
মেরু-নিশীথের নাবিকেরা পর্ব – দুই
পার্থজিৎ চন্দ
-প্রথম স্তবকেই কবি যখন অতি-স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন ‘সত্তা’ শব্দটি তখন সত্তার আলোকে কবিতাটির পরাপাঠের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। প্রথমেই যে সংকটের মুখোমুখি হতে হবে তা হল – প্রথম দিনের সূর্য কি নতুন? সত্তার নতুন আবির্ভাবের আগেও কি ছিল তার অস্তিত্ব? নাকি নূতন সত্তা এসে আবিষ্কার করল সূর্য’কে ও সূর্য চিহ্নিত হয়ে গেল প্রথম দিনের সূর্য হিসাবে? এ প্রশ্নটিকে নিতান্ত লঘু বলে উড়িয়ে দেবার কোনও কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথ যে মুহূর্তটিকে প্রথম বলে নির্দিষ্ট করলেন সে মুহুর্ত থেকে শুরু হয়ে গেল একটি ‘কাল-খন্ড’।
প্রথম দিনের সূর্য…
১১ শ্রাবণ, ১৯৪৮-এ লিখিত হয়েছিল এ কবিতাটি; অর্থাৎ কবির জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে উচ্চারিত হচ্ছে পঙক্তিগুলি। অবশ্য সংখ্যার নিরিখে পঙক্তি মাত্র ১২-টি। তার মধ্যে ‘কে তুমি?’ – এই দু’টি শব্দ দিয়ে গঠিত পঙক্তি দুটি স্তবকে ফিরে ফিরে এসেছে।
এ পর্যন্ত ইঙ্গিত পেয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ ব্যতিত আর কিছুই নয়। এ কবিতাটির পরাপাঠের দিকে কিছুটা প্রবেশ করার আগে দু’-একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি; বিশেষ করে বাংলার এক শ্রেণীর ‘সেরিব্রাল’ পাঠকের দ্বারা রবীন্দ্রনাথ যখন ‘কবি’ হিসাবে গণ্য না-হবার ফতোয়া জারি হয়ে গেছে তলে তলে, তখন কথাগুলি সামনে আসা জরুরি।
কিন্তু যে ব্যাপনয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে বিভিন্ন শিবির ও ব্যক্তি-সমষ্টির তরফ থেকে তার ভেতর তাঁকে পাঠ করা ও পুণঃপাঠ করবার বিষয়টি কতখানি কাজ করেছে? শুধুমাত্র ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ‘পুরাতনী’ পদ্ধতি যদি আধুনিকতার বিপ্রতীপ অবস্থান হিসাবে বিচার্য হয়ে থাকে তো জীবনানন্দ দাশের পঙক্তির পর পঙক্তি উদ্ধৃত করে প্রমাণ করাই যায় যে তিনিও আদপে এক ‘পুরাতন-ভাষা’তেই কবিতা লিখে গেছেন।
রবীন্দ্রবিরোধীতার নামে যে চটকদার বিষয়টির শুরুয়াৎ হয়েছিল এক সময়ে কয়েক দশক যেতে যেতে সেটি স্তিমিত। কারণ ‘তিনি’ গান ছবি প্রবন্ধ চিঠিপত্র নাটক ইত্যাদি দিয়ে লিলিপুটের দেশে এতটাই গ্যালিভার যে তাঁর দিকে আক্রমণ ও ব্যর্থতার তির ছুড়তে ন্যুনতম যে উচ্চতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেটিই অনুপস্থিত। ফলে যাবতীয় বিধুনন ও বিলক্ষের পর পড়ে থাকে তাঁর কবিতা যথেষ্ঠ আধুনিক নয় এমন এক কর্কট-ধারণাকে তলে তলে ছড়িয়ে দেবার গুপ্ত-পদ্ধতি।
এখন এ সময়ে এসে মনে হয় ‘আধুনিকতা’র বহির্লোকে এমন কতগুলি প্রতিরোধ হয়ে গেছে যেগুলিকে অতিক্রম না-করলে তাঁকে ধারণ করা অসম্ভব; শুধু তাঁর গানের ক্ষেত্রে যে এ কথাটি সত্য তাই নয়, তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেও কথাটি সমান সত্য।
রবীন্দ্রনাথের গানের মতো কবিতাতেও যে ‘সনাথ’ সত্তার উপস্থিতি বারংবার টের পাওয়া যায় তা আধুনিকতার উপরিচর ধারণার সব থেকে বড় শত্রু। আধুনিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অ্যনার্কিক প্রবণতা সন্নদ্ধ অবস্থানকে সন্দেহের চোখে দেখে। রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ণের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। কবন্ধ দানব এসে ফেলে রেখে গেছে তার ছায়া, সে ছায়ায় বসে আমরা শুধুই ‘অস্বীকার’ করে গেছি তাঁকে (এখানে তাঁর ‘কবিতা’কে)। ‘প্রথম দিনের সূর্য’ নিয়ে পরাপাঠের দিকে এটি যদি হয় প্রথম ধাপ তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপগুলিও দ্রুত অতিক্রম করা জরুরি।
এ কবিতাটি পড়তে পড়তে অনিবার্যভাবে চোখ চলে গিয়েছিল দু’-দিন পরে লেখা আরেকটি কবিতাটির দিকে; সে লেখাটিতে ‘প্রথম দিনের সূর্য’র মতো অতি-গূঢ় উচ্চারণ নেই। বরং কবিতাটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা উঁচু সুরে বাঁধা। ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি’তে কবি ঘোষণা করছেন ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে / এসেছে আমার দ্বারে;।’
এবং দুঃখের অস্ত্র হয়ে উঠেছে ‘কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত-’। দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম লাইনের তিনি আবার জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘যতবার ভয়ের মুখোশ তাঁর করেছি বিশ্বাস/ ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।’
দুটি শব্দের মধ্যে এভাবেই কি লুকিয়ে রেখে গেছিলেন অকল্পনীয় সব খেলা? যে খেলার হাতে পড়ে আজীবন ছুটে বেড়াতে হবে আমাদের! এখানে দেখে নেওয়া যাক তিনি দুটি শব্দের মাঝে একটি বিষয়কে আড়াল করলেন কী বিচিত্র উপায়। যে মুহূর্তে তিনি বললেন ভয়ের মুখোশের কথা সে মুহূর্ত থেকে আমাদের অবচেতনে গঠিত হতে শুরু করল মুখোশের বাস্তবতাকে অতিক্রম করে ‘মুখ’টিকে দেখে নেবার অদম্য বাসনা। বাসনাটি অদম্য, কিন্তু সেটি কিছুতেই প্রকাশ্য করছেন না রবীন্দ্রনাথ।কোথাও যে ভয়ের এই মুখোশের আড়ালে রয়ে গেছে উচ্চতর ‘দুঃখের’ বিষয় সেটি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করছেন না কবি। অবশ্য এটিও স্বয়ম্ভু নয়; কারণ একটি লাইন পূর্বেই তিনি লিখেছেন, ‘কষ্টের বিকৃত ভান’এর কথা। এটিকে স্বীকার করে নেবার আরেকটি অর্থ থাকে, তা হল কষ্টের প্রকৃত রূপ ভান-রহিত এবং সেটি বিকৃত নয়। সেটি ‘এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা কুহক’ ছাড়িয়ে অন্য এক নক্ষত্রলোকের বিষয়।
জীবনপাত্রে উছলে ওঠা দুঃখের অপার সমুদ্র থেকে হার-জিতের ক্ষুদ্র পরিসরটিকে ছিন্ন করে দিয়েছিলেন তিনি। জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে তিনি যেন প্রবলভাবে অস্বীকার করছেন দুঃখের পরিহাসকে, ভয়’কে। ‘জীবনের মিথ্যা কুহক’-এর ভ্রূণে রয়ে গেছে দুঃখের পরিহাস।
এর পরের কবিতাটি, সেই বিখ্যাত কবিতা, যার প্রথম তিনটি পঙক্তির আপাত সারল্য অতিক্রম করে চতুর্থ লাইনে এসে অতিকায় এক খাদের সামনে এসে দাঁড়াতে হয় আমাদের,
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী!
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে
সরল জীবনে!’
– কবিতাটি আদ্যপান্ত বারবার পড়লে নিশ্চিত অনুধাবন করা যাবে যে সরল জীবনের কথা কবি বলছেন তার সঙ্গে ছলনাময়ীর সম্পর্ক সরলরৈখিক তো নয়ই, বরং ঈষৎ জটিল।এবং কবিতাটির শেষ তিনটি লাইনে আরেকটি বিস্ফোরণ লুকিয়ে রয়েছে,সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।।’
– সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার সম্পর্ক এখানে এসে হয়ে ওঠে তীব্র দ্বন্দ্বের, দু’-জনেই একে অপরের চোখে চোখে রেখে বসে থাকে কালের পর কাল। একে অপরকে পরাজিত করতে করতে আক্রমণ করতে করতে অনঙ্গ অন্ধকারে আলোকিত হয়ে উঠতে শুরু করে। তীব্র অস্বস্তিকর সে সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের কবিতার আরেকটি প্রতিরোধ, আধুনিকতা যে প্রতিরোধের বর্ম ভেদ করে প্রবেশ করতে অধিকাংশ সময় ব্যর্থ হয় ভিতরমহলে প্রবেশ করতে, তা হল সেই ‘সনাথ’ উপস্থিতি। ব্যক্তি নিজেই আধুনিকতার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, ফলে বহির্লোকের ‘তুমি’তে সে আস্থা জ্ঞাপন করতে পারে না অধিকাংশ সময়ে। হায়, এই ধারণা যে কতবড় প্রতারক তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটির পরাপাঠের মধ্যে কিছুটা। যদিও আমার বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের এ কবিতাটি এত ঘন সন্নিবদ্ধ, এত স্তরের পর স্তর রয়েছে লেখাটিতে যে, যে কোনও পরাপাঠ আরও বহু বহু পাঠের মুখ খুলে দিতে পারে ও দেবেই।
কবিতাটিতে প্রবেশ করার আগে সেটি উদ্ধৃত করা যাক,
‘প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে –
কে তুমি?
মেলে নি উত্তর
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –
কে তুমি
পেল না উত্তর।।’
-প্রথম স্তবকেই কবি যখন অতি-স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন ‘সত্তা’ শব্দটি তখন সত্তার আলোকে কবিতাটির পরাপাঠের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। প্রথমেই যে সংকটের মুখোমুখি হতে হবে তা হল – প্রথম দিনের সূর্য কি নতুন? সত্তার নতুন আবির্ভাবের আগেও কি ছিল তার অস্তিত্ব?
নাকি নূতন সত্তা এসে আবিষ্কার করল সূর্য’কে ও সূর্য চিহ্নিত হয়ে গেল প্রথম দিনের সূর্য হিসাবে? এ প্রশ্নটিকে নিতান্ত লঘু বলে উড়িয়ে দেবার কোনও কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথ যে মুহূর্তটিকে প্রথম বলে নির্দিষ্ট করলেন সে মুহুর্ত থেকে শুরু হয়ে গেল একটি ‘কাল-খন্ড’।
এখানে প্যারাডক্স আরও ঘনিভূত হয়ে উঠছে, আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করছি সত্তা ও সূর্য একে অপরকে প্রথমবারের জন্য আবিষ্কার করছে। এটিই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত; কারণ সত্তা ও সূর্য – একে অপরের উপস্থিতি ছাড়া আবিষ্কৃত হতে পারছে না কিছুতেই।
প্রথম স্তবকে লক্ষ করার, সূর্য প্রশ্ন করছে সত্তাকে, তার পরিচয় জানতে চাইছে। এবং তর প্র্শ্নে নিরুত্তর রয়ে যাচ্ছে সত্তা।
এই নিরুত্তর থাকার কারণ কি নিজেকে আবিষ্কার করতে না-পারার অসহায়তা, না কি সত্তার অন্তর্গত প্রতিরোধ – সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি না এ মুহূর্তে।
দ্বিতীয় স্তবকে এসে আমরা পেয়ে যাচ্ছি ‘বৎসর বৎসর’ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। পশ্চিমসাগরতীরে অস্তগামী সূর্য শেষ প্রশ্ন নিয়ে ধকধক করছে; এবারেও তার একই প্রশ্ন ‘কে তুমি?’।
এবারও সে ‘পেল না উত্তর।’
প্রথম স্তবক ও দ্বিতীয় স্তবকে উত্তর না-পাবার ধরণে অতি-সূক্ষ পার্থক্য আছে। প্রথম ক্ষেত্রে মেলেনি উত্তর ও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি উত্তর। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, কী জানি কেন, মনে হয় যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তার অন্তর্গত প্রতিরোধ অনেক বেশি; সে যেন উত্তর দিতেই পারত অথচ দিল না।
এবার যে প্রশ্নটি আমাদের তাড়া করবে তা হল – এ সত্তা কি ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, প্রকৃতির মধ্যে নিহিত চৈতন্যের প্রকাশ? না কি তা ব্যক্তি-সাপেক্ষ, শারীরবৃত্তীয় বিষয়? ইনভেনশন ও ডিসকভারির মধ্যে লুটোপুটি খেতে থাকে আমাদের বিস্ময়ের পায়রা। সত্তার এ দুটি রূপের সন্ধানই কি ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিতে?
আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, এই ‘সত্তা’ কি আমাদের জীবনে ও শরীরে যুক্ত হয়ে থাকা ‘অতিরিক্ত’ কিছু উপাদান? না কি আমরা,মানুষেরা তাকে অর্জন করে নিই ধীরে ধীরে? যদি এটি মানুষের জীবন ও শরীরের ভেতর যুক্ত হয়ে থাকা ‘অতিরিক্ত’ কিছু উপাদান হয়ে থাকে তো তা অতি-অবশ্যই ব্যক্তি-নিরপেক্ষ; ব্যক্তির ভূমিকা সেখানে গৌণ হয়ে আসে। অথচ সত্তা-কে আমরা ব্যক্তির সাপেক্ষেই দেখে আসতে অভ্যস্ত হয়েছি এতদিন।
‘সত্তা’কে অর্জিত ‘বিষয়’ হিসাবে গণ্য করলে এ প্রশ্নের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তা জন্ম দিয়ে যাবে আরও কতগুলি প্রশ্নের। সত্তা যদি অর্জিত বিষয় হয় তা হলে অর্জন করার জন্য একজন এক্সপেরিয়েন্সারের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ পথ ধরে সত্তা শারীরিক হয়ে ওঠে; কিন্তু মানুষ এখনও পর্যন্ত শরীরের পথ ধরে সত্তাকে ছুঁতে অক্ষম।
এ জটিল প্রশ্নটি থেকে কিছুটা বিরতি নিয়ে আরেকবার কবিতাটির ভেতর লুকিয়ে থাকা অকল্পনীয় পরাপাঠের উপাদানের সন্ধান করা যাক। প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করছে সত্তার নতুন আবির্ভাবে…। এখন প্রশ্ন হল সত্তার আবির্ভাব যদি নতুন হয় সে কি করে চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছে প্রথম দিনের সূর্য’কে? ‘প্রথম’কে প্রথম হিসাবে গণ্য করার বোধ কে রোপন করে দিল সত্তার ভেতর? দ্বিতীয় অংশে এসে যদিও এ প্রহেলিকা কিছুটা ধূসর হয়ে আসে, ফিকে হয়ে যায়। সময়ের পর সময় কেটে গেছে।‘দিবসের শেষ সূর্য’ – এ তিনটি শব্দের মধ্যে ধরা রয়েছে মহা-পরিসমাপ্তির এক ইশারা। শেষ সূর্যের শেষ প্রশ্ন, আবার ‘কে তুমি?’
এবারও সে রয়েছে নিরুত্তর।
কিন্তু এই নিরুচ্চারিত অবস্থার ভেতর ঘনিয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন, যে রবীন্দ্রনাথ এক সময়ে উচ্চারণ করেছিলেন,
‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে –
জ্বলে উঠল আলো
পূবে পশ্চিমে’
-সে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটিতে এসে শুধু মানব-সত্তার জয়গানের পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন বুনে রেখে গেলেন বলেই আমার বিশ্বাস।
রবীন্দ্রনাথেরও সত্তার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব কিছু কম ছিল না।
জীবনের অন্তিম প্রহরে এসে এ সবের প্রশ্ন যেন খুঁজতে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ আরও তীব্রভাবে। এবং তাঁর খোঁজের মধ্যে সব থেকে আশ্চর্যের উপাদান ওই প্রথম দিনের সূর্যের প্রশ্ন করে ওঠা।
এখানে এসে দুটি সম্ভাবনার সূত্র বেরিয়ে আসে। তার একটি হল, প্রথম দিনের সূর্য’ও, অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই যে গ্র্যান্ড-ডিজাইন, সেও চিনে উঠতে পারছে না মানুষের সত্তা’র অংশটিকে। ফলে সত্তার কাছে সে নিজেও বেশ কিছুটা হতবিহ্বল।অ্যথ্রপিক প্রিন্সিপ্যাল মেনে বিশ্বজগৎ ও মানব-চেতনার মধ্যে যে সম্পর্কের ইশারাটিকে আমরা ডি-কোড করতে শুরু করেছিলাম ‘আমারই চেতনার রঙে পান্ন হল সবুজ’-এর মধ্যে দিয়ে তা এখানে এসে কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ছে।পরের সম্ভাবনাটি আরও গূঢ়; সত্তা ও প্রকৃতির মধ্যে এই যে মহা-জিজ্ঞাসার স্রোত এটা বোধহয় অক্ষুণ্ণ রয়ে যাবে সৃষ্টির ‘শেষ’ পর্যন্ত। কোনও যে উত্তর পাওয়া যাবে না সেটিই শেষ কথা। তবু এই প্রশ্ন করার পর্বটি বজায় রেখে যেতে হবে। কারণ এই প্রশ্নের মধ্যেই দোল খেয়ে চলেছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী। শুধু চারপাশেরই বা বলি কেন, লাইট-ইয়ারস দূরের ওই নক্ষত্রমণ্ডল থেকে শুরু করে মাল্টিভার্স’ও হয়তো সেই অর্থে কোনও পদার্থের দ্বারা নয়, এই প্রশ্নটি দিয়েই নির্মিত হয়ে রয়েছে।
পড়লাম । ভালো লাগলো । তবে বিষয়টি আগেও কোথাও আলোচিত হয়েছিল । সেই লেখাটি এবং এটি দুই অর্থে আকর্ষণীয় আমার কাছে । পার্থজিৎ-কে ধন্যবাদ জানাই ।