
কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১১
মেধার দাসত্ব ও দাসত্বের মেধা
রূপশ্রী ঘোষ
মেধার জয় সর্বত্র। কিন্তু এখন দেখছি মেধার বিকৃতিও সর্বত্র। কেন এমন হচ্ছে? কেন একজন সন্দীপ ঘোষ তৈরি হচ্ছে আমাদেরই এই সমাজে? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে জীবন ধন্য হবে, এই বুলি শুনতে শুনতেই তো আমরা বড় হয়েছি। আদাজল খেয়ে জয়েন্ট দিচ্ছি। আবার বিজ্ঞানে যারা অতিরিক্ত ভালো ফল করছে তারা অন্য বিষয়ের লোককে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করছে। 'তুমি আবার কী করো' ? যেন সাহিত্য বুঝতে মেধা লাগে না। শিল্পী হতে, কবি হতে, চিত্রশিল্পী হতে মেধা লাগে না? একজন কৃষকেরও যে মেধা আছে, তা একজন ইঞ্জিনিয়ারের নাই থাকতে পারে। তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানে ভারি হলেই সে জ্ঞান প্রজ্ঞা আনে না। বোধ আনে না। কিন্তু এই যুগ কি তবে শুধুই খড়বোঝাই মস্তিষ্কের জন্য? এলিয়ট কথিত ' Leaning together/ headpiece filled with straws'? কিন্তু তার ফলে কি হয়? সেই কবিতাতেই পেয়েছি আমরা 'Shape without form, shade without color, paralyzed force, gesture without motion'...এরকম লাখো লাখো সন্দীপ ঘোষে ছেয়ে আছে সারা ভারতবর্ষ। কীভাবে পরিবর্তন হবে সমাজব্যবস্থার? লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ এবারের কিঞ্চিৎ পরচর্চায়।
স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী
আমরা কি আর বইতে পারি?
এও কি একটা শাস্তি নয়?
কষ্ট হয়, কষ্ট হয়!আমার কষ্ট বুঝতে চাও
দোহাই পড়ার চাপ কমাও
কষ্ট হয়, কষ্ট হয়।।
প্রত্যেকেরই জানা এটি কবীর সুমনের গান। নয়ের দশকের শেষ দিকের। কিন্তু গানটা আমার প্রথম শোনা দু হাজার এক দুই সালে। বরানগরে আমার স্যারের বাড়িতে থাকার সময়। বাড়িটার ঠিক উল্টোদিকেই বান্টিদের বাড়ি। বান্টি তখন ছ সাত বছরের ফুটফুটে বাচ্চা। মিষ্টি হেসে খুব জোরে জোরে জানলার রড ধরে দাঁড়িয়ে এই গানটা করত। শুনেই ভালো লাগায়, ওকে যখনই বলেছি গাইতে ও গেয়ে শোনাত। বলত, এটা আমাদের স্কুলে করায়। অবাক হতাম স্কুলেরই ব্যাগের চাপ আবার স্কুলই করায়। ‘যাক আত্মসমালোচনা ভালো’ এটাই ভাবতে হত। তাতে যদি কিছুটা হলেও লাভ হয়। গান করিয়ে বান্টির স্কুলের ব্যাগের ভার কতটা কমেছিল জানি না কিন্তু গানটা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। এখন বান্টির খবর জানা হয়নি, কিন্তু বান্টি জানে না আমাদের ছোটোবেলার স্কুলের ব্যাগ ভারি ছিল না। গ্রাম শহর মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের স্কুলগুলোতে তো একই হওয়ার কথা, কিন্তু ওই আটের দশকে যখন সবে সবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো গজিয়ে উঠছে সেই সমস্ত স্কুলের কথা অজানা। এ লেখা পড়ে কেউ হয়তো জানাবেন আশাকরি। আর ওই সময়ে যারা একটু বেশি মেধাবী বলে পরিচিত ছিল তাদের অভিভাবকরা হয়তো একটু আধটু অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজির মতো বই বেশি পড়ানোর চেষ্টা করতেন। আর অবসর বিনোদনের জন্য এক্সট্রা বই বলতে গল্পের বই তো ছিলই। বেশিরভাগেরই পড়ার চাপ বলে বোধহয় কিছুই ছিল না। একটা রুটিন জীবন, সকালে কিছুটা পড়া তারপর স্কুল যাওয়া ফিরে এসে খেলার মাঠ সন্ধেবেলা আবার পড়া রাত হলে খেয়ে ঘুমোনো। গান, আঁকা, সাঁতার ইত্যাদি প্রভৃতি থাকলে আলাদা কথা। তবে সেগুলো শহরের জন্য প্রযোজ্য। গ্রামে অতটা ঘরে ঘরে এসব ছিল না। এখন আমরা অভিভাবকের ভূমিকায়। স্কুলের ব্যাগের ভার দেখে রাগ হলেও কমাতে পারি না। কারণ আমরা সবাই চাই ছেলেমেয়েদের মূর্খ করে না রেখে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করে পণ্ডিত করে তুলতে। কে কতটা পণ্ডিত হয় সে প্রসঙ্গ অন্য আর একদিন। কিন্তু বিদেশি ভাষাটা স্বচ্ছন্দে বলতে লিখতে পারলে যে মূর্খ বলে পরিচিত হবে না এ ব্যাপারে একশোভাগ নিশ্চিত। বিশেষ করে বাংলা মাধ্যমে পড়া বাঙালি বাবা মায়েরা আমরা যারা হোঁচট খাই তারা তো একেবারেই চাই না, ছেলেমেয়েরাও আমাদের মতো হোঁচট খাক। বাংলা মাধ্যমে পড়া ইংরেজি পন্ডিতদের সরিয়ে রাখলাম। ইংরেজি মাধ্যমের আবার বোর্ড অনুযায়ী ব্যাগের ভার কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে অকপটে স্বীকার করতে লজ্জা নেই এখনকার বাংলা মাধ্যম স্কুলের ব্যাগের ভার কতটা সত্যিই জানা নেই। এ লেখাটা লেখার আগে জানার সুযোগ থাকলেও জেনে নিলাম না। এও এক অক্ষমতা।
পড়ার চাপে চেপ্টে গিয়ে,
কী করব এই শিক্ষা নিয়ে?
অমুক হও, তমুক হও, অমুক হও, তমুক হও
কেউ বলে না মানুষ হও।
একথা তো ঠিক যে, অমুক তমুক একটা হতেই হয়। নাহলে ভাত জুটবে কীভাবে। তাই আমরা কিছু না কিছু সত্যিই হওয়ার চেষ্টা করি। আমরা অভিভাবকরা সবাই কিনা জানি না তবে অনেকেই পড়ার চাপের পাশাপাশি মানুষ হওয়ার কথা কিন্তু বলি। অন্তত ফেসবুকে তো দেখাই যায়, বাচ্চার জন্মদিনে বড়ো একটা পোস্ট দিয়ে তারপর শেষে লেখা হয় ‘সবার আগে ভালো মানুষ হও’। এখন প্রশ্ন হল মানুষ মানে কী? মানুষের মতো কেবল দেখতে? নাকি আরও অন্যকিছু। মানুষের মতো দেখতে হয়েই তো আমরা সবাই জন্মাই। আবার এও জানি দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ। এই দুটোর কোনো একটা প্রকট হলে সেই অনুযায়ী মানুষের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। তাইতো? তাহলে গুণ বেশি দোষ কম হলে মানুষ আর গুণ কম দোষ বেশি হলেই অমানুষ? জানা নেই। প্রত্যকে মানুষ যা চান তা অনেকটা এরকম, বাবা, মা, বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি নূন্যতম সম্মান, শ্রদ্ধা, ভদ্রতা, নম্রতাটুকু অন্তত থাকবে। কথায় কথায় মিথ্যে বলা, দুর্বিনীত ব্যবহার, মানুষকে অশ্রদ্ধা, অপমান, অসম্মান এসব না করা এটুকুই মনে হয় পরস্পরের প্রতি পরস্পরের চাওয়া থাকে। এবং পরিচিত মানুষ অচেনা বেরিয়ে পড়লে, সেই মানুষটার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে নিয়ে তখন ভাবতে খুব অসুবিধা হয়। মানুষ আর নিজেকেই তখন বিশ্বাস করতে পারে না। এই যেমন সন্দীপ ঘোষ সম্পর্কেই বলা যাক। আমার পরিচিত এক ডাক্তার বন্ধু, ওনারই ফ্যাকাল্টি। বললেন, ভাবতেই পারতাম না এতদিন স্যার ওরকম। তোমরাও যেমন টিভিতে দেখছ আমরাও তেমন দেখছি এবং অবাক হচ্ছি। একরকমভাবে চেনা মানুষ নিয়ে অন্যভাবে চিনতে বা গোল গোল চোখ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে আমরা কেউই বোধহয় চাই না। তবে একথা ঠিক, এই সন্দীপ ঘোষ প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে, আনাচে কানাচে, প্রতিটি ঘরের কোথাও কোথাও হয়তো ঘাপটি দিয়েই আছে। তাদের প্রত্যেককে চিনিয়ে দিলে সমাজ উপকৃত হবে। সাময়িকভাবে পরিচিত লোকের ব্যাপারটা মেনে নিতে অসুবিধা হবে, মন ভেঙে যাবে, নিজেরা হতাশ হবে তবুও এটা করা দরকার। কারণ এখান থেকে সমাজের দুটো দীর্ঘমেয়াদি উপকার হতে পারে। এক – সেই মানুষগুলোকে চিনিয়ে দিলে তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা যাবে এবং তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবে খারাপ কাজ করলে এমন কঠিন শাস্তি পেতে হয়। তা থেকে হয়তো শিক্ষা নিলেও নিতে পারে। সবাই নেবে বলা যায় না। তাহলে সত্যিই তো সমাজের আর খারাপ দিক বলেই কিছু থাকবে না। সেটা নির্মূল না হোক কমতে তো পারে কিছুটা হলেও। এটার জন্যই চিনিয়ে দিয়ে স্টেপ নেওয়া উচিত। তাহলে মানুষ অমানুষের সংজ্ঞা লিখতেও সুবিধা হবে। নাহলে অভিভাবকের ভূমিকায় থেকে সন্তানের যেকোনো খারাপ দিক দেখাটা বোধহয় খুবই কষ্টের। যদি অভিভাবক হিসেবে একটু হলেও বোধ থাকে। দুই – খারাপ কাজ করার আগে এমন কঠিন শাস্তির কথা মনে রেখে ‘না বাবা খারাপ কাজ করব না তাহলে ভুগতে হবে’ এমন শুভ বুদ্ধির উদয় হয় তাহলেও লাভ। মুশকিল হল যারা ভাবে খারাপ কাজে ঠাকুর পাপ দেবে তারাও করছে, আর যারা নিজেদের নাস্তিক বলে দাবি করে তারা ঠাকুর কেন কোনো মানুষের অস্তিত্বই তো স্বীকার করে না। অতএব এ বড়ো গোলমেলে ব্যাপার ওই অমুক তমুক হওয়াই বহাল থাকবে ‘মানুষ’ হওয়া বলতে যা বোঝায় তা হাতে গোণাই হবে। এই সমাজের ভবিতব্য মনে হয়। এমন অনেক শিক্ষিত পরিবার বা বন্ধু সঙ্গ আছে যা ভালো মানুষকেও খারাপ করে দিতে পারে। দেয়ও। কথাতেই আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। এমন অনেক সর্বনাশ কম-বেশি আমরা সবাই দেখি। আরো দেখতেও হবে হয়তো।
এত্ত রকম পরীক্ষায়
আমার খালি কান্না পায়,
কে করল রে এ নিয়ম?
লোকটা বোধ হয় খেলার যম!
খেলবে কেন, অঙ্ক করো,
যোগ্য হবার রাস্তা ধরো।
সত্যি পরীক্ষা ব্যাপারটা খুব খারাপ। আজকালকার বাচ্চাদেরও আমার মতো খুব কান্না পায়। মনে আছে জার্মানিতে জার্মান পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগেও বমি করতাম। পরীক্ষা ব্যাপারটায় এতটাই ভীতি ছিল। বাচ্চাদেরও দেখছি ভয়, টেনশন করতে। এখন আমার ছেলের যেমন মনে হয় পরীক্ষা তুলে দেবে সে বড়ো হয়ে, আমারও মনে হত আমার হাতে উপায় এলে আমিও পরীক্ষা তুলে দেব। কিন্তু শিক্ষকের ভূমিকায় থেকে তা মোটেই মনে করছি না। কোনো কোনো বিষয়ে ছাত্রীর ভূমিকায় থেকেও তুলে দিতে চাই না। কারণ কোনো বিষয়ে একজন যোগ্য মানুষ নির্ধারণে বোধহয় পরীক্ষার মতো মাপকাঠি দরকার। যদিও সবক্ষেত্রে তা কাজ দিচ্ছে না। জ্যাঠা, কাকা, মামা, বা লাইন করার পদ্ধতি দিয়ে বহু বেনোজল আজ সর্বত্র বিরাজ করছে। সেইসময়গুলো ভালো ভালো ছাত্রছাত্রীদের হতাশা জন্মাচ্ছে। মেধার মৃত্যু বলা যায়। অনেকে এর জন্য আত্মহত্যাও করেছে। এটা একটা যেমন খারাপ দিক আবার অন্য আর একটা খারাপ দিক হল অতিরিক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি। বর্তমানে স্কুল কলেজে প্রজেক্ট, ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট, থিওরি হেনা তেনা মিলে পরীক্ষার সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, তারা আদৌ কিছু শিখছে কিনা তা নিয়েও সর্বত্র সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। কারণ এখন এইসব প্রজেক্ট, ইন্টারনাল সবই স্কুল কলেজের নিজেদের হাতে নম্বর, এটার ফলে তো ছাত্রছাত্রীদের সর্বনাশ আরও বেড়ে গেছে। উমুক স্কুল, উমুক কলেজ তাদের ছেলেমেয়েদের বেশি নম্বর দিলে আমাদেরগুলো তো পিছিয়ে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে পরস্পর প্রতিযোগিতায় ছাত্রছাত্রীরা আজ গিনিপিগ। এবং ঘন ঘন পরীক্ষার ফলে একটা সিলেবাসও ঠিকমতো তারা শেষ করতে পারছে না। ইনফ্রাস্ট্রাকচার, শিক্ষকের সংখ্যা সেসব নিয়েও একদিন আলাদা করে লেখা হবে। এখন মূল কথা হল যাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছে আছে তারা কিছুটা হলেও শিখছে আগে যা হত এখনও তাই। আর পাশ করিয়ে দিতেই হবে এই চাপ থাকার জন্য বেশিরভাগই কিছুই প্রায় শিখছে না। তাহলে কী দেখা যাচ্ছে একদল হল খুব মেধাবী, একদল মাঝারি মানের আর একদল একেবারেই নিম্নমেধার। এই দল আবার তিনভাগে কাজ করতে পারে। মেধাবীদের মধ্যেই অনেকে সন্দীপ ঘোষ, মেধাবীরা নিম্ন মেধাদের দিয়ে করাবেন গুণ্ডামির মতো কাজগুলো আর মাঝারি মানেরগুলো কেবল রাস্তায় নেমে মোমবাতি হাতে হাঁটবে। চিৎকারও করবে। এই হল অঙ্ক শিখে যোগ্য রাস্তা চিনে নেওয়া। এই হাঁটার মধ্যেই আবার মধ্যমেধার বহু প্রতারকও পাবেন। কিছুটা হলেও তো অঙ্ক শিখতেই হয়, তাই যে যেভাবে পারে তার ভিতরের প্রবৃত্তিকে কাজে লাগায়।
কোথায় রাস্তা কোথায় যাবো?
কোথায় গেলে শুনতে পাবো
একটু পড়া, অনেক খেলা
গল্প শোনা সন্ধ্যেবেলা।
রাতের হাওয়ায় বুকের কাছে
স্বপ্ন দেখার গল্প আছে।।
এই লাইনগুলো হয়তো আট, নয়ের দশকের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য নয়। কারণ আমাদের তখন খেলা, গল্প শোনা, গল্প পড়া সত্যিই অনেক বেশি ছিল। এত পড়ো পড়ো খুব বেশি অভিভাবক করতেন বলে মনে হয় না। গ্রামে তো আরো কম। কারণ বেশিরভাগ বাবা মা ছিলেন হয় অশিক্ষিত নয় অল্প শিক্ষিত। তাঁরা খুবই চাইতেন ছেলেমেয়ারা লেখাপড়া করে কিছু একটা হোক, কিন্তু অত জোর দিতেন বলে মনে হয় না। গ্রাম থেকে ভালোকিছু পদের অধিকারী যাঁরা হয়েছেন বা হয়েছে তাঁরা তাদের নিজেদের চেষ্টাতেই। আর তখনকার বাবা মা’দের এত সময়ও থাকত বলে মনে হয়ে না ছেলেমেয়েদের পিছনে টিকটিক করার মতো। ব্যবসায়ী বা চাষিবাসি একান্নবর্তী পরিবার হলে তো কথাই নেই। তাদের বাড়ির লোকজনের জন্যে তিনবেলা খাবার তৈরি করা এবং অন্যান্য কাজ মিলিয়ে নিজেদের জন্য তো সময় বলেই কিছু থাকত না। তখন হয়তো দু একটা হাতে গোণা ফ্যামিলি থাকত, যাঁরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পিছনে সময় দিতেন বা নিজেরা না পারলে প্রাইভেট টিউটর দিতেন। এখনকার মতো প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা না হলে কিছুটা দিতেন। নয়ের দশক থেকে গ্রামে প্রতিটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা প্রাইভেট টিউটরের চলটা শুরু। তারপর বেড়েছে। শহরের ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই কেমন ছিল আমার অজানা। আবারও বলছি যাঁরা এ লেখা পড়বেন তাঁরা হয়তো এ বিষয়ে আলোকপাত করবেন। গল্প তো আমরা অনেক শুনেছি, বিশেষ করে ঠাকুমাদের থেকে। গরমকালের সন্ধেবেলা উঠোনে মাদুরে শুয়ে সাঁতরাবুড়ির গল্প শোনা, বিকেলবেলা গুছাইত ঠাকুমা, ঘোষেদের ছোটো ঠাকুমার গল্প শোনার পাশাপাশি থাকত প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত ক্লাসের মাস্টারমশাইদের বলা গল্প। আমরা ছোটোরাও এক একজন এক একটা করে গল্প বলতাম, যে যেটা জানত। পরবর্তীকালে সেসব গল্প বাচ্চাদের কাছেও বলেছি। আর কয়েকটা সূত্র দিয়ে ক্লাসে গল্প লিখতেও তো বসিয়ে দিতেন ক্লাস টিচার। কিন্তু আজকালকার বাচ্চারা খেলার টাইম হয়তো খুব বেশি পায় না কারণ তাদের বহু জিনিস শিখতে হয়। তার মধ্যেও যতটুকু পায় তাতে তারা আউট ডোর গেমের থেকে মোবাইল গেমটা বেশি খেলে। কেবল শহরে নয় এটা গ্রামেও। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আগের মতো আর লোকো-খেলাগুলো খেলে না। বা মাঠেও বিকেলে ক্রিকেট, ফুটবল, চিকে ইত্যাদি খেলাও আজ কমে গেছে। শহরের ছেলেরা তাও সুইমিংপুলে নিয়ম করে সাঁতার শেখে গ্রামের পুকুরগুলোয় রাসায়নিক সার দিয়ে মাছ চাষ করা হয় বলে বা জলগুলো খারাপ হয়ে গেছে বলে পুকুরে দাপাদাপিও নেই আর। ঘরে ঘরে বাথরুম থাকাটাও একটা বড়ো কারণ। তাই গ্রামের অনেক ছেলেমেইয়েই এখন সাঁতার জানে না। যা শহরে জানে। রাতের পাখার হাওয়ায় বা এসি ঘরে স্বপ্ন দেখার সুযোগ এখনো সবারই আছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখার বিষয়টাই হয়তো বদলে গেছে।
আমরা বড়োরা নিজেরাই আগামীদিন কী আসছে জানি না ভেবে বাচ্চাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই তাদের সবরকম প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দিই। তোমাদের জীবনে লড়াইটা অনেক কঠিন হবে বলে। কারণ আমাদের সময় আর তোমাদের সময় এক নয়। আমাদের ষাট শতাংশ নম্বর তুলতে রীতিমতো কালঘাম ছুটতো। তোমাদের সবাই প্রায় একশো শতাংশ নম্বর হেসেখেলে পেয়ে যাচ্ছে। অতএব এই হেসেখেলে নম্বর পাওয়ার জন্য লড়াইও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ অ্যাকাডেমিক স্কোরের যোগ বিয়োগ গুণ ভাগে এগিয়ে থাকলে তবেই ভালো কোথাও কিছু করার চান্স পাবে। এটা তখনও ছিল। কেবল শতাংশের দাবিটা এত উচ্চ ছিল না। খুব ভালো ছাত্র ছাত্রী মাত্র এক শতাংশ নম্বর পরীক্ষায় কম পেয়েও আজীবন আফসোস করে যায়। এই উদাহরণগুলোর দিকে আঙুল তুলেই আমরা বাচ্চাদের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিই। অভিভাবক হিসেবে আমার অন্যান্য বন্ধুদের মতো আমি পড়ার চাপ খুব যে দিই তা নয়, কিন্তু একেবারে প্রচণ্ড চাপ দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা করি না। উলটে বলি, নিজে যা চাও পেশায় তাই হোয়ো কিন্তু মানুষ হও, অন্যান্য মানুষদের সম্মান করো এটা সবার আগে শেখা দরকার। অমুক হও তমুক হও’য়ের আগে যা হওয়া দরকার সেটা বলি। সব অভিভাবকই হয়তো বলেন, কিন্তু তা কতটা ফলে বা ফলবে তাও দেখা সময়েরই অপেক্ষা। যে সমস্ত অভিভাবকরা সময় পেয়ে আজ দেখছেন তাঁদের সন্তান কোন ভূমিকায় এবং আদৌ মানুষ হয়েছে কিনা তাঁদের ভালোলাগা খারাপ লাগার উপলব্ধি নিশ্চয়ই সেই সমস্ত বাবা মা’দের নিজের নিজের কাছে আছে। আবার এমন বাবা মা’ও তো আছেন যাঁরা মানুষ হওয়ার পাঠটা দেনইনি বা দিলেও বাচ্চা নেয়নি বা নিলেও বড়ো ঠিক নিজের মতো নিজেকে বদলে নিয়েছে। তাই অনেকেই জানেন না তাঁদের ছেলেও আজ সন্দীপ ঘোষ কিনা। আবার এমন অভিভাবকও সমাজে কম নেই যাঁরা সন্তানকে সন্দীপ ঘোষ হতে সাহায্য করেন। আসলে সন্তান স্নেহ বিষম স্নেহ। মেধাবী ছাত্র হয়েও আজ ‘সন্দীপ ঘোষ’ একটা গালাগালিতে পরিণত হয়েছে। এটা তাঁর অভিভাবকের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যের।
-
কিন্তু সন্দীপ ঘোষের মা থেকে শুরু করে এমন বহু দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রতারক বা সন্ত্রাসবাদী মানুষদের মায়ের কেমন লাগছে বলা মুশকিল। আশঙ্কা নিয়ে বাঁচা বলেই এই ভাবনা। তবে এই সন্দীপ ঘোষের মতো লোক ধরতে যদি প্রতিটা কর্মক্ষেত্র স্টেপ নেয় এবং তাদের আলাদা করে শাস্তি দেয়, তারপর সেই অভিভাবকদের মনের অবস্থা নিয়ে একটা সার্ভে করা যেতে পারে। যেভাবে মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো তিলোত্তমার মতো অভিভাবকদের কাছে ছুটে যাচ্ছে তাঁদের মনের অবস্থা জানতে, ঠিক তেমনটা। সত্যিই তো পড়ার চাপে চেপ্টে গিয়ে কী লাভ যদি বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাইয়ের মতো জীবনটা ষোলো আনাই ফাঁকি হয়? জীবনের শেষ পরিণতি তো সেই মৃত্যু মাঝের যে কটা দিন পাওয়া সে কটা দিন প্রতারণা না করে, মিথ্যে বলেই সারাজীবন কাটিয়ে না দিয়ে সমাজের কাছে একটু ভালো উদারণও তো হওয়া যায়। ভালো উদারহণ হিসেবে যদি কেবল মুখোশ থাকে, এবং মুখোশ খুলে যাওয়ার পর সেই মানুষটার চারপাশের সবার চোখের পর্দা সরে যায় সেটা খুবই কষ্টের। কিন্তু কী আর করা মুখোশ তো একদিন না একদিন খোলেই… যেভাবে সব খুলছে একের পর এক। সবই সময়। আসলে লোভ এবং প্রতিহিংসা খুব গোলমেলে বিষয়। লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ আজ অনুচিত কাজ করে বসে। লোভেরও রকমভেদ আছে। ক্ষমতা, যৌনতা, অর্থ, লালসা, কামনা এর যেকোনোটাই থাক না কেন তা কোনোদিন কোনো ভালো মানুষ গড়তে পারে না। পারা অসম্ভব। তাতে যত মেধাবী মানুষই হোক না কেন। ওই আবার, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপের মতো রচনা লেখার মতোই ব্যাপার। তুমি মেধাকে কোন কাজে লাগাবে। ‘মেধা’ শয়তান, ধূর্ত, চালাক, ঠক, প্রবঞ্চক, প্রতারক যেমন তৈরি করে আবার নোবেল প্রাইজ আনতেও সাহায্য করে। মধ্যমেধার ভালো মানুষও কম করেনি। আপনি কোনটা বেছে নেবেন আপনার ব্যাপার। মেধা মৌনতাও তৈরি করতে পারে, যৌনতাও। একাগ্রও করতে পারে, আবার জীবনানন্দের ভাষায় যৌন-একাগ্রও। কিন্তু মেধা যদি মানূষকে যেন তেন প্রকারেণ ভোগবাদী, অর্থলিপ্সু করে তোলে, তাহলে সেই মেধা কি আদৌ মেধা?
তাহলে দেখা গেল ‘মেধা’ সন্ত্রাসবাদী, দুর্বিনীত, অহংকারী আরও নানান বিশেষণের মানুষ তৈরি করে। একবার গুগল সার্চ করলে বিখ্যাত বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদীদের মেধা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যায়। স্কুলের ব্যাগ ভারি না হলেও ভিতরে যদি মেধা থাকে তা দিয়ে সত্যিই অনেককিছু বদলে দেওয়া সম্ভব। আত্মদীপ ভব। দীপ কে কীভাবে জ্বালাবে সত্যিই তো তার তার নিজের হাতে। কারণ গভীর অন্ধকারে একটা জোনাকিও সুখের আলো জ্বালায়। রাতের হাওয়ায় বুকের কাছে স্বপ্ন দেখার গল্প কিন্তু এখনও আছে। গল্প শোনার অভ্যেস হোক। আর মানুষ যখন ছোটো, তখন থেকেই তাদের মনে বিষাক্ত জিনিসের বদলে অন্য ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হোক। আমরাই তৈরি করহি এক অবদমিত মেধাসর্বস্ব, বোধহীন, লিঙ্গসর্বস্ব, লোভী, হিংসুটে, অশিক্ষিত একটি জাতি। এরা তো নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। শেষে পড়ে থাকবে কারা? মেধা এবং বোধ শেষে কিছু মানুষের নস্টালজিয়ায় পরিণত হবে না তো?

