লিটল ম্যাগাজিনের আঁতুড় ঘরের দাই মা – সন্দীপ দত্ত <br />  ধীমান ব্রহ্মচারী

লিটল ম্যাগাজিনের আঁতুড় ঘরের দাই মা – সন্দীপ দত্ত
ধীমান ব্রহ্মচারী

কিছু মানুষ এক এক সময় প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রতিষ্ঠান হওয়ার পেছনে থাকে একটা আন্দোলন,একটা বিরাট চলার স্বাধীন স্বাধীনতা। কলকাতার কলেজ। আমার বাংলা নিয়ে পড়াশোনা। নিজের শহর ছেড়ে আসা ২০০৫ এ। এরপর বছর তিন পর অর্থাৎ সাল ২০০৮,মাস নভেম্বর। কবিতা বুলটিনের প্রকাশক চারুপাঠ প্রকাশনীর প্রকাশক জয়ন্ত মালাকার। হ্যাঁ জয়ন্ত দার সঙ্গেই প্রথম আমার কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার যাওয়া। সেই সময় সন্দীপ দা আজকের গোল টুপি পড়তেন না(যত টুকু স্মৃতিতে মনেপড়ে)। জানলাম তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলার প্রায় সব লিটল ম্যাগাজিন তাঁর এই সংগ্রহ শালায় রয়েছে। তখন লিটল ম্যাগাজিন শব্দটার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। আমি লিটল ম্যাগাজিন কী? কেন ? কীভাবে? কেমন ? এতো জানতাম না। সেই প্রথম পরিচয় ২০০৮ সাল। এর ঠিক এক বছরের মাথায় অর্থাৎ নভেম্বর ২০০৯ আমি প্রথম কবিতা বুলেটিন নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনার কাজ যোগ দিলাম। আমি আর বর্ধমানের আমার এক অগ্রজ কবি অনুপম বিশ্বাস। আর ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে আমার পরিচয় হয় পরিতোষ (ভট্টাচার্য)দার সাথে। কবিতা বুলেটিনের সব সংখ্যা(নভেম্বর, ডিসেম্বর,জানুয়ারি এই তিনটে সংখ্যা প্রকাশ হয়েই কবিতা বুলেটিন বন্ধ হয়ে যায়) নিয়মিতই দিয়ে আসতাম লাইব্রেরিতে।জয়ন্ত দায় বলত।

আজ ২০২৩ সাল। ১৫ই মার্চ। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের সর্বকালের প্রহরী আজ তাঁর সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর কাজের কর্তব্য নিষ্ঠা ও সজাগ প্রবৃত্তি তাকে ইতিহাসে অনন্য করে রেখে দেবে। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসের একটা বিরাট অংশের দাবি হয়ে থাকবেন সন্দীপ দত্ত। তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করতে করতে বিরোধী ব্যক্তি নিজেই হয়ে উঠছেন একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা সবাই সেই প্রতিষ্ঠানের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছি।

বাংলা সাহিত্যের আঁতুড় ঘর যদি লিটল ম্যাগাজিন হয়,তবে সেই ঘরের মাতৃ স্বরূপ দায় মা হলেন সন্দীপ দত্ত। সেই আঁতুড় ঘরের রক্তের ঘন্ধ মিশিয়ে রয়েছে যে হাতের ছোঁয়া তা বাংলার আপামোর লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা অনুভব আর উপলব্ধি করবেন।
তবে শুধুই কি তিনি একজন কর্মী ? শুধুই কি একজন প্রতিষ্ঠাতা ? না, তা কিন্তু একদমই নয়। তিনি একাধারে গবেষক – চিন্তক এবং একজন সু লেখক। তাঁর প্রকাশিত বেশ কিছু বই ,যেমন বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিবৃত্ত ( ১ম খন্ড, ২য় খন্ড), লিটল ম্যাগাজিনে দেশ ভাগ (সম্পা : সন্দীপ দত্ত) , ভারতীয় সংস্কৃতির নিগ্রহের ইতিহাস,বাংলা কবিতার কালপঞ্জী(১৯২৭-১৯৮৯),বাংলা গল্প কবিতার তিন দশক,কবিতা কাজ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কালপঞ্জী এগুলি তাঁর চিন্তার বিষয় হিসেবে ছাপ ফেলে। বাংলার বাইরে তথা বাংলাদেশ ও বিদেশেও লিটল ম্যাগাজিন চর্চার বিষয় তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছিল।

লিটল ম্যাগাজিনে দেশ ভাগ বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন , ‘ উদ্যোগী লিটল ম্যাগাজিনও

মানবতার যূপকাষ্ঠে মানুষ আজ মানুষেরই গড়া পৃথিবীতে লাঞ্ছিত, পলাতক, স্বদেশচ্যুত। পৃথিবী জুড়ে ছবিটা ক্রমশ প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ইরাক-সিরিয়া থেকে হাজার হাজার শরণার্থী গৃহহারা দেশহারা হয়ে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে অমানুষিক বন্দি জীবনযাপন করছে। মায়ানমারে রোহিঙ্গারা বিপন্ন, স্বদেশচ্যুত। হায় স্বদেশ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর চক্ষুঃশূল হয়েছিল ইহুদিরা। ইহুদিদের প্রতি নেমে এসেছিল নৃশংস অত্যাচার। জার্মানি থেকে পালাতে হয়েছিল আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীকেও।

আমাদের দেশে প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে ইংরেজরাজ যে বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি গড়তে চেয়েছিল, তারই অঙ্গ ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ঘোষিত বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা। সে দিন অখণ্ড বাঙালি জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছিল। ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার কূটচক্র রদ হয়েছিল। বাংলাকে ভাগ করা যায়নি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে ইংরেজদের ধর্ম ও জাতপাতের সেই বৈষম্যনীতিও আমাদের দেশের কিছু অদূরদর্শী নেতার অবিমৃষ্যকারিতা ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। একই সঙ্গে এসেছিল স্বাধীনতা ও দেশভাগ। লক্ষ লক্ষ মানুষ এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বা বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছিল নিজেদের বাস্তুভিটে ছেড়ে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও সাতচল্লিশের দেশভাগকে কেন্দ্র করে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে চর্চা নিরন্তর চলছে। প্রকাশ পেয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সংখ্যা, দেশভাগ সংখ্যা, উদ্বাস্তু সংখ্যা। এই সব বিশেষ সংখ্যাগুলি ছাড়াও নানা সময়ে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে আলোচিত হয়েছে এই বিষয়-ভাবনাগুলি এবং তৎ-অনুষঙ্গ প্রাসঙ্গিক রচনাগুলি। বর্তমান সংকলন গ্রন্থটিতে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ও উদ্বাস্তু সমস্যা বিষয়ক নির্বাচিত রচনা স্থান পেয়েছে। দেশভাগ

আমরা এই সংকলনগ্রন্থে বিষয়-ভাবনা অনুযায়ী রচনাগুলিকে সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করেছি। প্রথম: প্রসঙ্গ দেশভাগ, দ্বিতীয়: বঙ্গভঙ্গ, তৃতীয়: ১৯৪৭-এর দেশভাগ প্রসঙ্গ, চতুর্থ: উদ্বাস্তু সমস্যা, পঞ্চম: দেশভাগ: প্রেক্ষাপট ভারত, ষষ্ঠ: দেশভাগ ও বাংলা উপন্যাস, সপ্তম: দেশভাগ: শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ।

প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি লেখকদের তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগে-বিশ্লেষণে উপস্থাপিত। আশা করি, রচনাগুলি আলোচনার উন্নত ক্ষেত্র তৈরি করবে।

‘গাঙচিল’ বরাবরই দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে নানান গ্রন্থ প্রকাশ করে চলেছে। এমনকী ‘গাঙচিল পত্রিকা’-র প্রথম সংখ্যাটিও শরণার্থী সংখ্যা হিসেবে নিবেদিত। গাঙচিলের অধীর বিশ্বাসের ইচ্ছাতেই এমন একটি সংকলনের ভাবনা। আমি তাকে সামান্য রূপ দিতে চেষ্টা করেছি মাত্র।

এই সংকলন কতটা সফল হল তা পাঠকই বিবেচনা করবেন। কৃতজ্ঞতা জানাই এই গ্রন্থের প্রচ্ছদশিল্পী বিপুল গুহকে। গ্রন্থের প্রুফ দেখে দিয়েছেন ভ্রাতৃপ্রতিম প্রসূন মজুমদার এবং নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায়। যে সমস্ত লিটল ম্যাগাজিন থেকে … লেখাগুলি গৃহীত হয়েছে, সেই সব লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ”

এই লেখায় তাঁর সুচিন্তিত ভাবনা রসবোধের মাধ্যমে সংকলিত হয়েছে বলাই যায়। একজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী ও সাধক হয় তিনি বর্তমানে নানান পত্র পত্রিকায় বিরুদ্ধে কথা বলেন নি। বিপরীতে সেই সমস্ত ছোট ছোট পত্র পত্রিকাদের দিয়েছেন অনাবিল উৎসাহ। একটা পত্রিকা কীভাবে সময়ের সঙ্গে,যুগের সঙ্গে তাঁর চরিত্র – ধর্ম ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে সেখানে তিনি তার ইতিহাসই সন্ধান করেছেন বিরুদ্ধাচরণ না করে। এই বইয়ের ভূমিকায় একটা জাগায় আমরা দেখি তাঁর দেশ ভাগের যন্ত্রণার কথা , ” ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার কূটচক্র রদ হয়েছিল। বাংলাকে ভাগ করা যায়নি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে ইংরেজদের ধর্ম ও জাতপাতের সেই বৈষম্যনীতিও আমাদের দেশের কিছু অদূরদর্শী নেতার অবিমৃষ্যকারিতা ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। একই সঙ্গে এসেছিল স্বাধীনতা ও দেশভাগ। লক্ষ লক্ষ মানুষ এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বা বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছিল নিজেদের বাস্তুভিটে ছেড়ে।”– কলকাতাতেই তাঁর জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে এম. এ। শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৭৮ সালের ২৩ শে জুন গড়লেন প্রথম লিটল ম্যাগাজিন। একটাই ধ্যান একটাই মন্ত্র বাংলার লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলনের প্রসার ও সংগঠিত করার প্রয়াস। তাই নিজের বাস ভবনের নিচেই গড়ে তুললেন এই শতাব্দীর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থাগার যা আজকের ম্যাগজিন ইতিহাসে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। স্বর্ণাক্ষরে যা আজও বাংলার একটা চার পাতা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক থেকে চারশো পাতার সম্পাদকদের মন্দির হয়েই রয়ে যাবে। কালের নিয়মে সব শেষ হবে, এও যেমন বাস্তব,ঠিক তেমন বাস্তব তাঁর তিল তিল করে গড়ে তোলা মন্দির। এখন সেই মন্দিরের দুবেলা আরতি সারতে নিশ্চয় আসবেন কোনো জনৈক উত্তরসূরি ।যিনি এই গৌরবের তকমা নিয়ে কালের গতি পথে আমাদের মতো বাংলার হাজার হাজার সম্পাদকদের মন্দিরের দরজা সময় মতো খুলে রাখবেন।

তথ্যসূত্র :
১)বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিবৃত্ত ( ১ম খন্ড, ২য় খন্ড) গাঙচিল
২) লিটল ম্যাগাজিনে দেশ ভাগ (সম্পা : সন্দীপ দত্ত) গাঙচিল

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Mousumi ghosh 3 years

    ভালো লেখা, ভালো লাগলো।

  • comment-avatar
    Anirban Choudhury 2 years

    অনবদ্য স্মৃতিচারণ।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes