
বিউটি ও বিস্ট
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং
অনুসৃজনে রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
বাবাকে তার উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে অনুমতি পেল বিউটি। তার চরিত্রের বাইরে গিয়ে অন্য রকম ব্যবহার করল সে। বিশেষত যখন সে বাড়ি ফেরার সময় বিস্টের কাছ থেকে এক ট্রাঙ্ক সোনা চেয়ে নিল। বিউটির বাবার মন্তব্য থেকে বোঝা যায় বিস্ট একই সঙ্গে নিষ্ঠুর ও দয়ালু।
আমাদের সমাজে নারীদের পুরুষতান্ত্রিক নায়কোচিত মিথ পরিবেশন করা হয় যাতে তারাও পুরুষদের মত একটি বিশ্বাসযোগ্য অহং পরিচয় তৈরি করতে পারে এবং শিক্ষা অর্জন করতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের একটি পুরনো স্তর আছে যা নারীদের অনুভূতির মধ্যে উঠে আসে এবং মেয়েদের নারী করে রাখতে চায়, পুরুষের অনুকৃতি নয়। যখন মনস্তত্ত্বের এই প্রাচীন দিকটি তাদের মনে আসে আধুনিক নারীরা তাকে দমিয়ে ফেলে। কারণ এই ভাবনা তাদের বন্ধুত্বের মুক্ত সমানাধিকার, পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্য চোখ রাঙায়। অর্থাৎ এই ভাবনা তাকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ থেকে বিরত করতে পারে।
এই প্রাচীন ভাবনার দমন সার্থক হয়ে উঠতে পারে ততক্ষণ যতক্ষণ নারী বজায় রাখবে তার পরিচয় পুরুষতান্ত্রিক বৌদ্ধিক লক্ষ্যে যা সে স্কুলে কলেজে শিখেছে। এমনকি যখন সে বিবাহিত তখনও নারী স্বাধীনতার কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা সংরক্ষণ করে, এছাড়াও তার প্রতীয়মান আচরণ বিবাহের আদিরূপ থেকে উঠে আসে না – মা হওয়ার প্রতি যার অন্তর্নিহিত নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর ফলে যা আমরা প্রায়ই দেখি আজকের দিনে ঘটতে পারে অন্তর – বিরোধ শেষ পর্যন্ত যা নারীকে পুনরায় আবিষ্কার করতে বাধ্য করে খুবই যন্ত্রণাদায়ক পন্থার মধ্য দিয়ে তার কবর দেওয়া নারীত্ব।
আমি এর একটি উদাহরণ দেখেছি; একজন যুবতী বিবাহিত নারী যার এখনো পর্যন্ত কোন সন্তান হয়নি। কিন্তু তার অভিপ্রেত একটি বা দুটি সন্তান কারণ এটা তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার যৌন প্রতিক্রিয়া ছিল অসন্তোষজনক; এটা তাকে ও তার স্বামীকে চিন্তায় ফেলে ছিল। যদিও তারা এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে অপারগ ছিল। মেয়েটি সাম্মানিক স্নাতক পাস করেছে একটি ভালো মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে এবং বৌদ্ধিক সাহচর্য উপভোগ করছিলো তার স্বামী ও অন্য পুরুষদের সঙ্গে। যখন তার জীবনের এই দিকটি বেশিরভাগ সময় ভালই চলছিল তখন সে অনিয়মিত মেজাজ হারাত, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কথা বলতো যা পুরুষদের তার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল এবং তাকে অপরিতৃপ্তির একটি অসহনীয় অনুভূতি দিচ্ছিল।
সে এই সময় একটি স্বপ্ন দেখেছিল যা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল; সেটি বোঝার জন্য সে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিল। সে স্বপ্ন দেখেছিল যে সে তার মত যুবতী নারীদের একটি লাইন দাঁড়িয়ে আছে এবং লাইনটির শেষ মাথায় যে নারী পৌঁছচ্ছে তার মাথা গিলোটিনে কেটে ফেলা হচ্ছে। কোন ভয় না পেয়ে মেয়েটি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে। এবং সম্ভবত সে খানিকটা ইচ্ছুক যে তার সময় যখন আসবে সে নিজেকে অন্যদের মতো গিলোটিনে দেবে।
আমি তার কাছে ব্যাখ্যা করলাম এর অর্থ হল সে তার মাথা দিয়ে বেঁচে থাকার অভ্যাস থেকে সরে আসার জন্য প্রস্তুত। সে তার দেহ স্বাধীন করতে চাইছে কারণ সে দেহে স্বতঃস্ফূর্ত যৌন প্রক্রিয়াকে আবিষ্কার করতে চাইছে। এবং মাতৃত্বের জন্য তার জৈবিক পরিপূর্ণতা চাইছে। এই স্বপ্ন প্রকাশ করছে যে মেয়েটি এই প্রচন্ড পরিবর্তনটি চাইছে; সে পুরুষতান্ত্রিক নায়কোচিত ভূমিকা ত্যাগ করতে চাইছে।
কেউ হয়তো আশা করতে পারে এই শিক্ষিত নারীটির কাছে কঠিন মনে হবেনা বৌদ্ধিক স্তরে এই ব্যাখ্যাটিকে গ্রহণ করা, এবং সে নির্ধারিত করে নিজেকে আরও বেশি আজ্ঞাবহ নারীতে রূপান্তরিত করবে। সে তখন তার প্রেম জীবনকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেছিল এবং তারপর দুটি সন্তোষজনক সন্তানের মা হয়েছিল। যত সে নিজেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছিল সে দেখছিল একজন পুরুষের জন্য বা পুরুষতান্ত্রিক নারীজীবন খানিকটা ঝড়ের মত, নায়কদের কাজের মত। কিন্তু একজন নারীর সঠিক উপলব্ধি হলো জীবন নিয়ত জাগরণের একটি প্রক্রিয়া।
একটি বিশ্বজনীন মিথ প্রকাশ করে এই ধরনের জাগরনের কথা। এটি পাওয়া যায় একটি রূপকথার গল্পে। সবথেকে ভালো যে সংস্করণ পাওয়া যায় এই গল্পের তাতে বলা হয় কেমন করে বিউটি যে সব থেকে ছোট চার বোনের মধ্যে তার বাবার প্রিয় হয়ে উঠল তার স্বার্থপরতাহীন ভালোত্বের জন্য। দামী দামী উপহারের বদলে যখন সে তার বাবার কাছে একটি মাত্র সাদা গোলাপ চেয়ে নিল তখন সে তার অন্তরের আন্তরিক অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন ছিল। সে জানতো না সে তার বাবার জীবন এবং বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক কে বিপন্ন করছে। বিউটির বাবা বিস্টের মায়ামায় বাগান থেকে একটি সাদা গোলাপ চুরি করেছিল। বিস্ট চোরের ওপর অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছিল এবং তাকে তিন মাসের জন্য শাস্তি ভোগ করতে ফিরে আসতে বলেছিল; নইলে তার মৃত্যু ঘটবে।
বাবাকে তার উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে অনুমতি পেল বিউটি। তার চরিত্রের বাইরে গিয়ে অন্য রকম ব্যবহার করল সে। বিশেষত যখন সে বাড়ি ফেরার সময় বিস্টের কাছ থেকে এক ট্রাঙ্ক সোনা চেয়ে নিল। বিউটির বাবার মন্তব্য থেকে বোঝা যায় বিস্ট একই সঙ্গে নিষ্ঠুর ও দয়ালু।
বিউটি জেদ করে সে তার বাবার শাস্তি ভোগ করতে চায় এবং তিন মাস পর এই মায়াময় দুর্গ থেকে বাড়ি ফিরতে চায়। সেখানে সে একটি সুন্দর ঘর পেল এবং কোন কিছু নিয়ে তার ভাবনা চিন্তা করার কোনো কারণ থাকল না। শুধু বিস্ট যখন মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসত তখন সে ভয় পেত। বিস্ট তাকে বারবার একটাই কথা জিজ্ঞাসা করত যে সে কোনদিন বিস্টকে বিয়ে করতে পারবে কিনা। বিউটি সবসময় তাকে প্রত্যাখ্যান করত। তারপর একটি জাদু আয়নায় বিউটি তার বাবাকে অসুস্থ দেখে এক সপ্তাহের জন্য তার সেবা করার জন্য বাড়ি যেতে চায়। বিস্ট বলে বিউটি যদি তাকে মরুভূমির মতো শূন্য করে চলে যায় তবে সে মরে যাবে। তবুও সে এক সপ্তার জন্য বাড়ি যেতে পারে।
বাড়িতে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি তার বাবাকে আনন্দ দিয়েছিলো; কিন্তু তার বোনেদের তার প্রতি হিংসা ছিল। তাই তারা বিউটিকে নির্দিষ্ট দিনে ফিরে যাবার থেকে কিভাবে দেরী করিয়ে দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা করলো। দেরি হয়ে যাওয়াতে বিউটি স্বপ্ন দেখল যে বিস্ট হতাশায় মরে যেতে বসেছে। বিউটি বুঝতে পারল সে দেরি করে ফেলেছে। তাই সে বিস্টকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ফিরে গেল। বিস্টের কদর্যতা ভুলে বিউটি তাকে সাহায্য করল। বিস্ট তাকে বলে সে বিউটি কে ছাড়া বাঁচবেনা। বিউটি ফিরে এসেছে এবার সে আনন্দে মরতে পারবে। কিন্তু বিউটি উপলব্ধি করে সেও বিস্টকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কারণ বিউটি বিস্টকে ভালবেসে ফেলেছে। বিউটি তাকে এটা বলে এবং প্রতিজ্ঞা করে যদি বিস্ট না মরে তবে বিউটি তার স্ত্রী হতে রাজি।
ঠিক সেই মুহূর্তে দুর্গটি আলোয় আলোকময় হয়ে উঠল , চারিদিকে সুর বাজতে শুরু করলো এবং বিস্টকে আর দেখা গেল না। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একজন সুপুরুষ রাজকুমার। রাজকুমার বিউটিকে বলে সে এক ডাইনির মায়াজালে বদ্ধ ছিল। এই জাদুমন্ত্র ততক্ষণ অব্দি ছিল যতক্ষণ না একজন সুন্দরী মেয়ে তাকে তার ভালোত্বের জন্য ভালবেসে না ফেলবে।
এই গল্পে আমরা যদি সংকেতগুলিকে স্পষ্ট করতে চাই তাহলে দেখব বিউটি হলো যেকোনো যুবতী মেয়ে বা নারী যে তার বাবার সঙ্গে আবেগপূর্ণ ভাবে জড়িত এবং তার আধ্যাত্বিক প্রকৃতির জন্যই সে যোগাযোগ কম হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার মঙ্গলময় ভাব সংকেতায়িত হয় সাদা গোলাপ চাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু শুধু মঙ্গলময়তাই নয়, তার অবচেতনে তার বাবাকে এবং তারপর নিজেকে সে নীতিগত শক্তিতে স্থাপিত করেছে এবং সেখানে শুধু একটি মঙ্গলময়তাই নেই, নিষ্ঠুরতা ও দয়ার মিশেল রয়েছে। সে তার নিষ্পাপ ও অবাস্তব মনোভাব দিয়ে নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে চায়।
বিস্টের কাছ থেকে ভালোবাসা শিখে বিউটির মধ্যে জেগে ওঠে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, যা এতদিন গোপন’ ছিল তার পশুদের প্রতি ভালোবাসায়। অতএব সে ভালোবাসা ছিল অপূর্ণ। সম্ভবত এটা প্রতিনিধিত্ব করে একটি জাগরণের যা তার অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার শক্তি বৃদ্ধি করে, তাকে সক্ষম করে প্রেমমূলক মৌলকে গ্রহণ করতে। এটাই তার ইচ্ছে ছিল যা সে দমন করেছিল অজাচারের ভয়ে। তার বাবাকে ছেড়ে দিয়ে সে নিজে এই অজাচারের ভয় কে গ্রহণ করেছিল যতক্ষণ না সে চিনতে পারছিল সেই পশুমানবকে এবং যতক্ষণ না সে আবিষ্কার করতে পারছিল তার প্রতিক্রিয়া নারী হিসেবে।
এই ভাবে সে নিজেকে মুক্ত করেছিল এবং তার পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা থেকে, দমন থেকে। এই ভাবনাকে সে নিয়ে এসেছিল তার সচেতন মনে এবং তার ক্ষমতা বুঝেছিল ভালোবাসার বিশ্বাস এর ক্ষেত্রে যা আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক অক্ষরের সেরা জ্ঞান।
আমার একটি মুক্তিকাঙ্ক্ষী মহিলা রোগীর এটা প্রয়োজন ছিল অজাচারের ভয় থেকে সরে যাওয়ার জন্য, খুবই বাস্তবোচিত ভয় ছিল তার চিন্তায়। কারণ তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা তার খুবই কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। সেই স্বপ্নে সে দেখতো তাকে একটি ষাঁড় তারা করেছে, সে পালাতে শুরু করে কিন্তু বোঝে এভাবে সে ষাঁড়টির হাত থেকে মুক্তি পাবে না। সে পড়ে যায় এবং ষাঁড়টি তার ওপর উঠে আসে। সে জানতো তার একমাত্র আশা সে যদি ওই ষাঁড়টিকে গান গেয়ে ভোলাতে পারে। যখন সে কাঁপা কাঁপা গলায় গান গাইল ষাঁড়টি শান্ত হয়ে গেল এবং মেয়েটির হাত চাটতে শুরু করল। স্বপ্নের বিশ্লেষক দেখালেন যে এবার সে একজন পুরুষের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশতে পারবে- শুধু শারীরিক ভাবেই নয় বৃহৎ অর্থে প্রেমমূলক ভাবে তার সচেতন মনের পরিচায়ক হিসেবে।
কিন্তু সেই আগের নারীটির ক্ষেত্রে পশুত্বের মিথ সম্ভবত ইঙ্গিত করে না যে তার বাবার সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কের কথা অথবা শারীরিক সম্পর্কের পথে বাধা যা আমরা বিউটি এন্ড বিস্ট মিথে পেয়ে থাকি। এটা হয়তো নারীর দীক্ষামূলক অভিব্যক্তি যা সূচিত করে তার ঋতুজরা অথবা তার বয়সন্ধি। এটা যে কোনো বয়সে হতে পারে, যখন আত্মা ও প্রকৃতির মিলন উপদ্রুত হবে।