্ণ হবে বনমহোৎসব।

‘আমার বনে কদম ফুটে ওঠে’

‘কৈশোরক’ অবশ্য বৈধ পথেই এসেছিল এরকম সময়ে, তবে বৈধে আর রহস্য কী। রহস্য কথাটি সেসময় প্রায়শঃ ফিরত দেশভাগ উৎখাত বাঙাল পরিবারে, এত লোডশেডিংয়ের কী রহইস্য, খাইয়ালইয়াও পোলাপানগুলির দ্যাহ ঠিক হয় না ক্যান সেই রহইস্য, ঢাকা বিক্রমপুর বরিশাল উৎসের বধূগুলির আলাপের মধ্যে পাড়াপড়শির ক্বচিৎ মিঠে শান্তিপুরের তেমন নম্বর ছিল না আটের দশকের সেই শেষদিকেও, সিংহভাগ কলোনি অঞ্চলে। কৈশোরক নম্বর না খোয়ালেও ততদিনে ডিঙি মেরে পোলাপানের হাতের নাগালের বাইরের তাক থেকে যেহেতু পাড়া হয়ে গিয়েছে ‘চারু পদশব্দে বুঝিল অমল তাহার ঘরের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল — একবারও থামিল না’ অথবা ‘অমিত বললে “অক্সিজেন একভাবে বয় হাওয়ায় অদৃশ্য থেকে, সে না হলে প্রাণ বাঁচে না ; আবার অক্সিজেন আর-এক ভাবে কয়লার সঙ্গে যোগে জ্বলতে থাকে, সেই আগুন জীবনের নানা কাজে দরকার–দুটোর কোনওটাকেই বাদ দেওয়া চলে না। এখন বুঝতে পেরেছ?”…’ — সেহেতু পিছিয়েছে খানিক তো বটেই, আর রুদ্ধ উত্তেজনার টানাপোড়েনে অন্ধ সে শুনতে পাচ্ছে দূরাগত রুষ্ট মাতৃস্বর, মাস্টার বাপটি তাতে ঠেকা দিচ্ছেন ‘আহা ছেলেমানুষ, যা পড়তে চায় পড়ুক’। অথচ সে জানে সে ছেলেমানুষ নয় আর তত, ‘বড়দের বই’ বলে এই কবির উপন্যাসসমগ্র পড়তে বাধা দেবার পথ ধরে মা কি ক্রমশ চিরসুদূর হয়ে যাচ্ছেন তার কাছে?
তার চারিদিকে এইসময় অমেয় নব্বই। চিত্রহার, ক্যাম্পাকোলা, নীল রঙের কাঠের এস টি ডি বুথ। কোচিংফেরত আর্চিস গ্যালারির সামনে বন্ধুরা মাঝে মাঝে নেমে যায় বিকেলবেলায়। লাল তুলোর পুতুল আর পুজোর নতুন বিশুদ্ধ ধারা বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে এক অমোঘ নতুন সহস্রাব্দ, অজানাও, এগিয়ে আসছে তার দিকে। সেই কি তার প্রথম দ্যাখাশোনা ঘটছে? অষ্টমীপুজোর বেজুত শাড়ি আর সুরেলা সব দুপুরে তার মনখারাপ হচ্ছে কেন উড়ে আসা চিরকুটগুলির মধ্যে একজনও কেউ ইংরেজি প্রেমবাক্যের বদলে লিখে দিল না ‘কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি’! আশ্বিনে শারদপ্রাতে বেজে উঠছে আলোকমঞ্জীর আর তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিওর বড় বড় নব ঘুরিয়ে সারাবছরই সে টিউনিং করছে ‘শিল্পী : সুচিত্রা মিত্র’। ‘এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমালবনে’ শুনতে শুনতে সে শিখে নিচ্ছে এমন করে ছাড়া আষাঢ় বলা যায় না, এমন করে ছাড়া আষাঢ় লেখা অর্থহীন…আর সতর্ক হয়ে যাচ্ছে বাকি জীবনের মতো। জুলাই অগাস্ট জুড়ে ধ্বমধ্বম কণ্ঠে সুচিত্রা গাইছেন ‘তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা’, সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারছে ঠিক এইখানে এই বজ্রমানিকটি না থাকলে আকাশজোড়া উথালপাথালের সঙ্গে একত্র হতে হতে কী উল্লাসে ছাদ থেকে শুকনো কাপড়চোপড় নামিয়ে আনার সঘন আনন্দ জন্মাত না একেকদিন বিকেলে। শীত পড়েনি তখনও, কালীপুজো হয়ে গিয়েছে, এমন একেকটি আসন্ন সন্ধ্যায় দেবব্রত বিশ্বাস গাইছেন ‘ওগো প্রাণেমনে আমি যে তাহার পরশ পাবার পিয়াসী’ আর সমস্তই ঠিকঠাক চলছে, রান্নাঘরে সবে জ্বলেছে ষাট পাওয়ারের হলুদরং বাতি, বসার ঘরে চালু হল সন্ধের খবর অথচ কী এক বিপুল বেদনাবাঁশরি অকস্মাৎ দিক আচ্ছন্ন করে বেজে উঠছে তখন। সেই ব্যাকুল বেদনার মধ্য দিয়েই সেবছর সেই প্রথম হেমন্তকাল তার সুবৃহৎ ডানাদুটি মেলে দিয়ে নেমে এল পাড়াঘরে।
নাকি তারও পরে, খুব বেশি পরেও নয় অবশ্য, এমনই এক সন্ধেবেলা সারাদিন পর স্বজনপরিবারের ভিড় থেকে কিছুটা রেহাই পেয়ে যখন সে দোতলার সরু বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখবে একটি যাত্রা, ধূপগন্ধ, ফুলগন্ধ, সে তত কাছে যেতে চায়ওনি, অথচ নীচে কারও কারও মাথা সরে গেলে একটি মুখ, যদিও ঘন চুল মুড়োনো তখন, কপালে দুর্ঘটনাজনিত তদন্তের এফোঁড় ওফোঁড় সেলাই, যখন তার মনে হবে রেকর্ডগুলি কীভাবে গ্রামাফোনের যন্ত্রে বসাতে হয় দেখে নেওয়া হয়নি ঠিকমতো, কাল ফিরলে বলবার কথা ছিল পরের সোমবার স্কুল থেকে ব্যান্ডেল চার্চ, অনুমতির চিঠি চাই, দিতেই হবে, সে যাবেই, এ বছর গরমের ছুটির গল্পের বইয়ের তালিকা বানানো শুরুই তো হল সবে, আর এ তো সবেমাত্র হিম ফেব্রুয়ারি, বাড়িতে না থাকলে খাটের নীচে রাখা হাওয়াই চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে সে টেনে টেনে হাঁটে, ক্ষয়ে যাওয়া গোড়ালি, নীল ঢিলে ব্যান্ড, এখন তো যে কোনও সময়েই — খাতার বাণ্ডিল ইতিউতি, পাঞ্জাবির পকেট, সে কি তবে এবার থেকে সম্পূর্ণ বন্ধনহীন, অঙ্কের টাস্কহীন, দেরি করে খেলে ফিরলে ‘আসুক বলছি’ সংলাপহীন? সেই নিরালম্ব একক মুহূর্তে, সেই অতলান্ত এক সময়বিবরে মাথা নামিয়ে ডুবে যেতে যেতে সেই কি ফের প্রকৃত প্রথম সাক্ষাৎটি ঘটছে তার ভীমপলশ্রীতে — ‘আকুল চঞ্চল নাচে সংসারে, কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ’…?

জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি

সে পৃথক হয়নি আর। উপায় ছিল না। এ সেই অসংখ্য গানের কথা নয়, কবিতার কথা, গল্পগুচ্ছ উপন্যাসসমগ্রের কথা, অচিন্ত্য সব চিঠি, দিনলিপি কিংবা প্রবন্ধগুলির কথা নয়, গান্ধী আইনস্টাইন রলাঁও নয়, ‘তখন স্মরিতে যদি হয় মন’ সভাও নয় তেমন কোনও, শুধু যারা খোয়াইয়ের টোটো, কোপাইতে ফোনক্যামেরা, যারা তবু ঘরে ফিরে একটি মলিন গীতবিতান, একটি ছবির ধুলো ঝেড়ে উত্তরপ্রজন্মকে প্রণামের নির্দেশ, যারা ভুল উচ্চারণে বাধ্যতামূলক আবৃত্তি, ভুল সুর সত্ত্বেও গান, যারা গুণীজনের সম্ভবত ন্যায্য সমস্ত উপহাস বিদ্রূপ উপেক্ষা করে বৎসরান্তে একটি দুটি দিন পাড়ার স্টেজ, বাটিকছাপ, ঘাড়ে পাউডার, রজনীগন্ধার মালায় প্রাণপণ উদযাপন, যারা বৈশাখ এলে ভুল উদ্ধৃতিতে ইনবক্সে ইনবক্সে লহ প্রণাম কেবলই, যাদের কেউ কখনও শিখিয়ে দেয়নি কিন্তু বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহুদূরে যারা নিজেরাই আভাসে বা অনুমানে আবছায়া জেনেছে এঁর থেকে বিচ্যুত হওয়া চলে না বেঁচে থাকতে গেলে, এঁর থেকে দূরে গেলে তা সুন্দর থেকে বিচ্যুত হওয়া আসলে, মা-ভাষা থেকেই বিচ্যুত হওয়া একরকম, তাদের মতো করে, তাদের একজন হিসেবেই সে-ও পৃথক হয়নি কোনওদিন আর। উপায় ছিল না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে পড়া সেই চরিত্রটির মতো, ছবির নীচে ধূপদীপ জ্বেলে মনে মনে যে বলত রক্ষা কোরো, মনে মনে যে জানত ঈশ্বর যেমন, বিপদেআপদে ‘ঠাকুর’ তেমনই রক্ষা করবেন, তার মতোই, তারও একটি তর্কাতীত বাঙালি প্রণতি কেবল, অমোচনীয়।
সে এই প্রণতিতে থেকেছে আজীবন, সে প্রবল চিত্তবিক্ষেপে আছড়ে ভেঙেছেও দেয়ালের ছবি, বন্ধুর সঙ্গে মুঠোফোনের এপার থেকে খেলেছে প্রমাণ চাইবার মধুর খেলা — ‘দেখি কেমন সামনে সঞ্চয়িতা, বলো “কথার কখনো ঘটেনি অভাব/ যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব/ একবার ওগো বাক্য-নবাব/ চল দেখি কথা শুনে”, কোন কবিতা!’ আর প্রায় একশোত্রিশ বছর আগে শাহজাদপুরে বসে লেখা এ কবিতার ছদ্মবেশে নিজের বলবার কথাটি নিজের চেয়ে একশোত্রিশগুণ ভাল করে বলে ফেলতে পেরে নিজেই হেসেছে খুব। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় লিখতে গিয়ে রক্তকরবীর পাঠান্তরের হিসেব গুলিয়ে ফেলেছে নন্দিন ডাকটি মনে করে, স্টেশনবাজারে মাছ কাটার বঁটির সামনে ফাল্গুনসন্ধ্যায় সহসা দেখেছে আঁটো শাড়ির ‘বাবু ডেকেছিস ক্যানে’ খিলখিল। সে নিজেই জানে না এ সব কেন চিরদিন চারপাশে ঘটেছে তার, যেমন অনেকেরই ঘটে। শুধু আরও অনেকদিন পরে, অরুণ আলোর তরুণ দিনগুলি ক্রমশ মিলিয়ে এলে আরেক নতুন বালিকা ইশকুলের ভরা ক্লাশঘরে যখন একেকটি পিরিয়ডে কোণের দিকের মহাচঞ্চল মেয়েকটিও ক্রমশ ফিশফিশ থামিয়ে চুপ করে যায়, পরে সহসাই জানতে চায় ‘বীরের সদগতি কী ম্যাম? রাজ্যলোভেও ছাড়া যাবে না, কেন?’, তখন দিদিমণি বলেন — ‘বোঝা একটু কঠিন, আয় বরং আরেকবার পড়ি, তারপর ফের, দেখি কোনও একসময় একটু হলেও ঠিক বোঝা যায় যদি।’
সে জানে, বাঙালি নিজের কথা ভাষা দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারে না সবসময় ঠিকমতো, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে পারে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes