
বইকথাকও পর্ব-২
ধাত্রীমায়ের কথা ও কাহিনি
সায়ন ভট্টাচার্য
বিশ্বসংসারের সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা হলো নারী। নারীর জন্যই আজ নরের জন্ম হয়। নারীর গর্ভের বীজ আস্তে আস্তে যখন সে হয়ে উঠতে চায় বৃক্ষ, যখন সে চায় পৃথিবীর আলো বাতাস রূপ রস গন্ধ স্পর্শ বর্ণ – সে কিভাবে আসবে ধরিত্রীর বুকে, যদি না প্রথম কেউ কোল দেয়। তার জন্যও পৃথিবীতে আরও এক নারীকেই প্রয়োজন ছিল। নাডী় ছেঁড়া সেই মাতৃসম্পদকে আদরে কোল দিয়েছিল ধরিত্রীরূপী মাতা ধাত্রী। ধাত্রীকে তাই মায়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে।
আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান তার উন্নতির জোযা়রে নারী পুরুষ আলাদা ভাবে চিহ্নিত না করে প্রসবে সাহায্য করছেন ঠিকই, কিন্তু সেই পথ দেখিয়েছিল নারীরাই। এই ইতিহাসের কথা মানব পৃথিবীর হৃদয় মনে লেখা আছে। সেই ইতিহাস থেকে বিস্মৃত আমরা যাতে না হয়ে যাই সেই কথা ভেবেই মানস শেঠ রচনা করলেন ‘ধাত্রীবৃত্তান্ত – ইতিহাস ও সংস্কৃতি’।
নবজাতকদের যে ঋণ সেই ঋণের তো একটা ইতিহাস ,একটা স্বীকৃতি থাকা উচিত। মানস অসামান্য একটি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের চর্চার জন্য দলিল তৈরি করে দিলেন।
আমাদের সাহিত্যে চলচ্চিত্রে নাটকে ধাত্রীদের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বারবার ফিরে এসেছে। কিন্তু আমরাই হয়তো খুব মনের গভীরে স্থান দিই নি। মনে পরে বিভূতিভূষণ-এর ‘পথের পাঁচালি’ পড়তে পড়তে দুর্গাকে বলবে কুডু়নির মা দাই ,”ও খুকি, কাল রাত্তিরে তোমার একটা ভাই হয়েচে দেখবো না?” তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটা গোটা উপন্যাস লিখেছিলেন ‘ধাত্রীদেবতা’। কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতায় ফিরে এসেছে, ” শিয়ালদার ফুটপাথে বসে আছেন আমার ধাই মা/ দুটো হাত সামনে পেতে রাখা”। সত্যিই তো এই ভাবনাগুলো লেখক যদি আবার এতটা উস্কে না দিতো, ভাবতাম কি? সন্তান জন্মের মাধ্যম হিসেবে ভাবা একটি মানব গোষ্ঠীর অবদানকে কত সহজে তাকে চিকিৎসার যান্ত্রিক বিষয়ে নিয়ে গেছি। কোনও সাহিত্য সভা কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের আলোচনা চক্রে এমন একটি বিষয় নিয়ে তো খুব একটা কিছুই শুনি না।
বইয়ের অন্দর-মহলে প্রবেশ করা যাক। মোট আটটি অধ্যায়ে পুরো বইটির বহুমুখী দৃষ্টিকোণ দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে ইতিহাস থেকে নবজাগরণ, সাহিত্য নাটক চলচ্চিত্রে ধাইদের অবস্থান, দেশে বিদেশে কোন সংস্কৃতিতে কিভাবে ধাইদের দেখা হয়েছে, বর্তমানে তাদের পরিস্থিতি এই উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে কেমন তার কথাও আছে।
আমরা কর্ণাটকের সুলাগিত্তি নরসাম্মার কথা পড়ে অবাক হয়ে যাই, যিনি ২০১৮ সালে পদ্মশ্রী সম্মান পান। ওনার হাতে পনেরোর হাজার শিশুর প্রসবে ধাত্রীর কাজ করেন। এমনকি উনি দুর্বল মায়েদের জন্য যাযাবরদের কাছ থেকে শেখা ভেষজ ওষুধের গুণ শিখেছিলেন। সারোগেসির ইতিহাস বলছে, ডাক্তার নায়না প্যটেল ভারতে প্রথম সারোগেসি বাণিজ্যিক ভাবে চালু করেন ২০০৫ সাল থেকে। ধাত্রী কর্মে আধুনিক পৃথিবীর নব্য সংস্করণ সারোগেট মা।
বইটি পড়তে গিয়ে জানতে পারছি বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধাইরা আঁতুরঘরে কিভাবে কাজ করতো, যেমন; রাজবংশীদের মধ্যে একটা ব্যবহুত মন্ত্র আছে যা আসলে সন্তান
‘ উলোট কাপড় ফুলোত দলি
উপরোত দুই শ্রীফল দেবী
শিবে নিলেক খুন্তি কোদল
দেবী নিলেক ঝাটা ছাড়ছান
দুয়ারী, গেড্ডে কাটিয়া করিলোক
ঘাটা ভন্ডধারী খরা হইল
ফেন্নার ছাওয়া ফুলে জলে প্রসব হইল।’
ভারতীয় শাস্ত্রেও ধাইমাকে বলা হচ্ছে সপ্তমাতার মধ্যে অন্যতম – ” আদৌ মাতা গুরুপত্নী ব্রাহ্মণ রাজপত্নীকা। / ধেনু ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তৈস্তে মাতর: স্মৃতা।।” ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে চরক, তাঁর গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’-এ উল্লেখ করেছেন এই ধাত্রীবিদ্যার কথা। গৌতম বুদ্ধের আগমনের মাধ্যম হোক কিংবা আকবর ধাত্রীমাতার সাহায্য ছাড়া কিছুই হতো না। মেরি শেরলিব যিনি ভারতের প্রথম মেডিক্যাল ছাত্রী তিনি তাঁর ইংরেজ স্বামীকে, মুসলমান স্ত্রীদের ঘরে ঘরে সন্তান জন্মের সমস্যাগুলো বোঝাচ্ছেন গ্রামকে গ্রাম ফিল্ড ওযার্কের মধ্যে দিয়ে।
সমস্ত ধাইরাই কি খুব ভালো – না, একদমই না, তাদের কথা বলতে গিয়ে মানস ‘মন্দ ধাই’দের নিয়ে লিখেছেন। খুব বিস্তারিত একটা ইতিহাস গ্রন্থ নয় এই বই, তবে ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য, গবেষণার জন্য একটা অমূল্য সম্পদ তৈরি করেছেন মানস শেঠ এই গ্রন্থে।
গ্রন্থপাঠ বিমুখ একটা সময়ে তবুও প্রয়াস প্রকাশনা যে এমন একটি বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করলো তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
গ্রন্থ : ধাত্রীবৃত্তান্ত – ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : মানস শেঠ
প্রচ্ছদ : আমিনুল হাসান লিটু
প্রকাশক : তবুও প্রয়াস
মূল্য : ৩৫০/-


আলোচনা ভালো লাগল