
শাশ্বত সংকেত
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং
অনুবাদ- রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
আধুনিক সময়ে শাশ্বত সংকেতকে বোঝা ও মূল্যায়ন করা ডাঃ ইয়ুং এর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের একটি অন্যতম অবদান। আদিবাসী মানুষ যাদের প্রাত্যহিক জীবনে সংকেত একটি সহজাত বিষয় এবং আধুনিক মানুষ যাদের কাছে সংকেত স্পষ্টতই অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক -- এদের দুজনের মধ্যে অযৌক্তিক প্রভেদকে ভাঙতে সাহায্য করেছিল ইয়ুং এর কাজ। ইয়ুং তার বইতে আগেই দেখিয়েছেন মানুষের মস্তিষ্কের নিজস্ব ইতিহাস থাকে; পূর্ববর্তী পর্যায়ের বিকাশের ইতিহাসের বহু সন্ধান ধরে রাখে মন। এছাড়াও অবচেতনের বিষয়বস্তু সচেতন মনের ওপর একটি গঠনমূলক প্রভাব তৈরি করে। সচেতন ভাবে আমরা সেগুলোকে এড়িয়ে যাই; কিন্তু অবচেতনে আমরা সাড়া দিই, এবং সংকেত এর মধ্য দিয়ে , স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের প্রকাশ করে।
মানুষের প্রাচীন ইতিহাস সংকেতের মধ্য দিয়ে অর্থপূর্ণভাবে পুনরাবিষ্কার করা হচ্ছে আজ; যা প্রাচীন যুগের মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গভীরে খনন করে তুলে আনছেন অতীত। তবে অতীতের ঘটনাবলী আমরা আমাদের জ্ঞানের মধ্যে সঞ্চয় করতে চাইনা। অতীতের ভাস্কর্য , নকশা , মন্দির , ভাষা যা অতীত মানুষদের বিশ্বাসের পরিচয় দেয় তাই আমাদের আগ্রহের বিষয়। দার্শনিক ও ধর্মীয় ঐতিহাসিকরা এই বিশ্বাসগুলিকে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিক ধ্যান-ধারণায় রূপান্তরিত করে সংকেত রূপে আমাদের কাছে প্রকাশ করে। সাংস্কৃতিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মাধ্যমে এগুলি আমাদের জীবনে প্রবেশ করে। তারা দেখায় সভ্য সমাজের উপকণ্ঠে একই সংকেতের আদর্শ নানা আচার অনুষ্ঠান বা মিথের মাধ্যমে ছোট কোন উপজাতি সমাজে (যারা আজও টিকে আছে) শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে অপরিবর্তিত রয়েছে।
এই ধরনের গবেষণা আধুনিক মানুষের একমাত্রিক মনোভাব শুধরে দেয়, যারা মনে করে এই সংকেত প্রাচীন মানুষেরা বা আধুনিক কালে কোন পিছিয়ে পরা জনজাতি সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে এবং তাই এগুলো আসলে আধুনিক জটিল জীবনের প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক। লন্ডন অথবা নিউইয়ার্কে আমরা নিওলিথিক মানুষদের উর্বরতা বিষয়ক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রত্নতাত্ত্বিক কুসংস্কার হিসেবে বরখাস্ত করে দিতে পারি। যদি কেউ দাবী করে যে তার দিব্যদৃষ্টি আছে বা সে ঈশ্বরের নির্দেশের শুনতে পায় সে কখনোই সাধু বা দৈববাণীর বাহক হিসেবে গ্রহণীয় হবে না, বরং বলা হবে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। আমরা প্রাচীন গ্রীকের মিথ পড়েছি বা রেডইন্ডিয়ানদের লোকগল্প; কিন্তু আধুনিক জীবনের সঙ্গে এদের কোনো যোগাযোগ আবিষ্কার করতে পারিনি; আর এটাই তৎকালীন হিরো বা নাটকীয় ঘটনার প্রতি আমাদের মনোভাব।
যদিও যোগাযোগ একটা আছেই। এবং যে সংকেতগুলি তাদের প্রকাশ করে তারা কখনোই মানবজাতির কাছে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।
আধুনিক সময়ে শাশ্বত সংকেতকে বোঝা ও মূল্যায়ন করা ডাঃ ইয়ুং এর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের একটি অন্যতম অবদান। আদিবাসী মানুষ যাদের প্রাত্যহিক জীবনে সংকেত একটি সহজাত বিষয় এবং আধুনিক মানুষ যাদের কাছে সংকেত স্পষ্টতই অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক — এদের দুজনের মধ্যে অযৌক্তিক প্রভেদকে ভাঙতে সাহায্য করেছিল ইয়ুং এর কাজ।
ইয়ুং তার বইতে আগেই দেখিয়েছেন মানুষের মস্তিষ্কের নিজস্ব ইতিহাস থাকে; পূর্ববর্তী পর্যায়ের বিকাশের ইতিহাসের বহু সন্ধান ধরে রাখে মন। এছাড়াও অবচেতনের বিষয়বস্তু সচেতন মনের ওপর একটি গঠনমূলক প্রভাব তৈরি করে। সচেতন ভাবে আমরা সেগুলোকে এড়িয়ে যাই; কিন্তু অবচেতনে আমরা সাড়া দিই, এবং সংকেত এর মধ্য দিয়ে , স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের প্রকাশ করে।
স্বতন্ত্র ব্যক্তি মনে করতেই পারে যে তার স্বপ্ন স্বতঃস্ফূর্ত এবং অসম্বন্ধ। কিন্তু একটি দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্লেষক লক্ষ্য করবেন স্বপ্নের পরম্পরা এবং তিনি একটি অর্থপূর্ণ প্যাটার্ন খুঁজে পাবেন; এবং সেটি বুঝতে পারলে তার রোগী অবশেষে জীবনের প্রতি একটা নতুন মনোভাব অর্জন করতে পারবে। এই স্বপ্নগুলো থেকে প্রাপ্ত কিছু সংকেতকে ডাঃ ইয়ুং বলবেন – ‘সমষ্টিগত অবচেতন’; এগুলো ঐ বিশেষ মানসিকতার অংশীভূত যা মানবজাতির সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারকে ধরে রাখে ও প্রেরণা দেয়। এই সংকেত গুলি এতটাই প্রত্নতাত্ত্বিক এবং অপরিচিত যে আধুনিক মানুষের বুঝতে পারে না বা গলাদ্ধকরণ করতে পারে না।
এখানেই একজন বিশ্লেষক সাহায্য করতে পারে। সম্ভবত রোগী সংকেতের বন্ধনমুক্ত যা মামুলি ও অনুপযুক্তভাবে বড় হয়েছে তার অবচেতনে; অথবা সে অবশ্যই একটি সংকেতকে মৃত বলে দূরে সরিয়ে না দিয়ে, সংকেতের স্থায়ী মূল্য আবিষ্কারে সহায়ক হতে পারে, তার পুনর্জন্মের আধুনিক রূপ সন্ধান করতে পারে।
রোগীর সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্যকরভাবে সংকেতের অর্থ অন্বেষণ করার আগে একজন বিশ্লেষক অবশ্যই সংকেতের উৎস এবং তাৎপর্য বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করবে। প্রত্নতাত্ত্বিক সংকেত ও আধুনিক রোগীটির স্বপ্নে আসা ঘটনাবলীর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে এটা মনে রাখা উচিত এগুলি কোনটাই নগণ্য বা আকস্মিক নয়। আদিম মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে সংকেত গড়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আধুনিক মানুষটির অবচেতন মনের আছে বলেই তারা তার স্বপ্নে উপস্থিত হয়েছে। এবং এই ক্ষমতা এখনও পর্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ত্ব বিষয়ে অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করেছে। এমন অনেক উপায় আছে যা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে আমরা আমাদের স্বপ্নের মধ্যে আসা সংকেতের উপর নির্ভরশীল এবং আমাদের মনোভাব ও ব্যবহার গভীরভাবে তাদের দ্বারা প্রভাবিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যুদ্ধের সময় অনেকেরই হোমার , শেক্সপিয়ার , বা টলস্টয়ের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি ঘটে। এবং আমরা নতুন বোধগম্যতা নিয়ে সেইসব অংশই পড়ি যা যুদ্ধকে একটি স্থায়ী ও প্রত্নতাত্ত্বিক অর্থ দেয়। এই নতুন অর্থ আমাদের মধ্যে একটি উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যে মানুষ যুদ্ধের তীব্র আবেগময় অভিজ্ঞতা কখনো লাভ করেনি তার সাহিত্যে যুদ্ধের অংশ পড়ার প্রতিক্রিয়া প্রগাঢ় হয়। ট্রয়ের সমতলভূমির যুদ্ধ একেবারেই অপছন্দ করে অয়াজিনোকোর্ট বা বরোডিনোর যুদ্ধ, যদিও মহান সাহিত্যিকরা সময় ও স্থানের পার্থক্য অতিক্রম করে সর্বজনীন মিথকে প্রকাশ করে। এই মিথগুলির ভিত্তি সংকেত বলেই আমরা তাতে সাড়া দিয়ে থাকি।
যে ব্যক্তি খ্রিস্টান সমাজে বড় হয়েছে তার কাছে এই উদাহরণ আরো আকর্ষণীয় ভাবে পরিচিত মনে হতে পারে। বড়দিনে আমরা আমাদের অন্তরের অনুভূতি প্রকাশ করি সেই পৌরাণিক গল্পে যেখানে এক অর্ধদিব্য শিশুর জন্ম হয়; যদিও আমরা খ্রিস্টের কুমারী-মার প্রসঙ্গ বিশ্বাস নাও করতে পারি, এমনকি সচেতন ভাবে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস নাও থাকতে পারে। ফলে নিজেদের অজান্তেই আমরা পুনর্জন্মের সংকেতে বিশ্বাস করে ফেলি। এটা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত একটি একাকী উৎসব যা একটি পৌরাণিক ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন বহন করে যা উত্তর গোলার্ধের শীতের বিবর্ণ দৃশ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। যখনই আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে ইস্টারের সুখকর সংকেতময় উৎসবে ইস্টারের ডিম ও ইস্টারের ইঁদুর নিয়ে যুক্ত হই আমাদের সমস্ত কুতর্ক সন্তুষ্ট হয়।
কিন্তু আমরা কি বুঝতে পারি অথবা দেখতে পারি খ্রিস্টের জন্ম , মৃত্যু ও পুনর্জন্মের সঙ্গে লোক-সাংকেতিক ইস্টারের যোগাযোগ? সাধারণত আমরা এই ব্যাপারে বৌদ্ধিকভাবে যত্নবানই নই।
যদিও এই লোকসংকেত ও ইস্টার একে অপরের পরিপূরক। গুড ফ্রাইডের দিন খ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মধ্যে উর্বরতার সংকেতের সেই একই নমুনা পাওয়া যাবে যা ওসিরিস, তমুজ, অরফেউস, বাল্ডারের রক্ষাকর্তাদের ক্ষেত্রেও পাওয়া গিয়েছিল। তারাও দিব্য বা অর্ধ-দিব্য ভাব দিয়ে জন্মেছিল , বিকশিত হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল এবং পুনর্জন্ম লাভ করেছিল। তাই আবর্তনশীলতার ধর্মে ঈশ্বরের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম চিরকালের পুনরাবৃত্ত একটি মিথ। কিন্তু এই আবর্তনশীলতার ধর্মের সংকেতের তুলনায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের বিচারে ইস্টারের রবিবারে খ্রিস্টের পুনর্জন্ম আধুনিক মানুষের কাছেও কমবেশি সন্তোষজনক।
পুনর্জন্মের ধারণা খ্রিস্টধর্মেরই একটি ধারণা যা অন্যান্য ধর্ম থেকে তাকে পৃথক করে। খ্রিস্টদের মতে শেষ বিচার আসলে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার একটি মিথ। এটা একবারই ঘটে এবং উৎসব তার স্মৃতি রক্ষা করে। কিন্তু এই চূড়ান্ততার ধারণার কারণেই সম্ভবত পূর্বের খ্রিস্টানরা খ্রিস্টপূর্ব ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন; যা উপলব্ধি ঘটায় খ্রিস্টধর্মের পরিপূরক হওয়া উচিত পুরাকালের উপাদান উর্বরতার আচার-অনুষ্ঠান। পুনর্জন্মের পুনরাবৃত্তির শপথ তাদের প্রয়োজন; এবং সেটাই ডিম ও ইঁদুরের দ্বারা সংকেতায়িত হয়ে ওঠে ইস্টারে।
মিঃ ইয়ুং একেবারে দুটি বিপরীতমুখী উদাহরণ গ্রহণ করেছেন এটা দেখাবার জন্য যে আধুনিক মানুষ গভীর মানসিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করে সচেতনভাবে, কুসঙস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত আদিবাসীদের লোকগল্পকে সে বরখাস্ত করে। কিন্তু একে অতিক্রম করা প্রয়োজনীয়। কেউ যদি আরো নিবিষ্ট ভাবে সংকেতের ইতিহাস দেখে এবং বিভিন্ন পৃথক পৃথক সংস্কৃতির মানুষের জীবনে সংকেত কি ভূমিকা পালন করে তা দেখে সে ভালো ভাবে বুঝতে পারবে সংকেতের সৃজনশীল অর্থ আছে।
কিছু সংকেত ছোটবেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিছু বয়ঃসন্ধির সঙ্গে, কিছু প্রাপ্তবয়স্কতার সঙ্গে, কিছু বৃদ্ধ বয়সের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে যখন মানুষ অনিবার্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয়। মিঃ ইয়ুং বর্ণনা করেছেন কিভাবে একটি আট বছরের মেয়ের স্বপ্নের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে এমন বিষয় যা বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তার স্বপ্ন উপস্থাপিত করেছিল জীবনের সেই দীক্ষা যা আসলে প্রত্নতাত্ত্বিক সংকেতের নমুনায় মৃত্যুর দীক্ষা। আদিম সমাজে বিভিন্ন আচারের মধ্য দিয়ে যে সংকেত তৈরি হয়েছিল তাই ক্রমশ অগ্রগতি লাভ করে আধুনিক মানুষের অবচেতনে।
প্রত্ন বা আদিম সমাজের মিথ ও আধুনিক মনের অবচেতনে তৈরি হওয়া সংকেতের মধ্যে এই যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ তা বিশ্লেষকের কাছে অপরিসীম বাস্তব ও জরুরি। এই যোগাযোগ তাকে সংকেত চিহ্নিত করতে ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম করে যা সংকেতের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তাত্ত্বিক অর্থ নির্ণয়ে সহায়ক হয়। এবার মিঃ ইয়ুং গ্রহণ করবেন অতীতের আরো গুরুত্বপূর্ণ মিথ এবং দেখাবেন কীভাবে এবং কোন প্রয়োজনে তারা সংকেতময় বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, যা আমরা মোকাবিলা করি আমাদের স্বপ্নে।