ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য -র গল্প

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য -র গল্প

এক মাছরাঙা জীবন

“ আঃ, এত অবুঝ হলে চলে!”, বিরক্তিতে ধমকে উঠল শুভ,” চারিদিকে কী অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? রোজ তো সন্ধ্যে হতে না হতেই টিভি খুলে বসে থাক! সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ লেগে গেছে বাবা, যুদ্ধ! চারিদিকে এমার্জেন্সি পরিস্থিতি! এই অবস্থায় কবে দেশে ফিরব বলব কি করে? তোমাদের ওখানে তো এখনও পকেট আইসোলেশন চলছে। কিছু কিছু পাড়া এক এক করে সবে লকডাউনের আওতায় আনছে। আমাদের এখানকার পরিস্থিতি জানো! গত সপ্তাহের মাঝামাঝি থেকেই পুরো বস্টন শহর তালা বন্দি! কবে খুলবে কেউ জানে না! কিভাবে চলবে কেউ জানে না! হাসপাতালগুলোর অবস্থা জানলে আঁৎকে উঠবে। এদেশে সুখের আশায় এসেছিলাম, এখন করোনার ঠেলায় সব মাথায় উঠেছে! সব জায়গায় আতঙ্ক! সব জায়গায় আনসার্টেনটি! পরিত্রাণের এক বিন্দু উপায় দেখছি না কোত্থাও! আর তুমি দেশে সবে লকডাউন ঘোষণা হতে না হতেই অস্থির হয়ে উঠলে! আছ তো নিজের বাড়ির মধ্যেই! মাস গেলে অ্যাকাউন্টে মোটা পেনশন ঢোকে নিয়ম করে। আমাদের মতো তো প্রাইভেট চাকরির ঝক্কি সামলাতে হয় না, বোঝো না তাই! এত এত টাকা মাইনে পাই সেটাই শুধু লোকে দেখে, এখন এই সাংঘাতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ লাইফস্টাইলটুকুই যে কিভাবে মেনটেন করব ভগবান জানে! টেনশনে আমার ঘুম উড়ে গেছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হয়ে গেছে সোমবার থেকে। তাও উঁচু পোস্টে আছি বলে কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিছু জমানো পয়সাকড়ি আছে। ক’টা দিন চলবে। কিন্তু তারপর! তাছাড়া যেভাবে আছি তাকে থাকা বলে! নো আউটসাইড লাইফ। সারাক্ষণ ঘরবন্দি দশা। জাস্ট পাগল পাগল লাগছে এখনই! তার ওপর তোমার এই কমপ্লেনের বহর! জাস্ট পোষাচ্ছে না! প্লিজ আন্ডারস্ট্যান্ড বাবা, তুমি একা আছ, ভাল আছ। সব নিয়মপত্তর ভাল করে পালন করতে পারবে। হ্যাঁ, মিনতি মাসি আর আসবে না বটে, তবে সেটা তোমার নিজের জন্যেই সেফ। তাছাড়া তুমি তো চিরকালই অ্যাকটিভ ছিলে! ইন ফ্যাক্ট, এই চক্করে দুদিন অন্তর ঘর ঝাড়পোঁছ করলে শরীরটাও ফিট থাকবে। রোজ তো বিকেলে হাঁটতে যেতে, তার বদলে এখন নাহয় এটাই করলে! এমনিতে তো কোনও মেডিক্যাল প্রবলেম নেই তোমার। ঘরোয়া এ কাজগুলো রয়ে সয়ে করলে তেমন স্ট্রেনও হবে বলে মনে হয় না। আর যেকোনও সমস্যায় অসীম তো আছেই। ওকে একটা ভিডিও কল করলেই হবে!”

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে সামান্য থামে শুভ। উল্টোদিকের অস্বস্তিটা সে যে বুঝতে পারছে না তা নয়। কিন্তু এ মুহুর্তে সম্পূর্ণ উপায়হীন সেও। করোনার প্রথম ঢেউ পৃথিবী জুড়ে সবে ফণা তুলতে শুরু করেছে। বস্টন শহরের প্রতিষ্ঠিত একটি মাল্টিন্যাশনাল মেডিসিন কোম্পানির রিসার্চ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্তা হওয়ার খাতিরে এ ঝড়ের গতিপ্রকৃতি এখনই আন্দাজ করতে পারছে সে। অচিরেই দুনিয়া জুড়ে তাণ্ডব চালাবে এই মহামারী। এখনই অচেনা এ ভাইরাসের চোখরাঙানিতে পশ্চিমি বিশ্ব প্রায় পর্যুদস্ত। উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্যসুরক্ষার সমস্ত গর্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আরও বড় সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে এ রোগের বিজয়রথ আর সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী সেই রথের চাকায় পদপিষ্ট হয়ে প্রতি মুহূর্তে পোকামাকড়ের মতো মরছে লক্ষ কোটি শিশু জোয়ান বৃদ্ধ। এই মুহুর্তে বরাতজোরে জীবিত থেকে যাওয়া বিশ্ব জোড়া সব মানুষই অসম এই যুদ্ধক্ষেত্রের একেকটি সামান্য বোড়ে মাত্র। খুব ভেবেচিন্তে ধীরগতিতে চাল চেলে চেলে যাদের খেলার শেষ অবধি টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে প্রাণপণে। এক মুহূর্তের আবেগপ্রবণ ভুল সিদ্ধান্তই কালান্তক মৃত্যু হয়ে নেমে আসতে পারে খাঁড়ার মতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারী গলায় এবার বলে শুভ,” শোনো বাবা, তোমার বয়স হয়েছে। একা থাকো। টেনশন হয়। বুঝি আমি। কিন্তু কী করব বল? হাতে তো কারুরই এখন আর কিছু নেই! ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে মঙ্গলবার থেকেই। দেশে ফেরার পথই বন্ধ! আর এর বাইরে দেশগুলোর সরকারের কাছেই বা কী বিকল্প ছিল বল! এ রোগের কোনও ভ্যাকসিন নেই! কোনও ওষুধ নেই! নিশ্ছিদ্র সাবধানতাটাই একমাত্র উপায়। আর যে হারে ভাইরাসটা ছড়াচ্ছে, এই মুহুর্তে যেটুকুও বা হাতে আছে পরিস্থিতি, তাই বাঁচানোর জন্য আমাদের সবাইকেই এবার মরণপণ লড়াইয়ে নামতে হবে। ইন্ডিয়ায় লকডাউন শুরু হয়ে গেছে বড় বড় মেট্রোগুলোতে। তোমার মফস্বলে এখন কেস পজিটিভ পেলে পাড়াগুলোকে বন্ধ করছে এক এক করে। মিনতি মাসি তো ওইজন্যেই আসতে পারছে না। আর নিশ্চিন্ত থাকো, কদিনের মধ্যে তোমার গোটা শহরও লকডাউনের আওতায় চলে আসবে। তাই বলছি, এখন থেকেই নিয়ম মানা শুরু করে দাও। কতদিন যে এভাবে একা একা থাকতে হবে কোনও ঠিক নেই। কেউই জানে না এর ভবিষ্যৎ। মনে জোর আনা ছাড়া তাই আর কোনও উপায় নেই বাবা। আর এ সত্যিটা যত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে তুমি, ততই সহজ হবে তোমার আগামীর বন্দিজীবন!”

********

হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন অমলেশবাবু। সাদা ঢেউখেলানো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে অলস চোখে তাকালেন বাইরের দিকে। এটা বাড়ির পেছনদিক। বহুকালের পুরনো একটা পুকুর আছে এদিকে। এখনও তার স্বচ্ছ জলে মাছ খেলা করে। পুকুরপাড়ের ছোট ছোট বস্তিঘরের ছেলেপিলেরা সকাল হতেই ছিপ নিয়ে বসে যায় পুকুর ঘিরে। ক্বচিৎ যখন ঝুড়িভর্তি ছোট মাছ ওঠে ছিপগুলোয়, দারুণ মজা সেদিন ছেলেগুলোর। এই মাছের ওপরেই ওদের নির্ভর। বাজার থেকে মাছ কেনে না ওরা। পুকুরটাকে খুব যত্ন করে তাই। আশেপাশের বড় ফ্ল্যাটবাড়িগুলো থেকে ময়লা কিছু ছুঁড়ে পুকুরে ফেলতে দেখলে চেঁচিয়ে পাড়া মাৎ করে। বারান্দার নিরাপদ আশ্রয় থেকে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখেন অমলেশবাবু। তাঁর বিপত্নীক একাকী জীবনে ক্ষণিক উত্তেজনার আঁচ লাগে। একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনে ঘাই লাগে ঝুপ ঝুপ।

অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল অমলেশ চক্রবর্তীর। দিন দশ পনেরো থেকে চেনা এই সব ছবিগুলোই উধাও হয়ে গেছে তাঁর জীবন থেকে। পৃথিবীজোড়া ভীষণ ছোঁয়াচে এক অসুখের ভয়ে গোটা পৃথিবীই আজ গৃহবন্দি। তাঁর জীবনে যে কটা মানুষের সঙ্গ ছিল এতকাল, সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে, তাও আজ হাপিশ। অভ্যেসমতো রোজ সকাল বিকেল চায়ের কাপ হাতে বারান্দার ইজি চেয়ারটিতে এসে বসছেন বটে এখনও, তবে পুকুরপাড় জুড়ে সেই চেনা মানুষগুলোর আর দেখা নেই। এখন পুকুরভরা মাছ আর পুকুরপাড় ঘেরা গাছপালায় পাখিদের খেলা শুধু। ঝিমধরা এ পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন নিয়ে আজ শুধু বেঁচে আছে যেন মনুষ্যেতর আবোলা এই জীবগুলোই!

হঠাৎই চোখের ওপর দিয়ে চকিতে যেন নীল বিদ্যুৎ খেলে গেল অমলেশবাবুর। সেই মাছরাঙাটা! চমকে জলের দিকে তাকাতেই অমলেশবাবু দেখলেন এক ছোঁ মেরে চোখের নিমেষে একদম নির্ভুল লক্ষ্যভেদে জলের একেবারে মধ্যস্থল থেকে একখানা বেশ বড় আকারের মাছ তুলে নিয়ে হুশ করে উড়ে গেল পাখিটা! স্তম্ভিত দৃষ্টিতে হাঁ করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন অমলেশবাবু। খানিক দূরের চৌধুরীদের নীল সাদা তিনতলা বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে যে ঝাঁকড়া আমগাছটা আছে তারই একটা ডালে বসে আয়েস করে সদ্য ধরা মাছটার সদগতি করছে ও এখন। বিস্মিত হয়ে কাণ্ডটা একমনে দেখতে থাকেন অমলেশবাবু। পাখিটা এ অঞ্চলে আছে বহুদিন। তিনি বছর পনেরো আগে এ তল্লাটে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসার পর থেকেই দেখে চলেছেন ওকে। পুকুর আর গাছপালা থাকার কারণে সাধারণ চড়াই শালিখ ঘুঘুর পাশাপাশি এই একখানা দারুণ উজ্জ্বল নীলরঙা মাছরাঙা প্রথম থেকেই নজর কেড়েছিল তাঁর। বড় সুন্দর পাখিটা। তবে একা। অন্য পাখিগুলো যেমন সবসময়ই দল বেঁধে থাকে, এটা তেমন নয়। কোনও জোড় নেই ওর। কোনকালে ছিল কিনা তাও জানেন না তিনি। তবে তাতে ওর দৈনন্দিনের জীবনে যে বিশেষ প্রভাব পরে না তা বেশ অনুভব করেন অমলেশবাবু। রাতে কখনও খেয়াল করেননি, তবে ওর দিনের বেলাটা ভারী নিয়মে বাঁধা। পুকুরঘেরা এই সবুজ চৌহদ্দিটুকুই ওর দুনিয়া। এর মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আম, কাঁঠাল, সুপুরি, নারকেল আর কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে পাতায় নেচেকুঁদে ওর দিন কাটে। আর ওর সারাদিনের কাজের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটা হল খাদ্য সংগ্রহের পর্ব। যতই এ ডালে ও ডালে উড়ে বেড়াক ইতিউতি, ওর মন কিন্তু সবসময় পড়ে থাকে জলের দিকেই। আর মাছের চলাফেরায় পুকুরের ওপরের জলস্তরে সামান্যতম স্পন্দনও জাগে যখনই, গাছের ডালপাতার ফাঁকে স্থির হয়ে আসে ওর সমস্ত উচ্ছ্বাস। কী ভীষণ একাগ্র দৃষ্টি তখন ওর! এক মুহুর্তও জল থেকে চোখ সরায় না সেই মুহুর্তগুলোয়। দম চেপে চরম ক্ষণের প্রতীক্ষা করতে থাকে নিঃসাড়ে। তারপর ঠিক সময় সুযোগ বুঝে তড়িৎ গতিতে উড়ে এসে এক ছোবলে চোখের পলকে শিকার তুলে নিয়ে যায় জলের এক্কেবারে মধ্যিখান থেকে। এরপর তরিবৎ করে খাওয়ার পর্ব। আর তারপর আবার পূর্ববৎ গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো। এরপরে আবারও যখন কখনও তরঙ্গ উথলে ওঠে জলের বুক চিরে, তীক্ষ্ণ শিকারী সত্তাখানা পুনরায় জেগে ওঠে ওর বুকেও। অতঃপর সেই একই ঘটনার পূঙ্খানুপূঙ্খ পুনরাবৃত্তি।

দিন আসে। দিন যায়। মাছরাঙার গল্প বদলায় না। ব্যত্যয়হীন নিয়মের বাঁধনে এক সুরে রিনরিন করে বেজেই চলে নিরন্তর। আপনভোলা একাকী কোনও বৈরাগীর মতো আপন আনন্দে বিভোর হয়ে আপন নিয়মমতে দিনের পর দিন পাখিটা ওর একান্ত জীবন কাটায় নিশ্চিন্তে।

অমলেশবাবুর কপালে ভাঁজ পড়ে হঠাৎই। তাঁর আর মাছরাঙাটির জীবনে তেমন তফাৎ নেই তো তাহলে! গত বছরের মাঝামাঝি হঠাৎই শৈল চলে যাবার পর থেকেই যে প্রায় একাকী জীবন যাপন করে চলেছেন তিনি, সারাদিন ধরে একের পর এক মোটের ওপর নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলেছেন নিজের অজান্তেই, ভেবে দেখলে তার সাথে এ পাখিটির রোজের অভ্যেসের তো বেশ মিল! হঠাৎই মনে মনে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন অমলেশবাবু। খাপে খাপে পাখিটার সঙ্গে অনেকগুলো মিল অভাবিতভাবে বসতে শুরু করতেই তাঁর এ ক’দিনের মনমরা ভাবটা বুঝি অজান্তেই কেটে যেতে থাকে তির তির করে। আগে রোজকার নিয়মবাঁধা জীবনের ফাঁকে পড়ে পাওয়া যে সময়টুকু কেটে যেত পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করে, তাদের রোগভোগ আশানিরাশার গল্প শুনে, ভেবে দেখলে এখনও সে সময়টুকুই একমাত্র অতিরিক্ত তাঁর। ছেলে তো দেশে আসত এমনিতেই বছরে একবার, শীতের ছুটিতে। তা বাদে জীবন তো তাঁর একাকীই ছিল। স্ত্রী শৈল শিক্ষিকা পদ থেকে অবসর নিলেও জড়িয়ে ছিল নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। ভারী সুন্দর আবৃত্তি আর শ্রুতিনাটক করত ও। তাই রোববারগুলোয় প্রায় পাওয়াই যেত না ওকে। অন্যান্য দিনেও হাজারো ব্যস্ততায় দ্বৈতজীবনের যাপনে ছেদ পড়ত মাঝেমধ্যেই। তা নিয়ে অবশ্য কোনকালেই বিশেষ ক্ষোভ ছিল না অমলেশবাবুর। তাঁর একখানা একেবারে নিজস্ব জগৎ ছিল বরাবর। বইয়ের পোকা ছিলেন ছোট থেকেই। অবসরের পরও অনেকটা সময় বাংলা আর ইংরাজী সাহিত্য পড়েছেন নিয়ম করে। তবে পরের দিকে চোখ অপারেশনের পর যে পড়ার অভ্যাসে ছেদ পড়ল হঠাৎ করে, কেন যেন তা আর পরবর্তীতে গড়েই উঠল না সেভাবে।

হঠাৎই যেন অনেকদিনের শীতঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন অমলেশবাবু। চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠেই দ্রুত পায়ে চলে এলেন শোবার ঘরে। খাটের ডানদিক ঘেঁষে পাঁচ থাকের বড় সেগুন কাঠের বইঠাসা একটি আলমারি। শেলফের কাচ সরিয়ে একদৃষ্টে অমলেশবাবু চেয়ে থাকেন তাঁর বহু সাধের সার সার বইগুলোর দিকে। পুকুরপাড়ের মাছরাঙাটার মতোই একমুখী পলকহীন নজর তাঁর এখন। সমস্ত মন জুড়ে তিন মহাসমুদ্রের উথালপাথাল। বহুকাল হাত পড়ে না বইগুলোতে। শুভর কাছে একাকীত্বের ভয়ে কেন যে এত উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন এতদিন, বুঝেই পাচ্ছেন না এখন! আজ দৈবদুর্বিপাকে মনুষ্যসঙ্গ অপ্রতুল হয়ে উঠল বলে যে এত অস্থির বোধ করছিলেন, এগুলির সঙ্গের কথা তো তখন ভুলেই গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ! যে ক’টা দিন জীবনে এখনও পড়ে আছে, নিজের সাথে নিজের মনের মতো করেই তো কাটাতে পারেন তিনি অনায়াসে! লোকসঙ্গে তাঁর আগে সময় কাটত বটে, তবে চিরায়ত আনন্দ কি তাতে আদৌ কোনদিন বোধ করেছেন অন্তরে? তাহলে যা শাশ্বত নয়, চিরন্তন নয়, তার জন্য এত কাতর হচ্ছিলেন কেন?

হঠাৎই মনের ভেতরটায় যেন অদ্ভুত একপ্রকার জোর অনুভব করতে লাগলেন অমলেশবাবু। এই ভীষণ অন্ধকারেও অকস্মাৎ যেন আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছেন তিনি অবশেষে। শুভ ঠিক গুছিয়ে বোঝাতে না পারলেও মোটের ওপর ঠিকই বলেছিল। অকারণ আতঙ্কে না ভুগে, টিভি ও পরিচিত বন্ধুবান্ধব শুভাকাঙ্খীদের নেতিবাচক কথার স্রোত আর পাল্টা স্রোতে হাবুডুবু না খেয়ে বরং নিজের দিকেই নাহয় শেষবারের মতো ফেরা যাক এবার। রোজকার জরুরি কাজকর্মের অভ্যেস আর নিয়মের ফাঁক গলে যেটুকু অবসর পড়ে রইল এখনকার এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির ফলে, নিজের একান্ত প্রথম প্রেমের কাছেই নাহয় অবশেষে সমর্পিত হোক নিঃশেষে!

********

শুভর সঙ্গে কথা বলে এসে বারান্দায় আয়েস করে বসলেন অমলেশবাবু। করোনা ঝড়ের তেজ এখন তুঙ্গে। তবে তাঁর নিয়মবদ্ধ নিশ্চিন্ত জীবনে তার প্রভাব প্রায় শূন্য। সময় কাটানোর ছন্দটা ধরে ফেলেছেন তিনি এতদিনে। জরুরি কাজগুলোর বাইরের সময়টুকুও এখন ভরা তাঁর।

হঠাৎই চোখের ওপর দিয়ে নীল বিদ্যুৎ খেলে গেল অমলেশবাবুর। সেই মাছরাঙাটা আবারও! এদিকের আমগাছের ডাল ছেড়ে এক জোর উড়ান দিয়ে ওপাড়ের নারকেল গাছটার দীর্ঘ ঝিরিঝিরি পাতায় বসে আনমনে দোল খাচ্ছে আরাম করে।

ঠোঁটের কোণে একটা স্মিত হাসির আভাস ছড়িয়ে পড়ে অমলেশবাবুর। বাদামি মলাটের মোটা পুরনো বইটা খুলে পেজমার্ক দেখে নির্দিষ্ট পাতায় এসে থামেন তিনি। দ্য লাস্ট লিফ। ও হেনরির ছোটগল্প সংকলনের তেত্রিশতম গল্প। এ গল্পটাই আজ পড়বেন তিনি। গত এক সপ্তাহ ধরে এ বইটিই তাঁর অবসরের সঙ্গী, তাঁর বহুযুগের ইংরাজী সাহিত্যপাঠের প্রথম প্রেম। মুহুর্তে চারপাশ ভুলে বইতে ডুবে যান অমলেশবাবু। অবশেষে দিনের ক্ষণ গুণে গুণে এক শাশ্বত আত্মমগ্ন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। এক অমৃত সুখময় জীবন। এক মাছরাঙা জীবন।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes