
পাবলোর ডায়েরি – আমাদের পৃথিবী, একতরফা সবুজ
সম্রাট সরকার
শুখনো পাতা ঝ’ড়ে পড়ে আছে লক্ষনদাদুর বাগানে। বাগানে হরেক গাছ। আম, কাঁঠাল তো আছেই। আর আছে ভেটুল, লম্বু আর জীবন গাছ। এখন খুব দুপুর। গরমকাল। রোদ্দুর ঠাঁ ঠাঁ করছে। কচি আমের গন্ধ। একটা বেনেবৌ একটানা ডাকছে। গাছের ফাঁক দিয়ে নয়ানজুলির জল দেখা যায়। রোদ্দুরে চিকচিক করছে। জেলেদাদুর ডিঙিনৌকোয় ঘুরে এলাম। বাবা পাড়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। আমাকে নিতে। ডিঙি থেকে নামার কায়দা আছে। আলতো করে নামতে হবে। নাহলে ডিঙিতে জল উঠে যাবে। জেলেদাদুর লুঙ্গি ভিজে যাবে। তারপর অনেক কান্ড হবে। জঙ্গলের আড়ালে ডিঙি ভিড়িয়ে ভেজা লুঙ্গি খুলে শুকোতে দিতে হবে। তখন জেলেদাদুর ল্যাঙট সম্বল। সেই সময় কেউ ডাকতে এলে! জেলেদাদু গামছা নেয়না। কোথায় রাখবে? মাথায় বাঁধলে মাথা গরম হয়ে যায়। কোমরে বাঁধলে একটু পরেই পায়খানা পায়। গলায় রাখলে ফাঁস লেগে যাবে মনে হয়। কাঁধে রাখলে তো কথাই নেই। হাল টানতে গিয়ে জলে। ও গামছা আর পাওয়া যাবে না। জেলেদাদুর কথায় গামছা হল একটা বাঁধন। সামলানোর চিন্তা থাকে। সংসারে কোনো বাঁধন তার পছন্দ নয়। ডিঙি ভিড়িয়ে বাগানে শু’লে ওঠে না। তাস খেলতে বসলে সন্ধ্যে। বিড়ি খেয়ে খেয়ে একসা। বিড়ি ভিজে গেলে বিশাল সর্বনাশ। তাই নয়ানজুলির ধারে ধারে গাছের গোড়ায় গোড়ায় বিড়ির প্যাকেট রাখা। যখন যেখানে থামে বিড়ি খেয়ে নেয়। দিনের শেষে সবকটা প্যাকেট কুড়িয়ে তবে বাড়িমুখো হবে। এরকম একটা গাছের নিচে ফোনটা থাকে। ফোনটা একটা উটকো জিনিস। সন্দেশের প্যাকেটের মত গন্ডাখানেক গার্ডার দিয়ে আঁটা। কোনো ফোন ধরে না। আমি দেখেছি, ডিসপ্লে নেই। শুধু ঝনঝন করে বাজে। বিকেলে একবার ধরে। “আমার বৌমার কল্”। বাড়ি যাওয়ার পথে দুধ নিয়ে যেতে হবে না হবেনা তার নির্দেশ আসে। বাড়িতে মুক্তিবনু আছে যে! জেলেদাদুর সবসময় মুক্তি চাই। তাই নাতনির নাম মুক্তি।
আমি ঢাল বেয়ে পাড়ে উঠছি। বাগানের জমিটা স্পষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে। একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে শুখনো পাতার মেঝে থেকে। বাবা আমার দিকে পেছন ফিরে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে। এই দুপুরে দুটো প্রাণী আগুনে ঝলসে পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে মাথার দিকটা কালো হয়ে গেছে। তবু লেজটা পাক দিয়ে দিয়ে নড়ছে। দুটো চন্দ্রবোড়া। বাবার কথায় ‘রাসেলস্ ভাইপার’। গায়ে চাকাচাকা দাগ। দুটো বউ কঞ্চির ডগায় দাউদাউ আগুনের ওপর ওদের ধরে আছে। বউদুটো পাতা কুড়াতে আসে প্রায়। আজও এসেছিল। পায়ের কাছেই ছিল সাপগুলো। আরেকটু হলেই ছোবল দিত। বাবা বলছিল ‘মেটিং পেয়ার’। পাড়ার লোক কোনো চান্স নেয়নি। পিটিয়ে মেরে দিয়েছে। বাবা একটু বলতে গেছিল। পাত্তা পায়নি। শুনিয়ে দিয়েছে যে নিজের বাড়িতে হলে কি হত? আমার মনে পড়লো সেই চামচিকিটার কথা। নিজের বাড়ি সামান্য চামচিকি ঢুকলে কি হয় আমার মনে আছে। আর এ যে বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া। বাবারও কি তাই মনে হচ্ছিল? বাবা ভাবছিল কাউকে ফোন করা যায় কি না। যদি এসে নিয়ে যায়। ডিম পারার সময় জীবহত্যা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার আগেই আগুনে ঝলসে গেল। মাটির নিচে কবর দেওয়া হল ‘চন্দ্রবোড়া-চন্দ্রবুড়ি’-কে। আমাদের কারোর সঙ্গে বনিবনা হয়না। পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, গাছপালা, নদীনালা – কারোর সঙ্গে না।
“..রাতের আকাশ দেখে
প্রতিরাতে চমকে উঠে ভাবি নক্ষত্রখচিত একটা রাত্রি থেকে
অন্য একটা রাত্রি যেন সম্পূর্ণ আলাদা। বালুচরে একই জ্যোৎস্না
দ্বিতীয় রাত্রিতে আর আগের কুহকমায়া
ছড়াতে আসে না। প্রতি ভোরে মনে হয়,
প্রতিটি দিনের সূর্য প্রতিটি দিনের মত প্রাত্যহিক নয়।“
- কার লেখা বাবা?
- অনেকেই নাম শোনেননি এই কবির! গৌরাঙ্গ ভৌমিক।
- বাবা, আমাদের কারোর সঙ্গে বনিবনা হয় না কেন?
- যেহেতু পাবলো, প্রতিটি প্রাণী প্রতিটি প্রাণীর মত প্রাত্যহিক নয়। এই চন্দ্রবোড়ার জন্য এখন মন কেমন, অথচ আমাদের বাড়িতে এমন বিষধর সাপ ঢুকলে? শুরুতেই বনিবনা হয়না। সময় লাগে। চাইলে পরে হয়।
- কিন্তু বাবা প্রতিটি দিনের সূর্য প্রতিটি দিনের মত প্রাত্যহিক নয় বলেই তো সব নতুন। যদি দেখার দৃষ্টি থাকে।
- ভুল বলোনি। দেখার নতুন মানে শিল্পের নতুন আর সৃষ্টির নতুন। মনের নতুন। যদিও সেটাই সব নয়। অস্তিত্তের কাছে তো কিচ্ছুটি নয়। বরং সমস্যা।
নয়ানজুলির ওপরের সাঁকোটা অনেক উঁচু। দুদিকে ঢালু রাস্তা নেমে গেছে। আমি সাঁকোর ওপর থেকে সাইকেল চড়া শিখতাম। হুস্স্ করে নেমে যেতাম প্যাডেল না ঘুরিয়েই। সাঁকোর দুধারের দেওয়ালে পাড়ার দাদুদের আড্ডা। একজন কথকদাদু আছে। অনেক ঠাকুরের গল্প জানে। কথকদাদুর নাম সন্তোষ। আমার দাদান বলে ‘ডাকাত সন্তোষ’। আগে নাকি গ্রামে অনেক সন্তোষ নাম হয়েগেছিল। কোন সন্তোষ চেনা যেত না। যেহেতু প্রতিটি সন্তোষ প্রতিটি সন্তোষের মত প্রাত্যহিক নয় তাই নামের আগে এইসব শব্দ জুড়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিলনা। তবু হয়েছে। অস্তিত্তের প্রয়োজনে কত কিছু হয়। কথকদাদুর বাড়িতে বহুকাল আগে ডাকাত পড়েছিল বলে ‘ডাকাত সন্তোষ’। তেমনি আমাদের গ্রামে অনেক দুলাল আছে। কেউ কীর্ত্তনদলে গীটার বাজায় তাই ‘গীটার দুলাল’। কারোর মুখটা হাঁ বলে ‘হাঁ-করা দুলাল’। আবার একজনের কাছে এয়ারগান ছিল তাই ‘বন্দুক দুলাল’। সেই দুলালদাদুর এককালে বেলুন-ফাটানো বন্দুক ছিল। হাতের টিপ দারুন। পাখি, বাঘরোল, হনুমান সব এক টিপে মারতো। এখন বাঘরোল, বনবিড়াল নেই। দাদুর হাত কাঁপে। বন্দুকে জং ধরেছে। আর কত মারবে। মারতে মারতে জন্তুগুলোর ওপর মায়া পড়ে গেছে। একবার নাকি একটা হনুমানকে গুলি করেছিল। পেট থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। হনুমানটা ছুটে এসে দাদুর পা চেপে ধরেছিল। ব্যাস, পরদিন থেকে মারামারি বন্ধ। বাড়িতে হনুমানের পাল এলে আকাশে গুলি করত।
হনুমানের পাল আমাদের বাড়িতেও আসত। তখন আমাদের দোতলা হয়নি। দক্ষিণের মাঠ পেরিয়ে পার্থ ডাক্তারবাবুর বাড়ি। তারপর আসাম-বাড়ি টপকে আমাদের কলপাড় ডিঙিয়ে ছাদে। তারপর উঠোনের ফুলের কুঁড়ি ধ্বংস করে দেবদারু গাছের জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তা, সাঁকো হয়ে গ্রামের উত্তর দিকে। একদিন আমাদের দোতলা হল। পাঁচিলে পেরেক বসল। মানুষের পরিবার বড় হলে গাছেদের সঙ্গে বনিবনা কমে আসে। আমি বড় হয়ে যাচ্ছি। আমার আলাদা ঘর লাগবে। অতয়েব দোতলা। দুটো বড় আমগাছ, কাঁঠালগাছ, নারকেলগাছ কেটে ফেলা হল। ওদের খাবার কমল। হনুমানগুলো কিছু না পেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। আমাদের সবজিপাতি, এটা ওটা প্রায় নিয়ে যায়। হঠাৎ কেউ আবিষ্কার করে নিঃশব্দে রান্নাঘরে হনুমান ঢুকে বসে আছে। চিৎকার, চ্যাঁচামেচি। একবার বিস্কুটের বয়াম নিয়ে এক মদ্দা দে ছুট। হলুদের শিশি, দুধের বাটি, জলের বালতি সব লণ্ডভণ্ড। ছুটে বুম্বাদের বাড়ির ছাদে। সবাই তাড়া করতে নিষেধ করল। তাহলে রাগ করে বয়ামটা নাকি ভেঙে ফেলবে। আমি নিচে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। মদ্দাটা এক এক করে সবকটা বিস্কুট শেষ করে বয়ামটা কার্নিশে রেখে পায়ে পায়ে নেমে গেল মরা-যমুনার বাঁশঝাড়ে। যেন তার শুধু খাবারটুকু চাই। বাকি কিছুতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
“বিকেলের একা নৌকা যায়/ শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে।/ চলে যাচ্ছে কোন আঘাটায়:/ আম গাছে কোকিল চেঁচিয়ে
মরে গেল পুরোনো মন্দিরে/ শব্দ ওঠে সন্ধ্যা আরতির;/ পরে ঘন্টা থেমে গেলে ধীরে/ চরাচর জেগে ওঠে স্থির”
-কার লেখা বাবা!
– বীতশোক ভট্টাচার্য।
– কিভাবে স্থির অথচ জেগে ওঠে চরাচর?
– না পাবলো, ধীরে নিঃশব্দ জেগে ওঠার কথা এখানে প্রথম। সমস্ত কোলাহল নিভে এলে। তারপর দেখার স্থির ভাবে জেগে ওঠা পৃথিবীর। যদিও অস্তিত্তের কাছে কিচ্ছুটি নয়।
সন্ধ্যে নেমে আসার আগে ওই বাঁশঝাড় থেকে ঢং ঢং করে একটানা একটা ডাক ভেসে আসে। ওটা নাকি এক পাখির ডাক। রাতচরা। বাবার কথায় ‘লার্জ টেইল নাইটজার’। রাতের পাখি। দিনেরবেলায় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু সূর্য ডুবে গেলে জেগে ওঠে নাইটজার। ডাকে, ওড়ে, পোকা-মাকড় খায়। রাতের আকাশ মুড়ি দিয়ে ঘুমায় দক্ষিণের মাঠ। দমকা হাওয়ার পর পাশ ফিরে শোয় পাটক্ষেত। আমি আর বাবা বসে থাকি আলের ওপর। আমাদের এই গ্রাম। ঝিঁঝিঁপোকা ডাকে। আর কোনো আলো নেই। মাথার ওপর দিয়ে বেগুন, পটলের গাছ বয়ে গেছে অন্ধকারে। আলপথের সাদা মাটি শুধু জেগে আছে। আমি সেদিকে তাকালেই কল্পনার জিপসীটা নেমে আসে পথের ওপর। আলপথ ধরে চালাতে থাকি। পোকা-মাকড় এলোপাথারি লাফ দেয় অন্ধকারে। পাটের জমিতে ঢুকলে মনে হয় করবেটের উঁচু শাল জঙ্গলে এসেছি। রাস্তা থেকে এইমাত্র একটা নাইটজার উড়ে গেলো। সামনে লাউয়ের মাচা। নিচে এবড়ো-খেবড়ো মাটি। ঘাস জমি। একটা নেউল জিপসীর সামনে দিয়ে রাস্তা ক্রস করে চলে গেল। জিপসীগাড়ি লাফাচ্ছে। রাতের মত পা গুটিয়ে বসছে ‘গুলু’। বাবার কথায় ‘বার্ড বাটন-কোয়েল’। পেছনে সরে যাচ্ছে লাউয়ের সাদা ফুল। চন্দ্রবোড়ার পাক খাওয়া লেজের মত লাউগাছের ডগা, শুঁড়। উপরে তাকালে কিছু দেখা যায় না। ঠিক যেন মানসের ছাদ-ঢাকা উডল্যান্ড। আমার ভয় লাগে। বাঁদিকে জিপসী ঘুরিয়ে আবার আলে উঠে আসি। শান্তি! মাথার ওপর এবার তারা দিয়ে সাজানো আকাশ। একটা দুটো বাদুড় উড়ে যায় বয়সা বিলের দিকে। আমি ভাবি ওরা বুঝি ‘মদনটাক’। ‘লেসার অ্যাডজুটেন্ট স্টর্ক’। ওদের ঘর ভেঙে গেছে অনেকদিন আগে সরকার পাড়ায়। ভিটেহারা বাদুড় আস্তে আস্তে ওড়ে। জিপসী থেকে হাত বাড়িয়ে ওদের ছুঁতে মন চায়। আমাকে আরো লম্বা হয়ে যেতে হবে। আর এখন আমি বড় হয়ে যাচ্ছি। মা বলে শুধু বয়স বাড়লে নয়, ভালোবাসলেও নাকি মানুষ লম্বা-চওড়া হয়ে যায়। রাখালদাদু যখন গরুর গায়ে মাছি মারে তখন এরকম লম্বা হয়ে যায়। শেকড়-বাকড় চালিয়ে দেয় গ্রামের জলমাটিঝোপঝাড়ে। তখন মানুষ দয়ালু হয় গাছের মত। আর এখন আমি সেই গাছের মত হয়ে যাচ্ছি। আমার কি আর আলাদা ঘর লাগবে! একটা ঘর মানে তো থেকে যাওয়ার জায়গা। আমার একটা পৃথিবী লাগবে। একতরফা সবুজ। মনের সুখে শেকড়-বাকড় চালিয়ে দেওয়ার ফুরসত পাব। আমি গাছেদের মত লম্বা হয়ে যাব। আর হাজার হাজার পাতার পোশাক পড়ে আমাদের গ্রামে ডালপালা ছড়িয়ে দেব। আমার কোলে, কাঁখে, বুকে, পিঠে, কাঁধে, মাথায় সকলের থেকে যাওয়ার জায়গা হবে। মদ্দা হনুমান ঠেস দিয়ে বসবে দুপুরবেলা আমার গায়ে। বাবা দেখবে, তার পাবলো দোতলায় নয়, চারতলা সমান গাছ হয়ে ছায়া এনে দিচ্ছে আমাদের উঠোনে।