
সেপিয়া রঙের গলি- অষ্টম পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘প্রাণের হিল্লোলে এসো…’
‘নমস্কার। আমি ইডেন উদ্যান থেকে বলছি। এখন আমাদের বল করতে চলেছেন ফেলুবাবু। তাঁর এই স্বভাবসিদ্ধ লম্বা… তিনি দৌড় নিচ্ছেন। তিনি তাঁর মতন… মতো… নিজের মত মতন ফিল্ডিংটাকে সাজিয়ে নিচ্ছেন। হ্যাঁ, তিনি সাজিয়ে নিচ্ছেন, ফ্লিপকে একটু সরিয়ে নিচ্ছেন, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। তিনি প্যান্টে বলটা ঘষে এগোচ্ছেন… তিনি আআআআআআস্তে করে বলটাকে ঝুলিয়ে দিলেন, তাই না রে দোস্ত? যাই হোক আমার, যাই হোক বল টিম অপোনেন্টের ছিল। যাই হোক, আমাদের ব্যাট করছিলেন…’
রোদে ভিজে গেল বারো নম্বর রমাপ্রসাদ রায় লেন। সুবিশাল উত্তর কলকাতার কোথাও রয়েছে এই লেন। সঠিক স্থান জানার প্রয়োজন নেই। কারণ এই রাস্তা হল সেই ছায়াগলি, যার ভিতরে সময় একটি বিভ্রম। এই যে ঠান্ডা সিমেন্টের মেঝে, এই যে হলুদ দেয়াল, জং ধরা গ্রিল, ময়ূর আঁকা চাদর, সবকিছু পার করে ওই ডায়নোরা টিভির ভিতর রমাপ্রসাদ রায় লেনের রোদ উঠল। সেখানে বল করতে নামলেন ফেলুবাবু। ক্যাচ লুফে ডাক দিলেন নির্মল কুমার, ‘ঘেঁটু, অ্যাই ঘেঁটু…’ রোদের এত রকমফের জানা ছিল না। ওরা কারা? বল করতে নেমেছে কি সাদা-কালো রঙে তৈরি বাবার বন্ধুরা? টিম অপোনেন্ট খিদে। মত মতন ফিল্ডিং সাজানো যাচ্ছে না। ফলে আবারও রোদ্দুরে দৌড়… দৌড়… আড়ে-বহরে বিরাট, সাদা কালো ডায়নোরা টিভি সবটা দেখাতে পারে না। বরানগরের রোদে ঘেরা এক বাড়িতে গিটারটা বেচে দিয়ে এল বাবা। সেই দৃশ্য স্ক্রিনে ফুটে উঠল না। স্ক্রিনের ভিতর শুধু বড় হয়ে উঠল আমার বন্ধু ঘেঁটু।
আমি বরাবর দলছুটদের দলে। সবার একটা দল থাকে। ঘেঁটুর সঙ্গে দল পাতিয়েছিলাম আমি। আগেও একটি দল ছিল আমার। সেইসব শীতের রাতে ইন্দ্রনাথ, আমার বন্ধু, ডেকে নিয়ে যেত আমাকে। নৌকা বাইতে আমিই ছিলাম তার সঙ্গী। মাছ চুরি করতে, জলপথে হারাতে, মানুষের মাথার খুলিকে চালকুমড়ো ভেবে নিতে শিখিয়েছিল সে’ই। বসন্তরোগে মৃত আট বছরের ছেলেটাকে জলে ভাসিয়েছি সে আর আমিই। বামুন-কায়েত মানিনি, নৌকা যেমন জড়, তেমন জড় সেই শিশু, এই তো ভাবতে শিখিয়েছিল ইন্দ্র। আমাদের দামালপনায় কিছু একটা মিশেছিল। ইন্দ্র এগিয়ে গিয়েছিল। আমি থেমেছিলাম থেমে যাওয়ার নিয়মে। সেই বাঁকে ঘেঁটু এল। ডায়নোরা টিভি সম্পূর্ণ অন্ধকার হবার আগেই সে এসে আমাকে অধিকার করে নিল।
বোধহয় আমাদের খিদে মিলে গিয়েছিল। খিদে মিলে গেলে বন্ধু হয় কিনা জানা নেই, কিন্তু ঘেঁটু একটা কালো আয়না যেন, রোদে পুড়তে শেখালো। সে কোঁকড়া চুলের দামাল মেয়ে, তার আদল পুতুল পুতুল, সে কষি বেঁধে ঝগড়া করে, বেপরোয়া, কাঁদতে জানে, রাগতে জানে- শিকলগুলো ভঙ্গুর তা জানে। ঘেঁটুকে কেউ চায় না। চোখের সামনে মূর্তিমতি অস্বস্তি হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ছাদ টপকে যায়, আর অপেক্ষা রাখতে জানে।
ভরদুপুরে ঘুমন্ত মায়ের কোল ছাড়ানো শিশু। এক পা এক পা করে উঠে গেছে, নেমে গেছে সিঁড়ি বেয়ে। ন্যাড়া ছাদের কার্নিশে ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছে বেড়ালছানার পায়ে পায়ে। ষাটের দশকের কলকাতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে, হইচই করছে। ছাদের দরজায় আতঙ্কে স্থির বিধবা মা। বাড়ি-বাড়ি ছাদ টপকে শিশুটিকে কোলে তুলে আনে ঘেঁটু। ডায়নোরা পর্দার এপারে আমি ভাবি, ঘেঁটুই তো সেই মায়ের কোল ছাড়ানো শিশু, যার ন্যাড়া কার্নিশ বেয়ে জাগলিং শেষ হবে না আমরণ। অলক্ষ্যে কেউ দৃষ্টি রেখেছে, বলে দিয়েছে, ‘ওকে ডেকো না, ওর নাম ধরে ডেকো না…’
কালো রং ছাড়া আর কোনও রং পায়নি সে। আলোর মতো কালো রঙে জেদি ষাঁড় আঁকত সে। এই যে মল্লিকার পাশে বেমানান ঘেঁটু, আপন খেয়ালে ওই একচুলের খেলা খেলতে থাকা ঘেঁটু একটা স্পিরিট ছিল আমার কাছে। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, এই তো, কেউ কেউ হয়। ইন্দ্র হয়ে ওঠার সাধ জাগছিল আবার, কিন্তু বিকেল পাঁচটা বেজে গেল।
‘সরস্বতী’ বানান জানে না, না’ই বা জানল। ক্লাবের ক্যারাম কম্পিটিশনে ব্যস্ত থাকে, সে থাকুক। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা বিকেল ছুঁলেই কী যেন হয়, কোথায় যেন বৃষ্টি নামে। রোজ। শেড দেওয়া বাল্বের নীচে মেঘ করে আসে কলকাতায়।
ঘেঁটু ভিজতে থাকে, ভিজিয়ে দেয় আমার বারো বছর বয়সকে।
কোথায় যেন রয়েছে একটি ঘর। আমি রাস্তা চিনে বৃষ্টিতে পৌঁছে যেতাম সেই ঘরে। বেশি কিছু করে যায়নি মেয়েটা। শুধু একটা ঘরের দরজা খুলে রেখে চলে গিয়েছিল। ধরে নেওয়া যাক সেই ঘরে থাকে এক বেকার ছেলে। আচ্ছা, আরও ধরে নেওয়া যাক, ছেলেটার আদল আমি চিনি না। না হয় চিনলাম না, কিন্তু আমার বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় এই যে বৃষ্টি নামিয়ে গেল মেয়ে, এর ভিতরে আজীবন পুড়ে খাক আমি। আজও ছাদ জুড়ে আমার বারো বছর বয়সী বৃষ্টি পড়ে, আজও ছেলেটার আদল চিনি না আমি। আকাশে বাজে, ‘বাহির হয়ে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে, এসো আমার ঘরে… এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে…’
বারংবার, বারংবার ওই ফুরিয়ে আসা ডায়নোরা টিভির সামনে বুক কেঁপে উঠত আমার। ঘেঁটু আমাকে বিপদে ফেলে দিয়ে অদেখা একটা ঘরের সামনে দাঁড়াত। পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে, খিদে চেপে থাকা একটা ছেলে, দেশের আরও কোটি কোটি শিক্ষিত বেকারের মতো ছেলেটাই একমনে বৃষ্টি দেখত তখন। কে জানে, তারও হয়ত ছিল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গিটার। কে জানে, সারাদিনের দমচাপা রোদে সে বেচে দিয়ে এসেছে সুর। কাকভেজা ঘেঁটু দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখত। আর আমি ঢুকে পড়তাম সেই ঘরে। এই ঘরে মেঘের মতো মৃত্যু নামবে।
দৌড় দিতাম। সেইসব বিকেলবেলায় মাঠে ছোটার সময় পিছু ধাওয়া করত সুর… ‘দুঃখ সুখের দোলে এসো… প্রাণের হিল্লোলে এসো…’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ ছেয়ে যেত মাঠে, নিঃশব্দে ফিরে আসতাম ঘেঁটুর কাছে। মৃত্যু চিনব বলে।
চুরি। সবাই জানে, রোদের মতোই তার রকমফের আছে। ঘেঁটুও শেষে চুরি করল। ভারি ঘেন্না হল। আমার বন্ধু শেষে চুরি করল! যজ্ঞিবাড়ি থেকে চুরি সহজ ছিল। এখানে সেখানে পড়ে থাকে টাকা। একশটাকা তুলে নেওয়া কী আর এমন ব্যাপার!
ঘেঁটু বিপদে ফ্যালে, তাকে নিয়ে পৃথিবী জেরবার, পরিচারকদের জেরার শেষে ধরা পড়ল। পড়বেই, আমি জানতাম। কিছু টাকা ফেরত এসেছিল কি না, আজ আর মনে পড়ে না। ডোমকে দিয়ে, শ্মশানযাত্রীদের খাইয়ে, ফুল কিনে বোধহয় কিছু বাঁচিয়ে এনেছিল, আমার মনে পড়ে না। বাকি পড়ে থাকা ফুল নিয়ে ঘেমে যাওয়া কালো মুখে সদরে দাঁড়িয়ে থাকে ঘেঁটু। প্রেমিককে দাহ করে আসে প্রতিবার।
আমাদের ডায়নোরা টিভিটা আর নেই। রমাপ্রসাদ রায় লেন রোজ একটু একটু করে ধ্বসে পড়ছে। গিটার বেচে আসা ছেলেটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে। রোদের গলিতে বল করতে আসা ফেলুবাবুরা মৃত। শুধু ঘেঁটুই ছেড়ে যায়নি আজও। একটি অদেখা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো মুখে। দাহ করবার কাজ সেরে আসি, ফাঁকা ঘরে সুর ভাসে, ‘ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে, এসো আমার ঘরে… এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে…’
ছবি ঋণ – আশাপূর্ণা দেবীর ছোটগল্প অবলম্বনে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ১৯৬৩-র ছবি ‘ছায়াসূর্য’-তে ঘেঁটু চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর।