নির্ঝরের স্বপ্ন <br /> কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য-র ‘আমোচু’-র পাঠপ্রতিক্রিয়া <br /> রণবীর পুরকায়স্থ

নির্ঝরের স্বপ্ন
কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য-র ‘আমোচু’-র পাঠপ্রতিক্রিয়া
রণবীর পুরকায়স্থ

আমোচু নিয়ে লেখা হবে বিস্তর, পাঠ্য হবে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আমোচু পাঠের নির্যাস, তার সুবাস চিরস্থায়ী করে রেখেছেন লেখক তার গ্রন্থবিন্যাসে। । ‘উত্তরকথন’ নামের বোধিনী যে জুড়ে গেল বইয়ের শেষে, সে এক অমূল্য কথন। তপোধীর ভট্টাচার্য তার ভারতবাক্যের শুরুতে লিখেছেন, ‘গর-ঠিকানা এই বয়ানের উৎস প্রত্নকথাশ্রিত পরিবেশ বিদ্যায়।’

“আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা;…”

“আমোচু বয়ে চলেছে। দক্ষিণ তিব্বতের দশ হাজার ফুট উঁচু চমুলহরিতে তার জন্ম। তাকে চার/পাঁচটি সেপিয়ান অধ্যুষিত দেশ আর জাতি নিয়ে নদী কূটনীতি চালিয়ে যেতে হয়। কম বেশি দু-শো মাইল পাহাড়-সমতল পেরোতে পেরোতে তাকে যেমন ছ-লক্ষ কিউসেক জল সাগরকে দিতে হবে তেমনি তার লক্ষ ত্রিশ লক্ষ টন পলিমাটি। যা তাকে যেনতেন প্রকারেণ পদ্মায় ফেলতে হবে।”

‘এই যে সেপিয়ান, তাকে সেপিয়ান করে তুললো কে? নদী আবার কে?’

‘তাদিংদঙ পাশাখা উপত্যকার এখন নতুন নতুন নাম, নতুন নতুন ভাষা। এসব বুঝতে গেলে আমোচুকে, চমুলহরিকে বারবার জানতে হবে চিনতে হবে।’

মূঢ় সেপিয়ানদের সব কিছুর জবাব চাই, কিন্তু উপন্যাসের জবাব তো ভিন্ন, আখ্যানের জবাব হল প্রশ্ন, প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে দেওয়া পাঠককে, সমাজকে, সেপিয়ান সর্দারকে। তাই হয়তো ‘আমোচু’ নামের এক আণবিক শক্তিধর উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদেও কিন্তু সেই প্রশ্নই রেখেছেন আখ্যানকার। প্রথা ভেঙে উত্তরও একটা দিয়েছে, যা তার দেওয়ার কথা নয়, আসলে জবাব তো আর জবাব নয়, চাবুক। প্রতিপ্রশ্ন। ওই শেষ লাইনে মোক্ষম কথাটি বলে দিয়েছেন কথাকার। বলেছেন সুক্ষ্ম এবং স্বল্প পরিসরে, পাঠকের নব রচনার জন্য কিছুই যেন আর রইল না। উপন্যাসের উপরিতলে কথকের চাতুর্যে কখন যে বহিরাগত সেপিয়ান কূটনীতির জালে ভূ-প্রকৃতি আটকা পড়ে যায়, দুর্দশার দায় গিয়ে পড়ে নদী জপমালা ধৃত প্রান্তরে। ঝিকে মেরে বৌ-শিক্ষার এই অভিনব পাঠ পাঠককে আলোড়িত করে।
মহাদেবের জটা থেকে উৎপত্তি হওয়া এক নদীর নাম ‘আমোচু’, টেথিস সাগর ভেঙে যে উলটপালট হল পাঁচ কোটি বছর আগে, সৃষ্টি হল নগাধিরাজ হিমালয়ের। হিমালয়ের সিত পাথর ভেঙে তিব্বতের মালভূমি হয়ে ভুটান দার্জিলিং হয়ে থিতু হল মাদারিহাট সংলগ্ন তাদিং পাহাড়ের কোলে। আদরের তাদিংদঙে পৌঁছতে হলে জাতীয় সড়ক ৩১এ তালা লাগিয়ে নিষিদ্ধ দেশ টোটোপাড়ায় প্রবেশ করতে হয়। উপন্যাসকার কোথাও টোটোপাড়ার কথা সরাসরি বলেননি বরং মিত্রাংগাওয়ের কথা বলেছেন বার কয়েক। টোটোদের কথা স্পষ্ট করে বললে যে সংঘ ভেঙে যাবে, উপন্যাসের প্রকরণ ভেঙে যাবে। উপন্যাসের কুশীলব নির্মাণে উপন্যাসকার কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রাণিজগতের সুসভ্য প্রজাতিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন দৃশ্যত, যদিও উৎসুক পাঠক জানেন জড় জগতের ভারসাম্য নষ্ট করতে মানবসমাজে চক্রান্ত কেমন কার্যকরী। তাই যখনই নদী ফেডারেলিজমের দোহাই দিয়ে বেচারি নায়ক আমোচুকে খলনায়কের তকমা দেওয়া হয় তখনই প্রকাশ্যে এসে যায় কথকের অভিসন্ধি। এক মধুর চিয়ারুস্কুরু রচিত হয় মানবকে দূরত্বে সরিয়ে রেখে। আলো-আঁধারিতে ঘোষিত হয় মোক্ষম প্রশ্ন, সমাপনের অঞ্জলি,
“এই যে সেপিয়ান তাকে সেপিয়ান করে তুললো কে? নদী আর কে?”
বাঙালির এক বিজ্ঞানী গবেষণা করেছিলেন যে গাছপালা উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে,এবং তা প্রমাণও করেছিলেন। নদীকে দেখে তিনিও প্রশ্ন করেছিলেন,
‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? মহাদেবের জটা হইতে।’
মহাদেবের জটা থেকেই উৎপত্তি এই আশ্চর্য উপন্যাস-নায়ক, ‘আমোচু’র। হিমালয় সানুদেশ থেকে উৎপন্ন নদীর কত রূপ, কখনও সে মা নদী কখনো মেয়ে কখনও পিতা কখনও পুত্র। আমাদের ‘আমোচু’ পিতা নদী, তার অনেক সন্তান-সন্ততি। উপন্যাসের শুরুও তাই গৃহস্থ আমোচুর এক নামহীন সন্তানের কথা দিয়ে,
“আমোচুর ছোটো ছেলে এখন আগের চেয়ে অনেক বড়ো হলে কী হবে? এখনও তার নাম পাবার সময় হয়নি। নাম কী অত সস্তা? জন্মেই নাম পেতে হবে নাকি? জীবনের একটা সময় সেটা পেলেই হল। আমাদের কত লোকের নাম নেই। কত লোকের ঠিকানা নেই। কত জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, কত কিছুর ইতিহাস নেই। কত লোকের একটা ফটো পর্যন্ত নেই, কত লোক জীবনে রেল চড়েনি, সিনেমা দেখেনি।”
এই বর্ণনা থেকে কী প্রতীত হয়, মনে হয় যে কথাসাহিত্যিক কৃষ্ণপ্রিয় তার কবিত্বশক্তি উদ্ভাসিত করলেন। আসলে উপন্যাসের ধরতাই প্রথম পরিচ্ছেদেই। নদীতে মানুষে ভেদাভেদ সরিয়ে দেওয়া, জড় পৃথিবীর সঙ্গে প্রাণের মিলন ঘটিয়ে দেওয়া। আমোচুর ছোটো ছেলের সঙ্গে লোকের সম্পর্ক তৈরি করা, ঘরের ছেলে হিসেবে আমোচুকে প্রতিষ্ঠা করা ।
স্থান-কাল-পাত্র না হলে যে কথা হয় না, আখ্যান সজ্জিত হয় না। নদী আর তার ছানাপোনার কথা দিয়ে শুরু হয়েছে কথা বয়ন এক অপরূপ ভঙ্গিতে, যে ভঙ্গিমা বাঙালি পাঠক এর আগে পড়েনি। যদিও নদীকে মাতৃজ্ঞান করা বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম অভিজ্ঞান। বাড়ির দস্যি মেয়ে ভাবনায় রচিত হয়েছে পদ্মা তিতাস তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, এবার পুরুষ নদীকে ঘরের ছেলে, নায়ক হিসেবে পাওয়া অভিনব বটে। আমোচু অববাহিকার কথা সাতকাহন করে বলেছেন কথক , সাজিয়েছেন চিত্রাঙ্গদা সাজে। কিন্তু যাকে নায়ক করলে নিদেনপক্ষে সহনায়ক করলে অতি সহজ হয়ে যেত চলন, সেই নৃগোষ্ঠীকেই মেঘনাদ প্রতিপক্ষ সাজিয়ে রহস্য দিয়ে ঢেকে দিলেন মেঘালয় উপত্যকায়। বরং এতে ভালোই তো হল, উপন্যাসের কিছু নির্ণয় সহজ হয়ে গেল, স্থানও হল পাত্রও হল এক নামে, এক টিকিটে হয়ে গেল দুই ভ্রমণ। উপন্যাসের প্রচলিত ধারা ভেঙে সেপিয়ানরা থেকে গেল অ্যামবিগুয়াস না-কুশীলব হয়ে। অপূর্ব নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞায় কবি সৃজন করেছেন অবলা জড় জোড়া পাহাড়তলীকে। হিপসা পদুয়া নামে পাহাড়ি পুরাণের দুই অভিভাবক। কথক হাত জোড় করে বারণ করেছেন সেপিয়ান শক্তিকে, বলেছেন যথেষ্ট হয়েছে, এবার নদী বাঁচাও গাছ বাঁচাও পরিবেশ রক্ষা কর নিম্ন হিমালয় রক্ষা করো। কড়া ভাষায় বলেছেন, বাউন্ডুলেপনা করবি তো ইণ্ডিয়ার মাটিতে কর। স্তেপভূমি রক্ষা কর।
আমোচু নামের নদ যেমন নায়ক তেমনি তার সহনায়কও একজন, লাম্পাতি নামের এক গাছ পাথর । নায়ক মানে প্রধান পাত্র যেমন আমোচু লাম্পাতি তেমনি আমোচু বিধৌত তাদিং, আমোচুর অববাহিকায় নির্মিত হয়েছে স্থান, মানে আবার সেই নদী জপমালা ধৃত প্রান্তর। হিমশৈলের নিচে লুকিয়ে রাখা সেপিয়ানও তো আছে পরতে পরতে, স্বাভাবিক কৃষি জীবনকে বিনষ্ট করার কারিগরই কি মূল বিরোধী শক্তি, আমোচু লাম্পাতির প্রতিদ্বন্দ্বী।
হিংটিং ছট হয়েও কেমন নিয়ম মতে চলার শপথ নিয়েছে উপন্যাস। আখ্যান তো একটা রচিত হয়েছে,অবিকল উপন্যাস একটা হয়েছে কী না সে ভিন্ন প্রশ্ন। তাই কি তপোধীর ভট্টাচার্য আখ্যানের মর্যাদা দিতে একটু হলেও কুণ্ঠিত থেকে মহা আখ্যানের মর্যাদা দিয়েছেন আমোচুকে । আসলে আখ্যান না মহা আখ্যানের কূটতর্ক বিনিশ্চয় করবে কে। মহামতি পাঠকের কাছেই বরং থাকুক মন্ত্রগুপ্তির শর্ত, না হলে যে তক্কে তক্কে রাত গড়িয়ে যাবে, বলা হবে না ২০২০র জুনে ‘মল্লার’এর ফেসবুক পাতায় ছাপা ছ’শো শব্দের এক বিস্ফোরণ কথা। রাই কুড়িয়ে বেল, সেই ছোট্ট আমোচু যে এখন বিয়াল্লিশ পাতার ডাগর আখ্যান। আখ্যানের পরতে পরতে কত কথা, কাছে থেকে কত দূর রচনা। “তিব্বত থেকে শুরু করে ড্রুকউয়েল,দেজংলরি,দামসাঙ ,মোরাঙ, ইণ্ডিয়া,অবিভক্ত পাকিস্তান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার” সবার প্রিয় আমোচুর ভয়ংকর প্রতিশোধের কথা, আফটারশকের কথা। হিমালয়ান নদী-কূটনীতি থেকে আন্তর্জাতিক সেপিয়ান-কুটনীতির কবল থেকে উদ্ধার কর্তা বজ্রগুরু পদ্মসম্ভবের আশীর্বাদধন্য সেই নদীর কথায়ই বরং ফিরে যাওয়া যাক আবার।
একটি নদী যার নাম মোচু, তারপর আমো চু হয়ে ঢুকে পড়ল হিমালয়ের পাদদেশে তাদিং দেশে সমতলের পলিবহন করার জন্য, ডাকনামে তোর্সা বললেই তাদিং দুলালী সমাধিক পরিচিত। কোথাও কন্যা কোথাও দুলাল, এও এক ভিন্ন নদীকথা। সহায়ক হয়ে আমোচুর অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এক উদ্ভিদ রাজা, এক অশ্বত্থ গাছ লাম্পাতি। তিস্তাপারেও কি দেখা গেছে এই মহীরুহকে, বাংলাসাহিত্যে অনেক নদী অনেক বোধিবৃক্ষ। কৃষ্ণপ্রিয় কথক উপন্যাস রচনার মাপকাঠি ভেঙে চুরমার করতে গিয়েও বলেছেন, নমি আমি কবিগুরু তব পদাম্বুজে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন দেবেশ রায়কে,বাংলা সাহিত্যের অনন্য নদী-কথক,ভাষাচিহ্ন ব্যবহারের অনুপম জাদুকরকে।
তা বলে তিনি ইউরোপীয় বিন্যাস কি একেবারে ত্যাগ করেছেন কথা বয়নে, লাতিন আমেরিকা দেশের মতো ম্যাজিক ট্যাজিক তো আছে নদী ফেডারেলিজমে। টাইম-স্পেসের জাদু-খেলাও আছে। আবার মানুষ বিদ্যার ছাত্র হয়ে মানুষকেই হালুম করেছেন বারবার, তাই সেপিয়ান বলে বলে রহস্য মোডে আঘাত করেছেন, সেপিয়ান দৈত্য গড়েছেন। কিন্তু গন্ডোয়ানা রাজ্যে তো সেপিয়ান ছিল না আদিতে, আদিতে ছিল, চু। চু কি জল, না নদী। হোক না অম্বু কিংবা অম্বুবাহী, জীবনের শুরু তো জল থেকেই। জল ছিল বলেই সাগরভাঙ্গা। মাটি, মাটি পাথর, মাটি ফুঁড়ে বেরোনো উদ্ভিদ লাম্পাতি। উদ্ভিদরাজ লাম্পাতির সম্মান অপ্রতিহত তাদিং সাম্রাজ্যে। যদিও আদরে বারবার বলা হয়েছে বুড়ো। রবীন্দ্র নাটকের ঠাকুরদার মতো। দাদামহাশয় এর একপাশে হিপসা আরেকপাশে পদুয়া পাহাড়। আর আছে দুই উপনায়ক উপনায়িকা। দুই ঢোল কুমার টোল কুমারী। সাইঞ্জা আর ইশপা। ওদের বিয়ে হয় বর্ষাশেষে, হয় বর্ষবরণ। অবশ্য এর মধ্যেই মণি মুক্তোর মত সেপিয়ান অলংকারে সাজানো হয়েছে নদী উপত্যকা। প্রকরণ ভেঙেছেন যেমন গড়েও দিয়েছেন অভিনব বিন্যাস, সেপিয়ান জগতের সাম্রাজ্যবাদী বসতিকথা স্বল্পবয়ানে বিধৃত । প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের অভিপ্রয়াণ কথা, এক্সোডাস কথা গেছে কামরূপে, গোসানিমারিতে নেপালের মরাঙ প্রদেশে। অমিয়ভূষণও এক এক্সোডাসের কথা লিখেছিলেন ‘উরুণ্ডি’ গল্পে। ঝুমপ্রথা, কার্পাস চাষ, এণ্ডিচাষ সিল্ক উৎপাদন যে বন্ধ হয়ে গেল ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে। ভূমির ভারসাম্য নষ্ট হলো। তাই কি কথক ক্রুর বিদ্রূপে জানালেন,
“এমনকি মঙ্গল গ্রহে তো এখন তাদিংদঙ এর পরিচিতি চায়ের দেশ হিসেবে”
কিংবা অবজ্ঞা আরো তীব্র হয় যখন বলেন,
“নয়া সেপিয়ান প্রজন্মের কেউ অতীত জানেনা। হয়তো তাদিংদঙের পুরনো কথা জানে, এখানকার প্রাচীন জোঁক, টিকটিকি আর আরশোলা।”
আবার সেই প্রাচীন কালে ফিরে যাওয়া। আবার মিসিং লিঙ্ক ফিরে পাওয়া। উপন্যাসের তিন প্রধানের দুজন তো জিতে নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ। স্থান ও পাত্র নির্ণয় হয়েছে একই পাত্রে একই স্থানে। এবার থাকল কাল নির্ণয়, কাল মানে পাঁচ কোটি বছরের ভ্রমণ।টাইম-স্পেসের মিরাজে বিশ্বভ্রমণ। টেসিথ সাগরের আলোড়নের কাল থেকেই আছে আমোচু, আছে লাম্পাতি, উদ্ভিদ জন্মের আগে লাম্পাতি ছিল পাথরবুদ্ধ । ভূগোলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়েছে আমোচু, সবুজ সাভান্না পেয়েছে বলেই কী সাম্রাজ্যবাদ এখানে চা বাগান করতে পারল। লাম্পাতিদের সম্পর্ক এখানে খুব মধুর ছিল না বলতেই হবে, কারণ ঘাসের স্তেপ কমিউনে গাছেরা হয়েছিল সংখ্যালঘু। কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেত শুভ্রবসনা নববধূ চমুলহরি আমোচুর ধাত্রীদেবতা। নদীর উদয় যেখান থেকেই হোক, নদীর ইতিহাস নদীর জীবন যে সেপিয়ানদের মতো ক্ষণস্থায়ী নয় এমন দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এই মহাগ্রন্থে। বিপ্রতীপে নদী ধ্বংসেরও কথা বলা হয়েছে, কাপাসি আর টাঙ্গিয়া আমোচুর প্রিয় দুই সন্তানও তো হারিয়ে গেল। কিন্তু নদীর গলায় বকলেশ লাগানোর পরম্পরা তো এশিয়া মহাদেশের নয়। ইউরোপীয় প্রযুক্তি বিকাশের হাত ধরে এলো এই সেদিন, একশ বছরও হয়নি। কার্পাসবন নির্মূল করার সাম্রাজ্যবাদী কূটবুদ্ধি জানিয়ে দেয় বাঁচতে হলে অর্থকরী চাষাবাদ করতে হবে। মুনাফাই একমাত্র মূলধনের উপর কাঁঠালি কলা। তাই প্রাকৃতিক শালবন রাতারাতি বদলে যায় ভিন্ন ফসলে। ইচ্ছেমতো ধান গম ভুট্টা চাষ বন্ধ হয়ে যায়, ইচ্ছামত গবাদি পশু পালনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই রকম হয়েছিল আসামে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন গড়ে উঠেছিল চা-বাগান। সেখানেও ছিল সাভানাভূমি, সেখানেও শোষণ একইরূপে প্রকট হয়েছিল। গোটা উত্তরপূর্বের পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ঝুমচাষের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের এবং পরবর্তীতে উত্তর-উপনিবেশবাদী শোষণের নির্মমতা, পাঁচ ঝুমিয়ার নির্মম হত্যা আর প্রতিবাদ। নদীর কথা তবে কোথায় গিয়ে পৌঁছলো, নদীর কথায় নদী থাকে অবিরত, কিন্তু নদী শেখায় প্রতিবাদ। আমোচুও থাকে অবিকার তার প্রতিবাদের ভাষায় স্থির। প্রশ্নের পর প্রশ্নে পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার এই বিন্যাস হারিয়ে যাওয়ার নয়। তাই হয়তো মোক্ষম প্রশ্ন করেছেন লেখক তার নির্বাচিত নায়ক আমোচুকে,
“এভাবে তো একদিন তাদিংদঙ আমোচু কাপাসিকেও ক্যানডিসের মতো লেলিয়ে দিয়েছিল, হারিয়েও ছিল তাকে। লাম্পাতিও তার সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি। এবার কী বলবে আমোচু?”
আমোচু নিয়ে লেখা হবে বিস্তর, পাঠ্য হবে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আমোচু পাঠের নির্যাস, তার সুবাস চিরস্থায়ী করে রেখেছেন লেখক তার গ্রন্থবিন্যাসে। । ‘উত্তরকথন’ নামের বোধিনী যে জুড়ে গেল বইয়ের শেষে, সে এক অমূল্য কথন। তপোধীর ভট্টাচার্য তার ভারতবাক্যের শুরুতে লিখেছেন,
‘গর-ঠিকানা এই বয়ানের উৎস প্রত্নকথাশ্রিত পরিবেশ বিদ্যায়।’
এই তো আমোচু পাঠের সার কথা, এরপর আর কোনও বয়ান হয় না। তবু লেখা হবে, লেখালেখি হবে, পাঠক লেখককে আবদার করবেন আমোচু বিধৌত তাদিং নিয়ে বিস্তৃত কথাবয়ন হোক, পাঠক নিষিদ্ধ পাঠে পারগ হয়ে উঠুক।
বইয়ে অনেক ইংরেজি শব্দ, শব্দ না ইডিওম হয়তো, তাই সুপ্রযুক্ত। অনেক অপরিচিত স্থান নাম, নামের উৎস সংক্ষেপে বিধৃত হয়েছে। ক্ষুদ্র উপন্যাস বলেই কি আভাসে ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেছে, সব মিলিয়ে কিছু ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে পাঠক মনে, লেখকও কি বাদ পড়েছেন। আর ধাঁধার ধর্ম হল কালের দৃষ্টিসমুখ থেকে হারিয়ে যাওয়া। আমোচু ধোয়া তাদিংদঙ এর ছবিটিও সাংকেতিক।
এক বিখ্যাত লেখক তাঁর দীর্ঘ আখ্যানে শতাধিক ধাঁধা খুঁজে পেয়েছিলেন উত্তরকালে। এবং স্বীকার করেন সময়ের সাথে সাথে অনেক ধাঁধার অর্থ তার মন থেকেও হারিয়ে গেছে, এখন আর তিনি মর্মোদ্ধার করতে পারেন না। । আমোচুর রিডল গুলিরও একটা মানে-কথা সংযোজিত হোক না উত্তরকথনের পদাশ্রিত হয়ে। সাধারণ পাঠক ধন্য ধন্য করুক। অবশ্য মানে-কথা না জানলেও পাঠে ব্যাঘাত ঘটবে না নিশ্চিন্ত,কিন্তু পাঠক নিশ্চিন্ত হবে। শেষ বলে কিছুহয় না জেনেও একটা আপাত সমাপনে যেতেই হয়, বলতে হয় ধন্য ধন্য। চমুলহরিপুত্র আমোচু সৃষ্টির জন্য বাঙালি ঔপন্যাসিক কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য মহাকালের ধন্যবাদ প্রাপক হয়ে থাকলেন। অনাগত বৃহত্তর সম্মানের দাবীদারও তিনি।

আমোচু /কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য (উত্তরকথনঃ তপোধীর ভট্টাচার্য)/
চিন্তা / কলকাতা/ নভেম্বর ২০২১/ ২০০ টাকা।

*

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes