
অভিষেক বসু-র গল্প
গল্পের খোঁজে
গল্প কি? গল্প পড়ে মানুষ কি পায়? লিখেই বা কি পায় ? গল্প একটা লিখবো লিখবো ভাবছি বটে, কিন্তু এমন গুলিয়ে ফেলছি বারবার যে আবার ‘কি’ থেকে শুরু করাই শ্রেয় মনে হলো।
বিশেষত ফাঁকা আড্ডায় যখন নিষ্ফলা সময় কাটছে।
আমি গল্প লিখি। ছোটো থেকে লেখার স্বপ্ন দেখে আসছি। যা মনে আসতো, তাই লিখতাম। যতদূর মনে পড়ে, গল্প পড়ার রোমাঞ্চ থেকেই গল্পের প্রতি অনুরাগ শুরু। গল্প মানেই বিস্ময়; হঠাৎই এমন এক সত্যের মুখোমুখি হওয়া, যা প্রথাগত ও প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
এতদিন কেটে গেল। আমি এখন চল্লিশ। কৈশোরের সেই উপলব্ধির কি তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটলো? গল্প লিখেছি কিছু। দু-একটা ছেপেওছে এদিক ওদিক। সফল হয়েছি কি?
অবশ্য এখন এমন এক সময় যখন গল্প লেখায় সফল হওয়ার চেয়ে গল্প লিখে সফল হওয়াটা আমার কাছে বেশি জরুরী। গল্পই এই মুহুর্তে সাফল্যে পৌঁছানোর সেরা বাজি। সফল হলে হয়তো সবাই আবার আমার কথা মন দিয়ে শুনবে। তার আগে আবধি গল্পটা তো ফেকলুর মত অতি ব্যস্ত বন্ধুদের প্রতীক্ষার এবং সাক্ষাতে এই উপলব্ধির, যে আমার কথা শুনতে চায় না কেউই।
ভালো ছাত্র ছিলাম। উচ্চাকাঙ্খী ছিলাম না। বন্ধুরা যখন গেলো ডাক্তারী-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, আমি ভাবলাম ছাপোষা সরকারি চাকরি, বাড়িতে থাকার সুযোগ আর লেখা-লেখির স্বপ্ন নিয়ে জীবনটা দিব্বি কেটে যাবে। উচ্চমাধ্যমিকের পর মাঝারি মানের কলেজ। চাকরিও জুটে গেল, মাঝারির থেকে একটু ভালোই।
চলছিল সব ঠিকই। তারপর ধীরে ধীরে ফারাকটা চোখে পড়তে শুরু করলো — স্বপ্ন আর বাস্তবের, আমার মূর্খের স্বর্গের সঙ্গে পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর। ক্রমশ এই সত্য প্রতিভাত হলো যে আগের প্রজন্মে আমার মত সরকারী চাকুরেরা সামাজিক বা আর্থিক বাস্তুতন্ত্রে স্বমহিমায় বিরাজমান থাকলেও বর্তমানে বহুজাতিক সংস্থার কর্মচারীরা আর্থিক ক্ষমতার বিচারে আমাদের দশ গোল দেবে।
শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হতে শুরু করলাম। এতদিনে গুছিয়ে নেওয়া বহুজাতিকে কর্মরত বন্ধুদের সামনে নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হতে শুরু করলো, কারণ ওদের বর্ণময় অ্যাডভেঞ্চারের ন্যায় শোনাবার মত আমার কাছে কিছু ছিল না, আর ওদের মত স্বীকৃতি আর সমর্থন কেনার অর্থও। কেবল বাইরে নয়, আশংকা ঘরেও সত্য হলো। বর্ধিত বেতনক্রমে স্বস্তিও উবে গেল এক সরকারী চাকুরের স্ত্রী, আমার মাতার স্বীকারোক্তিতে, যে আগের বেতন দেখে অনেক কষ্টে তিনি অশ্রু সংবরণ করেছেন।
পরাজয় সম্পূর্ণ হলো জীবনযাপনের ধরনেও। ক্ষুদ্র আমার প্রমোদ তরী জলে নামতে না নামতেই ওদের প্রমোদ তরণীর ঢেউয়ে উল্টে যেতে যেতে কোনোক্রমে সেই যে রক্ষা পেল, আবার ভাসার আগে এখনো চারদিক ফাঁকা কি না দেখে নিতে হয়!
ধাক্কা লেগেছিল। দাপুটে এই এরা পড়াশোনায় সেরা ছাত্ররা নয়, বরং বেশীরভাগই ছাত্রাবস্থায় এই স্বপ্নের দুঃসাহস না দেখাতে পারা মধ্য-মেধার দল। শর্তহীন আনুগত্য, অমানবিক পরিশ্রম আর বলিয়ে-কইয়ে হওয়ার সৌজন্যে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। আগে কোনোদিন মেধা দিয়ে বন্ধু বিচার করিনি, কিন্তু উদযাপনের, দিনযাপনের বেড়ে চলা দূরত্বে তাদের এই সাধারণ চরিত্র ধরা পড়লো। আমার সমসাময়িক সেরা ছাত্রদের খুব কমই এ মফস্বলের নাগালে, আর যারা আছে, তাদের দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই ।
মধ্য-মেধার আস্ফালনের প্রাবল্যে কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত হওয়া বন্ধুত্ব বলিপ্রদত্ত হলো, পড়ে রইলো ক্রমশ অর্থহীন হয়ে পড়া কিছু অভ্যাস, যেমন এই ছুটির সকালে আড্ডা। এতদিন আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক পরিচয় বা অন্য সব পার্থক্যকে অতিক্রম করে আসা বন্ধুত্ব প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিলো ওদের ঔদাসীন্য। সব কিছু ঠিক আছে এমন ভাব করে এগিয়ে গেলে কপালে জুটল শীতল উপেক্ষা।
আমার লেখাও আত্মবিশ্বাস হারালো। লজ্জা ও সংশয়ের আবহে কি লিখব, ভেবে পাই না। আমার কথাই কেউ শুনতে চায় না, আবার গল্প!
সবাই ওদের কথাই শুনতে চায়। কথায় ভুল থাকলেও অর্থের আত্মবিশ্বাস তা ঢেকে দেয়। প্রচার ও প্রসার আছে। গুণমুগ্ধদের ধারণা, টাকা আছে, তাই সে সফল। আর সফল মানে সঠিক। গুণমুগ্ধদের সামনে ওরা যখন দুনিয়াদারি গুলে খাওয়া উধস্তন বা সিনিয়রের বাণী ভারী গলায় অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসে আউড়ে যায়, ওরা বোধহয় ভুলে যায় আমি ওদের ছোট থেকে চিনি। ওরা বোধহয় নিজেরা ছোটবেলায় কি ছিল, সেটাই ভুলে যায়।
গল্প কি? এখন গল্প একটা অস্ত্র এই অন্তঃসারশূন্য, স্ব-বিরোধিতায় ভরা সুখী জীবনের বিজ্ঞাপনের স্বরূপ উন্মোচিত করার। টাকা আছে, কিন্তু অন্ধ অনুকরণ ছাড়া উপায় নেই, কারণ মেধার অভাবে উন্নত রুচিও নেই।
গল্প বলে দেবে সবজান্তার ভেক ধরা ওরা বড় যন্ত্রের সেই তেল চকচকে চাকা ছাড়া কিছুই নয়, যে নিজেকে যন্ত্র ভাবে। মেধার বিকল্প টাকা নয়, খরুচে মানেই রুচিবান নয়। বুঝিয়ে দেবে, ভালো থাকার প্রমাণ হিসাবে শেষমেশ সেই প্রাইসট্যাগের আশ্রয়ই কেন নিতে হয়।
আরেকটা সিগারেট ধরাই। গল্প কি প্রতিশোধ হয়ে উঠছে? বড্ড ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে আক্রমণটা, কারণ প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে? কিন্তু ব্যাপারটা তো ব্যক্তিগতই! মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের জীবনযাপন, পরিবার ও বন্ধুদের সান্নিধ্যকে সর্বাগ্রে রাখা আমি আজ আর বন্ধুদের উল্লাসের স্বাভাবিক সঙ্গী নই, পরিবারেও প্রথম পছন্দ না। এর কারণ কি আর্থিক না জীবন দর্শনের ফারাক? না কি দ্বিতীয়টি প্রথমটি থেকেই জাত?
নিজের জালেই নিজে জড়ালাম? অর্থকেই অনর্থের মূল ধরলে মূল্যবোধের নিজস্ব জোর আর কি রইলো? টাকা থাকা আর না থাকাকেই তো সব বলে মেনে নিতে হয়। টাকা থাকলে একরকম, নইলে অন্যরকম।
আরো খানিকটা হাতড়ানো দরকার, কারণ গল্প তো আত্মদর্শনও বটে। আত্মসমালোচনা ছাড়া আমার গল্প যে ঈর্ষাকাতর বিষোদগারই হয়ে থাকবে, সত্যকে স্পর্শ করতে পারবে না।
সত্যিটা কি? আমিই বা কেন নিজেকে ঠিক আর ওদের ভূল ধরে নিচ্ছি? উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখা, উন্নতির চেষ্টা তো জীবনের ধর্ম। সেই ধর্ম পালন করে এগিয়ে গেলে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
তবে আমার কেন মনে হয়, এই অর্থ চোখ বুজে থাকার ঘুষ? গোটাটাই ভাঁওতা, কারণ টাকা দিচ্ছে যে, খরচের পথ বাতলে ফিরিয়েও নিচ্ছে তো সে নিজেই! এত এত টাকা কি কোনো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের অঙ্গুলি হেলনে উন্মাদের মত খরচ করার জন্য? নেশা আর বিলাসিতায় ডুবে তাল-জ্ঞান বিসর্জনের জন্য? চারপাশের পৃথিবী, মানুষের দূর্দশা সম্বন্ধে এত ঔদাসিন্যর জন্য?
অন্যদিকে বিলাস আর হতাশের দুই পৃথিবীতে পা রাখা বাঙালি মধ্যবিত্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সংযমী সঞ্চয়ী জীবন, দু-দ্ন্ড জিরিয়ে জীবনের প্রশ্নগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া আর চাইছে না ক্ষমতায় থাকা শক্তিরা। এক্ষেত্রে আমাদের কারোরই কি কিছু করার আছে? ওদের জায়গায় গিয়ে আমি কি করতাম, তাই বা কে বলতে পারে?
“সরে বোস! গতরটা করেছে দেখো!”, দামী সিগারেট বার করতে করতে বললো তূনীর, “ আরে কালকের হাফ বোতল বেঁচে ছিল, সুনীপের গাড়িতে বসে শেষ করলাম। কি মাল ভাই! দামটাও তেমন! তোকে কাল খেতে খেতেই ফোন করেছিলাম তো। কি বলেছি অবশ্য মনে নেই শালা!”
মনে হলো বাড়ি চলে যাই। কেনই বা যে আমি আসি! আবার সেই একই ক্লান্তিকর আলোচনা।
তা ছাড়া গল্পটা পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে।
তখন কলেজে। টাকা পয়সা কম। সুনীপ একবার সস্তা মদের জন্য তূনীরকে এক সমকামী মুদির কাছে বেচে দিয়েছিল। পরে অবশ্য সসম্মানে উদ্ধারও করেছিল, কিন্তু মদ খেলে তূনীর এখনো সেই অংশটা ভুলে যায়। কাল রাতেও সেই পুরনো অভিযোগ নিয়েই ও ফোন করেছিল।
মধ্যবিত্ত থাকুক না থাকুক, গল্পগুলো থেকে যাক।

