
‘শরীরপরব’ : দেহ, চিন্তা ও মননপ্রতিমার অভিযাত্রা
অচিন্ত্য মাজী
আত্মপ্রেম ও আত্মঘাতী মনোবৃত্তির কোনো অভেদ রূপকল্প নয় বরং এই যে নিরঙ্কুশ ও প্রবল আহ্বান তা যেন আত্মঘাতী সমস্ত উৎকণ্ঠাকে হটিয়ে দিতে চায়। এবং অস্বীকার করতে চায় প্রথাগত ধারাবাহিকতা। অভ্যস্ত এবং ক্লান্ত বাকপ্রতিমার সংবৃত, মুচড়ে যাওয়া চিৎকার নয় বরং এই কবিতাগুলিতে আমরা পাচ্ছি আত্মলগ্ন অথচ সসীম এক ঘেরাটোপে সঞ্চরমান, অস্থির বর্হিবৃত ভাষার অন্তর্দীপ্তি।
‘শরীরপরব’ পড়লাম। একটা ঘোরের অভিযাত্রা। যৌনতা, সঙ্গম কবিতাগুলির বাইরের আবরণ, ভেতরে ভেতরে বয়ে চলেছে এক চূড়ান্ত স্তব্ধ শিল্পীর আত্মখননের হ্রেষা। রমণীয় জ্যোতির্গুণ হাড়ের পরিখা ঠেলে খুঁজে পেতে চেয়েছে আপন নাভির ভেতরের নির্বিকার স্পন্দন। ঐ অন্বেষণ ঐ সন্ধান কবির আমিকে তীব্রভাবে তাড়া করে বেড়ায়, জীবনে তলিয়ে দেখতে শেখায়। এখানে সঙ্গম যেন আর্টের আগুন, যার প্রদাহে ও প্রবাহে ধীরে ধীরে মিশছে রতির ঘন কালো ছায়া পার হয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে নিংড়ে দেখার আর্তি। গিলেজ দ্যেলুজ বলেছিলেন নিজেকে জানার প্রতিটি মুহূর্তে একটি অবগুণ্ঠন রতির ছায়া মেখে ভুস করে উঠে আবার তলিয়ে যায়। সেই মশগুল রতির অপলক অথচ অদৃশ্য জারণেই আছে শিল্পের চমৎকারিত্ব। শুভমের কবিতা ঐ মশগুল রতির শিল্প, জীবনের হাড়মাংসের অবভাস ভেঙেচুরে কোনো নিরালা মন্থনে ফেলে আবার তাকে নতুন করে দেখতে শেখা—
“ভাসুক ভাসুক ভেলা
সাঁতারের ওমে
তোমাকে কামনা করি
শেষে ও প্রথমে
ধ্বংস হবো প্রিয়তম
ধ্বংস হতে দাও
তোমার বিষাদ খুলে
আমাকে পরাও” (বিষপদ্য)
আত্মপ্রেম ও আত্মঘাতী মনোবৃত্তির কোনো অভেদ রূপকল্প নয় বরং এই যে নিরঙ্কুশ ও প্রবল আহ্বান তা যেন আত্মঘাতী সমস্ত উৎকণ্ঠাকে হটিয়ে দিতে চায়। এবং অস্বীকার করতে চায় প্রথাগত ধারাবাহিকতা। অভ্যস্ত এবং ক্লান্ত বাকপ্রতিমার সংবৃত, মুচড়ে যাওয়া চিৎকার নয় বরং এই কবিতাগুলিতে আমরা পাচ্ছি আত্মলগ্ন অথচ সসীম এক ঘেরাটোপে সঞ্চরমান, অস্থির বর্হিবৃত ভাষার অন্তর্দীপ্তি। এখানে যৌনচেতনা নিছকই ব্যক্তিগত স্তরে আবদ্ধ নয়, সৃষ্টিভাবনার পরিপূরক বলয়ে বুনে দিচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক চিন্তাবীজ। মূর্ত ও বিমূর্তের ঝঞ্ঝালীন ভেদরেখা মুছে ফেলে মন আবেগে সন্ত্রস্থ না হয়ে বৌদ্ধিক ও স্বয়ংক্রিয় ভাস্কর্যে বলতে চেয়েছে–
“তোমার শরীরে কোনও মাটি নেই…মাংস নেই
তুমুল পৃথিবী আঁকে মূর্তিমান খড়ের স্তব্ধতা”(খড়)।
চিরকালের দামাল ছেলে জাঁ আর্তুর র্যাঁবো এক চিঠিতে লিখেছিলেন ‘The poet turns Himself into a visionary by long drastic and deliberate disordering of all his senses’. এই যে অনুভূতিকে ভিতর থেকে আক্রমণ, sense-এর বাঁধাগত ধ্বস্ত করে প্রকৃত বাস্তবতা এবং বাস্তবের সত্যকে চিনে নেওয়া সেখানেই আছে চৈতন্যের মুক্তি, সত্তার ভিন্ন নির্মাণ। আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত ভাসছে সেই প্রস্তরীভূত গুহাকন্দরের দরজা আর যার আংটাতে ঝুলে আছে প্রাচীন শবের কেশগুচ্ছ এবং এর মধ্যেই জেগে ওঠা শিল্পীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত চোখ। পান্ডুর জ্যোৎস্না চোখে এসে লাগলে অদ্ভুত ঘোরে সেই আধিপত্য থেকে ছিটকে যায় চোরা কলাকৃতি। অবসানহীন এই সংশয়ের অন্বেষণকে জিইয়ে রাখতে পারে শুভমের কবিতা—
“অপার মাধুরি ছিল চন্দ্রকরোটিতে
তুমি এসে ভেঙে দিলে সবুজ ন্যাকামি
দুর্বল লিঙ্গটি কাঁপে চন্দ্রাহত শীতে” (শরীরপরব ৬)
নিজের সত্তার পরিচয় পাওয়ার জন্যই এভাবে বিপরীত সত্তার বোধে আলগ্ন হয়ে সংযোজিত বোধের থেকে দূরে কিছুটা বা অবচেতনের আঁধারে খুঁজে নেয় স্বকীয় আত্মভাষ। সেই গূঢ় রহস্যময় নির্জন বিন্দুটির কাছে পৌঁছে গিয়ে ছদ্মবাস্তব ও জৈবিক ঘ্রাণ থেকে চ্যুত হয়ে ঝাঁপ দিতে পারে দেহবোধের আরও বিশাল কোনো উপদ্বীপে, নৈঃশব্দের হিমসিঞ্চিত বাতায়নে–
“আমি এক মৃৎশিল্পী
মৃতপ্রায় নিরুত্তাপ নির্বাক পাথর
তোমাকে ভীষণ ছুঁই
হাতে কাঠে যে কোনো ছুতোতে
শরীরে পোষাক এলে
তোমার ম্যাজিক শুরু হয়”( পোশাক)
পোশাক যেন সেই সেতু বিভিন্ন সম ও অসম উপাদানের মধ্যে গড়ে তোলে নিরুদ্দেশ যোগাযোগ, অস্তিত্বের আ্যবসার্ড রূপে তলিয়ে গিয়ে খোঁজ করে আত্মতার সার্বভৌম সংবেদ। কবি নিজস্ব স্বরায়নে ঐ আত্মগত সার্বিক অভীক্ষাটির কাছে পৌঁছে যেতে চেয়েছেন, যে পথে বারবার ছায়া ফেলে যায় জৈবিক ক্রমবর্ধমান এক উপস্থিতি, জায়মান সময়ের ক্লেদ, সম্পর্কের অভিযোজন ও টানাপোড়েন আর এসব থেকে নিষিক্ত হওয়া এক টালমাটাল অন্তর্দ্বন্দ্ব৷
মানুষী চৈতন্যের অস্তিবাদী সমস্যা ও তার চরিত্রের জটিলতাকে বুঝতে চেয়েছেন দার্শনিকরা। শুভম কবিতাতেও এই কথাই বলতে চেয়েছে —
“নিজেকে কুপিয়ে মারি
চাটানে থেঁতলে আছে লাশ
আর কিছু নির্জনতা
দিগন্তের সাদা পিঠে
এলোমেলো ট্যাটু এঁকে দেয়”( খুন)
অথবা,
“আমাকে বেষ্টন করে
নাচে প্রেত প্রেতিনী সকল
শরীরে আগুন জ্বলে
যোনিতটে খিদের জঙ্গল
রাক্ষস খিদের মন্ত্রে
দীক্ষিত যে অনাসক্ত প্রেম
খুলে দাও ঢুকে পড়ি
খুলে দাও সাবেক হারেম
কুপিয়ে কুপিয়ে মারি
কিউবিক জয়ধ্বনি হয়
অবচেতনের সিঁড়ি ঘুম নেই
ত্বকে ঘাম নেই
অনন্ত কণার দিকে
অফুরান প্রাণশক্তি ছোটে
জিভের চাবুক দিয়ে মারো
আর ঘেন্না যাক উঠে” (মাংসদোকান)
বোঝা যায় চৈতন্যের গহীন উৎস মুখে সঞ্চালিত ঐ মনন একইসঙ্গে সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ করছে৷ জৈব ও জৈবহীনতার দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রত্নগভীর ধূসর কোনো প্রশ্নের কাছে উপনীত হয়ে মেলে ধরছে সাম্যতার নিপুণ বলয়ে সমস্ত অসামঞ্জস্য ও বিয়োজনের কূটাভাস। এখানে উৎকর্তনভীতি ( castration fear) নেই, বরং অবদমন ( repression) ও সুপ্তাবস্থা পেরিয়ে ( Latency Period) অর্ধজাগ্রত, সুদূরপরাহত গূঢ়ৈষণার কাছে সম্পূর্ণ করছে তার বৃত্ত। আসল কথা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, উৎকণ্ঠা, যৌনতা মেশানো এই শরীরের গতিশীল পরিভ্রমণ, এক নিটোল সামূহিক প্রতিফলন ধরা পড়েছে ‘শরীরপরব’-এর কবিতাগুলিতে। শুধু একক ব্যক্তিত্বের স্বাদ নয়, ব্যক্তিত্বের দ্বিবৃত্তে সংঘটিত হয়েছে এই হ্লাদিনীর অনুভব৷ মানসিক ভগ্নাংশতায় সেই খণ্ড আয়োজন দ্বিধা অসহায়তার প্রভাব পড়েছে। এই কেন্দ্রীয় অনুভব ঘিরে তৈরি হচ্ছে আখ্যানহীন কথামালা, চিন্তাজাল, মননপ্রতিমা। সেই অনশ্বর ইন্দ্রজালের নির্যাস শুষে নিয়ে কবি পৌঁছাবেন দেহ ও দেহহীনতার অপরিমিত প্রসার ও ব্যঞ্জনায়।
‘শরীরপরব’ শুভম চক্রবর্তী
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
প্রচ্ছদ ও বর্ণ-সংস্থাপন : শূদ্রক উপাধ্যায়
প্রকাশক– ইতিকথা পাবলিকেশন্স।
মূল্য: ১৫০