
বিনোদ কুমার শুক্লার কবিতাগুচ্ছ
অনুবাদে কুন্তল মুখোপাধ্যায়
বিনোদ কুমার শুক্লা-র জন্ম ১৯৩৭ সালের ফার্স্ট জানুয়ারি রাজনন্দগাঁও , ছত্তিশগড়-এ । বিনোদ কুমার শুক্লা একজন করণিকের জীবন থেকে হয়েছিলেন একজন গ্রামের স্কুল মাস্টারমশাই । তাঁর বর্তমান বয়স ছিয়াশি । ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে তাঁদের তৈরি করতে করতে অদৃশ্য নাগরিকদের দেখত দেখতে তাঁর গল্প ধরে রাখতে পেরেছে ভারতবর্ষের পালটে যাওয়া সময় । জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ছত্তিসগড়ের রায়পুর-এ । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লগভগ জয় হিন্দ’ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় । ১৯৭৯ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘নৌকর কি কামিজ’ চলচ্চিত্রায়িত হয় । সেখানে শুধু নাগরিক জীবনের উন্মাদ অংশ নয়, ছোট ছোট শহর আর সেই জীবনের ধীর পঙক্তি, তার লড়াই আর তার স্বপ্ন বিবৃত করে । জাতীয় সাহিত্যে এইসব অবদানের জন্য যথার্থভাবেই ২০২৩ সালে পেন পুরস্কার পেয়েছেন বিনোদ কুমার শুক্লা। শুক্লার লেখার বৈশিষ্টগুলির অন্যতম হল তাঁর ভাষানৈপুণ্য , চিরকালীন আর উত্তীর্ণ এবং স্বপ্ন আর কল্পনার মধ্যে আশ্চর্যরকম চলাফেরা করার স্বাচ্ছন্দ। তাঁকে কবি, প্রাবন্ধিক আর ঔপন্যাসিক বলা হয় । যেভাবে তাঁর লেখায় কল্পনার সম্ভাবনা থাকে, তাতে হোজে সারামাগো আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজমধর্মী লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার তুলনা করা যায় । কিন্তু কোনও একটা নির্দিষ্ট জনরায় তাঁকে রাখা খুব মুশকিল । গদ্যধর্মী কবিতা , এত চিন্তাপ্রধান উপন্যাস যে তাকে প্রবন্ধও বলা যেতে পারে , শুক্লার লেখা আসলে যেন জীবনেরই ভাটা আর প্রবাহ ---- একই সঙ্গে আশ্রয়ধর্মী অথচ স্বাদলোভি।
মেয়েটির ইচ্ছে
মেয়েটির ইচ্ছে-
নদী অনেক বড়ো হয়
নদীর এক বিন্দু জল
বিন্দুভরা নদী
বিন্দুভরা গভীর
বিন্দুভরা বহতা
কিন্তু মেয়েটি বলে
সায়রও অনেক বড়ো হয়
সায়রের এক বিন্দু জল
বিন্দুভরা সায়র
বিন্দুভরা গভীর হয়ে যায়
বিন্দুভরা স্থির হয়ে যায়
মেয়েটির ইচ্ছে খুব ছোট
কতটা ছোট
তা মেয়েটি জানে না
আমার আটআনা
আমার একটা আট আনা
হারিয়ে গেছে
আমি তাকে খুঁজে বেরাই
আর মিলে যায়
চাঁদির একটা টাকা ।
ওই টাকাটা আমার ছিল না
কিন্তু ওই টাকায়
আমার মাথার
চিহ্ন আছে
(তাহলে ওই আট আনায়
নিশ্চয়ই আমার কবন্ধ থাকবে)
আর এই জন্যে
খুবই পরিশ্রমে
আমি খুঁজে বেরাচ্ছি
আমার হারিয়ে যাওয়া আট আনা ।
কিন্তু হায় ! কে জানত
আমার অপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
নিরান্নব্বইয়ের খোঁজে চলে যাবে ।
উদরে রয়েছে বুদ্ধি
আমার পেটে আমার বুদ্ধি
আমার পেটে
আমি একাই গর্ভস্থ হয়ে আছি ।
নিজের পেটে
নিজেরই এঁটো খেয়ে
বেড়ে উঠছি
আমি
আমি
পেন্সিলের মাথা চিবিয়ে
সারাপেট ভাবি ।
আমার পেটে
আমার বুদ্ধি
বাগানের মতো ঝলমলে ।
আমিই মানুষ
আমিই মানুষ
এই একান্নবর্তী ঘাটে
আমি এখানে মানবতার
আদিম অনুভূতির
শ্বাস নিই ।
খুঁজে খুঁজে পাথর ওঠাই
প্রস্তরযুগের পাথর ওঠাই
কলস্বিনী নদীর ঠাণ্ডা জল
অঞ্জলি ভরে পান ক’রে
জলের প্রাচীন স্বাদ পাই ।
আমি নদীতীরে চলতে-চলতে
ইতিহাস স্মরণ করে
ভূগোলের পাকদণ্ডী পাই ।
সংখ্যার একক অঙ্ক
কেবল দেখি ।
চারিদিকে প্রকৃতি আর প্রকৃতির ধ্বনিময়তা
আমি যদি কিছু বলি, তো
নিজের ভাষায় নয়
মানুষের ধ্বনিতেই বলব ।
যে আমার ঘরে কখনও আসবে না
যে আমার ঘরে কখনও আসবে না
আমি দেখা করতে
ওদের কাছে চলে যাব
উত্তাল নদীটি কখনও আসবে না আমার ঘরে
নদীর মতো মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে
নদীতীরে যাব আমি
কিছুটা সাঁতার আর কিছুটা ডুবে যাওয়া থাকবে আমার
পাহাড় টিলা শিলা সায়র
অসংখ্য বৃক্ষ মাঠ
কখনও আমার ঘরে আসবে না
মাঠ আর শস্যের মতো মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে
গ্রাম থেকে গ্রামে , জঙ্গল থেকে জঙ্গলে যাব
যে নিরন্তর কাজে আমি লগ্ন
তা থেকে অবসরে নয়
সেখানে সত্যিই জরুরী কাজের মতো
দেখা করে যাব
শেষ ইচ্ছাগুলোর মধ্যে
একেবারে প্রথম ইচ্ছা এই
ধোলগিরি দেখার পর
ধোলগিরি দেখে
আমার মনে হল
ধোলগিরির ছবি
কারণ প্রথমে আমি ছবিই দেখেছিলাম
পিতামহ পূর্বজদেরও ছবি আছে ঘরে
পূর্বপুরুষদের আমি কখনও দেখিনি
আমি পূর্বজদের না, ওঁদের ছবি মনে রাখি
কিন্তু ধোলগিরি দেখার পর
আমি আমার পূর্বজদের ছবি নয়
পূর্বপুরুষদের মনে রাখি
আমি এক আনা মানুষ
আমি এক আনা মানুষ
সবচে উঁচু পাহাড় নিয়ে চিন্তিত
এমন ভাবনা থেকে চিরদিন বাইরে বাইরেই থেকেছি
এক দিন এই বাইরেটির কড়া নাড়লো কেউ
যেমন আকাশ পৃথিবীর কড়া নাড়ে
হাওয়ার কড়া নাড়ে
জঙ্গলের বৃক্ষ
এক এক পঙক্তির কড়া নাড়ে
দেখো তো আকাশের নীচে
খোলা রয়েছে
কেউ সঙ্গে নেই
কেউ দূর পর্যন্তও নেই
তবু এই উন্মুক্ততাকে কড়া নাড়ে কেউ
কেউ কি আসতে চায় ?
আমি বলি
ভিতর অথবা বাহির
সমস্তই উন্মুক্ত
আমি দেখেছি আমার
হিমালয় দেখা হয়
বিছানা ভুলে গেছি
বিছানা ভুলে গেছি
ওতে দাড়ি কাটার যন্ত্রপাতি ছিল
বিছানা ভুলে গিয়ে নিজেরই ঘরে
সারারাত টইটই করতে করতে
নিজেকে যাযাবর লাগছিল
সঙ্গে চারজন শশ্রুময় বন্ধুও ছিল
নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল ।
পায়চারীকরদের পায়ের মাপে
বিশ পা ঘরের মধ্যে —- বিশ পা সড়ক
ওই কামরার ভিতরেই । তিন পা দূর তক্তা,
মাথার উপরে পাঁচতলায় ব্যাংক, যেখানে আমি
কাজ করতাম
তক্তার নীচে খুচরো পয়সা রাখার অভ্যাস এই
কারণেই
দাড়ি কাটানো আমার চাকরির মধ্যেই ছিল।
হাতে একটা ব্লেড নিয়ে
গম্ভীরভাবে বললাম
আঁধার ছোট ছোট চুলের মতো উঠছিল
সংগীরা একযোগে বলল:
বিছানা ভুলে গেছি
ওতে দাড়ি কাটার যন্ত্রপাতি ছিল ।
আমার ঘরের মুখোশ পরে আঁধার এসেছিল
ঘরের মতো আঁধার
চারজন কাছের বন্ধুর মতো আঁধার
দেয়ালে টাঙানো রাষ্ট্রপতি
প্রধানমন্ত্রী, বাবা-মা,
ভাই বোনের মতো অন্ধকার ।
আমার ঘরের মুখোশ পরে এসেছিল দিন
সারা শহর ঘুরেছিল
গভীর গর্তের মতো ঘরে
দরোজা বন্ধ ছিল টানটান
যখন আমার স্বাধীন দেশ
এক পাখি যে খাঁচাসহ গাছের
উপরে উড়ে বসেছিল
( যেমন আমিও ঘর নিয়ে ঘুরছিলাম)
পিপুল গাছের উপরে বসে ।
খেজুর গাছের উপরে বসে ।
হুজুরের পেটের উপরে বসে ।
রোয়াব যে দেখায় সে দাড়ি কেটেই দেখায়
আমি দাড়ি কেটেই চাকরি করতাম।
নাগরিকত্বের উঁচু ময়দান
এক সপাট সমতল সিঁড়ি ছিল
চলন্ত সিঁড়ি
এইভাবে পায়চারী করতে করতে হাতে
একটি নতুন ব্লেড নিয়ে খুব গম্ভীরভাবে
বলেছিলাম
আঁধার হয়ত নকল মোচ দাড়ি লাগিয়ে
এসেছিল
দেশের সুরক্ষার জন্য চারজন বন্ধু আর আমি
পাঁচটি নতুন ব্লেড অস্ত্রে সমর্পিত অথবা আত্মসমর্পিত হয়েছিলাম
বিল্পব আমরা আনতে পারিনি
অথচ ঘরের মধ্যেও কেউ ষড়যন্ত্র করেনি !!