
যেভাবে আঁকড়ে থাকি
সুদেষ্ণা মৈত্র
আমার মতো জীবনানন্দ-আক্রান্ত জীবনে জানি না কীভাবে তোমায় জায়গা দিই। কীভাবে ভাত বেড়ে দিই, কীভাবে দিই শুকনো হাওয়ার আরাম। দিতে হবে না বলে যেই না উঠে গেলে তখনই যেন বুকের ভেতর বেজে উঠলো –“ বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে”। এই বঞ্চনা, এই ফিরে আসা আর যাইহোক, প্রবঞ্চনা নয়। তোমার যোগ্য হয়ে উঠি, তখন না’হয় কথা বলবো তোমায় নিয়ে। আজ আমি আমার কথা বলি। কেন বাজাও এভাবে? ইটের পর ইট সাজিয়ে এই যে গড়ে ওঠা, আত্মতৃপ্তি, শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার, সব ঝরে পড়ে যায় ওই “ বাঁচালে মোরে” শুনে। সব লোভ, সব দম্ভ ঝরাপাতা, ঝরাপাতা। আমার এই বিপন্ন বিস্ময়ময় জীবনে তোমায় খুঁজিনি কখনো, খুঁজবো না কখনো। কিন্তু যখন কাঁদবো, ভীষণ ভীষণ হতাশা ঘিরে ধরবে মন থেকে শরীরেও, ঠিক তখন যদি গেয়ে উঠি “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু”, তুমি নিশ্চয়ই নিচুমুখ হাসিটা হাসবে? সে হাসতেই পারো। প্রভুর কাছে এই আকুতি আসলে যে নিজেকেই বোঝানো, নাকি আমারও এক জীবনদেবী আছে? মিলে যাচ্ছি কেন? অথচ কী ভীষণ মুখ ফেরানো। যেন শুধু তত্ত্ব তুমি। যেন শুধু তথ্য তুমি। সিলেবাসের সেই ‘অবধারিত’ তুমি। তাহলে এই যে জীবনের চলাচল, যা কিছু কামড়ে ধরে, পিছনে টানে, শাসিয়ে যায়, হারিয়ে দেয়, তারপর মুচকি হাসে অতীত তখন যেন তোমার কথা কানে এসে মন্ত্রশুদ্ধি ঘটায়-“ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে”। ফিরে আসি নিজের সত্তায়। আমার জানতে ইচ্ছে নেই ‘পূজা’ পর্যায়ের এই গান ঠিক কোন সময় বাজাতে হয়। যারা তোমাকে নিজের আভিজাত্যের নিদর্শন ভেবে গলা চেপে ধরতে আসে তাদের আমি ঘৃণাই করি। শুধু অবাক হয়ে যাই কী করে দুটো লাইন সমগ্র জীবনকে আবার সাজিয়ে তুলতে পারে! আমরা যারা মনে মনে কতবার দড়ি হাতে অশ্বত্থের ডালের কাছে গিয়েছি কতবার, অথচ যারা সুপক্ক যবের নিবিড় ঘ্রাণ নিতে অক্ষম, তারা আজও এখনো এইসব লাইনের কাছে মাথা নত করে বাঁচি। আমরা যারা ‘এদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না’ শুনতে শুনতে মাঝবয়সের দিকে এগনো জীবন, যারা পথের শৈবালদামকেই একসময় আন্তরিক ভেবে ভুল করে, ভুল করে আর তারপর ছাড়িয়ে আসার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, তখন তুমি বুকের ভেতর ঢুকে টুক করে সত্যিকথাগুলো খুলে নাও- “জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই, ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে”। হ্যাঁ, তুমি আমায় এভাবে বাজাও রবীন্দ্রনাথ। আমার মতো তুচ্ছ, তৃণসম মানুষটিকে শেখাও কীভাবে প্রভুকে সমান হতে হয় ভক্তের সঙ্গে। কীভাবে ঈশ্বর নামক অস্ফুট ফুলটিকে ফোটাতে হয় কাঁধে হাত রেখে বন্ধুত্বের মতো – “ তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছো নিচে/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার, প্রেম হতো যে মিছে”।
ভালো থেকো তুমি। দর্শনভীরু এই আমি তোমার এই চমকে দেওয়া দেখাগুলোর ভিতর যখন নিজেকে বসাই, তখন গলা বুজে আসে। কী যে বলতে চাই, কাকে বলতে চাই, নেই কেউ। পরে মনে হয় নিজের সাথে কথা বলতে বলতে যে আয়না তৈরি করে দিয়েছে জীবনানন্দ, সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তোমায় আওড়াই।