ধারাবাহিক গদ্য <br /> সেপিয়া রঙের গলি <br /> অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ধারাবাহিক গদ্য
সেপিয়া রঙের গলি
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম পর্ব
‘মুকুটটা তো পড়েই আছে…’

ধ্বংসস্তূপের উপরে একটি শিশু জন্মেছে। শিশুটির কান্না উঠছে বাতাসে। শনের নুড়ির মতো চুলের এক বৃদ্ধা তাকে কোলে নিয়ে উঠোনের ধ্বংসস্তূপে ঘুরছেন। উঠোনের ওপারে ঠাকুরদালান। চকমিলানো মেঝে থেকে যে দেওয়াল উঠেছে, তার গায়ে বহু বহু দিন আগে কেউ খোদাই করেছিল কুলদেবতার নাম। এখন সেখানে এক মুমূর্ষু স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দূরের কাউকে ডাকছেন, তাড়াতাড়ি দোতলায় পৌঁছে দেবার কাতর আর্জি তাঁর গলায়।

উঠোনে ঝড়ের চিহ্ন। গরিব মানুষের স্বাস্থ্যবর্জ্যে ভরে আছে রাজার উঠোন। একটি ভাঙা লোহার বেডের ধারে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে শিশুকোলে বৃদ্ধা আমাকে দেখলেন, একগাল হাসলেন। বললেন, ‘একফোঁটা মেঘ নেই আজকে!’

মেঘ ছিল না সেদিন। মে মাসের ঘর্মাক্ত ভরদুপুর। বার্মাটিকের কারুকাজ করা দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ওপরে লেখা ‘এক্স-রে’। বৃদ্ধার দিকে তাকালাম, মুখ থেকে হাসির মতো কিছু একটা বের করার চেষ্টা করে বললাম, ‘ঠাকুমা হলেন? না দিদিমা?’

উত্তরের আগে চিৎকার এল। দোতলার খড়খড়ি দেওয়া অপূর্ব জানালা, সদ্য সবুজ রং করেছে কেউ, সেখান থেকে চিৎকার করে উঠলেন শুভ্রবসনা নার্স, ‘ঠাকুরদালানে মেল ওয়ার্ডের পেশেন্ট পড়ে আছে, বয় কোথায়!’ আশ্চর্য! যুগ যুগ ধরে চালু নামটাই বললেন নার্স। করিডোরের নাম নিলেন না। ডেকে উঠলেন ‘ঠাকুর দালানে’। দেখে মনে হল অনন্ত শুভ্রা এক বহুযুগ ধরে অন্দরমহল পাহারা দিচ্ছে। ঠাকুরদালানের পৃথিবী সে চেনে!

রোগা কালো ছেলেটি দৌড়ে এল। স্ট্রেচার টানতে শুরু করল। সেদিকে একবার তাকিয়ে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন, ‘আর বলো কেন! নাতনি! ছেলের ঘরে মেয়ে! প্রথম বাচ্চা ছেলে হলেই ভাল ছিল, কিন্তু এখন তো আবার এসব বলাও যাবে না!’ সজোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কোলের শিশুটি বাইরের হাওয়ায় কোনো জাদুবলে চুপ করেছে। তার মুখ দেখা যায় না। বোধহয় ঘুমন্ত। সেই ঘুমন্ত মুখে পড়ল তার পূর্বনারীর দীর্ঘশ্বাস। আমারও গায়ে এসে লাগল।

তপ্ত বেলা, খিদের পেট, দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে কত বছরের ওপার থেকে বৃদ্ধার দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার মুখে। সেদিন মেঘ ছিল খুব। সেদিন বৃষ্টির আভাসে আরও জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা নামছিল মফস্বলে। কোনো এক বেসরকারি হাসপাতালের করিডোরে এই বৃদ্ধার মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আমার বাবা। রাগ করছিলেন, ছুঁতে চাইছিলে না কাপড়ের পুঁটলির মতো আমাকে। সদ্য তাঁর প্রথম পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা ভেঙে গেছে। জন্মের দিনে অভিমানে আমাকে কোলে নিলেন না বাবা।

বৃদ্ধার ডাকে চটকা ভাঙল। ‘তোমার কেউ ভরতি আছে?’

‘হ্যাঁ। আমার বাবা। ’

‘কী হয়েছে বাবার?’

‘হার্ট অ্যাটাক। ’

‘আহা গো এইটুকু মেয়ে! বাপের এমন…! বাড়ির আর কেউ আসেনি?’

‘পরিজনেরা বিকেলে আসে। খুব গরম তো! আমি সকালে আসি। একটা জরুরি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, সেটা কিনে দিয়ে ফ্রিজে রাখতে হয়। রাতে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে পরিবারের সঙ্গে বাড়ি যাই। আবার সকালে আসি। ’

‘দ্যাখো দেখি কী কাণ্ড! একলা মেয়ে! খাও কী?’

‘দুপুর দেড়টায় ইঞ্জেকশন দেওয়া হলে ভাতের হোটেলে খেয়ে নিই। ’

আয়ার ধমকানিতে বৃদ্ধা সতর্ক হলেন। আমাকে বললেন, ‘যাই গো। আয়াটা খিটখিট করছে কী! একা একা ঘুরো না। মেয়েমানুষ!’

শিশুটিকে নিয়ে বৃদ্ধা চলে গেলেন। বেঞ্চের এক কোণে ফাঁকা পেয়ে আমি বসে পড়লাম। দেড়টা বাজতে অল্প দেরি। রাজার লনে ছাউনিতে এখন বড় বেশি রোদ, পিঁপড়ের আখড়া। এখানে এক্স-রে প্রার্থী সেজে বসে থাকা ভাল। বসে বসে লোক দেখি।

অজস্র মুখের ভিড়। রাজবাড়ি। অন্দরমহলের ঠাকুরদালান এখন মেটারনিটি ওয়ার্ড। করিডোরে রেডিওথেরাপির বিভাগ। উঠোনে হাসপাতালের বর্জ্যের ধ্বংসস্তূপ। যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পোল্যান্ড! ছাওয়াতে বসে বসে ঠাকুরদালান দেখি। মেঝের সাদা কালো চৌকো থেকে দেওয়ালের উজ্জ্বল গেরুয়া রং হাসপাতালের পক্ষে বেমানান। তবু একটি হারিয়ে যাওয়া পরিবারের আভিজাত্য ধরে রাখতে কেউ ভেঙে দেয়নি। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা কৃষ্ণনাম, রাধানাম। একদা ঠাকুরঘর এখন সদ্যোজাতদের প্রথম আশ্রয়।

আজ অবধি যত হাসপাতালে অপেক্ষা করেছি, যন্ত্রণা ও দুঃখের মুখ ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি। প্রবল ব্যস্ততার মুখের মধ্যেও যেকোনো মানুষই সুযোগ পেলে যন্ত্রণার কথা বলতে চায়। নতুন প্রাণের বিভাগে বরং পরিবেশ কিছুটা হালকা থাকে। আমার দেখতে ভাল লাগে।

এলাকার এই হাসপাতাল সরকারি। পোশাকি নাম উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হলেও, এলাকার লোকের আদরের নাম রাজবাড়ি হাসপাতাল। রাজার বাড়িতে তৈরি হাসপাতালে এখন দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রার্থীর ভিড়। তার মধ্যেই জেগে রয়েছে অন্য যুগ। একটি পরিবারের গল্প বলবে বলে।

কবিগুরুর জন্মের বছর। গঙ্গা তীরের গ্রামটিতে বিয়াল্লিশ বিঘা জমির ওপর রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। তারও বেশ কিছু বছর আগে ১৮৩০ সালে হুগলির ভূমি-রাজস্ব বিভাগের রেকর্ডরক্ষকের চাকরি নিয়ে গঙ্গা তীরের গ্রামটিতে আসেন যুবক জয়কৃষ্ণ। সেই সময়ে বন্যার কারণে চাষের ক্ষতি হওয়ায় জমিদারি এস্টেট একে একে বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। চাকরিরত জয়কৃষ্ণ একে একে সমস্ত জমি কিনে নিতে শুরু করেন এবং একটি সময়ে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ কলিকাতার ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পত্তির সমান হয়ে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যেই কলিকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের কন্যা এসেছেন তাঁর স্ত্রী হয়ে। ১৮৩৫ সালে চাকরি ছেড়ে উত্তরপাড়া জমিদারির পত্তন করেন সাতাশ বছরের তরুণ জয়কৃষ্ণ। পরবর্তীকালে তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলার নবজাগরণে এই স্থান এক অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ১৮৩৮ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত জমিদার সংঘের সম্মানীয় সভ্য নির্বাচিত হন হিন্দু স্কুলের প্রাক্তনী জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।

সেকালে প্রায় পঁচাশি হাজার টাকা খরচ করে ভাগীরথী-হুগলি নদীর ধারে এক অসামান্য গ্রন্থাগার ভবন স্থাপন করেছিলেন তিনি, বর্তমানে যা জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী নামে পরিচিত। ১৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে নিজস্ব সংগ্রহের তিন হাজার বই দান করেছিলেন। আজও এটি এই অঞ্চলের অন্যতম গর্বের স্থান হয়ে দাঁড়িয়ে। এই গ্রন্থাগারে এসেছিলেন ঋষি অরবিন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রেভারেন্ড জেমস লঙ। অসুস্থ অবস্থায় আশ্রয় পেয়েছিলেন স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার দু’বছর পরে একইরকম নিওক্লাসিক্যাল রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাজা’ জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। পিতা জগন্মোহন মুখোপাধ্যায়ের দোমহলা বাড়িটিকে তিনমহলা রূপ দিয়ে রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে পিতার দাতব্য চিকিৎসালয়ের স্বপ্নপূরণ করতে রাজবাড়িটিকে এলাকাবাসীর জন্য একটি দাতব্য হাসপাতাল হিসেবে দান করে যান ‘রাজা’ জয়কৃষ্ণর পুত্র ‘রাজা’ প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়। অঞ্চলের শিক্ষাপ্রসারেও তাঁর অবদান শতক পেরনো মানুষ মনে রেখেছে।

বৈশাখের গলানো দুপুর। সদ্য সবুজ রং ধরা দেওয়াল উঠে গেছে অন্দরমহলের দোতলায়। এখন সেখানে ‘ক্রিটিকাল কেয়ার ওয়ার্ড’। একটু আগে যে সেবিকার মুখ দেখেছিলাম জানালায়, সেই জানালায় চোখ রেখে দেখি একটা পর্দার আড়াল মাত্র। একটা স্বচ্ছ পর্দা ঢেকে রেখেছে অন্য সময়। চোখ থাকলে দেখা যায়। চোখ থাকলে সরানো যায় ২০১৮ সালের পর্দা। সেখানে এখনও বসেন কোনো থান পরিহিতা বুড়ি পিসিমা, বসেন জমিদারবাড়ির মেয়েরা। সুপুরি কাটেন, চুল বাঁধেন, নানান কথার কানাকানিতে হুগলি নদীর হাওয়ায় হাওয়ায় তাঁদের জীবন চলে যায়। আমার জানতে ইচ্ছে করে, যে পরিবারে শিক্ষার এমন ঝলমলে আলো, সেই পরিবারের কন্যাদের জীবন কেমন ছিল? কন্যাজন্মে দীর্ঘশ্বাস ছিল? না ছিল এক অন্য পৃথিবী? অন্দরমহল জানা যাবে না। ‘এক্স-রে’ ঘরের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া রহস্যময় সরু সিঁড়ি বেয়ে আজ আর অন্দরমহল জানা যাবে না।

‘আপনি ‘এক্স-রে’ ক্যান্ডিডেট?’ কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন ল্যাব সহকারী।

আমতা আমতা করে বললাম, ‘না। বসে আছি, বাইরে রোদ খুব!’

তিনি ফেটে পড়লেন, ‘আরে অন্যরা বসবে তো! জায়গা আটকে বসে থাকলে চলবে! এটা তো ওয়েটিং রুম নয়। আপনারা সব শিক্ষিত হয়ে যদি…!’

সঙ্গত যুক্তি। উঠে এলাম। যেকোনো অবহেলা স্বাধীনতা দেয়। রাজবাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে দেড়টা বাজল।

রাজবাড়ির পাশে তৈরি হয়েছে হালের দোতলা বাড়ি। একতলায় মেল ওয়ার্ড। এখানে কোনও ইতিহাস নেই। কান্না আছে, ভয় আছে, বাস্তবদুনিয়া আছে। মেঝেতে রয়েছে যন্ত্রণা, সতর্ক ঘুম। ঐ কোণের বেডে বাবা ঘুমোচ্ছেন। সাড় নেই। আজ তিনদিন ধরে সাড় নেই। হৃৎপিণ্ড বন্ধ হতে বসেছিল। কন্যাকে দেখে দীর্ঘশ্বাসেরও শক্তি নেই। হাতে নাকে কতগুলি নল। প্রাণবায়ু দেওয়া চলছে, চেষ্টা চলছে। কাউন্টারের ফ্রিজ থেকে সই করে আনা ইঞ্জেকশনটা কর্তব্যরতা নার্সকে এগিয়ে দিয়ে আপনা থেকে খাদে নেমে যাওয়া গলায় বললাম, ‘কেমন বুঝছেন?’

‘পাঁচদিন না গেলে কিছু বলা যাবে না। আটটায় ডক্টর আসবেন, জিজ্ঞাসা করবেন!’

নার্স চলে গেলেন। তিনদিন আগেই আবিষ্কার করেছি, বাবার বেডের গায়ে একটা চওড়া জানালা। পিছনের করিডোরের সঙ্গে যুক্ত সেটা। দৌড়ে পিছনে গেলাম। হাতের শিরার চ্যানেলে ততক্ষণে সূচ ঢোকাচ্ছেন নার্স। বাবা সাড়া দিলেন না। বাবার কি খিদে পায়নি? মৃত্যুর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের খিদে পায় না?

কাজ শেষে মুখ তুললেন নার্স। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘আপনি আবার এখানে কেন? জানালা থেকে সরে দাঁড়ান। নিয়ম নেই। ’

খানিক লজ্জিত মুখে বেরিয়ে এলাম। দোতলা বাড়িটা থেকে বেরোতেই বৈশাখ পোড়াতে এল আমাকে। সামনে আবার সেই সবুজ রঙের রাজসিক চেহারার ছ’টি থাম। বেলা দুটো বাজে। খিদে ইতিহাসের চেয়ে বড়ো, সবার চেয়ে বড়ো। ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চওড়া থামের মাথায় দু’টি ত্রিভুজ, মাঝখানে লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। এই রাস্তাটার নাম রাজা প্যারিমোহন রোড। রাস্তার ডানদিকে গঙ্গাতীরে যাওয়া যায়। বাঁ দিক চলে গেছে রেলপথের দিকে। রাস্তার ওপারে সরু পথ নিয়ে যাবে একটা মাঠে। মাঠের ধারে রাজেন্দ্র ভবন। আপাতত ভাতের হোটেলটার ভিতরে পুবের ছায়া নেমেছে।

ভাত-মাছ সাঙ্গ করে হাসপাতালে ঢুকলাম না। একঝলক দেখে এলাম, বাইরের ছাউনিতে রোদ সরেনি। নেমে গেলাম মাঠের দিকে। মাঠের পাশে ভাঙা পাঁচিল, ব্যস্ত আরপিএম রোড থেকে অনেকটাই আলাদা জায়গাটা। পাঁচিলের জায়গায় অনেক বড়ো ফাঁক। ভিতরে রাজেন্দ্র ভবন।

হলদে-বাদামি রঙের আরেকটি প্রাসাদ। ফাঁকা। পাথুরে দালানে একদল লোক তাস খেলছে, মুখে তাদের কুকথার বান ডেকেছে। সেসব উপেক্ষা করে ভিতরে চোখ রাখলাম। নীলচে চুনকাম করা দেওয়াল, উঁচু সিলিং, সবটা খাঁ খাঁ করছে। রাজেন্দ্র ভবনে আর কোনও চিকিৎসক থাকেন না। সপ্তাহে মাত্র কয়েকটি ডিসপেন্সারি বসে। বাকি সময়টায় তাসের আড্ডা। একটি অপূর্ব প্রাসাদ একা একা হাহাকার করে। প্রাসাদের হাহাকার যারা শুনেছে, তারাই জানে এর মর্ম। রেলওয়ে স্টেশন যাওয়ার এটাই শর্টকাট। তবে রাতের দিকে এদিকটায় বড় একটা কেউ আসে না। কেন জানি না, রাজেন্দ্র ভবন দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ গল্পটি মনে পড়ল। একদা রূপসী কন্যার আত্মা নিজস্ব কঙ্কাল দেখে শ্বাস ফেলে বলছে, ‘মিটত না মিটত না! তখন নিজেকে দেখে আশ মিটত না!’

তাস খেলুড়েদের কথায় দাঁড়িয়ে থাকা গেল না। অল্প দূরে একটি লাল প্রাসাদ। প্রতাপ নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রাসাদ। চওড়া থামের আড়ালে তিনমহলা বাড়ি। দোতলার জানালা খোলা, লম্বাটে গরাদের ভিতরে টিউব জ্বলছে। টিউবের আলোয় ময়লাটে সাদা দেওয়াল ফটফট করছে। বাদামি লেটারিংসের অংশ কালো হয়ে গেছে, ক্ষয়ে গেছে থাম। তবু উদ্ধত সৌন্দর্যে দাঁড়িয়ে রেলের বাঁশির শব্দ মাখে লাল বাড়ি। সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে ছিলেন থামের গায়ে। তাঁর দৃ’ষ্টি উজ্জ্বল। তবু এই দুপুর-আলো, ব্যস্ত স্টেশনরোড, গাড়িঘোড়ার শব্দ, বা দোকানগুলির ঘিঞ্জিভাব যেন স্পর্শ করছে না তাঁকে। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে একটিবার মনে হল, তিনি কে? তিনিও কি মিলিয়ে যাওয়া সময় খুঁজছেন আমার মতো? বেয়াড়া সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, অটো রিকশা, ব্যক্তিগত মোটরের শব্দ ছাড়িয়ে খুঁজছেন ফিটনের শব্দ? এমন ভরা দুপুরে কিছুই না খুঁজে একা একা ভাঙা থামের গায়ে গা এলিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়?

রেলওয়ে স্টেশনের পথে অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম মা আসছেন। আসছেন অন্যান্য পরিজনেরা। একটু পরেই শুরু হবে ভিজিটিং আওয়ারস। রাজার বাড়িতে ভিড় জমছে একে একে।

লনের ছাউনি থেকে রোদ সরে গেছে। শতক পুরনো বটগাছতলায় রোগী-পরিজনদের ভিড়। নানান বয়সের মানুষ। কোনো শিশুর মা’কে ছেড়ে না যেতে চাওয়ার কান্না, কোথাও দুশ্চিন্তায় মুখ শুকনো, কোথাও ফিসফাস, কোথাও আড়ালে হাতে নোট গুঁজে দিয়ে, ‘এটা রাখ, লাগবে!’ কোথাও, ‘কী যে হবে জানি না!’ আবার কোথাও ফোনে উচ্চকিত, ‘শুনেছ? রুঙ্কুর ছেলে হয়েছে!’

হাসপাতালের ভিতর বিচিত্র মানবজীবন বয়ে বেড়াচ্ছে একটি রাজবাড়ি। তার কর্তব্য শেষ হয় না। এই জমাট কলতানে আমার বাবার তখনও নিঃসাড়। বিশেষ কিছুই করার নেই। ছাউনিতে এসে বসি। দেখি মানুষের কতরকম বেঁচে থাকা। মনে পড়ে এক সতেরো বছরের কিশোরীকে।

আমারই মুখ বসানো সেই কিশোরী দিব্যি সুস্থ সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রেমিকের পাশে হাঁটবে বলে। প্রেমিক বেচারা কী বলে সেই মেয়ের মন ভোলাবে ভেবে পায় না। অবশেষে অনেক ভেবে কিশোরটি বলল, ‘একটা গল্প শুনবি? সত্যি গল্প!’

মেয়েটি বলল, ‘বল শুনি!’

‘আমাদের রাজবাড়ি হসপিটাল আছে না, ওর ভিতরে জানিস রানির ভূত থাকে!’

‘রাজার বাড়িতে রানির ভূত থাকা স্বাভাবিক। তারপর?’ কিশোরী ভ্রূ নাচিয়ে কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকায়।

‘ওই দ্যাখ বিশ্বাস করলি না! আরে আমাদের পল্টন, ঝিলপাড়ে থাকে, কিছুদিন ভরতি ছিল রাজবাড়ির দোতলায়। ও নিজের চোখে দেখেছে!’

‘আচ্ছা? বেশ তো, রানিকে কেমন দেখতে, কোন যুগের রানি তিনি?’

‘আরে ধুর, শোন না। পল্টনের সার্জারি হল, ও বেচারার রাতে ঘুম ভেঙে গেল। তখন দেখল, হলের বেডগুলোর মাঝখান দিয়ে অনেক গয়না আর নীল শাড়ি পরা রানিমা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ও ভয়ের চোটে চোখ চেপে বন্ধ করল।’

‘এবং নিজের চক্ষুজোড়া সার্থক করল!’ বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল কিশোরী। অবাক করতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ছেলেটিও হেসে উঠল। কত বছর আগের সন্ধেয় কোচিংফেরতা পথ বেয়ে রাজবাড়ির গল্প করেছিল ওরা। আজ বাবার বেহুঁশ মুখের পাশে দাঁড়িয়ে হারানো কত মুখ মনে করে। সেই তো রাজবাড়ি! সেই তো গল্প! সেই তো মিথ আর ইতিহাসের হাত ধরাধরি। তবু এভাবে আসতে হবে ভাবিনি।

সন্ধেরাতের অন্ধকারে হালফ্যাশনের সাদামাটা দোতলা বাড়িটার একতলায় একটা দুর্গন্ধ ছড়াল। উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে কারও দেহাংশ পচছে। রোগী-পরিজন, কর্মীদের নাড়ি উলটে আসার জোগাড়। সবার প্রশ্ন, কী পচেছে? একটা ব্যস্ততা, একটা যন্ত্রণা উঠল। দেহাংশ, সুরক্ষা, সময় পচে যাচ্ছিল রাজবাড়ির ভ্যাপার ল্যাম্পের হলদেটে উঠোনে।

রাতে ডাক্তারবাবু এলেন। কথা… কথা… কথার পিঠে কথা… আমার আর মায়ের মুখ রক্তহীন হয়ে যাওয়া। তবু তো প্রার্থনা, পরদিন সাতসকালে এসে যেন দেখি, বাবার বুক ওঠানামা করছে। রাজার বাড়ির কাছে এটুকুই চাওয়া।

একে একে রাতের খাবার খাচ্ছেন রোগীরা। প্রাসাদে রাত নামে যেমন, এ’ও তেমনই। বটগাছ, লোহার গেট থেকে উঠে যাওয়া অশ্বত্থ গাছ ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসছিলাম আমি আর মা। ভিতরে সে কোন এক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে সবুজ গ্রিক স্থাপত্য এক। একবার ছ’টি থামের ফাঁকে ফাঁকে দোতলার জানালাগুলিতে তাকালাম। ভিতরে কে থাকেন এখনও? আজ আর অতিরিক্ত বুদ্ধিমত্তা দেখানোর থাকে না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, হয়ত আছেন নীল শাড়ি পরিহিতা সালংকারা রানি। হয়ত আসেন আজও। কারণ, ‘মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজাই শুধু নেই…’

একটি পাগলি হাসপাতালকর্মীর সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছে। কর্মীটি রগড় করছে, পাগলি তাতে আরও রেগে যাচ্ছে। রাতের উঠোনে ওরা বাঁচছে। রাজা মুকুটটা রেখে গেলেন বলেই না…

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    সন্মাত্রানন্দ 2 years

    একটি প্রাচীন রাজবাড়ি, আজ যা হাসপাতাল, তাকে কেন্দ্র করে ফুটে উঠেছে জীবনের আলেখ্য। জন্ম, মেয়েজন্ম, বিষাদ ও স্মৃতিকাতরতা–সংক্ষিপ্ত পরিসরে এতখানি তুলে ধরা লেখিকার মুনশিয়ানার সূচক।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes