ধারাবাহিক ভাবের ঘর – দ্বিতীয় পর্ব <br />  সপ্তর্ষি বিশ্বাস

ধারাবাহিক ভাবের ঘর – দ্বিতীয় পর্ব
সপ্তর্ষি বিশ্বাস

পর্বঃ ২, ফেরা

আকাশ আজ শরতের ঘোরে সানন্দ-নীল,হায়,এই কৃতান্ত নগরীতেও।
সত্যই নীল ? না’কি মর্মের আনন্দছায়াতেই এই নীলের জন্ম ? এই নীলিমার ছড়িয়ে পড়া ? মর্মের আনন্দ ?
কিসের ? শরতের।
কেন?
কেননা “শরৎ আনন্দের বাড়ি ফেরা”।
আনন্দিত বাড়ি ফেরা, পরবাসীর।
আমি পরবাসী। শরৎ তাই আমার শোণিতেও দেয় টান। আনে জোয়ার। ‘আনন্দের’ না হোক, ‘আনন্দ-স্মৃতির’, ‘আনন্দ-ছবি’র, ‘আনন্দ-কল্পনা’র। ডাক দেয় ‘ফেরা’র।
‘ফেরা’ কাকে বলে ?
‘ফেরা’ মানে, যে বিন্দুর থেকে একটি যাওয়া সূচিত, ঘুরে আসা সেই বিন্দুটিতেই ।
‘গৃহ’ তেমনই একটি বিন্দু ।
পাড়া, মফস্বল, গঞ্জ — সবই বিন্দু। আরম্ভের অথবা ফিরবার ।
যাত্রা করে ফেরেনা অনেকে — অনিচ্ছায় অথবা ইচ্ছায় । অনেকে পথ হারায় কিংবা পথই হারিয়ে ফেলে তাদেরকে। তবু ‘ফেরা’। তবু ফেরা-টান। মায়া। আকাঙ্ক্ষা।
‘ফেরা’ শব্দটির থেকে ‘আকাঙ্ক্ষা’ শব্দটিকে আর আলাদা করতে পারি না । “সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্খায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে” – পংক্তিটি প্রথমবার পাঠের পর থেকেই ।
প্রথমবার পাঠ স্কুলে যাপনের অন্তিম পর্বের দিকে যখন ‘ফেরা’, ‘না-ফেরা’, ‘আকাঙ্ক্ষা’র চক্রবাল গুলি মর্মে উদ্ভাসিত হওয়ার কথা নয় । তখন যা মর্মে গেঁথে গিয়েছিল ,ছুঁড়ে দেওয়া তীরের মতন,সে একটি ছবি । সরল খাঁ দিঘির ওই প্রান্তে ঝুড়ি নামা বট-শাখায়, পাতায় পাতায়, রহস্য । ঘন হতে হতে অন্ধকার । তার পিছনে মাঠে সূর্য ডুবে যাচ্ছে আর কা কা কা কা রব তুলে কাকপাখিরা উড়ে আসছে, ফিরে আসছে, নিজ নিজ শাখায়, নিজ নিজ গৃহে, তাঁবুতে, আশ্রয়ের দিকে। চেনা ছবি। নিতান্ত পৌগন্ড-কাল থেকে দেখা। দেখতে থাকা। “সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্খায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে” পংক্তিটি ওই ছবিটিকে যেন একটি ফ্রেমে করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল মর্ম দেওয়ালে । ‘আকাঙ্ক্ষা’ আর ‘কাক’, ‘কাক’ আর ‘ফেরা’। ‘ফেরা’ আর ‘সন্ধ্যা’। ‘সন্ধ্যা’ আর ‘নীড়’।
‘ফেরা’ শব্দের আলোড়ন হেউ ঢেউ হয়ে প্রথম আছড়ে পড়েছিল আরো পরে । হোস্টেল বাসের আদি পর্বে।
‘হোস্টেল’ বলতে ধেদিয়ে চলা সিটি বাসে চেপে ‘টাউন’। ২০ মিনিট। ‘প্রেমতলা’ নেমে আবার মিনিট ১০ হাঁটলেই ‘বাসস্ট্যান্ড’। বাস-টিকিট ১০ টাকা। কৌশিক মুখার্জি হেন বদান্য বন্ধু কিংবা রামধনু দত্তধেন দয়া-সাগর সিনিয়রের কাছে হাত বাড়ালেই ধার পাওয়া যায় ।
মুড়ির টিন হেন ভিড়, ঝাঁকানি,যখন তখন থেমে যাওয়া, কাটাখালের লেভেল ক্রসিং — ইত্যাদি ১৬ টি কলা যদি পূর্ণ হয় তাহলেও দেড় ঘন্টার মাথায় করিমগঞ্জ বাস-স্টপ । নেমে দাদ-খুজলি ধরা চামড়ার মত রাস্তা ধরে, চারপাশের দোকান-দাকান, মাঠ ময়দান, ছোট বাড়ি – বড় বাড়ি দেখে দেখে কচ্ছপ-চালে চললেও খালপাড়ের ছোট বাড়িটির আলো-ইঙ্গিত দেখতে পেতে ৩০ মিনিট। তথাপি হোস্টেল, হয় হোস্টেলই। বাড়ি নয় । নীড় নয় । প্রায় প্রত্যেক বিকালই যখন সন্ধ্যার তোরজোড়, তখনই ‘বাড়ি’,’নীড়’, ‘আকাঙ্ক্ষা’, হেউ ঢেউ ।
ক্রমে ‘হোস্টেল’ কথাটিও হয়ে উঠেছিল ‘নীড়’ই। তখন বিকালের ইঙ্গিত পেতেই কলেজ-বাসে চেপে ‘টাউন’ যাওয়া। তারপর শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চিনে নেওয়া বই- দোকান,চা-দোকান, শুঁড়িখানা, ছুঁড়ি-খানা। চা-দোকানে, শুঁড়িখানায়, ফুটপাতে — আড্ডায় মজে গিয়ে মিস করে ফেলা কলেজ বাস । ‘ফিরবার’ বাস। কোথায় ফিরবার? হোস্টেলে। হোস্টেল-কোঠায় । নিজের অভ্যস্ত খোপে। খাটিয়ায়। স্বাভাবিক অভ্যস্ততায়।
তবে কি সমস্ত ‘ফেরা’, সকলের ‘ফেরা’, সর্বত্র ‘ফেরা’ — প্রকৃত প্রস্তাবে অভ্যস্ততার টানে?
অভ্যস্ততাই কি জন্ম দেয় নিরাপত্তা বোধের?
না’কি নিরাপত্তার বোধ থেকেই আসে অভ্যস্ততা?
ফেরা’ শব্দের অন্তর্গত ‘আকাঙ্ক্ষা’ কি শুধুই নিরাপত্তার? না’কি আরো কিছুর? অন্য কিছু্?
ভাবনার ‘আগা নাই মাথা নাই’। সত্যই।
‘ফেরা’ র কথা থেকে কখন যে আজাইরা কথায় অন্য কথায় চলে গেছি …
পথ, রাস্তা, মাঠ, হাওড় পার হয়ে যে ‘ফেরা’, ঘরে কিংবা গন্তব্যে, সেই ফিরে আসাটির পরে কি হয়? কি কি হয়? আদৌ কিছু হয় কি ?
যেখানে ‘ফেরা’র বাসে ওঠা আর যেখানে নামা তাদের দূরত্ব, মাইলফলকের হিসাবে, ৫৬ কিলোমিটার। ৫৬ “কিলোমিটার” ? না’কি ৫৬ “আলোকবর্ষ”?
‘ফেরা’র পাড়ি গুলি, কোন কারনে, সততই ঘটতো বিকালে। পৌছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা । আড্ডা ততক্ষণে জমে গেছে ঘোষ ডেয়ারী,যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডারে । জমে গেছে তন্তশ্রীর সিঁড়িতে। বাড়ি যাব না আড্ডায় ভিড়ে যাব? ঘড়ি-কাঁটার মতন দ্বিধার এই টিক্ টিক্, শেষ পর্যন্ত, প্রতি বারই, নিয়ে গেছে আড্ডাতেই। কিন্তু আবডালে কোথাও আর একটা ‘ফেরা’, আর একটা অপরাধবোধ।
ওই যে ‘আড্ডা’ সেও কি ছিল না ‘ফেরা’ শব্দের অন্তর্গত উষ্ণতার একটি কম্বল,লেপ? এক টুকরো হাত সেঁকা,গা-সেঁকা আগুন?
‘ফেরা’র, ‘ফেরা ইচ্ছা’র আবডালে ‘আড্ডা’ নয় কি এক বিশাল চুম্বক অদ্যাপি?
‘আড্ডা টান’ অপরিবর্তিত কিন্তু যা বদলে গেছে বহু বৎসর আগেই তা আড্ডা সঙ্গীরা। সে আরেক কাহিনী। সে দিকে এখনো যাবোনা।
ফিরবার – সে গৃহেই হোক, গ্রহ কিংবা গ্রহান্তরেই হোক, কোনো বিশেষ মানুষী, মানুষ, কোনো দৃশ্য বা আবহের নিকটেই হোক – ইচ্ছাটির আবডালে থেকে যায় একটি উষ্ণতার অভিলাষ। অথবা কখনো পাওয়া একটি উষ্ণ’কে আবারো স্পর্শ করবার হেউঢেউ।
কিনারের শহর থেকে ঝর-ঝরা ধর-ধরা বাসে চেপে নিজের গঞ্জটিতে নামা মাত্রই উষ্ণতার বোধ। আড্ডাবাজি সেরে হাটতে হাঁটতে পাড়ায় ঢোকা । তারপর দূর থেকে নিজেদের বাড়িটির ইঙ্গিত চোখে পড়া মাত্র উষ্ণতারমশারি হয়ে ওঠা।
কেন?
কেননা ছোট থেকে ক্রমশ বড় হয়ে উঠবার চিহ্ন গুলি, ইঙ্গিত গুলি, মা-বাবার চোখ-মুখ, স্বর, কন্ঠ, দৃষ্টি, ধমকানি মিশে আছে ওই সাড়ে তিন কোঠা আর দেড় বাদ্রান্দার বসতের সর্বাঙ্গে। মিশে আছে চেয়ারে টেবিলে, তরজা-বেড়ায়, পিছনের খালে, খালের উপর নুয়ে পড়া অর্জুন গাছে, দুই ভাইয়ের রাত জাগা গল্পগাছায়, দরজা বন্ধ-করা সবান্ধব স-সিগারেট আড্ডায়। দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে গড়ে উঠেছে ওই তাপ, উত্তাপ, ওই উষ্ণ। উষ্ণতার এই ধারণাতেই একটি বাড়ি’র ‘আমার বাড়ি’ হয়ে ওঠা, একটি শহর ‘আমার শহর’, একটি গঞ্জ ‘আমার করিমগঞ্জ’ হয়ে ওঠা। এই একই নিয়মেই হোস্টেলের, মেসবাড়ীর নিতান্ত অস্থায়ী কোঠা, বিছানা, নোনা ধরা দেওয়াল, পাল্লা ভাঙ্গা জানালা – সকলেই এক সময় ‘আমার’ হয়ে ওঠে। আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি সেই উষ্ণতায়। সেই ব্যঞ্জনের স্বাদে,অ-স্বাদে,বিস্বাদে। এই অভ্যস্ততা হেতু ব্যঞ্জনের উপকরণে যদি বা কখনো কিছু কমও পড়ে যায়, মগজ টের পেলেও স্নায়ু পায় না কিংবা পেলেও এড়িয়ে যায়। ‘আলাপ’ গড়িয়ে যায় ‘বিস্তারে’।
এই অভ্যস্ত হয়ে উঠবার আবডালে ঘটে যায় আরো একটি ঘটনা । অভ্যস্ততার অন্দরের মানুষটি যেতে থাকে পাল্টে ।
‘অভ্যস্ততা’ আর তাতে ‘অভ্যস্ত মানুষ’টি উভয়ের বদলে যাওয়াতে একটি ভূমিকা কালের, অপরটি স্থানের । ‘স্থান’ অক্ষ দ্রাঘিমার নিরিখে বদলায় না। মানচিত্রে নিরিখে বদলায় অনেক সময় । তবে স্থান চরিত্র বদলের মূল চাবিটি থাকে বাণিজ্য আর বণিকের হাতে, বণিক সভ্যতার মুঠোতে। সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি আমলেও ঢাকা-কলকাতা নামক অঞ্চলগুলির পত্তন ও পরিবর্তন ঘটেছে। তবে ওই পরিবর্তনে যতটা সময় লেগেছিল বিলাইতি যুগে, সেই সকল নগরের চরিত্র ১০০ ভাগ কম সময়ের মধ্যে বদলে গেল গত কিছু বছরে।
কেন?
কেননা নিউ লিবারেলি হাওয়া বইল। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজি বাদ, শ্রম, শ্রমিক, শ্রেনী সংগ্রাম — ইত্যাদি ‘কড়ক’ শব্দের গা’য়ে বিদেশী ‘স্নো’ এর মোলায়েম প্রলেপ দিল নিও লিবারেলিজম। মোলায়েম কিন্তু সংক্রামক। সংক্রামক — মহামারী নয়, অতমারীর মতন কিংবা তার চেয়েও দ্রুতিশীল। ফলে নিউলিবারেলি বদল-হাওয়া প্রত্যন্ত মফস্বলকেও প্রায় রাতারাতিই দিল বদলে,বিগড়ে । প্রত্যন্ত মফস্বল, গ্রাম কিছুই নিস্তার পায়নি সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ আমলে কিংবা নিও লিবারেলি বাতাস বইবার আগেও । কিন্তু নিও লিবারেলি বাতাসের গতি দাবানলের কোটি গুণ আর তার বিষও কোটি গুন গভীরতর ।
ফলে অভ্যস্ত পটভূমি যে পরিবর্তন আমার মা-বাবাকে টের পেতে হয়েছিল চারটি-পাঁচটি দশকে তা’ই আমার প্রজন্মকে টের পেতে হলো এক দশকে বা তারো কম সময়ে। যে উষ্ণতার বোধ নিজ শহর, নিজ বন্ধু বৃত্তকে ঘিরে একদা টের পেতাম, তার প্রায় সমস্তটাই পরিণত হল, শুধু শৈত্যে নয় — সন্দেহে, ভীতিতে ।
এরা কারা — ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটেছে যাদের সঙ্গে — তাদের সিংহভাগই যে অন্দরে অন্দরে ছিল না ‘নাজি’, বা তাদের অন্দরের জাতি-দ্বেষ যে একেবারেই টের পাইনি, তেমন বললে তা হবে অণৃত-কথন। তবে ‘বাবরী’ ঢেউ এসে এদের মুখোশ-রং দিল ধুয়ে। ‘বন্ধু’, ‘সমপাঠী’ থেকে এরা হয়ে গেলো ‘করসেবক’। এদের অবচেতন-ছবি কে বাস্তবের রথ করে নামলো আদবানি। দাঙ্গা হল শুরু। দুই পেয়ালা চা নিয়ে যে পাঁচ জনে ভাগ করেছি ক’দিন আগেও তাদের তিনজনই এখন কপালে গেরুয়া ফিতে বাঁধে। “মন্দির এহি বানায়েঙ্গে’র হুঙ্কার তোলে। অতঃপর লালু-মোলায়েম আটকে দিল ওই খুনী রথ, খুনে পরিক্রমা। আবারো দেখলাম আরো এক দল চেনা মুখ অচেনা হল। “আরে ভাই, হিন্দুর রথ আটকানোর প্রতিবাদ তো করতেই হবে”। — অন্তিমে এসে পড়লো, ক্যালেন্ডারে, সেই ৬ ডিসেম্বর । নিজের একান্ত বৃত্তের না হোক, আড্ডা-বৃত্তের পরিধি স্পর্শ করে থাকা প্রায় প্রত্যেক জন মানুষের খুলিতে নাজি-তিলকের উদযাপন দেখা বাস্তবেই এক রক্ত বরফ করা অভিজ্ঞতা।
আবার এ’ও ভাবি, যে, এই সকল ঘটনা না ঘটলে — আমার অভ্যস্ততার, উষ্ণতার অনুভবের অদলবদল ঠিক কিভাবে, কত সময়ে ঘটতো? আদৌ ঘটতো কি? তবে এ নিয়ে আলোচনা– অনুমানের দুর্গ প্রাসাদ রচনা ও ধ্বংস ভিন্ন আর কিছুই না। তাই সেসবে না গিয়ে, সাধারণভাবে এটুকু বলা যায় যে এত দ্রুত না হলেও, ক্রমে ‘অভ্যস্ততা’ ও তা’তে ‘অভ্যস্ত’ মানুষটির, মানুষদের পরিবর্তন ঘটে,ঘটতোই — কালের কিংবা বয়সের নিয়মে । আর যেহেতু ‘প্রগতি’ মন্ত্রটি সভ্যতার বিকাশের সর্বস্তরে, সকল বাঁকেই ওঁৎ পেতে থাকে, তাই স্থান-চরিত্র, সমষ্টি-চরিত্রেরো গতিমুখ বদলাতো, এই বণিক-সভ্যতার কেটে দেওয়া খাল ধরেই। অতএব, যে বিন্দুটি থেকে যাত্রার আরম্ভ হয়েছিল, তা’তে ফিরবার, ফিরতে পারবার আলোচনাটি, অন্তিমে, প্রশ্নচিহ্ন হতে ছিল বাধ্যই। আমাকেও তাই ফিরতে হয় ওই প্রশ্নটিতেই — ‘ফেরা’ শব্দের অন্তর্গত যে ‘উষ্ণতা’ তা বর্তমানের আর কতদূর স্মৃতির? স্মৃতি প্রক্রিয়াটি কতটা বয়স নির্ভর ?
স্মৃতির,মনে হয়, কোন বয়স নেই ।
‘স্মৃতি’ এমন একটি ভাইরাস যাকে প্রতিহত করবার ক্ষমতা কিছু মানুষের থাকে, কিছু মানুষের থাকে না । যাদের যাদের মধ্যে থাকে, প্রতিরোধ, স্মৃতির বিপক্ষে, তারাও পুরনো দিনের গল্প বলে, স্মৃতিকথাও লিখে । তবে এর জন্য তাদের নির্ভর করতে হয, অপেক্ষা করতে হয়। নির্ভর করতে হয, অপেক্ষা করতে হয় বয়সের, বার্ধক্যের অথবা সহসা দেখা দেওয়া কোনো কালরোগের সঠিক কিংবা বেঠিক অনুভবই তাদের নিয়ে যায় স্মৃতিকথার দিকে, হারানো-পুরানো দিনের গল্প বলবার দিকে ।
স্মৃতি-ভাইরাস-প্রতিরোধ শক্তি যাদের নেই অথবা কম তাদের স্মৃতি-তাড়িত হতে বয়সের প্রয়োজন হয় না । ১৮-১৯ বৎসর বয়স থেকেই আমি স্মৃতি-তাড়িত। কলেজে বয়সে সম্বল হাই-ইস্কুল, পাঠশালা দিনের মন-ছবি। হোস্টেলে যোগ হলো বাড়ি ছবি। তবে ক্রমে, যে বন্দরে নিয়ত ফিরতাম, এখনো ফিরি, তা ইস্কুলের ৯ম শ্রেনী থেকে কলেজের ১১-১২ ক্লাশ।
স্মৃতি-তাড়িত, স্মৃতি-রোগাক্রান্ত প্রতিজন মানুষেরই সম্ভবত থাকে এই রকমের কিছু কিছু বন্দর, স্মৃতির মানচিত্রের ভিতরে যেখানে সে ফিরতে চায়, কিন্তু পারে না।
সামান্য কল্পনা-প্রতিভার অধিকারী হলেই সে আর ফিরতে পারে না তার আরম্ভ দিনে, যাত্রা লগ্নে, যাত্রার ঘাটে কিংবা আঘাটায়।

যদিও বন্ধু বৃত্ত, বিশেষ করে হাই-ইস্কুল-বন্ধু, কলেজ-বন্ধু ঘিরে যে বৃত্ত , তা চির না ধরে সোজা খান খান হয়ে গিয়েছিল বাবরি অভিজ্ঞতায় , কিন্তু ওই সময়েই তৈরি হচ্ছিল আরেক বন্ধু বৃত্ত — যার বেশ ক’টি নাম অদ্যাপী বন্ধু তালিকায় উজ্জ্বল । তাই বলতে পারি, যে, বন্ধু-তালিকা বদলে গেল ঠিকই কিন্তু ‘বাড়ি-ফেরা’ উষ্ণতার যে টুকু উত্তাপ বন্ধু-জনিত, আড্ডা জনিত, তার তারতম্য ঘটলো না । হ্যাঁ, আজো ফিরতে চাই সময়ের ওই বৃত্তেই।
সময়ের ওই বৃত্তে নেই ‘গজানো শপিং মল’, নেই ‘জবরদখল জমিতে মন্দির তুলে ধর্ম ব্যবসা ও তার রমরমা’। ওই সময়ের বৃত্তে নেই একটিও ফ্ল্যাট বাড়ি, আমার শহরে । এমনকি বাস্তব প্রয়োজনেই অদ্য আমাদের যে ভিটেবাড়ি ক্রমে দোতলা, তা’ও আমার স্মৃতি-মানচিত্রে ফিরতে চাওয়ার বন্দরটিতে নিতান্ত সাড়েতিন কোঠা আর দেড় বারান্দার একটি তরজা-বেড়ায় ঘেরা চত্ত্বর। ‘নাজি হুল্লোড়’ থাকলেও মর্মের বৃত্তে আছে প্রতিরোধ।
যারাই স্মৃতি পীড়িত, যারাই ফেরার স্বপ্নে তাড়িত — তাদের সকলেরই মর্মে থাকে এই রকমের কিছু ছবি যা একটি বিশেষ সময়ের চালচিত্রে আঁকা।
কিভাবে সেখানে ফেরা ?
অগাস্ট উপচে সেপ্টেম্বর এসে গেছে । সেপ্টেম্বর বয়ে যাবে অক্টোবরে । আসবে দুর্গাপূজা । চলে যাবে। যদি যাই, ‘বাড়ি’তে দুর্গাপূজায়,তাহলেই বা কি হবে ?
দুর্গাপূজা — সমস্ত প্রকৃত নাস্তিকের মত আমিও ভক্তিগদগদদের তুলনায় , অন্তর্গত উৎসবে ঢের বেশী আনন্দিত হতাম, হতে পারতাম, কেননা দেবীকে অঞ্জলি দিয়ে পুণ্যটুন্য কিনবার দায় নেই আমার । তাই, দেবী প্রতিমার মুখটি দেখবার মধ্যেই আমার আনন্দ। হেউঢেউ ।
‘মহালয়া’ আমার কাছে সহরময় অনর্থক পায়চারি করে বেড়ানোর ভোর নয় — মহা-গল্প মহাকাব্য শুনবার, আহ্লাদ। চন্ডী পুস্তিকা খুলে বীরেন ভদ্র’র বলে যাওয়া শ্লোকগুলি চিহ্নিত করবার চেষ্টা । ‘মহালয়া’ আমার কাছে, আকৈশোর, শরতের পূর্ণতার চিঠি ।
কিন্তু দেশ বাড়িতেও কি আসে আর ওই শরৎ ?
প্যান্ডেল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় পূজা করবার যে ধুম কৈশোরের শুরু থেকে প্রায় শেষ অবধি দেখেছি, তার মর্মে পাড়া-দাদাদের উদ্দেশ্য আর যাই থাকুক, নাজিবাদ-ফ্যাসিবাদের সচেতন,সদম্ভ প্রচার ও প্রসার নিশ্চিত ছিল না । টাউন কালীবাড়িতে আরএসএস-বীজানু নিয়ে হাফ-প্যান্ট গবেষণা ও প্রদূষণের মন্ত্রণা চলছিল, তবে রেখেঢেকে।
কালীবাড়ির মাইকে, তখনো, ধনঞ্জয় না হোক অন্তত পান্নালাল বাজতো। অমৃতসিং অরোরা উঁকিঝুঁকি দিলেও ফাঁক পায়নি ঢুকবার। তখনো।
রামপ্রসাদী আর কমলাকান্ত’র কথা, ধনঞ্জয়-পান্নালালের সুর,মনে,অন্তত আমার মনে,এনে দিত, প্রথম থেকেই কোন দেবী-মা’র ছবি নয় — নিজের রক্ত মাংসের মাকে।
কিন্তু দেশ বাড়িতে যে ফেরা, দুর্গা পূজার উপলক্ষে, নিজের রক্ত মাংসের মা’র কাছে থাকবার আকাঙ্ক্ষায়,তারও অনেকটা জুড়েই কি নয় ওই আবহও — যা প্রতিমা’তে মা আর মা’তে প্রতিমা দেখবার দৃষ্টিটি দিয়েছিল ?
আজ ওই আবহের অনুপস্থিতিতে মা’তে প্রতিমা কিংবা প্রতিমাতে মা স্থাপন — কি সম্ভব, দুরূহতম কল্পনাতেও ?
কল্পনা,হয় নিশ্চিত বিঘ্নিত । হয়েছে সেখানে গিয়ে পূজা উপলক্ষে, কিছু বৎসর আগে ।
মা ছিল,বাবা ছিল,ভাই ছিল, বন্ধুরা ছিল, আড্ডা হয়েছিল । ঠিক । তথাপি আগমনীর সুর আলোর বেণুতে বাজেনি ।
এই বেঙ্গালোরে বা আরো সব কৃতান্ত-নগরীতে যে ‘পূজা’, যে সকল ‘পূজা’ – সেগুলি তো ঘৃণারও অযোগ্য। অতএব, বাস্তবে আমার জীবন, আমার যাপন, আমার মতো আরো অনেকেরই জীবন ও যাপন থেকে বাহিরের শরৎ, বহিরঙ্গের আগমনী, পূজা – বিলুপ্ত। বহুযুগ। তথাপি “শরৎ আনন্দের বাড়ি ফেরা”, আনন্দিত বাড়ি ফেরা, পরবাসীর। কিন্তু তার সঙ্গে বাইরের কোন সংশ্রব নেই। সব সংশ্রব স্মৃতির, কল্পনার। — প্রতিফলিত, প্রতিসরিত রশ্নি। আলোছায়ার খেলা। অন্দরের।

– x –

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes