আলোকের সাধনা <br /> (টমাস আলভা এডিসনের জীবন-কাহিনি) <br /> হোমেন বরগোহাঞি <br /> মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

আলোকের সাধনা
(টমাস আলভা এডিসনের জীবন-কাহিনি)
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। অনুবাদক পরিচিতি- ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশত কুড়িটির ও বেশি।সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তেতাল্লিশটি।হোমেন বরগোহাঞির অসমিয়া উপন্যাস ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’(সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়) বাংলা অনুবাদের জন্য ২০২৪ সনের সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কারে সম্মানিত হন।

পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব

(২)
তিন মাসে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ছেলেটি
এর আগের অধ্যায়ে আমরা টমাস আলভা এডিসনের পরিচয় এই বলে দিয়েছিলাম যে তিনি ছিলেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক, তার সমান উদ্ভাবনী প্রতিভা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত অন্য কোনো মানুষ দেখাতে পারেনি। কিন্তু এরকম একজন মানুষকেও তাঁর শিক্ষয়িত্রী অতি নির্বোধ বলে ভেবেছিলেন এবং তিনি এডিসনকে তিন মাসের মধ্যে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন।
এডিসন আসলে নির্বোধ ছিলেন না। অত্যন্ত কম বয়স থেকেই এডিসনের চিন্তা শক্তি এবং কল্পনাশক্তি এত প্রখর ছিল যে সব সময় তিনি নিজের চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে থাকতেন। অর্থাৎ সবসময় তিনি কিছু না কিছু একটা বিষয়ে চিন্তা করতেন। চোখে দেখা এবং কানে শোনা প্রত্যেকটি কথাই, প্রত্যেকটি জিনিস, প্রত্যেকটি ঘটনা তার মনে নানা প্রশ্ন জাগিয়ে তুলত। তিনি সেইসব প্রশ্নের উত্তর চেয়ে নিজের মনে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করতেন। কেবল নিজেকে প্রশ্ন করে ক্ষান্ত না থেকে তিনি নানা বিষয়ে মা-বাবাকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন করতেন। উদাহরণস্বরূপ এডিসন একদিন হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করলেন–’বাবা, রাতের আকাশে কে এত প্রদীপ জ্বালায়?’
বাবা যখন উত্তরে বললেন যে সেসব প্রদীপ নয়, আকাশের তারা, আর সেই সব নিজে নিজেই জ্বলে, তখন এডিসন চট করে প্রশ্ন করল–’আকাশের প্রদীপ গুলি নিজে নিজে কীভাবে জ্বলতে পারে? আমাদের ঘরের প্রদীপ গুলিতো মা জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে জ্বলে।’
বাবা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল–’তুমি রাতের আকাশের তারা গুলিকে প্রদীপ বলে ধরে নিয়েছ, সেজন্যই তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে–এই প্রদীপগুলি কে জ্বালায়? কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশে সূর্যও তো জ্বলতে থাকে! জ্বলতে জ্বলতে সে আলোক এবং উত্তাপ বিতরণ করে। সূর্য যেভাবে নিজে নিজে জ্বলে, রাতের আকাশের তারা গুলি নিশ্চয় সেভাবে নিজে নিজে জ্বলে।
কিন্তু এডিসন এত সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার পাত্র নয়। তার প্রশ্নও এত সহজে শেষ হওয়ার নয়। বরং প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর তার মনে জাগিয়ে তুলে একটি নতুন প্রশ্ন। পিতার কথা শুনে এডিসন পুনরায় প্রশ্ন করল–’ওরা নিজে নিজে জ্বলতে থাকে সে কথা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তারা কখনও নিভে না গিয়ে সব সময় কীভাবে জ্বলতে পারে? ওরা কি কখনও নিভে যাবে না?’
পিতা পুত্রের মধ্যে এই ধরনের কথাবার্তার কয়েকদিন পরের ঘটনা। এডিসনদের সামনের উঠোনের এক কোণে কিছু শুকনো খড় স্তূপীকৃত করে রাখা ছিল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল যে কেউ খড়ের স্তূপটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ফলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে এবং আগুন ধীরে ধীরে ঘর পর্যন্ত চলে আসার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। দৃশ্যটা দেখার পরে স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। ভয়ে মানুষগুলি এদিকে ওদিকে দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু এর মধ্যেও প্রত্যেকেই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল যে আগুনের খুব কাছেই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট এডিসন। সমস্ত বাড়িতে সৃষ্টি হওয়া হট্টগোলের প্রতি নির্বিকার হয়ে সে তন্ময় দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এডিসনের মা দৌড়ে এসে ছেলেকে টান মেরে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে আগুন নিভে গিয়েছিল, খড়গুলি ছাইয়ে পরিণত হয়েছিল। খড়ে কে আগুন লাগিয়েছিল সে কথা জানতে আর কারও বাকি রইল না।–কারণ এডিসন আনন্দে হাততালি দিয়ে চিৎকার করে বাবাকে বলতে শুরু করেছিল–’বাবা বাবা, তুমি বলা কথা সত্য বলে প্রমাণিত হল। খড়গুলি পুড়ে শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনও নিভে গেল। আকাশের তারা গুলিও একদিন নিশ্চয় নিভে যাবে।’
বেশিরভাগ ছেলেই হয়তো পিতার বলা কথাকেই শেষ সত্য ধরে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত।সেই বিষয়ে তাঁর মনে নতুন কোনো প্রশ্নের উদয় হত না।কিন্তু এডিসন ছিল অন্য ধাতুতে গড়া-যার জন্য সে একদিন হতে পেরেছিল মানুষের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক।পিতার কথা যে সত্য সেকথা সে কীভাবে জানবে-যদি হাতে কলমে পরীক্ষা করে সে তার প্রমাণ পেতে চেষ্টা না করে?
এরকম একটি ছেলেকে কেউ কখনও নির্বোধ বলে ভাবতে পারে?অথচ এডিসনের শিক্ষয়িত্রী তার সম্পর্কে এরকমই ভেবেছিল।কেবল ভেবেই ক্ষান্ত না থেকে তিনি একটি চিঠি লিখে এডিসনের মাকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।আসলে কী হয়েছিল-এডিসন সব সময় নিজের চিন্তাভাবনায় এতটাই মশগুল হয়ে থাকতেন যে স্কুলে সে শিক্ষয়িত্রীর কথায় বেশি মনোযোগ দিতে পারত না।ফলে শিক্ষয়িত্রী কোনো প্রশ্ন করলে সে চট করে উত্তর দিতে পারত না।শিক্ষয়িত্রী পাঠ বোঝানোর সময় সে ব্যস্ত হয়ে ছিল নানা বিষয়ে তাঁর নিজের মনে উদয় হওয়া প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে,অথবা নানা সম্পরীক্ষার কথা চিন্তা করে।তাই এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই যে এডিসনের শিক্ষয়িত্রীর তাকে নির্বোধ এবং অমনোযোগী বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল।
সে যাই হোক না কেন ,শিক্ষয়িত্রীর চিঠি পাওয়ার পরে এডিসনের মা ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন না বলে ঠিক করলেন এবং এডিসনের শিক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন।
অর্থাৎ এডিসনের পাঠশালার ছাত্রজীবন স্থায়ী হল মাত্র তিন মাস ।
এডিসন নিজের মায়ের কাছ থেকে এরকম সর্বাঙ্গ সুন্দর শিক্ষা পেল– যে ধরনের শিক্ষা পাওয়ার সৌভাগ্য খুব কম ছেলে মেয়ের হয়। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে এখানে এডিসনের পিতা-মাতা এবং তাঁর ঘরোয়া জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে নেওয়াটা ভালো হবে। সন্তানের মঙ্গল চিন্তা করা পিতা-মাতা সন্তানের শিক্ষক এবং বন্ধু হতে পারার চেষ্টা করা উচিত। পিতা-মাতা যদি শৈশবে সন্তানের শিক্ষক এবং বন্ধু হতে পারে তাহলে তাদের চেয়ে ভালো শিক্ষক এবং বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। এডিসনের জীবন সে কথাই প্রমাণ করে।
খ্রিষ্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আমেরিকা আবিষ্কার করার পরে ইউরোপের নানা দেশ থেকে সেখানে যাবার মানুষের স্রোত ধারা বইতে লাগল। টমাস আলভা এডিসনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন হল্যান্ডের মানুষ। ভাগ্যের সন্ধানে আঠারো শতকের প্রথম দিকে তারা আমেরিকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে। কয়েক বছর সেখানে থাকার পরে তারা কানাডায় গিয়ে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। এডিসনের পিতা স্যামুয়েল এডিসনের হোটেলের ব্যবসা ছিল। তিনি একজন বুদ্ধিমান এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। হোটেলের ব্যবসা করে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কানাডাতে থাকা অবস্থায় তিনি নাঞ্চি এলিয়ট নামে আঠারো বছরের একজন শিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। কিন্তু স্যামুয়েল এডিসন কানাডায় বেশি দিন সুখে বসবাস করতে পারলেন না। অবশ্য তার জন্য অন্য মানুষদের চেয়ে নিজের কৃতকর্ম বেশি দায়ী ছিল। রাজনীতির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সেই সময়ে কানাডার শাসন ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট হয়ে কিছু মানুষ একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে কানাডার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।স্যামুয়েল এডিসনও সেই বিদ্রোহীর দলে যুগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কানাডার সরকার বিদ্রোহ দমন করে বেশিরভাগ বিদ্রোহীকে বন্দি করে। ব্যাপার বিষম দেখে স্যামুয়েল স্ত্রীকে কানাডায় রেখে নিজে আমেরিকায় পলায়ন করে।
আমেরিকায় এসে স্যামুয়েল এডিসন পাথরের ব্যবসা শুরু করেন। নতুন উপনিবেশ আমেরিকায় তখন চারপাশে নিত্যনতুন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। পাথরের ব্যবসা করে স্যামুয়েল এডিসন পুনরায় একজন ধনী মানুষ হলেন। তিনি কানাডা থেকে পালিয়ে আসার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে স্ত্রীও কানাডা থেকে এসে তার সঙ্গে যোগ দিলেন,আর দুজন মিলে নতুন দেশে একটি নতুন সংসার আরম্ভ করলেন। তারা আমেরিকায় ওহিও (Ohio) নামে একটি শহরে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির দিন তাদের কনিষ্ঠ সন্তান টমাস আলভা এডিসনের জন্ম হয়।
পাথরের ব্যবসা করে স্যামুয়েল এডিসন প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন যদিও নতুন নতুন সম্পদ আহরণ করার নতুন নতুন চিন্তা করা তিনি ছেড়ে দেননি। সেই সময় আমেরিকার মিসিগান নামের অঞ্চলে কাঠের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে উঠেছিল।স্যামুয়েল এডিসন পাথরের ব্যবসা ছেড়ে কাঠের ব্যবসা করার কথা ভাবলেন। ফলে তাকে ব্যবসা-বাণিজ্য ঘর গৃহস্থালি ছেড়ে মিসিগানে চলে যেতে হল। সেখানে তিনি পোর্ট হুরন নামের একটি শহরে নতুন করে বাড়িঘর তৈরি করে জীবনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করলেন। তখন টমাস আলভা এডিসনের বয়স সাত বছর।
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত এবং প্রতিভাবান মানুষের বাল্যকাল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে অতিবাহিত হওয়ার কথা আমরা জানি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে করা সংগ্রাম তাদের চরিত্র গঠন করায় এবং প্রতিভা বিকাশ করায় একটি বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু টমাস এডিসনের পিতা ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী; সেই জন্য টমাস সুখ স্বাচ্ছন্দের মধ্যে লালিত পালিত হয়েছিল। অভাব এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল না।কিন্তু মানুষের ধন সম্পত্তি কেবল থাকলেই হয় না; তাকে সৎকর্মে খরচ করার জন্য মানুষের কিছু জ্ঞান বুদ্ধিও থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে অভিভাবকরা যদি জ্ঞানী, দূরদর্শী এবং সুবিবেচক না হয়, তাহলে ধনসম্পত্তি ছেলেমেয়েদের মঙ্গল সাধন করার চেয়ে অপকার বেশি করতে পারে। এই ক্ষেত্রে টমাস ছিলেন ভাগ্যবান।
আগেই বলা হয়েছে টমাসের মা নাঞ্চি এলিয়ট বিয়ের আগে একজন শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি যে খুব ভালো শিক্ষকা ছিলেন তার আরও একবার প্রমাণ পাওয়া গেল তখন– যখন তিনি টমাসকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এলে নিজেই ছেলের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
কনিষ্ঠ সন্তান হেতু টমাসের প্রতি মায়ের ভালোবাসার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আদর বা প্রশ্রয়ের আধিক্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে। কিন্তু টমাসের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, কারণ কম বয়স থেকেই মা তার শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করায় আদর করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছেলেকে শাসনও করতেন। একটি ছোটো ছেলের পক্ষে ভালোবাসা মিশ্রিত শাসন এবং সুশিক্ষা একসঙ্গে পাওয়ার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর কি হতে পারে?
ছেলের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে মা প্রথমে টমাসকে নানা ধরনের মনোরম কাহিনি বলতে শুরু করলেন। কাহিনি শুনে শুনে টমাস যখন আরও বেশি কাহিনি শোনার জন্য প্রস্তুত হল, তখন তিনি নানা বিষয়ের নির্বাচিত বই এক এক করে ছেলেকে পড়ে শোনাতে লাগলেন। এভাবেই তিনি টমাসের বইয়ের প্রতি নেশা ধরিয়ে দিলেন । সঙ্গে তিনি টমাসের মনে এই ধারণাও ঢুকিয়ে দিলেন যে বই হল অনন্ত জ্ঞানের ভান্ডার, আর জীবনে উন্নতি করতে চাইলে বই পড়তেই হবে।
কিছুদিনের মধ্যে মা টমাসকে বই পড়ে শোনানোর প্রয়োজন নাই হয়ে গেল, কারণ টমাস নিজেই বই পড়তে শিখে গেল। ইতিমধ্যেই টমাসের মনে বইয়ের প্রতি অনুরাগ এবং জ্ঞানের প্রতি কৌতুহল এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে নিজে পড়তে শেখার সঙ্গে সঙ্গে সে মনের আনন্দে অবিরাম ভাবে একটির পরে আর একটি বই পড়তে শুরু করল। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে টমাসের ঘরে এরকম অনেক নির্বাচিত বই পত্র ছিল বলেই সে একের পর এক বই পড়তে পেরেছিল। বেয়ে চলার জন্য আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে লতার শুংগুলি যেমন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়,। ঠিক তেমনি চোখের সামনে বই দেখতে না পেলে অতি বিদ্যানুরাগী ছেলেমেয়েদেরও বই পড়ার ইচ্ছে অকালেই লোপ পায়। সেই জন্য প্রত্যেক মানুষের বাড়িতে সাধ্য অনুসারে ছোটো বা বড়ো একটি গ্রন্থাগার থাকা উচিত– যাতে ছেলেমেয়েরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিয়মিত সেই বইগুলি চোখের সামনে দেখতে পায়। বই দেখে দেখে বড়ো হলে ছেলে মেয়েদের মনে বইয়ের কৌতুহল এবং অনুরাগ সৃষ্টি হতে পারে। টমাস যে কেবল বই পড়তে ভালোবাসত তা নয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ; খুব সহজেই পড়া কথাগুলি বুঝতে পারত। তাঁর একজন জীবনীকার লিখেছেন যে একটিমাত্র বাক্য বুঝতে সাধারণ পাঠকের যতটা সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে টমাস বইয়ের একটি সম্পূর্ণ পৃষ্ঠার কথা বুঝতে পারত। কারণ ছিল একটাই, টমাস মগজ খাটিয়ে এবং অখন্ড মনোযোগ দিয়ে পড়ত। বই কীভাবে পড়তে হয় সে কথা তার মাও তাকে খুব ভালোভাবে শিখিয়েছিলেন। বই পড়ার আনন্দ টমাসকে এতটাই মাতাল করে তুলল যে বারো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সে এডওয়ার্ড গিবনের’ডিক্লাইন এন্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার (Decline and fall of the Roman Empire) এবং রবার্ট বার্টনের ‘এনাটমি অফ মেলান কলি (Anatomy of Melancholy) ইত্যাদি ইংরেজি সাহিত্যে ধ্রুপদী বইগুলি পাঠ করেন।
এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-৯৪) লেখা রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয় এবং পতনের ইতিহাসটি বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে প্রত্যেকেই এক মুখে স্বীকার করে নেন। ছয়টি খন্ডে বিভক্ত এই বিরাট গ্রন্থটি তার অনুপম শক্তিশালী গদ্যের জন্য বিখ্যাত। অনেক বয়স্ক মানুষও সম্পূর্ণ বইটি পড়ে শেষ করেছে কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে একটি বারো বছরের ছোট্ট শিশু এরকম একটি বই পড়ে শেষ করাটা প্রমাণ করে যে নাজানা কথা জানার জন্য টমাসের কৌতুহল ছিল সীমাহীন। সঙ্গে তার ধৈর্যও ছিল অসাধারণ। টমাস বারো বছর বয়সে এডওয়ার্ড গিবনের ‘ডিক্লাইন এন্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার’ (Decline and fall of the Roman Empire) পড়ে শেষ করাটা যেমন আশ্চর্যের কথা ছিল তার চেয়ে অনেক গুণে বেশি আশ্চর্যের কথা ছিল রবার্ট বার্টনের ‘এনাটমি অফ মেলান কলি’নামের বইটি পড়া। রবার্ট বার্টন ছিলেন একজন পন্ডিত এবং ধর্মযাজক। কোনো মানুষের চিরস্থায়ী বিষাদগ্রস্ততার কারণ এবং মনের ওপরে তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে লেখা এই বইটি অনেক বয়স্ক শিক্ষিত মানুষেরও বুঝতে কষ্ট হয়। এরকম ক্ষেত্রে এই ধরনের একটি কঠিন বই টমাস পড়ে শেষ করেছিলেন বারো বছর বয়সে।
টমাস বাল্যকালেই বই পড়ার অভ্যাস আয়ত্ত করে নেবার ফলে সেই অভ্যাস তার সমগ্র জীবনে থেকে গেল। তিনি যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক হতে পেরেছিলেন তার মূলে অনেক পরিমাণই ছিল তার বই পড়ার অভ্যাস। তিনি নিজেই বলে গেছেন–’আমি যখন কিছু একটা জিনিস আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করতে চাই, তখন সেই বিষয়ে অতীতে কে কী কাজ করেছিলেন তার বিবরণ থাকা সমস্ত বই আমি কাজটিতে হাত দেওয়ার আগেই পড়ে নিই। আমার গ্রন্থাগারে থাকা সমস্ত বই কেবল সেই উদ্দেশ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছিল।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes