নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস <br /> পৃথা কখন আসবে <br /> অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস
পৃথা কখন আসবে
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখকের নোট এই উপন্যাসের প্রায় পুরোটাই লেখা এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ শল্য বিভাগের বিছানায় বসে বা বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোওয়া হয়ে। ট্রামাডল ইনজেকশন নেওয়ার পর ব্যথা একটু কমলে এবং ফের যন্ত্রণা শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়গুলোতে এই উপন্যাসের বাক্য এবং যতিচিহ্নগুলো লেখা। কখনও মাঝরাতে উঠেও নিশ্চুপ হাসপাতালে বসে ভোর অবধি টানা লিখে গেছি। যখনই যন্ত্রণা শুরু হত ওঁরা ইনজেকশন দিয়ে কমানোর চেষ্টা করতেন, যাতে নিশ্চিন্তে লিখতে পারি। হাসপাতালে শুয়েই ডায়রি এবং নোট রাখার শাদা কাগজগুলোতে উপন্যাসটা গুছিয়ে আনার পর ‘অন রিকোয়েস্ট’-এ ডিসচার্জ নিয়ে ঘরে এসে এতে সংযোজন, পরিমার্জন ও ঘষামাজা সেরে ফেলি। কোনও অসুখ নয়, কোনও যন্ত্রণা নয়, আর কিচ্ছু নয়, মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এ উপন্যাস শুধু প্রেমের উপন্যাস। অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম অংশ

কম্পিউটারে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া চালিয়ে শুয়েছিলাম রাতে। ওঁর বাঁশিতে মিশ্র পাহাড়ি আমার বরাবরের প্রিয়। অনেক রাত অবধি চোখ বুজে শুনছিলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল মায়ের গোঙানির শব্দে। উঠে দেখি মা নিজের বিছানায় ঘুমের মধ্যে অস্পষ্ট ও জড়ানো গলায় গোঙাচ্ছে। আমি হাত দিয়ে অল্প নড়িয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম ঘুম গলায় ঘোরের মধ্যে আমার সত্তর বছরের মা জোরে জোরে বলল, ‘আমি লড়ব’। আমি বললাম, ‘কার সঙ্গে?’ মা বলল, ‘ওই যে ওরা স্বপ্নাকে মেরে ফেলল। আমি লড়ব।’ এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম পুরোপুরি ভেঙে মা চট করে উঠে বসল। বলল, ‘স্বপ্নাকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে।’
‘স্বপ্ন দেখলে?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, এই তো, এইমাত্র।’ মা বলল, ‘একটা একতলা বাড়ির ন্যাড়া ছাদে দাঁড়িয়ে স্বপ্না আমাকে কী যেন বলছে। আমি দেখতে পাচ্ছি ওর ঠোঁট নড়ছে। কিন্তু আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’
স্বপ্না, আমার ছোটমাসি। ছোটমাসি মারা গেছে গত ১৭ মার্চ। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হলেও সবাই মনে করছে আগুন লাগিয়ে ছোটমাসিকে মেরে ফেলা হয়েছে। কলকাতায় বিজয়গড়ে ছোটমাসিদের দু’ কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে জায়গা খুবই আঁটোসাঁটো। এক পা ফেলতে না ফেলতেই ঘর শেষ। অনেক রাত অবধি টিভি দেখে প্রায় শেষ রাতের দিকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ছোটমাসি ঘুমোতে যেত। উঠত অনেক বেলায়। ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ থাকত ওষুধের রেশে জড়ানো গলা। বেলা বেড়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নাগাদ এলে, তখন ছোটমাসি অনেকটা ফ্রেশ হয়ে উঠত। আগুন লাগার পর ছোটমেসো, ওদের ছোটছেলে এবং তার স্ত্রীর বক্তব্য, ছোটমাসি নাকি ভোর চারটের সময় চা বানাতে গিয়ে ঘুমের ঘোরে শাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভোর চারটেয় চা খাওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। অত ভোরে তিনি জেগেও থাকতেন না কখনও। ওরকম সময়ের অনেকটা আগেই তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। আর ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে, ওরকম আঁটোসাঁটো জায়গায় কারও গায়ে আগুন লাগল, আর বাড়িতে বাকি তিনটে মানুষ তা টেরই পেল না— এটাই বা কী করে হয়।
মায়ের মোবাইলে দেখলাম রাত দেড়টা বাজে। এর কিছুক্ষণ পরে আমার প্যাংক্রিয়াসের তীব্র যন্ত্রণা শুরু হল। মা বেশ কিছুক্ষণ পিঠে ম্যাসাজ করে দিল। আলট্রাসেট খেলাম একটা এজোম্যাক-ডি ফর্টি দিয়ে। তাতেও ব্যথা কমল না। তারপর বুপ্রিনরফিন ট্রান্সডারমাল প্যাচ মানে বুপ্রিজেসিক আর কি, লাগালাম পিঠে। এরও বেশ কিছুক্ষণ পর ব্যথাটা অল্প ধরল। একটা বুপ্রিজেসিক প্যাচ সাতদিন চলে। সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি। মেঘে ঢাকা আকাশ। ঠান্ডা লাগছে। খুব হালকা যন্ত্রণা আছে তখনও। যন্ত্রণায় কাহিল হয়েই কাটল গোটা দিন। দুদিন আগে রবিশংকরের একটা কম্পোজিশন শুনছিলাম সেতারে। ইচ্ছে হচ্ছিল বেহালায় বাজাই ওটা। সকালে বেহালাটা নিয়ে বসলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলাম না। সুর লাগছে না। বেহালার বাক্সে দেখলাম লাল ভেলভেটের ওপর সেই ছোট্ট সোনালি মাকড়সাটা বসে আছে, যাকে আমি ক’দিন ধরেই বেহালার বাক্সের ভেতরে দেখছি। কী করে এখানে ঢুকল কে জানে। বাক্স সবসময় বন্ধই থাকে। কী খায় এখানে তাও জানি না। হয়ত ওর মতো করে কোনও সুরের জাল বোনে। আমি বেহালাটা বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। বাক্সের ভেতর রয়ে গেল আমার ছোট্ট সোনালি মাকড়সা।
প্যাংক্রিয়াসের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে এর দুদিন পর রাত ৮টায় হাসপাতালে ভর্তি হলাম। গাড়ি থেকে নামার সময় খেয়াল করলাম, হাসপাতালে এমারজেন্সি গেটের সামনে এক যুবতি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে আরও কয়েকটি মেয়ে। তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে, যেন একসঙ্গে গল্প করছে। যুবতিটির চুল খোলা। পরনে গাঢ় সবুজ রঙের চুড়িদার। ‘আবার?’ আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে সে বলল। ‘আবার,’ আমি বললাম, ‘প্রতি মাসেই তো আসছি।’ তখনও আমি সেই যুবতিকে চিনতে পারিনি। গাড়ি থেকে নামার পর চিনতে পারলাম। ‘সিস্টার এবং পুলিশের মধ্যে’, আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘একটা মিল আছে।’ যুবতিটি জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বললাম, ‘এদের দুজনকেই নর্মাল ড্রেসে চেনা যায় না।’ যুবতিটি বলল, ‘তুমিও চিনতে পারোনি?’ ‘এখন পেরেছি’, আমি বললাম। ৩০শে জুন থেকে ৫ই জুলাই যখন এই হাসপাতালে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলাম, সেই ওয়ার্ডে এই সিস্টার ছিলেন। এই ওয়ার্ডে তো বটেই, গোটা হাসপাতালে, এমনকী আমি আমার রুগ্ন প্যাংক্রিয়াসের কসম খেয়ে বলতে পারি, গোটা শহরে ইনিই সবচে’ সুন্দরী যুবতি। কেন তাজমহল গড়া হয়েছিল, আর কেন পুড়েছিল ট্রয়, তা এরকম মেয়েদের দেখলে জানা যায়। এমারজেন্সির কর্তব্যরত ডাক্তার আমাকে দেখে, আমার কথা শুনে এবং আমার পুরনো কাগজপত্র দেখে আমাকে মেল মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য এমারজেন্সি স্লিপে লিখে দিলেন ‘এমএমডাব্লু’। আমি চিকিৎসককে বললাম, ‘মেডিসিন ওয়ার্ডে দিলে ওরা চেঁচামেচি করে। বলে, আপনি সার্জিক্যালের পেশেন্ট। এখানে কেন?’ চিকিৎসক আমার কথায় প্রভাবিত হলেন এবং এমএমডাব্লু কেটে লিখলেন এমএসডাব্লু— মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ড। আসলে, সার্জিক্যাল, মেডিসিন— কোনও ওয়ার্ডই আমার কাছে কোনও ব্যাপার নয়। সবখানেই একই ইনজেকশন। চিকিৎসার মোটামুটি একই প্রোটোকল। কিন্তু সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ওই সিস্টারকে দেখতে পাব। অন্যত্র পাব না।
মেল সার্জিক্যালে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কোনও বেড খালি নেই। খুঁজে খুঁজে বারান্দায় ট্রলি বে-র সামনে একটা বিছানা পাওয়া গেল। বেড নম্বর এক্সট্রা টু। ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘন্টা পরেও যন্ত্রণা কমল না। পরদিন ডাক্তার এসে তাঁর সঙ্গের জুনিয়র ডাক্তারদের বললেন, ‘নতুন কিছু তো করার নেই। ট্রামাজ্যাক টিডিএস করে চালিয়ে যা। আর তো কিছু করার নেই আমাদের।’ সেদিন সকালে ইউএসজি হোল অ্যাবডোমেন করিয়ে আনলাম। ইউএসজি-র গেটের বাইরে বেঞ্চে বসা একটি মেয়ে— নিশ্চয়ই কোনও ফিমেল ওয়ার্ডের পেশেন্ট। মুখে মাস্ক। বাঁ হাতে চ্যানেল। দু’ হাতে মেহেন্দি। আহারে। আমি মেয়েটিকে বললাম, ‘একটা কথা বলব? মেহেন্দি পরা হাতে ওই চ্যানেল একটুও মানাচ্ছে না।’ মেয়েটা বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি কিন্তু ওর সুন্দর হাত দুটোর প্রশংসাই করলাম, যে হাতে চ্যানেল মানায় না। একদিন পর সন্ধের দিকে ব্যথা কমল। খিদেও পেল। ইতিমধ্যে আমি বুঝলাম, ট্রয় জ্বালানো ওই সিস্টারকে অন্য ওয়ার্ডে বদলি করা হয়েছে। কারণ এখনও তিনি আসেননি। তবু যখন দেখলেন হাসপাতালে ঢুকছি, একবার তো খোঁজ নিতে আসতে পারতেন। আমার মনে হল।
ভর্তি হওয়ার পরদিন সকালে, যখন যন্ত্রণায় বাবাগো—মাগো করে চিৎকার করছি, যাকে চিৎকার নয়, আর্তনাদই বলা ভালো— তখন মোটা, কালো, টাক মাথা, গামছা পরা, খালি গায়ে এক পুলিশ খুব গলাবাজি করল আমার ওপরে। এখানে এরকম চিৎকার করা যাবে না। আমার বেডের কাছেই পুলিশ সেল। জেলের অসুস্থ কয়েদিরা ওই ঘরে থাকে। ওই পুলিশ ওখানকারই দায়িত্বে। আমি আমার পাশের বেডের রুগি ও তাদের বাড়ির পরিজনদের বললাম, ‘ধরুন, এই আমার জায়গায় যদি এখন কোনও গর্ভবতী নারী থাকতেন আর তিনি যদি প্রসব বেদনায় এরকমই চিৎকার ও আর্তনাদ করে যেতেন তাহলে কি ওই পুলিশ কিছু আপত্তি বা অভিযোগ করত? করত না। কারণ সব দয়া, মায়া, সিমপ্যাথি তো মেয়েদের জন্যে। পুরুষের তো যন্ত্রণা হতে পারে না। পুরুষের কান্নাকে আজও কেউ সহজে নিল না।’ পুলিশের আপত্তিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ভর্তি হওয়ার পরদিন গোটা দিনটা আমার আর্তনাদ করেই গেল। নেপালি একজন সিস্টার এসে বললেন, ‘আপনি কদিন আগে ওই ঘরে ভর্তি ছিলেন না?’ আমার ডায়রিতে যখন এসবই টুকিটাকি কথা নোট করে লিখছি, তখন আমার সামনে দিয়ে দেখছি তিনি হেঁটে আসছেন, আমার দিকে। এখন তিনি চেনা পোশাকে। সন্ধেরাতের আলো-অন্ধকার নয়, তাঁর মুখে এখন দিনের সহজ ও পরিষ্কার আলো। পুলিশ সেলের সামনে দিয়ে তিনি হেঁটে আসছেন আমার দিকে। না, এটা কোনও স্বপ্ন নয়। সত্যিই তিনি এলেন। এসে, নার্সের সেই চেনা পোশাকে আমার বিছানার সামনে দাঁড়ালেন। বললাম, ‘আপনি, অনেকদিন বাঁচবেন।’
‘কেন? মনে করছিলে?’ তিনি বললেন।
আমি বললাম, ‘আমি একটু আগে আমার ডায়রিতে এন্ট্রি করলাম, কাল তো আপনাকে দেখলাম না।’
পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে আসা ঝরনার মতো খিলখিল করে হেসে তিনি বললেন, ‘কাল ছুটি ছিল।’
সকালে মহিলা ডাক্তার এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত বইখাতা কেন? পরীক্ষা নাকি? কী করো তুমি?’ বললেন, ‘নতুন একটা ইনজেকশন দিচ্ছি। এতে ব্যথা একটু কম হবে। ঠিক আছে, তুমি লেখালেখি করো।’ পরে আবার একজন সিনিয়র ডাক্তার এলেন। জুনিয়রদের বললেন, ক্রেয়ন ২৫০০০ টিডিএস করে চালাতে। আমি বললাম, প্যানলিপ্যাজ ২৫০০০ টিডিএস করে খাচ্ছি। তিনি বললেন, প্যানলিপ্যাজ বা ক্যাডিপ্যানে কাজ হবে না। সঙ্গে প্যাংক্রিওফ্ল্যাট চালাতে বললেন। একটু পরে ব্যথা আর বমিভাব শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে ভয়ংকর যন্ত্রণায় হড়হড় করে বমি করে মেঝে ভাসালাম। নার্সরুম থেকে একজন ব্রাদার এসে পরপর কয়েকটা ইনজেকশন পুশ করল। আমি একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়ার কিছু আগে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখলাম, ছিপছিপে গড়ন। পাকানো গোঁফ। হাসপাতালে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বারান্দায় একটা কাগজ হাতে ছুটছেন। একবার কাগজ হাতে ছুটে নার্সরুমে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে আবার ছুটে গেলেন পুলিশ সেলের দিকে। আবার ছুটে এলেন এদিকে। হয়ত ওই প্রিজন সেলের কয়েদিদের মধ্যে কারও ছুটি হয়েছে। হাসপাতাল থেকে জেলে নিয়ে যাবে। কিংবা হয়ত কোর্টে তুলতে হবে। সময় হয়ে গেছে। আমি ওই ব্যস্ত অফিসারকে ডেকে বললাম, ‘এক সেকেন্ড’। তিনি এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। আমি দ্রুত বলে ফেললাম, ‘আপনার গোঁফটা ভালো, না আমারটা?’ ব্যস্ততা ভুলে হেসে ফেললেন ভদ্রলোক। মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, ‘আপনারটা সুন্দর।’ পুলিশ অফিসারদের খুব একটা হাসতে দেখা যায় না। হাসলে ভালো লাগে দেখতে। বিকেলে ইনজেকশন দিতে এসে নেপালি সিস্টার আমার পায়ের বড় বড় নখের দিকে বিরক্তিভরা ইশারা করে বললেন, ‘কী অবস্থা নেইলগুলোর, দেখেছেন?’ বললাম, ‘আপনি আমার নেইলগুলো দেখছেন। আমি আমার জীবনটার দিকে তাকিয়ে বলি— কী অবস্থা!’
আমার পরের বিছানায় নতুন পেশেন্ট ভর্তি হল। দুপুরে, ১২টা নাগাদ। মাথায় ব্যান্ডেজ। আট ঘণ্টা হয়ে গেল এখনও তাঁকে কোনও ডাক্তার দেখতে আসেনি। বাড়ির লোকজন স্বাভাবিকভাবেই খেপে লাল। বলছে, এখানে আনা যা, গোরস্থানে নিয়ে যাওয়াও তাই। আমি ওদের একজনকে ডেকে বললাম কমপ্লেন করতে। এখানকার হসপিটাল সার্ভিস নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে ৯৫৬৪৬৪০০৮৮ নম্বরে ফোন করে জানানো যায়। একজন ফোন করল। ফোন ঢুকছে না। বললাম, ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যান। লিখিত অভিযোগ দিন। এমারজেন্সির ডাক্তারের ঘরের ঠিক উলটো দিকে ওয়ার্ড মাস্টারের ঘর।

একদিন আমার বিছানাতেও হলুদ চাদর পাতা হল। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল, আমার বিছানাতেও হলুদ চাদর পাতা হোক। এতদিন পর সেটা হল। এই হাসপাতালে সপ্তাহে সাতদিন সাত রঙের বেড কভার দেওয়া হয়। ফ্যাকাশে বা শাদাটে লাল, হলুদ, ধুয়ে ধুয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া শাদাটে নীল— নেভি ব্লু যখন স্কাই ব্লু-তে পরিণত হয়, তখন যেমন লাগে দেখতে, মারি বিস্কিটের রঙের মতো হালকা ব্রাউন, গাঢ় সবুজ, গোলাপি এবং মাখন শাদা। এর মধ্যে হলুদ চাদরটি আমার সর্বাধিক প্রিয়। সবার বিছানায় হলুদ চাদর পাতা হলে মনে হয়, সবার বিছানায় আজ বসন্ত। মনে হয়, সব রুগি হুমায়ূন আহমেদের হিমু।
রোজ সকালে ওয়ার্ড বয় এসে সবার বিছানার সামনে নতুন চাদর দিয়ে যায়। ট্রেইনি সিস্টাররা বলে, বেডশিটগুলো চেঞ্জ করে নিন। একদিন এরকমই এক ট্রেইনি সিস্টারকে বললাম, এই যে আপনারা রোজ বলেন, বিছানার চাদর পালটে নিতে, যদি এভাবেই বলতেন জীবনগুলো পালটে ফেলুন। বলে, চাদরের মতোই কিছু একটা পেতে দিতেন। আর জীবনটা পালটে যেত। বিছানার চাদর আর স্যালাইনের বোতলগুলো শুধু পালটে পালটে যায়। জীবনটা আর পালটায় না। দিনগুলো কিছুতেই পালটায় না। যেটা পালটানো দরকার, ভীষণভাবে দরকার, শুধু সেটাই পালটায় না।
আমার একটা বিছানা পরে যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক, প্রবীরকুমার দত্ত, বেড নম্বর এক্সট্রা ফোর— জিরানপুরে বাড়ি। গ্রিল কারখানার কর্মী। হিপ জয়েন্ট ভেঙে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার তাঁকে বারবার করে বলেছেন পা ঝুলিয়ে না বসতে। তিনি ভুলে যান বা কথা শোনেন না অবাধ্য কিশোরের মতো। ডাক্তার বলেন— আবার পা ঝুলিয়ে বসেছেন? আমি তাঁকে বলেছি, পা ঝুলিয়ে দাঁড়াবেন না। পা ঝুলিয়ে হাঁটবেন না। ভদ্রলোক বললেন, ‘পা দুটো ব্যাগে ভরে রেখেছি।’ আমি বললাম, ‘তালা দিয়ে রাখবেন। নইলে পা ভাঙা কি পা কাটা কোনও রুগি হয়ত বলা যায় না আপনার পা নিয়ে গেল।’ ‘হ্যাঁ’, প্রবীরকুমার বললেন, ‘যা যুগের হাওয়া।’ একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দু’ হাতে ধরে সেটায় ভর দিয়ে হাঁটেন ভদ্রলোক।
সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে আমার চিরকাল ভালো লাগে। সিটি স্ক্যানের দরজার সামনে টুল নিয়ে বসে যে মেয়েটি, একদিন সে এল। আমি তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। মা পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আয়েষা। সিটি স্ক্যানের ওখানে বসে।’ আয়েষার মুখে মাস্ক। সালোয়ার কামিজ পরা। আমি বললাম, ‘আপনার নাম তো রাশিয়া।’ মেয়েটি যার পর নাই অবাক। আপনি জানলেন কী করে? বললাম, ‘আমরা খবরের লোক। খবর রাখাই আমাদের কাজ।’ রাশিয়া সত্যিই অবাক হয়েছে আমি তার নাম জানি দেখে। বলল, ‘সত্যিই আমার আসল নাম রাশিয়া। কিন্তু সবাই আমাকে ডাকে আয়েষা বলে। আয়েষা আমার মায়ের নাম। আমি আয়েষা নামেই সাড়া দিই এখন। আমার মা যখন মরে যাবে তখন মায়ের নামটা আমার সঙ্গে চলবে। কিন্তু আমার আসল নাম রাশিয়া। আপনি জানলেন কী করে!’ নীল মাস্কে তার নাক, ঠোঁট, চিবুক, গাল ঢাকা। কিন্তু চোখ খোলা। আর সেই দু’ চোখের তারায়, দু’ চোখের কোণে তার মনের সমস্ত অবাক হওয়া হাসির বিন্দু গুচ্ছ গুচ্ছ রেণুর মতো লেগে। এত ভালো লাগছিল দেখতে যে বলেই ফেললাম— মানুষের চোখে এরকম হাসি লেগে থাকতে দেখলে বোঝা যায় জীবন, কত সুন্দর।
আমি অনেকদিন আগে থেকেই জানি তার নাম রাশিয়া। অনেকদিন আগেই ভেবেছি, যে মেয়ের নাম রাশিয়া, তাকে নিয়ে অবশ্যই একটা গল্প লেখা উচিত। আমি বরং তাকে একটা হাসির গল্প বললাম। যন্ত্রণায় ছটফট করলে হাসপাতালে কৌতূহল বশে অনেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে— কী হয়েছে? আমি অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে বলি, বাচ্চা হবে। আসল উদ্দেশ্য— সে যেন দাঁড়ায়। দুটো কথা বলে। আমার পরিচিত এক ডাক্তার, সব্যসাচী সেনগুপ্ত, দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। প্রথম পোস্টিং পেয়েছিল জলপাইগুড়ি হাসপাতালে। একদিন আউটডোরে তার ডিউটি চলছে। রুগি এল। কী হয়েছে? রুগির বাড়ির লোক বলল, ‘প্যাটে বিষ’। বিষ? সে কী! সব্যসাচী সঙ্গে সঙ্গে পাইপ দিয়ে বিষ বের করতে উদ্যত। ওর এক সিনিয়র তখন হঠাৎ এসে পড়ায় এটা দেখে বললেন, আরে করিস কী! করিস কী! প্যাটে বিষ মানে পেটে ব্যথা। বিষ করে মানে ব্যথা করে। সব্যসাচী হতবাক। সত্যি সত্যিই পেটে বিষ গেলে, তখন এরা কী বলবে হয়ত সেই কথাই তখন সে ভাবছিল। আরেকবার এরকমই আউটডোরে একজন এল। কী সমস্যা? ‘পোকায় কাটছে’। পোকা? কী পোকা? বড় পোকা। কথা বলে জানা গেল পোকা মানে সাপ। সব্যসাচী জিজ্ঞেস করল, পোকাটাকে চোখে দেখেছেন? কী সাপ জানেন? রুগির সঙ্গে থাকা লোকগুলোর মধ্যে একজন বাজারের থলে থেকে একটা কাচের বয়াম বের করে ডাক্তারের টেবলে রাখল। তাতে ধরা সেই অপরাধী সর্প। থানায় এসেছে যখন অপরাধীকে হাতেনাতে ধরেই এনেছে।

পঞ্চম দিন সকাল ৯টায় ডাক্তার এলেন। ইউএসজি রিপোর্ট দেখলেন। তাতে সেই একই কথা লেখা— ক্রনিক ক্যালসিফিক প্যাংক্রিয়াটাইটিস। বললেন, সিইসিটি করাতে দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম, ‘আমাকে আপনারা সিটি স্ক্যানের জন্য কোনও কাগজ কিন্তু দেননি।’ ডাক্তার সিস্টারকে হাতের হলুদ কাগজটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা দেওয়া হয়নি কেন?’ সিস্টার বললেন, ‘আমি জানি না।’ কাগজপত্র ঘেঁটে ডাক্তার বললেন, ‘ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং এলএফটি রিপোর্ট না এলে সিটি স্ক্যান করা যাবে না। রিপোর্ট এলে আপনাকে সিটি স্ক্যানের কাগজ দেওয়া হবে।’ আমি বললাম, ‘ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন রিপোর্ট কীভাবে আসবে? আমার কাছ থেকে তো ব্লাডই নিয়ে যায়নি।’ ডাক্তারের মুখে এবার ধৈর্যহীন বিরক্তি। তিনি ডান হাতের কলমটা বাঁ হাতে ধরা প্রেসক্রিপশনের ওপর দু’ তিনবার ঠক ঠক করে মারলেন।
পঞ্চম দিন দুপুর থেকেই যন্ত্রণা। বেলা ৩টেয় সেই সুন্দরী নার্স ইনজেকশন দিয়ে গেলেন। আমি গ্লাভসবিহীন তাঁর হাতের তাপমাত্রায় চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘টেম্পারেচার কার বেশি? আপনার না আমার?’ তিনি বললেন, তাঁর। ‘জ্বর নাকি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘না। আমার টেম্পারেচার এরকমই।’ আগের চ্যানেলটা কাজ করছে না। বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের কাছে হলুদ জেলকো দিয়ে চ্যানেল করতে করতে তিনি বললেন, ‘ইশ! এই বাঁ হাতটার ওপরে বারবার করে’— কথাটাকে অসমাপিকা ক্রিয়ায় ছেড়ে জেলকোর নিডল ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, ‘এটায় কি কম লাগে?’ বললাম, ‘প্যাংক্রিয়াসের যন্ত্রণার কাছে এসব কিছুই না। তাও এখানে ভালো। কলকাতায় অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে সিস্টাররা চ্যানেল করেন না। ডাক্তাররা করেন।’ সুন্দরী নার্স বললেন, ‘আমি ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে চলে যাচ্ছি।’ ‘বেঁচে গেলেন’, আমি বললাম, ‘আর চ্যানেল করতে হবে না।’ আমার কথায় তিনি অল্প হাসলেন। তারপর বললাম, ‘সত্যিই যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ সত্যিই।’ একটু অবাকই হলাম আমি। আসলে আমি ভেবেছিলাম প্রতিদিন অজস্র চ্যানেল করার ক্লান্তিকর বিরক্তি থেকে ঠাট্টা করে তিনি হয়ত এ কথা বলছেন।
বললাম, কলকাতায় ওদের মধ্যে এমপ্যাথি কিন্তু অনেক বেশি দেখেছি। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ড থেকেই নার্সরুম দেখা যায়। নার্সরুমের সামনে একটা বড় কাচের জানলা। রাতে বিশ্রামের সময় একটা বড় পর্দা দিয়ে ওরা সেই কাচটা ঢেকে দিত। সেই পর্দাটা টাঙাতে হত টেবলের ওপর উঠে। ওয়ার্ডে বিছানায় শুয়েই দেখা যেত ওদের কাজ করতে। আমি বিছানায় যন্ত্রণায় হয়ত ছটফট করছি— ওদের কাউকেই কিন্তু বলিনি ইনজেকশন দিতে বা বলিনি আমার পেইন হচ্ছে। প্যাংক্রিয়াসের সঙ্গে আমি যেহেতু ক্রনিক কিডনি ডিজিজের পেশেন্ট, তাই চেষ্টা করি পেইন কিলার ইনজেকশন যতটা পারা যায় কম নিতে। কাচের ওপাশে নার্সরুম থেকে আমাকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে ওরা হাত নেড়ে ইশারায় বলছে— আসছি। দাঁড়াও আসছি।
সুন্দরী নার্সকে বললাম, একটা জিনিস আমি আবিষ্কার করেছি। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হলে যদি হাতের কাছে ইনজেকশন না থাকে কিংবা যদি থাকেন কোনও দুষ্টু নার্স, যিনি ইনজেকশন দিচ্ছেন না— তখন কোনও বই পড়ায় বা লেখায় মন দিলে যন্ত্রণাটাকে বোকা বানানো যায়। সেদিন সন্ধে ৬টাতেও যন্ত্রণা কমল না। বই পড়ে কমল না। লিখে কমল না। ইনজেকশনেও কমল না। সঙ্গে তীব্র বমিভাব আর শ্বাসকষ্ট। সুন্দরী নার্স শুনেই বললেন অক্সিজেন দেবেন কিনা। আমি বললাম, আগে স্যাচুরেশনটা দেখুন। অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন নাইন্টি নাইন দেখাল। তার মানে ঠিকই আছে। প্যাংক্রিয়াসের যন্ত্রণা থেকে হচ্ছে শ্বাসকষ্টটা। ডাক্তার এল প্রায় সাতটা নাগাদ। এরা আবার নতুন ডাক্তার। আবার নতুন করে কেস হিস্ট্রি বলতে হল। বললাম— একটা কথা বলব? যদি ধৃষ্টতা ক্ষমা করেন। আপনারা ট্রামাডল বা ট্রামাজ্যাকের সঙ্গে পিসিএম চালাচ্ছেন না কেন অল্টারনেট করে? এতে কিন্তু খুব আরাম হয় আর পেইন রিলিফ হয় দ্রুত। সিনিয়র একজন ডাক্তার বললেন, ‘না দেওয়ার তো কারণ নেই। দাও পিসিএম অল্টারনেট করে।’ আমার কথা শোনার পর জুনিয়র আরেকজন ডাক্তার সিনিয়রের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন বুঝলাম। জুনিয়রজন মাস্ক পরে ছিলেন। ডাক্তারের চোখের তারায় ঠিক সেই মেয়েটা, রাশিয়ার মতো লেগে থাকা হাসি। সুন্দরী নার্স একটু পরেই পিসিএম চালু করে গেলেন। বললেন, ‘ডাক্তার নতুন একটা ইনজেকশন দিয়েছেন।’ R দিয়ে নাম বললেন। এখন নামটা মনে আসছে না। বললেন, ‘তবে দেখতে হবে এতে এলার্জি হচ্ছে কিনা তোমার।’ পিসিএম চালু হতেই ব্যথা নেমে গেল। ঘুম চলে এল। এরকম নার্সকে দেখলেই ব্যথা অনেক কমে যায়— ইনজেকশন ছাড়াই। মেডিকেল সায়েন্স কি এটা জানে?

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    কমলকুমার দত্ত 3 years

    ‘হয়তো ওর মতো করে সুরের জাল বোনে’ বাক্যটা বাদ দিলে ভালো হয়। ‘এখন পেরেছি, আমি বললাম’, লেখা বাহুল্য, আগের বাক্যেই সেটা বোঝা ও বোঝানো গ্যাছে। ‘আমি হাসলাম’ এটুকুই যথেষ্ট।
    ভালো লাগছে। এই পটভূমিতে সন্দীপনও উপন্যাস লিখেছেন। অপেক্ষায় থাকলাম।

  • comment-avatar
    অভিজিৎ 3 years

    আহ সুন্দরী রাশিয়া ওহ পানক্রিয়াসের ব্যাথা

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes