
নারী, দেবী এবং দেবীপক্ষ
বেবী সাউ
ধীরে ধীরে অতীত ফিরে আসে। কয়েক শত বন্ধন থেকে, নিয়মকানুন ভেঙে মুক্তি আসে ফিরে। কত কত বছরের অপেক্ষা যেন। কত কত সময়ের প্রাচীর। প্রিয়জনের কাছে ফেরা। প্রিয় উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে দেখে নেওয়া একবার। এসব নিয়েই যেন আমাদের মহালয়া। স্নেহ এবং ভালোবাসার তৃষ্ণা নিয়ে কত কত দিনের অপেক্ষা। এইযে ফেরা শুরু হলো মহালয়ার দিন, এবার থেকে পরপর মা আসবেন, ছেলেপুলেরা আসবে। ঘরে শস্য আসবে। গোলাভরা ধান। বৃষ্টি জলে জল থই থই পুকুরে ভরা মাছ। এই লোকাচার এবং আমাদের উৎসব কী সুন্দর ভাবে ওতপ্রোত জড়িয়ে দিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আর সঙ্গে ভবিষ্যতের খাদ্যশস্য ভরা, জলভরা এক পৃথিবীর স্বপ্ন এঁকে দিলেন আমাদের চোখে, এই যেন আমাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যের রূপ। প্রতিটি নিয়মই জড়িয়ে থাকার, জড়িয়ে রাখার। একে অপরের কাছে, সুখে দুখে সঙ্গী হয়ে ওঠা। ভালোবাসা, স্নেহ, প্রেম এবং ভক্তি যেখানে মিশে যায়, সেখান থেকেই বোধহয় শুরু হয় এক সুন্দর সমাজব্যবস্থার।
আবার এরমধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় গ্রামবাংলার এই দরিদ্র রূপটিও। দেখা যায়, দেবীদুর্গার সাধারণ ছবি আঁকা কোনো এক উঠোনে গেরু পাথরে লেখা—
” শিবের বউ শঙ্করী
শাড়ি আছে শাঁখা নাই
মুড়ে তার সিঁদুর
বুড়ার হাতে ত্রিশূল”
তখন একের পর মোটা মোটা বই মার্ক্সিজম, ক্যাপিটালিজম, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা কূটনৈতিক চালকে মনে হয় বহু পুরোনো। এই দু’টো লাইনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল এক দেশের ছবি ফুটে উঠে কী সুনিপুণ ভাবে!
এইযে দেবীপক্ষের সূচনা, তা তো পুরুষজাতিকে উপেক্ষা করে নয়, বরং এটাও সমাজকে একটা বার্তা। নারীশক্তি, আদ্যাশক্তি। ছোট করে, অপমান করে দেখো না তাকে। সে মা। তোমার জন্মদাত্রী, আশ্রয়দাত্রী দরকারে ধ্বংসকারীও বটে। ভেবো না, পার পেয়ে যাবে। দশমাস গর্ভধারণে তোমাকে সে নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে আবার তোমার অনাচারে, অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে তোমারই মালা। তখন তো আর মণিপুর সৃষ্টি হয় না। হয় না কামদুনির লজ্জা। আমরা তো এভাবেই খুঁজে নিই আমাদের সংস্কৃতিকে। সুন্দরের হাত ধরে অসুরকে হারিয়ে জিতিয়ে দিতে পারি মানবিকবোধকে। যে বোধের হাত ধরে তুলে আনতে পারি এক সুন্দর ভারতকে। সহনশীল, বিবেকবোধে পরিপূর্ণ এক সমাজব্যবস্থাকে। একেকবার মনে হয়, আমাদের সমাজে এত এত জ্ঞানী, বোধসম্পন্ন মানুষ অবস্থান করেন তারচেয়ে কী অসুরের সংখ্যা বেশি? মোটেও তা না। সাধারণ মানুষ শান্তি চান, সহাবস্থান চান, আবেগ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান — আর চান নিশ্চিন্ত একটা জীবন। খুনী হত্যাকারীর সংখ্যা থাকবেই, থাকুক তা বলে কী চেঞ্জ করা যাবে না পৃথিবীকে? এই তো নাইজেরিয়ার শাসনব্যবস্থা দেখি। কই অসুবিধা তো হয় নি পরিবর্তনের। রাষ্ট্র চাইলেই পরিবর্তন সম্ভব, মানুষ চাইলে সবকিছু সম্ভব।
গ্রামবাংলায় দুর্গা এক মেয়ে। দুর্গা এক নারী। দুর্গা এক স্বামীসোহাগিনী প্রেমিকা। ভরা সংসার তার। তা বলে ঐশ্বর্যের রানী নন। অভাব আছে, অনটন আছে। সুবর্ণরৈখিক ভাষায়, দুর্গা ষষ্ঠীর দিন একটি ছড়া দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে দেওয়া হয়—
“দেবী দুর্গা ঠো ঠা
মাড়া পিঠা বড় মিঠা”…
সামান্য একটা লাইন। সামান্য ক’টা শব্দ। কিন্তু কী তাৎপর্যপূর্ণ! কী সুন্দরভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থানটিকে তুলে ধরা হয়েছে এর মধ্য দিয়ে! দেবী এবং দুর্গা— দুই বোন কিংবা দুই সতীন। তারা একসঙ্গে থাকেন। ঠো ঠা মানে শব্দ। কেমন শব্দ? না আর যাইহোক মধুর নয়। সারাদিন ঘরে হয়ত ঝগড়া ঝামেলাও আছে। অভাবের সংসারে এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তারা তাও একসঙ্গে থাকেন। ধান থেকে চাল বের করেন, চাল থেকে চালের গুঁড়ো তারপর তারা অতি সাধারণ অতি কম আয়োজনে বানাতে বসেন মাড়া পিঠা। এই মাড়া পিঠা জলে সেদ্ধ। দামী কোনো রিফাইন্ড তেল লাগে না তার। আখের গুড় দিয়ে পুর বানানো হয়। চালের গুঁড়োর সঙ্গে জল মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা ঘন মাড়। তারমধ্যে পুর দিয়ে বানানো মাড়া পিঠা জলে সেদ্ধ করা হয়। এই তার প্রসাদ। এই হল পুজোর নৈবেদ্য। সহজ, সরল, সাধারণ এবং পুষ্টিকর।
শিউলি ফুলে ভরে উঠেছে লাল মোরামের পথ। মাঠে মাঠে সোনালি শিশে মাথা দোলাচ্ছে শস্য খেত। পুকুর ডোবায় প্রতিচ্ছবি ঘন নীল আকাশের আর সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠেছে সাদা গোলাপি শালুক পদ্ম। প্রকৃতিও যেন সেই অতীত এবং বর্তমানের খেলায় মেতে উঠেছে। কাশের ফুলে নেমে এসেছে আকাশ আবার ভরা নদীর ছাপ ভাসছে আকাশে ঘন নীলে। মুগ্ধ এবং পুলকিত হয়ে ওঠে মন। আর পথে দৌড়তে দৌড়তে ধূলিধূসরিত কোনো বালক, গাইতে গাইতে বলে
“শিবের জটা, শিবের জটা
তার মুড়ে কাঁঠাল পাতা
দুর্গা, তোর বর কাই?
বরের নাম ন্যাংটা বাবা!”
এই দুর্গা রাজকীয় পোশাকের, ঝলমলে শাড়ি পরিহিতা, সরকারের টাকায় লক্ষ লক্ষ টাকার গয়না পরিহিতা কোনো গম্ভীর নারী নয়। এ যে আমাদের গরীব দুর্গা। যে রথের মেলা থেকে কিংবা মকরের মেলা থেকে ভাইয়ের জন্য দু’টাকার জিলিপি কিনে দেবে বলে সারাবছর টাকা জমায়। এই দুর্গা বিভূতিভূষণের রোগে ভোগা পাতলা লিকলিকে মেয়ে। তার বরও তেমন। ছেঁড়া গামছা হয়ত পরে থাকে কিংবা রুখা শুখা অযত্নের চুলে আটকে থাকে ঝরে পড়া কোনো পাতা। আমি ছোটবেলায় দেখেছি এক ছোট্ট মেয়ে, তার নাম দুর্গা, তাকে যখন এই ছড়াটি বলে আমরা সবাই ক্ষেপাতাম সেও লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠত, বড় বড় চোখে তাকাত আমাদের দিকে, তখন সেই মুখে যেন এসে পড়ত শারদপ্রাতের গভীর, স্নিগ্ধ হলুদ রোদ। কেন জানিনা, আমার তাকে সত্যি সত্যি দুর্গা মনে হত। মনে হত, বহু বহু যুগ থেকে অতীতের পিতৃপুরুষেরা তাকে শক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে রণকৌশল দিয়ে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন তাকে। যাতে সে ভবিষ্যতে হয়ে ওঠে এক পরিপূর্ণ নারী। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিন মিলে আমাদের উত্থান এবং পতন। শুভ এবং অশুভবোধ। অনুভব এবং অনুভূতি। এই নিয়েই ধর্ম এবং জীবন। বেঁচে ওঠার, বেঁচে থাকার, জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ধর্ম।
নস্টালজিয়ার পাশাপাশি তাই দেবীপক্ষের এই সূচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক চিরন্তন ঐতিহ্য এবং বিবিধ স্বরের বহুস্বরের কথা।