সীতার পত্রগুচ্ছ
কুমুদিনী দেবী
অনুবাদ – অনিন্দিতা দে
বিংশ শতাব্দীর তামিল সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শ্রীমতী রঙ্গানায়কী থাত্তাম, যিনি কুমুদিনী দেবী ছদ্মনামে নানা মণিমুক্তে সমৃদ্ধ করেছেন তামিল সাহিত্যকে। ১৯০৫ সালে শ্রীরঙ্গমের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দশ বছর বয়সে বিবাহ হয় তাঁর। যৌথ পরিবারের দায়িত্ব সামলেও জ্ঞানের জগতে অবাধে বিচরণ করে গেছেন তিনি। অবসর সময় পেলেই পড়াশুনা, লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা ছোটগল্প প্রকাশিত হত বিভিন্ন তামিল পত্রপত্রিকাতে। গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি, খাদির বস্ত্র পরিধান করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “যোগাযোগ” উপন্যাসটি” তিনি হিন্দি থেকে তামিল ভাষায় অনুবাদ করেন।
রামায়ণের চিরপরিচিত কাহিনীকে এক নতুন আঙ্গিকে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছিলেন কুমুদিনী দেবী। সদ্যবিবাহিতা সীতা ও তার মায়ের আলাপচারিতাকে চিঠির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর এই কাহিনীকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন তাঁর নাতনী অহনা লক্ষ্মী। গল্পটি সেই ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত।
সীতার পত্রগুচ্ছ
( কুমুদিনী দেবীর তামিল ভাষায় লেখা এই গল্পটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন তাঁর নাতনী অহনা লক্ষ্মী। তাঁর ইংরেজী অনুবাদ থেকে লেখাটির বঙ্গানুবাদ করলাম বাংলার পাঠক পাঠিকাদের কাছে এই অনন্যসাধারণ কাহিনীকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। )
জনক রাজার স্ত্রী সুনয়না দেবীর উদ্দেশ্যে লেখা সদ্যবিবাহিতা সীতার চিঠি –
১
শ্রীচরণেষু মা,
আমরা খুব ভালো আছি, তোমরা কেমন আছ? পিতা সময় মত খাওয়া দাওয়া করেন তো নাকি আগের মতোই সারাদিন পুঁথির মধ্যে ডুবে থাকেন? গত সপ্তাহে তোমার পাঠানো উপহারগুলি পেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই যারপরনাই খুশি, এমনকি আমার শাশুড়ি মা-ও। বার্তাবাহকেরা বলল যে তুমি দীপাবলিতে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছ। কিন্ত এখানে যা বর্তমান পরিস্থিতি তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় না আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে। মা, আশা করি তুমি আমার সমস্যা বুঝবে। আমার শ্বশুরমশাই দিনরাত মান্ডবীর শাশুড়িমার সঙ্গে থাকেন, আর আমার চিরদুঃখী শাশুড়ি মা আড়ালে চোখের জল ফেলেন। যদিও উনি এই নিয়ে সরাসরি কোন অভিযোগ করেন না, কিন্ত আমি বুঝি সব। সারাদিন পূজার্চনা আর রান্নাবান্নার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন উনি, আমি পাশে থেকে হাতে হাতে একটু সাহায্য করলে খুশি হন। তোমার জামাইও বিশেষভাবে বলেছে কৌশল্যা মার খেয়াল রাখতে। রোজ কাকডাকা ভোরে উঠে স্নান করি, তারপর ওনাকে দৈনন্দিন কর্মে সাহায্য করি। কাজের মধ্যে দিয়ে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে বুঝতেই পারি না। এক মুহূর্ত অবসরের উপায় নেই আমার।
বিয়ের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পরপরই মান্ডবীর স্বামী ভরত তার মাতুলালয়ে গেছে। শ্রুতকীর্তির স্বামী তো দাদা ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে, সেও সঙ্গে গেছে। ওরা না ফিরলে আমাদের অযোধ্যা ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। আর আমি তো বড় বউ, সবথেকে বেশি দায়িত্ব আমারই। আশা করি তুমি বুঝবে।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করার পরও আমি তোমার জামাইয়ের কাছে লঘুভাবে আবদার করেছিলাম দীপাবলিতে মিথিলা যাওয়ার জন্য। উনি স্বভাবোচিত শান্ত কিন্ত দৃঢ়ভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে এখন আমাদের এখানে থাকাই উচিত হবে। আমার শ্বশুরমশাই শীঘ্রই পিতাকে একটি চিঠি পাঠাবেন।
দাসদাসীদের মাধ্যমে আমার শ্বশুরবাড়িতে উপহার হিসেবে কিছু রেশমের কাপড় পাঠিয়ে দিও। তোমার জামাই পীতবর্ণের কাপড় ভালোবাসে, ভুলো না যেন। দীপাবলি উপলক্ষে প্রাসাদে শান্তাদিদি আর তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, জামাতার জন্য স্বর্ণালংকার আর দামী পোষাক তৈরি করতে দিয়েছেন আমার শাশুড়ি মা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে অলংকারের নকশা। তোমার বড় জামাইয়ের জন্যেও একইরকম অলংকার পাঠিও কেমন? তোমার পাঠানো বার্তা বাহকদের সঙ্গে আমি অযোধ্যার একজন স্বর্ণকারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি যিনি অনুরূপ নকশার গয়না বানাতে পারেন। আমি যে এই ব্যাপারে তোমাকে লিখেছি বা ওনাকে পাঠিয়েছি সেই নিয়ে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
তুমি আগের চিঠিতে লিখেছিলে যে আমার জন্য একটা সিঁদুর রঙের শাড়ি বোনা হচ্ছে। অযোধ্যার লোকজন পোষাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। বিদেশী সওদাগরেরা এখানে সরু পাড়ের রেশম বস্ত্র আমদানী করে, এত সুন্দর কাপড় আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার ননদ শান্তাদিদি সেদিন একটা নীল রঙের শাড়ি পরেছিলেন, আমারও ওরকম একটা চাই কিন্ত। আমার বিয়ের সময় তুমি সব চওড়া পাড়ের শাড়ি দিয়েছিলে। ওগুলো পরতে আমার খুব লজ্জা করে, আমার শাশুড়ী ননদেরা মুখ টিপে টিপে হাসে যে। ওরকম কাপড় আর পাঠিও না আমাকে।
পিতাকে আমার প্রণাম জানিও।
ইতি
তোমার সীতা
২
শ্রদ্ধেয় মা,
আমরা ভালো আছি। সেদিন তোমাকে পত্র পাঠানোর পর আমার ননদ শান্তাদির সাথে গল্প হচ্ছিল। নীল শাড়ি আমাকে পাঠিও না গো, নীল রঙ খুব তাড়াতাড়ি বিবর্ণ হয়ে যায়। তুমি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে সিঁদুর রঙের শাড়িই পাঠিও। নতুন বউকে ওই রঙেই ভালো লাগে নাকি, ও বলেছে! তা না হলে তুমি আমাকে তামা রঙ, মানে একটু অন্য ধরনের শাড়িও পাঠাতে পারো। সারাদিন ওই লাল শাড়ি পরতে আর ভালো লাগে না গো। যাই হোক, তুমি যা ভালো বোঝো করো। তোমাকে আর বিরক্ত করব না।
ভালোবাসা নিও
সীতা
পুনশ্চ – নীল শাড়ি বোনা হয়ে গিয়ে থাকলে কোনও দাসীকে দিয়ে দিও।
৩
পূজনীয় মা,
আমরা ভালো আছি। তোমাকে একটা সুসংবাদ দেওয়ার আছে। হঠাৎ করেই শ্বশুরমশাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তোমার জামাতার রাজ্যাভিষেক হবে। তুমি আশীর্বাদ করে ঐদিনের অনুষ্ঠানে পরার জন্য আমাকে একটা সুন্দর শাড়ি পাঠিও কেমন। কি রঙের শাড়ি পরবো, আমি ভেবে ভেবে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। অযোধ্যার ভাবী রানির অঙ্গে কি আর যেমন তেমন শাড়ি উঠতে পারে, তুমিই বলো? আচ্ছা, হরিণ গাত্রের আদলে নকশা করে একটা শাড়ি আমাকে পাঠাতে পারবে? হরিণ বড় প্রিয় আমার, তুমি তো জানোই। কতদিন লাগবে এমন শাড়ি বুনে পাঠাতে? জানো, আমার শাশুড়ি মা বিশেষভাবে বলেছেন, ওইদিন কালো শাড়ি না পরতে, অমঙ্গল হয় নাকি। প্রথমে ভেবেছিলাম বাঘছালের আদলে শাড়ির নকশা করব, তারপর ভাবলাম ওতে আমাকে পুরুষদের মত লাগবে। সারাদিন এসব ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ঘুরছে গো। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। তুমিই উদ্ধার কর আমাকে এই দোলাচল থেকে।
ইতি,
তোমার সীতা
৪
মা গো,
তোমাকে কোনও শাড়ি পাঠাতে হবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যাচ্ছি। ভরত হবে অযোধ্যার রাজা। যাকে দিয়ে এই চিঠি পাঠাচ্ছি সে তোমাকে বিশদে সবকিছু বলবে। আমাকে গাছের ছাল দিয়ে তৈরি একটিমাত্র পোষাক দেওয়া হয়েছে। যদি অরণ্যে বৃষ্টি হয় আর আমি ভিজে যাই, তাও ওই একবস্ত্রেই থাকতে হবে। আর কিছু পরার নেই যে আমার। তাই যদি সম্ভব হয়, আমাকে বেশি করে গাছের ছাল পাঠিও। আমরা চিত্রকূটে যাচ্ছি। কাউকে এই বিষয়ে কিছু বলার দরকার নেই। আবার কবে চিঠি লিখতে পারব জানি না গো। ভালো থেকো।
ইতি
অরণ্যবাসী সীতা
পুনশ্চ – কখন কী রঙের, কী নকশার শাড়ি পরলে ভাল দেখাবে তাই নিয়ে আর ভাবতে হবে না আমাকে। কী শান্তি, তাই না? সব মহিলাই যদি আমার মতো বনবাসে যেত কতই না ভালো হত! সংসারের অর্ধেক চিন্তাভাবনার অস্তিত্বই থাকত না তা হলে।
যাইহোক, ভালো থেকো মা।
তোমার কথা মনে পড়বে খুব।
ইতি
সীতা।
খুব খুব ভালো লাগল লেখাটি। একবারও মনে হল না যে এটি অনুবাদ পড়ছি। মনে হল যেন প্রকৃতই বাংলায় লেখা। চথুর্থ চিঠিটি পড়তে পড়তে বুকে মোচড় দিচ্ছিল।
অসাধারণ লেখা পড়তে পারলাম। অনেক ধন্যবাদ।
অনিন্দিতা…ভালোলাগা যেমন বাড়ল,খাটুনিও বাড়ল,এবার থেকে যে খুঁজে খুঁজে আপনার লেখা পড়তে হবে।কী ভালই না লাগল 💝💝💝
ঝরঝরে অনুবাদ। খুব ভাল লাগল। প্রাঞ্জল ভাষার জন্য মনেই হচ্ছিলনা অনুবাদ পড়ছি।