ধারাবাহিক উপন্যাস <br /> মনে রবে কিনা রবে  <br /> মোনালিসা ঘোষ

ধারাবাহিক উপন্যাস
মনে রবে কিনা রবে
মোনালিসা ঘোষ

এক

এ জন্মে পাপ নেই আমার, বলল ও। পূর্বজন্মের পাপের খেসারত দিতেই এই জন্ম। এমনি একটা অনুভুতি ওর মনে মনে ঘুলঘুলিয়ে ওঠার জন্য; সত্যিই এই জন্মে পাপ আছে কি নেই, তার একটা হিসেবনিকেশ করার বাসনা হল তার। কিন্ত মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের যে শব্দটা একটানা ওঁ ওঁ করে সেটাকে অনুসরণ করে সে একটা গোলকধাঁধার মত রাস্তায় ঢুকে পড়ল । রাস্তাটায় পাক খেতে খেতে তার চোখের সামনে ফুটে উঠল কত কিছু । যা যা দেখার সব কিছু দেখে ফেলার পর নিজের যদিও তার আচ্ছন্ন ও বিবশ মনে হবে, কিন্ত এই মুহূর্তে সে দেখছিল নানারকমের ঠাকুরের ছবি গাদাগাদি করে রাখা শোবার ঘরের কোণের একটা জায়গায়। আর সে সম্পর্কে মুগ্ধ হয়ে নানারকম বকবক করে যাচ্ছিল লিপির মৃত স্বামীর মা অর্থাৎ লিপির শাশুড়ি –মা । শাশুড়ি – মা- র মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসা কথাগুলোর মধ্যে সে শুনতে পাচ্ছিল লিপির এই পুজা- পুজোআচ্ছার বহর যে দিন দিন বেড়ে উঠেছে মহা সমারোহে এবং তাতে তিনি উচ্ছ্বসিত। লিপির জীবনযাত্রা সম্পর্কে সে যা জানত তার সঙ্গে এটা মিলছিল না। অতএব মনের মধ্যে কথাগুলোর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে ভাবল, তাই নাকি? তবে কি লিপির ভেতরে গজিয়ে উঠেছে নানাবিধ ইনসিকিওরিটি? হবে হয়ত বা। শাশুড়ি- মা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন, যদিও লিপির ব্যাপারেই। লিপি তাড়াহুড়ো করে তৈরি হছিল । গোলাপী রঙের সিল্কর মটকা পরে এবং তারপর সে এসে বলল, তোমরা তাহলে কথাবার্তা বল, আমি অফিস ঘুরে তোমাদের নিয়ে ইন্দ্রনাথের কাছে যাব। অবিশ্বাস্য ছিল কথাগুলো।
সে যদিও জানত লিপি তাকে জাত- শত্রু মনে করে। তবে তার হাতে নিজের শাশুড়ি –মাকে রেখে যাবার কারণ কি? এটাও তো হতে পারে, যে সে খানিক ভালমন্দ কথা লিপির ব্যাপারে তার শাশুড়িমাকে বলে ফেলতে পারে। ফলে, তার ধারনা হল লিপি হয়ত তার চেনাশুনা বিভিন্ন ধরণের মানুষদের সঙ্গে শাশুড়ি মায়ের আলাপ করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর তারা ইন্দ্রনাথের অফিসের মধ্যে একটা ছোট বসার ঘরে হাজির হল। তখন লিপির অফিসের দু একটা যা কাজ ছিল তা হয়ে গেছিল।অফিসে ইন্দ্রনাথও ছিল।কিছুক্ষণ কিসব যেন কথা হল। শাশুড়ি মায়ের কোন হেলদোল ছিল না, তার মৃত ছেলের জায়গা ইন্দ্রনাথ নিয়েছে বলে, সে দেখল। বরং উনি একটু আড়ষ্ট এবং লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে ইন্দ্রনাথ টুকটাক নিরীক্ষণ করছিলেন। কথাবার্তাগুলো তেমন জরুরী ছিল না। এমনিই কথা চালিয়ে যাবার জন্য বলা হছিল। বরং ইন্দ্রনাথ বেশী কথা বলছিল তার সঙ্গেই। কথা বলতে বলতে লিপি গিয়ে ইন্দ্রনাথের গা ঘেঁষে সোফাটায় বসে পড়ল। ইন্দ্রনাথ লিপিকে বলল, গা হাত পা ব্যথা করছে, হাতটা টেপো তো । লিপি ইন্দ্রনাথের হাত টিপতে শুরু করল। টিপতে টিপতে ইন্দ্রনাথ পুরো হাতটাই তুলে দিল লিপির কাঁধের ওপর। হাতটা শক্ত করে রাখার জন্য লিপির কাঁধটা খামচে ধরল ইন্দ্রনাথ। এবং কিছুক্ষণ মধেই কাঁধ থেকে লিপির ব্লাউজ নামিয়ে সেখানটায় ধরে রইল ইন্দ্রনাথ।লিপির শাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ম্যাসেজ করার জন্য এবং লিপি হাত ছেড়ে ইন্দ্রনাথের বডি ম্যাসাজ করতে আরম্ভ করেছিল।লিপি বলল, দাঁড়াও হচ্ছে না, তোমাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিই।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোফার হাতলে ঠেসান দিয়ে বডি ম্যাসাজ করতে লাগল লিপি। ইন্দ্রনাথ শাড়ির তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে থাইটা ধরে সাপোর্ট দিল। সাপোর্ট দিতে দিতে ইন্দ্রনাথ লিপিকে দেবযানীর সঙ্গে কারুর শারীরিক সম্পর্কের বর্ণনা দিতে লাগল মৃদু গলায়।
সে তটস্থ হয়ে উঠেছিল এবং ভাবছিল শাশুড়ি- মা কি ভাবছেন, এসব কি হচ্ছে ?কিন্ত শাশুড়ি- মা একদম নির্বিকার ছিলেন! ইন্দ্রনাথ তার অবস্থা বুঝে লিপিকে ছেড়ে দিয়ে জামা-কাপড় টেনেটুনে তাকে বলল ,এস, তোমাকে সুড়সুড়ি দিয়ে দিই। বলতেই সে দেখল, পাশের ডিভানটার ওপরে সে ইন্দ্রনাথের শরীরের ওপরে সমান্তরালভাবে ভাসছে। এটা আচমকা কিকরে ঘটল, ভেবেই পেল না সে । ইন্দ্রনাথের দুটো- পা- এর ওপর সার্কাসের খেলার মত ঘটছে ঘটনাটা .হঠাৎ ক্রোধে তার নিজেকে উন্মাদ মনে হল।উন্মত্তের মত তার ইচ্ছে করল, এই অবস্থায় সে ইন্দ্রনাথের শরীর নখ দিয়ে ফালা ফালা করে । অস্থির অস্থির করেছিল তার শরীর মন, মাথা। ঠিক কিভাবে সঠিক পদ্ধতিতে ঘায়েল করা যায় ইন্দ্রনাথকে সে ভেবে পাচ্ছিল না। লিপি পেছন ফিরে নির্বিকার বসে আছে। ডিভানটার ওপরেই। সে যদি ক্রোধে পাগল হয়ে যায়, তাহলে তার মনে হল লিপি হাসবে। লিপির কাছে সে হেরে যাবে। এমন কি করলে তার হারা হবে না, অথচ এটা বোঝানো যাবে যে, তার যথেষ্ট রাগ ধরছে। তার সঙ্গে রয়েছে তীব্র বিরক্ত। ইন্দ্রনাথ অপমানিত হোক আর তার সঙ্গে লজ্জিতও। এমনটাই চাইছিল সে। অথচ ইন্দ্রনাথ এমন এক ধাতুতে গড়া ছিল, সম্ভবতঃ তাকে লজ্জা দিতে পারে, এমন মানুষ তখনও পর্যন্ত জন্মায়ইনি পৃথিবীতে।
এইরকম একটা উৎকট স্বপ্ন যখন ভাঙল, তখন মুক্তি পাবারই কথা।ওহ্ , তারমানে আগাগোড়াটাই স্বপ্ন ছিল একটা ।চিটেগুড়ে পড়লে পিঁপড়ে , আর নড়তে চড়তে পারবে না টাইপের স্বপ্ন । কিন্তু মুক্তি পাবার বদলে সে লক্ষ্য করল, তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অস্বস্তিকার ঘিনঘিনে একটা কামবোধ। সেই কামবোধ এমন যে তাকে না গিলতে পারা যাচ্ছে না যাচ্ছে ফেলতে।
বোঝাই যাচ্ছে, ইন্দ্রনাথ তাকে ছাড়বে না।স্বপ্নটাই তার প্রমাণ। ইন্দ্রনাথ সম্পর্কটাকে নারকোলের দড়ির আগায় জ্বলতে থাকা, একটুখানি আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বালিয়ে রাখবে আর অনেকবারই নিবু নিবু হবে তা। আর তার বারবারই মনে হবে, এরচেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার হয়ে গেলে বাঁচা যায়। কিন্ত ইন্দ্রনাথের দৌলতে তা তো হবার নয়। ইন্দ্রনাথ ভালবাসবে, তবে শুধু নিজের সুবিধে মত ভালবাসবে।ব্যাপারটা একতরফা।

কে জানে, লিপির সঙ্গেও ইন্দ্রনাথ এরকম কিনা। এক সঙ্গে দুজনকে ভালবাসার হ্যাপা আছে। আগেকার দিনের রাজা-রাজড়ার মেজাজের মতন। একাধিকজনকে ভালবাসলে যে গোটা বৃন্দাবনের গোপীকূলকে নিয়ে রাসলীলায় মও হবে, মধ্যে রাধা! এসব সামলাতে ইন্দ্রনাথের মত ধুরন্ধরেরও নাকের জলে চোখের জলের অবস্থা হয়।তবে কিনা, ইন্দ্রনাথ তো ইন্দ্রনাথই। স্বয়ং শিবের বাবারও অসাধ্যি ইন্দ্রনাথকে জন্মের মত হাবুডুবু খাওয়ায়।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার কখন ঘুম এসে গেছিল কে জানে?এই জায়গাটায় রাতে মনের সুখে ঘুমোবার জো নেই। এক ইঁদুরের উপদ্রবে সারারাত জ্বালাতন পোড়াতন হতে হয়। আলো নিভে গেলেই সে তার কাজকম্ম শুরু করে। বাড়িটার কাঠের মেঝের তলায় ফাঁকা জায়গাগুলোর মধ্যে ঢুকে কাঠ কাটতে থাকে। ফলে খুড়ুর খুড়ুর করে আওয়াজ হয় রাতভোর। যেন রদ্যা চালাচ্ছে। ভারী বিচ্ছিরি ব্যাপার।
ইঁদুরটার কথা ভাবলে ওর গা চিড়বিড়ই করে। প্রথমতঃ মনে হয়, ইঁদুরটার গায়ে নিশ্চয় ভীষণ গন্ধ, তারপর ইঁদুরটার ওমনিধারা স্বভাব আর তার ওপর ওর এই ইঁদুর সুলভ চেহারাখানা । ব্যাপারটা ওর খুব অপছন্দের।গা ঘিনঘিনের।
রাতটা কেটে যাবার পর এই জায়গাটায় সুন্দর ভোর হয়। পাহাড়ের খাঁজ থেকে জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে ডিম ফুটে বেরোনোর মত সূর্যটাউঠে পড়ে।তখন সূর্যটাকে গপ করে খেতে ইচ্ছে করে।
কখনও কখনও ও সারাদিন এদিন পানে ওদিক পানে ঘুরে বেড়ায়। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেয়। এই পাহাড়ের দেশে রান্নাঘরটাকে দেখলেও পাহাড়ী-পাহাড়ী মনে হয়। মেটে রঙের দেওয়াল। তাকগুলো সব মোটা খোবড়ালো কাঠের। শক্ত গুঁড়ির গাছের কাঠ ছিল সেগুলো এককালে। তাই এখনও ওমন শক্তপোক্ত । তাকগুলোকে দেখলে ওর মনে হয় খুব পুরুষালি অথচ মানবিক ?? দুটো কি বিপরীত ধর্মীগুণ যে একটা থাকলে আর একটা থাকবে না ? পুরুষরা কি কম মানবিক ? না, তা কেন হবে? তবে এই ইন্দ্রনাথকে দেখে দেখে পুরুষ বিষয়ক বোধবুদ্ধিগুলো ওর কেমন যেন ঘুলিয়ে গেছে। এই জায়গাটার কি যেন নাম।মাঝেমাঝেই দেবেন্দ্র এসে ওকে মনে করিয়ে দেয় বটে, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আবার তা ভুলে যায় । কি যেন এক মহা বিস্মৃতির গুহার মধ্যে ঢুকে গেছে ও।এখানকার প্রকৃতির মতই অনেকটা। প্রকৃতি কি বিস্মৃত হয়? এই পাহাড়, জঙ্গল,চড়াই-উৎরাই ভরা রাস্তা, লম্বা লম্বা মহাসমারোহে অটল ব্যক্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো , আকাশে মেঘের রং বদল , এরা কি স্মৃতিহীন ? কিন্ত গাছের গায়ে হাত রাখলে গাছ ওকে চিনতে পারে যে ! যে রাস্তা মাড়িয়ে ও চলে যায়, রাস্তারা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায় । আবার ফিরে এলে চেনা দেয়। এরা নির্বাক ভঙ্গিতে মানুষের থেকেও বেশী কাছাকাছি থাকে। মানুষের থেকে ওর বেশী কাছাকাছি পশু- পাখিরাও থাকে। অবশ্যই সংবেদনশীলতা প্রকৃতি, পশুপাখি এবং বস্তুখন্ডদের মত নির্বাক প্রানী ও অপ্রাণীদের বেশি মানুষদের থেকে, একথাটায় নিজের মনেই বারবার সায় দিল ও । এই যে কাঠের রেলিংটার ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ও, রেলিংটাকে ও চেনে, রেলিংটাও ওকে চেনে। বেশ টের পাওয়া যায় সেটা। এই টের পাওয়া পাওয়ি নিয়েই আজকাল ওর দিনগুলো কাটে ।
যাইহোক ঘোরানো যে কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে ও নীচের বাগানটার নেমে দাঁড়ায়, সেই কাঠের সিঁড়িটার ওপর ও মাঝে মাঝে বসে থাকে। কাঠের সিঁড়িটা তখন ওর সঙ্গে কথা বলে। নেহাত খুব পোকামাকড়ের উপদ্রব না থাকলে সিঁড়িটার ওপর ও বিরক্ত হয় না কখনও। এটা অবশ্য একটা ব্যাপার যে, এই পৃথিবীর যাবতীয় পোকামাকড়, কাদা এবং গোবর, রক্ত এবং পুঁজ, শ্লেষ্মা এসব কিছুই ওর ভয়ঙ্কর রকমের অপছন্দের এমনকি শুকনো ধুলো এবং কিচকিচে বালির ব্যাপারেও আপত্তি আছে। এই পৃথিবীটা ছবির মত সুন্দর ও পরিষ্কার আবর্জনাহীন হলে ওর পক্ষে ভীষণ সুবিধেজনক হত। কিন্ত পৃথিবী ভর্তি করে এইসব বিরক্তিকর জিনিস বহাল তবিয়তে থাকলেও পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগস্থাপন করতে ওর তেমন কোন আসুবিধে হয় না। বরং মহাপ্রকৃতিতে ভাল আর মন্দের সহাবস্থান সে উপভোগই করে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন নোংরা- পাংরাগুলো সরাসরি গায়ে এসে পড়ে। নোংরা, ময়লা, ধুলো, কাদা এদেরও নিশ্চয় একধরণের ভাষা আছে, কিন্ত এদের সঙ্গে বৈরীতার দরুণ তাদের ভাষাটা ও রপ্ত করে উঠতে পারেনি। আজকাল তাই কিছুটা সময় যায় নোংরা তাড়াতে। আর বেশীরভাগ সময়ই কাটে প্রকৃতির সঙ্গে কথপোকথনে।
প্রকৃতিও সম্ভবতঃ ওর মতো স্মৃতিহীনতায় ভোগে। আবার ভোগেও না।সম্ভবত প্রকৃতি ওরই মতো তাৎক্ষণিক স্মৃতির অধিকারী। অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি প্রকৃতি মুছে ফেলে। যখন ও এবং প্রকৃতি দুজনে দুজনের মুখামুখি দাঁড়ায়। তখন টের পায় ওদের মধ্যে ভালবাসা আছে। তবে কিনা, সেই ভালবাসাটা শুধু সেই মুহূর্তের। ভালবাসাটার মধ্যে আর যাই থাক, পিছুটান নেই কোনো। যেকোনো মুহূর্তে প্রকৃতি ওর দিক থেকে চরম নিস্পৃহ হয়ে যেতে পারে,নিস্পৃহ হয়ে যেতে পারে ও-ও। এইরকম চরম উদাসীনতা ও নিস্পৃহতা আবার একই সঙ্গে গভীর সংবেদনশীলতা নিয়ে ওদের মধ্যের যে ভালবাসা তা ওকে সুখ দেয় খুব, কিন্তু শান্তি দিতে পারেনি এখনও।
স্বস্তি দিতে পারেনি ইন্দ্রনাথও। ইন্দ্রনাথ অর্থাৎ যে লোকটি প্রায়ই ওর স্বপ্নে আসে। হয়তবা বাস্তবেও । তবে সে সব ঠিক মতন মনে পড়ে না। বরং মনে করতে গিয়ে সব কিছুই অলীক বিভ্রম বলে মনে হয় ওর। ওর তাৎক্ষণিক স্মৃতিই বোধহয় এর জন্য দায়ী। তবে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি কিনা জানা নেই। আর ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ওর এত রকমই ঘটনা ঘটে এবং ঘটেছে তাই নিয়ে ভেবে ভেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। ঘটনাগুলো বিস্মৃতির অতল থেকে ভেসে মনের মধ্যে জেগে ওঠে। অবশ্য যদি ইন্দ্রনাথের বিষয়ও ওকে নিস্পৃহতা গ্রাস করে তাহলে আলাদা কথা। কখনও কখনও ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ওর সমস্ত হিসাবনিকেশ পাল্টে গিয়ে সম্পর্কটা চরম সুখের হয়ে ওঠে। তখন ওর অথবা ইন্দ্রনাথের কারুরই কোন অতীত থাকে না, ভবিষ্যতও তেমনি থাকে , তা মনে হয় না। এই ভাবে মহাসুখে সারাক্ষণ বর্তমানে বিরাজ করা ওর অথবা ইন্দ্রনাথের কারুর পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ইন্দ্রনাথের অতীত এবং লিপি ও হিঁচড়ে টেনে বার করেছে। আর ওর নিজের মনের ভেতর গুমড়ে থাকা চাহিদাগুলোও ওর নিজের চোখের সামনে আছড়ে এসে পড়েছে। দোষটা ওরই, অন্তত এমনটাই মনে হয় ওর। ইন্দ্রনাথ যতই পাঁচমিশালী মানুষ হোক, তার সমস্যাটা তারই। ইন্দ্রনাথের সমস্যা নিয়ে ও ব্যতিব্যস্ত হলে সমস্যাটা আর ইন্দ্রনাথের থাকে না, ওর হয়ে যায়। নিজের সমস্যা নিয়ে ও বরাবরই নির্মম। ক্ষমা নেই সেখানে।

যেমন একদিন রাত বারোটার সময় ইন্দ্রনাথের ফোন এল। সে সময়টাতে শব্দগুলো সব কমে এসে থম ধরেছিল অন্ধকারে। নিঝুম হয়ে গেছিল জানলা-দরজা, দোকান-পাট, শহর। ঘরের মধ্যে কুপকুপে অন্ধকারে বসেছিল ও আর অন্ধকার কাটিয়ে পরিত্রাহী চিৎকার করছিল ইন্দ্রনাথ। আওয়াজ করে নয়, হৃদয় ফুঁড়ে।
তিরিশ সেকেন্ড, মাত্র তিরিশ সেকেন্ড থাকতাম তোমার সামনে। একবার দেখতাম তোমায়।
কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল ও। অবিশ্বাস!! ভারী পর্দাটানা ঘরের ভেতরকার ঘোর অন্ধকার ঘিরে রেখেছিল ওকে, যার মধ্যে মিশেছিল জমাট বাঁধা অবিশ্বাসের টুকরো। এইরকম গাঢ় অবিশ্বাসের রঙ সাপের বিষের মত হয়। আর তার মধ্যে মিশে থাকে ভয় আর নিরাপত্তাহীণতা । ইন্দ্রনাথ ফিরে গেছিল। অতএব। ফিরে যেতে যেতে বলে গেছিল, আজ এইদিনে আমার বাবার অস্থি আমি ভাসিয়ে দিয়েছিলাম জলে। কেন আসতে দিলে না? কি করতাম তোমার? তখন ওর মনে হয়েছিল, আসতে দিলেই তো হত ! সত্যি কি আর করত সে !

এইরকম বিবিধ দোলাচলে ভোঁ ভোঁ করে ওর দিনগুলো। একরকমভাবে কেটে যায়। এসব সময় ওর আর ইন্দ্রনাথের মধ্যের সম্পর্কের হিসেব-নিকেশগুলো বদলে ফেলে ও নিজেই কখনও কখনও। তখন আদান ও প্রদান দুটো ব্যাপারকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অন্তত এমনটাই ধারণা হয় ওর। তত্ত্বগতভাবে এইরকম একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।যদিও এইধরণের সম্পর্কে ও এখনও ততটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বললেই চলে। তবে একদিন অভ্যস্ত হয়ে উঠবে, এইরকমই ওর বিশ্বাস। সেই দিন ও মহাপ্রকৃতি হয়ে যাবে।

মহাপ্রকৃতির কথায় ওর শ্বাস ঘন হয়ে আসে। রক্তর মধ্যে তৈরি হয় ছন্দ। সেই তালে শরীর বাঁধা হয়ে গেলে তা তানপুরার মত কেবলই বাজতে থাকে। যেন কোন অতল ফুঁড়ে উঠে আসা একটা ধুন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ওকে! প্লাবনের মত উপচে উঠে টইটম্বুর হয়ে যাবে একসময়। হাবুডুবু খেতে যে এত আনন্দ জানা ছিল না ওর আগে।
ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কাঠের মেঝের ওপর ক্রমাগত একটা আওয়াজ ওর দিকে এগিয়ে আসছিল। ফটাস ফটাস চটির আওয়াজ। ঘোর ঘোর চোখে তাকিয়ে দেখতে পেল দেবেন্দ্রকে। মজায় থাকে ছেলেতা।ম্যাথস্‌ নিয়ে সমস্যা আছে বলছিল। কখন যে পড়ে আর কখন যে করে কি জানে! সারাদিনই ওকে দেখা যায় টো-টো কোম্পানী করতে।
দেবেন্দ্র ওকে বলল, কি দিদি, কি করছ?
ও উওর দিল না।
দেবেন্দ্র এক ঝুড়ি বীনস্‌ নিয়ে যাচ্ছিল। ও জিজ্ঞস করল, কি করবে?……
-চাচী বলেছে, ভাজি বানাবে। বাগান থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।
যেতে যেতে দেবেন্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে বলল ,আও।
ও যেতে থাকল দেবেন্দ্রের পেছন। দেবেন্দ্রের পায়ে সাদা অজন্তা হাওয়াই। সাদা চটিতে নীল স্ট্র্যাপ্‌। এই চটি দেবেন্দ্রের সর্বক্ষণের সঙ্গী। ধুলোমাখা পা আর অজন্তা হাওয়াই নিয়ে দেবেন্দ্র সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। পাহাড়ে, বনে- বাদাড়ে। কাঁটা ঝোপে ভর্তি পাহাড়ের গড়ানে গা বেয়ে তরতরিয়ে নামে,ওঠে।উঠতে উঠতে শেষ পাথুরে পাহাড়ের টং-এ চরে বসে থাকে। তারপর সেখান থেকে হাওয়াই চটি ফটফটিয়েই কেমন করে যেন হড়কে হড়কে নেমে আসে।ভয় লাগে তখন। আর প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হয়, অবধারিত পতন হবে। পাহাড়ের তলায়, কোথায় কোন গভীর গর্তে সগর্ব উচ্চতা থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ছিটকে পড়া ধ্বসের মতন ধসে পড়বে ছেলেটা। কিন্ত ও দেখেছে, মানে ও নির্ঘাৎভাবে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থেকেছে যে, দেবেন্দ্র অজন্তা হওয়াই দু- আগুলে টিপে নিশ্চিন্তে নেমে এসেছে ওই আঘাটা থেকে।
হনুমানের জাতভাই তুমি। দেবেন্দ্রকে বলেছে ও।
আজ্ঞে, তুমিও।তফাৎটা শুধু এই যে এইসব কর্তব তুমি ইদানিং ভুলে গেছ।
হেসেছে ও।
এখন দেবেন্দ্র আর তার অজন্তা হাওয়াই-এর পেছন পেছন যেতে যেতে ও দেখল পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে দেবেন্দ্র রান্নাঘরে যাচ্ছে । রান্নাঘরের বাইরে কাঠের বেঞ্চিতে বসল, ওরা দুজন। দেবেন্দ্র গুছিয়ে জোগাড় করে নিয়ে এল,দুটো ছুরি আর চপার বোর্ড । নিপুণ হাতে কচুকাটা করছিল ওরা বীনগুলোকে। চাচী রান্না করবে। দেবেন্দ্র বকবক করছিল কত কথা। কথাগুলো এমনই যা বললেও হয় না বললেও হয়। ফুটবল ম্যাচে কাত করে দিয়েছে দেবেন্দ্র কাদের যেন। বোধহয় সেইসব ছেলেগুলোকে, সেদিন যখন দেবেন্দ্রর সঙ্গে ও হাঁটছিল, রাস্তা দিয়ে একটা মাঠের কাছে কিছু ছেলে খুব করে দেবেন্দ্রকে কিছু বলেছিল। ঠিকমত শোনেনি ও । টিটকিরিই হবে বোধহয়। টিটকিরিকে দেবেন্দ্র হজম করেছিল তখন । কিসের টিটকিরিকে কে জানে ? দেবেন্দ্রকে পেয়ে বসেছিল ফুটবল ম্যাচ ।
ওকে পেয়ে বসে ছিল প্রকৃতি ।এখনও তার ঘোর ওকে ছাড়েনি।
এই ঘোর নিয়ে সব কাজ করে ফেলা যায়, কিন্তু ঘোর ছেড়ে যায় না । এই যে দেবেন্দ্রর এতশত বকবকানি, ও কিন্ত দিব্যি আছে ,আধা শুনে আধা না শুনে । এত শব্দ করে বলা কথা , ওসবের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? ভাবছিল ও । প্রকৃতি তো কথা বলে না ! প্রকৃতি তো কিছুই না বলে কতো কিছু বলে দেয়।বলে যায় । নাক, মুখ চোখ দিয়ে প্রকৃতি আস্তে আস্তে ওর মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল ।
ও অনবরত কথা বলছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিঃশ্বাসের মারফৎ।
একনাগাড়ে বীনস্‌ কাটছিল ও। আর বীনস কাটকে কাটতে
একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল দেবেন্দ্রও । একনাগাড়ে ঘটে যাচ্ছিল অনেক ঘটনা।

(ক্রমশ)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (3)
  • comment-avatar
    ইন্দ্রাণী দত্ত 2 years

    একটি ধ্রুপদী উপন্যাস যেমন শুরু হয়, সূচনাপর্ব তেমনই। “এ জন্মে পাপ নেই আমার, বলল ও। পূর্বজন্মের পাপের খেসারত দিতেই এই জন্ম।” – ঘরে বাইরের বিমলার মনোলগ মনে এল।
    শুরুটা এমনই যেন মনে হয় ফিল্ম দেখছি। ক‍্যামেরা মূল চরিত্রের ক্লোজ আপ নিচ্ছে শুরুতে,ফেড আউট করে ফ্ল‍্যাশব‍্যাকে যাচ্ছে, কখনও সিঁড়ি , পাহাড়, রান্নাঘরে প‍্যান করছে- পারিপার্শ্বিক বুঝে নিচ্ছি ফলত, কখনও জাস্ট ফলো করছে চরিত্রদের। যথোপযুক্ত ভাষা, শব্দের ব‍্যবহারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফটফটিয়ে হাওয়াই চটি উঠে যাচ্ছে পাহাড় অথবা সিঁড়ি বেয়ে, কিম্বা রান্নাঘরে চপিংবোর্ডে খচাখচ বীনস কাটছে দেবেন্দ্র।
    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকব।

  • comment-avatar
    Sikha Roy 2 years

    অতি নিপুণ সচেতনতায় গড়া এক ভাষার ছবি, এক নড়ে যাওয়া মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে যাতে। মনটি নড়ে যাওয়া ঠিকই, তবে তা হয়তো বা নিয়মসিদ্ধ স্বাভাবিকতার পরিবর্তে প্রকৃত স্ব-ভাব অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। প্রকৃতি এবং ঐ বর্ণিত অঞ্চলটি, উল্লিখিত মানুষসহ, এক প্রধান চরিত্রের দাবিদার হয়তো বা। সাগ্রহে পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম।

  • comment-avatar
    Sikha Roy 2 years

    নিপুণ সচেতনতার সঙ্গে গড়া এক ভাষার ছবি, যাতে আপাতদৃষ্টিতে নড়ে যাওয়া মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। নড়ে যাওয়া ঠিকই, তবে তার যাত্রা নিয়মবদ্ধ স্বাভাবিকতা থেকে প্রকৃত স্ব-ভাব অভিমুখে। প্রকৃতি, ঐ অঞ্চল আর তার মানুষজন সহ,এক প্রধান ভূমিকা নিতে চলেছে বলে অনুমান হচ্ছে। পরবর্তী সংখ্যার জন্য সাগ্রহ অপেক্ষায় রইলাম।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes