
প্রসূন মজুমদার-এর কবিতাগুচ্ছ
আলোর বিরহবিন্দু
১
তিনি কি আলোকধর্মী?
তিনি কি আছেন নাকি নেই?
তিনি কি আছেন আর নেই?
ফাইনম্যানের ঘরে বসে আছি মনে হয়।
মনে হয় সব কথা বলা গেলে ভালো হতো, তবু
কোনও কথা হল না তখন।
কথা যেই শব্দ পারে তারও বেশি স্তব্ধতায় আমাকে শেখাল।
শেখাল থাকার অর্থ না-থাকাও হয়ে যেতে পারে।
সমস্তই বাস্তবতা সমূহই কল্প-অবাস্তব।
অতঃপর এই রাস্তা পথ হয়ে যদি না চালায়
তবে কি চলার ঈহা,কেবল চলারই ঈহা আমাকে চালাবে?
কতদূর কতদূর কতদূর যাবে?
বিচ্ছুরিত আলোস্রোত আলোকে হারাবে?
২
শ্রোডিঙ্গারের কাছে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকা যায়।
কেবল বেড়ালই নয় প্রত্যেকেই আছে আর নেই।
তবে কি দুঃখও আছে?
যেখানে আমিই আছি এবং আমিই নেই
সেখানে আমার দুঃখ আছে? নাকি নেই?
দুঃখের নিবৃত্তি আছে?
নিবৃত্তির নিবৃত্তি আছে না কি?
আমাদের পথ চলা বাকি।
আমাদের পথ চলা বাকি।
৩
ফাদার লিমেত্রের ঘর। আলো কম। অন্ধকারও কম।
আইনস্টাইনের কাছে এইমাত্র বকা খেয়েছেন।
অঙ্ক দিয়ে সব কিছু মাপা কি ধৃষ্টতা?
ফাদার ওই ফিরে তাকালেন।
সুপার অবজার্ভার তাঁকে দূর থেকে মেপে দেখছেন।
সব ঠিকই মাপমতো কারণ ব্রহ্মাণ্ডে কোনও পরিমাপ নেই।
প্রসারিত… প্রসারিত… প্রসারিত… ক্রম প্রসারণ
শ্রেষ্ঠত্বে বিজ্ঞানী সত্য না মানলেও সত্য কি পালটায়?
অস্ফুটে ফাদার ওই বলে চলেছেন।
ছায়াপথ সরে যায়… সরে যায়… সরে… সরে যায়
বৃহৎ-এর থেকে আরও বৃহৎ – এ সফেন।
৪
ওওই… ওওই… আইনস্টাইন।
একা বসে যুক্তি শানাচ্ছেন।
আলোর গতির থেকে বেশি বেগে ছুটেছে চেতনা।
সময় ক্রমেই যায়, কমে যায়, কমে যেতে থাকে।
তবে কি স্মৃতিরা যাবে?
যাওয়া যায় মাতৃগর্ভে আবার, আবার?
গুটিসুটি থাকা যায় সেখানে কোটরে?
তারও আগে কী ছিল? কী আছে জানা যাবে?
চেতনারা কতদূরে যাবে? চেতনারা কতদূরে যায়?
কিছু কথা তত্ত্বমতো উত্তর মেলেনি ব্যাখ্যায়।
৫
প্রেম ও কলহের দ্বন্দ্বে বস্তুর বাস্তবতা শেষ?
আলো হয়ে জ্বলে আছে এমপিদোক্লেস।
মনে করো সূর্য নেই তবুও রাতের আলো পাই।
আলোর উৎসের সূত্র চন্দ্রালোক হলে?
চোখের গোপন আলো জ্বলে ওঠে, পথ দেখে নাও।
পথ কি চোখের আলো চেনে?
চোখ চেনে আলোকে পথের?
অথচ আলোর কণা, আলোকর সব কণা তাদেরও রয়েছে।
জাগাতে পারলেই সত্য ইলেকট্রন স্রোত।
যখন কোথাও আলো নেই,
গভীর আপন থেকে সেই আলোকণা জাগানো সম্ভব?
প্রশ্নাতীত সব অসম্ভব?
প্রশ্ন আসে, সব অসম্ভব?
৬
এখানে পতঞ্জলি ধ্যানে বসেছেন।
আনন্দবেদনাহীন কী তপস্যা
ভ্রুযুগলমধ্যে তাঁর আলোকে জাগায়?
সেই আলো, সেই রঙ, মনের সকল শক্তি জমে যে মনন
সাধারণ্যে পেতে পারে?
হঠাৎই ঝলসায়? খায় গোপনে পাতার নিচে, কুরে।
লার্ভার মতোন খোঁটে বেগুনি বেদনা-বিষ ।
দুঃখের অনন্ত থেকে কষ্টঢেউ তবে স্তব্ধ হবে?
কবে!
এই উন্মাদনা সে কি দিব্য নয়
যদি না মনের
আলোর আনন্দভার,আলোর বেদনাভার
লুপ্ত হয়, লুপ্ত হতে পারে?
যোগমতে সে বিয়োগ চোখের আলোর প্রবণতা।
শান্ত হই, শান্ত হতে শিখি।
৭
হাসান-ইবন-আল-ফ্যাথাম / আল – হাজেন
ছোট্ট একটা ফুটো দিয়ে মহাশূন্যে চেয়ে রয়েছেন।
চোখ কি সত্যিই দেখে? নাকি সে দেখায়?
সে কেবলই লেন্সমাত্র, রশ্মিরাশি মস্তিষ্কে পাঠায়
তবে কি মস্তিষ্ক দেখে? নাকি দেখে মন?
বিভ্রমসূত্রের যোগে চাঁদ এলে মাথার উপর
দিগন্তের চাঁদ যেন তারও দূরে মনে হয় তবে? দিগন্ত রেখার থেকে মহাশূন্য কাছে হবে! হয়?
সব প্রশ্ন দৃষ্টিভ্রম, ভ্রমদৃষ্টি, ক্ষয়?
৮
এবার হয়েছে রাত্রি, পিয়েরে সিমন লেপ্লাস
কী ভাবছেন? আমি তার তরঙ্গ কি জানি?
সৌরলোক কেঅটিক, তাই সুসজ্জিত।
সম্ভাবনা-ঘাসে ঝরে রহস্য – শিশির।
তবে কি আলোর অন্ত দানবী ব্ল্যাকহোল?
সেই কৃষ্ণগহ্বরের কালোতে যে আলো
তা কি মেখে নেওয়া যায়? নেওয়া যেতে পারে?
কালী এসে দাঁড়ান দুয়ারে।
ক্ষুদ্র হয় বুধ কক্ষ, দীর্ঘ হয় শনি – কক্ষপথ।
কেন হয়? যদি নয় তাহলে কী হবে?
সূর্যের গতির চক্র যেন বা অলাতচক্রে
মণ্ডলের গ্রহগতি করেছে আপোষ
তবে হয় সৌর-সুস্থিতি।
এ অঙ্ক আলোর দান, প্রসন্ন প্রসব অদিতির।
অতএব বিরোধিতা দোষ?
নাকি শুধু শৃঙখলাই অনাদি আফশোস?
৯
আলো কোনও কণা নয়, আলো কোনও ঢেউ নয়
অর্ধ্বনারীশ্বর।
কোয়াসি – কণার স্রোতে কিরিল টলিপগো আজও ভেসে চলেছেন।
তবে কি অর্ধ্বই সত্য? অর্ধ্বে অর্ধ্বে দ্বন্দ্বমধুময়?
আলোর সর্বত্রব্যাপ্তি সত্য মনে হয়।
তাও সত্য কিছু নয়।
তবে যে আলোর জন্ম জন্মে জন্মে আলো বয়ে আনে?
খুঁজে খুঁজে ফেরা দূর ভবিষ্যৎ জানে।
ভণিতার গ্রহে ভূত ভবিষ্যৎ জানে?
১০
‘ক্রোকার’, ‘ক্রোকার’ বলে কোন পাখি ডেকে গেল অই।
ক্রোকার ইউং – রাত্রি, আলো তো খুঁজবই।
আলো কি কণার স্রোত? আলো তো ঢেউয়ের মতো ছোটে
নিউটনিয় অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জেমস ইউং-এর সঙ্গে অতঃপর দেখতে দেখতে যাওয়া
অন্তরের আলো জ্বালো, ‘ক্রোকার’, ‘ক্রোকার ‘ বলে হাওয়া।
অন্তরে আলো কি জ্বলে? ভাবতে ভাবতে গেলে
কপিল সাংখ্যের বিশ্বে সদুত্তর মেলে।
চেতনা তবে কি এত শক্তিমান, যায়
বিজ্ঞানের বহু আগে ব্রহ্মচেতনায়?
শব্দ? না আলোই ব্রহ্ম? পৃথিবী বাড়াল তার গতি
চিরন্তন নয় কিছু, শুধু খোঁজ খোঁজার প্রগতি।
১১
পোলারিটনের বিশ্বে অর্ধ্বকণাঢেউ।
সত্যেন বসুর ঘরে বসে আছে কেউ।
দুহাজার আঠারোর ফোটনে, আড্ডায়
বোসনিক কণা ওড়ে, আলো দেখা যায়।
যা কিছু বৃহৎ – দর্শ, মস্ত – মেটাফোর
রূপকের রত্নমালা স্নায়ুসূত্রে ঘোর
সৃষ্টি করে? তবে আলো অন্ধকার হয়?
অন্ধকারে আলো নেই? তরঙ্গ প্রশ্রয়।
আঁধার রূপকমাত্র, আসলে যে মন
জাগাতে পারে না আলো ঋষির মতোন
তারই বিশ্ব নিরালোক, যদিও সে দেখে
সমস্ত দেখার ভুলে ভ্রান্তি একে একে
গড়ে তোলে অনুমান, প্রত্যক্ষ গড়ে না
যা কিছু পারে না চোখ, যা কিছু পড়ে না
মনে হয় কিছু নেই তবু সবই আছে
মনে হয় আছে কিছু মানুষেরই কাছে
অথচ সমস্ত দৃশ্য কেবলই রূপক
ফলত সত্যের বিন্দু স্তব্ধ কারুবক।
ওড়ে না, ঘোরে না তার মননের জাল
জ্বাল দেয় আদিকণা মস্তিস্কে মাছাল
নেমে যদি মৎস্যজ্ঞানে স্নায়ুরস চোষে
অজ্ঞানের আস্ফালন মরে কোশে কোশে।
এই ক্ষেত্র সমুর্বর আলো জ্বালতে পারে
ছলাৎছল আলোকের বিরহ – বিস্তারে?
১২
আলো কেন জাগে ও জাগাব?
দায়ে বা দায়িত্বে নয়। নিজের খুশিতে জাগে আলো।
এই যে আমাকে এত দৃশ্যমালা দেখাবে, দেখাল
সেসব ঘটনামাত্র অথবা তা নয়।
আমার নিজেরই ইচ্ছে খোঁজায় আমাকে, চায় আলো।
নেমে যেতে যেতে ধীরে শরীরী কণার চকমকি
ঠুকে ঠুকে অন্ধ যায় পেরিয়ে অনঙ্গ অন্ত্র,— ভোর
সেভাবেই পারাপার আড়াআড়ি স্নায়ুসূত্রে ঘোর
জেগে ওঠে? আলো ফোটে, ফোটায় কমলবৃন্তে
দিব্য শতদলে
আপনার জন্য ফোটে
আপনারা অনেকান্ত
জাগে ও জাগার কথা বলে।