
পর্ণশবরীর কথকতা ১২
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
ঝিরঝিরি আর রিনরিনে বৃষ্টির ফোঁটা আম-কাঁঠালের পাতা আর তাদের ফাঁক দিয়ে ক্রমাগত টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকলে এরকম জ্বরের ঘোরে মনে পড়ে আমার পুরাতন গ্রামের বাড়ির কথা। পুরাতন, কারণ তখনকার মানুষ আর তাঁদের পছন্দের কিছুই আর নেই সেখানে। বসতবাটি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে বছর দশেক আগে। শীতের দিনে হাঁড়ি বেঁধে খেজুরের রস নামানোর জন্য পুকুর ধার ঘেঁষে সার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেঁটে মোটা খেজুর গাছগুলো নেই। দুপুরবেলার পাতপেড়ে খাওয়া আর খাওয়ানোর কলাগাছের বন আর তাদের শ্যামল সবুজ পাতাদের স্নিগ্ধ গন্ধ নেই। ফি-হপ্তায় পুকুরে জাল আর ছিপ ফেলা নেই। সেই মায়ের দাদুর আমলে লাগানো লালচন্দন গাছখানি, যার লাল-লাল বীজ কোঁচড়ে ভর্তি করা ছিল প্রিয় খেলা, সে নাকি জলের দামে বিকিয়ে গেছে কাঠুরের করাতে। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব বিষম বালাই, জঞ্জাল। পাখি আসে, জঞ্জাল করে নাকি তারা বিষ্ঠায়। তাই সমস্ত মহাবৃক্ষদের মুণ্ডন করে কেজি দরে বেচে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভরে ফেলা হয়েছে। আমায় আর টানে না সে বাড়ি। আমি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকি পুকুর ধারে বসে, রক্ষণের অভাবে যে এখন পাতলা সবুজ সর গায়ে মেখে এলিয়ে পড়ে থাকে নিশ্চুপ। এসব অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখে আমাদের সেই প্রাচীন বাস্তুসাপটি দেহ রেখেছে আয়লার বছরে। মায়ের জন্ম নেওয়া ছোটো কুঠুরিখানি ভেসে গেছে সেবারের বৃষ্টিতে। এই পুরাতন ঘরগুলোর প্রতি আর মায়া নেই কারো। আমিই শুধু আধঘুমের মধ্যে শাপগ্রস্ত আত্মার মতো ফিরে ফিরে যাই দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলার আভা মেশানো অব্যবহৃত ঘর আর ক্রমাগত বৃষ্টির ছাঁটে গলে আসা তোলা উনুনের কাছে।
একাল আর সেকালের ব্যবধান রেখা মেলে ধরলে আমি আমার সমস্ত মন-প্রাণ নিয়ে সেকালের হয়ে থাকব তা জানেন আমার বিধাতা। পুরাতন বাড়ি, রাতভর বৃষ্টির জেরে দুই পুকুরের জলের স্রোতের সঙ্গম, ৯৮এর বন্যায় জন্ম নেওয়া শ্যামলী গাইয়ের বাছুর, যার নাম দাদু রেখেছিলেন বানেশ্বর, পিতলের জালায় জিইয়ে রাখা মাছ আর হাঁসের ঘরে উবু হয়ে বসে ভোরের সূর্যের মতো লাল কুসুমের ডিম তুলে আনার ইতিহাস কপালের উত্তাপকে শীতল করে। মনের উত্তাপকেও।
আমার যে খসড়া আজ প্রস্তুত করেছেন আমার ভাগ্যদেবতা তার সিংহভাগ গড়ে উঠেছে পুরাতনকে ঘিরে পাকের পর পাক খেয়ে। আমাদের ভবিষ্যতও আসলে তাই-ই। আমার জলচর স্বভাব আর বর্ষাস্নাত মনের গভীরে ডুব দিয়ে বসে আছে সেসব সন্ধ্যে যেখানে দাদুর বুকের কাছে গুটি মেরে বসে শুনতাম তাঁর হয়ে ওঠার কাহিনি। জোনাকি ঝিকিয়ে উঠত অশ্বত্থের চূড়া পর্যন্ত, আতপচালের গন্ধ মেখে উষ্ণ হয়ে উঠতো রান্নাঘরের দিকটা। ঘুমে চোখ ভারী হয়ে আসত সন্ধ্যা গড়ানোর আগে। দাদুর মুখের গল্প আধখানা হয়ে থাকত, যেমন আধখানা আমার মুখে ভাতের গরাস…।