
নতুন ধারাবাহিক
মহিলা কামরা
রূপশ্রী ঘোষ
১
— “তুমি গলায় ওটা কি হার পরে আছ – রূপোর?”
— “না না এটা এমনি, রূপো নয়।”
— “তুমি সাজো না কেন? এইটুকু বয়স। এই বয়সে তোমরা সাজবে না তো কি আমরা সাজব? যদিও তোমাদের বয়সেও কিছু এমন সাজিনি। আমি আমার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের বলি তোরা সাজবি। সাজলে আমার খুব ভালো লাগে। তখন আমরা সাজিনি ভুল করেছি।”
দুই মহিলা আর একটি অল্প বয়সি মেয়ের গল্প। কেউই কাউকে খুব বেশি চেনেন না। মাঝে মাঝে দেখা হয় এটুকুই। আমার মতই এঁরা সবাই লোকাল ট্রেনে রোজ যে যার কাজে যান। তাড়াতাড়ি ক্লাস থাকলে আমি ন’টা ছত্রিশের ট্রেনে যাই, নইলে দশটা সতেরো। ট্রেন সাধারণতঃ দশ মিনিট দেরি করেই আসে, কিন্তু সেই দেরির উপর ভরসা করা যায় না। তাই অধিকাংশ দিনই আগে আসলে স্টেশনে অপেক্ষা। অফিস টাইমে খুব ভিড় থাকে তাই, আর কোনো পুরুষ কলিগের সঙ্গে দেখা না হয়ে গেলে মহিলা কামরাতেই যেতে পছন্দ করি। ঐ সময়ে নানা স্কুলের বহু দিদিমণিও যান। আমার কলেজ ছাড়া অন্যান্য কলেজের কিছু দিদিমণিকেও যেতে দেখি। তবে তাঁরা খুব চুপচাপ। কখনও কখনও নিজের পরিচিত কাউকে পেলে গল্প করেন, না হলে পেপার পড়তে পড়তে বেশ একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে কপাল উঁচু করে চশমার ফাঁক দিয়ে কামরার গতিবিধিতে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। অতিরিক্ত চেঁচামেচি মনে হলে চোখে মুখে বিরক্তিও ফুটে ওঠে।
যাবার পথে আমার বাড়তি পাওনা বলতে অন্য মহিলাদের কথোপকথন – কামরার বাইরে ও ভিতরে যা যা শুনি। স্কুলের দিদিমণিরা বেশ হইহই করতে করতে যান। আধঘন্টা অন্তর এক একটা ট্রেন, আর মহিলা কামরাও মাত্র দুটো। তাই একই স্কুলের না হলেও প্রায় সবাই একে অপরকে চেনেন, নাম জানেন, গল্প করেন। আমি নিজে খুব মুখচোরা। সেধে সেধে কারও সঙ্গে আলাপ করা আমার ধাতে নেই। কিন্তু আমি এখন সবাইকে রোজ দেখতে দেখতে চিনে গেছি, কারো কারো নামও জানি। আমাকেও হয়তো সবাই চিনে গেছে। কিন্তু কথা হয় না। শুধু একটি মেয়ে আছে – সুতপা – যার সবার সঙ্গে সহজে আলাপ করে নেবার গুণ আছে, তাই আমার সঙ্গেও তার আলাপ হয়েছে। তার সঙ্গেই শুধু কথা হয়। সে আমার কলেজের পাশেই একটা স্কুলে পড়ায়, তাই মাঝে মধ্যে আমরা একসঙ্গে যাই রিক্সা শেয়ার করে। এঁদের সকলকেই আমার ভালো লাগে, তবু যাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ নেই এই লেখায় তাঁদের নামটুকু পাল্টে দিলাম।
ওইদিন ওই দুই বয়স্ক মহিলা তাঁদের মেয়ের বয়েসি মেয়েটিকে সাজতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। একজনের পরে অন্য বয়স্ক মহিলাও বলে উঠলেন – “হ্যাঁ আমিও আজ অবধি কোনোদিনও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাইনি। ওই একটু ভেসলিন, ব্যাস সাজ হয়ে গেল। আজকাল মেয়েরা কি একটা ন্যাচারাল কালার এনে দিয়েছে ওটা ঠোঁটে লাগিয়েই আবার একটু আঁচল দিয়ে মুছে নিই। কেমন লজ্জা লাগে নাহলে। আমার মেজো মেয়ে আবার সাজতে খুব ভালোবাসে। হাত ভরতি করে শাঁখা পলা চুড়ি, সিঁথিতে চওড়া করে আবার সিঁদুর। ছোটো মেয়ে আমার ঠিক তার উল্টো। সে মেজো মেয়েকে বলে এত সব পারব না বাবা তোর মতো। অতি ভক্ত (ভক্তি) চোরের লক্ষণ জানিস তো? ভালোবাসা বাবা এখানে থাকে আমার বুকে আছে। বাইরে অত দেখানোর কিছু নেই।” মহিলা একটা হাত বুকে রেখে দেখালেন সে কি ভাবে বলে। “ছোটো মেয়ে হাতে শুধু ওই পলাটুকুই পরে থাকে। কখনও আবার স্টাইল করে ওসব খুলে অন্য চুড়িও পরে।” অল্প বয়সি মেয়েটিও সায় দিল – “হ্যাঁ আমারও ওই অত হাত ভরতি চুড়ি গয়না সব ভালো লাগেনা।” এই বলতে বলতে ওরা সবাই ট্রেনে উঠে গেল, এর পরের কথা আর আমার কানে এল না।
একদিন এক দিদিমণি আর এক দিদিমণিকে বলছিলেন – “বেরিয়েছিলি ওইদিন?” — “হ্যাঁ। বেরিয়েছিলাম। মিমিকে (মেয়ে) বলেছিলাম তুই যদি সারাদিন পড়িস তাহলে তোকে নিয়ে যাব। বেচারি পড়েছিল সারাদিন, বিকেলে আর পারছিল না। কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল। বললাম, একটু ঘুমিয়ে নে তারপর বেরোব। বলা মাত্রই শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। কাল ফিরে শুনলাম ম্যাথের ক্লাসে যায়নি। সারাদিন টিভি দেখেছে। আমি গিয়েও দেখি টিভি দেখছে। আমি কিছু না বলে টিভিটা বন্ধ করে দিলাম। সেও কিছু বলার প্রয়োজন মনে না করে আবার চালাল। আমি আবার বন্ধ করে দিলাম। রেগে গিয়ে বলল, তুমি বারবার অমন করো কেন? বললাম, কাল ম্যাথের ক্লাসে যাওনি কেন? শুনে মাথা নিচু করে বসে রইল।” সেটা তিনি দেখালেন কিভাবে বসেছিল। “আজকেও স্কুলে বেরোনোর সময় দেখলাম টিভি খুলল। আমি বললাম এই দ্যাখ ব্যাগে করে জামাকাপড় নিয়ে যাচ্ছি আর বাড়ি ফিরব না। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল না মা তুমি বাড়ি ফিরো, যেয়োনা মা।” তাঁর প্রতি মেয়ের এই আকুলতার বর্ণনা দিয়ে কিছুটা তৃপ্ত হয়ে মহিলা একটা বড়ো হেডফোন বের করে, গ্যালাক্সি ট্যাবে লাগিয়ে হাসিমুখে গান শুনতে লাগলেন। অন্য দিদিমণি কী একটা বললেন, আমি শুনতে পাইনি। সম্ভবত ট্যাবটার সম্পর্কে কিছু। মহিলা তখন কান থেকে হেডফোনটা খুলে শুনে নিয়ে বললেন – “হ্যাঁ আমি লজ্জায় এটা বের করি না, ভাবি কে কী বলবে!!”
সেদিন দুজন দিদিমণির কথা হচ্ছিল – “এই ময়ূরী তুমি তোমার স্কুলের অমুককে এই কানের দুলটা দিয়ে দেবে? আমাকে কিনতে দিয়েছিল। শুক্রবার থেকে ব্যাগে নিয়ে ঘুরছি তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।” ময়ূরী বলল – “হ্যাঁ হ্যাঁ দিয়ে দেব, কেন দেব না। আমার সঙ্গে তো দেখা হবেই।” বোঝা গেল, ময়ূরী আর তিনি একই স্কুলের নন। ময়ূরী আরও বলল – “ও তো ব্যাটা আমার কপিক্যাট। আমি যা কিনি ওরও তাই কিনতে হবে। এই কানের দুলটা এই যে আজ আমি যেটা পরে আছি সেরকম।” আমি তখন তার কানের দুলটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। যে মহিলা কিনেছেন তিনি দুলের বাক্সটা ময়ূরীকে দিতে দিতে বললেন – “এই বক্সটা তো আবার বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি, এইটুকু দুল তার এতবড়ো বক্স। ব্যাগে বয়ে বেড়াতে অসুবিধা না?” বাক্সটা তিনি ময়ূরীকে দিলেন, আর সেটা তেরো হাত হলেও ময়ূরীকে তার ব্যাগে ভরে নিতেই হল।
বয়স্ক দুই দিদিমণির একজন ময়ূরীকে বললেন – “জানোতো আমার মেয়ের কোমর চব্বিশ, তার জিন্স আবার কোথাও পাওয়া যায় না। ওই একটা দোকান আছে সেখান থেকে পাই, সেও যাওয়ার টাইম হচ্ছে না। আমি মেয়েকে বলেছি তোরা স্কুল থেকে চলে যাবি। তখন আবার দোকান বন্ধ থাকে।” ময়ূরী বুদ্ধি দিল – “কেন কোনো একটা ম’লে চলে যেতে পারো তো? সেখানে সব পেয়ে যাবে। সাউথ সিটিতে গিয়ে দেখো। ওদের আবার সব আলাদা আলাদা মাপ হয় জানোতো। হয়তো ছাব্বিশের স্মলটা তোমার মেয়ের কোমরে হয়ে যাবে। আর একটা আছে কোয়েস্ট ম’ল। সেটা অবশ্য আমি কখনও যাইনি। ওই বন্ধুদের কাছে শুনেছি। এক্স্যাক্টলি কোথায় বলতে পারব না তবে ওই পার্কসার্কাস আর বালিগঞ্জের মাঝে কোথাও একটা হবে। তবে সেখানে গিয়ে আমরা খাপ খুলতে পারব বলে মনে হয় না। বন্ধুদের কাছে যা শুনি – বাপরে!!” আমার মনে পড়ল আমিও একবার গিয়েছিলাম কোয়েস্ট ম’লে। একটা ব্যাগের দোকানে ঢুকে ব্যাগ দেখতে দেখতে সরল মনে একটা ব্যাগের দাম জানতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কত আর হবে, দুই তিন, বড়োজোর পাঁচ-ছয় হাজার হবে। সেটার দাম ছিল সাঁইত্রিশ হাজার।
একটি লম্বা ঢ্যাঙা মেয়ে, মোটা – চৌকো কালো ফ্রেমের চশমা, ছেলেদের মতো প্যান্টশার্ট ইন করে পরা। ট্রেন থেকে নামার ঠিক আগে ময়ূরীকে কোনো সম্বোধন না করেই বলল – তোমার ব্যাগটা তোমার ড্রেসের সঙ্গে বেশ ভালো যাচ্ছে। ময়ূরী প্রথমে কমপ্লিমেন্টটা খেয়াল করেনি। পরে তাকিয়ে বলল – “ওহ! থ্যাংক ইউ। আমি এখন চুটিয়ে অনলাইন শপিং করছি। বাট তোমাকে লুকিং নাইস। একটু বেশ মোটা হয়েছো ভালো লাগছে। লুকিং বিউটিফুল অ্যাকচুয়ালি।” এত প্রশংসা করলে খুশি না হয়ে পারা যায় না। মেয়েটি বেশ হাসিমুখে বলল – “সত্যি বলছ?” নিজের প্রতি একটু চোখ বুলিয়ে আবার বলল – “বিচ্ছিরি মোটা লাগছে না তো?” — “নানা একদম নয়। খুব ভালো লাগছে। আগে যেমন তোমাকে হাড় জিজ্জিরে লাগতো এখন সেটা মনে হচ্ছেনা। যাক খুব ভালো লাগল তোমার সঙ্গে এতোদিন পর দেখা হয়ে।” — “হ্যাঁ বাই আসি আবার দেখা হবে” – বলে মেয়েটি চলে গেল।
আমি ওই লম্বা মেয়েটিকে আগেও কয়কবার দেখেছি, শাড়িতে। বয়সটা বুঝতে পারতাম না। একদিন সে চুপচাপ বসে বসে দুটো বাচ্চা মেয়ের কথোপকথন শুনে ঘাড় নাড়ছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। মেয়ে দুটো একে অপরকে সিনেমার ডায়ালগ জিজ্ঞেস করছিল। যে জিজ্ঞেস করছিল, সে খুব পাকা। সে পটাপট একটার পর একটা ডায়ালগ বলছিল আর অন্য মেয়েটা খুব রেগে যাচ্ছিল – “ধূর! তোর একটাও মনে নেই? তুই কিচ্ছু জানিস না।” তখন অন্য মেয়েটার হঠাৎ একটা মনে আসতেই “আমি বলব বলব” করে বলতে শুরু করেছিল — “এক চুটকি সিন্দুর…..”।
একই স্কুলের দুই অল্পবয়সি দিদিমণি। এদের মধ্যে একজন বিবাহিতা। অন্যজন তাকে বলছিল – “তুমি কেন অমন গোলা সিঁদুর লাগাও বলো তো? ভালো লাগে? আমার মা লাগায়, আমার একটুও ভাল্লাগে না, আমি মা’কে বকি। বাপি আবার ইয়ার্কি মেরে বলে চাপ নেই, না লাগালেও চলবে। তবে আমাদের বাড়িতে ওই হাতেরগুলো নিয়ে খুব চাপ জানোতো! শাঁখা পলা একেবারেই খোলা চলবে না। সে বেড়ে গেলেও খুব ঝামেলা। বেড়ে যাওয়া বোঝো তো?” এটা বোঝা খুব দরকারি, তাই বিবাহিতা মেয়েটি “হ্যাঁ বুঝি।” বলার পরে তবেই সে আরও বলতে থাকল – “ওই সময় হাতে কিছু একটা গলিয়ে – সেটা রাবার ব্যান্ড হলেও চলবে – আগে শাঁখা পরে আসতে হবে। আমার ঠাকুমা এ ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। এমনকি কেউ সোনার শাঁখা বাঁধানো পরবে তাও চলবে না। আমার জেম্মা যখন বাপের বাড়ি যায় লুকিয়ে চটপট ওইসব হাতে পরে নেয়। আমার বাপি খুব খেপে যায়, মনে মনে ভীষণ গরগর করে। নেহাত বউদি হয় বলে কিছু বলতে পারে না।” এইসব বলে মেয়েটি একটু দুশ্চিন্তা করতে লাগল — “হে ভগবান আমার যে কী হবে যদি অমন শ্বশুর বাড়ি হয়! আমি একটুও গয়নাগাটি পরতে পারি না। কিন্তু আজকাল তো অনেকেই এমন আছে গো যারা কিচ্ছু পরে না।” এটা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সুতপা বলল – “হ্যাঁ আছে তো।” পাশে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সব শুনে বিজ্ঞের মতো বললেন – “যদি এপারে থাকো চাপ আছে, ওপারে কোনো কথা নেই, কে দেখতে যাচ্ছে।” তাঁর এপার ওপারের মর্ম আমি বুঝলাম না। হয়তো সমুদ্রের এপার বা ওপার, অথবা কলকাতার এপার ওপারও হতে পারে। মেয়েটি বলল – “আমি যখন জিন্স পরি, বেড়াতে যাওয়ার সময়, তখন শাঁখাটা খুলে শুধু লোহাটা পরে থাকি। ওখানে গিয়ে লোহাটাও খুলে ফেলি, সিঁদুরও পরি না।” — “তোমার বর কিছু বলে না?” মিষ্টি করে হেসে — “না, আমার বর খুব ভালো। সে এসব নিয়ে কিছু বলে না।” অবিবাহিতা মেয়েটি বান্ধবীর সৌভাগ্যে মুগ্ধ – “আর তোমার কি ভাগ্য না? সকাল আটটায় উঠে শাশুড়ির রান্না ভাত খেয়ে বেরিয়ে আসো।” বউমার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। “হ্যাঁ আমি বিয়ের আগেও অমন ছিলাম। আমি বিছানার মাঝখানে বসে থাকতাম আর আমার চারপাশে সমস্ত বই ছড়ানো। আমি মোটামুটি ওখানেই থাকতাম, আমার মা সব খাবার এনে এনে খাইয়ে দিত। মায়ের তো খুব চিন্তা হয়ে গেছিল! এ মেয়ে কিচ্ছু কাজ জানেনা, একে কে বিয়ে করবে!! যাক এখন শান্তি! আমার শ্বশুর বাড়ি খুব ভালো।” “হুম! সে তো বোঝাই যাচ্ছে তোমাকে দেখে।”
টিচার্স ডে’র দিন স্টেশন পৌঁছেই সব দিদিমণিদের দেখে মনে হল কোথাও একটা বিয়ে বাড়ি আছে। একে অপরকে বলছে – “তোমাকে দারুণ লাগছে”, “তোমার শাড়িটা খুব সুন্দর”, “কানের দুলটা ভালো ম্যাচ করেছে।” বরং যারা শাড়ি পরে আসেনি তাদেরকে হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল। কৈফিয়ত দিতে হল কেনো শাড়ি পরেনি। সুতপা তো বলেই ফেলল – “পরলে মাঝরাস্তায় খুলে যেত!” সুতপা সেই অল্পবয়সি বিবাহিতা মেয়েটার কানের দুলটা আমাকে দেখিয়ে বলল “কাল ও ওটা ট্রেন থেকেই কিনেছে।” ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ ময়ূরী এসে হাজির হল একেবারে ট্রেনের সামনেই, আর সবাই মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়ল – “তুমি শাড়ি পরোনি কেনো?” ময়ূরী এককথায় সবাইকে উড়িয়ে দিল — “ধুৎ তোর নিকুচি করেছে শাড়ির” – বলে প্রবল অবজ্ঞায় মুখ ব্যাজার করল। তার মধ্যেই একজন তার হাতের চুড়িগুলো ময়ূরীকে দেখাল। তাতে দেখা গেল সেও ওর মতো একই চুড়ি পরেছে। চোখাচোখি করে দুজনে হাসি বিনিময় করল আর বলল সেও ওই মেয়েটার থেকেই ট্রেনে কিনেছে। ময়ূরী পরেছিল লং কুর্তির সঙ্গে লেগ-ইন্স। তাতেও সাজ ছিল খুবই পরিপাটী। ইনফ্যাক্ট রোজই তাই থাকে।
ট্রেনে ওঠার পরে আমি আর সুতপা মুখোমুখি বসলাম। সুতপা সঙ্গে সঙ্গে তার সামনের মহিলাকে বলল “তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে।” তিনি প্রশংসাটা যেন প্রত্যাশাই করছিলেন। জানতে চাইলেন “শাড়ির রংটা ভালো না?” সুতপা বলল “হ্যাঁ।” তিনি বললেন “এটা বিয়েতে পেয়েছিলাম। বর্ষা বলে এতদিন বের করিনি।” যারা শাড়ি পরেনি তাদেরকে শুনতে হল “আজকের দিনটাতেও পরতে পারলে না? বছরে তো একটা দিন-ই আমাদের, এটাতেও সাজব না?!”
ট্রেনের এই মহিলা কামরায় তপনদা বা তপতীদিরও যথেষ্ট অবদান আছে। নানা, তারা কোনো স্কুলের দাদা বা দিদি নয়। তারা হকারমাত্র।
তপনদা বেচে জোয়ান, আমলকী, আনারদানা। দিদিমণিদের মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করে সে জনপ্রিয়। একদিন ট্রেনের সিটে রাখা একটা ব্যাগ দেখে শ্রেয়া খুব জোরের সংগে বলেছিল এটা নির্ঘাত তপনদার ব্যাগ। অমুকদি ব্যাগটা নামিয়ে দাও তো। শ্রেয়া আমার পূর্ব পরিচিত। আমার কলেজের পাশে একটা স্কুলের দিদিমণি। তপনদা ফিরে আসার পর শ্রেয়া একগাল হেসে বলেছিল — “তোমার ব্যাগটা নামিয়ে দিয়েছি। তপনদা তোমার কাছে ওই ক্রিস্টাল জোয়ানের প্যাকেটটা আছে?” — “না আজ নেই গো!” শ্রেয়া ঠোঁট উল্টে “যাহ!” বলে দু:খ প্রকাশ করে একটু হালকা ধমকও দিয়েছিল। তপনদা বুঝেছিল না থাকাটা অপরাধ। শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিয়েছিল নেক্সট দিন এনে দেবে।
তপতীদি বেচে শাড়ি, সালোয়ারের পিস। সেও সকলের মধ্যে খুব প্রিয়। কোনো কোনো দিদিমণিকে বলতে শুনেছি – এই দ্যাখো তপতীদি “তোমার থেকে কেনা শাড়ি পরেছি।” তপতীদি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে – “এই দ্যাখো আমার দেওয়া অথচ আমিই চিনতে পারিনি। তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তোমার রংটা বেশ খুলেছে এই শাড়িতে। তুমি তো এমনিতেই সুন্দর, যা পরো তাতেই মানায়। তবুও আমার দেওয়া বলে বলছি না, এটায় সত্যিই তোমাকে দারুণ লাগছে।” পাশ থেকে হঠাৎ একজনের আবদার, তার পাশে বসা একজনকে হাত দিয়ে দেখিয়ে, “তুমি এই দিদিকে সেদিন যে শাড়িটা দিলে সেরকম আমাকে একটা এনে দিয়োনা প্লিজ। আর শোনো ওই যে ওই শাড়িটা সেই হলুদ জমিন জরির কালো পাড়, মনে পড়ছে?” একটু ভেবে নিতে এটা তপতীদির মনে পড়ল – “হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।” শাড়ির অর্ডার দেওয়া হল – “ওটা বারোটা মতো নিয়ে আসবে। আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে ওইদিন আমরা সবাই একই শাড়ি পরব।” তপতীদি “ঠিক আছে” বলে মিনতিদির খোঁজ করতে লাগল। তার থেকে ও টাকা পাবে। এদের সঙ্গে রোজ রোজ চলতে চলতে এতটাই বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, তপতীদি ধার-বাকিতেও শাড়ি বেচে। এমনি একদিন এক ফলওয়ালাকেও বলতে শুনলাম – “দিদিমণি আপনার তিনশো টাকা হয়েছে। আজ দেবেন?” দিদিমণি ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিলেন। এই তপনদা, তপতীদির মতো আরও অনেক জনপ্রিয় দাদা দিদি আছে যারা রুমাল, চুলের ক্লিপ, বাসনমাজার স্কচ ব্রাইট থেকে সেফটিপিন অবধি বিক্রি করে।
২
– “বাসন মাজা — স্কচ ব্রাইটটা পাবেন — চুউউলের ক্লিপ — সেফটিপিন —” টান দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে হাজির হয়ে গেল স্বপনদা।
– সঙ্গে সঙ্গেই এক মহিলা ডাকলেন — “দাদা সেফটিপিন দেবেন এক পাতা।”
– “কোনটা? বড়ো না ছোটো পাতা?”
– “ছোটোটাই দিন। এই ক্লিপগুলো কত করে?” ছোটো সাইজের একটা ক্লিপ দেখিয়ে — “পাঁচ টাকা?”
– “পাঁচ টাকা? পাঁচ টাকায় আজকাল আর ক্লিপ হয় না দিদি। এটা দশ, এটা পনেরো আর এটা কুড়ি” — বলেই
স্বপনদা তিন-সাইজের তিনরকম ক্লিপ দেখিয়ে দিল।
এর মধ্যেই অন্যদিক থেকে আর একজন – “পেয়ারা! এই ভালো ভালো ডাঁশা পেয়ারা! পাঁচ টাকা পিস। জোড়া দশ। পাঁচটা কুড়ি। দেব নাকি দিদি?”
এর থেকে অনেকেই পেয়ারা কেনে। তবে রাজকুমার যতটা জনপ্রিয় এ ততটা নয়। রাজকুমার উঠলে সবাই, এমনকি দিদিমণিরাও, রাজকুমার রাজকুমার বলে এমন ডাকাডাকি ফেলে দেয়, যে সে পুরো পাগল হয়ে যায়।
তার চোখ-মুখ দেখে মনে হয়, কোনদিকে আগে গেলে ভালো হয় সেটা যেন সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না।
একে দেখে কেউ তেমন একটা ডাকাডাকি করে না। তবে মাঝে মধ্যে আমি এর কাছ থেকে পেয়ারা কিনেছি, ভালোই দেয়। আমার এক কলিগ জানতে চেয়েছিল — “এই পেয়ারাওলা কেমন পেয়ারা দেয় রে? রাজকুমার তো খুব ভালো দেয় শুনেছি।” মুচকি হেসে বলেছিল — “যদিও তার থেকেও কিনিনি কখনও।”
বলেছিলাম — “ভালো, খারাপ নয়।”
এ মোটেই নতুন নয়। আমি তো প্রায় রোজই দেখি। শুধু তাই নয়, বহুবার এর পেয়ারার ঝুড়ি খালি হয়ে যেতেও দেখেছি। তবুও ‘রাজকুমার’ বলে কথা।
এদিনও জিজ্ঞেস করল — “দিদিমণি, পেয়ারা?” বললাম — “না। ফেরার সময় যদি থাকেন নেব।” সে একগাল হেসে বলল — “এখন দেব না?” আমি আবার বললাম — “না।”
একদিন রাজকুমার মহিলা কামরায় উঠেই খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে না দেখে পরের স্টেশনে নেমে যেতে যাচ্ছিল গেটের মুখে ভিড় থাকায় তার নামা হল না। সে গজগজ করতে করতে আবার কামরার ভিতরে অন্যদিকটায় ঢুকল। এক চেনা দিদিমণিকে দেখে ডাকল — “কি দিদিমণি পেয়ারা দেব?”
দিদিমণিও সুযোগ বুঝে — “এখন কেন? হ্যাঁ?! এতক্ষণ তো আমাদের পাত্তাই দিচ্ছিলে না, নেমে চলে যাচ্ছিলে। নামতে পারলে না দেখে এখন দিদিমণিকে মনে পড়ল?”
রাজকুমার লজ্জায় রাঙা হয়ে এক মুখ হেসে বলল — “ছি! দিদিমণি এমন বলবেন না। আপনাদের জন্যই তো আসি। আপনাদের না দিয়ে কখনও গেছি? বলুন কতটা দেব?”
দিদিমণি — “আর পারব নিতে? এক্ষুনি তো নামতে হবে। সময় হবে না গো” বলতে বলতেই নেমে গেলেন।
রাজকুমারের বিক্রি তখন জমে উঠেছে, তাই কামরার ভেতর থেকেই হাঁক দিল — “দিদিমণি নেবেন কিনা বলুন? তাহলে আমিও নামছি।” দিদিমণি “না আজ থাক, তোমাকে নামতে হবে না”, বলে হাঁটা দিলেন।
“ভাজাআআআ বাআদাআম? চিঁড়েভাজাআআ, ডালমুট, ঝুরিভাজা। সবুজ- মটর দুই,পাঁচ। বড় চিপস দশ। ডালের ভুজিয়াআ” — সুর করে বলতে বলতে খুব বয়স্ক এক দাদু ওঠেন। বয়স আন্দাজ করতে পারি না, তবে টাকমাথা, দাঁত মাত্র আর দু একটা আছে, কোমরটাও প্রায় পড়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, অল্প ঝুঁকে দাঁড়ান। একহাতে থাকে অনেক প্যাকেট আর অন্যহাতে একটা কাঁচি।
দাদুর বয়স এবং কষ্ট দেখে অনেকেই আহা-উহু করে। যারা তা করে, তারা কিন্তু দাদুর থেকে কেনে না। একমাত্র কচিকাঁচাগুলো খুব বায়না করলে বা কোনো দিদিমণি নেহাত খিদে সহ্য করতে না পারলে তবেই দাদুর ভাগ্য খোলে। দাদুর বয়সের ভার আর শরীরের কষ্ট তাঁর হাসিকে মলিন করেনি। ফোকলা দাঁতে বেশ সুন্দর হাসি দিয়ে সুর করে হাঁকতে হাঁকতে কামরার এদিক থেকে ওদিকে চলে যান। কাউকে কখনও কেনার জন্য জোর করেন না।
এদিকে তপনদা আমাকে জোর করতেই থাকে। আমি তাকে প্রতিদিন বুঝিয়েও পারি না যে আমি হজমিগুলি, পুদিনাগুলি, ভাজা জোয়ান কিচ্ছু খাই না। ঠিক এসে হাসি হাসি মুখে আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করতে থাকে। “আনারদানাটা খেয়ে দেখুন।” একটাই আশা, অনেক বোঝানোর পর যদি কোনোদিন ভুল করেও একটা প্যাকেট কেনে।
একজন মাসিও আছে যে নানাধরনের চিপস বেচে। প্রচণ্ড খড়খড়ে গলায় চেঁচাতে শুরু করে দেয় — “এই চালের চিপস, সাবুর চিপস, মশালা চিপস, প্লেন চিপস ছোটো পাঁচ, বড়ো দশ।” বলার ফাঁকে ফাঁকে চেনা প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে গল্পও জুড়ে দেয়। একদিন এক খুব বুড়ি মহিলার পিছনে লাগল দেখলাম। “এই বুড়ি তোর জলের বোতলটা দিবি? দেনা? একটু খাই। ফ্রিজের জল এনেছিস নাকি? দেনা গো একটু গলাটা ঠাণ্ডা করি।” সেই মহিলা খুব বিরক্ত হয়ে মুখ বেঁকিয়ে ট্রেনের বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন।
মাসির জীবন খুব সুখের নয়। মাসির বর মাসিকে ছেড়ে চলে গেছে। স্টেশনে বসে একদিন মাসি এক শশা বিক্রেতা মহিলাকে গল্পটা বলছিল — “মুখপোড়া এখন কোন চুলোয় আছে কে জানে? আদৌ বেঁচে কি মরে তাও জানি না। যখন ছেড়ে চলে গেল তখন কম কষ্ট ভোগ করেচি মা। ওই ছোটো ছেলে নিয়ে কম নাকাল হইনি।”
অন্য মহিলা — “ক্যানো মাসি? গেল ক্যানো?”
— “কি জানি মা, কি বিকার হয়েছিল। গেচে যখন দুঃখ হয়েচে। কিন্তু তার আগে আমাকে কম কষ্ট দেয়নি মাগো! কি বলব রোজ মদ খেয়ে এসে অত্যাচার কোত্তো। মুখপোড়া গ্যাচে বেঁচেচি। আজ দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাচ্চি।”
— “মেসো আবার বিয়ে করেচে নাকি মাসি?”
— “কি করে জানব আমি? বলচি না তার কুনো খবরই আমার জানা নেই মা।”
বলতে বলতেই সেদিন ট্রেন এসে গিয়েছিল, বাকি গল্প আর শোনা হয়নি।
মেয়েদের চুলের ক্লাচার, হার, কানের দুল, বালা, ব্যাক ক্লিপ, টিপ নানান গয়না নিয়ে যারা ওঠে তাদের মধ্যেও কারও রেপুটেশন বেশি, কারও কম। এখানেও আছে এক রাজকুমার, সাকির, সাহেব এবং মাঝবয়েসি একজন “কাকু”। কাকুর থেকে আমি দুবার ক্লিপ কিনেছিলাম। কাকুর একটা হাত চাপা দেওয়া থাকত। পরে খেয়াল করে বুঝেছি যে একটা হাত নেই।
ক্লিপওয়ালা রাজকুমারদাও খুব ফেমাস। অনেককেই বলতে শুনি “আমি রাজকুমারের কাছে কিনি”। তার কাছে দিদিমণিদের অনেক আবদার দেখেছি। “তোমাকে তো বললাম রাজকুমারদা, এই ঝুমকোটা নয়, অন্য ধরনটা এনে দিতে। সেই জয়পুরি স্টাইলটা।”
রাজকুমারদা আশ্বাস দেয় — “দেব দেব।”
— “ঠিক আছে। বলো আজ এটার জন্য কত দেব?”
— “একশো ষাট।”
— “কী? একশোওওও ষাআআট!” আকাশ থেকে পড়েন দিদিমণি। “তুমি তো দিনেরবেলাতেই গলায় ছুরি বসিয়ে কাটছ রাজকুমারদা। নাহ! আর তোমার থেকে এত জিনিস নেওয়া যাবে না” — বলে দেড়শো টাকা বের করে হাতে দিতে গেলে রাজকুমারদা কিছুতেই রাজি হয় না। বলে “এত টাকা লাভ থাকে না আমাদের দিদিমণি।”
দিদিমণিও আর দশ টাকা বের করতে চান না।
শেষে রাজকুমারদা বলে — “ঠিক আছে আর পাঁচটা টাকা দিন।”
দিদিমণি ভীষণ পছন্দের দুলটা হাতছাড়া করতে চান না বলেই সেদিন ঠোঁট উল্টে ব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকা বের করে দিয়েছিলেন।
এক মহিলাও তার বউমার জন্য কিনলেন — “রাজকুমার ঝুমকোর টপটা যেন গোল হয়, লম্বা নয়।”
— “আচ্ছা ঠিক আছে, এটা দেখুন তো মাসিমা।”
“মাসিমা” অনেক দেখে লম্বাটাই কিন্তু নিলেন। তাঁর সঙ্গী বারবার বলছিল — “তুমি তো গোল চাইছ? তাহলে লম্বা নিচ্ছ কেন? গোলটা তো ভালোই দেখতে।” তবুও মাসিমার লম্বা পছন্দ হল। বলল — “নিয়ে যাই, পছন্দ হলে পরবে, না হলে আবার বদলে নিয়ে যাব।” সঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “একি? এটা তোমার নয়?”
মাসিমা হাউমাউ করে উঠলেন — “মরণ! আমি এসব পরি এই বুড়ো বয়সে? দেখ আমি কানে যেটা পরে আছি” — কান দেখিয়ে — “এটা পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিচ্ছু হয়নি। বহুলোক আমাকে জিজ্ঞেস করেছে এটা সোনার? আমি ইয়ার্কি করে বলেছি হ্যাঁ পাঁচ টাকার সোনা।”
তাকিয়ে দেখলাম কানের টপটা সোনার মনে না হলেও, খারাপ নয়। রঙ-টঙ ঠিকই আছে, চটে যায়নি। সেই মাসিমা তার সঙ্গীকে বলছিলেন — “আমাকে একটা কাজ খুঁজে দেনা, একটা টাইম ফাঁকা আছে।” তারপর তিনি কোথায় কার বাড়িতে কি কাজ করেন তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হল।
এই রাজকুমারদা, সাকির সবার কাছেই জিনিস অর্ডার দেওয়া যায়। একদিন এক দিদিমণি সাকিরের কাছে অর্ডার দিলেন তাঁর মেয়ের জন্য সাদা পাথর বসানো একটা গোল টাইপের বাউটি। সেই বাউটি সেদিন সাকিরের কাছে ছিল। সেটা দেখে পছন্দ হতে যেই দিদিমণি কিনতে গেলেন, দেখা গেল বাউটিটায় একটা তারের খোঁচা এমনভাবে বেরিয়ে, চোখে-মুখে লাগলে বিপদ হতে পারে। দিদিমণি তাই সেটা না নিয়ে নতুন বাউটির অর্ডার দিলেন। আর সাকির সেটাকে অনেক এদিক-সেদিক বাঁকিয়ে, তারটা মুড়ে বেচার চেষ্টা করল। পারল না।
তারপর থেকে ওই দিদিমণি সাকিরকে যখনই দেখতে পেতেন, জিজ্ঞেস করতেন — “কি গো? এনেছ?”
— “কী বলুন তো?”
— “আমার মেয়ের বাউটিটা?”
সাকির এক হাত জিভ বের করে বলত — “এই দেখেচেন একদম খেয়াল ছিল না। পরের সোমবার ঠিক এনে দেব।”
সোমবারে দিদিমণি বললেন — “আজ এনেছ? নাকি আবার ভুলে গেছ?”
— “সরি দিদিমণি, সত্যিই ভুলে গেচি।”
— “পরের সপ্তাহে কিন্তু অবশ্যই এনে দিও। তোমাকে বললাম না একটা বিয়েবাড়ি আছে।”
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ চলার পর অবশেষে দিদিমণি কিন্তু সেই সাদা পাথর বসানো সুন্দর বাউটি পেয়েছেন।
সাকিরকে কোনোদিন আলাদা করে আমার চোখে পড়ত না, যদি না সে যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করত। যেদিন আমার ফোন চুরি গিয়েছিল সেদিন আমি ট্রেনের মধ্যে হইচই চেঁচামেচি না করে চুপচাপ ‘থ’ হয়ে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা মেয়ের থেকে ফোন চেয়ে আমার বরকে ঘটনাটা বলেছিলাম। আর একজন হকার আমার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল বলে আমি তাকে বিড়বিড় করে বলেছিলাম — “আমার ফোনটা চুরি গেছে।” সে শুনতে পেয়েছিল কিনা জানি না। আমার মনে হয়েছিল ও বুঝি আমার অবস্থা বুঝেছে, তাই বলেছিলাম। তবে পরে ওই হকারকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। মনে হয়েছিল সে আসলে ফ্যালফ্যাল করে নয়, যেন চোরচোর করে তাকিয়ে ছিল। আমি বলার পরেই পরের স্টেশনে নেমে চলে গিয়েছিল। তাকে ওই ট্রেনে রোজ দেখতাম না, মাঝে মধ্যে দেখতাম। কোমরে কলসি নেওয়ার মতো করে একটা বড় বোয়েম নিয়ে ঘোরে। তাতে থাকে নানা রঙয়ের টক-ঝাল লেবু লজেন্স, আদা, জেলি, লিচু লজেন্স। আর আমার দিকে তাকানোটা সেই একইরকম।
পরেরদিন আবার ওই কামরায় উঠেছিলাম। সাকির সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে এসে বলেছিল — “কি ম্যাডাম, আগেরদিন আপনার ফোন চুরি গেল আর আপনি আমাদের একটুও বললেন না? আপনি যখন নেমে গেলেন তখন এক মহিলা বলল। আপনি তো আমাদের একটু বলে দেখতে পারতেন। আপনি তা না করে চুপচাপ বসে রইলেন! আমরা যারা থাকব তাদেরকেই বলবেন। এরকম আমরা অনেক চোর ধরে দিয়েছি। ওদের আমরা চিনি। দেখলেই চিনতে পারি। এই তো সেদিনই একটা ধরে পাবলিকের হাতে দিয়ে দিলাম। পাবলিক পেটাতে পেটাতে নিয়ে গেল।”
তার কথা শেষ হতে বিমর্ষ হয়ে বলেছিলাম — “হুম! আমার তো জানা ছিল না।”
তারপরেই শুরু করেছিল — “দিদিমণি আপনি কোথায় থাকেন? কোথায় পড়ান?”
শুনে বলেছিল — “তাহলে অনেকটা আসতে হয় তো আপনাকে।”
— “এই পাবলিক ‘টান্সপোটে’ যাতাত করেন, এত দামি দামি ফোন ইউজ করেন কেন? একদম করবেন না। কথা বলার জন্যে যেটুকু না হলে নয়, এই একদম এরকম” — পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে দেখিয়ে — “সেরকমই কিনবেন।”
— “যাগগে! থানায় ডায়রি করেচেন তো?” বললাম “হ্যাঁ।” জানতে চেয়েছিল থানায় আমাকে কি বলেছে। সব শুনে বলেছিল — “থানায় তো অমন হাজার হাজার ডায়রি হয়। তারা চাইলেই ধরতে পারে।” পুলিশদের উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বলেছিল “কাজ করলে তবে তো ধরবে। দেখুন আপনারটা কি হয়। চলি ম্যাডাম” বলে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল।
একদিন এক দিদিমণি ট্রেনে উঠেই তার মোবাইল ফোনটা বের করে বসেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এক রুমালওলা চেঁচিয়ে তার রুমাল বিক্রির সুরেই বলতে লাগল — “দিদিমণি ব্যাগে ফোন ঢোকান, একদম হাতে রাখবেন না। এখন খুব চুরি হচ্চে। জানলা দিয়ে পুরো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দৌড় দিচ্চে।” গায়ে পড়ে জ্ঞান দেওয়াতে বিরক্ত হয়ে দিদিমণি চোখ কপালে তুলে এমন করে তাকালেন, তাই দেখে আমার কলিগ বলতে শুরু করল “হ্যাঁ গো একদম সত্যি কথা। ঠিকই বলেছে ও।” তখন আমিও বললাম — “হ্যাঁ আমি তো জানি। আমারটাও তো গেছে। তবে ব্যাগ থেকে।”
এরকম জিনিস নিয়ে আরও অনেকেই উঠলেও সবাই ফেমাস হয়ে উঠতে পারেনি। আরও এক মাসি আছে। বাচ্চাদের নজরকাঠি, হাতের নোয়া, কালো সুতো , টাইগারবাম, আইকার্ডের কভার, রেশন কার্ডের কভার, পাসপোর্টের কভার বেচেন। সেই মাসির বিক্রির মাত্রা খুবই কম। তার মুখে কখনোই হাসি দেখিনি। সবসময় একটা ব্যাজার মুখ করে জিনিস বিক্রি করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সারাদিন ঘুরে মাসি কেমন আয় করে? চলে যায় নিশ্চয়ই।
পাশে বসা কোনো প্যাসেঞ্জারের ফোনালাপ থেকে তার মনের অবস্থা, পারিপার্শ্বিক দিকও বোঝা যায়। সেদিন শুনলাম এক মহিলা ফোনে বলছেন — “হ্যাঁ? হ্যালো! ভালো আছ?”
— “হ্যাঁ বেরিয়েছি। হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো যাচ্ছি ট্রেনে আছি। তোমাদের সব ভালো তো?”
— “জানো? অমুক এখন চাকরি পেয়ে গেছে। রাইটার্সে বসছে।”
— “আরে বুঝতে পারছ না? ওই তো অমুক। ক্লাস এইটও পাশ করেনি। জাস্ট ভিতরে ভিতরে সোর্স করে পেয়ে গেল।”
— “এতদিন তো তারাতলায় একটা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করত। হ্যাঁ হ্যাঁ। কপাল। বুঝলে? কপাল। যাদের কপাল ভালো হয় তাদের বেশি লেখাপড়া করতে হয় না।”
— “কত দেয় জানো?” অন্য একটা হাত দিয়ে মুখটা একটু আড়াল করে লো ভয়েসে — “কত দিচ্ছে জানো? আরে চোদ্দো দিচ্ছে চোদ্দো। ভাবো? কি কপাল। আরে না না এস সি-টেস সি না গো। মুখার্জি। বুঝলে না? ওর পদবি মুখার্জি।”
ট্রেনে ভিক্ষা চাওয়ার রীতিও যুগের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে।
আজকাল হয়েছে বুকের কাছে ঝুলিয়ে বা ব্যাগ রাখার তাকে একটা বক্স তুলে দিয়ে হাতে ওয়্যারলেস মাইক নিয়ে ভুলভাল সুরে গান গেয়ে তারপর পয়সা চাওয়া। না দিলে তারা দু-চার কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না।
অন্ধবর-অন্ধবউ হাত ধরে, অন্ধবাবার হাত ধরে মেয়ে বা ছেলে, বিকলাঙ্গ পুরুষ ট্রেনের মেঝেতে পা ঘষে ঘষে এরা তো আছেই। এছাড়াও – এই ট্রেনে কয়েকজন ফিক্সড তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ওঠে। তাদের পয়সা চাওয়ার ধরন বেশ আলাদা। এসেই আশীর্বাদের ছলে সবার মাথায় হাত রাখে আর মঙ্গল কামনা করে। যারা পয়সা দেয় তাদের আরও বাড়তি মঙ্গলবাণী জোটে। তাদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে দু-চারটে কথাও বলে যায়। “তোর পাশে ওটা কে বসে গো? ছেলে? বাহ!” বলেই তার মাথাতেও হাত রেখে আশীর্বাদ করে। গাল টিপে আদরও করে দেয়।
আর যারা পয়সা দেয় না তাদের — “কি রে? তোদের নেই নাকি? নেই তো তবে আগে বলতে কি হয়েছে? আগেই বলে দিতে পারতিস। আমি তো তোদের থেকে জোর করে নিই না। থাকলে দিবি না থাকলে বলে দিবি। বল আমি কোনোদিন জোর করে নিয়েছি?”
মঙ্গলকামনাটা ফ্রি তে দেওয়া হয়ে গেল।
Ki je anando pelam Tomar lekhata pore!! E jeno amader sei chotto belat train jatra r galpo! Takhon proti Robibar train e kore desher bari jetam. Tar excitement i onyorakom chilo. Jodio chutir din jetam bole teacher der temon dekha milto na, ar general e uthtam bole meyeder kenakati o sebhabe drishtigichor hoyni, kintu boro haoar por du ekbar ei drishyo dekhechi, ar kichu ta Amar bondhuder kacheo shunechi. Tai Tomar galpo ta ekdom chokher samne sotti hoye uthlo. Anek anek subhechha roilo. Erakom aro lekho, anko…eisab sundor shilpo-sahitye din gulo sundor hok ar Amra ta grohon kore aro samridhho hoi. Khub bhalo theko.