
ফয়েজ় পরিক্রমা – ১০
নীলাঞ্জন হাজরা
মির্জ়া গালিব থেকে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় কত দূর? খুব দূর নন হয়তো, কিংবা দূরত্ব ও নৈকট্যের মানদণ্ডে মাপাই যাবে না এ দুজনার সম্পর্ক। মির্জ়ার পাপ, তাঁর পাগলামোর জ্বর, হাহাকারকে ফয়েজ় ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে নিয়ে চলে যান। তদুপরি, মির্জ়ার ‘পরাজয়ে নিজেরই ভেঙে পড়ার আওয়াজ’ ফয়েজ়ে তো নেই-ই, বরং রয়েছে এক সমষ্টিগত উন্মাদনার উত্থান যা অপ্রতিরোধ্য। কাজেই কিসের পাপ, কেন পাগলামোর জ্বর, কার জন্য হাহাকার— ইত্যাকার প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ বদলে যায়। মির্জ়ার অন্তহীন প্রতিক্ষার সঙ্গে এক নিরন্তর অদম্য অপ্রতিরোধ্য খোঁজ জুড়ে দেওয়াই সাবেকি শ্রেষ্ঠ উর্দু কবিতার ধারায় ফয়েজ়ের বিপ্লব।
ভোর শুধু খুঁজে ফেরে, ফিরে ফিরে গেল কতবার
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। শিল্পী সাদকেন
বিচিত্র এক পরিস্থিতিতে মির্জ়ার সঙ্গে আমার যে গভীর বন্ধুত্বের, রাজ়দানি, সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল হয়তো আজকের নবীনদের পক্ষে ব্যাপারটা বোঝাই একটু কঠিন। কঠিন এই কারণেই যে, ‘ফেসবুক’ নামক পরিকল্পিত পশ্চিমী দানবটি সারা বিশ্বের যে ভয়াবহ ক্ষতি করে চলেছে তার মধ্যে ভয়ঙ্করতম ক্ষতি ‘ফ্রেন্ড’ কথাটার উপর্যুপরি ধর্ষণ। তাই ব্যাপারটা খোলসা করা দরকার। আমি প্রাচ্যের মানুষ, এবং এমন একটা দেশের মানুষ যেখানে ‘বন্ধু’ কথাটার দ্যোতনা অতলান্তিক। ‘জীবন মরণের সীমানা’ অতিক্রম করা সে সম্পর্কের শুধু রাবিন্দ্রীক অনুষঙ্গই অযুত রঙে রঙিন। প্রসঙ্গত, ‘বন্ধু’-র এমন অন্তহীন এক্সপ্লোরেশনের পরম্পরা তিনি স্পষ্টতই নিচ্ছিলেন প্রাচীন সংস্কৃত টেক্স্ট এবং পারসিক ও উর্দু কাব্য থেকে (আমরা প্রায়শই খেয়াল রাখি না, রবীন্দ্রনাথ লালিত হয়েছেন একাধারে সংস্কৃত ও পারসিক কবিতার— বিশেষত হাফেজ়-এর— দুগ্ধে। দেবেন্দ্রনাথের অসামান্য ‘আত্মজীবনী’ ছত্রে ছত্রে দেখিয়ে দেয় কোথা থেকে তাঁর গান, তাঁর দর্শন এবং তাঁর রক্তে প্রবাহিত মুসাফিরি-র মূল উৎসার। প্রণম্য শঙ্খ ঘোষ সে বই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রমনের চাবিকাঠি হিসেবে।)। এবং বাউল ও লোকসঙ্গীত থেকে, তা যে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা গানে কোথায় হারিয়ে গেল সেও এক গভীর রহস্য।
কে জানে কত সহস্র বছর আগে গভীর অনুধ্যানে ঋষিরা আমাদের দিয়ে গিয়েছেন ‘বন্ধু’-র এমন এক সংজ্ঞা যা বিশ্বের আর কোনও দর্শনে আছে কিনা সন্দেহ—
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।
(হিতোপদেশ। সম্ভবত এই সংকলন ৮০০ থেকে ৯৫০ সাধারণাব্দের মধ্যে পূর্বভারতের কোথাও রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়। সংকলক বৈয়াকরণ ও দার্শনিক নারায়ণ। মনে করেন, বিখ্যাত কূটনীতিক ও সংস্কৃত পুথিপত্রের সুপণ্ডিত তরজমাকার এএনডি হাকসর। সূত্র— Narayana. The Hitopodesa. A.N.D. Haksar. Penguin Classics. 2007)
আর কোন সম্পর্ককে এত দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পার করে তবে নিজের নামের সুবিচার করতে হয়?
এই পরম্পরা সমানে বাহিত সেরা উর্দু কাব্যের ‘দোস্ত’ ও ‘ইয়ার’-এর অন্তহীন এক্সপ্লোরেশনের রঙিনতর ফসলে। মির্জ়া মোটেই ব্যতিক্রম নয়। আর আমার ফয়েজ় পরিক্রমায় মির্জ়া এক অপরিহার্য পথ। আমাকে এ বিশ্বাস থেকে টলানো বেশ মুশকিল যে, এই বন্ধুত্বের, এই ‘রাজ়দানি’ সম্পর্ক ব্যতিরেকে মির্জ়ার সেরা কবিতা তারিয়ে তারিয়ে আদৌ পান করা সম্ভব নয়।
কিন্তু অসমবয়সী বন্ধুত্ব কি হয় না? আলবৎ হয়। তা হলে গত অধ্যায় এ কথা দিয়ে শেষ করা কেন যে, ‘‘পাঠক হয়তো এক্ষণে বেশ কল্পনা করে নিতে পারছেন, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় জারিত এক বৃদ্ধ কবির, খুখ্খুকে কাশি আর আলবোলায় ভুড়ুক ভুড়ুক টানের ফাঁকে ফাঁকে এক-কুড়ির মাঝকোঠার যুবকের সঙ্গে শে’র-ও-শায়রির ইশারায় কথপোকথনের দৃশ্য। যদি পারছেন, খুব সম্ভবত, সম্পূর্ণ ভুল করছেন…!’’?
কারণ, একটি বাক্য— আমার মির্জ়াপাঠে এক হতচকিত চমক। সেটা পেতে গেলে একটা কেতাব খুলতে হবে— Ghazals of Ghalib. Editor Aijaz Ahmad (Columbia University Press, 1971)। এ গ্রন্থ মির্জ়ার কবিতার ‘তরজমা’ ঠিক নয়, বরং ভারতীয় সাহিত্যের দিকপাল আলোচক প্রণম্য এইজাজ় আহমদ একে ‘Versions from the Urdu’ বলাই শ্রেয় মনে করেছেন।
এই সংকলনে অধ্যাপক আহমদ যাঁদের দিয়ে গালিবের কবিতার ইংরেজি ‘ভার্শন’ করিয়ে নিতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন একের পর এক স্বনামধন্য আমেরিকান কবি — ডব্লিউ এস মেরউইন, এগ্রিয়েন রিচ, উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ড, ডেভিড রে প্রমুখ। এই বই শুরু হচ্ছে অধ্যাপক আহমদের বেশ দীর্ঘ একটা ভূমিকা দিয়ে। আর সেখানেই রয়েছে সেই বোঁ-করে মাথা-ঘুরিয়ে দেওয়া বাক্য— On the other hand, there is evidence that most of what we know as his complete works were substantially completed by 1816, when he was 19 years old, and six years after he first came to Delhi. কী বলছেন স্যার! যে কবিতা অনায়াসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কাব্যসৃষ্টির পঙ্ক্তিতে তার প্রায় গোটাটাই লেখা হয়ে গিয়েছিল কবির ১৯ বছর বয়সের মধ্যে?! বিলকুল।
এ তথ্যটা মোটেই নতুন কিছু নয়, কিন্তু আমি জেনেছিলাম মির্জ়ার সঙ্গে আমার রাজ়দানি শুরু হওয়ার বহু বছর পরে। কাজেই না, ‘ক্যায়েদ-এ-হয়াত’ বা ‘বন্দ-এ-গম’-এর অন্ধকারে সেই কথপোকথন মোটেই হচ্ছিল না এক জীবন-জারিত বৃদ্ধ ও এক অর্বচিনের মধ্যে! সেটা হচ্ছিল সমানে সমানে। আসলে সব সব্বোনাশের মূলে রয়েছে এতাবৎ পাওয়া মির্জ়ার একটি মাত্র ছবি— সেই যে দেড়েল গম্ভীর চিমড়ে মার্কা মুখের এক কবির ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের মনে একেবারে খোদাই হয়ে গিয়েছে, তার কয়েদ থেকে মির্জ়ার কবিতাকে উদ্ধার করা সব্বার আগে দরকার! আর সেটা করার ক্ষেত্রে আমার খুব সুবিধা হয়ে গিয়েছিল কবিতার ‘আরশ’-আসীন মির্জ়ার কোনও ছবি কখনওই সে ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে না যাওয়ায়।
মির্জ়া গালিবের একমাত্র ফটোগ্রাফ
সে কথাই আমি বিস্তারে লিখেছিলাম সঞ্চারী সেনের অসামান্য কেতাব ‘মির্জ়া গালিব’-এর ভূমিকায়। এই তিন দশকের পরিচয়েও কিছুতেই একটু সশ্রদ্ধ দূরত্বে রাখতে পারিনি ইজ়্জ়তুন নিসা বেগম ও আব্দুল্লা বেগ খানের দ্বিতীয় সন্তান মির্জ়া অসদুল্লা খানকে। সে মহাসনে থাকুন রবীন্দ্রনাথ, থাকুন ফয়েজ়। হতে পারে তোমার জন্ম আমার জন্মের ১৭০ বছর আগে, আমার পাঠে, মির্জ়া, তুমি রইবে আমার মুখোমুখি। সে রাজ়দান ওই দাড়িওয়ালা চিমড়ে মার্কা বুড়ো নন, সে মির্জ়া, জানাচ্ছেন মেহর অফশান ফারুকি, ছিলেন আগ্রা আর দিল্লির ডাকসাইটে রূপবান যুবকদের অন্যতম।
আমাদের আদান প্রদান হবে সমানে সমানে— আঘাতে, ব্যর্থতায়, সাফল্যে, সন্দেহে, ঈর্ষায়, ভীরুতায়। রুখে দাঁড়ানোয়। পালিয়ে যাওয়াতে। মেজাজে। গর্বে। অপমানে। ভাদ্রের গরমে ২৪০ নম্বর বাসে ঝুলতে ঝুলতে প্রতিনিয়ত। পৌষে মাতলার আদিগন্ত প্রসারতায়, লঞ্চে। আপিসে বসের সামনে হাত কচলাতে কচলাতে। কফি হাউসে পুরনো বন্ধুদের গুলতানিতে। বাড়িতে সন্তানের চুমুতে। তোমার আশ্চর্য সব গজ়লের বাগানে ঘুরব ফিরব। প্রতিনিয়ত অবাক হবো। সকলকে ডেকে ডেকে দেখাব তাজ্জব ফুলের বাহার। পোকা-ধরা দু-একটা চোখে পড়লেই ঝগড়া করব— এ কী মির্জ়া, আরও শতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সব থেকে পছন্দের ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে দিওয়ানের পাতার ভাঁজে রেখে পাঠাতে চাইব… কী জানি কাকে? আমরা যে একই আঁধারে বন্দী, আলোর চোখে একই পাপে পাপী—
রবীন্দ্রনাথ পাপ থেকে সাবধান করেন —
চাহিয়া দেখ রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি
চেয়োনা চেয়োনা তারে নিকটে নিতে টানি।
মির্জ়া পাপ কুবুল করে। শুধু কুবুলই করে না, পাপ উদ্যাপন করে। আমরা ক্রমে দেখব, ফয়েজ়ও তাই করেন, কিন্তু একেবারে অন্য চলনে। সে প্রসঙ্গে আমাদের ফিরতেই হবে, যখন ফয়েজ় সাহাবের কবিতার দুনিয়ায় প্রবেশ করব।
তমাশা-এ-গুলশন তমন্না-এ-চীদন
বহার আফ্রিনা গুনহগার হ্যায়ঁ হম।।
(বাগান দু-চোখ ভরে দেখি, ছিঁড়ে নিতে চাই ফুল
বসন্তের দেবী, আমরা যে পাপী বিলকুল।।)
(মির্জ়া গালিব)
এ তো অনুশোচনা নয়, এ তো সেলিব্রেশন!
আমার সঙ্গে মির্জ়ার বন্ধুত্বের, রাজ়দানি, সম্পর্কটা ঠিক সেখানেই। হ্যাঁ, ‘গুনহগার’। এই কথাটা আর স্বীকার করি কতবার? নিরন্তর পথ চলা। নিরন্তর অস্থিরতা। নিরন্তর চাওয়া। আর নিরন্তর পাপ। সেই যে অদৃষ্টের তলোয়ারের এক কোপে ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলা হল তোমার কৈশোর, সেই থেকে এই তো তোমার জীবন।
মনে পড়ে মির্জ়া সেই কবে ঘর ছেড়েছিলে? বয়স তখন পনের, কী বড়জোর ষোল। নবাব ইলাহি বখ্শ খান মারুফের কন্যা, বছর বারোর টুকটুকে বউ দিল্লি থেকে আসা উমরাও বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ফের চলো দিল্লি। ১৮১২। নিজভূম আগরার পাট চিরকালের মতো শেষ। তত দিনে কালা মহল অঞ্চলের সেই আলিশান হাভেলির রঙ চটতে শুরু করেছে। টান পড়েছে বিপুল কিলার গুলাব বাগে ছড়ান ফোয়ারার জলে। আকবরাবাদের শান-ও-শৌকত ফিকে হতে হতে হয়ে উঠেছে আগরা। তা ছাড়া এই হাভেলির ছাদে কবুতর ওড়ানোর বকবকম শৈশবের স্মৃতিই শুধু তোমার ভাগ্যে জোটেনি। অনাথ হয়ে গেছ তুমি— বাবা মারা গেছেন। তার বছর দুইয়ের মধ্যে যে চাচা-জান তোমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেই নসরুল্লা বেগ খানও, যুদ্ধে হাতির পিঠ থেকে পড়ে। বাপ-চাচার সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। যার হাতে গিয়েছিল তার একাংশ, তিনি কিছু দিন দুই পরিবারের জন্য বছরে বেশ মোটাসোটা রকমের বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা ধার্য করলেও শীঘ্রই তা অর্ধেক করে দিয়েছেন। পড়ে রইল লাটিম খেলার ভাঙাচোরা উঠোন, আকাশটা তেমনই থাকলো বটে, কিন্তু ঘুড়ি কেটে গেল। খালি পেটে দিন চলে না, দিন চলে না, দিন চলে না। কাজেই চলো দিল্লি।
কিন্তু তোমার পরমাশ্চর্য কলম চলতেই থেকেছে। প্রথম দিওয়ান, কাব্যসংকলন, যখন প্রকাশিত হয়ে গেল তখন তোমার বয়স উনিশ! ১৮১৬। তার পাতার পর পাতায় যাকে পাই সে বড়ো একা হয়ে যাওয়া এক মানুষ, গমগমে দিল্লিতেও একা। বড়ো ইনসিকিয়োর। ঠিক যেমন একা আর ইনসিকিয়োর এই ছশো কোটির দুনিয়াতে আমরা সকলেই। যার মূলে আছে সারাটা জীবন ধরেই একটা অফুরন্ত চাওয়া। অথচ নিজেই বোঝো না তুমি ঠিক কী পেলে পাকাপাকি পরিতৃপ্ত হবে মন। এক্কেবারে একবিংশ শতকের শিক্ষিত, সংবেদনশীল মধ্যবিত্ত মন— সততই কিছু না কিছু চাই। পাইও অনেক। তবু শেষ নাই! সারা জীবনটাই এক অন্তহীন ভালো, আরও ভালো থাকার খোঁজ ও তজ্জনিত চির-অতৃপ্তি। সত্যজিৎ রায়ের বাঘার মুখের সেই অনবদ্য, অনবদ্য সংলাপ— ‘আমি তখনই বলেছিলাম, তিন বর যথেষ্ট নয়!!’ ভূতের রাজা এত পাইয়ে দেওয়ার পরেও। আজকের পুঁজিবাদী লব্জে যা অতি লোভনীয় upward mobility। অসাধারণ সেই গজ়লের প্রথম দু’ পঙ্ক্তি — মকতা। যা আমরা সকলেই জানি, যদিও বাকিটা নয়, তাই এই মওকায় শুনে নিই গোটাটাই।
হাজ়ারোঁ খ্বাহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খ্বাহিশ-পে দম নিকলে
বহত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফিরভি কম নিকলে।।
(লক্ষ বাসনা এমনই যে মনে হয় বাঁচব না একটিও দেয় যদি ফাঁকি
মিটেছে অনেক সাধ, তবু হায় সবই বুঝি রয়ে গেল বাকি।।)
ডরে কিউঁ মেরা কাতিল কেয়া রহেগা উসকি গরদন পর
উয়ো খুন জো চশ্ম-এ-তর সে উম্র-ভর ইয়ুঁ দম-ব-দম নিকলে।।
(ভয় পাবে কেনই বা খুনি যে আমার, রইবে কি ঘাড়ে তার
সেই রক্ত সারাটা জীবন যা সিক্ত দু’ চোখ থেকে ঝরে ঝরে পড়ে অনিবার।।)
নিকলনা খুল্দ সে অদম কা সুনতে আয়ে হ্যায়ঁ লেকিন
বহত বে-আব্রু হোকে তেরে কুচে সে হাম নিকলে।।
(অনন্ত মহাসৃষ্টি থেকে এসেছে মানুষ, শুনেছি তো এমনই চিরদিন
তবে কিনা, তোমার ওই পথ থেকে আমরা যে বেরিয়েছি একেবারে আব্রুবিহীন।। )
ভরম খুল যায়ে জ়ালিম তেরে কামত কি দরাজ়ি-কা
আগর ইস তুর্রা-এ-পুর-পেচ-ও-খম-কা পেচ-ও-খম নিকলে।।
(অত্যাচারী, তোমার ভণ্ড-মহিমার যত ডাকসাইটেপনা তার হবে পর্দাফাঁস
পাগড়িটার প্যাঁচে গোঁজা পালকের যেমনি খুলে যাবে ওই ফাঁস।।)
মগর লিখোয়ায়ে কোয়ি উসকো খত তো হাম সে লিখোয়ায়ে
হুয়ি সুবহ্ অওর ঘরসে কান পর রখ-কে কলম নিকলে।।
(তবু যদি কেউ তাকে দিতে চায় চিঠি, লিখিয়েই নিক তবে আমাকে দিয়ে
ভোর হল কি না হল বেরিয়ে যাবই আমি কানে কলম নিয়ে।।)
হুই ইস দওর মে মনসুব মুঝসে বাদা-অশামি
ফির আয়া উয়ো জ়মানা যো জাহাঁ মে জাম-এ-জম নিকলে।।
(দিব্যি তো ঠিক ছিল, চলবে এবার পাত্রে আমার দেদার মদ ঢালা
তারপরে যে পড়ল কী দিন, এ দুনিয়াতেও হল হাজির জমের পেয়ালা।।)
হুয়ি জিনসে তবক্কু খস্তগি-কি দাদ পানে কি
উয়ো হাম-সে ভি জ়িয়াদা খস্তা-এ-তেগ-এ-সিতম নিকলে।।
(ছিল আশা করুণ এই ধস্ত দশা কাটিয়ে ওঠার যিনি আমায় সাহস জোগাবেন
অত্যাচারী তলোয়ারে তিনিই দেখি আমার থেকেও ধস্ত হয়েছেন।।)
মুহব্বৎ-মে নেহি হ্যায় ফর্ক জিনে অওর মরনে কা
উসি কো দেখ কর জিতে হ্যায়ঁ জিস কাফির পে দম নিকলে।।
(নেই তো ফারাক ভালোবাসায়, জীবন যেমন তেমনি মরণ
যার বিশ্বাসঘাতকতায় অকাতরে প্রাণ যায় যায়, চক্ষে হারাই তাকেই সারাক্ষণ।।)
কাহাঁ ম্যায়খানে কা দরওয়াজ়া গালিব অওর কাহাঁ ওয়ায়িজ়
পর ইতনা জানতে হ্যায়ঁ কাল উয়ো জাতাথা কি হম নিকলে।।
(শুঁড়িখানা কোথায় গালিব আর মহাজ্ঞানী উপদেশক মশাই কোনখানে
তবে এইটুকু কাল জেনেই গেছি যেমনি আমি বেরিয়েছি তিনিও দেখি চলেন সেদিক পানে।।)
কী নেই এ গজ়লে? এর কয়েকটা শে’র আর একটু রসিয়ে লক্ষ্য করি। প্রথমটার কথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু তিন নম্বর?—
অনন্ত মহাসৃষ্টি থেকে এসেছে মানুষ, শুনেছি তো এমনই চিরদিন
তবে কিনা, তোমার ওই পথ থেকে আমরা যে বেরিয়েছি একেবারে আব্রুবিহীন।।
‘একেবারে আব্রুবিহীন’— বটেই তো নগ্ন জন্মাইনি আমাদের মধ্যে এমন কে আছেন? তা হলে এত আব্রু এল কোথা থেকে? লজ্জা, শরম— কার সৃষ্টি? কেন সৃষ্টি? কেন এই একমাত্র প্রাণী — হোমো সেপিয়েন্স— বিশ্বের তাবৎ প্রাণীকুল থেকে আলাদা হয়ে গেল আব্রুর খোঁজে? কিন্তু ‘আব্রু’ তো শুধু দেহের নগ্নতা নিবারণই নয়। চকিতে মনে পড়ে যায় প্রণম্য হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে শোনা সেই আশ্চর্য লোকগান—
https://www.youtube.com/watch?v=FniqeClIO-A
ইউটিউবের এই ভিডিওতে গোটা গানটার কথাই লিখে দেওয়া আছে, তাই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কেবল দুটো পঙ্ক্তির কথা—
কারো বা আছে ধুতি গো চাদর, আমার আছে ছিড়া ট্যানা ও
ট্যানায় লাজ ঢাকে তো আব্রু ঢাকে না ও মুর্শিদ।।
এই সাংঘাতিক গানে শ্রেণিচেতনার অসামান্য প্রকাশের বাইরেও যে অতলান্তিক বার্তা রয়েছে, তাই লোকগানকে কালজয়ী করে দেয়। নাম নেই, ধাম নেই, কে কবে লিখেছেন কেউ জানে না। স্বরলিপি নেই, কথা ছাপা নেই। নদীর মতো বয়ে চলেছে, প্রাণে ভরপুর। আমার অন্তত মনে হয়েছে ওই তিন নম্বর শে’র-এ তেমনই অপার হাজির করে ফেলেছে মির্জ়া। তার মধ্যে যে অজস্র প্রশ্ন ঠাসা আছে— কে দূর করবে সে ভাবনা? সে সব ভাবনা।
আরও আছে, ‘তোমার ওই পথ থেকে’। কার পথ থেকে? যদি পড়ি নির্দয় প্রিয়তমার? যে মানুষ সৃষ্ট পরমেশ্বরের মহাসৃষ্টি থেকে, কেন, কোন ক্ষমতায়, কোন স্পর্ধায় তাকে এমন বেআব্রু করে ফেলতে পারে আর এক মানুষ? সে স্পর্ধা, সেই ক্ষমতা তাকে দিল কে? উত্তরে আবার চকিতে মনে পড়ে যায় ফয়েজ়ের শে’র—
বরবাদি-এ-দিল জব্র নেহি ফয়েজ় কিসিকা
উয়ো দুশমন-এ-জাঁ হ্যায় তো ভুলা কিয়ুঁ নেহি দেতে।।
(হৃদয় বিধ্বস্ত করতেই হবে, এমন জবরদস্তি তো কেউ করেনি ফয়েজ়
সে যদি এমনই শত্রু প্রাণের, তবে তাকে ভুলেই বা যাচ্ছ না কেন?)
শাবাস! ঢুকে পড়লাম ভালোবাসার, প্রেমের মৌলিক প্রশ্নে। সে প্রশ্নের উত্তরের খোঁজের পথ খানিকটা আলবৎ পার করে দেবেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। যৌনতা এক অনির্বচনীয় বাঁধন ও অভিজ্ঞতা, কিন্তু সেটার সঙ্গে আছে আরও সাত সমুদ্দুর। যা পার করার জন্য তৈয়ার অসম্ভব সব স্বপ্নে ঠাসা জাহাজে সওয়ারি করার অদম্য যুক্তি-ছেঁড়া আকাঙ্খাই ভালোবাসা।
কিন্তু শুধু সেই ভালোবাসার মৌলিক প্রশ্নই কি? নাকি তার থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে এই দুই শে’র-এই ঢুকে পড়লাম মানব সমাজে ক্ষমতার বিন্যাসের মৌলিক প্রশ্নে। সম্পদ উৎপাদনের ওপর দখলদারি ক্ষমতার বিন্যাস বহুলাংশে নির্ধারণ করে ঠিকই, কিন্তু সেটাই কি সব? সামন্ততান্ত্রিক থেকে ফাশিস্ত সমাজ বিন্যাস পর্যন্ত সর্বত্রই প্রভু ও প্রভাবিত অনুগামীর সম্পর্ক শুধুই অর্থনীতির কার্যকারণে বাঁধা এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন।
মির্জ়ার এই শে’রটাতেই আরও যে কত কিছু পড়া সম্ভব! যেমন, ‘শুনেছি তো এমনই চিরদিন’, হয়তো বা ধর্ম, হয়তো বা পরম্পরাগত হিতোপদেশ, যা কিছু চিরদিন শোনা তাই শেষ সত্য কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন। প্রশ্ন বলেই ওই ‘লেকিন’, ‘তবে কিনা’। মির্জ়ার শে’রের পর শে’র উদ্ধৃত করে এই চ্যালেঞ্জ দেখান সম্ভব। ক্ষমতাধারীর এই ক্ষমতার উৎস নিয়ে প্রায় গোটা গজ়লটা জুড়েই বুনিয়াদি প্রশ্ন তোলে মির্জ়া।—
দিব্যি তো ঠিক ছিল, চলবে এবার পাত্রে আমার দেদার মদ ঢালা
তারপরে যে পড়ল কী দিন, এ দুনিয়াতেও হল হাজির জমের পেয়ালা।।
এখানে সব্বার আগে ‘জমের পেয়ালা’ কথাটা খোলসা করা জরুরি অপরিচিত পাঠকের কাছে। ‘জম’ পারসিক ও উর্দু কাব্যে ‘জামশিদ’-এর সংক্ষেপ। কে এই জামশিদ? পারসিক লোকগাথা ও পরবর্তীতে পারসিক সাহিত্যের এক বহুল চর্চিত সম্রাট। ফেরদৌসি-র মহাসৃষ্টি ‘শাহনামা’-সহ অজস্র পারসিক কাব্যে ছড়িয়ে রয়েছে জামশিদের নানা কাণ্ডকারখানার কথা। যা থেকে ভূরি ভূরি আহরণ করেছেন উর্দু কবিরাও। জামশিদ পারসিক প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যে এক বিপুল অধ্যায়।
পারস্যের গাজার সাম্রাজ্যের সময় আঁকা রাজা জমশিদের বিখ্যাত প্রতিকৃতি। শিল্পী মিহ্র আলি। ১৮০৩।
সিরাজ় থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে ধুধু মর্বদশ্ত্ প্রান্তরের মাঝে ৫৫০ থেকে ৩৩০ পূর্বসাধারণাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত হখামনেশি সাম্রাজ্যের রাজধানী যে পারসেপোলিস দেখে শিহরিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, ফারসিতে তার পরম্পরাগত নামই তখ্ত-ই-জামশিদ। শাহনামের বর্ণনায় সাড়ে পাঁচশো বছর রাজত্ব করেছিলেন সম্রাট জামশিদ। ফেরদৌসি কোনও উল্লেখ না করলেও পরবর্তী কালের সাহিত্য-লোকগাথায় কোনও এক সময় এই জামশিদের হাতে চলে এসেছিল এক ‘জাম’, পেয়ালা, যে পেয়ালায় তাকিয়ে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখতে পেতেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘ রাজত্বকালের অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই পেয়ালা।
এই অবধি জেনে যদি আমরা মির্জ়ার ওই শের আর একবার পড়ি কী দেখা যেতে পারে তাতে?—
দিব্যি তো ঠিক ছিল, চলবে এবার পাত্রে আমার দেদার মদ ঢালা
তারপরে যে পড়ল কী দিন, এ দুনিয়াতেও হল হাজির জমের পেয়ালা।।
স্তম্ভিত হতে হয়। রাষ্ট্রীয় নজরদারীর কথা বলছে নাকি মির্জ়া? যেখানে অঢেল মদ্যপান করে মাতাল হওয়ার একান্ত ব্যক্তিগত সময়টুকুও রাষ্ট্রীয় নজরদারীর আওতায়! মির্জ়ার সময়কাল মাথায় রেখে যদি রাষ্ট্রীয় নাও বলি, সামাজিক নিঃসন্দেহে। এই শের পড়ে চ্যাপলিনের চিরসবুজ ছবি ‘মডার্ন টাইম্স’-এর এ দৃশ্যই আমার মনে এসেছিল—
https://www.youtube.com/watch?v=ANXGJe6i3G8
বুক হিম করা নজরদারি। যেখানে বাথরুমের আড়ালেও দুদণ্ড বিড়ি ফুঁকে নেওয়ার জো নেই শ্রমিকের। সেখানেও হাজির হুজুর— সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী উন্নয়ন। ১৯৩০ সালে চ্যাপলিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন কী দিন আসছে। মির্জ়ার ঘাড়ে যদি সে দূরদৃষ্টির বোঝা নাও চাপাই, জামশিদ ও তার পেয়ালার ক্ষমতায় কবির আক্ষেপ বা বিরক্তি যে সুস্পষ্ট তা সন্দেহাতীত।
আর নিচের এই শেরটি প্রসঙ্গে অবশ্য বেশি কথা না বলে একটা ছবি সেঁটে দেওয়াই যথেষ্ট—
অত্যাচারী, তোমার ভণ্ড-মহিমার যত ডাকসাইটেপনা তার হবে পর্দাফাঁস
পাগড়িটার প্যাঁচে গোঁজা পালকের খুলে যাবে যেমনি ওই ফাঁস।।
একেবারে ‘মতলা’ — শেষ শে’র যেখানে কবি নিজের নাম ব্যবহার করেন— সেখানেও পাই অনুরূপ সরাসরি আক্রমণ—
শুঁড়িখানা কোথায় গালিব আর মহাজ্ঞানী উপদেশক মশাই কোনখানে
তবে এইটুকু কাল জেনেই গেছি যেমনি আমি বেরিয়েছি তিনিও দেখি চলেন সেদিক পানে।।
পাক্কা মনে পড়ে যায় পূর্বজ মীরের সেই শে’র যা এই পরিক্রমাতে আমরা আগেই পার করেছি।
তবে এ গজ়লে আমার সব থেকে প্রিয় শে’র এটি—
ছিল আশা করুণ এই ধস্ত দশা কাটিয়ে ওঠায় যিনি আমায় সাহস জোগাবেন
অত্যাচারী তলোয়ারে তিনিই দেখি আমার থেকেও ধস্ত হয়েছেন।।
এ কবিতায় (মনে আছে নিশ্চয়ই, আগে যা বলেছি একাধিকবার— গজ়লের প্রত্যেকটি শে’র এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা। তাকে, এবং এক্ষেত্রে তার তরজমাকেও, পড়তে হবে সে ভাবেই) এমনই করুণ কিছু একটা রয়েছে, যা হরেক কিসিমের ‘সর্বশক্তিমান’-কে চ্যালেঞ্জ করে আরও বহু দূর প্রসারিত। মানুষের অনন্ত আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসাকে, সর্বমঙ্গলময়ের ধারণাটাকেই ক্ষমতার বিন্যাস যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে, করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার এত সহজ কাব্যিক প্রকাশ আমি আর মনে করতে পারি না। এখানে কি তবে বিনত হল মির্জ়া? হয়তো। কিন্তু ভক্তির পরাকাষ্ঠাকে বহু দূরে রেখে, এক অনবদ্য স্বকীয় চলনে— উর্দু সাহিত্যে তো বটেই বিশ্বসাহিত্যেও যার তুলনা মেলা কঠিন।
আমার মনে হয়েছে ফয়েজ়-এর কবিতার যে মূল দুই ধারা তার একটা হৃদয় বিদীর্ণ করা দীর্ঘশ্বাস, এবং অন্যটা সেই দীর্ঘশ্বাসকে ঢেকে রাকা একটা আপাত-কৌতুকময় চলন। মির্জ়ার কবিতাতেও প্রায় তাই-ই বলা যায়। কিন্তু এই দ্বিতীয় ধারাটায় আমরা ক্রমাগত খুঁজে পেতে পারি মির্জ়ার ঢেউ, প্রথমটিতে নয়। ফয়েজ়-এর দীর্ঘশ্বাসে আর মির্জ়ার আর্তনাদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। যেটা আমরা এই পরিক্রমায় চলতে চলতে টের পাব। আপাতত প্রথমটির বিষয়ে শুধু এইটুকু—
না গুল-এ-নগমা হুঁ না পর্দা-এ-সাজ়
ম্যায় হুঁ আপনি শিকস্তকি আওয়াজ়।।
(রাগিনীর আলাপ নই, নই কোনও স্বরে বাঁধা বাজ
পরাজয়ে পরাজয়ে আমি নিজেরই ভেঙে পড়ার আওয়াজ।।)
ফয়েজ়ের দীর্ঘশ্বাসে এই ‘আপনি শিকস্তকি আওয়াজ়’ আমি অন্তত কখনও মনে করতে পারি না।
সেরা পারসিক ও উর্দু কবিতার মত মির্জ়া ও ফয়েজ়ের কবিতাও ‘গুল-ও-বুলবুল’, ফুল আর বুলবুলির কথপোকথনের অছিলায় ধারাল রক্তপাতে ঠাসা। কিন্তু দুজনের রক্তপাতের প্রকাশ, আমরা দেখব, মৌলিক ভাবে পৃথক— কোনটা ফিনকি দিয়ে, কার গলগল করে তা বলতে পারি না, কিন্ত দুই কবির রক্তলেখও আলাদা।
মির্জ়ার দারুণ খঞ্জর কাটবে এই ভাবে—
কফস-মে মুঝসে রুদাদ-এ-চমন কহতে না ডর হমদম
গিরি হ্যায় জিসপে কাল বিজলি উয়ো মেরা আশিয়াঁ কিউঁ হো।
(খাঁচাবন্দী বলে বাগানের খবর দিতে চিরসাথী ভয় পেয়ো না যেন
বাজ কাল পড়েছে যেখানে তা আমারই বাসা হতে যাবে কেন।। )
খাঁচার পাখি আর তার মুক্ত সাথীর মধ্যে গালগল্প চলতে চলতে যখন বাগানে বাজ পড়ে একটা বাসা ছাই হয়ে যাওয়ার কথা অর্ধেক বলে আটকে যায় মুক্তজন, সব বুঝেও কিছুই না জানার ভানে আর্তনাদ ঢেকে ফেলে খাঁচার পাখি।
কিংবা সহজতর লব্জে—
কহতা হ্যায় কৌন নালা-এ-বুলবুল কো বে-অসর
পর্দেমে গুলকে লাখ জিগর চাক হো গয়ে।।
(কিছুই হয় না তো আর্তনাদে বুলবুলির, এ কথা কে বলে
ফালাফালা হল লক্ষ হৃদয় ফুলের আড়ালে আড়ালে)
অথবা
কুমরি কফ-এ-খাকিস্তর-ও-বুলবুল কফস-এ-রঙ্গ্
অ্যায় নালা নিশান-এ-জিগর-এ-সোখতা কেয়া হ্যায়।।
(পারাবত একমুঠি ধুলো, রঙের খাঁচা বুলবুলি
ওহ্ আর্তনাদ, পুড়ে যাওয়া হৃদয়ের চিহ্ন কাকে বলি।।)
এখানে দীর্ঘ আলোচনা করব না, কিন্তু দেখুন কী ভাবে ফয়েজ় এই বুলবুল, ফুল, খাঁচা ও বাগানের যে দীর্ঘ পরম্পরায় ভেসে আসা ছবি তাকে কুচিকুচি করে বাতাসে উড়িয়ে না দিয়ে মোক্ষম কয়েকটি রেখার টান বদলে যেন গোটা ছবিটাই বদলে দিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গজ়লের শুধু ‘মতলা’ আর ‘মকতা’-ই পেশ করলাম—
অব ওহি হর্ফ-এ-জুনুঁ সবকি জ়ুবাঁ ঠহরি হ্যায়
জো ভি চল নিকলি উয়ো বাত কাহাঁ ঠহরি হ্যায়।।
(সকলের ঠোঁটে আজ পাগলামোর সেই সব জ্বর-অক্ষর
যেই কথা একবার রওনা হয়ে যায় সে আর কোথায় আটকায়।।)
হামনে জো তর্জ়-এ-ফুঘাঁ কি হ্যায় কফসমে ইজাদ
ফয়েজ় গুলশনমে ওহি তর্জ়-এ-বয়াঁ ঠহরি হ্যায়।।
(ফয়েজ় সারা বাগান জুড়ে তেমনই আজ বলার ধরণ
যে চলনে হাহাকার আমরা শুরু করেছি খাঁচায়।।)
গায়ে কাঁটা দেয় আমার। সবার আগে চোখে পড়ে এই পাগলামোর জ্বর, এই হাহাকারকে তিনি ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে নিয়ে চলে গেলেন। তদুপরি, ‘পরাজয়ে নিজেরই ভেঙে পড়ার আওয়াজ’ তো নেই-ই, বরং রয়েছে এক সমষ্টিগত উন্মাদনার উত্থান যা অপ্রতিরোধ্য। কাজেই কেন পাগলামোর জ্বর, কিসের জন্য হাহাকার— ইত্যাকার প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ বদলে যায়। বাগানের বুলবুলকে আজ নিজেকে সামলে নিতে হয় না খাঁচার পাখিকে দুঃসংবাদ শোনাতে গিয়ে, বাগানের বুলবুল আজ খাঁচার বুলবুলের কাছ থেকে পাগলামোর যে জ্বর-বার্তা নিয়ে আসে বাগানের সমস্ত বুলবুলের কণ্ঠে তা ধ্বনিত হতে থাকে। বাগানের ওপর যে অধিকার কায়েম করে আছে, তার কাছে এর থেকে ভয়ঙ্কর বিপদ আর কী হতে পারে? এটুকু মোটামুটি গদ্যে ভেঙে বলা যায়, বাকিটা নিখাদ কবিতা, অননুকরণীয় ফয়েজ়।
আরও কাছাকাছি উদাহরণ টানা সম্ভব —
ইয়ে না থি হামারি কিসমত কি বিসাল-এ-ইয়ার হোতা
আগর অওর জিতে রহতে ইয়েহি ইন্তজ়ার হোতা।।
(আমার কপালে ছিল না প্রিয়ার সঙ্গে মিলন
বাঁচতাম যদি আর কিছু কাল এ প্রতিক্ষাই চলত সারাক্ষণ।।)
দেখুন এই প্রতিক্ষার হাহাকার ফয়েজ়ের তর্জ়-এ-বয়াঁ-তে, বলার চলনে, কেমন বদলে গেল—
তেরি উম্মিদ তেরা ইন্তজ়ার জবসে হ্যায়
না শব-কো দিন সে শিকায়ত না দিন কো শবসে হ্যায়।।
(তোমাকে পাওয়ার আশা, তোমার প্রতীক্ষা যেই দিন থেকে
না তো দিনের কাছে রাত্রির আছে অভিযোগ, না দিনের রাত্রির কাছে।।)
কিংবা
তুম আয়ে হো না শব-এ-ইন্তজ়ার গুজ়রি হ্যায়
তলাশ মে হ্যায় সহর কে বার বার গুজ়রি হ্যায়।।
(আসনি তুমি, শেষ হয়নি রাত প্রতিক্ষার
ভোর শুধু খুঁজে ফেরে, ফিরে ফিরে গেল কতবার।।)
মির্জ়ার অন্তহীন প্রতিক্ষার সঙ্গে এক নিরন্তর অদম্য অপ্রতিরোধ্য খোঁজ জুড়ে দেওয়াই সাবেকি শ্রেষ্ঠ উর্দু কবিতার ধারায় ফয়েজ়ের বিপ্লব।
যেতে যেতে এ গজ়লের আশ্চর্য সঙ্গীত-রূপ কানে নিয়ে যেতে পারেন —
https://www.youtube.com/watch?v=8vDwXj0uG-8
(ক্রমশ)
দারুণ দারুণ
I keep waiting for this article.