আমার বন্ধু  রবীন্দ্রনাথ <br /> তন্দ্রা ভট্টাচার্য

আমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথ
তন্দ্রা ভট্টাচার্য

“তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাক”

রবীন্দ্রনাথের সব গানই আমাদের খুশি থাকার উপকরণ বলা যেতে পারে।আমার শিশুকালে আমি জানিনা রবীন্দ্রনাথ কে? আর কেনই বা রবীন্দ্রনাথ মানুষের জীবন জুড়ে ছায়ার মতো আশ্রয়?
কিন্তু বিশ্বাস করুন সহজ পাঠ আমার কাছে সত‍্যিই সহজ পাঠ। “রাম বনে ফুল পাড়ে, গায়ে তার লাল শাল হাতে তার সাজি” অথবা ” ডাক পাড়ে ওঔ ভাত আনো বড়ো বউ”, বিধু গয়লানী মায়ে পোয় সকাল বেলায় গোরু দোয়”
এখানে সব লেখার সঙ্গে আমার শিশু মন আমার মেয়েবেলা এক এক্কে এক মিলিয়ে নিতে পারে। আমি সকালে উঠে বাড়ির উঠোনে হাতে সাজি নিয়ে ফুল তুলি আর আমার মায়ের একটা লাল শাল ভাঁজ করে গিঁট বেঁধে আমায় পরিয়ে দেয় মা।
খেতে বসলে দাদু মাকে বলে আর একটু ভাত দাও বড় বউ।
সকাল হতেই হারু ঘোষ এবং হারুর মা দুধ দোয়, বিচালি কাটে, গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে । আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ আমার খুব চেনা গল্পের বই যেন আমায় উপহার দিয়েছেন। এখন দুর্গা পুজো, কালী পুজো, সরস্বতী পুজো, স্বাধীনতা দিবস, ঈদ, বড়দিন, মহরম তেমনই পঁচিশে বৈশাখ আমার কাছে একটি সরল স্বাভাবিক উৎসব। তবে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আমার বিরাট ব‍্যস্ততা সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় । আমি নাচব, কবিতা বলব এবং গাইব। সেইসঙ্গে একটু সুপ্ত অহংকার আমার চোখমুখে বিছিয়ে থাকবে। গান, কবিতা, নাচ সব জায়গায় আমি আমার নিজস্ব বিশ্ব খুঁজে পাই। ” মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি” বহুদিন আমি বলেছি “বাদল গাছে উঠি” কেউ হাজারবার শুধরেও ঠিক করতে পারেননি । তার কারণ আমাদের বিরাট আম বাগানে বাদল কাকা কাজ করতেন, গাছে উঠে আম পাড়তে দেখতাম, শীতকালে খেজুর গাছে উঠে ঠিলি বাঁধতে দেখতাম। তাহলে আমি বাদল গাছে উঠি বলব, “গেছে টুটি” না বলে তাই না?
আমি ঐ বয়সে জানতাম না এই রবীন্দ্রনাথ নামক মানুষটি কোথায় থাকেন? সবথেকে বড় কথা এমন কোনো প্রশ্ন মনে ভিড় করেনি। তিনি মানুষ না দেবতা! আমার মনে বিশ্বকবি আমাদের কাছে এক অভ‍্যাস এক সাধনার নাম। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশ এ শ্রাবণ মা একটি সাদা ফুলের মালা গেঁথে কবিগুরুর ছবিতে পরিয়ে প্রণাম করতেন। কখনও কখনও আবৃত্তি করতেন। আর আমার নাচের অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। প্রথম গান শেখার হাতেখড়ি হয় ” খোল খোল দ্বার রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে” এই গানটি দিয়ে।
মনে আছে প্রথম রবীন্দ্রনাচ শিখেছিলাম ” আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে ”
তখন গানের মানে বোঝার মতো বয়স হয়নি, নাচের মানে নাচ আর গানের মানে গান এর বেশি কিছুই বুঝতাম না।

কবির গল্প, উপন‍্যাস খুব বেশি আমার মনে প্রভাব ফেলেনি। বাচ্চা বয়সে ডাকঘর গল্পটি পড়ে খুব দুঃখ পেতাম। তারপর যৌবনের সুপ্রভাতে আমি শরীরে ও মনে বড় হলাম। তখন আমার থেকে একটু বেশি বয়সী ছেলেদের দেখে লজ্জা অনুভব হতো। ইচ্ছে হতো প্রেমে পড়ার, মনে হতো আমি যেন চর্চিত হই। কিন্তু প্রেম কোথায় আর প্রেমিক কোথায়? মনে মনে আমি যে সেই গান গাই ” আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী” । আসলে বাচ্চা বয়সে সোজা, সরল কথার গান গুলোকে আমি তাড়াতাড়ি ছুঁতে পারতাম। সহজেই তালে তাল মিলে যেত।
আমার যেহেতু শিকড় গ্রামের তাই রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়, পূজা পর্যায় এবং প্রকৃতি পর্যায়ের গান আমার কাছে
মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
আমি আল বরাবর ধানের ক্ষেত ধরে হেঁটে যাই আমি মেলাতে পারি ” আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা রে ভাই, লুকোচুরির খেলা”। আর লুকোচুরি তো রোজই খেলি বন্ধুদের সঙ্গে, তাহলে সবই মিলে গেল। তখন গভীর ভাবে মানে বোঝার মন গড়ে ওঠেনি।

যখন একটু বড় হলাম কিছু সময় আমার কাছে বিভীষিকা হয়ে এসেছে, কষ্ট পেয়েছি, ভয় পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের সেই অদৃশ্য হাত আমি ধরেছি “নাই নাই ভয় হবেই হবে জয়/ খুলে যাবে এই দ্বার”
অদ্ভুতভাবে কাউন্সিলিং এর কাজ করত রবীন্দ্র গান।
তাইবলে কী সবসময় রবীন্দ্রনাথ মাথায় নিয়ে ঘুরতাম? না না তা তো হয় না। কিন্তু এটা বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ আমার চলার পথের সহায়। তাঁকে দেবতার আসনে কখনও বসাই নি। তবে কবির জন‍্য আগে একটা আসন পেতেছি তারপর আমার জন‍্য। সেই আসন সম্মানের, শ্রদ্ধার এবং বন্ধুত্বের।
রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন এক সংক্রামক আনন্দের নাম। যাঁকে জীবন ভরে পান করা যায়।
জীবন মানেই দার্শনিকতা । ব‍্যক্তি জীবনে মানুষকে কখনও কখনও আত্ম জিজ্ঞাসার কাছে দাঁড়াতে হয়।
সেই আদালতে আমিই বিচারক আবার আমিই আসামী। সুতরাং উত্তর তো আমাকেই দিতে হবে না হলে আত্মতুষ্টি পাবনা। “কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি”।জীবনের সব হিসেব মেলেনা। পরিণত বয়সে এসে বুঝি রবীন্দ্রনাথ নামক প্রতিষ্ঠানে আমরা সবাই ছাত্রছাত্রী।
রবীন্দ্রনাথ যে কত মানুষকে কতভাবে বাণিজ্যিক সহায়তা দিয়ে চলেছেন তা আমরা সবাই জানি। কেউ তাঁর গান গাইছেন, কেউ আবৃত্তি করছেন কেউ নাচ করছেন । এ সবই তাঁদের পেশা। অপর পক্ষে আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সত‍্যিকারের এক প্রেমিক তাই আমার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি প্রেমে পড়ি প্রায় মাঝে মাঝেই। স্বভাবতই আমি গেয়ে উঠি “গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর /হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর”।
আসলে আমার সমস্ত না বলা কথা তাঁর গানে লেখা আছে। আমি নারী আমার প্রেমে পড়া মানা, আমার প্রেম ভাঙা মানা, আমার প্রেম বিলানো নিষেধ, সুতরাং আমার রক্ত মাংসের শরীরটার স্বাভাবিক গুণগুলো সমাজ এক সরলরেখায় বাঁধতে পারেনা। আমার মনকে বাইরে সবার চোখে নির্বাসন দিতে হয়। দেখাতে হয় এই তো আমি কাঠের পুতুল, তোমার কেনা দাশ।সত‍্যিই কী হৃদয়ে কেউ লক্ষ্মণরেখা দিতে পারে? ” গোপনে প্রেম রয়না ঘরে আলো মতো ছড়িয়ে পড়ে”। আজকের নারী কখনও এতখানি আধুনিক হতে পারত না, যদি না রবীন্দ্রনাথকে আমরা পড়তাম কিংবা না জানতাম।

রবীন্দ্রনাথের লেখার ভেতর যে দার্শনিকতা তা বড় বয়সে গল্প, উপন‍্যাস পড়ে বুঝেছি। খুব গভীর চেতনার যে গান, যেখানে প্রবল জীবন বোধ মিশে আছে, দেবব্রত বিশ্বাসের গান ও তাঁর উচ্চারণ ভঙ্গিতে আমার কাছে সুস্পষ্ট ভাবে ধরা দেয়। আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মানে বুঝতে চেষ্টা করেছি। একটা সময় হিন্দির আগ্রাসনে কখনও রবীন্দ্র গানকে একঘেয়ে যে লাগেনি তা নয়। কিন্তু আবারও আমি বিদ‍্যুৎ চমকের মতো রবীন্দ্রনাথের প‍্যাভিলিয়নে ফেরত এসেছি।
কেউ কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথকে জানা খুব শক্ত, তা অবশ‍্য ঠিক।
সত‍্যি কথা বলতে আজও আমার মনে হয়, আমার ব‍্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথকে আমি বেশ ভালো করে বুঝি। সমাজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের যে দায় তা ছিল, আছে এবং থাকবে চিরকাল সমগ্র ভারতবর্ষে।। আর জনগণের দায়িত্ব থাকবে, জন গণতন্ত্রে রবীন্দ্রনাথকে সম্মানে ও যত্ন সহকারে সংরক্ষণ ও রবীন্দ্র শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথকে কেউ জোর করে উচ্চবিত্ত বা মধ‍্যবিত্ত বাঙালি সমাজে প্রবেশ করাননি, কবি আমাদের নিজস্ব সম্পদ তিনি কখন আমাদের রক্তে মিশে গেছেন আমরা কেউ জানিনা। কিন্তু যে মেয়েটি নিম্নবিত্ত পরিবারের যার অক্ষর জ্ঞান হয়েছে কিংবা হয়নি, সে কী রবীন্দ্রনাথকে জানে? একবার আমার বয়সী একটি মেয়ে যার মা আমাদের বাড়িতে কাজ করত, ওর নাম নয়ন ও দু একটি বাড়িতে ঠিকে কাজ করে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে চিনিস? ও বলেছিল “জানি কিলাবে ফানশান হয়, তুই লাচ করিস, আর কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি আমি ফড়ফড় করি বুলতে পারি”। যাইহোক এই জানাটা আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বেশি করে সাধারণের কাছে যেটুকু পৌঁছেছেন হয়তো তাঁর গানের মাধ‍্যমে। মননে, আত্মায় যদি কবি থাকেন, জানবেন সেটা শিক্ষিত সমাজে। আমিই কী রবীন্দ্রনাথকে সমগ্র পড়তে পেরেছি? নাহ্ পারিনি কারণ এক জীবনে তা সম্ভব নয়।
“আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব‍্যাকুল শুধাইল না কেহ” কাউকে তো মনের সব কথা বলা যায়না। যা গোপন, যা অতি গোপন ও একান্ত তা কেবলই রবীন্দ্রনাথই জানেন।
আমি হাতড়ে বেড়াই সেই গানের সমুদ্র যেখানে আমার শান্তি আছে, নিবেদন আছে। আমার মনে হয় কবি আমাদের বাঙালির শিরদাঁড়া, আমাদের সমাজ চেতনা, সাম‍্যবাদের হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথ মানুষের কথা বলেছেন, বলেছেন হৃদয়ের কথা। কিন্তু তিনি ধর্ম মানতেন না। লিখেছেন অজস্র পূজা পর্যায়ের গান। সেই পূজা কিন্তু মানবতার পূজা। কবি যেমন আমার একার তেমনি কবি সামগ্রিক বাঙালির ভাবনার প্রতীক। আমার একথাও মনে হয় বহির্বিশ্বে আমাদের পরিচিতি শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ আর শ্রীবিবেকানন্দকে দিয়ে। কবি আমাদের একটা আকাশ দান করে গেছেন তাই তো আমরা রোজ রোজ সেই আকাশে তারা হয়ে জ্বলি। আমার কাব‍্য বোধ, কবিতা ভাবনা, আমার নিজস্ব ভাষা হৃদয় খুঁড়ে জন্ম নিয়েছিল, কবি রবীন্দ্রনাথকে দেখেই তৈরী হয়েছিল সেই কবে মন তপস‍্যা -ভূমি ।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনার কোনো অন্ত হয় না। যত রবীন্দ্রনাথ পড়েছি তত আমি আমাকে নতুরূপে গড়েছি, ভেঙেছি। নব নির্মাণ হয়েছে নিজের ভেতর, যা আমি ছাড়া কেউ দেখতে পায় না। আমার দেখার চোখ হয়েছে , হৃদয়ের পরিসরটা অনেক বড়ো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েই আমি রবীন্দ্র পূজা করি ” আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব” কিংবা উদার গলায় গাইতে পারি ” অনেক দিয়েছ নাথ আমায় অনেক দিয়েছ “.। সবশেষে বলি যদিও এটি গান, আমি বলি মন্ত্র যা আমি প্রতিদিন উচ্চারণ করি হাত জোড় করে ” আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে”

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes