
মুহম্মদ আবদুল-হাইয়ের কবিতা
অনুবাদ: সম্রাট লস্কর
সুদানের আধুনিক কবিতার এক বিশিষ্ট নাম মুহম্মদ আবদুল-হাই (১৯৪৪-১৯৮৯)। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে উচ্চশিক্ষার জন্য আবদুল-হাই পাড়ি দেন ব্রিটেনে। প্রথমে লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন; তারপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে আসেন দেশে। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেন তাঁর অকালমৃত্যর আগে পর্যন্ত। লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, নাটক, সাহিত্য সমালোচনা। অ্যাকাডেমিক লেখালিখি ইংরেজিতে করলেও, সৃষ্টিশীল সাহিত্য মূলত আরবি ভাষাতেই লিখতেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় আবদুল-হাইয়ের প্রথম এবং যুগান্তকারী কাব্যগ্রন্থ অল আওদাহ ইলা সিন্নার (Sinnar: A Homecoming)। এখানে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ মুয়ালাকাত অল-ইশারাত (The Signs Ode) কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদের চেষ্টা করা হল। সুফি দর্শন নিয়ে কবির অনন্য অনুধ্যান যুক্ত করেছে সাতটি কবিতাকে, যার প্রায় প্রতিটিতেই কোনো না কোনো আব্রাহামিক (ধর্ম)গুরুর ভাষ্য উঠে এসেছে। সরাসরি আরবি থেকে নয়, আদিল বাবিকিরের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকেই এই বাংলা অনুবাদগুলি করা হল।
চিহ্ন-গীতি
আদমের চিহ্ন
নামের মাধ্যমেই
আমরা ছন্নছাড়া এই জগৎকে ফিরিয়ে আনি স্মৃতিতে:
সাগর। মরুভূমি।
প্রস্তর। বায়ু। জল।
বৃক্ষ। অগ্নি। নারী।
আঁধার ও আলো।
তারপরেই তো আল্লাহ আসেন
নামের স্বর্গীয় আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে
তাঁর দিব্যদৃষ্টির জন্ম হয় তখনই।
নোয়ার চিহ্ন
ঈশ্বরের মুখের দিকে তাকাই,
কান্নাধরা গলায় বলি,
বছরের পর বছর লড়াই করে লবণাক্ত স্বেদমাখা শ্রম
হিংস্র ওই বন্ধ্যা জমির থেকে
ছিনিয়ে এনেছিল এক টুকরো সবুজ,
সেইখানে, ঠিক সেইখানে
জলের এই মহাপ্রলয় শুরু করে
কী করে তুমি শান্তি পাও, প্রভু?
বলে দাও, আবার কেন শুরু করতে হবে এক নতুন যাত্রার?
কিন্তু শোনো সবাই, সব যখন আবার আবছা হতে শুরু করেছে,
বজ্রের আলো, ঝলসে ওঠো তুমি ওঁর বেদনার আঁধার চিরে, আর
আমার এই কবিতাকে উজ্জ্বল করে তোলো।
একটা নৌকা, আমাদের সব দুর্বলতাকে বহন করে
ভেসে যায় নতুন দেশের খোঁজে।
আব্রাহামের চিহ্ন
তিনি কি আসছেন?
আসছেন কি তিনি এই বাঙ্ময় রাতে?
আসছেন কি শব্দের নিস্তব্ধতা আর নক্ষত্রের গোলাপের মধ্য দিয়ে,
গহীন রাতে শাণিত তরোয়াল হয়ে আঁধারের মাংসল দেহে?
তোমাদের অপর দেবদূতও কি আসবেন আজ রাতে? ওই শোনো!
বাজপাখির তীক্ষ্ণ ডাক; বন্য, আনন্দ সংবাদ।
মৃত মেষের রক্ত-ফেনা লেগে আছে তারাদের গায়ে।
মেঘে দেখা যায় প্রজ্বলিত অশ্বদের,
বৃক্ষের সবুজ অগ্নিজাত ভাষা ঘুরে বেড়ায় বাতাসে, আর
রাতের পাখি মুক্তির খোঁজে উড়তে উড়তে
ঝাপ দেয় আগুনের ওই দর্পণে—
ভস্ম হয়ে যায়।
মুসার চিহ্ন
ভস্মরাশি,
অনাঘ্রাত এক ভোরে কাছে আসে, জড়ো হয়, উড়তে থাকে উপরে,
পবিত্র আলোয় স্নাত সবুজ বৃক্ষেরা,
শিশির ভেজা পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা রক্তিম ফলেরা,
একটি শ্বেত পাখি, একটি উদার বসন্ত,
সব কিছু, আর একটি স্বপ্ন যা
ধীরে ধীরে উন্মোচিত করছে সেই প্রতিশ্রুত ভূমি।
জিশুর চিহ্ন
শোনো,
পাহাড় আর বৃক্ষের হৃদয় থেকে বয়ে আসছে ভোরের নূপুরধ্বনি,
বলছে, এইভাবেই বীণাতে সুর তোলে বাতাস,
এইভাবেই আগুনের আচ্ছাদনের নীচে,
রাস্তার ধুলো আর চিৎকারের মাঝে
আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েছিল দেবদূত আর সেই কুমারী —
তারা অবশেষে বিদায় নিয়েছে পরস্পরের থেকে,
একজন ফিরেছে স্বর্গে, অপরজন তার পূর্ণ নারী শরীরে,
পাখিদের কলতান মন দিয়ে শোনো,
স্পষ্ট হবে রুধির-সঙ্গীত।
মুহম্মদের চিহ্ন
বাগিচাটি আমাদের বিস্মিত করেছিল।
হৃদয় মাঝে গোলাপগুচ্ছ আর পবিত্র অগ্নির আলো;
শ্বেত, উজ্জ্বল অশ্বের দল;
পরিমিত এই দেশে ময়ূর মেলে দেয় তার রঙিন পেখম।
অমোঘ সত্যের সেই পাতায় যা কিছু আছে—
অগ্নি-বৃক্ষ, গভীর সমুদ্রর ঢেউ, সবই গিয়ে মেশে
অগ্নি শিখায়, সৌন্দর্যে আর আশীর্বাদে।
পাখিদের পতন হয় তটে পৌঁছোনোর আগেই,
আনন্দের সাথে ওরা আলিঙ্গন করে অনিবার্য নিয়তিকে।
ফুলে ভরা ওই বাগিচা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করেছিল।
হৃদয় মাঝে ফুটে আছে সেই সবুজ গম্বুজ,
আনন্দ সংবাদ ধ্বনিত হয়: জন্ম হয়েছে মহামানবের।
পরমানন্দ সত্য হয়েছে আজ,
সূর্যের তাজা আলো গায়ে চাপিয়ে
নামেরা গাইছে আজ পরমানন্দের গান।
একটি চিহ্ন
তৃণের সূর্য, আর দুটি ঘুঘু,
গাইছে।
সময় শুরুর আগে থেকে।
সময় থেমে যাওয়ার পরেও।
পুড়ছে ওরা,
নিষিদ্ধ বৃক্ষের
শাখায়, প্রশাখায়।