মনে রবে কিনা রবে <br />  মোনালিসা ঘোষ

মনে রবে কিনা রবে
মোনালিসা ঘোষ

এই উপন্যাসের পূর্বের পর্বগুলি
প্রথম পর্ব ,

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ-পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম-অষ্টম পর্ব

নবম-দশম পর্ব

এগারো

খাড়াই পাহাড়,জঙ্গল আর কুয়াশা যখন ভুলোমনার জীবন হয়ে উঠেছে,তখন ভুলোমনা হঠাৎ এই সত্যটা আবিষ্কার করল যে মিঠুয়া জানত এই পৃথিবীতে সে মোটেই অপরিহার্য নয়। তবুও আসলে তখন সে যা করছিল
সেটাকে এক কথায় বোধহয় এটাই বলা চলে নিজেকে সে যথেষ্ট পরিমাণে অপরিহার্য করে তোলার চেষ্টা করছিল। কি যে একধরনের পাঁচমিশালী জীবন কাটানো ছিল তখন…। কি ঠিক হয়েছিল আর কি ভুল এসবের কোনো মানে নেই এখন। সবটাই ছিল একটা অনবদ্য অভিজ্ঞতা আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাটা ছাড়া সবটাই ছিল ছিবড়ে। তো সেই সার শিক্ষাটা শুধু নিলেই তো হত। খামোখা মনে একগাদা দাগা খেয়ে বিস্মরণের মধ্যে চলে যাবার কি ছিল? কিছুই তো থাকে না…কিছুই থাকে না…

দেবারুণের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের বনিবনা ছিল না। কেন যে ছিল না, তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। একটা গাছের ডাল তুলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল ভুলোমনা। চিকুও যাচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে। কি আর করা যাবে? চিকুর
হাতে কোনো কাজ ছিল না। ভুলোমনারও না। পাহাড়িরা হাতে বোনা নাইলনের দড়ির বাস্কেট নিয়ে দোকান-বাজারের দিকে যাচ্ছিল কেউ কেউ। এরা সাজগোজের ব্যাপারে খুব পরিপাটি । আলুথালু এদের দেখা যায় না মোটে। সানসেট পয়েন্টের কাছে পৌঁছে একা একা বসেছিল ভুলোমনা। এখানে কত গাছগাছালি। জায়গাটা শুধু নির্জন নয়, ভীষণ নির্জন। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ভুলোমনার
শুধু পাতা নড়ার খসখস
আওয়াজ আর কিছু পাখির ডানার শব্দ, ঘরে ফিরছে যারা তাদের কিচির-মিচির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে এল না। এগুলো সবই ওখানকার নিঃস্তদ্ধতাটাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। ভুলোমনা নাক টানল। সে গন্ধ নেবার চেষ্টা করল। তার মনে হল, নিঃস্তব্ধতার একটা গন্ধও আছে। নিঝুম হয়ে আসছিল পাহাড়। বিশাল বিশাল মহীরূহগুলোর সঙ্গে নীচে বুনো ঘাস,বুনো ফুলের গাছ,কাঁটা ঝোপ না জানি কতরকমের গাছ। ভুলোমনা কোনো গাছই চিনতে পারল না। পাইন, দেবদারু,বিশাল লিচু গাছ এসব তো আছেই। এছাড়া বড় একটা গাছের নাম জানা নেই তার। আগ্রহও নেই। সে গাছেদের বিভিন্ন ধর্ম জানে না। কিন্তু ভুলোমনার মনে হচ্ছিল সে গাছেদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। গাছেদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। গাছেরা ঘুমোচ্ছে না জেগে আছে টের পায়। কোন গাছ দুঃখী তা অনুভব করতে পারে। গাছেরা তাকে বোঝে। তারা যে তার সঙ্গে আছে এটা বোঝাতে পারে। শুধু গাছ নয়, পাথর, আকাশ, মেঘ এরাও বোঝাতে পারে। ভুলোমনা পুরো সময়টাই এদের সঙ্গে ছিল। চিকুও ছিল তার সঙ্গে,যেমন ছিল এরা। নিঃশব্দে। সে ছিল আর তার সঙ্গে ছিল নিঃস্তব্ধতা । এই নিঃস্তব্ধতা এমন ছিল যা আস্তে আস্তে মনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে। নিঃস্তব্ধতা যখন মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন মন সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। আবার উল্টোটাও সত্যি ছিল ভুলোমনার কাছে। তার মনের ভেতর যেগুলো জমেছিল,সেগুলো খুলে উড়িয়ে দিতে পারলেও মনের ভেতর নিস্তব্ধতা ঢুকে পড়তে পারত।খুব নিঃশব্দে নিঃস্তব্তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল ভুলোমনা। ওর অজান্তেই ও পা বাড়িয়ে দিয়েছিল এমন এক জগতের দিকে, যার বাইরে নিঃস্তব্ধতা,ভেতরে নিঃস্তব্ধতা। বোধহয় এটা ছিল তার নিয়তি। ভুলোমনাকে তার নিয়তি ডাকছিল। কিন্ত কিছু পিছুটান ছিল। পিছুটান ছিল তার ফেলে আসা জীবন। যা নদীর তলায় পলি পড়ে জমে থাকার মত তার মনের তলায় জমেছিল। মনকে খুঁড়ে সেসব জমে থাকা মুহূর্তগুলোকে উগরে বার করে ফেলতে না পারলে সে নিঃস্ব হবে না। সে নিঃস্ব না হলে মুক্ত হবে কি করে ? এমনি একটা ভাবনা তার ছিল। সেই ভাবনায় ভর করে এই আসন্ন,সন্ধের নিঝুম হয়ে আসা পাহাড়ে সে দেবারুণ আর ইন্দ্রনাথের মধ্যে কি যেন একটা ইক্যুয়েশন ছিল, সেটা মনে করার চেষ্টা করল। মনে করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল যে এই ব্যাপারটা তার মনে আছে, কিন্তু ওখান থেকে সে এত দূরে সরে এসেছে যে , বহুদূর থেকে ওগুলোকে কেমন যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে দূরে ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়ার মত। কি যেন একটা বোকাবোকা ব্যাপার হয়েছিল ওদের মধ্যে। ইন্দ্রনাথই হোক আর প্রমিতই হোক আর দেবারুণই হোক,মেয়েদের ব্যাপারে একটা দুর্বলতা এদের সকলেরই ছিল।

ইন্দ্রনাথ ভাব দেখাত সে একজন মারকাটারি প্রেমিক। তাকে দেখামাত্রই তার আদাকারি,নাজাকত ইত্যাদি প্রভৃতি দেখে মেয়েরা সব তখুনি উল্টেপাল্টে ধড়াস ধড়াস করে পড়ে যাবে। তারা নাকি ভীষণ ঝুলোঝুলি শুরু করে থাকে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রেম করার জন্য। আর ইন্দ্রনাথ..ভগবান জানত ইন্দ্রনাথ কি করে? প্রচুর বোকামি করে নিশ্চয়। একবার ত্রিপুরায় না কোথায় যেন,ত্রিপুরাটা ত্রিপুরা না হয়ে উড়িষ্যাও হতে পারে, ভাবল ভুলোমনা। ঠিক মনে পড়ছে না। ধুর, মরুক গে যাকগে।ত্রিপুরা না উড়িষ্যা, তাতে কি যায় আসে ! সেখানে একদল কবির সঙ্গে কবিতা পড়তে গিয়ে কে যেন এক মহিলা কি যেন তার গালভরা নাম, সে নাকি ইন্দ্রনাথকে জহরকোট পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর তার পরেরদিন ইন্দ্রনাথের চিরপ্রেমিক ভাবমূর্তি নিয়ে সেই মহিলা আবেগভরা এস.এম.এস করেছিল ইন্দ্রনাথকে । পুলকিত হয়ে ইন্দ্রনাথ মিঠুয়াকে ফোন করে সাতকাহন করে বলছিল। বলছিল, দাঁড়াও তোমাকে এস.এম.এস-টা পাঠাচ্ছি। কিন্তু সে সময় মিঠুয়ার আলমারিতে জামাকাপড়ে বর্ষায় ছাতা ধরে গুমো গন্ধ বেরোচ্ছিল বলে মিঠুয়ার ভীষণ রাগ ধরছিল। তাই ও ইন্দ্রনাথকে সটান বলে দেয়,ওইরকম অন্তত আড়াইশোটা এস.এম.এস আমি এক্ষুনি আপনাকে ফরওয়ার্ড করতে পারি। তাই শুনে ইন্দ্রনাথ পাত্তা না পাওয়ার কারণে এত দুঃখিত হয়েছিল যে,আর এস.এম.এসটা ফরওয়ার্ড করেনি।বেচারা ! পাহাড়ে বসে বসে ভাবল ভুলোমনা।

ইন্দ্রনাথ কেমন একটা সবাই ওকে ভীষণ ভালবাসবে,ডাকবে, মানবে,চিনবে,স্বীকতি দেবে এইরকম একটা তৃষ্ণার্ত চাহিদায় অনেক পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করত। এই স্বীকৃতিটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ও চাইলেও ইন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম একটা স্বীকৃতি পাওয়ারই রূপক ছিল। সবাই নাকি তার প্রেমে পড়ে। মিঠুয়া বলেছিল,
কেন, কারুর কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?
-করিশ্মা, ডিয়ার করিশ্মা।
-ও আচ্ছা । সবাই যদি আপনার প্রেমে পড়ে, তাহলে খামোখা আপনি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন কেন?
-ওটা তো আসলে,আমি তোমাকে দেখাশুনা করছি।
-ও আচ্ছা।

এরপর একদিন ইন্দ্রনাথের স্ত্রী সহেলির সঙ্গে মিঠুয়ার আলাপ হয়। একদিন দুদিন আলাপের পরেই সহেলি, লিপি যে কতবড় খতরনাক মেয়েছেলে, ইন্দ্রনাথ আর সহেলির জীবনের দুষ্টগ্রহ ইত্যাদি মিঠুয়াকে বলে বসে। তারপরেই জোর করে চোখ খুঁটে চার ফোঁটা কেঁদে মিঠুয়াকে বলে,অথচ,বিয়ের ঠিক হবার পর ইন্দ্রনাথ যখন আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমাকে বলেছিল হাতটা দাও,আমি হাতটা দিয়েছিলাম,আর তখন ও বলেছিল তোমার মনে হচ্ছে না কেউ একজন আছে? সেই ইন্দ্রনাথ কি করে যে এত পাল্টে গেল?
সহেলির দজ্জাল,কুচুক্ষুরে আর মুখরা বলে বাজারে দুর্নাম ছিল। তাই সহেলিকে সেদিন বুক চাপড়াতে দেখে মিঠুয়া তাড়াতাড়ি ওখান থেকে পালিয়ে যায় ।পরে একদিন সুযোগ সুবিধে মত মিঠুয়া ইন্দ্রনাথকে ডেকে পাঠায়।আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ইন্দ্রনাথকে জামার কলার ধরে দেওয়ালে ঠেসে ধরে বেধড়ক মার লাগায়। ইন্দ্রনাথ, -আরে কি করলাম,কি করলাম বলে চ্যাঁচাচ্ছিল তখন।
-লিসন,সহেলি আমাকে বলেছে,আপনি প্রথমদিন বেড়াতে গিয়ে হাত চেয়ে,হাত ধরে বলেছিলেন,মনে হচ্ছে না জীবনে কেউ আছে?

-অ্যাঁ…কি জানি বলেছি বোধহয়,মনে পড়ছে না।
-মনে পড়াচ্ছি। আপনি আমাকেও কোন চুলোয় আউটিং-এ নিয়ে গিয়ে একই বোকা বোকা কথা বলেছেন।
-ও তাই বুঝি! ইস্ খুব ভুল হয়ে গেছে।
-এবার শুনুন। আমি তো আর সহেলির মত গাধা নই। তাই কি হয়েছিল শুনুন। আমি আপনমনে হাটঁছিলাম। খামোখা আপনি আমাকে বলছিলেন, তোমার হাতটা দেখি। আমি বললাম,কেন? আপনি বললেন,দাও, দিলেই বুঝতে পারবে ।
-আহা,স্টাইলটা ভালো ছিল না বলার? বল? উঁ হুঁ হুঁ, বলতেই হবে…স্টাইল ছাড়া আমি…
-চুপ। একদম চুপ। শুনুন।
-আচ্ছা, শুনছি। শুনছি।
-আমি কাঠখোট্টার মত হাতটা দিলাম। আপনি ধরে বললেন, কিছু মনে হচ্ছে না এবার।
-না।
-মনে হচ্ছে না একজন কেউ আছে।
-সে তো আপনি আছেন,দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। শুধু শুধু মনে হবে কেন?
-না, মনে হচ্ছে না, তোমার জীবনে সত্যিকারের কেউ তোমার পাশে আছে? খানিক ভেবে আমি বলেছিলাম ,
-না,আমার এরকম কিছু মনে হচ্ছে না।
খুব হতাশ হয়ে আপনি হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলেন, -আচ্ছা,একদিন মনে হবে। আমি বললাম , আচ্ছা !
এরপর আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এবং একটা গান গাওয়ার চেষ্টা করেন
গুনগুন করে। কিন্তু সেটা খুব বেসুরো হয়েছিল।

এইসময় দেওয়ালে ঠাসা অবস্থায় ইন্দ্রনাথ বলে ওঠে, -এই না। এরকম বললে চলবে না। গানটা আমি সুরটা একটু কম লাগলেও হৃদয় দিয়ে গাই।
sintomasdelsida.org -মাথা গান। এরপর নিদারুণ বিরক্ত হয়ে আমি আপনাকে বলি,প্রেমটা কি শুধু টেকনিক নাকি? খুবই চিন্তিত হয়ে যান আপনি। কারণ, আপনি বুঝতে পারেন, আমাকে ঠিক কব্জা করতে পারছেন না। তাই গভীর স্বরে বলেন,না, প্রেম একটা প্যাশান।
-এই তো। কেল্লাফতে করেছি তো? মানতেই হবে।
-কচু। আবার মার লাগাব। এই গোঁফ আর দাড়িগুলো যদি পটাস পটাস করে তুলতে থাকি কেমন লাগবে তখন?
-লাগবে বলছি। সিরিয়াসলি লাগবে!
-আপনার লজ্জা করে না ? কবি হয়ে শব্দের এত আকাল হয়েছে যে..আপনি কচি বয়স থেকে বুড়ো

বয়স ওবধি একই ডায়লগ মারছেন! এই আপনার সৃজনশীলতা? সৃজনশীলতায় কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে আপনার।
ক্রিইয়েটিভলি কনস্টিপেটেড।লজ্জা করে না?
-না,না।আমি আসলে পারসিয়ালিটি করতে চাই না। মাইরি বলছি।
ইন্দ্রনাথ অনেক ধানাই-পানাই করেছিল কিন্ত মিঠুয়াও অনেক মারধর করেছিল। রফা হয়েছিল, এবার প্রেমে পড়লে যথাযথ শব্দ এবং আবেগের নিত্যনতুন প্রয়োগপদ্ধতি এবং তার সমন্বয় সাধন করা চাই। তারপর ওরা ইন্দ্রনাথের মোবাইলে আসা এস.এম এস. পড়ে পড়ে খুব হাসাহাসি করছিল। তখন থেকে ওরা একটা খেলা খেলত। ইন্দ্রনাথ একটা এস.এম.এস পড়ত, সেটা কে পাঠিয়েছে মিঠুয়া তার নাম আন্দাজ করে বলে দিত। কিন্ত এইসব এস.এম.এস.-এ লিপির এস.এম.এস কখনও থাকত না। আর মিঠুয়া ওর নিজের এস.এম.এস কক্ষনো ইন্দ্রনাথকে পড়াতো না, কারণ মিঠুয়া জানত ইন্দ্রনাথ সেগুলো বরদাস্ত করতে পারবে না।কারণ…কারণ…এর কারণ ব্যাখ্যা করত দেবারুণ।

দেবারুণ সব কিছুরই একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণের বিশ্লেষণ এসব করে কাটাত। দেবারুণের ব্যাখ্যা ছিল, প্রত্যেক পুরুষের মধ্যেই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার এক আদিম প্রবণতা কাজ করে। কারনাল কনট্রোল। ডিক্সনারিতে কারনালের অর্থ দেখেছিল মিঠুয়া, কামজ, ইন্দ্রয়জ, এমনকি রক্তমাংস সংক্রান্ত এইসব লেখা আছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মানে , লিবিডো দ্বারা পরিচালিত এবং লিবিডো আক্রান্ত মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি লিবিডোনাল আকর্ষণ-বিকর্ষণ জনিত যে নিঃশব্দ সমীকরণ তৈরি করে, তাই। এইসব কারনাল কনট্রোল নাকি পৃথিবীতে চলে আসছে। দেবারুণ এও বলেছিল, কারনাল কনট্রোলের এই সমীকরণ নিঃশব্দে চলে বলেই কবিরা কবিতা লিখতে পারে। মিঠুয়ার মনে হয়েছিল, কি বীভৎস ব্যাপার। বাপরে! ভাগ্যিস ও কবিতা লিখতে পারে না!

এইরকম কারনাল কনট্রোল যা নাকি একজন নারীর ওপর একজন পুরুষের প্রকৃত কনট্রোল, তা নাকি দেবারুনের আর্তি দত্তের ওপরে ছিল। নাতাশার ওপরেও ছিল। তো এইরকম কারনাল কনট্রোল চালাতে চালাতে
দেবারুণ আর আর্তি দত্ত দুজনে কি যেন একটা ম্যাগাজিন বার করে ফেলেছিল। সেটা ইন্দ্রনাথ আর লিপি বইমেলায় নেড়েচেড়ে দেখছিল। ইন্দ্রনাথ বইটা দেখতে চাইলে দেবারুন বই-এর দাম চেয়েছিল। ইন্দ্রনাথ নিজেদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন দাম দিয়ে কেন কিনবে ভেবে পায়নি বলে কেনেনি। তারপর ওদের মধ্যে সম্পর্ক খুব বাজে হয়ে যায়। কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি।

ভুলোমনা বাড়ির দিকে ফিরতে লাগল। তখন পাহাড়ে চাঁদ উঠেছে। ফটফটে জ্যোৎস্না। পাহাড়ি রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল চাঁদের আলোয়। যেন প্লাবন। যারা সারা জীবন লেখালেখি নিয়ে কাটিয়ে হতাশা, অপমান,
অস্বীকৃতি, আর কিছু ছুটকো সম্পর্কে, ভুয়ো প্রেমের ফাঁদে পড়ে জীবন কাটাল, তাদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল ভুলোমনার। এইসব মানুষেরা মিঠুয়াকে মুহূর্ত জমিয়ে জমিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছিল। ছোট ছোট সুন্দর মুহূর্ত কত ছোট কবিতার মত, সুরের মত অভিভূত করে তুলতে পারে। শুধু মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে সংগ্রহ করে কত ক্ষোভ, কত না পাওয়া বেমালুম ভুলে থাকা যায়, এরা সেটা দেখিয়েছিল। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, সারাক্ষণ
সবাই একটা জবরদস্তি প্রেম করার, প্রেমে পড়ার প্রতিযোগিতায় মও ছিল হাস্যকরভাবে। সকলেরই বগলদাবা করে রাখার মত একটা করে প্রেমিকা বা প্রেমিক থাকতে হবে। থাকলেই তার সঙ্গে কিছু একটা কাজে জড়িয়ে পড়তে হবে, যাতে ফ্রুটফুল হয় প্রেমটা ।

সাধারণত লোকে প্রেম করে বিয়ে করার জন্য, তারপর সংসার করে আর বাচ্চা ইত্যাদি হয়। এখানে সেসব ঝামেলা তো নেই। প্রায় সকলেই বিবাহিত। তাই বিয়ে করার দায় নেই। কিন্তু একাকীত্ব কাটানোর দায় আছে। আর প্রেম করতে করতে যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায়, তাই একসঙ্গে কিছু কাজ করার আছে। যারা নাটক ইত্যাদি করে, তারা একসঙ্গে নাট্যভাবনা নিয়ে কাজ করে। কবিরা সাধারণত পট করে একটা লিটল ম্যগাজিন বার করে ফেলে।এটা মিঠুয়া অনেকবার দেখেছিল। কেউ প্রকাশনা খুলে ফেলে। এরকম যার যেখানে প্যাশন, সে সেরকম কিছু করার চেষ্টা করে। এরকম করতে করতে অনেক প্রেম লোপাট হয়ে যায়, কিছু নতুন প্রেম গজায় আর কিছু প্রেম টিঁকে যায়। টিঁকে যাওয়া প্রেমগুলো অভ্যাসে পরিণত হয় আর সেগুলো
মালগাড়ির মত চলতেই থাকে..আর চলতেই থাকে।

দেবারুণ ইন্দ্রনাথ আর লিপির প্রেমকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। সে বলত, লিপি ইন্দ্রনাথের জন্য,তাকে ভালবেসে নিজেকে দানছত্র করে দিয়েছিল। সে যা করে তা থেকে ইন্দ্রনাথ লাভবান হয়। সে যে সমস্ত ইভেন্ট,ইভেন্ট ম্যানেজার পরিচালিত করত, তাতে নাকি শুধু ইন্দ্রনাথকে প্রোমোট করা হত আর ইন্দ্রনাথের কনট্যাক্টট বাড়ত। আর ইন্দ্রনাথ নাকি এমন হতভাগা যে সে মোটেই লিপিকে ভালবাসত না, সে কেবল লিপিকে ব্যবহার করত।
এদিকে লিপি সম্পর্কে দেবারুন বলত, সে মহা সেয়ানা মেয়ে ভীষণ ধান্দবাজ। দারুণ অ্যাগ্রেসিভ ধরণের, অসৎ একজন মানুষ। সেই লিপি আবার ইন্দ্রনাথকে এমন ভালবাসে যে তারজন্য কত কি করে, এটা কেমন মেলাতে পারত না মিঠুয়া। ভীষণই ভজকট লাগত তার।
তারপর দেবারুণ বলত, এমন কোনো মেয়ে পাওয়া যায়নি যে শুধু দেবেরুণের জন্যই বাচঁবে ।তার কাছ থেকে কিছুই চাইবে না আর শুধু দেবে সেই মেয়ের নাম হবে কস্তরী। সে তার হরিণ চোখ পেতে দেবারুনের জন্য অপেক্ষা করবে। আসামাত্রই লেবু চা বা ক্যাপাচিনো কফি করে দেবে।সেটা খুব গরম। এই ‘গরম’ শব্দটা দেবারুণ উল্লেখ করতে কখনও ভুলতে না।তারপর সে ইষদুষ্ণ জলে ওডিকোলন দিয়ে দেবারুণের গা স্পঞ্জ করে দেবে। তারপর….. কবিতা পড়বে বোধহয়।নাকি শুনবে।
যাইহোক কবিতা হয় পড়বে নয়তো শুনবে তারপর সেই কবিতা নিয়ে আলোচনা করলে ওটা স্কুলের ভাবসস্প্রসারণের মত হয়ে যায়। কবিতাটার রেশ থাকে না, তাই আলোচনাটা বাদ থাক। আর সবথেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল, সেই কস্তরীর আর কোন বন্ধু থাকবে না। মিঠুয়ায় মনে হল, শুধু বন্ধু কেন, তার তিনকূলে কেউ না থাকলে ভাল হয়। অর্থাৎ দেবারুনের জীবন- দর্শন ছিল, যে তার বন্ধু হবে, তার কোন বন্ধু নেই।

ভুলোমনা গুরুং গেস্টহাউসে পৌঁছে গেছিল।সন্ধেবেলা গুরুং গেস্টহাউস মোটামুটি সরগরম ছিল । সুরেন্দ্র এবং রাজ একটা গিটার বাজিয়ে বাজিয়ে গেস্টহাউসের ড্রয়িংরুমে একদল বোর্ডারের বিনোদনের ব্যবস্থা করছিল। ঝ্যাং ঝ্যাং আওয়াজ আসছিল। ভুলোমনা নিজের রুমে যাওয়ার পথে হনিমুন স্যুইটটার দিকে আনমনে একবার তাকাল। তাকিয়েই রইল। মনে মনে বলল, ইন্দ্রনাথ আর লিপির নাম লিখে দিলাম ওই ঘরে।তোমাদেরই মানায় আমার জন্য নয় ওসব। আমার জন্য নয়। বহুদূরে চলে গেছি আমি। দূর আমায় হাতছানি দিচ্ছে। সুদূরের নেশা বড় ভয়ের। সে নেশা আর ফিরে আসতে দেয় না। ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়।তোমরা ওখানে বসে বিয়ারের সঙ্গে তন্দুরি পমফ্রেট খেও। ও বাবা, এই পাহাড়ে পমফ্রেট কোথায় পাবে যাকগে, আর পাহাড়ে বিয়ারের চেয়ে স্কচই ভাল। সে তো ছিল সমুদ্রসৈকত। রোদ, বালি আর পমফ্রেট মাছের দেশ গোয়া । মুম্বইতে মিটিং সেরে দুদিনের জন্য স্ট্রেস ফ্রি হতে গোয়ায় গায়েব হয়ে যাওয়ার দিন।এমনিতেই তো জীবনে চাকরি-বাকরি আর সাংসারিক ঝামেলার ক্লান্তি। তার ওপর মানসিক খাদ্যজোগাড় করার জন্য নানাধরণের মেলামেশার ঝকমারি, আবার তার সঙ্গে পরকীয়া জীবনের কম হ্যাপা নাকি ? পরকীয়ার একটা বেশ হাঙ্গামা আছে। তা মোটেই কেবল সুখের সপ্তম স্বর্গে ভাসা নয়।বরং স্বর্গ নামক মরীচিকার পেছনে ছোটা। “স্বর্গে পৌঁছেছো? স্বর্গ কত দূর?’…. স্বর্গ কেবল মরিচিকার মত সরে সরে যায়। সেখানে সমুদ্রস্নানের পর কোল্ড বিয়ার সহযোগে তন্দুরি পমফ্রেট এত আনন্দদায়ী ছিল যে একমাত্র এই কথাটাই ইন্দ্রনাথ মিঠুয়াকে বলেছিল। মিঠুয়া জানত লিপি সঙ্গে আছে। কারণ ইন্দ্রনাথ তাকে সকাল সাতটার মধ্যে ফোন করে নিত। দায়িত্ববোধ একেই বলে। সবদিক সামলাতে হবে তো! কিন্তু তারপর ইন্দ্রনাথের মোবাইল অফ থাকত।মিঠুয়া চেক করেছিল।তার মানে, নির্ঘাত সকাল সাতটা পর্যন্ত লিপি ঘুমোত।

ফেরার পর ইন্দ্রনাথ তন্দুরি পমফ্রেট আর বিয়ারের কথা বারকয়েক বলেছিল বটে। সে সময় তার চোখে ছিল ঘোর ঘোর ভাললাগা। আরামের ছোঁয়া। মনে হচ্ছিল, শুধুমাত্র এবং একমাত্র তন্দুরি পমফ্রেট আর কোল্ড বিয়ারের জন্য একটা উইক এন্ড ট্রিপ দারুণ ভালভাবে উতরে গেছে। তখন মিঠুয়ার এত অবাক লেগেছিল! তার কেবলই মনে হয়েছিল, একটা পুরোনো হয়ে যাওয়া বউ আর পুরোনো হয়ে যাওয়া পরকীয়া প্রেমিকার মধ্যে কোনই তফাত নেই।

ডায়েরি খুলে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল ভুলোমনা। এই যে মিঠুয়া, একে ভুলোমনা কি চেনে? যদি চিনত, তাহলে যে জীবন মিঠুয়া কাটাত একদিন তা কেন এত নিদারুণভাবে হাস্যকর মনে হচ্ছে ভুলোমনার ? সে ডায়েরিতে লিখল ,
পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান- একদিন মিঠুয়া জীবন খুঁজতে বেরিয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল, তার রুচি,তার সৃষ্টির ক্ষমতা আর কিছু মূল্যবোধের পুঁজি। মানুষ দেখতে চেয়েছিল সে। পয়েন্ট নাম্বার দুই- এইভাবে জীবন নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করতে নেমে তার প্রথমেই মোলাকাত হয় ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। সেটা দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বোধহয়, দুর্ভাগ্যও নয় সৌভাগ্যও নয়, ওটা জাস্ট একটা ঘটনা ছিল এবং ঘটনা সবসময়েই নিরপেক্ষ হয়। আমরা তাকে আমাদের আবেগ অনুসারে ভাল বা মন্দ তকমা দিই।
পয়েন্ট নাম্বার তিন- এই ইন্দ্রনাথ যে মেয়ে দেখলেই খেলোয়াড় হয়ে উঠত, সে পাকেচক্রে সত্যি সত্যিই মিঠুয়ার প্রেমে পড়ে যদিও তার একজনের সঙ্গে বহু বছরের প্রেমসম্পর্ক ছিল। জনৈকার নাম ছিল লিপি। এই ইন্দ্রনাথ মিঠুয়ার কাছে তার এই সম্পর্কের কথা চেপে গেলেও মিঠুয়া নানাভাবে জানতে পারে। তার মনে হয় তাকে ঠকানো হয়েছে যেটা অন্যায় এবং অনুচিত। অথচ এই সম্পর্ক নিয়ে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে তার কোনোদিন সরাসরি কথা হয় না !

পয়েন্ট নাম্বার চার- ইতিমধ্যে মিঠুয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিল প্রমিতের এবং প্রমিতের মাধ্যমে দেবারুণের সঙ্গে তার
আলাপ হয়। এদেরও নানাবিধ সম্পর্কের কথা সে জানতে পারে। এরাই নিজেদের মুখে মিঠুয়াকে জানায় এবং সেই নিজের মুখে জানানোর ব্যাপারটা মিঠুয়ার ভাল লাগে।
পাঁচ-অদ্ভুত ব্যাপার হল, মিঠুয়া দেখতে পায় সকলেই ভীষণ প্রেমে পড়ার জন্য উন্মুখ। মেয়েদের কাছে প্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি কোথাও একটা এদের পুরুষত্বকে আনন্দ দেয়। শুধু আনন্দই দেয় না এরা অযথা প্রেমে পড়ার নেশায় আসক্ত। আর এরা প্রেমকে প্রেম বলে না, বলে সম্পর্ক। কেন সেটাকে প্রেম না বলে সম্পর্ক বলা হবে, এ বিষয়ে এরা নানান ব্যাখ্যা দেয়।কিন্তু শেষপর্যন্ত মিঠুয়া এই বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেনি।
পয়েন্ট নাম্বার ছয় হল এটাই যে, এদের মাধ্যমে এদের প্রেমিকদের সঙ্গেও মিঠুয়ার মোলাকাত হয়। মিঠুয়া দেখতে পায়, এরা সকলেই খুব সাধারণ হয়েও কোথাও একটা অসাধারণ। প্রত্যেকের জীবনের প্রতি মিঠুয়ার একধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। এরা গড়পড়তা সুখী লোকেদের মতো জীবন কাটায় না। প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি নেয়, নিয়ম ভাঙে, বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে ও উঠে দঁড়ায়। এদের জীবনবোধ অদ্ভুত, প্রতি মুহূর্তেই এরা জীবনবোধ তৈরি করে ও ভাঙে আবার নতুন ভঙ্গিতে জীবনকে দেখে। হ্যাঁ, একথা খুব সত্যি এদের এইসব হাস্যকর প্রেমাসক্ত জীবনের অপর্যাপ্ত ফ্যালাসি দেখতে দেখতে মিঠুয়া নিজেও সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠে।
পয়েন্ট নাম্বার সাত তাহলে এটা যে, যেসব মানুষ মিঠুয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মনোভাব রাখত , তারা ইন্দ্রনাথের মত চিটিংবাজি না করে সাতপুরোনো বাতিল হয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের গল্পও মিঠুয়ার কাছে করেছিল। তাদেরও সঙ্গে দেখা হলে আলাপও করিয়েছিল।কারুর সঙ্গে মিঠুয়ার মেলামেশা ইন্দ্রনাথ পছন্দ করত না।সে চাইত মিঠুয়া তার চোখ দিয়ে জীবনকে দেখতে শিখবে।ফলে, মিঠুয়ার সঙ্গে ইন্দ্রনাথের একটা ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিলই।

এতদূর অবধি লিখে ভুলোমনা ডায়েরির পাতাটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল।তার মনে হচ্ছিল,যাক বাবা, এটুকু থেকে মুক্ত হওয়া গেছে।কিছুটা আরাম হচ্ছিল তার।সে দরজা খুলে বাইরে কাঠের বারান্দায় এল। বাইরে গাঢ় সন্ধ্যে। তার ওপর শীতের সাদা পরত পড়েছে। সে ঠাণ্ডা হাওয়া নিল। হালকা পায়ে সে রান্নাঘরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকল। উঁকি মেরে দেখল, রান্নাঘরে তখন যজ্ঞি চলছে। চাচীই হেড কুক। কিন্তু আজ নতুন কিছু মহিলাও আছে যাদের কাজের হাত চলছে দ্রুত। রান্নাঘরের দরজার বাইরে কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভুলোমনা ভাবল, এদের মধ্যে নিশ্চয় দেবেন্দ্রর মা আছে। এতদিনে সে একবারও দেবেন্দ্রর মাকে দেখেনি। বাবাকেও না। অবশ্য গুরুং পরিবারের বয়স্ক ছেলেদের কখনই দেখা যেত না, একমাত্র গুরুং ছাড়া। কমবয়সী ছেলেদের, রাজ, সুরেন্দ্র, দেবেন্দ্র এদের গুরুং- এর সঙ্গে দেখতে পাওয়া যেত। মহিলাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চাচী আর পিসী। বোধহয় পিসীই সর্বেসর্বা ছিল। হাবভাব দেখে তাই মনে হত। দেখে মনে হত তার একচ্ছত্র দাপট সবাই মেনে নিয়েছে।

ভুলোমনা দরজার বাইরে কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগল, কিন্তু ভেতরে ঢুকল না। ও খেয়াল করে দেখেছে এদের বাড়ির মেয়েরা তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ নয় বোর্ডারদের সঙ্গে। যদিও ভুলোমনা বহুদিন ধরে আছে, অন্য বোর্ডারদের মত কদিনের জন্য এসে চলে যায় নি , তাই ওকে সবাই চেনে। অসুস্থ বলে খানিকটা করুণার ভাবও আছে, কিন্ত বন্ধুত্ব নয়। তবে কে বন্ধুভাব দেখালো আর কে দেখালো না, তাতে আর
ভুলোমনার বেশী কিছু এসে যায় না। সে তার ঘোরের জগতে বেশ আছে। এমনি সময় দেবেন্দ্র বেরোলো,হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে। ভুলোমনা দেবেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল,

– অ্যাই দেবেন্দ্র, তোমার মা কোথায়? তোমার মা কি এখানে আছে?
দেবেন্দ্র মাথা নাড়ল।-নহী।
-কখনও দেখি না কেন, তোমার মাকে?
-ও এখানে থাকে না।
-কোথায় থাকে?
-জানিনা।
-তুমি তোমার মা কোথায় থাকে জানো না?
-না।
-কেন?
-ও এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
-কোথায় চলে গেছে? ভুলোমনার ভয় করতে লাগল, দেবেন্দ্রর মা মারা গেছে?
-অন্য বাড়িতে, আরেকজনকে বিয়ে করে।
দেবেন্দ্র আর দাঁড়াল না। চলে গেল চটি ফটফটিয়ে।কিন্তু ভুলোমনা দাঁড়িয়েই রইল। জোরকা ঝটকা কেমন
ধীরেসে দিয়ে চলে গেল দেবেন্দ্র, অবশ হয়ে গেল সে। ক্রমাগত বিড়বিড় করে নিজের মনে আওড়াতে লাগল,

আউট বিয়ন্ড আইডিয়াস অব্ রং ডুয়িং এ্যন্ড রাইট ডুইং
দেয়ার ইজ আ ফিল্ড আই উইল মিট ইউ দেয়ার…

বারো

পরপর চারদিন ভুলোমনা কেবল শুয়ে রইল। সে কবে এই বিস্মরণের হাত থেকে মুক্তি পাবে আর মুক্তি পেলেই সে অন্য কোথাও চলে যাবে।কিন্তু কোথায় যাবে সে জানে না। পুরনো জীবন, মানুষ, ঘটনা তার গা থেকে
খোলসের মত খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে। শুধু বিস্মরণের মুহূর্তটাই যা মনে পড়া বাকী।
নতুন জীবনে সেটা আচমকা মূর্তিমান আপদের মত তার মনে উদয় হয়ে নতুন কোনো অঘটন বাঁধিয়ে না বসে, তাই এই চিন্তা। তাই এখান থেকে পাততাড়ি গোটানোর আগে সেই ঘটনাটার মুক্তি পাওয়া দরকার। কিন্তু সেটা যে কবে হবে তা কে জানে?

সে বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে দাঁড়াল। একরকম একঘেয়ে প্রকৃতি,একভাবে বয়ে চলা জীবন, একঘেয়ে সব কিছু যেন পাহাড়ি ধুন । সে জানলার কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসে সেখানেই ক্লান্ত সৈনিকের মত পড়ে রইল। যেন তার অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে যুদ্ধে। মাঝে মাঝে উঠে সে রিমপোচের ঘরে যাবার চেষ্টা করল।
কিন্ত বারবার চেষ্টা করেও বারবার সে ফিরে এল। অবশেষে চারদিন বাদ পাঁচদিনের দিন সে একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে রিমপোচের ঘরে গিয়ে কার্পেটের ওপর বসে পড়ল। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে। সিধে হয়ে বসার মত শক্তিও তার ছিল না। কিন্ত ক্লান্ত চোখে রিমপোচের চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার খুব আরাম লাগছিল।
রিমপোচে তার দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, কি চাও?

-পুরনো জীবনের কথা আর না ভাবতে। কেই বা চায় কোনকিছু ভাবতে। ভাবনা মনেই গোলকধাঁধা !
ভুলোমনার দু চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। দেখো এই পৃথিবীতে আমি বেমানান। এখানে আর কিছু না হোক,টিঁকে থাকার যোগ্যতা দরকার। আমি পারিনি। আমি পারি না।

রিমপোচে ভুলোমনার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ছিল করুণা, বুদ্ধের মত লাগছিল তাকে।
-ভুলোমনা , মিঠুয়াকে ডাকো,ওর সঙ্গে কথা বল।
রিমপোচে বলল ।
দূর থেকে একটা গান ভেসে আসছিল… ধীরে ধীরে ধীরে সবকুছ হোয়ে….রিমপোচে ঢিমে ঢিমে দুলছিল গানের সঙ্গে। তার সঙ্গে ছিল ঘোর|সেই ঘোর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ভুলোমনার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল ঘোর।হঠাৎ তার মধ্যে থেকে অনেকদিনের আগের মিঠুয়া বেরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল।ভুলোমনা হঠাৎ ভীষণ হকচকিয়ে গেল।এখন কি করবে সে? কি করা উচিত? তার হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগল। মনে হল সব এই মুহূর্তে বোমা ফাটার মত ফেটে ছিটকে বেরিয়ে পড়বে । তার ধাক্কায় ছিটকে যাবে ও নিজেও। কিন্তু তক্ষুনি তার চোখ পড়ল রিমপোচের দিকে। রিমপোচে ছিল স্থির।
শান্ত। তার চোখে ছিল অদ্ভুত শান্ততার সঙ্গে অভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া ভয়হীনতরটা মত একটা কিছু। ভুলোমনা বেশীক্ষণ ভয় পেতে পারল না। শরীর থেকে ঘাম ঝরে ঝরে পড়ে যাওয়ার মত ভয় একসময় ঝরে পড়ে গেল অমনভাবে যে ভুলোমনা তার আশেপাশে ভয়ের খোলসটাকেও খুঁজে পেল না।

মিঠুয়া হাসল।-চিনতে পারো?
ভুলোমনা সহসা হ্যাঁ বা না কিছু বলতে পারল না।
মিঠুয়া বলল,তুমি কি খুঁড়ে বার করতে চাইছ? শুধুই কিছু ঘটনা না তোমার ভুলগুলো?
ভীষণ অবাক হয়ে গেল ভুলোমনা।-আমার ভুল? -তোমার ভুল নয়?
-তুমি আর আমি যে এক এটাই তো তুমি ভুলে গেছ। মনে করে দেখো ভুলোমনা আমি তোমার অতীত, তুমি এখন এই ঘরে এই মুহূর্তে বর্তমান আর আরেকজন আসছে যে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।
-সে কবে আসবে?
-সে আসবে।তুমি নিজেকে পুরো খুলে ফেলতে পারলেই সে আসবে।
-কিভাবে খুলে ফেলব আমি নিজেকে ?
-আঁতিপাতি করে খুঁজে।

-কি খুঁজব,আমি ভুলে গেছি গো। আমার যে কিছুতেই মনে পড়ছে না।
-আমার দিকে তাকাও মনে পড়বে।দেখো, আমি একটা ভালবাসা চেয়েছিলাম। তুমি একটা ভালোবাসা চেয়েছিলে। এমন একটা ভালবাসা যেটা পানসে হয় না। সবসময় টাটকা। সবসময় সেই প্রেমের ভেতর বাঁশীর ডাক।তুমি জীবন পণ করে অভিসারে চলেছ , তোমার মনে রাধার উত্তেজনা, মীরার অপেক্ষা। ছমছম মল্ যাতে পায়ে না বাজে , নুপূর খুলে ফেলেছ তুমি।রাধা সবকিছু দাঁও পে লাগিয়ে দিয়েছিল।তুমি কি পেরেছিলে ?
আমি কি পেরেছিলাম? ভেবে দেখো।
না, আমি পারিনি।
পরক্ষণে গর্জে উঠল ভুলোমনা।
-কেন পারব? কি করে পারব? এত আত্মসুখী, নার্সিসিস্ট একজন মানুষ ছিল সে। রাধা পেরেছিল কারণ আর যাই হোক কৃষ্ণ আত্মসুখী ছিল না।
-তুমিও কি আত্মসুখী ছিলে না? আমিও কি ছিলাম না? ভেবে দেখো।
– না। মিঠুয়া, আত্মসুখী নয়। আমরা রেসিপ্রোকেশন চাইতাম। প্রপার আদান-প্রদান।কমিটমেন্ট। লয়ালটি।
বফাদারী। বেবফাঈ নয়।
-হাসালে। কৃষ্ণ তো সবচেয়ে বড় বেবফা ছিল।এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে তার চেয়ে বড় বেবফা তো আর কেউ আসেনি।তাহলে রাধা কি করেছিল ?
-রাধা আবার কি করবে? রাধা ভাল লাগা,মন্দ লাগা, মান অভিমানের ওপারে নিজেকে নিয়ে গেছিল।
ওই আউট বিয়ন্ড আইডিয়াস অব রং ডুইং এ্যান্ড রাইট ডুইং, দেয়ার ইজ আ ফিল্ড আই উইল মিট ইউ,
দেয়ার…ওখানে।
– সেটা আমরা পারিনি।
-না আমরা পারিনি !
-তুমি একটা দিব্যসত্তা খুঁজেছিলে…যা তোমাকে সীমাহীন প্রেমস্বরূপের সঙ্গে মোলাকাত ঘটিয়ে দেবে। তা
সম্ভব ছিল না। যারা ভীষণ বেশী মানুষ হয়ে আছে, তাদের মধ্যে দিব্য প্রেম খুঁজতে গেলে শুধু তার সীমাবদ্ধতার সঙ্গেই বারবার মোলাকাত হয়। তাই হয়েছিল।
-তোমার মনে নেই, মাঝখানে প্রমিত আর ইন্দ্রনাথের মধ্যে কিসব লাফড়া চলছিল, সবটা মনে নেই, এরা ছিল খুবই সম্পর্ক কাতর মানুষ, বলা যায় সম্পর্ক অবসেসড্।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়ছে বৈকি। হেসে ফেলল ভুলোমনা।
কি যে সব কাণ্ড হত ! আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম যে এরকমও একটা পৃথিবী আছে। হ্যাঁ, সেটা আমি প্রাণভরে দেখেছি, যথেষ্ট দেখেছি।সম্পর্ক বুভুক্ষু কাতর নরনারী সব…নিজেদের মধ্যে রেষারেষিতে মগ্ন। অবাস্তব আমিত্বে ভরা উচ্চকিত কন্ঠস্বর সব।একদিন হল কি…কোথায় যেন কবিতা পাঠ শুনতে যাওয়ার কথা প্রমিতের সঙ্গে। প্রমিত লিখত ভাল। খুবই ভাল। তবে ওর গদ্য লেখার হাতটা ছিল বেশী সহজ। তো ভর সন্ধ্যের কলকাতায় খুব হুড়োতাড়া করে প্রমিত আমাকে
একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে ফেলল। কবিতা পা লাটে উঠল। সেখান থেকে সোজা কোন এক রেস্টুরেন্টে। নামটা মনে নেই। প্রমিত সেখানে কেবলই ড্রিঙ্ক করতে লাগল পেগের পর পেগ। আর ভীষণ কাঁদতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ওর চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোনোর মত জল ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ও বলতে লাগল, আমি খুব আধুনিক। তারপর আরও কাঁদতে লাগল। বলতে লাগল ওদের মধ্যে বন্ধুতটা নষ্ট
করে দিল লিপি শোয়াশুয়ি করে। ওদের মানে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ওর। তারপর বীভৎস বর্ণনা দিতে লাগল ইন্দ্রনাথ ও লিপির প্রেমকাহিনীর। ও তখন ছিল প্রত্যক্ষদর্শী। এইসব আর কি !
তারপর আমি বাড়ি চলে এলাম জোর করে। বাড়ি ফেরার পর প্রমিত ক্রমাগত ফোন করতে লাগল।বিরক্ত হয়ে আমি ফোন সুইচ অফ করে দিলাম। রাত একটায় পড়াশুনো সেরে আবার ফোন অন করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ফোন বাজতে লাগল।প্রমিত।ও কি পাগল নাকি? এমনিভাবে ফোন করে চলা কি করে সুস্থ মানুষের লক্ষণ হতে পারে, বলো। আমি ফোন ধরলাম। প্রমিত থমথমে গলায় বলল, আমি জানি আপনি প্রেম, সম্পর্ক, এসবে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি ম্যাডাম। আমি কি করব ? হ্যাঁ প্রমিতের
গলার মধ্যে আমি অসহায়তা দেখেছিলাম।ওই রাত একটায় ওটা সত্যি ছিল। হয়ত পরেরদিন সকালেই ওটা আর সত্যি থাকবে না। অন্যকিছু হয়ে যাবে।আসলে, কিছু কিছু সত্য মুহূর্ত এসেছিল। কিন্তু ওগুলো জুড়ে জুড়ে মালা গাঁথতে যাওয়াটা হল চরম বোকামি।
-হ্যাঁ, আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম প্রেম নিয়ে এইরকম বাতিকগ্রস্তের মত ব্যবহার দেখে।এমন ধরণের মনুষ্য প্রজাতি আমি আগে কখনও দেখিনি। তাই বড় অবাক লাগত। মনে হত, এরকম কেন করে? মনের ভেতর কে কামড়ায়? এইসব ভাবতাম।তারপর অবশ্য আর ভাবতাম না। অভ্যেস হয়ে গেছল।
-এরপর কি হল মনে পড়ে?
-মনে পড়ে মিঠুয়া। বোধহয় তোমাকে দেখে মনে পড়ে গেল। তোমাকে হাঁটতে চলতে ফিরতে দেখছি ওইসময়ে। যখন সেদিন তুমি ঘুমিয়ে পড়লে পরদিন ভোর সাড়ে পাচঁটায় ফোন এল ইন্দ্রনাথের উদ্বিগ্ন । চরম অস্থির।
-তারপর?
-আঁতিপাতি করে প্রশ্ন করল, কবিতা পাঠ শুনতে আসিনি কেন? বললাম, শরীর খারাপ লাগছিল।বলল, ফোন কেন বন্ধ ছিল।বললাম, ওই প্রমিত বারবার ফোন করছিল তাই।
-এরপর কিসের যেন অশান্তির বাষ্প চারদিক ছেয়ে গেছিল।
-হ্যাঁ, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি যে আসলে ঘটছে। সবকিছুই ছিল ভীষণ দুর্বোধ্য। আমার ওদের কিশোর বয়সের উদভ্রান্ত প্রেমিকদের মত লাগাছিল। আসলে তা নয়। ওরা যেযার নিজেদের স্বার্থ নিয়ে লড়ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ওরা মোহরা হিসেবে ব্যবহার করছিল আমাকে।
-সত্যি কথা বলতে কি, আমরা ছিলাম আদ্যপান্ত হাঁ করা একটা মেয়ে। এই দেখাগুলোতে নাজেহাল না হয়ে, শুধু দর্শক হিসেবে দেখলেই তো হত !
-এই পাহাড়ে, এই প্রকৃতির মাঝে ওগুলোকে যে কত তুচ্ছ, কত সময় ও শক্তির অপব্যয় ও হাস্যকর বলে মনে হয় আর মনে পড়াতেও ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে গেছে। এবার ওগুলো উড়ে যাক হাওয়ায়, আকাশে, বাতাসে। আমি আর ওদের বহন করতে চাই না।
-একদিন এই পাহাড়ে এমনিভাবে প্রকৃতির ভেতর দিয়ে তোমার নিজেরই উন্মোচন হবে, তা কি তুমি
জানতে না ?
-সঠিক হয়তো জানা ছিল না। কিন্তু আভাস তো পেয়েছিলাম। মন খুব খারাপ ছিল তখন। মানুষদের মধ্যে এত স্বার্থের সংঘাত, শুধুমাত্র সাহিত্যের জগতে নিজের নাম প্রতিষ্ঠার জন্যই তো ! আর তো কিছু না।

মানুষের ভেতর থেকে ছায়ামূর্তির প্রেত, পিশাচের মতো দাঁত নখ বের করা অন্ধকারের প্রবৃত্তিরা হানা দিত।একে অপরকে খুবলে নিত। শুধুমাত্র টিঁকে থাকার জন্য।তার লেখার পাঠক পাবার জন্য। কিছু পুরষ্কারের জন্য।
নামের মোহের জন্য। এরাও তো সর্বস্ব পণ করেছিল শুধু সাহিত্যের জন্য। পিছিয়ে পড়তে বা হারতে চাইত না কেউ। তাই বারবার হারতে হত ওদের।
কষ্ট হচ্ছিল আমার। সত্যিকারের কষ্ট। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিলাম এসবে। বারবার মুখে চোখে জল দিচ্ছিলাম আমি। কোথায় এসে পড়লাম, এমনিই ঘুরতে ঘুরতে। ভারী অদ্ভুত জায়গা তো। ভারী অদ্ভুত আচরণ মানুষের।
এরকম মানুষ আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার কষ্ট হচ্ছিল। ভীষণ কষ্ট কষ্টটা বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়লাম
আমি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে উৎকট দমচাপা ভাব। দেখলাম কারেন্ট চলে গেছে। দরজা খুলে পায়ে
পায়ে পাশের ঘরে এলাম। খোলা জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালাম।

গভীর নিশুতি রাত বাইরে। শহরে রাস্তার আলো নিবে যাওয়ার জন্য রাতটাকে বহু শতাব্দী পেছনে চলে যাওয়া এক আদিম রাতের মত লাগছিল।
সামনের মাঠে বিশাল বিশাল মহীরূহ ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের শাখা-প্রশাখায় রাতের আকাশ ছেয়েছিল। গাছেদের রঙ ছিল গভীর কালো। তাদের কালোর গভীরতা রাতের আকাশকে হার মানিয়ে দিয়েছিল।আমি ওই কালো কালো ডালপালায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। কি অপূর্ব, কি মোহময়! এ তো প্রেম ! এর কাছে কোথায় লাগে প্রেমাম্পদের প্রথম চুম্বন।

সেই প্রথম আমি দেখেছিলাম নিজেকে নিঃশব্দ ইথারের মতো প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেতে। আমি হুঁশহারা হয়েছিলাম। এক সময় আমি শুয়ে পড়ি আর বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে অবিরাম বয়ে চলা নিরবচ্ছিন্ন প্রেম, আমার ওপর
দিয়ে হাওয়ার মতো বয়ে চলে। আমি পড়ে থাকি চুপচাপ। ক্রমে আলো ফুটে ওঠে ও শহর আড়মোড়া ভাঙে।আর আমার মনে হয়, রাস্তায় শুয়ে থাকা গৃহহীন ভিখারিদের ঘুম থেকে ডেকে বলি, চলো উৎসব করি।

অবশেষে এর জন্য আমি মনে মনে ধন্যবাদ দিই প্রমিত এবং ইন্দ্রনাথকে। তারা এভাবে আমাকে মুখোশ খুলে মানুষের মুখ না দেখালে আমার এইভাবে একটা রাতের বোধ হত না। বিশ্বের সর্বত্র কোণে কোণে কানায় কানায় ভরে আছে প্রেম, হাত ভরে তুলে নিঃশ্বাসে ভরে নাও। এ বোধে আমি পৌঁছতাম না। আমি বিশ্বে ভরা-ভরতি প্রেমের মতো ভর্তি হৃদয় দিয়ে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম ওদের।
আনমনে মিঠুয়া বলল, হুঁ। কিন্তু যাইহোক আর তাইহোক, বড্ড বোকা ছিলাম আমরা।
-বোকা ছিলাম। পুনরাবৃত্তি করল ভুলোমনা।
-শিখতে সময় লাগছিল। কতরকম জীবন হয়। মানুষদের ধারণাগুলোও কত ধরণের হয়। বাক্তিগত ধারণা অনুযায়ী ব্যক্তিগত জীবন পরিচালিত হয়। তার মধ্যে ভাল-মন্দ বিচারের ঝুলি কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার
জন্য আমরা কে? প্রতি পদে পদে নিজের ধারণা অনুযায়ী অন্যদের ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করাটা উচিত হয়নি ।

মিঠুয়া চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ পর মিঠুয়া বলল, কি করা উচিত ছিল?
-জানি না। তুমি একটা প্রেম খুঁজছিলে মিঠুয়া। এমন একটা প্রেম যা পুরনো হয়ে যায় না। অভ্যেসে পরিণত হয় না। কোনো শর্তের ওপর নির্ভর করে না। যে প্রেম সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সবসময় চিরনতুন থাকে।
-হ্যাঁ, ঠিক এটাই…এটাই। একমাত্র এটাই চেয়েছিলাম। সেইজন্য চেয়েছিলাম, ইন্দ্রনাথ মিথ্যে কথা বলাটা বন্ধ করুক। সত্যি কথা বলুক। তারপর যা হয় দেখা যাবে। কিন্তু লিপির ব্যাপারে যেহেতু ও গোপন করতে চাইত,তাই মিথ্যে কথাটাও ওকে বলতে হত।
-ও ভয় পেত মিঠুয়া। আসলে ভীষণ ভিতু ছিল ইন্দ্রনাথ। একটা শক্তপোক্ত পুরুষালি ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটা ডরপোক দুর্বল মানুষ দাঁড়িয়েছিল।
-একটা কথা ও বলত বটে। মনে আছে তোমার? ও বলত, ওর একা হয়ে যেতে ভয় করে। আমি ওকে বলতাম, আমরা সকলেই তো একা। খামোখাই কিছু সম্পর্ক বন্ধুত্ব ইত্যাদি পাতিয়ে একটা মিলিত সময় কাটাচ্ছি। কিন্তু একা হয়ে যাওয়ার খা-খা ভাব কখনোই মুছে যাচ্ছে না। স্বজনহীন,বান্ধবহীন খালিপন,শুন্যতা কাটাতে আমাকেও .. হয়ত তাই ছিল এত তোড়জোড়…এত প্রেম অন্বেষণ।

-আমি নিজে নিজেই একটা অপেক্ষা তৈরি করে নিয়েছিলাম। সৎ হওয়ার অপেক্ষা । যেদিন ইন্দ্রনাথ সৎ হবে সেদিন সে সাহসীও হবে। গোপনীয়তা আর মিথ্যাচার থেকে বেরিয়ে আসবে।
ভীষণ হাসি পেল ভুলোমনার। কষ্টের হাসি, কান্না মেশানো হাসি।
-এটা কি খুব জরুরী ছিল মিঠুয়া? কেন তুমি প্রেমের মধ্যে শর্ত টেনে এনেছিলে? সব শর্ত তো ভাঙতেই চেয়েছিলে তুমি ! না ?
মিঠুয়া মাথা নীচু করে রইল। চলতে চলতে তারপর এমন একটা দিন এল একদিন, যেদিন হঠাৎ ইন্দ্রনাথ ফোন করল এক অদ্ভুত সুরে। এটা সেই দিনটা ছিল যেদিনের অপেক্ষায় ছিল মিঠুয়া। ফলে ইন্দ্রনাথ যখন কোনো এক ফাইন মরনিং মিঠুয়াকে ফোন করে জানাল,-তোমার যত না-বলা অভিযোগ ছিল, সব মুছে দেব আমি। মিঠুয়া ভাবল, হল কি?
ইন্দ্রানাথ বলে উঠল, আমার যে সম্পকর্টা ছিল, ওসব আর নেই।
…আর নেই।
মিঠুয়া ভাবল, তবে কি সত্যের জয় হয়েছে?
কারণ দেবারুণ আর প্রমিত যে স্থির প্রত্যয়ের সাথে বলত, যে সম্পর্কে দুজনেই দুজনকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে, সে সম্পর্ক একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরকমই ধারণা নিয়ে ওরা সকলেই বড় হয়েছিল। এই মূল্যবোধ ওদের ধমনীতে নীরবে বয়ে চলেছিল।
মিঠুয়া ভুলোমনাকে প্রশ্ন করল, তুমি জানো, কোনটা নৈতিক আর কোনটাই বা অনৈতিক?
ভুলোমনা যদিও হঠাৎ কোন উত্তর দিতে পারল না, কিন্তু একটু পরেই সে জানাল যে, না সে জানে না। তবে হ্যাঁ, ভুলোমনার মনে পড়ছে এইরকম একটা বিপজ্জনক সময়ে ইন্দ্রনাথ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিল
যার স্বপ্ন সে দেখেছিল শুরু থেকেই। ফলে, তার অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল অনেকটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। তার মনে পড়ল, দিনে চারবার ফোন করে ইন্দ্রনাথ কি যে সব বলত। সে মাঝেমধ্যে হাহাকার করত, কখনও ভীষণ ক্রূদ্ধ, কখনও শাপশাপান্ত করত , আর মিঠুয়ারূপী সে হাঁ করে ভাবত, হলটা কি? এইরকম এক হাহাকারের দিনে ইন্দ্রনাথ একদিন হতাশার মধ্যে ঘোষণা করল, লিপি জীবনে যা করেছে, তা ইন্দ্রনাথের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। এখন ওর মাথার ওপরে ইন্দ্রনাথের সহযোগিতার হাত না থাকায় ও দ্রুতগতিতে পতনের দিকে ধাবিত হবে।
পতনের দিকে ধাবিত হবে কি হবে না, সে সম্পর্কে মিঠুয়ার কিছু জানাই ছিল না। সে বুঝতে পারেনি দিনে দিনে আর্সলে শুধু সে দর্শকে পরিণত হতে চলেছে। তাই যা তার অভিজ্ঞতায় কোনদিন ঘটেনি,কেবল তাকে স্বাক্ষীস্বরূপ হয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। সেসময় কয়েকদিন ইন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে চাইত, সভা সমিতি ও আড্ডার আসরে। মিঠুয়া খুব অবাক হয়ে উপলব্ধি করেছিল,
ইন্দ্রনাথের চাহিদামত এত দৌড়ঝাঁপ তার পোষাচ্ছে না। আর ইন্দ্রনাথ বেশ নাছোড়বান্দা।এইসময় ইন্দ্রনাথ মিঠুয়াকে দ্বিতীয় লিপি হিসেবে গড়ে তোলার কসরত চালাচ্ছিল আর মিঠুয়া ঘোরতরভাবে বুঝতে পারছিল যে তার পক্ষে লিপি হয়ে ওঠা একেবারে অসম্ভব। সে ইন্দ্রনাথকে বলল, এই যে হঠাৎ পালাবদল, এর কারণটা আমি জানতে চাই।
ইন্দ্রনাথ জানাল যে, সেও বলতে চায়, তবে তাকে কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে। তবে সে বলবে যখন বলেছে, তখন বলবেই। পাঁচদিন অসাক্ষাতের পর ইন্দ্রনাথের কাছে লিপি এল। ইন্দ্রনাথ আগে থেকেই মিঠুয়াকে জানিয়ে রেখেছিল। সাক্ষাৎ প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ চলেছিল। তারপর আবার ইন্দ্রনাথ মিঠুয়াকে জানিয়েছিল। তবে মিঠুয়া যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছিল। সে অপেক্ষা করছিল। আবার আর একটা অপেক্ষা ইন্দ্রনাথ যখন তাকে বিশ্বাস করে সবকিছু খুলে বলতে পারবে সেই দিনের অপেক্ষা।

সেই দিন এলে তবে সে পুরোপুরি ইন্দ্রনাথের হবে। সেইদিন আর আসেনি। তার বদলে ইন্দ্রনাথের ফোনে লিপির মেসেজ এসেছিল। “ইট’স রেনিং। এগজ্যাক্ট টাইম বলো। নয়তো ভিজে যাব’। ইন্দ্রনাথ ফোন বাড়িতে ফেলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেছিল গাড়ি নিয়ে। একটুখানি গিয়েই তার মনে পড়ে সে ফোন ফেলে গেছে। ফোনে লিপির মেসেজ আসে এবং মেসেজটা দ্যাখে সহেলি। ফোন নিতে এসে ইন্দ্রনাথ বাড়িতে আটকা পড়ে। সে বাথরুমে ঢুকে ছড়ছড় করে কল খুলে দেয় এবং মিঠুয়াকে ফোন করে
জানায়। তবে সে, সত্য বলেনি, অনেকখানি মিথ্যে মিশিয়ে বলেছিল। কারণ লিপির সঙ্গে দেখা করার পরেই তার মিঠুয়ার সঙ্গে দেখা করার ছিল। মিঠুয়াকে ফোন করে লিপির মেসেজের কথা জানায় সহেলি। আবার ইন্দ্রনাথ মিথ্যের আশ্রয় নিতে আরম্ভ করে।

এই ঘটনার পর মিঠুয়া একেবারে থমথমে হয়ে যায়। সে এক গভীর ভাবনার জগতে ঢুকে পড়ে। অবসর সময়ে সে শুধুই বুঝতে চেষ্টা করত, যা ঘটছে, আসলে তার স্বরূপ কি। এইভাবে ভাবতে ভাবতে বছর দুই পার হয়ে গেছিল।ইন্দ্রনাথ আসত,যেত। সে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করত।পুরোনো স্মৃতির মধুর হাতছানি মাঝে মাঝে তাকে নাড়া দিয়ে যেত। সে শুধু বোঝার চেষ্টা করত কোনটা কতটা সত্যি ছিল আর
কোনটা ছিল কতটা মিথ্যে।

তেরো

ব্যাপারটা সম্পর্ক না প্রেম নাকি আশ্রয় না ভালবাসা না কি ছাতার মাথা এ সমস্তই একটা সময়ে তালগোল পাকিয়ে গেছিল। ব্যাপারটা তখন নিয়মমাফিক একবার ফোনে দাঁড়িয়ে গেছিল। সেই ফোনটা মাঝে মাঝে হত
অনেকটা এরকম। ইন্দ্রনাথ ফোন করল,_কি করছ?
-গল্পটা এডিট করছি।
-গল্পটা লেখা হয়ে গেছে? শেষটা কি করলে?
-শেষটাতে…
-আচ্ছা, দাঁড়াও আমি তোমাকে আবার ফোন করছি।
ফোন কেটে গেল।
দশ মিনিট পর আবার ফোন।
-মিহিদানা কিনতে এসেছি।
-আপনি মিহিদানা খাবেন ?
-হ্যাঁ
-লজ্জা করে না? আপনার না মিষ্টি খাওয়া বারণ?
-লজ্জা করবে কেন, আমি তা জামাকাপড় পরে আছি। আচ্ছা, দাঁড়াও, তোমাকে আবার ফোন করছি। এ.টি.এম-এ ঢুকব। টাকা তুলে নিই তারপর।পাঁচমিনিট বাদে আবার ফোন।
-হ্যাঁ, তারপর বলো, গল্পটার শেষটা কি দাঁড়াল?
-শেষে আবার প্রথম সিনটা ফিরে এল।
-প্রথম সিনটা যেন কি ছিল?
-ওয়ালথার রিভলবার দিয়ে ও নিজেকে শ্যুট করছিল।
-ও হ্যাঁ সুইসাইড করছিল তো?
এইরকম চলত। মাঝে মাঝে ইন্দ্রনাথ সিরিয়াস ফোন করত। সাধারণত কবিতা লেখার পর ইন্দ্রনাথ খুব সিরিয়াস হয়ে থাকত। তখন সে ঘন ঘন মিঠুয়াকে ফোন করত। কবিতার দর্শন,শব্দচয়ন ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা
হত। ক্রমশঃ মিঠুয়া বুঝতে পারছিল ইন্দ্রনাথের অসহায়তার কথা। সে প্রাণপণে চাইত, সকলের কাছ থেকে মিঠুয়াকে লুকিয়ে রাখতে, পাছে কেউ মিঠুয়া সম্পর্কে কিছু বলে, আর যদি সেই কথা লিপির কানে পৌঁছোয়। এটা
ইন্দ্রনাথ কখনই চাইত না বটে, কিন্তু এটা সম্পর্কে সে যে ভীষণ সাবধানী এ ব্যাপারেও সে কখনও কিছু বলত না। এতদিক রক্ষা করতে হলে যে কেউ কাহিল হয়ে পড়বে । এমনই ভাবত মিঠুয়া এবং এই ভাবনার মধ্যে সত্যতা ছিল। সেইসব দিনে সত্য এবং মিথ্যে এমন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিল, সত্য আর মিথ্যেকে আলাদা করে চেনা ছিল দুষ্কর।

ভুলোমনা রিমপোচের ঘরে বসে বসে, মিঠুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক সময় পার করে ফেলেছিল। এমনকি তার এটাও বোধ ছিল না,অনেক সময় পেরিয়ে গেছে না অল্প সময়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছিল এবং কিছু কিছু গ্রামবাসী রিমপোচের ঘরে এসে বসছিল। এইসময় ভুলোমনা উঠে দাঁড়াল, সে মিঠুয়াকে রিমপোচের ঘরে রেখে একা একা বাইরে এল। সে এমনভাবে মিঠুয়াকে রিমপোচের কাছে রেখে এসেছিল যেন মনে হচ্ছিল, সে চিরকালের মত মিঠুয়াকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে । বাস্তবিকই, মিঠুয়ার জীবন থেকে বিদায় নিয়ে ভুলোমনা হাঁটতে শুরু করল আপন মনে।
সে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলতে চলতে নেমে গেছিল জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গলের মধ্যে পায়ের চাপে পাতার ওপর আওয়াজ উঠছিল মস মস। দূর থেকে এক ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল ঢং ঢং ঢং ঢং। হয়তো কোনও মন্দিরের হবে। সে ঘণ্টাধ্বনি অনুসরণ করতে করতে চলছিল। যেতে যেতে সে কেবলই একটা কবিতা বলছিল আপনমনে।
‘আই শাট মাই আইজ এ্যান্ড অল দ্য ওয়ার্ল্ড ড্রপ ডেড। আই লিফ্ট লিডস এ্যান্ড অল ইজ বর্ন এগেইন। আই থিঙ্ক আই মেড ইউ আপ ইনসাইড মাই হেড।

হাঁটতে হাঁটতে সে একটা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। পাহাড়ের ঢালে সিঁড়ির মত ধাপ কেটে বাড়ি বানানো। কাঠের সরু সরু বারান্দা। গ্রামটার মধ্যে স্থির হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের ওপর বসল ভুলোমনা। অনেকদিন পাহাড়ে থাকতে থাকতে সে কিছুটা পাহাড়িদের মত হয়ে গেছে। পাহাড়ে চলতে ফিরতে আর তেমন হাঁপায় না। আগে হাঁপিয়ে যেত। দেবেন্দ্রর সঙ্গে বেড়াতে বেড়িয়ে প্রায়ই দেবেন্দ্রকে বলত দাঁড়াতে। ওর জন্য অপেক্ষা করতে। আজ তার মনে হল, ওর জন্য কারুর অপেক্ষা করার আর দরকার নেই। ও নিজেও আর কারুর জন্য অপেক্ষা করে না। পাথরটার ওপর বসে থাকতে থাকতে সে বিড়বিড় করে আবার কবিতাটা আওড়ালো, -স্টারস গো ওয়াল্টজিং আউট ইন ব্লু এ্যান্ড,রেড।এ্যান্ড আরবিট্রারি ব্ল্যাকনেস গ্যালপস্ ইন্। আই শাট মাই আইজ্ এ্যান্ড অল্ দ্য ওয়ার্ল্ড ড্রপ্ ডেড ।
বিড়বিড় করতে করতে সে দেখতে পেল সে আর ইন্দ্রনাথ একটা বাড়ির আশেপাশে লুকোচুরি খেলছে। সে বিড়বিড় করে বলছিল নিজের মনে নিজেকেই, খুব বেশী বায়নাবাজ প্রেমিকা কোনো বয়স্ক প্রেমিকেরই সহ্য হয় না। তাদের আরও নানা একগাদা কমিটমেন্ট থাকে। আর তাছাড়া তারা নিজেরাই হয় ভীষণ বায়নাদেড়ে। কিন্ত যখন থেকে আমি নানা ধরণের আবদার ও মান-অভিমান ইত্যাদি বন্ধ করে কেবলমাত্র বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানে অবস্থান করতে লাগলাম, তখন থেকেই আমাদের প্রেমটা একেবারেই দরকচা মেরে গেছিল। অথচ ইন্দ্রনাথ নিয়ম করে ফোন করত। নিয়ম করে ফোন করার অর্থ নিয়ম করে জানান দেওয়া যে আমাদের মধ্যে কিছু একটা
আছে, যা মেইনটেইনড্ হচ্ছে। আমাকে ও ছেড়ে চলে যাচ্ছিল না। আবার এও হতে পারে, ছেড়ে যাবার মত মুরোদ ও হারিয়ে বসেছিল। বা হয়ত ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলে তবেই ছাড়াছাড়ি হয়। সম্ভবত তেমন ভয়ঙর কিছু তখনও পর্যন্ত ঘটেনি। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাপারটা ছিল, ভগ্নাংশের মত। এদিকে ভগ্নাংশ ব্যাপারটা আমাদের মাথা জুড়ে বসে আমাদের অধিকারবোধকে ক্রমাগত খর্ব করে চলেছিল। ইন্দ্রনাথ লিপিকে হয়ত ৩/৪
অংশ ভালবাসত, আমাকে বাসত ১/৩, এইরকম কিছু একটা হবে। আবার কেউ হয়ত ওর কাছে ২/৩ জুড়ে বসেছিল। আমি চাইছিলাম একটা গোটা এক। পাচ্ছিলাম না। ওটা আমার হ্যাংলামো হয়ে যাচ্ছিল হয়ত। আসলে ভালবাসা ব্যাপারটায় ভগ্নাংশ ঢুকে পড়ার ফলে আমার যতটা না অসুবিধে হত, তারচেয়ে অনেক বেশী অসুবিধে হত মিথ্যে কথা বলার কারণে। তবে, সব সত্যি কথা বলাটা হয়ত সম্ভব ছিল না, এটা আমার বোঝা উচিত ছিল। আর কেউ কিছু একটা বলতে না চাইতেই পারে, এই গণতান্ত্রিক অধিকার তার থাকা উচিত।

ইন্দ্রনাথ আমাকে কিছুটা ভালবাসত। এটা সত্যি ছিল। লিপিকেও ভালবাসত। তার ওপর আবার লিপিকে ওর বেশী দরকার ছিল। আরও কিছু কিছু জিনিসও জীবনে ওর দরকার ছিল। সেগুলোও সত্যি ছিল।

সবকিছুই এত সত্যি আবার সবকিছুই একইসঙ্গে মিথ্যে ছিল। এই সত্যি-মিথ্যের মহা সংকটে একদিন আমি ঘোরতর বিদ্রোহ করে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, এসব নিয়ে নাও। যাও। আমার এভাবে চাই না। ইন্দ্রনাথ উত্তর না দিয়ে চলে যেতে লাগল। আমি দেখলাম, আমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছি। কতবার…কতবার এইভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকেছি। আবার উঠেছি। আবার ভালবেসেছি। ভালবাসা পেয়েছি । আর এটাও ঠিক এই ভালবাসা পাওয়া না পাওয়া সবটাই ছিল ভয়ানক মিথ্যে আর ঘোরতর সত্যি। আমি সত্য মিথ্যের এই মহা ঘুর্ণিচকে পিষ্ট হতে হতে চিৎকার করে বলতে চাইলাম। চাই না, এসব চাই না, কিছু চাই না। যেনাহাং নামৃতা
শ্যাম, কিমহং তেন কুর্যাম? যা নিয়ে আমি অমৃতা না হব, তা নিয়ে আমি কি করব? আওয়াজটা ঘুরেফিরে প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছেই ফিরেছিল। আমি চাইছিলাম, আওয়াজটা ইন্দ্রনাথের কানে পৌঁছিয়ে দিই। যখনই এমন মনে হয়েছিল, তখনই প্রবল ভয়ে কে যেন ভেতর থেকে বলে উঠেছিল, সহ্যের,বাড়া গুণ নাই।সহ্য কর,সহ্য করলে জগৎ তোমার। আমি ভয়ে কুঁকড়ে মিইয়ে যেতাম, যেন নোংরা পোঁছা ন্যাতা।

নোংরা পৌঁছা ন্যাতা…শব্দ বন্ধটা মনে মনে বারবার আওড়েছিল ভুলোমনা। অবশেষে একদিন আমি সত্যি সত্যিই নোংরা পৌঁছা ন্যাতা হয়ে গেলাম…বলল সে।

বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ভুলোমনা। আর চলতে লাগল। পাহাড় বেয়ে ওপর দিকে উঠছিল সে। গ্রামটা শেষ হয়ে গেছিল। গ্রামের শেষে কখানা বাড়ির পেছনে লম্বা লম্বা বাঁশের আগায় সাদা সাদা পতাকা লাগানো ছিল। পরিবারের যারা মৃত তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। সেইখানে ইন্দ্রনাথকে একা একা জীবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে দিয়ে সে এগিয়ে গেল।

নোংরা পৌঁছা ন্যাতা…কি যেন ঘটেছিল। ইন্দ্রনাথ একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল। সে মিঠুয়াকে বারবার বলছিল,ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যাবে আর কোথায় কেমন সাজানো যায় সে নিয়ে কথা বলবে। কিছুদিন বাদে দেখা গেল, ফ্ল্যাটটা লিপি মনের মত করে সাজাতে শুরু করেছে। তার কাছে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি। ইন্দ্রনাথ আরও কিছু বন্ধুকে ফ্ল্যাট দেখিয়ে আনল। সবাই বেজায় খুশী। তারপর আর কারা যেন দেখতে চলল। সবকিছুই ইন্দ্রনাথ অত্যন্ত ঘটা করে মিঠুয়াকে জানাল। একদিন ইন্দ্রনাথ বলল, সে মিঠুয়ার কাছে সন্ধে নাগাদ এসে ডিনার করতে পারে। কিন্ত সন্ধে নাগাদ ইন্দ্রনাথ ফোন করে প্রথমে একটা বেসুরো গান শোনালো। তারপর ভীষণ ফুর্তিতে লাফালাফি করতে করতে বলল, সীমাকে নিয়ে যাচ্ছি ফ্ল্যাট দেখাতে। সীমা ইন্দ্রনাথ ও লিপির বন্ধু ছিল। ওরা খুবই ভালবাসত সীমাকে। ইন্দ্রনাথ বলল, তারপর আমি আর সীমা চায়না টাউনে ডিনার করব। এতদিনের রপ্ত করা নিস্পৃহতা, আয়ত্ব করা উদাসীনতা, বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবের কি হল কে জানে, সব তোলপাড় হয়ে গেল। মিঠুয়া আচমকা বলে বসল, হাউ ক্যান ইউ ডু দ্যাট? ইন্দ্রনাথ এত ভয় পেয়ে গেল…ভয়ে সে ফোন ছেড়ে দিল। কে জানে ইন্দ্রনাথ এত ভয় পেয়েছিল কেন? আর মিঠুয়া?
ভুলোমনা ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে পথ হাতড়ে হাতড়ে পাহাড়ের ওপরে উঠছিল। একটা করে পদক্ষেপ তার সেইদিনের একটা করে মুহূর্তকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। সে ফোন ছাড়বার পর অনেকক্ষণ চিৎকার করেছিল। চিৎকার করতে করতে একসময় সে গোঙানির মধ্যে চলে গেছিল। সে তার হাঁটুদুটো মুড়ে বুকের কাছে জড়ো করে বিছানাময় কাতরাচ্ছিল। দেড় দিন বাদে ঘুম ভেঙে সে দেখে কারা যেন ভীষণ বেল টিপছে আর দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে। সে দরজা খুলে সামন্তকে দেখতে পেয়েছিল।

সামন্ত তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। কিন্ত সে সামন্তের কোন কথা বুঝতে পারেনি। তখন থেকে সে শুধু বসে থাকত একা একা। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে, ওর কিছুই মনে পড়ত না। ফলে, কি উত্তর দেবে ও কিছু বুঝতে পারত না। তাই ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। সে যে প্রকাশনার অফিসে কাজ করত, সামন্ত ছিল তার মালিক। ডাক্তার বলেছিল, মিঠুয়াকে এই শহর থেকে সরিয়ে ফেলতে। ফলে মিঠুয়ার দাদা ও বৌদি এসে তড়িঘড়ি সামন্তর সঙ্গে মিঠুয়ার বিয়ে দিয়ে দেয়।

মিঠুয়ার স্বাধীনচেতা ভাব আর জীবনকে নিজের হাতে নেড়েচেড়ে দেখার ইচ্ছেটাকে মিঠুয়ার সখ করে বিয়ে করা আই.এ.এস বরের পাগলামি ছাড়া কিছু মনে না হওয়ার কারণে একসময় ওদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেছিল । হাতে পরে থাকা সেই নোয়াটা বিসর্জনে গেছিল কবেই ।

সামন্ত মিঠুয়ার সব দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল নিজে থেকেই। হয়ত সে বহুদিন ধরেই মিঠুয়াকে বিয়ে করতে চাইছিল, এমনি কিছু একটা হবে। সেই বিয়েটা কেমন ছিল? সেরকম কিছু ছিল না। একটা রেজিস্ট্রি মত হয়েছিল। একই জায়গায় কাজ করার সুবাদে ওদের কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কয়েকজন এসেছিল। সামন্তর কয়েকজন বাড়ির লোক আর মিঠুয়ার দাদা ও বৌদি। মিঠুয়ার খুব ঘুম পেয়েছিল। সে আধো ঘুমে আধো জাগরণে সইটা করে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই সামন্ত তাকে গুরুং গেস্টহাউসে দিয়ে যায়।

আকাশটা এমনভাবে নেমে এসেছিল পাহাড়ের ওপর , পুরো পাহাড়টাই মেঘেদের রাজত্বে চলে গেছিল। ঘন সাদা মেঘের আচ্ছাদনে নীচের গ্রামটা গায়েব হয়ে গেছিল। ভুলোমনা একভাবে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। সে
ঘণ্টাধ্বনির উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পাহাড়ের ওপর অবধি এসে সে দেখল, সেখান থেকে একটা রাস্তা শুরু হয়েছে। সে রাস্তায় উঠে দাঁড়াল। সেখান থেকে নীচের পাহাড়টা পুরোটাই মেঘের কবলে চলে গিয়েছিল।
সামনে ছিল আরও অসংখ্য পাহাড়ের সারি। ঘণ্টাধ্বনি পাহাড়দের মাথা ছুঁড়ে ছুঁয়ে দূর দূর ছড়িয়ে পড়ছিল। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছিল। ভীষণ বিষন্নতায় ভরা মেঘলা ভারাক্রান্ত একটা সন্ধ্যে শুরু হতে যাচ্ছিল।
সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভুলোমনা কেবল ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেল। যতদূর দেখা যায় দূর দূর পাড়ি দিচ্ছিল ঘণ্টাধ্বনি শুনতে শুনতে ভুলোমনার মনে হল, ঘণ্টাধ্বনি আর কোথাও নয়, যেন তার মাথার ভেতরই বাজছে।

বেজে চলেছে ঢং ঢং ঢং ঢং। ভুলোমনা বিড়বিড় করতে লাগল, আই থিঙ্ক আই মেড ইউ আপ ইনসাইড মাই হেড। ক্রমে সন্ধ্যে নেমে এল। ঘোর অন্ধকারে কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ে থমকে দাঁড়িয়ে ভুলোমনা কেবল ঘণ্টাধ্বনি শুনতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, তার শরীরটা মন্দির। ঘণ্টাধ্বনি তার ভেতরে। মুহুর্মূহু নাভীকুণ্ড উজাড় করে উত্থিত হচ্ছে অনাহত নাদ। সেই নাদ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে, জলে ,অন্তরীক্ষে, মানুষ থেকে মানুষে আর মনুষ্যেতর প্রজাতিতে। এর যেন বিরাম নেই। বিরাম হীন প্রেমসর্বন্ব এক জগৎ, যেখানে প্রেম ছাড়া আর কিছুই নেই। তার মাথার ওপরে ছিল মহাকাশ। পায়ের নীচে ছিল সমগ্র পৃথিবী। নিকষ অন্ধকারে ভরা ছিল সে জগৎ। অন্ধকার মন্থন করলে একমাত্র প্রাপ্যস্বরূপ উঠে আসত প্রেম। আর বাকী সবকিছুই যা আসত তার আগে সেসবই ছিল ভীষণ তুচ্ছ। তুচ্ছতায় ভরা জগৎ , তুচ্ছতায় ভরা মহাবিশ্ব। নামেই শুনতে লাগে এত এত বিস্ফোরণ, ধামাকার মত। জগৎ যেন এক অতিকায় তিমি, বিশাল হাঁ-এর মধ্যে সব তুচ্ছতাকে গপাগপ গিলছে। সেই তুচ্ছতার মধ্যে রয়েছে এতদিনের যাবতীয় ছেলেখেলা,ছোটাছুটি, অহেতুক মান-অভিমান আর কাজের নামে জড়ো করে রাখা যত পন্ডশ্রম। সবকিছু দানছত্র করে দিল ভুলোমনা সেই আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে। পায়ের তলায় পৃথিবী রইল তার সাক্ষী।

এমনিভাবে অনেকক্ষণ কেটেছিল নাকি অল্পক্ষণ, হঠাৎ ভুলোমনা শুনতে পেল গুরুং-এর গলার আওয়াজ।তার নাম ধরে ডাকছে। সঙ্গে দেবেন্দ্রর গলাও। ওদের হাতে টর্চ। ক্রমে টর্চ হাতে ওরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে এল ভুলোমনার কাছে। বলল, বাড়ি চলো। বাড়ি? কার বাড়ি? কারা থাকে? তার কি কোন বাড়ি আছে? তার কি কোন বাড়ি ছিল কোনোদিন? তবুও কোন কথা না বলে ভুলোমনা নিঃশব্দে ফিরতে লাগল ওদের সঙ্গে।অনেক রাতে সে তার রুমের দরজায় টকটক আওয়াজ পেল। গুরুং। দরজা খুলতে গুরুং জানাল ঠাকুরজী মানে রিমপোচে তাকে ডাকছে। একটা শাল জড়িয়ে ভুলোমনা রিমপোচের ঘরে এল। রিমপোচের ঘরে শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছিল টিমটিম করে। বাইরে ছিল গভীর রাত। চারদিকের পাহাড়ের মতই স্তব্ধ হয়ে থেমে ছিল সে রাত।
ভুলোমনা দেখল রিমপোচের মুখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা। যেন তার চারপাশ দিয়ে আলো বেরোচ্ছে। ধীরে গিয়ে ভুলোমনা ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল। চাঁদের আলোর মত হালকা সাদা আলোয় ঘর ভরে গেল। ভুলোমনা দেখল, রিমপোচে যেন আয়নার মত। রিমপোচের দিকে তাকালে সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। আজ ভুলোমনার সমস্ত আমির সত্ত্বায় অদ্ভুত এক শান্ত শূন্যতা। রিমপোচের মধ্যেও তাই। ভুলোমনা রিমপোচেকে বলল,
আমার আর না..আজ সব মনে পড়ে গেছে।
-তবে, আর কেন?
রিমপোচে বলল।
-আমি ওদের পাখির মত আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি। মুক্ত করে দিয়েছি।
-বেশ করেছো। ঠিক করেছো?
একটুখানি চুপ থেকে রিমপোচে বলল, তাইতো বলি, তবে আর কেন?
-তুমি আমাকে কি করতে বলো?
-সময় চলে যাচ্ছে। সময়কে চলে যেতে দিও না।
-কি করব আমি?
-ডাক শুনতে পাও না? আকাশে…বাতাসে, অন্তরীক্ষে সর্বত্র সেই চিরপ্রেমিকের ডাক। শুনতে পাও না?
-শুনেছি। আমি সেই ডাক শুনতে পেয়েছি। আমাকে সে ডেকেছে ।
বলতে বলতে ভুলোমনা কাঁদতে লাগল, কেন কাঁদছে না জেনেই। সে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল, কেন কাঁদছি? উত্তর পেল না। শুধু শুধু তার ভেতরটা উথাল-পাথাল করতে লাগল। সে দেখতে পেল রিমপোচেরও গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে আরও কাঁদল। রিমপোচেও আরও কাঁদল। নিস্তব্ধ রাত আরও গভীর, গম্ভীর হয়ে এল। সে রিমপোচের মধ্যে সেই নিঃস্তব্ধ রাতের ছায়াও দেখতে পেল। নিঃস্তব্ধতার ছবিও দেখতে পেল তার মধ্যে। আশ্চর্য হয়ে সে রিমপোচেকে জিজ্ঞেস করল,
-তুমি কে?
-আমি কেউ না।
-লোকে বলে তুমি বারবার জন্মাও। সত্যি?
-সবাই বারবার জন্মায় তুমিও। তফাৎ হল এই যে আমি যে বারবার জন্মই সেটা আমি জানি। তোমারটা তুমি জানো না।
-তোমার বয়স কত?
-আমার বয়সের আদি অন্ত নেই। আমি তো মহাকাশ, আমিই মহাবিশ্ব। আমিই আলোকতরঙ্গ, অথবা কসমিক স্রোত । আমি দূর থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি। আমি কৃষ্ণের বাঁশির সুর এবং বুদ্ধের করুণা। আমি কেবল প্রবাহিত হই। শুধু জেনে রাখো আমি কর্তা নই।
-তুমি আমার ঘণ্টাধ্বনির কথা কি করে জানলে?
-রিমপোচে একটু মুচকি হাসল।
-তোমাকে দেখে। তুমি নিজেই তো তোমার ঘণ্টাধ্বনি। ওই শব্দ অবিরাম তোমার মধ্যে থেকে উত্থিত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছো না?

ভুলোমনার মনে হল ঘরের দেওয়ালগুলো সরতে সরতে কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল। এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে একা। সে মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
অনেকক্ষণ কেটেছিল নাকি অল্পক্ষণ কে জানে? একসময় সে চোখ খুলে দেখেছিল, রিমপোচের ফাঁকা ঘরে সে একা কার্পেটের ওপর পড়ে আছে। রিমপোচে নেই। তখনও রাত। সময়ের জ্ঞান নেই তার। সময় এগিয়ে
চলছিল না থেমে গেছিল, তাও জানত না সে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে রাত ঠেলে ঠেলে সে এগিয়ে গেল।

ভুলোমনা একটা ছেঁড়া পাতায় লিখল, “তোমাদের দেখতে চাই না… তোমাদের দেখতে চাই মানে…ভেবো না, তোমাদের ভালবাসি না। আসলে যা যা করি, আমি ঠিক তার উল্টোটাই।’

সামন্ত কে সঙ্গে নিয়ে গুরুং ভুলোমনার ঘরের দরজার লক যেদিন চাবি দিয়ে ঘুরিয়ে খোলে, তখন ভুলোমনার মোবাইল তারস্বরে বাজছিল। মনে হচ্ছিল, ফোনটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছে। সামন্ত মোবাইল তুলে দেখল, উনত্রিশটা মিসড কল ইন্দ্রনাথের। সামন্ত মুখ কুঁচকেছিল বোধহয়। বিছানার ওপর বাক্স উপুড় করে পড়েছিল ওষুধগুলো।
ওরা একসাথে রিমপোচের ঘরে গেছিল। এটা জানাতে যে ভুলোমনা নামক যে মেয়েটি এখানে ছিল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কি করা উচিত।
ঘরে রিমপোচে ছিল না। গুরুং অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল। সামন্ত বাধ্য হয়ে ওখানে থেকে গেছিল আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে। তারা আবার রিমপোচের মতামত জানতে গেছিল। রিমপোচে ছিল না। তার ঘরে
পুলিশ অফিসারের দেওয়া দশ হাজার টাকা, বিভিন্ন মানুষের দেওয়া হাজার হাজার টাকা তার আসনের তলায় ছিল। তার থেকে অনেক টাকাই রিমপোচে দুহাতে গরিবদের দিয়েছিল। ঘরে তার জমা করা বোতলের ছিপি
সবই ছিল সেই বাটিতে। ছিল না শুধু রিমপোচের সঙ্গে করে নিয়ে আসা ঝোলাটা আর তার পাদুকা দুটো।

ভুলোমনা হেঁটে চলেছিল পাহাড় থেকে পাহাড়ে। তার পিঠে ছিল ছোট একটা ব্যাগ আর তাতে সামান্য কিছু গরমজামা। পাহাড়ে কুয়াশা জমছিল। কুয়াশারা নেমে আসছিল ক্রমশঃ । ভুলোমনা শুধু আরও উঁচু পাহাড়ে আরও গভীর কুয়াশার রাজ্যে হেঁটে চলেছিল। সে ভুলোমনা নামটাকেও ফেলে এসেছিল। তার ছিল না আর কোন নাম। সে নামহীন হয়ে কেবল কুয়াশা থেকে গভীরতর কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিছুই সে সঙ্গে আনেনি। স্থৃতিদের সে উড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তার অজান্তে খুব নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করেছিল একজন । সে চিকু, সামান্য একটি কুকুর মাত্র ….

সমাপ্ত

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    ইন্দ্রাণী দত্ত 2 years

    মহাকাব্যিক সমাপ্তি।
    এযাবৎ প্রতিটি পর্বের নিচে যা যা লিখেছি, মনে মনে সেই সব আবার‌ও বললাম।
    এমন বিষাদপ্রবণ অথচ আনন্দময় আখ্যান মনে থাকবে।
    পরবর্তী উপন্যাসের অপেক্ষায় থাকব।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes