
দেবাশিস দাশ-এর কবিতাগুচ্ছ
চাম্বুল কাঠের নৌকো
চাম্বুল কাঠের নৌকো
একাকিত্ব ঠেলে-ঠেলে কতদূর ভেসে যাব আর?
চাম্বুল কাঠের নৌকো যেন তীব্র মানুষজীবন!
গহন গম্ভীর ভবনদীর উজানে চলে কত-কত লাশ।
যেভাবে হৃদয়মাঝি দাঁড় বায় অকূল স্বভাবে,
যেভাবে পাথর নিয়ে অভিশপ্ত জেদি সিসিফাস
নির্ধারিত কর্মমার্গে আকাঙ্ক্ষাকে ঠ্যালে লাগাতার,
সেভাবে চলেছি আমি, মেলোডি, তোমার সঙ্গে একা।
অহঙ্কার থেকে দূর স্রোত টানে ভাটিয়ালি মন…
উপসাগরীয় জলহাওয়ার আবেগে শুধু শেখা—
বাগীশ্বরী মগ্নতার শেষহারা ওলোটপালোট।
পরিযাণ
পথে সেই শ্রমিকের সঙ্গে দেখা হল। কাঁধে বাঁক—
শ্রাবণী মেলায় যেন তারকেশ্বরের লক্ষ্যে যাবে!
অথচ এ-দৃশ্যে কোনও শিব নেই, অতিমারী আছে।
নাকমুখ কাপড়ের ফেট্টি দিয়ে তীব্র বাঁধা থাক।
স্কন্ধে তুলে-ধরা থাক শিরদাঁড়া— ব্রাত্য সমাজের।
এ-লাঠিই চিতাকাঠ, ভিন-পরিপ্রেক্ষিতের আঁচে।
বহু মাঠ পার করে একদিন শস্যের অভাবে
ঘুররাজ্যে এসেছিল, বেঁধেছিল সংসার-ভারতী;
দীর্ঘ লকডাউন যাকে ফিরে যেতে প্রবৃত্ত করেছে,
চঞ্চলা শ্রীলক্ষ্মী তার পবিত্র শরীরটুকু বেচে।
আবাদ সম্পূর্ণ হল কবিতার! আরও কত ক্ষতি
দেখে যেতে হবে আজ পরিযায়ী সোশ্যাল সাইটে?
বাঁকের দু’দিকে দুটো গামলা বাঁধো নাইনল দড়িতে।
নম্রতনু দুই শিশুকন্যা রাখো তরাজু-পাল্লায়।
তারপর হাঁটা শুরু— অতীত গ্রামের দিকে, সঞ্চিত সাহসে
হাজার-হাজার মাইল যতদূর দৃষ্টি হেঁটে যায়।
মানুষেরই পায়ে-পায়ে সভ্যতা প্রস্তুত করে পথ।
মেঘ-জানলার গায়ে, অনিচ্ছুক উচ্চতায় ব’সে
কবি একা স্বপ্ন লেখে— দুর্গতিনাশিনী ভবিষ্যৎ।
সহজ উঠোন
একপাটি নীল চপ্পলের মতো খোলা পড়ে আছি।
বন্ধুহারা
কুশান দুপুর দূরে বাঁধেন দোতারা।
খুদ-সংগ্রহকারী একটি ডাহুক
আসে, আর আস্তে চলে যায়।
অগোছালো কথার বাগানে
ঝরা মরা পাতা যাকে টানে,
সে-জীবন
ঈশ্বরীর সঙ্গে রোজ খেলে কানামাছি।
হারানো পথের কোলে, জবাগাছটির কাছাকাছি
অসতর্ক গামার-ছায়ায়
ভুল কোনও প্রণামের মতো
এখনও অক্ষত
এই মন
ভালবাসা দিয়ে ধরে আছি।
মেঘদূত
যাও মেঘ তুমি পাহাড় ভাঙতে-ভাঙতে
কাজুবন ছেড়ে রাস্তা যেমন চলল,
যাও মেঘ, আজ আকাশ মোড়ানো রাংতায়
ঢেকে নিয়ে চলো হৃদয়ের লাল হুল্লোড়।
লাফিয়ে পেরোও সাইবারপাস রাত্তির
খনি অঞ্চলে বৃষ্টি ঝরাও অল্প
বুকে ধু-ধু বালি, কয়লায় কালো যার তীর
সে-নদী লিখুক ঘাস-গজানোর গল্প।
রাঙামাটি চা-বাগান
গন্তব্য হারানো কোনও শুকনো ঝোরা আমার জীবন।
কিশোরীর চুল থেকে খসে-পড়া রিবনের মতো
শতাব্দী-হারানো পিচপথ
বাঁক নিয়ে ছুটে যায় গিরিছোঁয়া অসীম সন্ধানে…
জাম্বুরা গাছের নীচে থমকে আছে সুবর্ণ বয়েস।
দেউসি’র মাদল বাজে অন্ধকার মনের বাগানে।
জানি এই রাস্তা একমুখী।
ক্ষয়ে গেছে ছেড়ে-আসা পাড়।
পেছনের দিকে, দূর থেকে
গভীর নির্জন দুটো চোখ
তবু কেন ডাকে বারবার?
*দোতারাবাদক*
আমি সেই দরবেশ, যার
মন কেনা যাবে না কখনও।
ছোট্ট চা খেতের পাশে একা
ব্যক্তিগত এক বনাঞ্চল, হুহু ঝোরা
আমাকে লালন করে,
সারারাত জেগে
আমি তার বেঁধে নিই গ্রহে-গ্রহান্তরে।
ওগো আসমানি মেয়ে, শোনো–
আমার একমাত্র কাজ
মৃত্যু পার করে করে
মায়াপথে ছায়াপথে নক্ষত্র জ্বালানো।