রামনামই সত্য, হায় ! : রামকথার একটি রাবীন্দ্রিক পাঠ
গৌতম চৌধুরী
এক রামায়ণে রক্ষা নাই, আবার নয়া-রামায়ণ! বরং সাবেক রামায়ণকথা লইয়াই রবীন্দ্রনাথের পাঠ-পাঠান্তরগুলি আজ খানিক উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখি। ঠাকুর তাঁহার লম্বা জীবনে নানা উপলক্ষে রাম-রামকথা-বাল্মীকি এসব কিছু লইয়া নানা কিসিমের মন্তব্য করিয়াছেন। কখনও আবার বিলকুল স্বতন্ত্র আলাপও ফাঁদিয়াছেন। সব রচনার অনুপুঙ্খে গেলে তাহা এক রকম মহাভারতই হইয়া যাইবে। এ-বাবদে তাঁহার ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণগুলি লইয়া বিদ্বানেরা নিশ্চয়ই এন্তার মাথার ঘাম ফেলিয়াছেন। আমরা অস্থিরমতি পড়ুয়া মাত্র। ভাবিতেছিলাম, বাঙালির অন্তিম যাত্রায় রামনামই সত্য হইয়া উঠিতে চলিতেছে কিনা১! সেই আশংকা যে আমাদের বর্তমান পাঠপ্রয়াসে যথেষ্ট শ্রাবণমেঘের ছায়া ফেলিয়াছে, তাহা পহেলাই কবুল করিয়া রাখি।
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।
ভ্রমণের শর্ত কি মোক্ষম একটি গন্তব্য, না তাহা কেবলই নানা অভাবিত অভিজ্ঞতার ফয়দা তুলিতে তুলিতে নাশক চলিতে থাকা? ভ্রমণের ভিতর কি একটু ভ্রম মিশিয়া থাকিবে না! ভ্রমই কখন ভ্রমর হইয়া উড়িয়া যাইবে, আমরাও তাহার পিছু পিছু আমাদের নিছক শূন্য হইতে এলাহি মহাশূন্যের গরিমা খানিক স্পর্শ করিব। রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের সেই মহাপথিকতায় ডাক দেন। গান-কবিতা-নাটক-আখ্যান বাদ, স্রেফ তাঁহার কেজো গদ্যগুলির ভিতর দিয়া একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নিম-সফরেও, তাহাদের মহাজগতিক আভা আমাদের ঘুমন্ত স্নায়ুকোষগুলিকে জাগায়, সস্নেহে তাহাদের পরিচর্যা করে, আর চুপি চুপি বলিয়া যায় আরও আরও গহনে চলিতে। দেখি, আমাদের হালফিল বিপন্নতার কতা না ওষধি সেখানে থরে-বিথরে সাজানো। কবির প্রলাপ বলিয়া আমরা তাহাদের উপর ধুলা জমিতে দিয়াছি। আমাদের ভাগ্য ভালো সেসব হরফে এখনও বল্মীকের স্তূপ গজায় নাই। তেমন ঘটিলে আবার নতুন করিয়া এক বাল্মীকি-প্রতিভার আয়োজন করিতে হইত। রাম না-জন্মাইতেই আবার করিয়া রামায়ণ রচিবার বরাত পড়িত তাঁহার উপর।
এক রামায়ণে রক্ষা নাই, আবার নয়া-রামায়ণ! বরং সাবেক রামায়ণকথা লইয়াই রবীন্দ্রনাথের পাঠ-পাঠান্তরগুলি আজ খানিক উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখি। ঠাকুর তাঁহার লম্বা জীবনে নানা উপলক্ষে রাম-রামকথা-বাল্মীকি এসব কিছু লইয়া নানা কিসিমের মন্তব্য করিয়াছেন। কখনও আবার বিলকুল স্বতন্ত্র আলাপও ফাঁদিয়াছেন। সব রচনার অনুপুঙ্খে গেলে তাহা এক রকম মহাভারতই হইয়া যাইবে। এ-বাবদে তাঁহার ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণগুলি লইয়া বিদ্বানেরা নিশ্চয়ই এন্তার মাথার ঘাম ফেলিয়াছেন। আমরা অস্থিরমতি পড়ুয়া মাত্র। ভাবিতেছিলাম, বাঙালির অন্তিম যাত্রায় রামনামই সত্য হইয়া উঠিতে চলিতেছে কিনা১! সেই আশংকা যে আমাদের বর্তমান পাঠপ্রয়াসে যথেষ্ট শ্রাবণমেঘের ছায়া ফেলিয়াছে, তাহা পহেলাই কবুল করিয়া রাখি।
বাংলাভাষার অনেক প্রধান সাহিত্যিকই গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকও বটেন। এ-ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্রের পরেই রবীন্দ্রনাথের নাম করিতে হয়। জীবনে অনেকগুলি কাগজই ঠাকুর সম্পাদনা করিয়াছেন। তবে তাহাদের ভিতর সাধনা-র নাম নানা কারণে মনে রাখিবার মতো। সাধনা-কে রবীন্দ্রনাথ মনে করিতেন তাঁহার ‘হাতের কুঠারের মতো’। এ-কাগজের মেয়াদ স্রেফ চার বছরের হইলেও (বং ১২৯৮-১৩০২), একদিকে যেমন তাঁহার সাহিত্যজীবনে তাহার একটি জমপেশ ভূমিকা ছিল, তেমনই তাঁহার সম্পাদক সত্তাও কাগজটিকে লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিল। সমসাময়িক অন্য লেখকদের দিয়া তো তিনি লিখাইতেনই, নিজেও সেখানে দুই হাতে গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখিতেন।২ এসবের বাহিরে তিনি চালু করিয়াছিলেন কিছু বিভাগীয় রচনা – সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা, বৈজ্ঞানিক সংবাদ ও সাময়িক সারসংগ্রহ। প্রথম দুইটি বিভাগের আলোচ্য তাহাদের শীর্ষনাম হইতেই বুঝা যায়। আর, সাময়িক সারসংগ্রহের রচনাগুলি ছিল এক ধরনের কড়চা। সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ছোট ছোট প্রতিবেদন। এইসব অসাক্ষরিত গদ্যের বেশির ভাগই ঠাকুরের নিজের রচনা।
আমাদের বর্তমান আলাপ শুরু করিব সাধনা-র অন্তিম সংখ্যায় (ভাদ্র-কার্তিক ১৩০২) প্রকাশিত সাময়িক সারসংগ্রহ বিভাগের তেমনই একটি টুকরা গদ্য দিয়া। রচনাটির শিরোনাম – নূতন সংস্করণ। প্রতিবেদনটিতে মহারাষ্ট্রের সেকালীন ‘নব্য হিন্দুদের’ কিছু সামাজিক সংস্কার-আন্দোলনের কথা তুলিয়া ধরা হইয়াছে। তাহাদের একটি হইল রামনবমী উদ্যাপন সংক্রান্ত। প্রতিবেদন মারফত আমরা জানিতে পারি, মারাঠি সেই নয়া প্রজন্ম ভাবিতেছিলেন, রামনবমীর দিন ‘রামকে দেবতারূপে পূজা করায়, দেবাধিদেব পরমেশ্বরের মহিমা ও ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের সাহিত্য-মর্যাদা যুগপৎ খর্ব’ হয়। এটি তাঁহারা মানিতে পারিতেছিলেন না। কিন্তু প্রচলিত অনুষ্ঠান পুরা বর্জন না-করিয়া, সেই উৎসবের শেষে নিজেদের কিছু নয়া কর্মসূচি জুড়িয়া দিবার কথা ভাবিলেন তাঁহারা। সেই কর্মসূচিটিই আসল খবর। প্রথমত তাঁহারা ‘কথকতা কীর্তন প্রভৃতির দ্বারা রামায়ণের কবিত্ব-রসাস্বাদন করিবেন’, পাশাপাশি ‘প্রবন্ধপাঠ ও আলোচনাদির দ্বারা উহার সাহিত্যনৈপুণ্য ও নীতি-মহত্ত্ব উপলব্ধি করিবেন’। দেখা যাইতেছে, মারাঠি সেই সংস্কারকরা আদৌ ধর্মদ্রোহী নন। বরং, রামকে দেবতা বানাইয়া পূজা করিলে যে ঈশ্বরের অবমাননা হয়, এইরূপই তাঁহাদের বুঝ। ফলত, একটি সুমহান সাহিত্যকৃতি হিসাবেই রামায়ণকে তাঁহারা আমলে লইতে চান, এবং তাহার পরিশ্রমী চর্চায় সামিল হইতে চান।
এটি উনিশ শতকের শেষ লগ্নের বোম্বাই প্রেসিডেন্সির একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর খবর মাত্র। বাঙালি পাঠকের জন্য ঠাকুর এটি বাছিতে গেলেন কেন! কিন্তু স্রেফ খবর পরিবেশন করিয়াই তো তিনি ক্ষান্ত হন নাই, প্রতিবেদনের শেষে ‘আমাদের দেশে’র জন্য কিছু সুপারিশও রাখিয়াছেন –
বোম্বাইয়ের নব্য হিন্দু সম্প্রদায় এইরূপে উৎসব ও পবিত্র দিবসকে উপযুক্ত অনুষ্ঠানের দ্বারা সজীব করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছেন এবং তাঁহাদের ক্ষুদ্র দলের মধ্যে অনেকটা কৃতকার্যও হইয়াছেন। উল্লিখিত সমস্যার এইরূপ সুন্দর মীমাংসা আমাদের দেশে প্রচলিত হইবার উপযুক্ত। আমাদেরও প্রত্যেক শুভকার্যের সহিত যে-সকল সুরুচিবিরুদ্ধ ও অপ্রীতিকর প্রথা জড়িত আছে তাহা পরিত্যাগ করিলে নব্য হিন্দুরা নব উৎসাহে সেগুলিতে যোগ দিতে পারেন।
অর্থাৎ, ঠাকুরের বিবেচনা মোতাবেক, অন্তত উনিশ শতকের সেই শেষ লগ্নের (১৮৯৫) বিবেচনা মোতাবেক, রামকে অবতার ভবিয়া রামনবমী পালন করা একটি ‘সুরুচিবিরুদ্ধ ও অপ্রীতিকর প্রথা’। রামায়ণকে মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসাবে বিবেচনা করিয়া তাহার যথাসাধ্য চর্চা ‘উল্লিখিত সমস্যার’ একটি ‘সুন্দর মীমাংসা’। যাহা মারাঠি সংস্কারকরা করিয়া দেখাইয়াছেন। যাহা আমারাও ‘আমাদের দেশে’ অর্থাৎ বাংলাদেশে চালু করিতে পারি।
ভক্তেরা রামকে ভক্তি করিলেও রাম-চরিত্র এবং সেই চরিত্রের মহান ভাব যে একজন কবির সৃষ্টি এবং আদিকবি বাল্মীকি যে সেই কাহিনির মহাপ্রতিভাধর রচয়িতা, এই উপপত্তি রবীন্দ্রনাথকে অবশ্য বোম্বাই হইতে আমদানি করিতে হয় নাই। এহেন ধারণার উল্লেখ তাঁহার প্রথম জীবনের রচনাতেই পাওয়া যায়। মাত্র ২০ বছর বয়সে, শিল্পসৃষ্টি আর শিল্পস্রষ্টার আন্তঃসম্পর্ক লইয়া ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত (মাঘ ১২৮৮) একটি ছোট গদ্যে তিনি লিখেন –
প্রতিভা যখন মুহূর্ত কালের জন্য অতিথি হইয়া এক জন কবিকে বীণা করিয়া তাঁহার তন্ত্রী হইতে সুর বাহির করিতে থাকে তখন তিনি নিজের সুর শুনিয়া নিজে মুগ্ধ হইয়া পড়েন। বাল্মীকি তাঁহার নিজের রচিত রামকে যেমন ভক্তি করিতেন এমন কোন ভক্ত করেন না এবং যতক্ষণ তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও তাঁহার নিজের মহান্ ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন। (নিরহঙ্কার আত্মম্ভরিতা, বিবিধ প্রসঙ্গ, ১২৯০)
রামায়ণ যে চিরন্তন বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ নমুনা আর বাল্মীকি এক অন্তর্দ্রষ্টা মহান কবি, এই বুঝ হইতেই ঠাকুর তাঁহার প্রথম জীবনের নানান রচনার ফাঁকে এই কাব্য ও তাহার রচনাকারকে লইয়া এইভাবে নানা কথা বলিয়াছেন। নানান বাচনভঙ্গিমায় সেখানে ধরা পড়িয়াছে নানান সাহিত্যতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ। কয়েকটি নমুনা দেখিয়া লওয়া যাক।–
১. বই লিখিয়া টাকা নাই হইল! যে না লিখিয়া থাকিতে পারিবে না সেই লিখিবে, যাহার টাকা না হইলে চলে না সে লিখিবে না। … বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করিয়া কি কুবেরের ভাণ্ডার লুঠ করিয়াছিলেন? যদি তাঁহার কুবেরের ভাণ্ডার থাকিত রামায়ণ রচনার প্রতিবন্ধক দূর করিতে তিনি সমস্ত ব্যয় করিতে পারিতেন। … লেখার উদ্দেশ্য মহৎ না হইলে লেখা মহৎ হইবে না। (একটি পুরাতন কথা, সমাজ, অগ্রহায়ণ ১২৯১)
২. পালোয়ানিকে আমাদের দেশে সর্বাপেক্ষা বড়ো জ্ঞান করিত না। এইজন্য বাল্মীকির রাম রাবণকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, রাবণকে ক্ষমা করিয়াছেন। রাম রাবণকে দুইবার জয় করিয়াছেন। একবার বাণ মারিয়া, একবার ক্ষমা করিয়া। কবি বলেন, তন্মধ্যে শেষের জয়ই শ্রেষ্ঠ। হোমরের একিলিস পরাভূত হেক্টরের মৃতদেহ ঘোড়ার লেজে বাঁধিয়া শহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিলেন – রামে একিলিসে তুলনা করো। … আমাদের কবিরা পুরস্কারেরও লোভ দেখান নাই। ইংরাজেরা য়ুটিলিটেরিয়ান, কতকটা দোকানদার; তাই তাঁহাদের শাস্ত্রে পোয়েটিক্যাল জাস্টিস-নামক একটা শব্দ আছে, তাহার অর্থ দেনাপাওনা, সৎকাজের দর-দাম করা। আমাদের সীতা চিরদুঃখিনী, রাম-লক্ষ্মণের জীবন দুঃখে কষ্টে শেষ হইল। (চিঠিপত্র ৫, চিঠিপত্র, আশ্বিন ১২৯২)
৩. … কাব্যে আমরা আমাদের বিকাশ উপলব্ধি করি। তাহার সহিত নূতন তত্ত্বের কোনো যোগ নাই। বাল্মীকি যাহা ব্যক্ত করিয়াছেন তাহা বাল্মীকির সময়েও একান্ত পুরাতন ছিল। রামের গুণ বর্ণনা করিয়া তিনি বলিয়াছেন ভালো লোককে আমরা ভালোবাসি। কেবলমাত্র এই মান্ধাতার আমলের তত্ত্ব প্রচার করিবার জন্য সাত-কাণ্ড রামায়ণ লিখিবার কোনো আবশ্যক ছিল না। কিন্তু ভালো যে কত ভালো, অর্থাৎ ভালোকে যে কত ভালো লাগে তাহা সাত-কাণ্ড রামায়ণেই প্রকাশ করা যায়; দর্শনে বিজ্ঞানে কিম্বা সুচতুর সমালোচনায় প্রকাশ করা যায় না। (কাব্য, সাহিত্য, চৈত্র ১২৯৮)
৪. সমীর কহিল– ‘… তোমরা যে সকল কথা তুলিয়াছিলে সেগুলো বড়ো বেশি সাধারণ কথা। মনে করো যদি বলা যায়, রামায়ণের তাৎপর্য এই যে রাজার গৃহে জন্মিয়াও অনেকে দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে, … – তবে সেটাকে একটা নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা বলা যায় না।’
স্রোতস্বিনী কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া কহিল, ‘আমার তো মনে হয় সেই-সকল সাধারণ কথাই কবিতার কথা। রাজগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াও সর্বপ্রকার সুখের সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমৃত্যুকাল অসীম দুঃখ রাম ও সীতাকে সংকট হইতে সংকটান্তরে ব্যাধের ন্যায় অনুসরণ করিয়া ফিরিয়াছে – সংসারের এই অত্যন্ত সম্ভবপর, মানবাদৃষ্টের এই অত্যন্ত পুরাতন দুঃখকাহিনীতেই পাঠকের চিত্ত আকৃষ্ট এবং আর্দ্র হইয়াছে।’ (কাব্যের তাৎপর্য, পঞ্চভূত, অগ্রহায়ণ ১৩০১)
দেখা যাইতেছে, লেখকতার শুরু হইতেই রাম-চরিত্রের অবতারত্ব লইয়া রবীন্দ্রনাথের কোনও মাথাব্যথা নাই। তিনি বাল্মীকির কবিপ্রতিভার উপরেই ইমান রাখিয়াছেন। আদিকবি রচিত এক এলাহি মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় মানবচরিত্র এই রাম, যাহা কবির রচনার গুণে কাল হইতে কালান্তরে প্রজন্ম হইতে প্রজন্মান্তরের মনোগহনে ঠাঁই পাইয়াছে। বাল্মীকির কবিচিত্তেই তাঁহার জন্ম। এই অনুভাবটিই কালক্রমে ঠাকুরের বহুচর্চিত ভাষা ও ছন্দ কবিতায় আখর পাইয়াছে। আদিকবি তখন নতুন এক কাব্যসৃষ্টির স্বপ্নে বিভোর। যেকোনও নবীন কবির মতোই সেই কাব্যের রূপকল্পনার নানা দিক লইয়া তিনি আলোড়িত। ভাবিতেছেন, লোকমুখে বহুব্যবহৃত ভাষা তাঁহার আসন্ন রচনায় পাইবে এক নতুন উড়াল – ‘মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দে দিবে নব সুর, / অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর / ভাবের স্বাধীন লোকে’। ভাবনার সেই মুক্তাঞ্চল গড়িয়া উঠিবে ‘ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্যাদা’ দান করিয়া। বিষয়মাহাত্ম্যের সেই দূরান্বয়ও আদিকবির কাছে ধরা পড়িতেছে – ‘তেমনি আমার ছন্দ ভাষারে ঘেরিয়া আলিঙ্গনে/ গাবে যুগে যুগান্তরে সরল গম্ভীর কলস্বনে/ দিক হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান,/ ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্যাদা করি দান’। সবই টের পাইতেছেন। কিন্তু ধন্দ শুধু এই যে, সেই আসন্ন কাব্যের সুউন্নত আদর্শের কেন্দ্রে কে থাকিবেন, কে হইবেন তাহার নায়ক! তখন দেবর্ষি নারদ রামের নাম প্রস্তাব করিলেন। রাম সংক্রান্ত তথ্যজ্ঞানের অভাবে বাল্মীকির দ্বিধা, আর কবিতা যে নিছক তথ্য দিয়া রচিত হয় না, হয় মহৎ প্রতিভার আলোয়, নারদের এই অনুপ্রাণিত-করা উক্তিতে বাল্মীকির কাব্যের অনুধ্যান শুরু। যেখানে, ঠাকুরের কবিতাটির সমাপ্তি –
”… কহো মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।”
নারদ কহিলা ধীরে, “অযোধ্যার রঘুপতি রাম।”
“জানি আমি জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা”,
কহিলা বাল্মীকি, “তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা,
সকল ঘটনা তাঁর – ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।”
নারদ কহিলা হাসি, “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
এত বলি দেবদূত মিলাইল দিবাস্বপ্নহেন
সুদূর সপ্তর্ষিলোকে। বাল্মীকি বসিলা ধ্যানাসনে,
তমসা রহিল মৌন, স্তব্ধতা জাগিল তপোবনে। (ভাষা ও ছন্দ, কাহিনী, ভাদ্র ১৩০৫)
ভাষা ও ছন্দ কবিতাটি রচনার আরও বছর পাঁচেক বাদে রবীন্দ্রনাথ আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের রামায়ণী কথা-র একটি ভূমিকা লিখেন। সে-গদ্যটিতে নারদ-বাল্মীকি কথোপকথনের প্রসঙ্গটি আবার আসিয়াছে। এবং সেই সূত্রে সেখানে ঠাকুর সুস্পষ্টভাবেই বলিয়াছেন – ‘রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা, দেবতার কথা নহে’।
আদিকাণ্ডের প্রথম সর্গে বাল্মীকি তাঁহার কাব্যের উপযুক্ত নায়ক সন্ধান করিয়া যখন বহু গুণের উল্লেখ করিয়া নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন –
সমগ্রা রূপিণী লক্ষ্মীঃ কমেকং সংশ্রিতা নরম্।
কোন্ একটি মাত্র নরকে আশ্রয় করিয়া সমগ্রা লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করিয়াছেন? তখন নারদ কহিলেন –
দেবেষ্বপি ন পশ্যামি কশ্চিদেভির্গুণৈর্যুতম্।
শ্রূয়তাং তু গুণৈরেভির্যো যুক্তো নরচন্দ্রমাঃ।
এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না, তবে যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এই-সকল গুণ আছে তাঁহার কথা শুন। রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা, দেবতার কথা নহে। রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।
মানুষেরই চরম আদর্শ-স্থাপনার জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন। এবং সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই আদর্শচরিত-বর্ণনা ভারতের পাঠকমণ্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছে। (রামায়ণ, প্রাচীন সাহিত্য, ৫ পৌষ ১৩১০ )
২.
রামায়ণী কথা-র ওই ভূমিকা হইতে আমরা অতঃপর ৪২ বছর পিছাইয়া আসি, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জন্মসালে। মেঘনাদবধ কাব্য তখন অংশত ছাপা হইয়াছে। কোনও কোনও মহলে কবি প্রশংসিত হইতেছেন। কিছু মানুষজনের আবার অভিযোগ এই যে, কবির হৃদয় রাক্ষসদের দিকে ঝুঁকিয়া। কবি নিজেই মানিতেছেন, সে-ফরিয়াদ ষোল আনা সত্য। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখা একটি চিঠিতে তিনি অক্লেশে জানাইতেছেন যে, রাম এবং তাহার সাঙ্গপাঙ্গদের তিনি ঘৃণা করেন। বরং রাবণের মনশ্ছবি তাঁহার কল্পনাশক্তিকে উৎকর্ষিত করে, প্রজ্জ্বলিত করে, ‘he was a grand fellow’। এহেন অভিব্যক্তির ভিতর দিয়া বাংলাভাষা ও বাঙালির মননে রামায়ণকে বিচার করিবার একটি মৌলিক দৃষ্টকোণ তখনই উপস্থাপিত হইল। যে-দৃষ্টিকোণ ধর্মাতিরিক্ত, পুরাদস্তুর শিল্পবোধসঞ্জাত।
সেই শিল্পবোধ হইতেই, প্রচলিত হিন্দু মূল্যবোধের বাহিরে দাঁড়াইয়াও, পৌরাণিক ভারতের প্রাচীন কাব্যসম্পদ মধুসূদনের কাছে কিছু কম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ছিল না। বন্ধু রাজনারায়ণকে আর একটি চিঠিতে তিনি এ-প্রসঙ্গে লিখিতেছেন–
I must tell you, my dear fellow, that though, as a jolly Christian youth, I don’t care a pin’s head for Hiduism, I love the grand mythology of our ancestors. It is full of poetry. A fellow with an inventive head can manufacture the most beautiful things out of it. (15th May, 1860)
প্রশ্ন উঠিতে পারে, তবে কি ধর্মান্তরিত হইয়াছিলেন বলিয়াই, ‘as a jolly Christian youth’ মধুসূদন রামায়ণের চরিত্রগুলিকে নিছক সাহিত্যবস্তু হিসাবে পুনর্মূল্যায়িত করিবার হিম্মত দেখাইলেন? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো বা যুগপৎ হ্যাঁ এবং না। ধর্মপরিচয়ের নিরিখেই ঘটনার সুরতহাল করিতে দড় কোনও চৌকিদার সাহেব বলিতেই পারেন, হিন্দু সংস্কার-নিরপেক্ষভাবে একটি প্রাচীন মহাকাব্যকে স্রেফ মহাকাব্য হিসাবেই আমলে লইতে হিন্দুআনির বাহিরে আসিয়া দাঁড়ানো সেইসময়ে মধুসূদনের সামনে এক গরজি শর্ত ছিল। পালটা আমরাও বলিতে পারি, একজন ইতিহাস-সৃষ্টিকারী কবি হিসাবে, যাহা কিছু পুরানা ধ্যান-ধারণা সব মিশমার করিয়া নতুন কিছু গড়িবার স্বপ্নে বিভোর সেদিনের সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটাইবার ব্রতে, কবির সামনে কোনও ধর্মগ্রন্থ ছিল না, ছিল হোমার ভার্জিল বাল্মীকি কালিদাস মিলটন প্রমুখের কিছু কাব্যগ্রন্থ। বা, সেই কাব্যগ্রন্থগুলিই ছিল তাঁহার একান্ত ধর্মগ্রন্থ। তিনি কখনওই সাহিত্যবিচারে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয় দেন নাই। বরং বন্ধু রাজনারায়ণ তরুণ বয়সের উষ্মা হইতে বৈষ্ণবপদের রাধিকার প্রণয়কে ‘অবিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম’৩ সাব্যস্ত করিলে, কবি তাঁহাকে বুঝাইয়াছেন – ‘Poor man! When you sit down to read poetry, leave aside all religious bias.’ (২৯ আগস্ট ১৮৬১তে লিখা চিঠি)।
কিছুদিন পরে যখন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করিবেন, ‘রামচন্দ্রের চরিত্র নির্দ্দোষ, অকলঙ্ক, দেবোপম বলিয়া ভারতে খ্যাত, কিন্তু বস্তুতঃ বাল্মীকি কখন রামচন্দ্রকে নির্দ্দোষ বা সর্ব্বগুণবিভূষিত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে ইচ্ছা করেন নাই। রামায়ণগীত শ্রীরামচন্দ্রের অনেক দোষ…’। বা, যখন আরও সরাসরি বলিবেন, ‘রামচন্দ্রও অনেক নিন্দনীয় কর্ম্ম করিয়াছেন। – যথা বালিবধ। কিন্তু তিনি যে সকল অপরাধে অপরাধী, তন্মধ্যে এই সীতা বিসর্জ্জনাপরাধ সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর।’ (উত্তরচরিত, বিবিধ প্রবন্ধ, ১৮৭৬) – তখন কি কেউ বঙ্কিমের ধর্ম লইয়া প্রশ্ন তুলিবেন? অবশ্য রামায়ণ লইয়া সাহিত্যিক আলোচনা ফাঁদিলেও, শ্রীকৃষ্ণকে তিনি কিন্তু খুব জোরেশোরেই অবতার হিসাবে গণ্য করিয়াছেন, এবং নিজের এই মত প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য কৃষ্ণচরিত্র নামে একটি বিশাল বহি লখিয়া ফেলিয়াছেন (প্রথম ভাগ ১৮৮৬, সম্পূর্ণ ১৮৯২)।
কৃষ্ণচরিত্র রচনাটি শুরুতে প্রচার পত্রিকার আশ্বিন ১২৯১ সংখ্যা হইতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতে থাকে। আর মজার কথা এই যে, ২৪ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ যেন সেই বঙ্কিমী বাখোয়াজি বরদাস্ত করিতে বিলকুল বেরহম। প্রায় কোনও রকম সময় নষ্ট না-করিয়া, কৃষ্ণচরিত্র -এর অবতারতত্ত্ব এবং সেখানে উপস্থাপিত ‘কৃষ্ণকথিত সত্যতত্ত্ব’-এর বিরুদ্ধে ভারতী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১২৯১ সংখ্যাতে যথেষ্ট ভব্যতার সাথেই কলম ধরিলেন তিনি –
লেখক মহাশয় একটি হিন্দুর আদর্শ কল্পনা করিয়া বলিয়াছেন, তিনি ‘যদি মিথ্যা কহেন তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণ পূর্ব্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় – অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।’ কোনোখানেই মিথ্যা সত্য হয় না, শ্রদ্ধাস্পদ বঙ্কিমবাবু বলিলেও হয় না স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলিলেও হয় না। বঙ্কিমবাবু শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করেন। কিন্তু, ঈশ্বরের লোকহিত সীমাবদ্ধ নহে – তাঁহার অখণ্ড নিয়মের ব্যতিক্রম নাই। (একটি পুরাতন কথা, সমাজ, অগ্রহায়ণ ১২৯১)
এইবার আমাদের সেই চৌকিদার সাহেব আবার আড়মোড়া ভাঙিয়া জাগিয়া উঠিতে পারেন। মধুসূদনের মামলা তো মুলতুবি হইয়াছে, এইবার এই ২৪বছরের ছোকরাটির এইসব চ্যাটাং চ্যাটাং কথারও কিছু ছানবিন দরকার। কিন্তু ইনি তো মাইকেলের মতো কোনও ধর্মান্তরিত ইয়ং বেঙ্গল নন। তবে হ্যাঁ, আশৈশব তাঁহার বাবামহশয়ের অপৌত্তলিক একেশ্বরবাদী জীবনাচরণে লালিত। সেই আদর্শে হারগিজ অবতারবাদের কোনও জায়গা নাই। এ-ব্যাপারে, আমাদের তরুণ কবিটিকে ছাড়িয়া বরং তাঁহার স্বনামধন্য পিতৃদেবের এজাহার আমাদের কাজে আসিতে পারে। মহর্ষি তাঁর আত্মজীবনীর এক জায়গায় উল্লেখ করিতেছেন –
ব্রাহ্মসমাজে যখন আমি প্রথম যাই (১৮৪২ খৃঃ), তখন দেখিলাম যে, … সেই ব্রাহ্মসমাজের বেদী হইতে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের সহযোগী ঈশ্বরচন্দ্র ন্যায়রত্ন, অযোধ্যাপতি রামচন্দ্রের অবতার হওয়ার বিষয় প্রতিপন্ন করিতেছেন। ইহা আমার অতিশয় অসঙ্গত ও ব্রাহ্মধর্ম্ম বিরুদ্ধ বোধ হইল। আমি ইহা প্রতিবিধান করিবার জন্য … বেদী হইতে অবতারবাদের বর্ণনা নিবারণ করিলাম। (অষ্টম পরিচ্ছেদ, আত্মজীবনী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৯৮)
ইহাতে আর কী প্রমাণ হইল! প্রমাণ হইল, বাবার আদর্শ ছেলের উপর বর্তাইয়াছে। কিন্তু সে প্রভাব যে কবির ৭৬ বছর বয়স ইস্তক বহাল থাকিয়া যাইবে, এতটা বোধ হয় চৌকিদার সাহেবও ভাবিতে পারেন না। সময়টা অক্টোবর ১৯৩৭। প্রায় মাসখানেক অসুখে ভুগিয়া কবি বোলপুর হইতে কলিকাতা আসিয়াছেন চিকিৎসার জন্য। এদিকে তখনই সেখানে চলিতেছে এআইসিসির বৈঠক। বৈঠকের নানা আলোচ্যের মধ্যে রহিয়াছে বন্দে মাতরম্ গানের প্রসঙ্গ, সেটি রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত থাকিতে পারে কি না, থাকিলেও আগাগোড়া সবটুকুই কি না, ইত্যাদি। কংগ্রেসের পক্ষ হইতে কবির মতামত চাওয়া হইল। জওহরলালকে চিঠি দিয়া (২৬ অক্টোবর) কবি তাঁহার মতামত জানাইলেন। দিনকয়েক বাদে খবর কাগজের পাতায় সেই চিঠির যে-বয়ান প্রকাশিত হইল, তাহা এইরকম (অংশবিশেষ) –
… To me the spirit of tenderness and devotion expressed in its first portion, the emphasis it gave to beautiful and beneficient aspects of our motherland made special appeal so much so that I found no difficulty in dissociating it from the rest of the poem and from those portions of the book of which it is a part, with all sentiments of which, brought up as I was in the monotheistic ideals of my father, I could have no sympathy. (Amrita Bazar Patrika, 2 November 1937)
কাজেই তাঁহার চিঠিতে, গানের প্রথম দুইটি স্তবক ছাড়া বাকি অংশ বর্জন করিবার সুপারিশই রহিল। আর সেজন্য, বিশ্বনাগরিকতার বোধ, বহুত্ববাদে বিশ্বাস, ইত্যাদির কথা না-পাড়িয়া তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিতার একেশ্বরবাদী আদর্শকেই সাবুত মানিলেন। শেষ তক নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সিদ্ধান্তের সহিত তাঁহার সুপারিশ মিলিয়া গেল। এবং বাজারে ঢিঢি পড়িয়া গেল।
কিন্তু সত্যি কথা বলিতে কি, কবির এই চিঠি আসলেই ছিল অনেকখানি রাখিয়া ঢাকিয়া বলা। কারণ জনমতের ভয় তাঁহারও ছিল। কলিকাতার হিন্দু বাবুসমাজ ও হিন্দু খবর কাগজগুলি, কংগ্রেস অধিবেশনের আগে হইতেই বন্দেমাতরম্ লইয়া বাজার গরম করিয়া রাখিয়াছিলেন। এদিকে হাজতের আড়ালে তখনও শত শত বাঙালি তরুণ পচিতেছে। সেসব লইয়া বাবুদের তেমন গা নাই, বন্দেমাতরম্-এর অজুহাতে হিন্দুআনি গেল গেল করিয়া তাঁহারা ব্যাকুল। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলমান-তোষণের নালিশ তো ছিলই।৪
তবু মনের কথা কি আর চাপা থাকে! ঠাকুরও বন্দেমাতরম্ বাবদ যত কথা আছে, মন খুলিয়া সবই লিখিয়া দিয়াছিলেন কয়দিন আগের একটি অ-দাফতরিক চিঠিতে। চিঠির প্রাপক, আর কেহ নন, কয়দিন বাদেই যিনি সারা ভারত কংগ্রেসের সভাপতি হইবেন, পরে বিতাড়িতও। এই চিঠিটি তো অন্তত আমাদের বাংলার ইস্কুলে ইস্কুলে পড়ানো যাইত –
বন্দেমাতরম্ গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব এ কথা এতই সুস্পষ্ট যে এ নিয়ে তর্ক চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলা দেশের সঙ্গে দুর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভূজামূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনো মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না। এবারে পূজা সংখ্যার বহু সাময়িক পত্রেই দুর্গাপূজার প্রসঙ্গে বন্দে মাতরম্ গানের শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করে দিয়েছে – সহজেই দুর্গার স্তব রূপে একে গ্রহণ করেছে। আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীনভাবে সংগত হোতেই পারে না। বাংলা দেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আব্দার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় ওঠে। বস্তুতঃ এতে আমাদের পরাভব।
…
পুঃ
বাঙালি হিন্দুরা এই আলোচনা নিয়ে চঞ্চল হয়েছেন, কিন্তু ব্যাপারটি একলা হিন্দুর মধ্যে বদ্ধ নয়। উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রীয় সাধনায় আমাদের শান্তি চাই, ঐক্য চাই, শুভবুদ্ধি চাই – কোনো একপক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই নে। (সুভাষচন্দ্র বসুকে লিখা চিঠি, ১৯ অক্টোবর ১৯৩৭)
প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, রামায়ণী কথা হইতে আমরা সরিয়া আসিয়াছি বহুদূরে, ঠাকুরের ২০ বছর বয়স হইতে এক্কেরে ৭৬বছর বয়সে। এইবার, শঙ্খবাবুর কবিতার বদৌলতে বিখ্যাত হইয়া-যাওয়া সেই কন্ডাকটার মহোদয়ের ধ্বনি মোতাবেক, আবার কিছুটা পিছনের দিকে আগাইবার কোশেশ করা যাক।
৩.
মানুষ পরিবর্তনশীল, ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। আমরা সকলেই সেই ভেলকির অংশ। উনিশ শতকের সত্তর দশক হইতেই কলকাতা-কেন্দ্রিক বাবুসমাজের ‘জাগরণে’ কিছু ভাটার টান। প্রত্যাহত বিদ্যাসাগর কার্মাটাঁড় চলিয়া গেলেন। ব্রাহ্মসমাজে প্রবীণ-নবীনে দ্বন্দ্ব। সময় যাঁহাদের চোখে শুধু মানুষকে আগাইয়া লইয়া চলে, তাঁহাদের মনে হইতেই পারে, ঘড়ির কাঁটা তখন যেন পিছন পানে ঘুরিতেছে। তিরিশের কাছাকাছির যুবক রবীন্দ্রনাথের গলায়ও কিছুটা হতাশার সুর। হতাশা হইতেই কলমের মুখে কিছুটা শ্লেষও চলিয়া আসে –
সবসুদ্ধ দাঁড়াইতেছে এই সমাজ বা ধর্ম সম্বন্ধে হাত দিবার বিষয় আমাদের কিছুই নাই। … মাঝে একবার দিনকতক সমাজ সংস্কারের ধুয়া উঠিয়াছিল। শিক্ষিত যুবকেরা সকলেই জাতিভেদ বাল্যবিবাহ প্রভৃতির অপকারিতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিঃসন্দিগ্ধ ছিল। কিন্তু তথাপি কেবল দুই-চারি ঘর উৎপীড়িত সামাজবহির্ভূত ব্রাহ্ম পরিবার ছাড়া আর সর্বত্রই সমাজনিয়ম পূর্ববৎ সমানই ছিল। জড়তা এবং কর্তব্যের সংগ্রামে জড়তাই জয়লাভ করিল, … মাঝে যে ঈষৎ চাঞ্চল্য উপস্থিত হইয়াছিল তাহা দূর হইয়া বাঙালি ঠাণ্ডা হইয়া বসিল। (নব্যবঙ্গের আন্দোলন, ভারতী ও বালক, আশ্বিন ১২৯৬)
বুঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ কোন পরিপ্রেক্ষিত হইতে ‘ঠাণ্ডা হইয়া’-বসা বাঙালি মনকে চেতাইবার জন্য আরও ৬বছর বাদে সাধনা-র পাতায় বোম্বাইয়ের নব্য হিন্দু সম্প্রদায়ের রামনবমী সংক্রান্ত খবরটি ছাপিবেন। কিন্তু সমাজ বা ধর্মের সংস্কারের বিষয়ে সক্রিয়তা স্তব্ধ হইলেও, এই সময় কলিকাতার বুকে আার একটি ভাবনার মোড়ক খুলিয়া গিয়াছে। ঠাকুর পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতায় ও অংশগ্রহণে কয়েক বছর চলিয়াছে হিন্দু মেলা। এই মেলার দার্শনিক ভিত্তি ১৮৬৭ সালে রচিত রাজনারায়ণ বসুর একটি রচনা Prospectus of a Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal । ওই বছরেই মেলা শুরু হয়, প্রথম তিন বছর চৈত্র মেলা নামে। মেলার দ্বিতীয় বছরে প্রথম ভারতীয় আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের মেজদা, রচিত এই গান মেলায় গাওয়া হয়। সকলেই মাতিয়া উঠেন –
মিলে সবে ভারত সন্তান
একতান মন প্রাণ,
গাও ভারতের যশোগান।
ভারত ভূমির তুল্য আছে কোন্ স্থান?
এই মেলা স্বাদেশিকতা জাগাইল। ক্রমে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাও নির্ণীত হইল। সাবেক ইয়ং বেঙ্গল রাজনারায়ণ, মধুসূদনের সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ রাজনারায়ণ, ব্রাহ্ম সমাজের নায়ক রাজনারায়ণ, ১৮৭২ সালে লিখিলেন হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা নামে তাঁহার বিখ্যাত গ্রন্থ। সেখানে বলা হইল ব্রাহ্মধর্ম আলাদা কিছু নয়, হিন্দুধর্মেরই পরিশীলিত এক রূপ। আর সেই হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলা হইল –
এ ধর্ম্মকে কে বিলুপ্ত করিতে পারে? বৌদ্ধেরা হিন্দুধর্ম্মকে বিলুপ্ত করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হয় নাই। মুসলমানেরা হিন্দু ধর্ম্মের বিনাশার্থ যৎপরনাস্তি চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু ইহার কিছুই করিতে পারে নাই। খৃষ্টীয় মিসনরিরা এখানে ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসিয়াছেন, কিন্তু হিন্দুধর্ম্মের বল দেখিয়া তাঁহাদিগকে এখন পালাই পালাই ডাক ছাড়িতে হইয়াছে।
অর্থাৎ হিন্দুত্বের প্রতিস্পর্ধী একটি অপর-সত্তা নির্মিত হইল। আর সেই অপরের মোকাবিলা করিবে কাহারা, তাহারও নিদান দেওয়া হইল এইভাবে –
হিন্দু নাম কি মনোহর! … এইনাম দ্বারা সমস্ত হিন্দুগণ ভ্রাতৃসূত্রে সম্বদ্ধ হইবে। এই নামদ্বারা বাঙ্গালী, হিন্দুস্থানী, পঞ্জাবী, রজপুত, মাহারাট্টা, মাদ্রাজী, সমস্ত হিন্দুবর্গ এক হৃদয় হইবে। তাহাদিগের সকলের এক প্রকার উন্নত কামনা হইবে, সকল প্রকার স্বাধীনতা লাভ জন্য তাহাদের সমবেত চেষ্টা হইবে।
যতই ভাসা ভাসা হউক, আনন্দমঠ-এর (১৮৮২) ঢের আগে, এইভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি খসড়া রচিত হইয়া গেল। যাহার ভিতর ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও ভান নাই। যাহার জমিনটি হইল আপামাথা হিন্দুআনি। সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে মঙ্গলঘট ভরিবার বহুত্ববাদী কবিকল্পনা যে-জাতীয়তাবাদী প্রকল্পটি হইতে হাজার যোজন দূরে। এই সূত্রে দুইটি ঘটনা আমাদের মনে পড়িয়া যাইতে পারে। ১. জাতিভেদ প্রথায় অবিশ্বাসী ব্রাহ্মধর্মের একজন আচার্য হইয়াও রাজনারায়ণ একবার তাঁহার সুহৃদ ভুদেব মুখোপাধ্যায়কে (তিনি অবশ্য সনাতন হিন্দু ব্রাহ্মণ) সঙ্গে লইয়া ‘পিতৃভূমি’ কনৌজ (কান্যকুব্জ) দর্শনে গিয়াছিলেন। যেহেতু জনশ্রুতি এই যে, বঙ্গীয় ব্রাহ্মণেরা সংকর বলিয়া তাহাদের প্রতি অবজ্ঞাবশত অবাঙালি রাজা আদিশূর কনৌজ হইতে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও তাহাদের ভৃত্য হিসাবে পাঁচজন কায়স্থ এদেশে আনাইয়াছিলেন। তাই, কনৌজ হইল ব্রাহ্মণ মুখোপাধ্যায় ও কায়স্থ বসুর ‘পিতৃভূমি’! ২. হিন্দুমেলায় কোনও অহিন্দু (ভারতীয় হইলেও) সদস্য হইতে পারিত না।
এই অবধি আসিয়া মনে হইতেছে, এত সাতকাহনের কী দরকার ছিল! হয়তো শুধু এইটুকুই ঠাহর করিবার জন্য যে, জীবনের প্রতিটি পর্বপর্যায়ে কতরকম মায়াডাক এড়াইয়া রবীন্দ্রনাথকে তাঁহার সুদূর পারের পথটি তৈয়ার করিতে হইয়াছে। ১৮৯৯ সালে সদাহাস্যোজ্জ্বল বৃদ্ধ রাজনারয়ণের প্রয়াণ। জীবনস্মৃতি-র বদৌলতে আমরা সকলেই জানি, তাঁহার বিষয়ে অল্পবয়সী ঠাকুরের মুগ্ধতার কথা। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর হয়তোবা তাঁহার সেই ‘পিতৃভূমি’র রূপকথা কবিকেও কিছু কাবু করিয়াছিল। কোনও এক দোলাচলে বাংলাদেশ হইতে ‘পশ্চিম’কে মনে হইয়াছিল শ্রেয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ ছড়া পড়িতে পড়িতে হয়তো তাই তাঁহার মনে হইল, ‘পশ্চিমে’ অর্থাৎ গো-বলয়ে ‘বাংলা অপেক্ষা পৌরুষের চর্চা অধিক’। বাংলার ছড়ায় দেখা যায় রাধাকৃষ্ণ বা হরগৌরীর কাহিনির রমরমা, রাম-সীতার আখ্যানের এখানে তত চল নাই। আর বাড়তি পৌরুষের গুণেই হয়তো গো-বলয়ে ঠিক তাহার উলটা। সেখানে ‘রামায়ণকথাই সাধারণের মধ্যে বহুলপরিমাণে প্রচলিত’। এই বিষয়ে ঠাকুরের বিশ্লেষণ হইল, ‘আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণের কথায় সৌন্দর্যবৃত্তি এবং হরগৌরীর কথায় হৃদয়বৃত্তির চর্চা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে ধর্মপ্রবৃত্তির অবতারণা হয় নাই’। কিন্তু গো-বলয়ে ‘বহুলপরিমাণে প্রচলিত’ সেই ‘রামায়ণ-কথায় এক দিকে কর্তব্যের দুরূহ কাঠিন্য, অপর দিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য, একত্র সম্মিলিত। … তাহাতে সর্বপ্রকার হৃদ্বৃত্তিকে মহৎ ধর্মনিয়মের দ্বারা পদে পদে সংযত করিবার কঠোর শাসন প্রচারিত।’ তাই সব মিলাইয়া কবির গভীর আক্ষেপ –
বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণকথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে নাই তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর। (গ্রাম্যসাহিত্য, লোকসাহিত্য, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩০৫)
ঠাকুরের তৎকালীন এই আক্ষেপ ভেদ করিয়া দুইটি সত্য নির্মমভাবে বাহির হইয়া আসিতেছে। সেই দুইটি হইল –
১. কোনওদিনই ‘বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণকথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে … মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে নাই’।
২. ‘রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা’ ভিন্নতর। অর্থাৎ, আমরা ও তাহারা আলাদা।
ঠাকুর সেইদিন এই ভিন্নতার জন্য দুঃখ করিয়াছিলেন। সেই ভিন্নতাকে আমাদের ন্যূনতা ভাবিয়াছিলেন। কিন্তু বাঙালির শ্রেষ্ঠতা কোথায় সেকথা তাঁহার মতো করিয়া আর কে জানিত? কারণ তিনি নিজেই তো তাহা আমাদের দান করিয়াছেন। আজ তাঁহার মুখ হইতে সেই কথা বারেক শুনিয়া শ্লাঘা প্রকাশের দিন নয়। কারণ আমরা তাঁহার কোনও কথা মনে রাখি নাই। রাখি নাই, কারণ রাখিতে চাই নাই। চাই নাই, কারণ আমল দিই নাই। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়াছে। আসুন, একবার তাঁহার কথা শুনি –
ইন্ধনের নিজের মধ্যে আগুন প্রচ্ছন্ন আছে বলিয়াই বাহিরের আগুনের স্পর্শে সে জ্বলিয়া উঠে; পাথরের উপর বাহির হইতে আগুন রাখিলে সে ক্ষণকালের জন্য তাতিয়া উঠে, কিন্তু সে জ্বলে না। বাংলাসাহিত্য বাঙালির মনের মধ্যে সেই ভিতরের আগুনকে সত্য করিয়া তুলিতেছে; ভিতরের দিক হইতে তাহার মনের দাসত্বের জাল ছেদন করিতেছে। একদিন যখন এই আগুন বাহিরের দিকে জ্বলিবে, তখন ঝড়ের ফুৎকারে সে নিবিবে না, বরং বাড়িয়া উঠিবে। এখনই বাংলাদেশে আমরা তাহার প্রমাণ পাইয়াছি, বর্তমান কালের রাষ্ট্রিক আন্দোলনের দিনে মত্ততার তাড়নায় বাঙালি যুবকেরা যদি-বা ব্যর্থতার পথেও গিয়া থাকে, তবু আগুন যদি ভারতবর্ষের কোথাও জ্বলিয়া থাকে সে বাংলাদেশে; কোথাও যদি দলে দলে দুঃসাহসিকেরা দারুণ দুঃখের পথে আত্মহননের দিকে আগ্রহের সহিত ছুটিয়া গিয়া থাকে সে বাংলাদেশে। ইহার অন্যান্য যে-কোনো কারণ থাক্, একটা প্রধান কারণ এই যে, বাঙালির অন্তরের মধ্যে বাংলাসাহিত্য অনেক দিন হইতে অগ্নি-সঞ্চয় করিতেছে– তাহার চিত্তের ভিতরে চিন্তার সাহস আনিয়াছে, তাই কর্মের মধ্যে তাহার নির্ভীকতা স্বভাবতই প্রকাশ পায়। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নহে, তাহার চেয়ে দুঃসাধ্য সমাজক্ষেত্রেও বাঙালিই সকলের চেয়ে কঠোর অধ্যবসায়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিয়াছে। পূর্ণ বয়সে বিবাহ, বিধবাবিবাহ, অসবর্ণবিবাহ, ভোজনপঙ্ক্তির বন্ধনচ্ছেদন, সাম্প্রদায়িক ধর্মের বাধামোচন প্রভৃতি ব্যাপারে বাঙালিই সকলের আগে ও সকলের চেয়ে বেশি করিয়া আপন ধর্মবুদ্ধির স্বাতন্ত্র্যকে জয়যুক্ত করিতে চাহিয়াছে। তাহার চিন্তার জ্যোতির্ময় বাহন সাহিত্যই সর্বদা তাহাকে বল দিয়াছে। সে যদি একমাত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়াই আবহমান কাল সুর করিয়া পড়িয়া যাইত – মনের উদার সঞ্চরণের জন্য যদি তাহার মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আলো, মুক্ত ক্ষেত্র না থাকিত – তবে তাহার মনের অসাড়তাই তাহার পক্ষে সকলের চেয়ে প্রবল বেড়ি হইয়া তাহাকে চিন্তায় ও কর্মে সমান অচল করিয়া রাখিত। (সাহিত্যসম্মিলন, সাহিত্যের পথে, বৈশাখ ১৩৩৩)
আমরা কৃত্তিবাসের রামায়ণ আর সুর করিয়া পড়ি না ঠিকই। কিন্তু বদলে কী পড়িতেছি? হনুমান চালিশা? রামনামই তবে এইভাবে সত্য হইল, হায়!
১ মনে পড়িয়া যাইতেছে অতুলপ্রসাদের প্রায়-লুপ্ত গানটি : মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা। বিখ্যাত গানটিকে প্রায়-লুপ্ত বলায় সবাই আলবাত হৈচৈ করিবেন। কিন্তু এ-গানের শেষ লাইনটি মনে আসিতেছে – ঐ ভাষাতেই বলব হরি, সাঙ্গ হ’লে কাঁদা হাসা। হাসিকান্না আমাদের কবেই সাঙ্গ হইয়াছে। বাংলা ভাষা লইয়া আর গর্বও নাই, আশাও নাই। বাঙালির সেই অন্তিম যাত্রায় এখন রাম নামই সত্য, হায়!
২ চার বছরের ৪৩টি সংখ্যায় কবিতা ৩১টি, গল্প ৩৬টি! আর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-টুকরা গদ্যের তো ইয়ত্তাই নাই।
৩ মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনায় রাজনারায়ণ এক জায়গায় মন্তব্য করেন –
– চমকি রামা উঠিলা সত্বরে, –
গোপিনী কামিনী যথা বেণুর সরবে (৫ম সর্গ ৩৮৭-৮৮ পং)
এইস্থলে অবিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম অকস্মাৎ আসিয়া কবি-বর্ণিত নিষ্কলঙ্ক দাম্পত্য প্রেমের বিশুদ্ধতা এক কালে বিনষ্ট করিয়াছে। এটা অমার্জ্জনীয় দোষ। নিশ্চয়ই মিল্টন কখনও এইরূপ লিখিতেন না। (মেঘনাদবধ সমালোচনা, বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম খণ্ড, ১৮৮২)
৪ যেসব কাগজ না-পড়িলে নাকি ফিলহাল পিছাইয়া পড়িতে হয়, সেসবের তৎকালীন সম্পাদকীয় পড়িলে মনে হইবে যেন পাঞ্চজন্য বা স্বস্তিকা-র সম্পাদকীয় পড়িতেছি! আগ্রহী জন নেপাল মজুমদার রচিত রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র বহিটি দেখিয়া লইতে পারেন।
শ্রাবণ ১৪২৭
পাঠপঞ্জি
গুপ্ত, ক্ষেত্র (সম্পা.), মার্চ ১৯৮৪, মধুসূদন রচনাবলী, কলিকাতা, সাহিত্য সংসদ
ঘোষ, বারিদবরণ (সম্পা.), বৈশাখ ১৪০২, রাজনারায়ণ বসু নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ, কলিকাতা, কলেজস্ট্রীট পাবলিকেশন প্রাঃ লিঃ
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ২৫ বৈশাখ ১৩৬৮, রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, প্রবন্ধ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ২৫ বৈশাখ ১৩৬৮, রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, প্রবন্ধ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, অগ্রহায়ণ ১৩৯০, রবীন্দ্র-রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, কবিতা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ফাল্গুন ১৩৯৫, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দশম খণ্ড, প্রবন্ধ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ফাল্গুন ১৪০৬, রবীন্দ্র-রচনাবলী, পঞ্চদশ খণ্ড : ক, বিবিধ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, পৌষ ১৪১০, রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ফাল্গুন ১৪০৪, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৩০তম খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ২৬-০৯-২০১৬, বিচিত্রা : বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার, কলকাতা, স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দ্র.
http://bichitra.jdvu.ac.in/manuscript/manuscript_viewer_bn.php?manid=373&mname=RBVBMS_283%28i%29
চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, দোলপূর্ণিমা ১৩৬১, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, কলিকাতা, সাহিত্য সংসদ
বসু, রাজনারায়ণ, ১৩১৫ (১৯০৯), আত্ম-চরিত, কলিকাতা, কুন্তলীন প্রেস
বসু, রাজনারায়ণ, ১৭৯৪ শক (১৮৭২), হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা, কলিকাতা, জাতীয় যন্ত্রে মুদ্রিত
ভট্টাচার্য, অমিত্রসূদন, ১৩৮৭, রবীন্দ্রনাথ : সাধনা ও সাহিত্য, সাধনা পত্রিকা পর্ব ১২৯৮-১৩০২, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং
মজুমদার, নেপাল, ১৩৫৫, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র, কলিকাতা, সারস্বত লাইব্রেরী
মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, কার্তিক ১৪১৭, রবীন্দ্রজীবনী, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ
মিত্র, অরবিন্দ ও আমেদ, অসীম (সম্পা.), ৭ পৌষ ১৩৮৮, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, কলিকাতা, চ্যারিয়ট ইন্টারন্যাশন্যাল্