কিঞ্চিৎ পরচর্চা ১২
ভেসে যায় বাঁচার লড়াই
রূপশ্রী ঘোষ
ভেসে যায় বাঁচার লড়াই
এই পর্বের নাম পরচর্চা হলেও চর্চার থেকে বেশি পরিস্থিতির কথা বলতে চাই। চর্চা মানে একটা হীন ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। এখানে তা নয়। আমাদের এলাকার মানুষের পরিস্থিতি নিয়েই কথা। ওদিকে এখন বন্যা চলছে। মানুষের মন, মেজাজ, পরিস্থিতি সবই এখন বন্যার মতো আশঙ্কায় ডুবে। কিন্তু সবার তা বলব না। অনেকেই আবার এই বন্যার সঙ্গে এতটাই মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত যে যেন, প্রতিবছর বন্যা হলে তাদের খুব আনন্দ হয়, না হলে, ‘কী যেন একটা হয়নি, কী যেন একটা হয়নি’ ভাব থাকে। আমাদের গ্রাম থেকে খানাকুল খুব বেশি দূর নয়। কিন্তু বন্যা খানাকুল অঞ্চলেই হয়। দামোদর নদীর বাঁধ ভাঙলে তবে আমাদের গ্রামে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ছোটো থেকেই একটা ছড়া শুনতাম
পোল ডুবডুব দাইনান ভাসে
পাতুলের লোক দাঁড়িয়ে হাসে।
এই পোল, পাতুল, দাইনান সব খানাকুলের এক একটা গ্রাম। তাহলে ছড়া থেকে বোঝাই যাচ্ছে কোন কোন গ্রামে বন্যা অবধারিত। যদিও এর বাইরেও অনেক গ্রাম আছে তবুও এটুকু ছড়া ওই এলাকার জন্য প্রচলিত। আজ যেসব জায়গা খবরে দেখা যাচ্ছে আগে সেসব জায়গার বন্যা পরিস্থিতি ওখানে থেকেই শুনেছি। পোল, রাজহাটি, রাউৎখানা, শীতাপুর, রামনগর সব জায়গাতেই আমার আত্মীয়বাড়ি। তাদের কারো কারো বাড়ি এখন জলের তলায় কারো বা গেটের মুখে জল। যাদের বাড়ি একতলা সমান উঁচু জায়গা থেকে করা হয় তাদের এমনই অবস্থা আর যারা না বুঝে নিচু থেকে তৈরি করেছে তারা বান এলেই জলের তলায় থাকে। দোতলা থাকলে ভালো, না থাকলে ছাদে ত্রিপল দিয়ে সাময়িক কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা করে নেওয়া হয়।
যাদের মাটির বাড়ি তাদের চিন্তা বেশি থাকে। আমার কাছে এখন ওদিক থেকে ভিডিও, ফটো অনেক আসছে তাতে তো পাকাবাড়িও ভেসে যেতে দেখলাম। প্রকৃতির রুদ্র রূপের কাছে আসলে সবই মাটি। এইসময় মুশকিল, খাবার জল, চান, বাজার আরও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজ এবং জিনিস সংগ্রহ করার। যাদের নিজেদের নৌকা আছে তারা ওইসময় নৌকাগুলো বের করে গ্রামের প্রায় সব মানুষকেই যতটা পারা যায় সাহায্য করার চেষ্টা করে। অনেকের বাড়িতেই নৌকা থাকে এই বন্যার কথা ভেবে। গতকাল শুনলাম রাজহাটিতে একটা নৌকা ডুবে গেছে কিন্তু কারোর কোনো ক্ষতি হয়নি। এবারে তিনখানা নদীর বাঁধা ভাঙা, ডিভিসি’র ছাড়া জল এবং বৃষ্টির জল মিলিয়ে বন্যা ভয়াবহ হয়েছে। এইসময় আরও একটা ভয়ের ব্যাপার হল বিষাক্ত পোকামাকড় তেঁতুলবিছা, কাঁকড়াবিছা এবং বিষধর সাপের মতো প্রাণীর আগমন বৃদ্ধি। এটা নিয়ে মানুষ খুবই আশঙ্কায় থাকে। কিন্তু গতকাল শুনলাম একটা বিষধর বড়ো সাপ নিজেই ভয়ে কলাগাছে উঠে বসে আছে এবং মানুষ তাকে দেখছে আরও সাপও অসহায় হয়ে মানুষকে দেখছে। এইসময় অন্যান্য ফলমূল সবজির তুলনায় মাছ বেশি পাওয়া যায়। অফুরন্ত জোগানে দামও কম হয়। সবাই মোটামুটি যারা রান্না করে খাওয়ার অবস্থায় থাকে তারা মাছ খায়। গবাদি পশুদের দুরবস্থার কথা এরপর আর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
যে কটা দিন বন্যা থাকে বা বানজল পুরো নেমে না যাওয়া পর্যন্ত রোজই ভয়ের ব্যাপার। বিশেষ করে ওইসময় যদি কোনো মানুষ অসুস্থ হন, বা কেউ মারা যান বা কারও বাচ্চা হওয়ার দিন এগিয়ে আসে সেইসব বাড়িতে তো মানুষকে উদ্বিগ্নই থাকতে হয়। কিন্তু গতকাল টিভি খুলে একটা ব্যাপার দেখে বেশ ভালো লাগল, দেখা গেল হাসপাতাল থেকে (কোন কোন হাসপাতাল যাঁরা খবর দেখেছেন সবাই জানেন) জুনিয়র ডাক্তাররা ওষুধ, ত্রাণ সামগ্রী বা আরও যাকিছু লাগতে পারে বলে মনে হয় নিয়ে গেছেন। তাঁরা ভালো ভালো পোশাকেই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাড়িগুলোর উদ্দ্যেশে চেঁচিয়ে তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেতে অনুরোধ করছেন। ছোটো থেকেই শুনতাম এই সময় সরকার থেকে পঞ্চায়েতগুলোতে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হত এবং সত্যিই যাদের প্রয়োজন তাদের দেওয়া হত। চিঁড়ে, গুড় ত্রিপল এই ধরনের কিছু জিনিসের কথাই শুনতাম। টিভির খবরেই দেখতাম পলিটিক্যাল দলগুলো শাসক পক্ষ বা বিরোধী পক্ষ যেই হোক না কেন তারাই দুর্গত এলাকাগুলো খতিয়ে দেখতে যেত। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। পরবর্তীকালে কিছু এন জিও কেও জামাকাপড়, স্যানিটারি প্যাড, গ্লুকন ডি, ইলেকট্রল পাউ্রডার এইসমস্ত জিনিস নিয়েও এগিয়ে যেতে দেখা গেছে বন্যাদুর্গত এলাকায়। ডাক্তার অভিজিৎ চৌধুরীকেও নৌকায় করে বন্যাদুর্গত এলাকায় যেতে টিভিতেই দেখেছি। এটা খুব সম্ভবত আমফানের মতো কোনো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড়ো ঘটনার সময়। কিন্তু কাল দেখলাম, রাজহাটি গ্রামে জুনিয়র ডাক্তাররা একটা ক্যাম্প করেছেন। সত্যি কথা বলতে গ্রামে বড়ো ডাক্তারের খুব অভাব। হাতের কাছে কোয়াক ছাড়া কিছুই থাকে না। বড়ো বড়ো ডিগ্রি নেওয়া ডাক্তাররা আরামবাগ, খানাকুল, রামনগর, রাজহাটির মতো শহরেই বসেন। প্রত্যন্ত ্গ্রামের মানুষজন আগে থেকে নাম লিখিয়ে তারপর দেখানোর সুযোগ পান। আজকাল ডাক্তারের সংখ্যা এবং বিভিন্ন বিষয়ের স্পেশালিস্ট একটু হয়তো বেড়েছে কিন্তু যতটা প্রয়োজন ততটা নয়। আর গ্রামের যেসমস্ত বুদ্ধিমান ছেলেরা ডাক্তারি পড়ে বড়ো ডাক্তার হয় তারা গ্রামে থাকতে চায় না। খুব কম ছেলেমেয়ে বা কম ডাক্তারই ছিলেন যাঁরা গ্রাম ভালোবেসে সেই গ্রামেই থেকে গেছেন মানুষের সেবার জন্য। অসুখ তো আর শুধু বন্যার সময়ই হয় না। সারাবছরই লেগে থাকে। শুধুমাত্র ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবেই অনেক মানুষ মারা যান। এমন অনেক অসুখ বা হার্ট অ্যাটাক টাইপের মতো ঘটনা আছে যা কেবল উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবেই মানুষকে মারা যেতে হয়েছে। এগুলোর পার্মানেন্ট সমাধান দরকার। শুধুমাত্র আজ বন্যার জন্য ছুটে যাওয়া নয়। তবে একথা ঠিক যে আজ হয়তো এই ছুটে যাওয়াও তিলোত্তমার সম্মানার্থে। কোনো ডাক্তারকে প্রাণের বিনিময়ে সম্মান পেতে হচ্ছে এ বড়ো কষ্টের ব্যাপার। এই কদর্য ঘটনার জন্য গ্রামের মানুষও আজ মোমবাতি হাতে হেঁটেছেন বলেও হয়তো জুনিয়র ডাক্তাররা বুঝেছেন বিচ্ছিন্নতা মানুষকে ভালো রাখতে পারে না। সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। আজ গ্রাম শহর মিলিয়েই যদি একজোট হয়, তাহলে হয়তো অনেক সমস্যারই সমাধান হবে। এমন ঘটনা মানুষকে একজোট করুক এ বোধহয় কেউ চায় না। সতস্ফূর্ত যূথবদ্ধ সমাজই হয়তো মানুষ আশা করে। গ্রাম শহর মিলে যাক। আরও সহজ হোক একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানসিকতা। মনন তৈরি হোক, ঘটনা নয়। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এসব লাইন বইতে এবং মুখের বুলি হিসেবে নয়, সর্বোতভাবেই কার্যক্ষেত্রে পর্যবসিত হোক। চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে কত ভোগান্তি থাকে সে নিয়েও একদিন লেখা হবে। কিন্তু আজ ডাক্তারদের ছুটে যাওয়া সত্যিই খুব ভালো লাগছে। আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু আছেন। আমি খুব সহজে চিকিৎসা পাই বা আমার বাড়ির কারো প্রয়োজন হলেও তাঁরা সাহায্য করেন। কিন্তু কেউ কারো পরিচিতি না নিয়ে যাতে সব মানুষ সমানভাবে সহজে সুযোগ সুবিধা বা সাহায্য পান সেটা খুব দরকার।
যাহোক প্রকৃতি যদি বাধ না সাধে তাহলে হয়তো বন্যা পরিস্থির উন্নতি এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা যাবে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ আবার চোখ পাকাচ্ছে শোনা যাচ্ছে। সেটা হলে অনেক মানুষের আবার ক্ষতি হবে। প্রকৃতির উপর তো আমাদের কারোর হাত নেই তাই তার শান্ত হওয়া দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। যা আছে তা হল দুর্গতদের সাহায্য করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো। এটা চলছে। এভাবেই সহায়তা চলুক।
আসলে জীবনের সবটাই লড়াই। গ্রামের এই বিশাল সংখ্যক মানুষ দিনের পর দিন লড়াই করেই বাঁচছে। যেটা চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এসমস্ত ছড়া তো আর একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফল। ওই সমস্ত গ্রামের মানুষ জানে তাদের কিছু করার নেই। যখন বন্যা আসবে নিচের তলা থেকে সমস্ত আসবাবপত্র গুটিয়ে নিয়ে দোতলা থাকলে উঠে যেতে হবে আর না থাকলে অন্য ব্যবস্থা। কারো বাড়ি ঘর ভেসে যাবে কারো যাবে না। কাউকে অন্যত্র সরানো হবে কাউকে হবে না। বানজল চলে গেলে তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। সত্যিই কি এটা স্বাভাবিক? এটা স্বাভাবিক জীবন না। এখনো অনেক জিনিস আছে যা সরকার স্টেপ নিয়ে তার উন্নতি ঘটাতে পারে। ম্যানমেড বন্যা যদি বছরের পর বছর শুনতে হয় এটা তো কষ্টের। প্রকৃতির রুদ্র রূপ রুখে দেওয়া যাবে না। কিন্তু যেটা মানুষের হাতে আছে তার উন্নতি ঘটিয়ে পরিস্থিতি তো আরো ভালো করা সম্ভব বলে মনে হয়। বা সম্ভব না হলে তার বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভেবে পরিস্থির উন্নতি ঘটানোর কথা তো ভাবতেই পারে। ব্যারেজ বা বাঁধের জল ধারণ ক্যাপাসিটি নিয়ে এত কথা শোনা যায় সেটার কী আর অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় না? বা নদীগুলোর সংস্কার, ড্রেন সিস্টেম বা জল নিকাশী ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো বা আরও যা যা করা সম্ভব তা তো চেষ্টাও করার কথা শোনা যায় না। বরং সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে গাড়ির কারখানা করার জন্যও মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। আরও অনেককিছুর জন্যই অবশ্য দিতে হয় এটা একটা ঘটনার উল্লেখ মাত্র। যারা যখন সরকারে আসে তারা শহুরে শিক্ষিত লোকের ভোট কটা পায়? শহুরে শিক্ষিত লোকের ভোট ভাগ হয় অনেক বেশি। কারণ এখানে চিন্তা ভাবনা করা লোকের সংখ্যা গ্রামের তুলনায় বেশি। কিন্তু গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণে যেটুকু জিনিস প্রয়োজন তার সামান্য সাহায্য পেলেই একটা দলকে জিতিয়ে ক্ষমতায় আনতে পারে। তারা খুব বেশি রাজনীতি বা কূটনীতি বোঝে না। তারা চায় কেবল খেয়ে পরে বাঁচতে এবং বাঁচার জন্যই মিনিমম সুযোগ সুবিধা। ডাক্তার, ওষুধপাতি, মাথা গোঁজার ঠাঁই, আলো, জলের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ এটুকুই। তাদের এমনকিছু আকাশছোঁয়া চাহিদা থাকে না। কিন্তু শহরের মানুষের চাহিদা অনেক বেশি। তাদের সামান্য লড়াইকেও যেভাবে প্রকট করা হয় গ্রামের এই বিশাল সংখ্যক মানুষের দিনের পর দিন লড়াই করে বাঁচাকে যদি প্রকট করা হয় তাহলে গ্রাম একটু আশার আলো দেখতে পায়। যেখানে গোটা বিশ্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেখানে একটা দেশের গোটা অংশ সব বিষয়ে মিলেমিশে যাচ্ছে না কেন? এটায় আলোকপাত করা দরকার। সবাই সবার মতোই লড়াই করছে। প্রকৃতিও বোধহয় মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত। প্রকৃতি আর মানুষের লড়াইয়ের সহাবস্থানটা মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। কিন্তু লড়াইয়ের ধরন বা লড়াইয়ের ট্রিটমেন্ট কিন্তু এক হচ্ছে না। যেটা হয়তো সম্ভব। নাহলে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের কথা নেপথ্যেই থেকে যাবে। লড়াই এবং লড়াইয়ের প্রতিকার হোক সঙ্ঘবদ্ধ। এটাই মনে হয় সব মানুষের চাওয়া।