
সুগাথাকুমারীর দীর্ঘ কবিতা- ‘কৃষ্ণ, তুমি আমায় চেনোনি’
অনুবাদ- বেবী সাউ
মালয়লম কবি বোধেশ্বরন এবং সংস্কৃত স্কলার কার্তিয়ায়িনী আম্মার কন্যা, সুগাথাকুমারী এই সময়ের মালয়লম সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বর। কেরালার মানুষ তাঁকে যেমন কবি হিসেবে চেনেন, তেমন চেনেন পরিবেশ-বাঁচাও আন্দোলন ও কেরালার প্রকৃতির জন্য লড়াইয়ের এক অক্লান্ত যোদ্ধা হিসেবেও। তাঁর কবিতা ‘রুথরিমাঝা’ ( রাতের বৃষ্টি) এবং এই লেখায় অনূদিত ‘কৃষ্ণ, তুমি আমায় চেনোনি’ খুবই জনপ্রিয়। সুগাথাকুমারীর কবিতা কেরালার কবিতার রোমান্টিক ও গীতিকবিতার ঐতিহ্যের এক উত্তরাধিকার, যার সূচনাবিন্দু হিসেবে আমরা কুমারন আসানের কথা বলতে পারি। ওএনভি কুরুপ, সুগথাকুমারী এবং এমভি বিষ্ণুনারায়ণ নাম্বুথিরির কবিতা ৬-এর দশকের পর থেকেই কেরালার কাব্যজগতে রোমান্টিক কবিতার ঘরানাকে প্রতিষ্ঠিত করে। সুগাথাকুমারী নিজে একজন রোমান্টিক এবং মরমীয়া কবি হলেও সামাজিক বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন তিনি আজীবন। কে ভি সুরেন্দ্রন ২০০২-এ ইন্ডিয়ান ইংলিশ পোয়েট্রি, নিউ পার্সপেক্টিভ-এ সুগাথাকুমারীকে তুলনা করেছেন কমলা সুরাইয়া (কমলা দাস) এবং গৌরী দেশপান্ডের সঙ্গে। ২২ জানুয়ারি, ১৯৩৪ সালে এই কবির জন্ম কেরালার আরানমুলায়। ৮৬ বছর বয়সে কোভিড কেড়ে নেয় তাঁর প্রাণ। ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ তাঁর প্রয়াণদিবস। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- কেরালা সাহিত্য অকাদেমি (১৯৬৮), সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৭৮), পদ্মশ্রী (২০০৬) ইত্যাদি।
কৃষ্ণ, তুমি আমায় চেনোনি
আম্বাদির এক কোণে
কাদার ঝোপের ভিতরে আমার ছোট মাটির কুঁড়েঘর।
আমি চুপ করে থাকি।
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে চেনোনি…
রঙিন ঘাগরায় ঢাকা,
নূপুরের শব্দ করে
আমার সুঠাম কটীর একটি চকচকে পাত্রে
আমার চোখে কামনার কালো কোহল…
আমি কখনই তোমার পাশে ছিলাম না
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে জানো না।
মন উচাটন করা কালিন্দীর অর্ধেক আড়ালে ঢাকা
চোখ লজ্জায় পড়ে গেল, শরীর কাঁপছে,
কখনও তোমার কাছ থেকে আমার বস্ত্র চাই নি,
হাত বাড়িয়ে মন বাড়িয়ে দিইনি
তুমি আমাকে জানো না,কৃষ্ণ
অন্ধকার অরণ্যের অভ্যন্তরে যেমন ্তোমার বাঁশি ইশারায় বাজে…
ভাল করে পোশাক না পরে, ফুটন্ত দুধ হেলায় উপেক্ষা করে,
ঘর খোলা রেখে, আলুলায়িত পোশাকে ও খোলা চুলে
আমার ক্রন্দনরত শিশুকে না দেখে,
আমার স্বামীর বিস্মিত ভ্রু উপেক্ষা করে
আমি কখনই আমার সখীদের সঙ্গে দৌড়ে যাইনি তোমার কাছে
তোমার একান্ত হওয়ার জন্য।
কৃষ্ণ, তুমি আমায় বোঝনি…
তাদের নূপুরের শব্দগুলি দূরে বিবর্ণ হয়ে যায়, শুনেছিলাম –
তারপরেও চোখ বন্ধ করে আমি আমার কাজে ফিরে আসি,
আমার জীবনকে বাঁধি নিয়মে,
হাজার হাজার কাজে
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে জানো না
তুমি যখন চারপাশে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল
তোমাকে ঘিরে যখন গোপিনীরা নাচের মুদ্রায়
যখন বাঁশিটি খুব দুষ্টু এবং পাগল
মাতাল নূপুরগুলো হাসিতে গড়িয়ে পড়ে,
সুন্দর হাতের চারপাশে চুড়িগুলি ঝলকানি রংধনু,
হাতে হাতে ঝলসে ওঠে বালা
রামধনু থেকে রং গড়িয়ে পড়ে, উন্মাদের মতো
সোনালি শরীরগুলো দোলে
নাচের ছন্দে দোলে একেকটা শরীর
তবু আমি তাদের সঙ্গে কখনও পা মেলাইনি তালে
আমার চুলে কখনও ধরেনি কনে দেখা আলোর আগুন
কৃষ্ণ, ওগো, তুমি আমাকে জানো না
নাচে ক্লান্ত, আবেশের মিষ্টি ঘামে শরীর ভিজে,
ফুলের গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে দেহ-
হৃদয় কামনায় ফুটে ওঠে
আমি কখনও তোমার মোহময় মুখের দিকে তাকাতে পারি নি…
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে জানো না।
কোনও রসিক বান্ধবীরা তোমার কানে
আমারই ভালবাসার সুর বলে যায়নি
কখনও তোমার কানে আমার ভালবাসার বার্তাটি পাঠায় নি কেউ
তোমার পায়ের শব্দটুকু শোনার জন্য অপেক্ষাও করিনি কোনওদিন
সাদা সাদা ফুলের ভিতর, গভীর বনের মধ্যে যাইনি কখনও…
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে জানো না।
চাঁদের আলোয় যখন ফোটে অসংখ্য সাদা ফুল
যখন বাতাসে ভাসে আশ্চর্য নেশা
আমার ব্যাকুল মাথা কখনও বিশ্রাম চায়নি তোমার
পুরুষালী বুকের নীল আশ্রয়ে
কৃষ্ণ, আমাকে জানো না তুমি
যখন তোমার বাঁশি জানায়
বসন্ত এসে গেছে
ঘরের মধ্যে বন্দি করে নিজেকেই
আমি তোমার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছি
সকলের অজ্ঞাতে, কেঁদেছি আনন্দে
কৃষ্ণ, তুমি আমাকে চেনোনি
গোকুলের হৃদয় বেঁধে কাঁদে সুর!
কৃষ্ণকে মথুরায় নিয়ে যেতে অক্রুর এসেছেন, তারা চিৎকার করছে!
নীরব, মূক আমি তখন আমার বাড়ির বাইরে বসে চলচ্ছক্তিহীন
ঘোড়া কাছে আসে,
কাছে আসে রথ
চোখ তুলেছি যখন …
তুমি, রাজার রথে পূর্ণিমার চাঁদের মতো ছড়িয়ে পড়েছ
পিছনে কেঁদে উঠেছেন নারীরা, গরু এবং বাছুর পাশাপাশি ছুটছে
তুমি তাকিয়েছ ঘুরে, অশ্রুসিক্ত, লালচে চোখ…
যেমন ঠান্ডা পাথরের ভাস্কর্যের মতো হিমশীতল আমি,
যদিও, তুমি আমায় জানো না কৃষ্ণ,
তবুও তোমার রথ এক মুহূর্তের জন্যও থামে আমার সামনে
তুমি আমার দিকে তাকাও, তোমার চোখ জলে ভরে আছে,
তোমার মুখে যেন করুণার আলো, দয়ার মতো হাসি
আমার প্রতি তোমার ঠোঁটে এক স্বর্গীয় আলোর আভা…
কৃষ্ণ, তুমি কি আদৌ আমাকে জানো?
কৃষ্ণ, তুমি কি কোনওদিন আমায় চিনেছিলে?
পড়লাম। ভালো লাগল।
চমৎকার অনুবাদ।
ভালো লাগল
অপূর্ব অনুবাদ একটি অসামান্য কবিতার
যেমন প্রখর কবিতা তেমনই উজ্জ্বল অনুবাদ
চির আকাঙ্ক্ষিত সেই পরম পুরুষ কৃষ্ণের প্রতি নারীর চিরন্তনী নিবেদন, যা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিনিয়তই প্রতীয়মান, যা বিরহিনীর বেদনাশ্রুতে সিক্ত করে যায়।
খুবই সুন্দর অনুবাদ।
Khub valo laglo.Natunatta ache vabnai.anubadeo.onyi sahityer sange porichito hoar sujog ta valo lagche.
অনবদ্য । সহজ শব্দে এমন মরমী অনুবাদ মুগ্ধতা আনে তৃষিত প্রাণে।
খুব ভালো লাগলো
বাহ,
খুব সুন্দর অনুবাদ
পড়লাম দারুন লাগল।
খুব তীক্ষ্ণ অনুবাদ। ‘চলচ্ছক্তিহীন’-এর প্রয়োগ কী অসামান্য। ভীষণ ভালো লাগলো।
ভীষণ সুন্দর … অভিভূত হলাম
খুব ভালো লাগল
ভালো লেগেছে,চমৎকার অনুবাদ
খুব ভালো লাগলো দিদি। কৃষ্ণ সে তো সত্যিই বোঝে না কোনকালেই। কত কিছু দায়ভার মেটাতে হয় রাইকে। কবি সুগাথাকুমারীকে শ্রদ্ধা আর আপনাকে জানাই শুভকামনা এত সুন্দর অনুবাদের জন্য।