
ফুটোস্কোপ দিয়ে যতটা দেখি…
পার্থজিৎ চন্দ
কেন ‘ভুলে যাওয়া’কে এত সন্দেহের চোখে দেখে সিস্টেম? কারণ ভুলে না-যাবার যান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে সে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে ভুলে যাওয়া তার কাছে এক থ্রেট। ভুলে যাওয়া আসলে এক অসীম শক্তি; ভুলে যাবার মধ্যে দিয়ে শুরু হতে পারে একজন ব্যক্তি মানুষের অনন্ত বিস্তার, সত্তার প্রসারণ।
জীবনে পাঁচনে গেলার অভিজ্ঞতা কম হয়নি, জীবন আমাদের মতো অনেকের কাছে নিজেই পাঁচন। বাহ্যিক, অতিরিক্ত কোনও উপাদানের দরকার হয়নি প্রতিদিন নিয়ম করে পাঁচন গেলানোর জন্য। হাসির ছলে কান্না মুছতে হয়েছে, কান্না কান্না মুখে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে; পৃথিবীজোড়া হত্যাশালা… পৃথিবীজোড়া বাধ্যতামূলক পাঠদানের আয়োজন। এসব বাধ্যতামূলক পাঠদানের মহা-আয়োজনের মধ্যে আমরা আরশোলা-ছারপোকা’সম। জীবন, বেঁচে থাকা্, গণতন্ত্র ইত্যাদি অনেক বড় ধারণা, নিদেনপক্ষে সভ্যতা-ভদ্রতার কারণেই ‘চয়েস’-এর খুব বড় ভূমিকা রয়েছে। একজন মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার মান নির্ভর করে তার সামনে থাকা চয়েসের সংখ্যার উপর।
আপনার উত্তরদিকে যাওয়ার কথা ছিল; এই ‘কথা’টি কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্মিত হয় আপনার বিন্দুমাত্র ‘কনসেন্ট’ না-নিয়ে। এবার ধরা যাক, এক হেমন্তের সকালে এমন এক রোদ্দুর উঠল, এমন এক হাওয়া দিল, ঘাসের আগায় এমন এক হিরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করতে শুরু করল শিশিরবিন্দু যে আপনার উত্তরের বদলে দক্ষিণে চলে যাবার খেয়াল হল। আপনি হাঁটতে শুরু করলেন এবং অনিবার্যভাবে প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধতা শুরু হল। ‘খেয়াল’ শব্দটি এভাবেই ধীরে ধীরে নেতিবাচক একটি শব্দ, প্রায়-ধ্বংসাত্মক একটি শব্দের মর্যাদা পেয়েছে আমাদের সামাজিক পরিসরে। এই খেয়াল যে আপনার নিজস্ব কোনও ধারা হতে পারে, অথবা এমন একটি পথ যার সৃষ্টি ও ধ্বংস আপনার হাতেই সম্পন্ন হয় এটাই স্বীকার করতে চায় না বৃহত্তর সিস্টেম।
এ পরিসরে দাঁড়িয়ে স্থান-কাল-পাত্র চুরমার করে সংক্রান্ত সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যে সিস্টেম আগাগোড়া ‘অদ্ভুতুড়ে’ তাকে আক্রমণ করবার জন্য অদ্ভুতুড়ে যুক্তি ও পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করাই একমাত্র উপায় বলে মনে হয়।
এই যে পৃথিবীজোড়া পাঠশালা, যে পাঠশালা প্রকৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা নয়; যে পাঠশালা কৃত্রিম ও ভয়াবহ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাড়িকাঠে গলা পেতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। কী শিক্ষা কেন শিক্ষা এ প্রশ্ন শুরুর আগেই আমাদের হত্যা-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আর কে বলেছে যে হত্যা একপ্রকার? হত্যা বহুপ্রকার, বহুমাত্রিক।
সুকুমারের জন্মদিনের সকালে আবার ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’র সামনে বসেছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম ‘কনসেন্ট’ ‘চয়েস’ ইত্যাদির উপর হামলে পড়ছে কালো ভাল্লুক।
মানুষের মৌলিকতাকে হত্যা করবার প্রথম প্রহরে যে আয়োজন সেখানে তৈরি হচ্ছে একটি স্পেস। কীভাবে তৈরি হচ্ছে তা?
সেটি তৈরি হচ্ছে ‘উপভোক্তা’র স্বাধীনতা হরণ করে; এখন সে স্পেস তৈরি হল সেটিকে ভরাট করা হবে কীভাবে? সেটিকে ভরাট করা হবে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ধারণা দিয়ে। এ এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে এসে হত্যাটিকে বেশ পেলব বলে মনে হবে; এমনকি হত্যাটিকে ‘জন্মদান’ ‘শিক্ষাদান’ হিসাবেও গণ্য করতে পারেন কেউ কেউ।
লেখাটি শুরুই হচ্ছে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে, ‘আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে।’ ফুটোস্কোপ মুহূর্তের মধ্যে যে বিস্ময়কর কৌতুক নিয়ে আসে সেদিকে পরে তাকানো যাবে, বা তাকানোর দরকার নেই আদৌ। সব থেকে বেশি নজর দেওয়া দরকার, যে এখানে উপভোক্তা ও তার কনসেন্ট’কে গুরুত্ব না-দেবার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেল। মুখ্য এবং একমাত্র স্বর হয়ে উঠল যে পরীক্ষা করবে তার স্বর।
দ্বিতীয় পঙক্তি’তে এসে আমরা পেলাম, ‘দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে।’ ব্যক্তির অস্তিত্বকে দুমড়েমুচড়ে দেবার জন্য এই পঙক্তির থেকে বেশি ঘাতক পঙক্তি আমি আর পাইনি। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, আপাত হাসির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ডমিন্যান্ট-ফোর্স হিসাবে এখানে যে শক্তি কাজ করছে তার ‘ধরে নেবার’ বিষয়টি। খুব সূক্ষ একটা খেলা রয়েছে এখানে, খেলাটি বেশ অদ্ভুত। একদিকে পরীক্ষা করবার জন্য প্রায় ধরেবেঁধে আনা হচ্ছে ছেলেটিকে, আবার অন্যদিকে পরীক্ষার আগেই ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে যে মগজের ঘিয়ে ভেজালের মেকি রয়েছে। শুধু তাই নয়, পরীক্ষার আগে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, ‘কতখানি ভস ভস ঘিলু কতখানি ঠক ঠকে কাঁপা’।
যে সিস্টেমের কথা হচ্ছিল, সে সিস্টেম যন্ত্রবৎ। গণনায় নির্ভুল, স্মৃতিতে নির্ভুল থাকাই তার অভ্যাস ও পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়া থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি সে সহ্য করে না। ক্র্যামিং বিষয়টিকে শিক্ষাপদ্ধতিতে শুধুমাত্র পরীক্ষার তরণী পার হবার দিক থেকে বিচার করলে ভুল হবে। শুধুমাত্র তথ্য আহরণ করে চলা, দিনের পর দিন এই যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সেটিকেই একমাত্র সার্থক উপায় হিসাবে গণ্য করার মধ্যে সামাজিক শক্তি কাঠামোর চিত্র রয়েছে। সে কিছুতেই এই তথ্যের বাইরে পড়ে থাকা প্রান্তরটিকে স্বীকার করতে চায় না। এই ‘ভুলে যাওয়া’ তার কাছে দ্রোহের সামিল।
কেন ‘ভুলে যাওয়া’কে এত সন্দেহের চোখে দেখে সিস্টেম? কারণ ভুলে না-যাবার যান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে সে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে ভুলে যাওয়া তার কাছে এক থ্রেট। ভুলে যাওয়া আসলে এক অসীম শক্তি; ভুলে যাবার মধ্যে দিয়ে শুরু হতে পারে একজন ব্যক্তি মানুষের অনন্ত বিস্তার, সত্তার প্রসারণ।
ভুলে যাওয়া এক ধরণের স্বাধীনতাও বটে। মনে রেখে দেওয়া যেমন এক শক্তি, ভুলে যাওয়া তার থেকে অনেক বেশি শক্তির প্রকাশ।
আশ্চর্য হয়ে শুধু দেখে যেতে হয়, ‘সাধারণ… নিরীহ’ খেলাচ্ছলে এক পরীক্ষা পদ্ধতির মিধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শক্তি কীভাবে ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠছে। সে কথা বলছে খেলাচ্ছলে; কিন্তু তার প্রতিটি শব্দের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে শাসক অথবা ডমিন্যান্ট শক্তির নির্দেশনামা, ‘আয় দেখি বিশ্লেষ ক’রে- চোপ রও ভয় পাস কেন?’। এই খেলাটি বেশ কৌতুকের, দাঁত-নখ বার করাও বটে। কারণ একদিকে ভয় না-পাবার কথা বলা হচ্ছে আবার একদিকে ‘চোপ রও’-এর পথ ধরে চুপ করে থাকার ফতোয়াও দেওয়া হচ্ছে।
অনন্ত বিশ্লেষণ করবার সময় সিস্টেম অভয় দেয়, কারণ অভয় না-দিলে তার বিশ্লেষণ করবার প্রক্রিয়া বারংবার ব্যাহত হবে। তবে সেখানেও আপনার-আমার সামনে কোনও চয়েস নেই, কোনও বিকল্প পথ গ্রহণ করবার স্বাধীনতা নেই। কারণ তার আগেই আমাদের সামনে ‘চোপ রও’ উচ্চারিত হয়ে গেছে।
কবিতাটির শেষ দিকে শুরু হল সরাসরি শারীরিক আক্রমণ পদ্ধতি, ‘কাৎ হয়ে কান ধ’রে দাঁড়া, জিভখানা উলটিয়ে দেখা।’ অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এখানে যে ‘বুঝে’ নেওয়া হচ্ছে তা তো বিজ্ঞানের হাত ধরে।
স্পষ্ট করে বলে রাখা ভাল, বিজ্ঞান এখানে অজুহাত মাত্র। ‘শিক্ষা’ পদ্ধতিতে মানুষের মৌলিকত্ব ধ্বংস করতে এ ধরণের অজুহাতের অভাব হয় না। পরীক্ষক কেবলই ভাল করে বুঝে নিতে চায়, ‘ভালো ক’রে বুঝে শুনে দেখি বিজ্ঞানে যে রকম লেখা’।
অর্থাৎ বিজ্ঞান একটি স্ট্রাকচার নির্মাণ করে রেখেছে, সেই অ্যকসেপ্টেড প্যারামিটারে অবিরাম নিজেকে প্রমাণ দিয়ে যেতে হবে।
শেষ দু’-লাইনে অ্যবসার্ডিটি আরও স্পষ্ট হয়েছে, ‘মুণ্ডুতে ‘ম্যাগনেট’ রেখে বাঁশ দিয়ে ‘রিফ্লেকট’ ক’রে,/ ইঁট দিয়ে ‘ভেলসিটি’ ক’ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে’।
এই অ্যবসার্ডিটি ঘনিয়ে তোলার একমাত্র উদ্দেশ্য সম্ভবত এতক্ষণ সে সন্ত্রাস চলেছে তার উপর একটু প্রলেপ দেওয়া। এবং কবিতাটিকে আপাত-লঘু করে তোলা।
এবার সব থেকে গূঢ় প্রশ্ন, এতদিন এই প্রশ্নটির সামনে নিজেকে দাঁড় করাইনি। আজ সকালে হঠাৎ আছড়ে পড়ল সেটি; এই যে বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে, সারা কবিতা জুড়ে বিজ্ঞান শিক্ষার যে মহা-আয়োজন, এ শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে কার? ফুটোস্কোপ দিয়ে যার মস্তিষ্ক পরীক্ষা কর হচ্ছে আপাত অর্থে বিজ্ঞান শিক্ষা তার হচ্ছে বলেই মন হবে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা তো হয়ে চলেছে পরীক্ষকের; কারণ তিনিই বারবার পরীক্ষার মাধ্যমে ফলাফল মিলিয়ে নিতে চাইছেন। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ‘উপভোক্তা’ সে আসলে গিনিপিগের ভূমিকা পালন করে চলেছে অবিরাম।
এই গিনিপিগ-তন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে সুকুমার পালাবার পরিসর, প্রশ্ন করবার পরিসর।
এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই প্রশ্ন করবেন ভুরু কুঁচকে ভাববেন, সুকুমার রায়ের লেখা’কে এই বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে দেখা পাঠকের নিজস্ব সত্তার আরোপ তাঁর লেখার ওপর। আপাতত এই ‘আরোপিত’ পদ্ধতি ছাড়া বেঁচে থাকবার সামান্য সামান্য পরিসরগুলি ধ্বংস হয়ে যায়।
দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিকতা প্রশংসনীয় । ভাল লাগলো
খুব ভালো লাগলো।
অপূর্ব ❤️ অপূর্ব ❤️ ওষুধ পেলাম ।