সমীরণ চট্টোপাধ্যায়-এর গদ্য

সমীরণ চট্টোপাধ্যায়-এর গদ্য

ভয়

ভয়। এই নামে সিনেমা হয়েছে। আর এই নামে একজনের লেখাও আছে যিনি অনেক গুণে গুণী। তারপর ভয় নিয়ে লিখতে ভয় ভয়ই করছে। কিন্তু লেখা পেলে লিখতেই হয়। আমার এক বন্ধু বলেছিল, লেখা হল ফোঁড়ায় জমা বদ রক্তের মতো। একে টিপে টুপে বের করে দিতেই হবে। নইলেও ভয়। কখন যে পেকে উঠবে। তখন আরও ভয়। কাঁচি, ছুরি, কাটাকাটি, মায় অজ্ঞান পর্যন্ত। এত ভয় পেলে লেখাই হবেনা। অতএব, লেখায় মনোনিবেশ করি।

ছাপোষা মানুষ আমি। কলুর বলদের মতো ঘানি টানি। কেরানি বলাই উচিত। কিন্তু লোকে মাস্টার বলে ডাকে। একই কথা। মানে আমি তো আর সেই মাস্টার নই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, প্রশ্ন করো, প্রশ্ন করো। কোনো কথা ঠিক না মনে হলে মেনে নিওনা। এই সব বর্ণ পরিচয় আর সহজ পাঠের পড়া গুলো জীবনে খুব গণ্ডগোল পাকায়। একটা মিটিং এ আছি। সব তাবড় তাবড় মানুষের মাঝে আমার মতো অনেক চুনোপুঁটি। বস্ খুব বকছে। আমি কদিন ছুটিতে ছিলাম। সেই সময় নাকি সব অনর্থ ঘটে গেছে। অতএব, খুবই স্বাভাবিক ভাবে কর্তার কাজ না হবার দায় এসে পড়ে সামান্য কর্মীদের ওপর। অর্থ বিভাগের প্রধান পর্যন্ত আমাদের কাজের অর্থ খুঁজে পায়না। বকুনি খেতে খেতে হঠাৎ মনে হল, ‘আমিই লেনিন।’ দিলাম বিপ্লব করে। মানে একটা ভাঙাচোরা প্রতিবাদ আর কী! আর একা তো কোন বিপ্লব হয়না। বাঁ, ডান কোন পাশের লোকেই পাশে থাকলনা। সবাই দেখলাম হয় সিলিং এর দিকে, না হয় মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই ভয়। আমার বস্ এমন কিছু বলল না। কিন্তু এমন করে দেখল, যেন বাঘ হরিণকে দেখছে, মানে মেপে নিচ্ছে, কতটা হাঁ করবে। আমার বুকের ভিতর দিয়ে একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। পড়ে যেতে যেতে বসে পড়লাম। ব্যস। তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘণ্টা খানেক বাদে কানাই এসে বলল, ‘কি হল? বেরোন। দরজায় চাবি দিতে হবে তো!’ তারপর বসের ঘরে দেখা করতে যাওয়ার ডাক। ভয়ে ভয়ে গেলাম। যখন ফিরে এলাম, শ্মশানের নীরবতা।

আগের ঘটনাটায় আমার বস্ অন্তত জানত যে সে বাঘের মতো। এবং সে সুবাদে সকলকে ভয় দেখানো তার ঘোষিত কাজের মধ্যেই পড়ে। এবার যে ঘটনাটা বলব, সেটা এক ম্যাডামের। ম্যাডাম তো। হাজার হোক মাতৃ মূর্তি। খুবই বকেন কিন্তু মনে করেন যে মোটেই বকেন না। আমার বৌ আমাকে সর্বক্ষণ বকে। কিন্তু তার কোন রাখ ঢাক নেই। তার বকা এবং ভয় দেখানোই কাজ। এবং আমার সেই বকুনি শোনা এবং ভয় না পাওয়াটা কাজ। আবার সে’ই যখন মেয়েকে ভুলের বানান কেন ভুল লিখল তা’ই নিয়ে তুলোধনা করে আর ওই একরত্তি মেয়েটা যখন ভয়ে সিঁটিয়ে যায়, তখন আমাকে বলতেই হবে, “mother’s scolding comes from her love.” না বললে দুজনেরই ভয়ের কারণ ঘটবে। আর রাগের চোটে যদি রান্নাঘরে হরতাল হবার সম্ভাবনা তৈরি হয় তো হয়েই গেল। এর চেয়ে ভয়ের কোন কারণ থাকতেই পারে না।

এইবার আসি ম্যাডামের কথায়। তিনি মোটেও রাগী নন। খুব সাধারণ ভাবে কথা বলেন। যা বলেন, তা শুনে নিলে কোন সমস্যা নেই। গোল বাধবে যদি কোন প্রশ্ন করেন। আপনাকে লালমোহন বাবুর মতো জপতে হবে, ‘কোন প্রশ্ন নয়।’ প্রশ্ন করলে এমন চিৎকার করবেন যে আপনি ভয় পেয়েই যাবেন। উনি আবার খুব উৎসব প্রিয়। মানে একেবারে বাঙালির মতো। তা’ তিনি কি যেন একটা উৎসব করবেন। সবাইকে মেল করে দিলেন। ধৈর্য ধরে থাকলে আর সবটা সহ্য করে টিকে থাকলে ঠাণ্ডা কফি আর একটা খাবার প্যাকেট পাবেন। নেমন্তন্ন পেলে যদি যান, তাহলে আর ভয় নেই। মানে যতক্ষণ ম্যাডামের কর্তা ব্যক্তিরা স্টেজ আলো করে বসে থাকবেন, ততক্ষন থাকা বাধ্যতামূলক। শ দুয়েক মানুষকে উনি চোখে দেখেই মনে রাখবেন। কোন নাম ডাকা ডাকি নেই। কোন সই সাবুদ নেই। না গিয়ে দেখুন। না যাবার দিনের সাহস পরের দিনে খতরনক ভয়ে পরিণত হবে।

সবাই আসার পর তিনি এলেন। মানে তিনি কাজের মানুষ। তবে তিনি নিজে তো কিছু করেন না। এই যেমন সবাই এসেছে বলে খবর গেলে তিনি লিফটে একা একা নামবেন। আমার দাদুর বাড়িতেও এত ছুতমার্গ ছিলনা। দাদু সংস্কৃত পণ্ডিত, স্মৃতিতীর্থ। যজমান ছিলেন। কিন্তু সবার সাথেই একসাথে বসতেন, খেতেন। কিন্তু তিনি তো ম্যাডামের মতো অধিকর্তা ছিলেন না। অধিকর্তার অধিকারই আলাদা। যাই হোক, তিনি এলেন। ভিড় দেখে কান এঁটো করা হাসি। ‘দেখুন, সবাই কি রকম ভালোবাসে বলুন। কাল একটা মেল করেছি আর আজ সবাই চলে এসেছে।’ খুশি খুশি জানান তিনি। হাল্কা ভিড় থেকে কে যেন বলে ওঠে, “ভালোবাসা না ভয়, কে জানে! দুটোরই তো প্রকাশ একই।” যে বলেছে তাকে দেখা যায়নি। তোতা কাহিনিতেও বার বার এই রকম ভিড়ের মধ্যে থেকে রাজার কান ভাঙানো হয়েছিল। তা’ ম্যাডাম আমাকে সামনে পেলেন। আমার তো হয়ে গেছে। ‘কী! আমাকে সবাই ভয় পায়! আপনি বলতে পারলেন?’ গলার স্বর ক্রমেই হারমোনিয়ামের ডান প্রান্তের দিকে চলে যাচ্ছে। আমি তো ভিরমি খেয়ে একাকার। কি বলতে চাইছি, আর কী যে মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে কী অবস্থা! যারা এ দৃশ্য দেখল, তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল। কিন্তু জানেন তো, ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে।’ শেষ কথা না বললে অপরাধ হবে। ম্যাডামের নেমন্তন্ন মেল যারা পায়নি, তারা ভয় পেয়ে ওই অনুষ্ঠানে যায়নি। স্বাভাবিক। গত বছর তারা গিয়েছিল আর খাবার প্যাকেটের লাইনে তাদের দেখে ভীষণ বকেছিলেন। কিন্তু তাঁর কি অত কথা মনে থাকে? কত কাজ ওনার। এবছর নেমন্তন্ন না পেয়ে যারা যায়নি, তাঁদের ঘরে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে তারা চলেও গেল। এইবার বকার পালা। তারা কেন যায়নি? তার জন্য কত প্যাকেট নষ্ট হল, ইত্যাদি, প্রভৃতি। যে ভয়ে তারা গেলনা সেই ভয় তাদের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা বাদে চেপে বসল।

এই ম্যাডাম কিন্তু খুবই যুক্তিবাদী। অবশ্য ভয়তো সেখানেই। যুক্তির তো কোন সংজ্ঞা নেই। তাঁর যুক্তি আপনার যুক্তি না হলে খুবই ভয়ের ব্যাপার হবে। তিনি সবাইকে মিটিং করতে বলবেন। মিটিং-এ এমনকি বাইরের বিশেষজ্ঞ রাখতে দেবেন। তা’ সেই মিটিং-এ বাইরের লোকেরা হয়ত কিছু বলল। যেমন আরও একটা ঘর পেলে ভাল হয়। অনেক লোক হয়ে গেছে। একটু জায়গার দরকার। কি সরঞ্জাম একটু বেশি পেলে কাজটা ভালো হবে। তো মিটিং শেষে অবশ্যই আলোচনা নথিবদ্ধ হবে। আপনি অবাক হয়ে দেখবেন এই সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব সেখানে নেই। ‘সে কী! সব লিখলে না তো!’ ‘থাক না। লিখলে কি হবে কে জানে।’ সেই ভয়। এই ম্যাডামের অবসরে করার মতো আর একটা কাজ আছে। সবাই ঠিক মতো আসছে যাচ্ছে কিনা এর একটা হিসেব যন্ত্র থেকে বের হয়। উনি সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। শরতচন্দ্রের মেজদার মতো। একটু নড়চড় হলেই একটা মোক্ষম অস্ত্র তূণ থেকে বেরিয়ে আসবে – “শো কজ।” সময় মতো কাজ কোন কারণে না হলে, একই চিকিৎসা – “শো কজ।” বাপরে, ভয় কী সাধে হয়!

এইটুকু পড়ে আপনি যদি মনে করেন এই একজন ম্যাডাম-ই শ্রীমতি ভয়ঙ্করী তো ওঁর প্রতি অবিচার করা হবে। এক হাতে তালি বাজেনা – এই কথাটা এখানে বেমানান হলেও বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। তালির অন্য একটা হাতও আছে। সেটা ঠিক হাত নয়। মুখ। আর একজন আছেন। খুব প্রভাবশালী। কিন্তু তাঁর মুখের ওপর মনের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এটা বলা ভুল হল। মনের ওপর মুখের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটাও তো বাজে কথা হয়ে গেল। মানে, বলতে গেলেই ভয় ভয় পাচ্ছে, আর কি! তিনি সব সময় থাকেন না। মানে তিনি কখনও আপনার সামনে আসবেন না। তিনি আপনাকে ডাকবেন। ভয় পাওয়ার জন্য আপনিই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। অনেকটা ইচ্ছে করে হরর মুভি দেখতে যাবার মতো। ভয় পেতেই টিকিট কেটে যাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে যাওয়া ছাড়া আপনার কোন পথ নেই। গিয়ে কোন কথা বলবেন না। শুধু শুনবেন। আর পারলে মেপে মেপে ‘সাধু, সাধু’ বলবেন। কোন আব্দার করবেন না। প্রথমত, তিনি ডাকবেন, আপনি যাবেন। গেলেই দেখা হবে না। আপনি গিয়ে দেখবেন তিনি আসেনইনি। এইবার যখন লাস্ট বাস চলে গেলে কি হবে ভাবতে বসবেন, তখন শশব্যস্ত হয়ে তিনি আসবেন। কিন্তু আপনি উতলা হবেন না। তাঁর বড়োসড় পারিষদ দল আছে। তাঁরা আগে যাবেন। তার পর আপনাকে ডাকবেন। আপনি ভয়ে ভয়ে যাবেন। একটা বেফাঁস কথা বলেছেন কী ‘ছিচড়ে’ সিনেমার ‘অ্যাসিডের’ মতো তপ্ত লাভা বেরিয়ে আসবে। আপনি ভস্ম হয়ে যেতে পারেন।

খুব শান্ত ভাবেও ভয় দেখানো যায়। একথা ভুলবেন না। আর একজন আছেন। ভালো গান গান। মানে তাই তো বলেন। সেজে গুজে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে জীবনটাকে বেজায় উপভোগ করেন। টেনিদার চার মূর্তি মনে পড়ে? সেই যে হাবুল বলেছিল বর্ধমানে বেড়াতে যেতে, টেনিদা নিমরাজিও হয়েছিল, কিন্তু ক্যাবলা ভয় দেখিয়েছিল এই বলে যে সেখানে যেতে নেই যেখানে ঘরে পুলিশের বড় কর্তা থাকে। এই মহিলাও পুলিশের ঘরণী। বেচাল করেছেন কি, কী যে হয়ে যাবে তা’ আপনি জানতেও পারবেন না। একজন গান করেন, তো অন্যজন গান দিয়ে গুলি ছোঁড়েন। তবে উনি একা কিছু করেন না। ওঁরা তিনজন। একেবারে বাঘা বাঘা মানুষ। আপনি ওদের যদি কিছু বলেন তো সে কথা মনিবের কানে যেতে বাধ্য। কিন্তু আপনি কি বললেন আর মনিব ওঁদের কান দিয়ে কী শুনল তার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকবেই। আরে, সেইটাই তো ভয়।

এই এত ভয়ের মধ্যে রাজার চায়ের দোকানটাই যা ভালো। দোকানটা অফিস বাড়ির বাইরে। ফুট কুড়ি দূর, গেটটা থেকে। একটা যন্ত্র আছে বললাম না। সে আপনাকে দিনে দুবার দেখবে মোটামুটি আট ঘণ্টার ব্যবধানে। মানে আপনিই আপনার মুখ দেখাবেন। সে জেনে নেবে আপনি এসে গেছেন বা চলে গেলেন। এইবার বস্ ডাকল। আপনি রাজার দোকানে। মোবাইল ফোনে বলে দিলেন আমি ঘরে আছি। যাচ্ছি। এখানেও ভয়। আপনার ঘরেও পাহারাদার যন্ত্র আছে। ঠিক বলে দেবে আপনি ঘরে আছেন কিনা। ধরুন আপনার ঘরের যন্ত্র খারাপ। তাহলে জ্যান্ত পাহারাদার আছে। দৌড়ে দেখে যাবে। কাজেই ওই রাজার দোকানের চেয়ে বেশি দূরে যেতে পারবেন না। বিপদের ঘণ্টি (মানে ফোন) বেজে উঠলে ধরতে ধরতে ছুটতে থাকুন। ঘরে পৌঁছে ফোন ধরুন। দেখুন, চাকরি করা কোন মুখের কথা নয়।

ভয় কিন্তু আমার জন্যে এখানেই শেষ হয়না। এইবার বাড়ি ফিরে এসে দেখব মূর্তিমান ভয় বৌ-এর রূপ ধরে বসে আছে। কেন করনি আর কেন করেছর স্রোত পার করে ঘামে ভিজে যখন বিছানায় বসব আর ভাবব, ‘ধরণী দ্বিধা হও’ ঠিক তক্ষনই একটা হাত এসে পড়তে পারে মাথার ওপরে। মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘এত ভয় পাও কেন তুমি?’ এইবার নিজেকে ভীষণ নির্ভীক লাগবে। এখন আমি নিরাপদ।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes