
কিঞ্চিৎ পরচর্চা
পর্ব-৩
রূপশ্রী ঘোষ
কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ৩
আর মাত্র আশি দিন বাকি? কীসের? যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝেছেন। হ্যাঁ, পুজো আসছে। প্রথম কথা কলকাতায় বসে আপনার মনে হবে ইংল্যান্ডের পুজো মিটিং জয়েন করেছেন আপনি। এখানে সবাই ইংরেজ। ইংল্যান্ডে কারা থাকে জানা নেই, তবে আজ পর্যন্ত কলকাতার যতগুলো আবাসনে থেকেছি সেখানে দুর্গাপুজোর মিটিং জয়েন করে আমার অন্তত একথাই মনে হয়েছে। ক্লাবের বা পাড়ার পুজোয় কী হয় জানা নেই। এটা ভাষাদিবস নিয়ে বা কোনো মৌলবাদী চিন্তা থেকে লেখা নয়। আজ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা বলছে বাঙালির দুর্গাপুজোর মিটিং, বাংলা ভাষায় বাদ দিয়ে হিন্দি ইংরেজিতেই বেশি চলে। বাংলা ভাষার নাম গন্ধও থাকে না। প্রতিটা মিটিংয়েই ‘হ্যাভ সাম টি’ থাকে। যাওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কলকাতায় বেশ বড়ো বড়ো হাইরাইজ বিল্ডিং আছে। হাইরাইজ যখন বড়ো বড়ো তো হবেই। তার মানে এই নয় কিন্তু যে, সবাই আকাশ ছুঁয়েছে। এমন বিল্ডিংও আছে যার নাম ‘স্কাই লাইন’ অথচ চারতলা। কানার নাম ‘পদ্মলোচন’ যেমন হয় আর কী! তো পুজো আসছে। এবার এই পুজো ঘিরে আবাসনগুলোর উন্মাদনাই আলাদা। কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ কোন আবাসন কাকে বেশি টেক্কা দিল, মূর্তি, লাইটিং, প্যান্ডেল, অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব মিলিয়েই সেটা বেশ দেখার বিষয়। পুরস্কার ঘোষণা করলে তো কথাই নেই। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। এই পুরস্কার দাতারাই আবাসনে আবাসনে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দেয়। কার আবাসনের পুজো সবচেয়ে ভালো তাই নিয়ে গণ্ডগোল। পুরস্কার নিতে গিয়ে সে এক উত্তেজনা। এই বুঝি আমাদের নাম ডাকল, আচ্ছা এবার ডাকেনি, নিশ্চয়ই পরেরটা, যাঃ এবারেও নয় তাহলে এর পরেরটা…। এইভাবে সান্ত্বনাটাও কি মিলবে? নিশ্চয়ই মিলবে, নাহলে এত খরচা করে গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের ডেকে আনল কেন? হ্যাঁ, এমন করেই গাড়ি পাঠিয়ে আবাসনের সদস্যদের নিয়ে যায় পুরস্কার দাতারা। সঙ্গে টিফিন, চা, কফি, মিষ্টি, ডিনার ফ্রি। কিছু না পেলেও ডেকে নিয়ে গেলে পাঁচ হাজার টাকা অন্তত পাবে। একবার এক প্রমোটার কোম্পানি খোলা আকাশের নিচে বসিয়ে খুব সুন্দর করে পুরস্কার ঘোষণার দিনের আয়োজন করেছিল, গঙ্গার পারে। পুরস্কার পাও না পাও সেই অনুষ্ঠানটা বেশ উপভোগ করা গিয়েছিল। শুধু একটা বিষয়ই খুব কানে ধাক্কা দিচ্ছিল, সঞ্চালিকা বারবার ‘করজোড়হাত’ একটা জোরে হাততালি হয়ে যাক বলে চিৎকার করছিলেন। বেশ কয়েকজনের খুব ইচ্ছে করেছিল শুধরে দিয়ে আসার, কিন্তু সাহস হয়নি। সর্বোচ্চ পুরস্কারের অঙ্কটা বেশ উঁচুর দিকেই, লোকে সাজো সাজো রব ফেলে দেবে নাই বা কেন? একটা একটা আবাসনের এক একরকম ইউনিফর্মও ছিল। এই পুরস্কার এমন একটা খুড়োর কল এটা পাওয়া নিয়ে আবাসনের নিজেদের সদস্যদের মধ্যেও গোল বেঁধে যায় কখনও কখনও।
ধরুন খুব বড়ো আবাসন। তাদের অনেকগুলো ব্লক। মোটামুটি একটা পাড়া সাইজের। গ্রামের পাড়া হলে তার থেকেও বড়ো। আবাসনের ভিতরেই এপাড়া ওপাড়া ভাগ হয়ে যায়। এপাড়ার লোক দলবেঁধে বলে, পুজো আমাদের পাড়ায় হবে। ওপাড়ার লোক দলবেঁধে বলে অসম্ভব। এই নিয়ে বচসা চলতেই থাকে। এপাড়া ওপাড়া আলাদা আলাদা গ্রুপও আছে। যদি গ্রুপের মধ্যে গুপ্তচর থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। এপাড়ার কথা ওপাড়ায় চলে যায়, ওপাড়ার কথা এপাড়ায় আসে। এই নিয়ে সে আর এক তুমুল তোলপাড়। অনেকেই রাগারাগি শুরু করে দেয়। গুপ্তচরদের বাদ দিয়ে গ্রুপ করা হবে না কেন? কেউ কেউ হেঁকে ওঠে, না না নিশ্চয়ই হবে, নিশ্চয়ই হবে। একদল আছে, তাদের বাবা কোনোকিছুতেই কিছু এসে যায় না। যেখানে হোক একটা হলেই হল। আমরা বাবা খাব দাব, ফূর্তি করব। কোনো দল বলে, আচ্ছা গতবার তো এখানে হওয়ার জন্য পুরস্কার হাতছাড়া হয়েছে, আগে যেখানে পুজো করার ফলে পুরস্কার পেত সেখানেই হোক না। আবার কারো কারো মত, প্রতিমা পরপর তিনবছর একই জায়গায় হতে হয়। লাউঠ্যালা। কে কার কথা শুনবে। যত আবাসন তত মত, থুড়ি যত লোক তত মত। পুজো কমিটির এমনিই কত চাপ থাকে, আবার এই পুজোর প্যান্ডেল কোথায় হবে তা নিয়ে যদি মাথা ঘামাতে হয়, সে তো এক মহা মুশকিলের কথা। আরও কত কাজ থাকে। একটা পুজো মানে চাট্টিখানি কথা? এই ধরুন প্যান্ডেল কেমন হবে, কত খরচের হবে, চাঁদা আদায় করতে হবে, কত করে চাঁদা ধার্য করা উচিত, প্রতিমা বানাতে দিতে যেতে হবে, তাই বা কত বড়ো আর কত দামের হবে, রিচুয়ালসের কত খরচ, কত নিয়ম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তারই কি দায় কম? কোরিওগ্রাফার, প্যান্ডেল, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড, ড্রেস সে এক মহাযজ্ঞ। বলুন তো কত দিকে মাথা ঘামাতে হয় পুজো কমিটির সমস্ত সদস্যদের। রাত নেই দিন নেই নাওয়া খাওয়া ফেলে কত মিটিংও করতে হয়। যারা করেছে তারাই জানে। কথায় কথায় ছোটোখাটো ব্যাপারে আমরা ওরা করে গোল বাঁধালে চলবে? সব আবাসনেই মিটিং এবং কম বেশি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নারদ নারদ বলে একদল মজা লুটছে। অনেক দাদা দিদি আবার হাঁটাহাঁটি জিম শুরু করে দিয়েছে। আরও আশি নব্বই দিন বাকি পুজোর। তাতে পুরোপুরি যেমন স্লিম অ্যান্ড ট্রিম চেহারা চান তেমন করে ফেলতে পারবে সে বিশ্বাসও আছে। জোর কদমে হাঁটা, জিম চলুক। যারা সারাবছর মেইন্টেন করে শীতে থেমে থাকে, তারাও কসরৎ শুরু করে দিয়েছে অনেক আগেই। অনেকে আবার সুইমিং করে পুরো অর্ধেক হয়ে গেছে। কারো কারো আক্ষেপ মিষ্টিটা কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। যাহোক পুজোর তোড়জোড়ের পাশাপাশি শরীরচর্চা এমনিই চলুক। এতে শরীর এবং মন দুটোই খুব ভালো থাকবে।
এদিকে কচিকাঁচাদের নিয়ে খুব ভয়। মশা, মাছি, মঙ্গুস তাও নাকি আবাসনে দেখা যায়। নামে কলকাতা, আসলে তো গ্রাম ভরিয়ে আবাসন। যাদবপুর, রামগড়ের মতো আবাসনেও বেজি দেখা যায়। ঠিক সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেরোলে, তারাও হেঁটে হেঁটে এদিক থেকে ওদিক রাস্তা পার হয়। আবাসনের ভিতরেই। বর্ষাকাল থেকেই ডেঙ্গি শুরু হয়ে যাবে, চলবে পুজো পর্যন্ত। কত মানুষ যে আনন্দ করতে পারবে না তার কোনো ঠিক নেই। তবুও চলবে পুজো ঘিরে এই দ্বন্দ্ব। মানুষ কি তাহলে খুব অল্পে খুশি? পুজোয় নাহলে এত মাতামাতি এত উন্মাদনা কেন? না, আসলে তা নয়। যারা সারাবছর এই পুজো কটাদিনের জন্য অপেক্ষা করে তাদেরই এত উন্মাদনা থাকে, সবার নয়। অনেকেই আছে বাইরে বেড়াতে চলে যায় বা বাড়ি থেকে বেরোয় না। জাস্ট ঘরে বসেই পুজোর ছুটি উপভোগ করে। কারো বা আবার ওই পুজোর কটাদিন প্যান্ডেল হপিং, আলোর কায়দা সবই খুব ভালো লাগে। কেউ বা আবার খুব বিরক্ত হয়, ‘এত আলো কেন’? বলে। রাস্তায় ভিড় বাড়বে। ফুটপাত ধরে হাঁটা অসম্ভব হবে। তবে এবছর কী হবে জানা নেই। কারণটা সবার জানা। রেস্তোরাঁ, আর পার্লারে ভিড় বাড়বেই।
পুজো আসছে। আলোর রোশনাই থাকবেই। বাঙালির এটাই সবথেকে বড়ো আনন্দের সময়। গোটা কলকাতার ক্লাবগুলোর মতো সমস্ত আবাসনও তাদের পুজো নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। কোন থিম, কেমন প্রতিমা, কেমন প্যান্ডেল ইত্যাদি ইত্যাদি। মা দুর্গা কীসে আসবেন জানা নেই এখনও তাহলে প্রকৃতির রূপ কেমন যাবে তা নিয়েও চর্চা শুরু হয়ে যেত। কে কোথায় পুজো উদ্বোধন করবেন তারও পরিকল্পনা হবে। পুজো ঘিরে উন্মাদনা বাড়ুক।
কে জানে বাবা, এই উদ্বোধনের মঞ্চ আলো করা কাউকে যেন পরে জেলে দেখতে না হয়।
কেই বা বলতে পারে কার ভাগ্যে কী আছে।
(ক্রমশ)