ভাষা মানে মুক্তি <br />রূপশ্রী ঘোষ

ভাষা মানে মুক্তি
রূপশ্রী ঘোষ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট –

ভাষা মানে জাতি
ভাষা মানে ভাত
ভাষা মানে মুক্তি
ভাষা মানে বাবা মা

কোনো লাইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। চারটে লাইনই আমাদের বাঙালিদের পরিচয় বহন করে। যারা রোগা হওয়া, ডায়েট করা বা সুগারের চক্করে ভাত ছেড়েছে তাদের কথা আলাদা। তবুও বাকি তিনটে লাইন তাদের বাঙালি পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখবে। কিন্তু ভাষা মানে যে মুক্তি, এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।

আমার বড়ো হওয়া একেবারে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পড়াশুনো, প্রথমে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক, জুনিয়র হাই, এবং হায়ার সেকেন্ডারিতে। তারপর একেবারে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি হলাম বাংলা অনার্স নিয়ে। প্রতিদিন ক্লাস নেওয়ার সময় এক স্যার বলতেন, ‘যার নেই কোনো গতি সে যায় রবীন্দ্রভারতী। তার উপর বাংলা। চিন্তা নেই, গাছতলায় বসে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দাও। বছরের শেষে দেখবে পাশ করে গেছ।’ না পড়ে পাশ করা যায় কথাটায় সাময়িক আনন্দের চেয়ে, হতাশই হতাম বেশি। কোনো গতি নেই বলে আমরা…! যাকগে, সেসব কথা, না পড়ে পাশ করা গেলেও, ভালো রেজাল্ট করা যায় না। সেটা বুঝেছিলাম। বাংলা পড়া নিয়ে প্রথম ধাক্কা।

অনার্স শেষ করে, বিয়ে হল। এক ছুটে চলে গেলাম জার্মানি, বরের কাছে। গিয়ে কি আর করা, শুরু হল ওদের ভাষা শেখা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রোজ ভোরে উঠে মর্নিং ক্লাসে যাওয়া। চিবিয়ে চিবিয়ে জার্মান আওড়ানো, বিশ্বাস করুন, একটুও ভালো লাগত না। দরকার ছিল বলে শিখতাম। তাই দিয়ে নিজের ভাত জোটাব জীবনেও ভাবিনি। বা শিখে আনন্দও হত না খুব একটা। ক্লাসরুমে ঢুকেই মনে হত, ‘চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে!’ ভর্তি নানান দেশের ছেলেমেয়ে। নানান ভাষা তাদের। গল্পের কমন ভাষা ছিল জার্মান। তাই দিয়ে কতটা গল্প করা যায়, কতই বা দৌড়। ক্লাসমেট হিসেবে আমাদের দেশেরও আমি কাউকে পাইনি। কয়েকদিন পর পেলাম, আমার প্রতিবেশী দেশের একজন। সে পাকিস্তানি। জঙ্গি নয়। যেহেতু হিন্দি, ইংরেজি বলতে পারত, তাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েই আমার ক্লাসরুমকে স্বর্গ মনে হয়েছিল। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যেই তো ভাষা। তাই ভাষাতেই মুক্তি।

গালভরা কথা আমি জার্মান জানি, তাই দিয়ে যতটা বাহবা দেবে ভাবে, সত্যি সত্যি তত বাহবা পাওয়ার মতো না। কেউ প্যাশন থেকে আনন্দ করে শিখলে আলাদা কথা। এই ভাষা শিখতে শিখতে, আর ওখানে থাকতে থাকতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠতাম। মনে হত, নিজের জন্যে, নিজের ভালোলাগার মতো কিচ্ছু করছি না। একদিন ভোরে উঠে কাঁদতে বসলাম, আমি এম এ পড়ব। কলকাতা যাব। আমি একা থাকতে পারব কিনা, আরো নানান বাধা বিপত্তির আশঙ্কা, বরের অনেক বোঝানো সবকিছুকে উপেক্ষা করে, জেদের বশে চলে এসেছিলাম কলকাতা। আবার রবীন্দ্র ভারতী। সেই চেনা ক্যাম্পাস, চেনা ক্লাসরুম, চেনা স্যার-ম্যাডাম। একঘর বন্ধু। সবাই বাঙালি। বাংলায় হইহই, চিৎকার, চেঁচামেচি, জমিয়ে আড্ডা, ক্যান্টিনের বেঞ্চ বাজিয়ে গান, মান – অভিমান। সবটাই কেমন আমার। কোথাও তাল কাটত না, বেসুরো মনে হত না। প্রাণ ভরে আনন্দ পান করা যেত।

বাংলা পড়ার জন্যে একটা হীনমন্যতায় ভুগতাম। অনেকের বাঁকা চোখ, বাঁকা কথা শুনতে শুনতে নিজের মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা বাসা বেঁধেছিল। কি সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছি, কেউ জিজ্ঞেস করলেই, সে শুনে চোখমুখ বেঁকানোর আগেই বলে দিতাম, ‘পাতি বাংলা।’ বাঙালির প্রতি বাঙালির যতটা না ঘৃণা, তার চেয়ে বেশি ঘৃণা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা বা সেই বিষয়ের ছেলেমেয়েদের উপর। আবার কেউ কেউ আছে, ‘ও বাবা! বাংলা পড়েছে, দম আছে বলতে হবে। আমি বাবা বাংলাকে খুব ভয় পাই।’
এখানে দুটো দিক তৈরি হয়ে গেল। বাংলাভাষা মাতৃভাষা হওয়ার জন্যে বাংলায় কথা বলতে সবাই জন্ম থেকেই পটু, কিন্তু বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ার ভয় অনেককেই তাড়া করে। আবার অনেকে হেয়ও করে, ‘’ধুর! বাংলা? ও আবার পড়তে হয় নাকি? ও তো এমনিই পাশ করা যায়।’’ গেলেই ভালো।

চারপাশে বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের দেখে, আমার চেনা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার-ম্যামদের দেখেও মনে প্রশ্ন জাগত, আচ্ছা ওনারাও কি বাংলা পড়ে হীনমন্যতায় ভুগতেন? নাকি একটা ভালো চাকরি বাংলা পড়ার হীনমন্যতা দূর করে দেয়? কে জানে! এটা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি কারোর সঙ্গে। তবে আমার থেকে অনেক জুনিয়রকে বাংলা পড়ার জন্যে হতাশ হতে দেখেছি। অনেকটা যুগের কারণেও। ধুর! বাংলা পড়ে কিছু হয় না। কম্পিটিশন অনেক বেশি। এটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা দিক। এটা নিয়েও বিশাল লেখা হয়ে যাবে।

আর একটা দিক দেখেছি কথায় কথায় অনেকেই ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রদের ‘বাংলা’ নিয়ে হেয় করা। ‘ওদের বাংলা তো, বাব্বা! মা-বাপ নেই। বানান দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। একটা বাক্য লিখতে বলো, দশটা ইংরেজি ঢুকিয়ে দেবে। ওদের ভিত খুব কাঁচা।’ খুব ভুল কথা এটা। আমি বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদের বাংলার হাল যা দেখি, তাতে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রদের গালাগালি প্রাপ্য বলে মনে করি না। আর পুরো দায় স্কুলের উপর না চাপিয়ে বাড়ির দায়ও থাকা উচিত। আমার বাংলাও দারুণ নয়, তাতেও দশটা ইংরেজি শব্দ আছে। বাংলা বা ইংরেজি দুটো ভাষাই কে কতটা শিখবে, কতটা নিতে পারে সেটা মনে হয় সেই ছাত্রছাত্রীদের মেধার উপরই নির্ভর করে। বাংলা মিডিয়ামের অনেক ছাত্র যেমন ভালো ইংরেজি জানে, ইংরেজি মিডিয়ামের অনেক ছাত্রছাত্রীও ভালো বাংলা জানে। ভালো, মিডিওকার, খারাপ এগুলো তো মাপকাঠি। কে কতটা শিখতে চায়, তার ব্যক্তিগত ইন্টারেস্টটা বোধ হয় বেশি কাজ করে। কাজের জন্যে আমার মনে হয় ইশ! ইংরেজিটা দারুণ ভালো জানা থাকলে খুব ভালো হত, আবার এক দিদিকে বলতে শুনেছি, ইংরেজিটা তো ছোটো থেকে চর্চা করেছি, তাই ওতে যতটা ভালো লিখি, বাংলায় তত ভালো লিখি না। তাই এখন বাংলাটার চর্চা করছি। সবটাই নিজস্ব ভালোলাগা, দরকার জড়িয়েই মানুষ ভাবনা চিন্তা করে। ইংরেজি শিখতে গিয়ে মাতৃভাষাকে হেয় করা যেমন উচিত নয়, আবার শুধুই মাতৃভাষার প্রতি গোঁড়ামি করাটাও চলে না। দরকারে অন্য ভাষা শিখে নেওয়াই উচিত। আর অন্য ভাষা শিখলে যে নিজের ভাষা ভুলে যাবে তাও তো নয়।

জার্মানির পরে ব্যাঙ্গালোরে থাকার সময় যেমন, দরকার হল ইংরেজি। ওখানে হিন্দি কম বলত, ইংরেজি বেশি। তাই সেভাবেই অভ্যেস করে নিতে হয়েছিল। কিছু মনেও হয়নি, বহু ভাষা শিখলে বরং জানার পরিধি বাড়ার জায়গা থাকে একটা।

কিন্তু কলকাতার চল, বেশিরভাগই নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলা। বিশেষ করে হাইরাইজ কমপ্লেক্সে থাকা মানুষগুলো। আমি নিজেও কলকাতার এমন কয়েকটা জায়গায় থেকেছি, থাকি। প্রথম প্রথম সবার সঙ্গে বাংলায় আলাপ করতে কেমন ভয় পেতাম। পুজোর মণ্ডপে দেখতাম, মহিলারা বসে আড্ডা দিচ্ছেন ইংরেজি ভাষায়। তাঁরা বাংলা জানেন না এমনটা কিন্তু নয়, ইংরেজিটা জানেন সেটা বোঝানো মনে হয় বেশি দরকার হত। কমপ্লেক্সের মিটিং এ কয়েকবার গিয়ে দেখেছি, চা দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করত, হ্যাভ সাম টি? এতে আন্তরিকতা বেশি দেখানোর দরকার নেই বলেই হয়তো…! যাকগে ভাষায় মুক্তি পেতাম না। সন্ধেবেলায় হাঁটতে নেমে, বেঞ্চে বসে চেনা মানুষদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেই ভালোবাসি। শুধু বাংলায় কথা বললে, লোকে আনস্মার্ট, অশিক্ষিত, গেঁয়ো এসব ভাবতেই পারে।
তবুও–
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে ॥

কোনো বিদেশি বা অবাঙালি না হলে, আমি তাদের সঙ্গে, কি গো! কেমন আছো? ভালো? সব খবর ঠিকঠাক তো? এভাবেই কুশলাদি জানতে ভালোবাসি।
শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়। বাকি ৩৬৪ দিনও থাকুক বাংলা ভাষার চর্চা। তাহলে হয়তো আর পরীক্ষার খাতায় রচনা হিসেবে দেখতে হবে না, ‘’বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মতামত কি? নিজের ভাষায় বুঝিয়ে লিখুন।”

পরবর্তীকালে চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলা যাক।
সন্তোষপুর মোড় থেকে আমার কলেজ প্রায় এক কিলোমিটার। সেটুকু রাস্তা অটো বা রিক্সায় যেতে হয়।

একদিন হঠাৎ অটোতে উঠে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। “Where will you get down madam?”
আমি বাংলায় বললাম, “কলেজে নামব।”
“OK, I thought so.”
আমি হেসেছিলাম। নামার সময় যখন ভাড়া দিতে গিয়েছিলাম, তখন অটোওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “Don’t you have change?”
আমি বলেছিলাম, “না।”
অটোওয়ালা বলেছি্লেন, “It’s OK, nobody seems to have change. I’ll give you change. ”

অবাক হবার কিছু নেই। আমার অন্য কলিগরাও ওনার অটোতে উঠেছে। আমাদের দেখলেই তিনি ইংরজি বলতেন।

আরো একদিনের ঘটনা। একদিন কলেজ যাওয়ার সময় সন্তোষপুর মোড়ে গিয়েই শুনলাম অটোস্ট্রাইক, একটা অটোও যাবে না। কোনো রিক্সাও যেতে চাইল না, বা সুযোগ বুঝে ভাড়া তিনগুণ চাইতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে শুনতে পেলাম, “ম্যাডাম যাবেন? দশ টাকা দিতে হবে কিন্তু।” পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এক রিক্সাওলা আমাকে কথাটা বলছে্ন। অলরেডি তাঁর রিক্সায় এক মহিলা বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন। শেয়ারে যেতে হবে তিনি দশ আমি দশ। পনেরো টাকা ভাড়া হয় দুজনে, রিক্সাওলার কুড়ি হল, তিনিও খুশি আমিও খুশি। তবে সেই মহিলা খুশি ছিলেন কিনা জানিনা, তাঁর মুখটা ব্যাজারই ছিল। আমি রিক্সায় চড়ে বসলাম।

কিছুটা যাওয়ার পরেই ওই মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি স্কুলে পড়ান?”
বললাম, “না, কলেজে।”
“ইংলিশ মিডিয়াম?”
বললাম, “না, বাংলা।”
উনি আবার বললেন, “এখানে ইংলিশ নেই?”
হ্যাঁ আছে, ইংরেজি নিয়ে পড়লে তো ইংরেজিতেই পড়তে হবে। অন্যান্য সাবজেক্ট বাংলায় চাইলে বাংলায়, ইংরেজি চাইলে ইংরেজিতেই পড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাটা ইংরেজিতে পড়ানো হয় না।
মহিলা শুনে একটা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে “ওহ!” বলে চুপ করে গেলেন।

আমার কৌতূহল হল। জানতে চাইলাম – “কেনো ইংলিশ মিডিয়াম দিয়ে কি হবে?”
সঙ্গে সঙ্গে উনি ওনার ওই তিন চার বছরের মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।”
“কোন স্কুল?”
বললেন, “ওই যে সামনেই সেন্ট ম্যাথুজ।”
তাঁর উচ্চারণ অনুযায়ী ওটাই বুঝেছিলাম। পরে ওই স্কুলের একটা ব্যানার আমার কলেজের উল্টোদিকে দেখেছি। আমি ওহ বলে চুপ করে রইলাম, স্কুলটা আমার আজও অজানা। একটু পরেই তিনি নেমে গেলেন। তারপর আমি একা তাঁর কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কলেজে পৌঁছে গেলাম। ভাবলাম — ওহ কলেজটা ইংলিশ মিডিয়াম হওয়া উচিত ছিল।

তিনি বা তাঁর মতো অনেকেই বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম বা হিন্দি মিডিয়াম যেখানেই পড়ান না কেন, সেটায় আমার কিছু এসে যায় না। আমার কোনো বক্তব্য নেই, থাকা উচিতও নয়। কিন্তু কলকাতায় থেকে বাংলা ভাষার ওরফে মাতৃভাষার প্রতি সবার এত নাকউঁচু ভাব দেখে আর চারদিকে ইংরেজি শুনে শুনে নিজের একটু হতাশ লাগে। ভাবি, ছোটোবেলাটা বুঝি ইংলিশ মিডিয়ামেই কাটানো উচিত ছিল, বা যতটুকু ইংরেজি শিখেছি সেটা বুঝি কলকাতার জন্য যথেষ্ট নয়। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে একবার মনে হল, এই ভাষার সঙ্গে পরিবেশের তাল রাখতেই বুঝি “দিদি” কলকাতাকে লণ্ডন বানাতে চাইছিলেন। কিন্তু সফল হননি দেখে একটা সোজা পথ বের করলেন। শেষে বাংলায় বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করে দিলেন।
এই প্রসঙ্গে আমার আরও একটা ঘটনা মনে পড়ল। আজ থেকে বছর পাঁচ আগের কথা। তখন অন্য একটা বাড়িতে। একদিন আমি দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। কমপ্লেক্সের নিচে অনেক বাচ্চা খেলছিল। তাদের মধ্যে দুজন দৌড়ে এসে আমার সঙ্গে লিফটে উঠল। তারা দুই ভাই। মুখ চিনতাম। একজন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স, অন্যজন থ্রি বা ফোর — ঠিক মনে নেই। লিফটে তারা তাদের ফ্ল্যাল্টে যাওয়ার বোতামটা টিপেই আমাকে বলল, “আন্টি তোমারটা কত?”
বললাম, “এগারো।”
সঙ্গে সঙ্গে দুই ভায়েই অবাক হয়ে চোখ মুখ বেশ কুঁচকে বলল, “মানে? এগারো মানে?!”
বললাম, “ওহ তোমরা বাংলা জানোনা? ইলেভেন।”
দুই ভায়েই বেশ খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে শুরু করল, “না আমরা বাংলা জানিনা। আমাদের স্কুলে হিন্দি আর ইংলিশটা শেখায় ওটা আমরা ভালো জানি। লিখতে পড়তেও পারি।”
বললাম বাড়িতে মা বাংলা শেখায় না?
বলল, “শেখাত আমাদের ভাল্লাগেনা।”
বললাম, “বাংলায় কথা তো দিব্যি বলছ।”
বলল, “হ্যাঁ কথা বলতে পারি কিন্তু লিখতে পড়তে ভাল্লাগেনা।” বলে তারা আমার আগে লিফট থেকে নেমে গেল।
আমি হালকা করে বলার চেষ্টা করেছিলাম, “বাংলাটা শিখে নিও!”

ভাষা একটা মাধ্যম। যেটা মনের ভাব প্রকাশ করতে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে এমনকি চিন্তা করতে সাহায্য করে। একটা বাচ্চা, যে বাংলায় কথা বলে, ইংরাজি আর হিন্দিতেও তুখড় সে কি করে “এগারো” কথাটায় থমকে যায়? তাহলে সে চিন্তাটা কোন ভাষায় করে? অনেক ভাষা জানা মানে তো গর্বের কথা। তাহলে এই ছেলেটির গর্ব কাকে নিয়ে? জানি না। অনেক প্রশ্ন মাথায় কামড়ায়, উত্তর পাই না। হয়তো সে একদিন এগারো কথাটা শিখে যাবে, আমারো হতাশা দূর হবে।

অনেকেই ভাবতে পারেন, নিজের ছেলেকে তো বাবা ইংলিশ মিডিয়ামেই দিয়েছ, তাতে আবার বড়ো বড়ো কথা কীসের! একদম সত্যি কথা ইংলিশ মিডিয়ামের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তাই বলে ছেলে বাংলা শিখবে না এটা হতে পারে না। আমি নিজে বাঙালি, বাংলা ভাষাতেই লিখে, পড়ে, গল্প করে, হেসে, কেঁদে আনন্দ পাই। আমার সাবজেক্টও বাংলা। তাই ছেলে যাতে বাংলা শেখে তার প্রচেষ্টা আমি বাড়িতেই করি। সে মাঝে মাঝে ডায়রি লেখে। অধিকাংশ সময়ে তাতে স্কুলের কোনো একটা ঘটনা দু-লাইনে থাকে। বাংলা বানানেও ভুল ধরিয়ে দিতে হয়। বাক্য গঠনও শেখানো হয়। ইংরেজি গল্পের বই পড়ার মধ্যে যে উৎসাহ বাংলা গল্পের বই পড়ায় অত উৎসাহ না থাকলেও ভাংলায় ভীতি নেই। বা বাংলা জানি না বলে কোনো গর্ব করতেও দেখি না। ছেলের বন্ধু আমার ছাত্র সোহম বলেছে, “ছোটো থেকে ইংরেজি আর হিন্দি শেখায় লড়াই চলেছে এতদিন এবার ভালোভাবে বাংলা শেখার লড়াই চলবে”। শুনে খুশি হয়েছি।

একটা সময় ছিল যখন বাংলা মিডিয়ামে ইংরেজি শেখানো হত দেরিতে, ক্লাস ফাইভ বা সিক্স থেকে। ততদিনে হয়তো একটু মিডিওকার বা ক্লাসের কম বুদ্ধির ছেলেদের মধ্যে ইংরেজি ভীতিটা তৈরি হয়ে গেছে। এ খুব কঠিন ভাষা, বিদেশি ভাষা। একটা টিউশন নিয়ে ‘জাস্ট’ কোনোরকমে পাশ করলেই চলবে। তাদের মধ্যে কেউ ভালো করলে ইংরেজি অনার্স অবধি পড়ত। এখনো পড়ে। কিন্তু একটা সময় এল যখন এরাই মা বা বাবা হল। তখন তাদের মনে হল, ছেলেমেয়েরা যেন তাদের মতো না হয়। ইংরেজিটা জানতেই হবে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে অন্তত ইংরেজিতে কথাটা তো বলতে পারবে। রাস্তাঘাটে চলতে আসুবিধা হবে না, চাকরি পেতে সত্যিই সুবিধে হবে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হোক। কিন্তু এটা কেবল একটা তারিখ হিসেবে উদযাপনের দিন নয়। প্রতিদিনই তার চর্চা চলুক। প্রত্যেক মাতৃভাষাই সম্মান পাক। একে অপরের ভাষার প্রতি কটাক্ষ নয়, সম্মান জানানোই হোক মূল লক্ষ্য। প্রত্যেকের মুক্তি ঘটুক যার-যার নিজের মাতৃভাষায়।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes