ধারাবাহিক গদ্য সেপিয়া রঙের গলি – দ্বিতীয় পর্ব <br /> অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ধারাবাহিক গদ্য সেপিয়া রঙের গলি – দ্বিতীয় পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন— সেপিয়া রঙের গলি প্রথম পর্ব

সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে…’

কান বিঁধানো কন্যাটি সুতোর গয়না পরেছে। হয়ত কখনও জুটবে এককুচি সোনা, আপাতত ঘোলাটে সুতোর গিঁট বেঁধেছে কানে। চলন্ত মোটরসাইকেলের সামনে পড়ে গিয়ে একচুলের জন্য বাঁচতে বাঁচতে উঠে দাঁড়াল কন্যা। পৃথিবীর সকল মৃত মায়ের মুখ মেশানো আদল তার। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়েছিল, উঠতে পেরেই ভাঙা রাজবাড়ির অরক্ষিত উঠোনে নেমে গেল।

তখন বিকেল। মুহূর্তের মধ্যে কী হতে পারত ভেবে চারটি হৃৎপিণ্ড বেদম জোরে ছুটছে! কালো ইজের পরা কন্যাটি উঠোনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটে। ছোট্ট নরম বাদামি শরীরখানা অশ্রুত ছন্দের তালে তালে নেচে ভাঙাবাড়িতে ঢুকে যায়। আমরা চারজন তখনও ভয়ে কাঁপছি।

একেকটি দিন ষড়যন্ত্রী হয়। স্বাভাবিক দিনের ছদ্মবেশে আসে সেসব দিন। কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই। অথচ বহু বছর পরে সেসব দিনের দিকে চোখ পড়লে হতবাক হতে হয়- এই তবে শেষ দিন ছিল! বোঝা যায়নি তো!

সেই গলানো কমলা রং মেখে ক্রমে ছোটো হয়ে আসা বেলায় আমরা পৌঁছই আড্ডাখানায়। সেইসব দিনে জীবনকে আস্ত একটি আড্ডাখানা ভাবার প্রবণতা ছিল। সীমানা বিস্তৃত হচ্ছিল, অথচ আমরা আঁকড়ে ধরছিলাম চেনা পৃথিবীটাকেই। আমাদের সেই তিনফালি মফস্বলি স্টেশনের বাইরে আর কোনও দুনিয়া থাকতে পারে, সেদিন আমরা তা বিশ্বাস করিনি।

আমাদের চামড়া টানছিল। উৎসব শেষের শান্ত মরা সময়। হু হু বাতাসে হিম আভাস। বিকেলের রোদে একটা কান্না ছিল। আমরা টের পাইনি সেই ইঙ্গিত। হপ্তামাফিক আড্ডাখানায় এসে বসেছি।

তিনজন অবিশ্বাসী প্রাণ ঘিরে থাকত আমার বিশ্বাসী প্রণাম। ভাঙা রাজবাড়ি, লাগোয়া টেরাকোটা মন্দির আর ঐ যে সুউচ্চ অপরূপ পদ্মের পাঁপড়ি, সেইখানে চারটে এতোল বেতোল প্রাণের অর্থহীন গজল্লা। জটিল হবার প্রথম পাঠ।

কন্যাটি কোথায় হারাল কে জানে! উঠে এলাম পাথুরে উঠোনে। ঠাণ্ডা। আলো সরে গেছে বিপরীতে। আগেকার মতো হইহই এগোনো নেই। হাসি নেই। পাঁজরের খাঁচায় ভয়ের দৌড় থেমেছে, তবু চুপচাপ। কত কী ইশারা সময়ের হাতে থাকে। দিন ফুরোলে বোঝা যায়।

পুরোহিতমশাইয়ের চেনা মুখ আমরা। তাঁর আবছা মুখে পরিচিত হাসির ঝলক। চোখে প্রশ্নের অধিকার। ‘আর কেউ বিশ্বাস করো না?’

লজ্জিত হাসি। তারপরে উত্তর, ‘মেমসাহেব আমাদের হয়ে চেয়ে নেয়। ’

বজ্রাক্ষ, ইরা, চিত্রিণী, পিঙ্গলা, ও সুষুম্না- সমন্বয়ে মানবদেহ। মানবদেহের আকারে একটি মন্দির। রত্ন স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। ভিতরে বসে আছেন মা। দেবীত্বের বাইরে তিনি মা। জন্মদাত্রী। যন্ত্রণা, জীবনযাত্রা ও সম্পর্কের বাঁধুনি ঘেরা এক নারী। রাজা নৃসিংহদেব রায় মহাশয়ের জননী রানি হংসেশ্বরী দেবী। জগজ্জননী দক্ষিণা কালীরূপে পূজিতা হন হারিয়ে যাওয়া এক মা।

রোদ চাই। আমাদের নীরবতায় রোদ্দুর চাই। আমরা নেমে আসি পোড়ামাটির মন্দিরে। এখান থেকে ভাঙা রাজবাড়ি আরও কাছে। শখের ক্যামেরা, বিস্ময়, সয়ে আসা অভ্যেস ক্রমে প্রকাশ পায়। ভিতরে ধুলো। দু’চারজন বসে আছে। আড়াল খুঁজছে কেউ কেউ। প্রিয়তম বন্ধুটির গলা বাজল সবার আগে। ‘কী চাইলি মেমসাহেব?’

কী চাইলাম! কী যে চাওয়া যায়, সেটাই তো প্রশ্ন! গোলাপি পদ্মপাতাগুলি আকাশ ছুঁতে চাইছে। নীল সাদা আকাশে ধাক্কা মারছে অন্যরকম হয়ে ওঠার দম্ভ। এমন মিনারের কাছে দাঁড়িয়ে কীই বা চাওয়া যায়! তেরোটি রত্ন (মিনার) ঘেরা ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিবার বিস্ময় প্রকাশ করেছি। মস্তিষ্কের ভিতরে ঝড় বয়েছে, মস্তিষ্ক যেন নিজের এক বন্ধ দরজা খুলতে চেয়েছে। সেই দরজার ফাঁকফোকর বেয়ে আলো পড়ে চৌকাঠে, উঠে আসে কাঁচা শব্দ, আবছা দুনিয়া, অস্পষ্ট মুখ হাঁটে মাথার ভিতর। এতসব কি বোঝানো যায়! মুচকি হেসে উত্তর দিই, ‘বলতে নেই। ’

‘ভারি তো তোর ভগবান! বুঝি না আমি!’

ঈশ্বর কি বুঝবার? না মানবার? না ভালবাসবার? না ভয় পাবার? আমি সংশয়ে থাকি। যাকে নিজেই বুঝলাম না, তাকে কী করে বোঝাই! অল্প দূরের রাজবাড়ির বারান্দায় একটা ছেঁড়া চট ঝুলছে। ভিতরে বেলা পড়ে এসেছে। কোথাও কেউ নেই। ছেঁড়া চটখানা হাওয়ায় দুলছে। দূরের মানুষ যেভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকে, সেভাবে। যেভাবে বলে, ‘এসো, আমার শরীরে সময় বন্দি, ছানবে, হারানো মাটি তুলবে এসো!’ সেইভাবে ভাঙা, শ্যাওলা ধরা রাজবাড়ির বারান্দায় ছেঁড়া চটখানা দুলছে।

তন্ত্রে বিশ্বাসী রাজা নৃসিংহদেব রায় মহাশয় ১৭৯৯ সালে মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কথিত আছে, রাজার মা রানি হংসেশ্বরী দেবী ছিলেন শ্যামবর্ণা। মায়ের আদলে তৈরি নিমকাঠের দেবীমূর্তিতে তাই ঘন নীল রঙের প্রলেপ। মস্কোর পোক্রভস্কি ক্যাথিড্রালের স্থাপত্যের সঙ্গে অদ্ভুত মিলের এই অনবদ্য স্থাপত্য রাজা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। ১৮০২ সালে রাজা নৃসিংহের মৃত্যুর পর মন্দির নির্মাণ থেমে যায়। শরিকি বিবাদ সামলে এগিয়ে আসেন রাজার দ্বিতীয়া স্ত্রী রানি শঙ্করী। দু’টি তলের অসমাপ্ত মন্দিরকে তিনি পাঁচটি তলের ও তেরোটি পদ্মের মিনার সমেত মানবদেহের আকারের এক অন্যরকম স্থাপত্য হিসেবে গড়ে তোলেন। ১৮১৪ সালে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের শেষে আগুনে পোড়া এক আগুনে নারীর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় হংসেশ্বরী মন্দির।

অন্ধকার হয়ে আসছে। আলো শেষে ছবি নেই ভেবে আমার অবিশ্বাসী বন্ধুদের ব্যস্ততা বাড়ছে। এমন সময় মুখে আফসোসের শব্দ করল এক বন্ধু। ‘এই জায়গাটা মনে পড়বে রে! কী সুন্দর ছিলাম আমরা!’

টাইম ট্রাভেল ফেলে রেখে আমি ঘুরে তাকাই। ‘ মানে? এখুনি অতীত হয়ে গেছি নাকি আমরা?’

‘আরে আমি তো চলে যাচ্ছি বেঙ্গালুরু। কবে আসব না আসব আবার!’

যত সহজে বলল, তত সহজে থেমে গেল ক্যামেরা, কাঁচা কবিতার চেষ্টা, প্রিয়তম বন্ধুটির সেলফোনে লুকোনো টেক্সট। সকলের চোখ আকির দিকে। তিন জোড়া চোখ আলগা অভিমানে বলছে, ‘বলিসনি তো আগে!’

গলা ঝেড়ে গলা বাজল। ‘কবে যাচ্ছিস!’

‘এই তো জানুয়ারিতে। আর দেরি নেই। ’

এই আকস্মিকতায় আমার মস্তিষ্কের ভিতর শব্দ পেলাম। গঙ্গাপাড়ের গলিতে সেই যে আকিদের দুর্গের মতো একটেরে তিনতলা ভাড়াবাড়ি, সেই দুর্গের মাঝারি লোহার গেটখানা বন্ধ হবার ঘরঘরে শব্দ হল। বন্ধুদের বাড়ির দরজা এমনি করে বন্ধ হয়ে যায়।

অমোঘ অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠল। আমাদের নীরবতায় এসে পড়ার মতো রোদ্দুর অবশিষ্ট নেই আর। প্রিয়তম বন্ধুর মোবাইলে ঘন ঘন আলো জ্বলে উঠছে। সে কোন দূরের মেয়ে তাকে ডাক পাঠাচ্ছে। আমার উপস্থিতি বিষয়ে অবগত নয়, এমন এক মেয়ে ডাকছে তাকে, উদ্বিগ্ন হচ্ছে। দল ছেড়ে মুকু সরে গেল। ভুতো সিগারেট হাতড়ে টেরাকোটা মন্দিরের উল্টো পিঠে চলে গেল। রাজবাড়ির ছেঁড়া চটের ওপারে একটা বাল্ব জ্বলে উঠল।

‘কী রে, কিছু বলবি না? এমন চুপচাপ?’

হেসে বললাম, ‘সাবধানে যাস। ’

সেলফোনের বাক্যালাপ সেরে এসে মুকুর ব্যস্ততা বেড়ে গেল। ‘এবার বেরোতে হবে!’

ভুতোর মুখে আফসোস, ‘আজ আড্ডা জমল না ছাই। চ’ ফিরি। ’

‘আকিটার জন্য! এমন একটা মনখারাপের খবর দিল!’

‘ফালতু বকিস না। বাচ্চা মেয়েটার জন্য! কীভাবে গাড়ির সামনে পড়ল! ভাবলে এখনও আমার… তখনই তাল কেটেছে। বড় বিপদ থেকে বেঁচেছি আজ!’

আমরা চারজন টের পাচ্ছি, আমাদের ভাবনা পাল্টে গেছে। একসুরে বাজছে না কিছুই। আসবার সময় রোদ ছিল, হাওয়া ছিল। এখন ভাঙনের হিম অন্ধকার।

কিছুদূরে গেলে একটা ব্রিজ। যাতায়াতের পথে পড়ে সেই নির্মীয়মাণ সেতু। এড়ানোর রাস্তা নেই। নীচের রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। আমি বন্ধুর প্রতি ভরসায় সেই রাস্তার নাম মনে রাখিনি। এখন খুঁজলে পাওয়া যাবে কি? রাস্তার গায়ে একটা বাড়ি ছিল। গির্জার মতো দেখতে পুরনো বাড়িটার নাম ‘কালাচাঁদ’। বাড়িটার বিপরীতে শান্ত গঙ্গা ত্রিবেণীর দিকে চলেছে। ফি-হপ্তার আড্ডা শেষে এই বাড়িটার কাছে দাঁড়াতাম আমরা। হো হো হাসি, ইয়ার্কি, মারপিট, গান, প্রেম… নরক গুলজার। আজও দাঁড়ালাম। অভ্যেস ছাড়ে না। আকি গাইছে, ‘মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা, ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা…’ (ঘুরেফিরে শুধু এই গানটা গাইত)। আমার চোখ মুকুর দিকে। বেচারা! উশখুশ করছে। সেলফোনে ঘনঘন আলো জ্বলে উঠছে। ধাক্কা দিতে ইচ্ছে হল। বললাম, ‘গান থামা। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে!’

মুকু চোখ নামায়। লজ্জিত হাসে, ‘সবই তো বুঝিস মেমসাহেব!’

আমরা চারজন ফিরে যাচ্ছি। আমাদের আলাদা আলাদা ঠিকানা কখনও আলাদা মনে হয়নি। বন্ধুর বাড়ির উঠোন রোদ, মেলে রাখা শাড়ি জামা আমি চিনতাম। কিন্তু সেই হেমন্ত সন্ধেয় আমাদের ঠিকানা আলাদা হল। মোটর সাইকেলে স্টার্ট পড়ল। একবার পিছন ফিরে দেখলাম নির্মীয়মাণ ব্রিজ। রাতভর আলো জ্বেলে কাজ চলছে। বুঝলাম, সময়বিশেষে গড়ে উঠতে থাকা সেতুকে দেখলে ভাঙা সেতু বলে মনে হয়!

বেশ ক’বছর কাটল। আমরা বয়ে গেছি পৃথক পৃথক প্রবাহে। ‘কালাচাঁদ’ বাড়িটা ভাঙা পড়েছে কি না জানা নেই। আমরা ছেড়ে এসেছি আমাদের ‘মৃদু জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম’।

‘আমাদের ছুটি মন বদলের খেলা/ আমাদের ছুটি অরণ্যে খোঁজাখুঁজি/ আমাদের ছুটি হাসি-কান্নার বেলা/ আমাদের ছুটি ইঙ্গিতে বোঝাবুঝি/ খেলায় খেলায় জীবনপৃষ্ঠা ওড়ে/ খেলায় খেলায় ইতিহাস দেয় উঁকি/ এদিকে ওদিকে পৃথিবীর পিঠ পোড়ে/ কত না মানুষ ভুরু কুঁচকিয়ে সুখী…’

রত্নমন্দির তার গোলাপি পাঁপড়ি মেলে রেখেছে আকাশে, নির্মীয়মাণ সেতু খুলে গেছে বহুদিন। আমি শুধু ভাঙা সাঁকো দেখতে পাই, তাই আর যাই না সেই পথে।

‘সাঁকোটির কথা মনে আছে আনোয়ার? এতকিছু গেল, সাঁকোটি এখনও আছে/ এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার/ সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে…’

ক্রমশ

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    সন্মাত্রানন্দ 2 years

    ছোটোবেলার বন্ধুদের দেখা হওয়া ছেড়ে যাওয়া মনে পড়া নিয়ে হংসেশ্বরী মন্দিরের আশেপাশে আবর্তিত হয়েছে এই মুক্ত আখ্যান। মনোমুগ্ধকর।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes