
মেফিস্টো : শুধু নাটক না, একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
"শিল্পীর বা শিল্পের সাথে রাষ্ট্রের কি সম্পর্ক হবে, তা নিয়ে বরাবরই ভেবেছেন সুমন। হারবার্ট বা তিস্তাপার, বিসর্জন বা রাজা লিয়র, কাঙাল মালসাট বা রক্তকরবী-নানাবিধ প্রযোজনাতেই এই প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে তাঁর শিল্পকাজে ও জীবনে। আহত হয়েছেন, চুপ থেকেছেন আবার উঠে দাঁড়িয়ে শিল্পের জোরেই বোমা মেরেছেন তিনি বারবার। একটা আন্ডারকারেন্ট থেকেই গেছে তাঁর চিন্তায়...যা আনসেফ, যেমন এ নাটকে যখন অনির্বাণ চক্রবর্তী দূতাবাসের তরফে কথা বলেন, তখন সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে আদত জার্মানির হালহকিকিত জানিয়ে দেন আচমকা...কালো আফ্রিকান মেয়েটির সাথে যখন হফগেনের রিরিংসাপ্রবণ মুহুর্তগুলি অভিনীত হয়, তার বিভঙ্গগুলি জাতক্রোধ তৈরি করে যা যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অপমানের লজ্জা, মনে পড়ে আজও ভারতবর্ষে জাতপাতের নামে মানুষকে খুন করা হয়..ভোটের রাজনীতি চলে..আজও, সেই একই সমস্যা বর্তমান যার জন্য ভদ্রপাড়ার থিয়েটারে কালো মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন না হফগেন..আজও..পাউরুটির জন্য নিজের পেছন খুলে পাছা দেখায় বাচ্চাছেলেটি..তাকে বলতে বলা হয়, বল, 'হাইল হিটলার..' সে তা বলে ও রুটি পায়, যেমন ভোটের আগে নাগাড়ে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ আসছিল বিজেপির বিরুদ্ধে..এভবেই প্রতিচিহ্নে ইতিহাস ও সমকাল একাকার করে রেজিস্ট্রেশান করেন সুমন...একটা মস্ত থিয়েট্রিক্যাল ইভেন্ট তৈরি হয় মঞ্চজুড়ে.." মেফিস্টো নাটকটিকে নিয়ে লিখলেন দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
মেফিস্টো পর্ব ১
আজ ভোট। সুমনের ‘হাউজদ্যাট’ গানে ছিল এক ভোটের সকাল। সেখানে ক জন শিশু সেই সকালে রাস্তায় ক্রিকেট খেলছিল। হঠাৎ, রাস্তায় বল পড়ে থাকতে দেখে একজন সেই বল তোলে। সেটা বল ছিল না, ছিল বোমা। সঙ্গে সঙ্গেই তা ফেটে যায়। মারা যান শিশুটি। সুমনের রাগী কন্ঠ তারপর চেঁচিয়ে ওঠে, ‘দেখুন বড়োরা কাঠও কতটা লজ্জা পান/লজ্জা কীসের বোমাতন্ত্রটা চালিয়ে যান..’ আজ আস্ত একটা দেশ ‘বোমাতন্ত্রে’র উপর বসে, সেভাবেই আজ নির্বাচন, ‘মগজে কার্ফিউ’ নিয়ে সেভাবেই আমরা আজ ভোট দিতে যাব..আর ক দিন পর, সেই ভয় নিয়ে রাস্তা পেরতে পেরতেই দেখতে যাব সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত নাটক মেফিস্টোও..
গতকাল চেতনার রিহার্সাল ঘরে যেতে যেতে এমনটাই ভাবছিলাম। দিন-রাত খেটে একঝাঁক আজকের শিল্পীরা মিলে গড়ে তুলছেন মেফিস্টো। অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন নানা বয়সী প্রখ্যাত অভিনেতারা। অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন সুমন মুখোপাধ্যায়, আমাদের লালদা। লর্ডসের মোড় পেরিয়ে, আনোয়ারশাহ-র কাছে পৌঁছতেই কানে এলো সমবেত অভিনেতাদের কন্ঠস্বর; মানে, রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে..ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ক্রমাগত ছুটে ছুটে অভিনেতাদের নির্দেশ দিচ্ছেন লালদা। অনির্বাণ থেকে ঋদ্ধি, সুরজিত বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়-সমকালের নানা বয়সী অভিনেতাদের নিয়ে একটা আস্ত সিম্ফনিই রচনা করছেন সুমন। মনে পড়ছিল তিস্তাপার, বহু অভিনেতাদের একসাথে আলো-শব্দ দিয়ে ক্যানভাসে এভাবে বাঁধতে, অর্কেস্ট্রেট করতে, শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ছে না..
যখন ঘরজোড়া কন্ঠস্বরগুলো ছিটকে এসে লাগছিল শরীরে কিছুটা অপ্রস্তুত লাগছিল কারণ আমাদের ক্যামেরা বহুদিন বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জের বিলাস-বহুল এপার্টমেন্টের বাইরে যায় না। আমাদের ছিল বটে আইপিটিএ কিন্তু আজ নেতারা সহজেই বলেন শিল্পীদের ‘রগড়ে’ দেবেন। দিনের-পর-দিন মিথ্যা বলে চলেন প্রধাণমন্ত্রী, টাকা দিয়ে কিনে নিতে চায় শিল্পী-দেশ-ব্রহ্মাণ্ড, খিল্লি-খিস্তি-ফাটকাবাজি দিয়েই গড়ে তুলতে চায় জনপরিসর, মানুষকে মারতে চায় মারতে চায় মারতে চায় নির্বিচারে, তখন তারই ধারাভাষ্য শোনাতে থাকে মেফিস্টো। আর সেই ভাষ্য আছড়ে এসে পড়ে দুটি ভোটের মাঝামাঝি মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। কিছুটা আনসেফ লাগে। মনে পড়ে দেশভাগ নিয়ে আইপিটিএ-র একাধিক শিল্পীর প্রতিবাদ ধিক্কার। আর আজ যখন দেশবিক্রি তখন হাতেগোনা একটা নাটক দেখছি, দেখছি আর ক জন সিধে শিল্পীকে..অথচ বাকি শিল্পীরা কোথায়? আজ??
রিহার্সাল এগিয়ে চলেছে। কখনও প্রবল নার্সিসিস্ট অভিনেতা হফগেন নিজেকে ‘শিল্পীর’ দোহাই দিয়ে জরুরি অবস্থায় স্বদেশ ছেড়ে বার্লিন যাওয়ার জন্য সুটকেস গোছাচ্ছে তো কখনও এরিকার কাছে দাবী করছে, তাঁর কাছে একমাত্র সত্য শেক্সপিয়ার। কার্যত শেক্সপিয়ারের আড়ালে নিজের শিল্পের দোহাই দিয়ে গা-বাঁচানোর চেষ্টা করছে সে, আর যখন তাঁর এই সুবিধেবাদ কাছের লোকেদের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে, তাঁর স্বার্থসর্বস্ব উচ্চাকাঙখাকে ঠাট্টা করছে তাঁর চারপাশ-তখনই রেগে যাচ্ছে হফগেন। এই রাগ, এই ক্রোধ মেফিস্টোর পরতে পরতে ঠিকরে পড়ছে নানা ভাবে, সময় যেন কালোবমি করছে প্রতি নাট্যমুহূর্তে, যেন হিটলারের জার্মানির নির্বাচন জয়ের ঘন্টাধ্বনি বাজবে আর কিছু পরে, কিছু মানুষ সে বার্তা শুনতেই মরিয়া, তবু তারা মত্ত বিলাস-বিত্ত-সুরা আর সুরে..অথচ জার্মানি পুড়ছে..
নির্বাচনের সময়কালে বা জরুরি অবস্থায় এত জন অভিনেতা নিয়ে আগেও বারবার এ নাটক মঞ্চস্থ করেছেন সুমন। নবারুণ বলতেন, খারাপ সময় তিনি ভেঙে পড়েন না বরং লেখায় সে সময়কে ব্যবহার করেন। সুমনও তেমন ভাবেই গড়ে তোলেন বারবার তাঁর মঞ্চ। অসুখ দিয়েই গড়ে তোলা বারবার তাঁর সিনেমা আর থিয়েটারের চালচিত্র তাই বারবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে, রাষ্ট্রের সেন্সার নেমে এসেছে বারবার তাঁর শিল্পের উপর। কখনও তিনি বিরক্ত হয়েছেন তো কখনও রেগে গেছেন। কখনও তিনি দূরে চলে গেছেন থিয়েটারের কখনও ছেড়েছেন তাঁর শহর, আন্তর্জাতিক বহু শিল্পীরাই যেমন রাজনৈতিক কারণে স্বদেশ ও স্বভাষা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন নানা সময়ে, সুমনকেও সেই গভীর নির্জন পথ দিয়ে যেতে হয়েছে বারবার..
কোরাস এগিয়ে আসছে ওদিকে রিহার্সালে। একঝাঁক অভিনেতা মঞ্চে হাত বাড়িয়ে যেন-বা ঝাঁপ দিচ্ছে আমার উপর, কখনও হফগেনের আয়নাটাকে তুলে সরিয়ে দিচ্ছেন সুমন কখনও আবার ছুটে এসে চালিয়ে দিচ্ছেন সাউন্ডযন্ত্র..আবহ ভেসে আসছে..সেই আবহের অর্কেস্ট্রায় হাত-পা ছেড়ে দিচ্ছেন হফগেন..একটা লড়াই চলছে যেন মহলাজুড়ে..চলছে একটা সিন্থেসিস..এনগেজমেন্ট..এনকাউন্টার..সেই এনকাউন্টারের একদিকে গুলি ছুঁড়ছেন পরিচালক সুমন আর অন্যদিকে তার পাল্টা দিচ্ছেন অভিনেতারা..মাঝে আমার বড় অসহায় লাগছে মাঝেমধ্যে..বুঝতে পারছি না, এই অসম প্রতিদ্বন্দ্বীতায় কে জিতবে, সময় না মানুষ? স্বৈরাচার না শিল্প?
লাঞ্চ ব্রেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরালাম। লালদার যে বইটি সম্পাদনা করছি, জানতে চাইলাম, তা নিয়ে কবে আবার বসা যাবে। ‘ভোটের আগে হবে বলে মনে হয় না বুঝলি’ হালকা হেসে জানালেন লালদা। এই হাসির মানে, শিল্পীর কমিটমেন্ট, যা সুমন মুখোপাধ্যায়র মজ্জায় মজ্জায়। মনে পড়ছে মেফিস্টোর আগের প্রযোজনার সময় একটি ইন্টারভিউতে সুমন জানান, ‘ব্রেখট থেকে মার্কেজ..তালিকা বিশাল। কেউ অন্য দেশে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছেন। তবে পাওয়ারের ভেতর থাকায় অনেক ক্রাইসিসও আছে। ব্রেখটের একটা কবিতা আছে জানেন তো, যখন ফাশিস্তরা বই পোড়াচ্ছে তখন একজন কবি দেখলেন তাঁর নাম ব্ল্যাক লিস্টে নেই। তার বই পোড়ানোও হচ্ছে না। তখন ছুটে গিয়ে শাসককে প্রশ্ন করলেন, জীবনে একটা বইও কি লিখিনি, যা পোড়াবার যোগ্য? এই ক্রাইসিস থেকেই আমি বলছি, হফগেনকে কোনও ছোট জায়গায় ধরলে হবে না। শিল্পীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দেখতে হবে। তিনি নাট্যকর্মী হলে এ প্রশ্ন থাকা উচিত, তিনি কার জন্য থিয়েটার করছেন? নরেন্দ্র মোদীর উত্থান দেখেও আমি চোখ বন্ধ করে থাকব?’
বস্তুত বারবারই সুমন নানা আলোচনায় ব্রেখটেরও আগের রোমান নাট্যকার প্লটাসের কথা বলেছেন। বলেছেন, তাঁর রোপ নাটকে কীভাবে রাজসভার স্তুতিকারদের মাঝে বসে রাজতন্ত্রের চাহিদা মিটিয়েও, রাজশক্তিতে উপেক্ষা না করতে পেরেও, অন্তর্ঘাত ঘটান একভাবে। এ নাটকে চাকররা নিজেদের রান্নাঘর বা খাবার ঘরে সত্যিকথাগুলো বলে দেয়। দর্শক তা শুনেও নেয়। কিন্তু নাটকের শেষে রাজার মন মতোই সব মিলিয়ে দেন নাট্যকার। ততক্ষণে দর্শকরা সত্যি কথাগুলো নিয়েই ফিরে গেছেন। এভাবেই হেজমনিস্টিক প্যাটার্নের ভেতর থেকেও সাবভার্সানের কথা বারবার বলতে চান শিল্পীরা। মেফিস্টোর এই পুর্নবার মঞ্চায়নও তারই ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে আমাকে, অহরহ..
রিহার্সাল শেষে সারাদিনপর বেরিয়ে সিগারেট ধরালাম। মনে পড়ল ক দিন আগে একটি লেখায় সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁর মাস্টারমশাই শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়র ‘গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস’ থেকে কিছু লাইন ব্যাখ্যা করেছিলেন। শিবাজীদার নির্বাচিত রবি ঠাকুরের ঠাকুমার ঝুলিকে ‘এত বড় স্বদেশী জিনিস আর আমাদের দেশে কি আছে?’ উক্তি নিয়ে লালদা বলছিলেন, কীভাবে শিবাজীদার ব্যাখ্যায় রবি ঠাকুরের স্বদেশী চিন্তার ব্যাপক অর্থ ও গভীর রাজনৈতিক মাত্রা ব্যক্ত। লালদা লিখছেন ‘মূল কথাটা হল উপনিবেশের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংঘাতে হাতিয়ার হয়ে উঠছে দেশীয় লোক আখ্যান।’ কিন্তু তার পরেই আবার লিখেছেন, ‘সরলরৈখিক বিপরীত যুগ্মকের’ আশ্রয় না নিয়ে রবি ঠাকুর যেমন ব্যাপক অর্থ নির্ণয় করেছেন, তেমনি আজ সেই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ’ বদলে ‘নয়া-সাম্রাজ্যবাদকে আমন্ত্রণ তা জানাচ্ছে গায়ে সাম্প্রদায়িকতার নামাবলি জড়িয়ে..’ তাই তাঁর আশঙ্কা, ‘করোনা ভাইরাস মুক্ত হলেও, সাম্প্রদায়িকিতার এই ভাইরাস থেকে কীভাবে মুক্ত হব আমরা? আদৌ কি হব?’
আজ ভোট। আর কিছু পরে এই সমস্ত উত্তরই জমা হবে কালের খাতায়। মেফিস্টোর রিহার্সাল শুরু হবে আর কিছু পরে। দিন ক্রমে রাত হবে। ভোট নিয়ে লেখা গানের শেষে কবীর বোমা ফেটে মারা যাওয়া শিশুটিকে লিখেছিলেন, ‘গানের দোহাই বোমার ভোট এড়িয়ে যাস..’ বোমার দেশ কি এড়াতে পারবে হফগেন? উত্তর দেবে মেফিস্টো। উত্তর দেবে সমকাল আর মানুষ। সেখানেই সুমন মুখোপাধ্যায়র এই প্রযোজনার নিয়তি..ভবিষ্যৎ..
মেফিস্টো পর্ব ২
গতকাল মেফিস্টোর প্রথম শো হাউসফুল। করোনা আর ভোটের বাজারেও রবীন্দ্রসদনে ১২০০ লোক উপচে পড়ল। শুধুমাত্র ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে এ নাটকের। আর, তাতেই ভরে গেল সদন। এ ঘটনাটাই একটা ট্রেন্ড সেটার বলে মনে করছি এ মুহুর্তে। এ ঘটনাটাতেই একটা ইতিহাস তৈরি হল গতকাল বিকেলে, যে ইতিহাসের মিলনবিন্দুতে এসে স্বস্তি পেল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাইনারিতে ক্লান্ত-ধ্বস্ত-সন্ত্রস্ত মধ্যবিত্ত। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁদের। তাঁরা বুঝে গেছে, হয় করোনায় নয়তো শীতলকুচির মত গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হবে। কাজেই রাস্তাই একমাত্র রাস্তা এখন। আর, সেখানেই অনিবার্য পথ দেখাল সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত মেফিস্টো আবারও। ইতিহাসের কাকতালে এর আগে আরও দু বার অভিনীত হয়েছে এ নাটক। দু বারই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিল্পীর সম্পর্ক যখন চূড়ান্ত প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছে, বেজে উঠেছে এ নাটকের সত্য, প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেয়েছে…গতকালও হিটলারের জার্মানি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আজকের ভারত..মনে হচ্ছিল, শিল্পের জোরেই একমাত্র আজও রাস্তা খুঁজে পাবে মানুষ, এখনও, যেভাবে একদিন নবান্ন পথ দেখিয়েছে এ শহরকে-দেশকে, যেভাবে থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয় বলেছিলেন ঠাকুর..
হাউসফুল মেফিস্টোর টিকিট পাইনি আমি। অথচ সুমন মুখোপাধ্যায়র যে কোনও কাজের মত এ কাজেও জুড়ে ছিলাম কোনও-এক-ভাবে। লিখে ফেলেছি এ নাটক হয়ে ওঠা নিয়েও কয়েকটি লেখা। টিকিট না-পাওয়ায় ভেবে নিয়েছিলাম পরে কোনও একটা শো দেখে নেব। কিন্তু গত পরশু রাতে আচমকা ফোন এলো সুমন মুখোপাধ্যায়র, আমাদের লালদার। ‘হ্যাঁ রে, কাল আসছিস তো?’ লজ্জা করেই জানালাম, ‘না-লালদা, টিকিট পাইনি..’ সাথে সাথে চেনা আবেগ ঠিকরে এলো লালদার গলায়, ‘সেকি রে! টিকিট পাসনি মানে!! কাল বিকেলে রবীন্দ্রসদন চলে আসবি। টিকিট রাখা থাকবে..’ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম এরপর। এমন নয় যে চেতনা বা লালদার সাথে আমার সম্পর্ক নতুন। ছোট থেকেই নানা ভাবে বড় হয়েছি তাঁদের সাথে। আর তাই, নানা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কতটা পরিশ্রম করে সারাদিন একটা থিয়েটার/সিনেমা/ বই সমস্তটাই গড়ে তোলেন লালদা। মেফিস্টোর রিহার্সালও চলছিল রোজ সকাল থেকে রাত। ব্যস্ততম অভিনেতাদের নিয়েই চলছিল প্রবল খেটে। লালদা যে পরিশ্রমটা করছিলেন তা করতে গেলে অনেকেই কেলিয়ে যাবে আজকের অনেক সেলেবরা। তারপরেও দিনের শেষে তাঁর এই ফোন আমাকে স্তব্ধ করে শেখাল, আমার প্রজন্মের দু দিনের বিপ্লবী বা সেলেবরা যদি এই কনসার্নের ছিটেফোঁটাও পেত! যারা নিত্য নানা ভাবে আমার মত মানুষকে এ শহরে হিউমিলিয়েট করে, জেনে বা না-জেনে, স্রেফ কেউকেটা প্রমাণ করতে..
রবীন্দ্রসদনের ফার্স্ট রো। সুমন মুখোপাধ্যায়র মঞ্চের সামনে বসার চাপ আছে। কখন গায়ে এসে লাগে একদলা রক্ত বা কখন ছিটকে পড়ে এসে আস্ত অভিনেতারাই গায়ের উপর-কোনও নিশ্চয়তা নেই!! নাটক শুরুর আগে মঞ্চে এলেন সুমন। বললেন, কেন ভোটের মাঝে, দশ দিনের ব্যবধানে এ নাটকের উপস্থাপনা..বললেন, দেশটা নিয়ে যেভাবে ছিঁড়ে খাচ্ছে রাজনীতি, সেখানে এই থিয়েটার এক ধরণের বিদ্রোহ..বেঁধে বেঁধে থাকার সাহস..ব্যকড্রপে পর্দায় একটা পাখি গেঁথে রাখা লোহার দণ্ডে..মোবাইল ফোন না বাজানোর চিরায়ত অনুরোধ করে চলে গেলেন সুমন..নেপথ্যে সাদা পর্দা নেমে এলো..
সাদা পর্দা নামার সাথে সাথেই নেমে এলো একদল লোকের জমায়েতও ..কালো কালো ছায়ামূর্তি..ছন্দে ছন্দে এগোতে থাকলেন তাঁরা..মঞ্চে বিচিত্র আলোর কারুকাজ..অভিনেতা হফগেন ও বাকিরা একে একে বেরিয়ে এলেন মঞ্চে…বেজে উঠল শৌখিন জার্মানি..ক্রমশ একের পর এক অনবদ্য নাট্যমুহুর্ত তৈরি হতে থাকল..মঞ্চের নানা কোণ ও আলোর বিচিত্র খেলায় একের পর এক ম্যাজিকে বিহ্বল লাগছিল..হারিয়ে যাচ্ছিলাম..বহুদিনপর মনে হচ্ছিল, বাংলা থিয়েটার পারছে, আবার, বাংলা পারছে, আবার..আবার..সংলাপের পর সংলাপে..মানুষের অনন্ত প্রবাহে..
যে দর্শকরা এসছেন আজ এ নাটক দেখতে, তাঁদের মাঝে মাঝেই দেখছিলাম হলে ঢোকার আগে। এরা সকলেই যে খুব ইন্টেলেকচুয়াল তা নয়। কিন্তু এদের আমি দেখেছি অনেককেই এন আর সি বিরোধী মিছিলে, দেড় লাখের জমায়েতে। এরাই পড়ালেখাজানা মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ, যারা মেনে নিতে পারছেন না স্বৈরাচার। অসহ্য ছটফটানি থেকেই আজ তাঁরা চলে এসেছেন মিলিত হতে। এরাই আগামীর বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ। যে ভারতে লটকে লট লোককে ডিটেনশান ক্যাম্পে বন্দি করার নিদান দিয়েছে বিজেপি..যেমন এ নাটকে কনসান্ট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথে ট্রেনেবন্দি ইহুদীদের চিৎকার শৌখিন হফগেনকে অস্থির করেছে..যেমন, প্রিয় বন্ধু অটোকে স্রেফ ইহুদী হওয়ায় মায়ারহোল্ডের মত বা আরও অসংখ্যা শিল্পীদের মত দশ দিন ধরে টানা পিটিয়ে হাড়মাংস খুবলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে..আর এসব শুনতে শুনতে উচ্চাকাঙখী হফগেন নিজেকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে, অস্থির হয়ে বারবার স্বগোতক্তি করে ভুলিয়েছে নিজেকে, আমি তো অভিনেতা..সাপের খোলসে ঢুকে পড়েছে তারপর ফণা..আমি তো অভিনেতা এই সংলাপ প্রতিধ্বনিত হয়েছে, দিকে দিকে..
শিল্পীর বা শিল্পের সাথে রাষ্ট্রের কি সম্পর্ক হবে, তা নিয়ে বরাবরই ভেবেছেন সুমন। হারবার্ট বা তিস্তাপার, বিসর্জন বা রাজা লিয়র, কাঙাল মালসাট বা রক্তকরবী-নানাবিধ প্রযোজনাতেই এই প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে তাঁর শিল্পকাজে ও জীবনে। আহত হয়েছেন, চুপ থেকেছেন আবার উঠে দাঁড়িয়ে শিল্পের জোরেই বোমা মেরেছেন তিনি বারবার। একটা আন্ডারকারেন্ট থেকেই গেছে তাঁর চিন্তায়…যা আনসেফ, যেমন এ নাটকে যখন অনির্বাণ চক্রবর্তী দূতাবাসের তরফে কথা বলেন, তখন সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে আদত জার্মানির হালহকিকিত জানিয়ে দেন আচমকা…কালো আফ্রিকান মেয়েটির সাথে যখন হফগেনের রিরিংসাপ্রবণ মুহুর্তগুলি অভিনীত হয়, তার বিভঙ্গগুলি জাতক্রোধ তৈরি করে যা যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অপমানের লজ্জা, মনে পড়ে আজও ভারতবর্ষে জাতপাতের নামে মানুষকে খুন করা হয়..ভোটের রাজনীতি চলে..আজও, সেই একই সমস্যা বর্তমান যার জন্য ভদ্রপাড়ার থিয়েটারে কালো মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন না হফগেন..আজও..পাউরুটির জন্য নিজের পেছন খুলে পাছা দেখায় বাচ্চাছেলেটি..তাকে বলতে বলা হয়, বল, ‘হাইল হিটলার..’ সে তা বলে ও রুটি পায়, যেমন ভোটের আগে নাগাড়ে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ আসছিল বিজেপির বিরুদ্ধে..এভবেই প্রতিচিহ্নে ইতিহাস ও সমকাল একাকার করে রেজিস্ট্রেশান করেন সুমন…একটা মস্ত থিয়েট্রিক্যাল ইভেন্ট তৈরি হয় মঞ্চজুড়ে..বেহালা বাজতে থাকে মঞ্চের নেপথ্যে..শব্দ আর নীরবতায় কখনও একক বা কখনও যৌথতায় হফগেন ও বাকিরা নানা স্থাপত্য গড়ে তোলেন ও মিলিয়ে যান মঞ্চে..এভাবেই একের-পর-এক জিগ’স পাজল দেখতে দেখতে স্তব্ধ হয়ে আসে শব্দ..নিথর লাগে..
স্তব্ধতা ভাঙে হিটলারের মিকিমাউজ..হিটলার ও তাঁর সঙ্গীদের কথোপকথন, নেপথ্যের লাল নাতসি সুবিশাল পতাকা..সাদা পতাকা..সম্পর্ক অথবা রাজনীতি সবেই ক্রমাগত আপোষ করতে থাকা হফগেন..স্বপ্ন-রাগ-প্রেম-দ্রোহ খোলসের মত খুলে গিয়ে, সততা হারানো উলঙ্গ সময়ের মুখোশনাচ জল্লাদের উল্লাসমঞ্চে দেখাতে থাকেন হফগেন..যিনি একদিন বার্লিন যেতে চান, যিনি চান একদিন বড় অভিনেতা হবেন..চান, সবাই হইহই করবে, এলিট মহলে কদর করবে রুচিশীল মহিলারা..মুছে যাবে তাঁর যন্ত্রণার অতীত, শৈশব..সাফল্য-প্রতিষ্ঠা-মদমেয়েসুরায় ভরে উঠবে কলরোল..পুতুলের ঠুনকো স্লোগান আর দাউদাউ করে পুড়তে থাকা স্বদেশের মাঝে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজে পাবেন হফগেন কি? জানা নেই। হফগেনকে দেখতে দেখতে আমার ভেতরেও কোনও ধান্দাবাজ বসে নেই তো-প্রশ্ন চলে আসে..আমার সুবিধেবাদ আর একটু ভালো থাকার বিনিময় ‘আমি আর কতটুকুই বা করতে পারতাম’ যুক্তি প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে না তো, অজান্তে..
কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল দু ঘন্টার এ নাটক দেখতে দেখতে..এত এত গ্রাঞ্জার..এত এত নাট্যমুহূর্ত..আজ নববর্ষ। কিন্তু এ নাটকের মতোই থমতমে কলকাতা..যেন, যে কোনও মুহুর্তে হিটলার চলে আসবে পাওয়ারে, তারপরেই স্বস্তিকা চিহ্নের মত পদ্মফুল চিহ্নগুলো ছড়িয়ে পড়বে ঘুমের মধ্যে..জাগরণে..যা বারবার আমাকে মনে করিয়ে দেবে, আমার কোনও ভয় নেই তো!… জানি না, এ নাটককেও তিস্তাপারের সেটের মত আক্রমণ করবে কি না চাড্ডিরা..সে সম্ভবনা প্রবল..আর তাই, নাটকের শেষে ছোট ভিডিওতে ভেসে ভেসে ওঠে আবহমান শিল্পীদের মারা যাওয়া রাষ্ট্রের নীপিড়নে, সেখানে যেমন রয়েছেন চে গেভারা-গ্রামশি-ওয়াল্টার বেনিয়ামিন-মায়ারহোল্ড তেমনি রয়েছেন কালবুর্গি-পানসারে-গৌরী লঙ্কেশ আবার তার পাশেই আজকের আবমান দুনিয়ার নানা আন্দোলনের সাথে ভেসে উঠছে সত্তর দশক ও চারু মজুমদার..নেপথ্যে বেজে চলেছে, বেলা চাও চাও চাও..হাততালি দিচ্ছে দর্শক তালে তালে..একে একে যেন এগিয়ে চলেছে ভারতবর্ষ সামনের দিকে, আগামীর দিকেদিকে সুদীর্ঘ মিছিল..যে মিছিলের শুরু থেকে চিৎকার করে লালদা নির্দেশ দিচ্ছেন অভিনেতাদের..আমাকেও তার সাথে বলতে ভুলছেন না রাতে ফোনে, ‘হ্যাঁ রে টিকিট পেয়েছিস তো? কাল একটা কান্ড ঘটবে মঞ্চে, চলে আয়..দ্রুত..’