ধারাবাহিক উপন্যাস <br /> যে আমারে চায়  দ্বিতীয় পর্ব <br />  ঈশা দেব পাল

ধারাবাহিক উপন্যাস
যে আমারে চায় দ্বিতীয় পর্ব
ঈশা দেব পাল

২০০৬ সাল। রুদ্র অশেষ স্বপ্নে ভর করে গিয়ে পৌঁছয় নিউ দিল্লিতে। কলকাতায় থেকে যায় তার স্ত্রী আনন্দী , সদ্য জন্মানো পুত্র বুমবুম। নানা টানাপোড়েন এবং যন্ত্রণা পেরিয়ে সে প্রতিষ্ঠা করে নিজের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। কাজ, কাজের দেবতাই তার জীবনের বিধাতা। তাঁর লেখা বিধিলিপিতেই সে পেরিয়ে যায় সবরকম লড়াই। সেই সংগ্রামে থাকে কখনো হঠাত বিনা নোটিশে চাকরি চলে যাওয়া, পরিচিতদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া, স্ত্রীর জীবনে অন্য পুরুষকে আবিষ্কার কিংবা প্রিয় বন্ধুর অকাল মৃত্যু। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে এক একটা চাকরির জন্য নির্ধারিত চেয়ার বস্তুত মিউজিক্যাল চেয়ার। এক নিমেষে কেউ ছিটকে যেতে পারে। এসে যেতে পারে অন্যজন। বারবার হেরে যাওয়াকে পেরোতে থাকে সে। দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করে কর্মদেবতার কাছে আত্মসমপর্ণ ই একমাত্র লক্ষ্য ছিল তার। সে এগোতে এগোতে টের পাচ্ছিল তার স্বপ্ন তাকে এগিয়েই দিচ্ছে ক্রমশ। যা আপাত পরাজয় তাও জমা হচ্ছে জীবনের ধনের মত। রবীন্দ্রনাথের গানের এই পংক্তি –‘ পথ আমারে সে দেখাবে যে আমারে চায় ’ যেন ঘুরে ঘুরে আসে তার জীবনে। নিজের স্বপ্নের সেই প্রতিষ্ঠার কাহিনি ‘ যে আমারে চায় ’।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– যে আমারে চায় প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব
নভেম্বর, ২০০৬
এক
বড় কাঁচের দরজাটা বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। তার একটা শব্দ হচ্ছে। ঠিক ক্যাঁচ নয়, ফ্যাঁস। ফ্যাঁসফেসে। কৃষ্ণদাসন বারবার বেরোচ্ছে আর ঢুকছে। লোকটা স্টাইলিশ বেশ। দেখতে ছোটখাটো। কিন্তু লাল , নাহ ঠিক লাল নয়, ম্যাজন্টা রং এর জামা আর জিন্স । চোখের চশমাটা মনে হয় ফোটোক্রমিক। অফিসের ভিতরের আলোতেও কালো। কালো মানুষের চোখে কালো চশমা দেখলে বেশ স্ট্রাইকিং লাগে। কিছুটা ভিলেনিও। তাইই লাগছে কৃষ্ণদাসনকে। তামিলদের মধ্যে একটা অন্যরকম সিরিয়াসনেস থাকে, এরমধ্যেও সেটাই আছে যেন। সাজটা একটু অদ্ভুত হলেও লোকটার বডি ল্যাংগোয়েজ আর অন্যরকম একটা ছটফটানি লোকটাকে আলাদা করছে।
রুদ্র দেখছিল আড়চোখে। আসলে সে বুঝতে চাইছিল বস কেমন হয়। একটা গোটা অফিসের বসের ঠিক কী কী বৈশিষ্ট্য থাকে ! গোটা অফিস জুড়ে এসির শীতলতা। কলকাতার যে অফিসটায় এই কদিন কাজ করছিল রুদ্র, তার একটা ঘরেই শুধু এসি ছিল। তাও সেই এসি পুরনো আমলের উইন্ডো এসি। ভালো করে ঠান্ডাই হতনা। তাতেই চালানো নিয়ে কত কড়াকড়ি যে ছিল । কিন্তু নিউ দিল্লী হয়ত সবেতেই এগিয়ে। এখানে কি সব অফিসেই সেন্ট্রালি এসি চলে ? আর সারাদিন চলে ? ফোনে তার ইন্টারভিউ হওয়ার পর গতকাল সকালে দিল্লি পৌঁছেই সে ঠিকানা খুঁজে এই অফিসে এসে দেখা করে গেছিল। তখনও দেখছিল সব ঘরে এসি চলছে। তার বেশ স্বস্তি হচ্ছিল আর ভালো লাগছিল। নয়ত গলির মধ্যে এই ছোট্ট অফিস দেখে প্রথমে সে দমে গেছিল। সে নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণের অনন্ত দায় থেকে সুদূর কলকাতা থেকে দৌড়ে এসেছে, সাজানো অফিস , সুন্দর মাইনে এবং যাবতীয় প্রত্যাশায়। বদলে সে দেবে নিজেকে উজাড় করে। নিজের সব পরিশ্রম, মেধা দিয়ে সে কিনে নেবে এই অফিসকে, এই শহরকে। এই জেদ থেকেই সে মাপছিল এই অফিস তার সব শ্রম আর মেধাকে মূল্য দিতে পারবে তো ?
রুদ্র অল্প কিছুক্ষণ কাজ করার পরই দেখে অফিস জুড়ে কী এক ব্যস্ততা। সে আজ পৌনে দশটায় এসে গেছিল। তার খুব ভয় ছিল প্রথম দিন সে লেট না করে ফেলে ! বিশ্বাস লজ থেকে ঠিক কীভাবে আসবে সেটা সে কালই ছকে নিয়েছিল। আজ যখন সে অফিসে এসেছে তখন সে একা। সিকিউরিটি সবে এল। সে একা কিছুটা সময় বাসার পর কৃষ্ণদাসন এসে তাকে কাজ বুঝিয়ে দিল। তারপর বাকিরা একে একে। বেশ ঠান্ডাভাবেই কাজ হচ্ছিল। কিন্তু তারপর মনে হল কিছু একটা হয়েছে। বারবার ল্যান্ড লাইনগুলো বাজছে। অফিসটা এমনিতে ছোটই। তিনটে ঘরওলা একটা ফ্ল্যাট। যার একটা ঘর বস কৃষ্ণদাসনের। বাকিটা জুড়ে কোথাও ক্রিয়েটিভ টীম, কোথাও মার্কেটিং, কোথাও প্রোগ্যাম ম্যানেজার বসে। ছোট্ট প্যান্ট্রি, ওয়াশরুম। দুপুরে সবার জন্য গরম কফি এসেছে, সঙ্গে বিস্কিট। এটা নাকি অফিস থেকে দুপুরে দেওয়া হয়। বাকি কিছু খেলে নিজের খরচায়। রুদ্র দুধ খায়না, তার সহ্য হয়না। তবু সে ক্ষুধার্তের মত খেয়েছে। সকাল ন’টায় বিশ্বাস লজে দুমুঠো ভাত ডাল খেয়েছিল। কিন্তু বাইরে থেকে কিছু কিনে খাবার তার রেস্ত নেই। রাতে আবার লজে ডাল ভাত।
খুব ব্যস্ত হয়ে ড্রাইভারকে ফোন করতে বেরিয়ে গেল রাঘব। বসের এসিস্ট্যান্ট। বোঝা গেল কিছু হয়েছে। কী সেটা ? রুদ্র বোঝে এখন প্রশ্ন করা যাবেনা। সবাই একমনে কাজ করছে, তারমধ্যেই ফিসফিসানি চলছে। মার্কেটিং এর বালন তার কাছে এসে জানতে চায় তার একাউন্টের কাজের স্টেটাস। এই ব্যাপারটা একদিনেই বুঝে গেছে রুদ্র। যে যে ক্লায়েন্টের মার্কেটিং দেখে সেই ক্রিয়েটিভের ব্যাপারে সব দায়িত্ব নেবে। সেইই চাপ দেবে, তাড়া দেবে। হয়ে গেলে তাকেই প্রথম জানাতে হবে। রুদ্র একটা রিয়েল এস্টেটের লোগো বানাচ্ছে। তার একটু বেশিই হয়ত সময় লাগছে। কলকাতার কাজের ধরনের সঙ্গে দিল্লির ধরন পুরো আলাদা। সে আজ প্রথম দিনে অতটা ধাতস্থ হয়নি। তাই বালনকে সফটলি বলল—বিকেল চারটে অব্দি টাইম দাও, আমি বানিয়ে ফেলব।
বালন ছেলেটা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে। প্রায় ২৭/২৮ বছর বয়স, কিন্তু মুখের মধ্যে দশ বছরের সারল্য। এরকম স্বপ্নালু চোখও রুদ্র আগে দেখেনি। মার্কেটিং বা সেলসের ছেলেরা যেরকম স্মার্ট হয়, ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয় যেরকম ওপর চালাকি রেখে চলে এই ছেলে সেসবের ধার দিয়ে যায়না। এর মধ্যে একটা ঋষি সুলভ গভীরতা। ছেলেটাকে খুব ভাল লাগছে রুদ্রের। বেশ ভরসা করা আর নির্ভর করা যায়ের মত মুখ। বালন তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—তুমি তো প্রায় নামিয়েই ফেলেছ। চল, বাইরে একটু সিগারেট খেয়ে আসি।
রুদ্র হাঁফ ছাড়ে। একটু বেরোলে ভাল। সে স্মোক করেনা, তাও। বাইরে এসে রুদ্রর কীরকম একটা চমক লাগে। দিল্লি শহর দুরন্ত বেগে দৌড়চ্ছে। এক সময় সে মাণ্ডি হাউসে এসেছিল কাজে, দিল্লির পথ ঘাট দেখতে দেখতে তার নেশা চেপে গেছিল। তারপর বছর দুই আগে আনন্দীকে নিয়ে এসেছিল, তাদের বিয়ের জাস্ট পরে পরেই। পয়সার অভাবে তারা হেঁটে হেঁটে ঘুরত। তখন অফিসে অফিসে গিয়ে দরখাস্ত দিয়ে এসেছিল রুদ্র। কাজ হয়নি। সঠিক অফিসের সন্ধান পায়নি। যা পেয়েছিল তাদের চাহিদার সঙ্গে সে ম্যাচ করেনি। বাইরে এসে বালন হাতে আরেক কাপ চা ধরিয়ে দিল। যাক, এটা কালো চা। তারপর আপাত শান্ত ছেলেটাই অনেক কথা বলতে শুরু করল তার সঙ্গে। বোঝা গেল ছেলেটা মনের মত মানুষ পেলে কথা বলে। নয়ত চুপচাপ থাকে। কথা বলতে শুরু করেই রুদ্রর মনে হল আরেক স্বপ্নালু মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। ছেলেটা একটু অন্যরকম। কাজ নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। তার বাড়ির গল্পও করল। এক দুকথায়। তারপরই তার মার্কেটিং আর ক্লায়েন্ট নিয়ে নানা কথা বলতে থাকল। রুদ্রর খুব ভালো লাগছিল।
তারপর অবশ্য বালন তাকে অফিসের কথাও বলল। আজ নাকি একটা ঝামেলা হয়েছে। ভালই ঝামেলা। তাইই রাঘব বেরিয়ে গেল সামলাতে। কৃষ্ণদাসন গোমড়া হয়ে বসে আছে ঘরে। ফেঁসেছে ভালই। রুদ্রর কৌতূহল হল। ব্যাপারটা কী ? আরও অবাক হল অফিসের মধ্যে তো সবাইই নিজের কাজ করছিল। কাউকে আলোচনা করতেও দেখেনি। তা ঘটনাটা বালনই বা জানল কীভাবে ?
সন্তোষ কুমার নামে এক বিহারী গ্রাফিক ডিজাইনার কাজ করছিল এখানে। ছেলেটার খুব মেজাজ। আর কোনো টাইমিং এর ব্যাপার নেই। ইচ্ছেমত আসত যেত। স্যরের সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকত। কিন্তু কাজ খুব ভাল ছিল। একবার বানালে সেটাই ক্লায়েন্টের পছন্দ হয়ে যেত। গত মাসের আগের মাসে দশ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছিল। সেটাও স্যরের রাগ। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। সন্তোষ মুখের ওপর বলে গেছিল স্যর যেন তার মাইনে থেকে কেটে রাখে। কীজানি ওটাই গায়ে লেগে গেছিল নাকি স্যরের, ও গত মাসের এক তারিখে ফিরে এসে অফিসে দেখে তার চেয়ারে বসে আছে অন্যজন। তার জন্য আর কোনো জায়গা নেই। সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে বিনা নোটিশে। সে ছেলে তো সেদিন হুলুস্থূল করে দিয়েছিল। কৃষ্ণদাসন এমনিতে চুপচাপ থাকে, কিন্তু পেটে পেটে শয়তান। পুলিশ ডেকে সন্তোষকে সেদিন বার করে দিয়েছিল। এসব ছোটখাটো অফিসে এরকমই হয় রুদ্র। আজ জব আছে, কাল নেই। কিন্তু আজ কী হবে তাইই ভাবছি।
রুদ্রর বালনকে খুব বন্ধুর মত লাগছিল। প্রথম দিনেই এত মন খুলে আড্ডা পেয়ে সে স্বস্তি বোধ করছিল। কিন্তু আজ কী হয়েছে ? সেই কৌতূহলে সে বালনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা একটু ধীর স্থির। রয়ে সয়ে বলছে। আজ নাকি একটু আগে পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন এসেছিল। সন্তোষের ফ্যামিলি মানে বউ আর দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ভোরের ট্রেনে এসে পৌঁছেছে নিউ দিল্লি স্টেশনে। সন্তোষ নাকি একমাস আগেই ওদের টিকিট কেটে দিয়ে এসেছিল। তখনই বলেছিল এইদিন ও স্টেশন থেকে ওদের আনতে যাবে। কিন্তু যায়নি। কেউ আসেনি। ওদের হাতে শুধু এই অফিসের ঠিকানাটাই আছে। সেটাই পুলিশকে দিয়েছে। তাইই পুলিশ ডাকছে।
এখন আমি যতদূর জানি সন্তোষের বউ একেবারেই গ্রামের মেয়ে। সে ফোন না পেয়ে সোজা চলে এসেছে হয়ত। জানে বর বড় চাকরি করে ।
কত স্যালারি ছিল সন্তোষের ?
— চল্লিশ হাজার।
রুদ্রর পিঠটা একটু সিরসির করে। তাকেও কৃষ্ণদাসন চল্লিশ হাজার দেবে জানিয়েছে। সে আনন্দীর গয়না বিক্রি করে দশ হাজার টাকা নিয়ে দিল্লি এসেছে।
চা খেতে খেতে বালন আরেকটা সিগারেট ধরায়। রুদ্র মন দিয়ে বড় রাস্তা দেখে। কেজানে কেন ছুটন্ত রাস্তা দেখতে তার এত ভাল লাগে ! এই যে সেপ্টেম্বরএ ও বেশ গণগণে টকটকে রোদে গাড়িগুলো রাক্ষসের মত গর্জন করতে করতে যাচ্ছে সেসব দেখে তার মন ভাল হয়ে যায়। তার মনে হয় এই পৃথিবীটা তার। সে এই দাপুটিয়া পৃথিবীর অংশ হতে চায় । সে নিজেকে মনে মনে বোঝায় যো ডরতা হ্যায় ও মরতা হ্যায়। সাহস সাহস আর সাহস।
বালন চায়ের কাগজের কাপটা ফেলে দিয়ে তাকে ডাকে। বলে—অফিসে ঢুকবে তো ? রুদ্র একটু ইতস্তত করে। তারপর বলে— তুমি যাও, দু মিনিট পর আসছি। সে এতক্ষণ লোভীর মত তাকিয়েছিল। চা আর কোল্ড ড্রিংক এর দোকানটার পাশে একটা ওষুধের দোকানে এস টি ডি বুথ। সে পায়ে পায়ে গিয়ে বুথে ঢোকে। পয়সার অভাবে আনন্দীকে একা সে ফোন কিনে দিয়ে এসেছে একটা। বলেছে একমাস সহ্য কর। প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েই নিজের ফোন কিনে নেবো। এখন ঠিক পৌনে তিনটে বাজছে। আনন্দী কি ঘুমোচ্ছে ? ছেলেটা রাতে জাগে , দিনে ঘুমোয়। আনন্দীও তাই। একজন দিন রাতের লোক রাখতে হয়েছে সাধ্যের বাইরে গিয়ে। মাত্র দুমাসের বেবী নিয়ে আনন্দী একা থাকবে কীভাবে ? এক দু মাসের মধ্যেই এসব সামলে নেবে রুদ্র।
ফোন রিং হচ্ছে। আনন্দীর গলাটা ঘুম জড়ানো।
—-তুমি ? তুমি এখন ? ঠিক আছ তো তুমি ?
—-কীভাবে বুঝলে এটা আমি ? আমি তো হ্যালোও বলিনি এখনো।
—-দিল্লির নম্বর মোবাইলে এলো, তাইই। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম জানো তুমি ছোলাভাজা খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছ ? এটা কি তোমার অফিসের নম্বর ?
—-না, এটা অফিসের পাশে। আর কখন হাঁটব ? আমি তো সেই সকাল ন’টা থেকে অফিসে। পুরোটা এসি জানোতো !
—-এখন এসি লাগছে ? শীত শীত না ?
—-নাহ, দুপুরে বেশ গরম লাগছে। এইই একমিনিট হয়ে গেল । তুমি দুপুরে ঘুমোওনি।
—-কারেন্ট নেই, ছেলেটাকে হাওয়া করছি ।
—-বাব্বা, কাঁদছে কেন ? ঘুমোয়নি ?
—-হ্যাঁ, উঠে গেল বদমাইশটা। এত হাল্কা ঘুম !
—-আনন্দী…।
—-বল। আবার দুমিনিট হয়ে যাবে তো !
—-খুব মনখারাপ করছে। আমি মনে হয় থাকতে পারবোনা তোমাদের ছেড়ে।
—এক্কেবারে এসব বোলোনা। তুমি সেটল করলেই আমি চলে যাব তো । মন শক্ত রাখো। পারবে। রাতে আর ফোন কোরোনা। কাল কোরো। অফিসের আগেই।
রুদ্র ফোনের পয়সা দিয়ে বেজায় অন্যমন্সক হয়ে যায়। নিজের সন্তানের গলার আওয়াজে শরীর মন জুড়ে এত বৃষ্টি পড়ে কেন ! সব লড়াই বন্ধ হয়ে যায় । মনে হয় আজ বিকেলেই ট্রেনের টিকিট কেটে উঠে পড়বে !
অফিসে ঢুকে দেখে ধুন্ধুমার। রাঘব ফিরে এসেছে। পুলিশ আসছে নাকি।

দুই
অফিসটা ধাঁ চকচকে। ছোট্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে হলে কী হবে ? ডিজাইনার চেয়ার-টেবিল-সোফা । সব কিছুই অরেঞ্জ আর বেজ কালারের কম্বিনেশন। রুদ্রর অবশ্য একটু লাউড লাগছে সব। তার ডিজাইনে রং ব্যবহার খুব ভাইব্র্যান্ট হয়, কিন্তু সে নিজে খুব শান্ত পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। সে চায় তার চারপাশে একটা মৃদু হাল্কা রং ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা।
অফিসের ভেতরে রুম ফ্রেশনারের লেবু লেবু গন্ধ আর কফির কড়া তীব্র গন্ধ মিলেমিশে একাকার। কৃষ্ণদাসন সাউথের বলে এখানে এমপ্লয়িরাও বেশিরভাগ জনই সাউথের। কফিটাও খাওয়া হয় ওখানকার মত করেই। স্টিলের ছোট গ্লাসে। রুদ্র দেখে যে কর্পোরেট শীতলতা অল্প আগেও সবাই বজায় রাখছিল , এখন আর সেটা নেই। এ ওর টেবিলে বসে গসিপ করছে। বসের ঘরে রাঘব বসে আছে। কাঁচের দরজার এপার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সবাই উত্তেজিত। রুদ্র কাউকেই প্রায় চেনেনা, তাই সে নিজের টেবিলে গিয়েই বসে কাজে মন দেয়। শোনে পুলিশ আসছে। ব্যাপারটা ভজঘট হয়ে গেছে। সন্তোষ যে মেসে থাকত সেটাতেও নাকি সে একমাস ধরে নেই। তার ট্রেস পাওয়া যাচ্ছেনা। তার বউ বাচ্ছা এখন পুলিশের হেফাজতে একটা হোটেলে উঠেছে। তার বউ শুধু এই অফিসের ঠিকানাই জানে। আর কিছুই সে বলতে পারছেনা।
রুদ্র আজ জয়েন করেই শুনেছিল এই এজেন্সি প্রথমবারের জন্য একটা টেলি এডের বরাত পেয়েছে। এটুকু শুনেই সে বুঝেছে তাকে নেওয়া হয়েছে এই জন্যই। সে ভিডিওগ্রাফি জানে। ভালমতই জানে। তার কাজের নমুনা সে পাঠিয়েছিল। সে তাই টেলিভিশন এডের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়েছিল। কাজ একমাত্র কাজই তাকে ভুলিয়ে দিতে পারে সব। সে নিজেকে নিংড়ে কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। সে শুধু চায় একটা সঠিক প্ল্যার্টফর্ম, যেখানে সে দাঁড়িয়ে দেখাতে পারবে এই পৃথিবীকে তার শ্রেষ্ঠ সৃজনশীলতা। লোগোটাও সে মন দিয়ে করছে, বালনকে যখন বলেছে চারটের মধ্যে দেবে,তখন সে তাইই দেবে। নিজের দিক থেকে সে কিচ্ছু ত্রুটি রাখবেনা। এই পুলিশ আসার ব্যাপারে সে খুব বিড়ম্বিত বোধ করছিল। এই ঘটনার জেরে সবাই কাজ বন্ধ করে গসিপ করছে এটাও তার ভাল লাগছিলনা।
ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ দুজন অফিসার এলেন। কৃষ্ণদাসন একগাল হেসে তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। আর এই প্রথমবার দেখল রুদ্র বসের ঘরের কাঁচের দরজার ওপারে টানা পর্দা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অরেঞ্জ আর বেজ। তাই পর্দার ওপারে কী হল কেউ জানেনা। তার খুব আনন্দীর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল এসব নিয়ে। অথচ একটা ফোন মানেই দু মিনিট আর অতগুলো টাকা। কিছুই কথা বলা হয়না তাতে। সে একেবারেই দুর্বল নয়, তবু আনন্দীর কথা, তার কালো ছোট্ট ছানাটার কথা মনে হলেই তার চোখ ভিজে ভিজে আসছে। সে ঠিক চারটেতেই বালনকে কাজটা ট্রান্সফার করতে পারল। একটি বিখ্যাত রিয়েল এস্টেটের লোগো।

তিন
আনন্দীর সঙ্গে হঠাত দেখা হয়েছিল তার। একটা অন্যরকম সংকটের মুখে। এমনিতে তার জীবনে বিপদের শেষ নেই। জন্মের আগে থেকেই তার জীবনে ঘটে চলছে বিপদ। তার জন্মের তিন মাস আগে বাবার অকাল মৃত্যু, তার মায়ের কোলে পঞ্চম সন্তান হিসেবে তার আগমন এবং ফলত হাজারো অর্থনৈতিক বিপদ, অনিশ্চয়তায় সে বড় হয়েছে। সে ছোটবেলা থেকে দারিদ্রকে দেখে বড় হয়েছে , সে অভ্যস্ত হয়েছে দরিদ্র জীবনে। কিন্তু অভাবকে সে মেনে নিতে শেখেনি। তার এই সবই ভাগ্যের কাছে পরাজয় বলে মনে হয়েছে। সে এই ভাগ্যকে জয় করতে চেয়েছে। সে দেখেছে মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আড়াল দিয়ে বেরিয়ে আছে খোঁপা, দেখেছে দিদিরা পড়া ছেড়ে দিল শুধু টাকার অভাবে। সন্ধেতে কেরোসিনের আলো জ্বালানোর ক্ষমতা তাদের ছিলনা। বিকেলেই তাড়াহুড়ো করে তাদের রাতের রান্না সেরে ফেলা হত, যাতে রান্নার জন্য আলাদা আলো জ্বালাতে না হয়। সেই রান্না অবশ্য নিয়মিত ছিল শাক সেদ্ধ আর রুটি। তার বেশি তাদের খাওয়ার উপায় ছিলনা। বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে সে মাঠে ঘাটে খেলে বেড়াতো। আর সন্ধেতে ফিরেই অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়ত। তবু তার মধ্যে দিয়েই সে পাশ করে তার ছোটবেলায় কতবার গোটা জামা , না ছেঁড়া জুতো ছিলনা বলে সে বিয়েবাড়ি যেতে পারেনি। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে পাড়ায় আলোর উৎসব আর সাজগোজ করা তার বয়সী ছেলেমেয়েদের। সে অতিক্রম করতে চেয়েছিল এই দুঃখ, এই অপমান। খুব ভুল কি সেটা ? কিন্তু সে জানতনা তার জন্য এত লড়াই ।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে উত্তরবঙ্গ থেকে একটা ম্যাপ হাতে সে কলকাতায় এসেছিল। একা নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হয়েছিল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক বন্ধুর থেকে খবর পেয়ে সে ভর্তি হয়েছিল একটা ফিল্ম স্কুলে। এসবই ছিল তার জন্য বিপ্লব। ভাবতে পারার বিপ্লব। অন্ধকার এক কুঠুরি ঘর থেকে প্রাসাদে পা রাখার ভাবনার বিপ্লব। ছোট শহর থেকে বড় শহরে আসার তীব্র ইচ্ছার বিপ্লব। মায়ের পাঠানো মাসে মাসের সামান্য টাকায় তাকে খুব হিসেব করতে হত। আগরপাড়ায় একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে ভোরবেলা উঠে কয়লার উনুনে আঁচ দিয়ে তাতে ভাত , আলুসেদ্ধ আর ডালসেদ্ধ বসাতো। কিছুটা খেয়ে বাকিটা রেখে দিত রাতের জন্য । প্রথম প্রথম বুঝতে পারতোনা খাবার রাখারও পদ্ধতি আছে। ক্ষুধার্ত ফিরে এসে কতবার দেখেছে ভাতে গন্ধ হয়ে গেছে বা বিড়াল খেয়ে নিয়েছে। পরে পরে সব শিখেছে। যত ক্ষুধা জমেছে তার তত জমেছে জেদ ।
সেইসব দিনে বাসে ওঠারও উপায় ছিলনা। সে পায়ে হেঁটে জোড়াসাঁকোয় ইউনিভার্সিটি যেত, পায়ে হেঁটে সেখান থেকেই বিকেলে বউবাজার গিয়ে ফিল্মের ক্লাস করত। সে বুঝেছিল ফিল্ম বানানো তাকে শিখতেই হবে। এই শিক্ষা তার সারাজীবনের পথ খুঁজে দেবে। তাছাড়া তার নেশার মত লাগত স্যরের ক্লাস। তার কাছে জীবনের অর্থ বদলে যেত। স্যর শুধু টেকনোলজি শেখাতেন না , জীবনের পাঠও দিতেন। একদিন খুব বিভ্রান্ত হয়ে সে স্যরকে প্রশ্ন করেছিল—-এই কোর্সটা শেষ হলেই কি আমি চাকরি পাবো ? কীভাবে পাবো স্যর ? কোথায় খুঁজবো ?
স্যর তার দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে বলেছিলেন— রাস্তায় কোনোদিন কোনো সোনার টুকরো পড়ে আছে দেখেছো ? সোনার মোহর ? সবাই দেখছে অথচ তুলছেনা ?
সে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলেছিল—নাহ, সেটা হয়না। সবাইই ঝাঁপিয়ে তুলে নেবে ।
স্যর হেসে বলেছিলেন—ঠিক তাই। কিন্তু আধুলি , সিকি পড়ে আছে তেমনটা তো দেখেছ ?
—হ্যাঁ, অনেকবার।
—-তোমার কাজ হচ্ছে নিজেকে ওই সোনার মোহর বানিয়ে তোলার, যাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমাকে সবাই নিয়ে যায়।
সে স্যরের ওই কথাটা সারাজীবন ভোলেনি। বুঝেছিল নিজের কাজ ঠিকভাবে করা ছাড়া তার আর অন্য কিচ্ছু করার নেই। তাকে শুধু নিজেকে তৈরি করতে হবে।
স্যর তাদের ফিল্ম স্কুলে একবার ছবি তোলার প্রতিযোগিতা করালেন। বিষয় ছিল—তুমি । সাতদিন সময় ছিল। সে তখন সেসব উত্তেজনায় কত ক্ষিদে ভুলে থাকত, ছেঁড়া চটি, ভালো স্যান্ডো গেঞ্জি না থাকার যন্ত্রণা, নিজেকে একটু পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ানোর কষ্ট সব ভুলে থাকত। সে পরিশ্রমে এবং সঠিক খাবার না খেয়ে খেয়ে রোগা হয়ে যাচ্ছিল , নানারকম দুর্বলতাজনিত রোগও তাকে পেড়ে ফেলছিল ওই কুড়ি বাইশ বছর বয়সেই , কিন্তু তবু সে জেদ চেপে ধরেছিল। তাকে পারতেই হবে।
বাড়িতেও সে দারিদ্রের সঙ্গে মা-দাদা-দিদির লড়াই দেখে অভ্যস্ত। তারমধ্যেই মা তাকে টাকা পাঠানোয় সে মরমে মরে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কাছে উপায় কিছু ছিলনা। সে শুধু জানত একদিন সে মাকে সব ফিরিয়ে দেবে। দেবেই।
স্যরের সেই ছবি তোলার প্রতিযোগিতার জন্য তার কাছে কোনো উপযুক্ত ক্যামেরা ছিলনা। ক্লাসের অন্য একটি মেয়ে বিতস্তা তাকে নিজের দামী ক্যামেরাটা দিল। সে ছবি তুলে আনল। বাড়ির পাশের একটা বাচ্ছাকে মডেল করে। খরচ করে প্রিন্ট করিয়ে জমা দিল স্যরের কাছে।
নির্দিষ্ট দিনে স্যর সব ছবি একে একে প্রকাশ করলেন। গোটা ফিল্ম স্কুলের জুনিয়র সিনিয়র সেদিন একঘরে। সবাইই , মানে সবাইই ‘ তুমি ’ বিষয়ের ওপর প্রেমের ছবি জমা দিয়েছে। মেয়ে মডেল ফুল দিচ্ছে ছেলে মডেলকে বা উল্টোটা বা ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ছবিটা স্যর সবার শেষে দেখালেন। সে ততক্ষণে প্রেমের ছবি দেখতে দেখতে কনফিউজড হয়ে গেছে। সে কি তবে বিষয়টা বুঝতে ভুল করল ?
স্যর তার ছবিটা দেখালেন। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। আর তার নিচে দূরে খুব দূরে এক বাউল দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে দুহাত তুলে—‘ তুমি ’। স্যর অকারণ বেশি কথা কোনোদিনই বলেন না। শুধু বললেন— এই ছবিটা শুধু এবারের প্রতিযোগিতাতেই সেরা, তা না । এই ছবিটা গত পাঁচবছরের প্রতিযোগিতার জন্যই সেরা। সে আপ্লুত হয়েছিল। পরের মাসে একাউন্টসে স্কুলের ফীজ দিতে গিয়ে শুনেছিল তার ফীজ কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে। সেদিন সে সত্যিকারের খুশি হয়েছিল। মাকে চিঠি লিখেছিল বাড়িতে এসে। মনে মনে ভেবেছিল নিজের প্রতিভার অর্জন দিয়ে সে এভাবেই সামলে দেবে সবটা।
কন্ডাক্টরের গলা শুনে সে সচকিত হয়। এসে গেছে করোল বাগ। আরেকটু বেখেয়াল হলেই সে এগিয়ে যেত খামোখা। আবার হাঁটতে হত। লজে ফিরে দেখে ডিনার সবারই শেষ। শুধু তার খাবারই রাখা আছে । সে হাত ধুয়ে আগে খেয়ে নেয়। এই লজে একমাসের জন্য ঘর পাওয়া যায়। সে একটা ডবল বেড শেয়ার করে আছে ব্যানার্জীদা নামের একটা লোকের সঙ্গে। ওনার বাড়ি বাঘাযতীন, কলকাতা। ব্যাংকের চাকরি। উনি দুবছর ধরে এই লজেই আছেন। অপেক্ষায় আছেন বদলির। ওনার যুক্তি এখানে কোনো ঝামেলা নেই। টিভি আছে , দুবেলা মাছ ভাত আছে । ব্যস। আর কী চাই ?
সে বাঘাযতীনের বাড়ি শুনে আপ্লুত হয়ে বলেছে— তাদের বাড়ি বা বাসা রামগড়ে। সেখানে তার বউ আছে , দুমাসের সন্তান আছে। তার আজকাল শুধুই আনন্দী আর ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। ব্যানার্জীদা মাঝ বয়সী একটা লোক। বউয়ের গল্প শুনেই ছবি দেখতে চাইলেন। আনন্দীর তিন চারটে ছবি ছিল তার কাছে। প্রথম দেখা হওয়ার পরপরই সে একটা ছবি তুলেছিল সেটা , বিয়ের কনের সাজে আর সদ্য মা হবার পর। ব্যানার্জীদা তার থেকে আনন্দীর ফোন নম্বরটাও নিল। বললেন নিজের স্ত্রীকে দেবেন। কাছেই তো থাকে ওরা।
এইতো তার পরিধি বাড়ছে। চেনাজানার। সে আনন্দীর জন্য সব পারে। আনন্দীকে এই একা ফেলে এসে ওর যা যা অসুবিধে হচ্ছে তার সবটা ও মিটিয়ে দেবে।
রাতের খাওয়া সেরে ফেলে সে লজের বাইরে আসে। রাত সাড়ে দশ। কিন্তু এই ঘিঞ্জি আর জনবহুল এলাকা এখনো সন্ধের মত গমগমে।
সে আবার লোভীর মত এগিয়ে যায় এসটিডি বুথের দিকে। একমিনিট কথা বলবে, আনন্দীর গলাটা শুনবে শুধু।
চার
বস তার লোগোটা পছন্দ করেছেন, বালনেরও ভাল লেগেছে কিন্তু ক্লায়েন্ট প্রচুর চেঞ্জ দিয়েছে। সেই নিয়ে সারতে সারতে রুদ্র দেখল বেলা গড়িয়ে গেল এবং ক্লায়েন্টের মনোমত বানাতে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটা লোগো সে বানিয়ে ফেলল। যেটা আদপেই ভালো না। কিন্তু বালনও হাসতে হাসতে বলল, এরকমই হয়। কিন্তু রুদ্রর কাঁধে বেশ কয়েকটা নতুন কাজ জুড়ে গেল। সেসব সারতে গিয়ে তাকে তিনদিনই রাত প্রায় এগারোটা অব্দি অফিসে থাকতে হল। প্রতিদন বিকেল হলেই বাড়ির জন্য যে তীব্র মনখারাপ হচ্ছিল তার সেসব করারই সুযোগ পেলনা। অফিসে আসার আগে একবার আনন্দীকে ফোন করত, ব্যস। ছেলের খবর ওই ফোনেই নিত। শনিবার অফিস ছুটি। কিন্ত তাকে আসতে হবে। তার কাজটা শেষ হবেনা নয়ত। সে কিন্তু মনে মনে খুব খুশি হয়। তার কাজকে গুরূত্ব দিচ্ছে বস , আর কী চাই ? সে তো কাজ করতেই এসেছে।
অফিসে আরেকটা ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে তার। খুব ভাল বন্ধুত্ব। ছেলেটার নাম প্রসেনজিত চক্রবর্তী। সিলেটিয়া বাঙালি। কপি লেখে । ছেলেটা হ্যান্ডিক্যাপড। ওর শিরদাঁড়াটা একটু বাঁকা। ফলত ওকে হেলে হাঁটতে হয়। কিন্তু ছেলেটার উজ্জ্বল দুটো চোখ, অসম্ভব উইটি কথা আর দারুণ ইংরেজি জ্ঞান মুগ্ধ হওয়ার মত। প্রসেনজিতের বাবা মা কেউই নেই। দিদির বিয়ের পর থেকেই সে দিল্লিতে দিদির বাড়ি থাকে। এখানেই কলেজ । ময়ূর বিহারে ওদের ফ্ল্যাট। ছেলেটা বাংলায় কবিতা লেখে, এই বিশেষ খবরটাতেই রুদ্র সবচেয়ে আপ্লুত হয়। সে ছেলেমানুষের মত বলে ওঠে— তুমি কবিতা লেখো ? আমার বউও তো কবিতা লেখে। সব নামীদামী পত্রিকায় ওর লেখা বেরোয়, জানোতো ?
এই সংবাদের প্রসেনজিত অবশ্য সত্যিই খুব খুশি হয়। সে খুব আন্তরিকভাবে বলে—এইই, বৌদি এলে আসবে আমাদের বাড়ি। আমার দিদি আর জামাইবাবু কিন্তু আমার মা আর বাবা। তবে এই রবিবার আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো। আমার কবিতাপাঠ আছে। তোমাদের করোল বাগেই।
—-করোল বাগে কবিতা পাঠ ? বাংলায় ? ওই ঘিঞ্জি এলাকায় ? হিন্দিই সবাই যা বলে আমি বুঝতে পারিনা ভালো
—-আরে ওসব দেহাতি হিন্দী। আমিই ভালো বুঝিনা এতদিন থেকে। থে হ্যাঁ, বাংলা কবিতা পাঠই আছে। নিয়ে যাবো তোমাকে। রসগোল্লা-শিঙাড়া সহ । ভালো লাগবে।
শনিবার অফিস আসার আগে আনন্দীকে ফোন করল রুদ্র। আনন্দীর গলাটা ম্রিয়মান। এতদুর থেকে রুদ্র ওকে সত্যিই ছুঁতে পারছেনা যেন। শুধু তো দূরত্বই না, কাজের চাপে রুদ্র ওই বুথের ফোন থেকে একমিনিট বা দু মিনিটে পুরো মনটাই তো দিতে পারছেনা। সদ্য মাতৃত্ব লাভের পড়ে মেয়েদের হাজার অসুবিধে সে দেখে এসেছে, শুধু তার অর্থনৈতিক চাপটা সে নিতে পারে। বাকিটা সে পারছেনা। আনন্দী অবশ্য তাকে জানায় সে ঠিক আছে, একদম ঠিক আছে। ছেলেটাও ভাল আছে। শুধু খুব কাঁদে। কেন কাঁদে সে সবসময় বুঝতে পারছেনা। আয়া মেয়েটা বলেছে বাচ্ছাটার খুব বায়না। এসব শুনে তার খুব কান্না পাচ্ছে। কবে আসবে রুদ্র ?
রুদ্র হাসে। সবে এক সপ্তাহ হল। অন্তত মাস দুই না গেলে সে ছুটিই তো পাবেনা । সে আনন্দীকে বলতে পারেনা সন্তোষ নামের একটি ছেলে নিখোঁজ, যে কিনা এই অফিসে কাজ করত। একদিন বাড়ি থেকে এসে সে দেখে তার চেয়ারে বসে গেছে অন্য একজন। সে ছিটকে গেছে এই মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা থেকে। রুদ্র কোনোভাবে ছিটকাবেনা। তাকে টিঁকে থাকতেই হবে। আজ আনন্দী যত চোখের জল ফেলছে একদিন সে ততটাই হাসবে, নিশ্চিন্ত হবে। তাই এখন আনন্দীকে পূর্ণ মনযোগ দেওয়া তো তার পক্ষে সম্ভবই না। সে নিজেকে কিছুটা কঠিন করেই অফিসে ঢোকে আর কাজে মগ্ন হয়ে যায়। তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় এটাই যে তার কাজ দিয়ে সবাইকে সে মুগ্ধ করে দেবে। ক্লায়েন্ট তার কাজ ছাড়া অচল হবে, তার বসও হবে। তার এই সুদূর যাত্রার মূলধন যে তার কাজ, তার সৃজনশীলতা। আর যে তার কিচ্ছু নেই। এই মূলধনকেই সে কাজে লাগাতে পারে ভালভাবে।
পরপর দুদিন তাকে আসতে হল। শনি আর রবি। শনিবার গোটা অফিসে সে একাই ছিল। সে আর সিকিউরিটি রাজু ভাইয়া। রাজু ভাইয়া তাকে দুবার কফি আর দুবার বিস্কিট এনে দিল। সে অন্ধের মত কাপ হাতে নিল আর কাজ করল। রাত আটটার দিকে তাকে কৃষ্ণদাসন ফোন করলেন। তার বস। বসের গলায় তখন বাড়তি আনন্দ ঝরে পড়ছে। মনে হচ্ছিল এতদিনে তিনি একটা মনের মত লোক পেয়েছেন যে তার অফিসের জন্য দিন রাত এক করে কাজ করতে পারে। তবু বস নিজেই তাকে বললেন আজকের মত থাক, সে যদি রবিবার আসতে পারে ভাল হয়।
রবিবার সে অফিসে আসতে পারে জেনে খুশি হচ্ছিল। রবিবারগুলো আসলেই তার আতঙ্ক লাগে সারাদিন লজে থাকতে হবে ভেবে। আর ওই ব্যানার্জিদা দুপুরবেলায় নিজের ছোট্ট একটা টিভি চালিয়ে পর্ন ফিল্ম দেখে। সে গত রবিবার সারা দুপুর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। মাইনে পেলে আনন্দীর জন্য কী কী কিনবে সেসব ভেবে ভেবে দোকানে দোকানে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে লজে ফিরে ডিনার করেই ঘুমিয়ে গেছে। সেখানে রবিবার এই অফিসে এসে একা কাজ করা তার কাছে বিরাট সৌভাগ্য। সে বসকে হ্যাঁ বলে সিস্টেম অফ করে। রাজু ভাইয়া তাকে বসতে বলে বাইরে যায় একবার। সে শীতল অফিসে একা চুপ করে বসে বসে ভাবে এরকম ঠিক এরকম একটা অফিস তার নিজের হতে পারেনা ? কত দাম পড়ে এর ? কত খরচ ? আনন্দীকে বললে হাসবে নিশ্চয়ই, ভয়ও পাবে। বলবে আজগুবি স্বপ্ন দেখোনা। আমরা সাধারণ মানুষ… এই অব্দি শুনলেই বুকের ভেতরটা ভেঙে যায় রুদ্রর। সে নিজেকে ছাপোষা ভাবতে পারেনা। কিছুতেই পারেনা। তার বাবা অকালে মারা যাওয়া –সেও নাকি এক স্বপ্নের পিছনে । তারপর তার মায়ের লড়াই করে তাদের মানুষ করা সব সবকিছুর পরেও সে স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় । তার মামা তার মাকে বলেছিলেন রুদ্র নাকি বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখে, যা খুব খারাপ। রুদ্র আহত হয়েছিল। না, তার স্বপ্ন বড়লোক হবার না, বড় কাজ করার। যার অবশ্যম্ভাবী ফল অর্থ। তার অর্জিত অর্থই তার এগিয়ে চলার মাপকাঠি হবে। আর সেটুকুই সে বাড়ির লোককে উপহার দিতে পারে। কিন্তু সে একদিন এই রাজধানী জুড়ে নিজের কাজ দেখতে চায়। তাইই তো সে এসেছে।
রাজু ভাইয়া এসে তাকে একটা প্যাকেট ধরায়। হেসে বলে—এটা আমার তরফের ট্রিট দাদা। ইডলি আছে। সেই সুবে থেকে আপনি কাজ করে যাচ্ছেন।
অবাক হয়ে যায় রুদ্র। তার চোখে জল চলে আসে। সে হেসে বলে—আমার ওরকম অভ্যাস আছে। কিন্তুস এ ইডলিটা নেয়। বলে—লজে গিয়েই খাবো । রাজু ভাইয়া তার চেয়ে অনেকটা বড়। এই বৃদ্ধ বিহারী মানুষটার দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে গেল তার নিজের বাবার একটা সাদা কালো ফোটোগ্রাফ।
পাঁচ
তার সঙ্গে আনন্দীর দেখা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। এসব দেখা হওয়ার টাইমিং কে যে করে দেয় ! ভগবান বলে কি সত্যিই কিছু আছে ? সে সারাজীবন ধরে দেখেছে তার বাবা নেই, অর্থ নেই , তার জেঠু-কাকুরা তাদের দায়িত্ব নিতে চায়নি, কিন্তু তার কে যেন আছে ! চরম বিপদের সময় তিনি তাকে হাত ধরে বাঁচিয়ে দিয়েছেন বারবার। সেই অজানা লোকটার ভরসাতেই কি সে রিস্ক নিতে শিখে যাচ্ছে ? সে বুঝে গেছে লোকটা তাকে শুধু একটাই মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছে রোজ—চরৈবতি, চরৈবতি। এগিয়ে চল। এগিয়ে চল। যত এগোবে তত মধুক্ষরণ হবে তোমার চলার পথের।
হ্যাঁ, এই এগিয়ে চলার মধুকে সে টের পাচ্ছে। সে টের পাচ্ছে জীবনে সামনের দিকে এগোলে অনেক আগাছা-গাছ-কাঁটা । কিন্তু মধু ঝরে বইকি। রবীন্রভারতীর কোর্সের পরে সে বুঝেছিল ফিল্ম স্কুল শেষ না করলে তার কাজ পাওয়া মুশকিল। সে ভেবেছিল শুরুটা করবে ফোটোগ্রাফার হিসেবে, কিন্তু তারপর সে ফিল্ম বানাবে। সে তো ক্যামেরা হাতে নিলেই একটা চলমান ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পায়। সে ওভাবে ধরতে চায় পৃথিবীটা। সে ইন্সটলমেন্টে একটা ক্যামেরা কিনতে চাইছিল, তখন তার ফিল্ম স্কুলের শেষ বছর। সেইসময় বিতস্তা নামের ওই মেয়েটা এগিয়ে এসেছিল। সে তাকে নিজের ক্যামেরাটা ধার দিয়েছিল। বলেছিল তার আরেকটা আছে। এটায় সে কাজ চালাক আপাতত। মেয়েটার অত্যন্ত সদয় ব্যবহার , খুব আন্তরিক সাহায্য সে নিয়েছিল এবং দ্রুত তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছিল। জীবনের প্রথম সম্পর্ক হিসেবে সে খুব খুশি হয়ে পড়েছিল। মাকে লম্বা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল সব। মেয়েটি খুব বড়লোকের মেয়ে সেকথাও জানিয়েছিল। চিঠির উত্তর মা দেয়নি, দিয়েছিল বড়দিদিভাই। বলেছিল—এখন নিজের পড়াশোনা আর কাজে মন দেওয়াই ভালো। বড়লোকের মেয়েদের সঙ্গে মেশার অনেক ঝামেলাও আছে। সেসব দিকে এখন বেশি না এগোনোই ভালো। সে দমে গিয়েছিল। বলাই বাহূল্য সে দিদির বক্তব্য এবং দিদির আড়ালে মায়ের বক্তব্যকে শোনেনি। হয়ত মা বা দিদিরা সেটা আশাই করেননি। তাঁরা কোনোদিন রুদ্রকে কড়া করে কিছুই বলেননি, বলতে পারেননি। চিরকাল তাকে আগলে রেখেছেন তার সর্বশক্তি দিয়ে। তাই সে বিতস্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল পুরোপুরিভাবে। প্রায় দুমাস কেটে যাওয়ার পর তার মনে হল—এটা সে কী করছে ? সে তার লড়াই থেকে সরে যাচ্ছেনা তো ! সে বুঝেছিল বিতস্তা তার পূর্ণ মনযোগ চাইছে দিনরাত। যেটা দিতে গেলে তার সব কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বদলে বিতস্তা তাকে টাকা দিচ্ছে যেনতেনপ্রকারেণ। সে প্রথম দু একবার নিয়ে ভেবেছিল তাদের জীবন তো জুড়েই যাচ্ছে একসঙ্গে, টাকা নিতে আপত্তি কী ? কিন্তু মাস দুই এর মধ্যেই তার মোহ ঘুচতে লাগল।
খুব জ্বর হল তার একবার। সম্ভবত ম্যালেরিয়া। সে জানত না। রোজ রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসত। স দিন পনের যেতে পারেনি ফিল্ম স্কুলে। কেউ অবশ্য খোঁজও নেয়নি, কারণ তার আস্তানাটা প্রায় কেউই জানতনা। সে ভেবেছিল নিজেই সামলে নেবে এই জ্বর। কিন্তু কমছিলনা। সে উঠে নিজে রান্না করবে এই ক্ষমতাই পাচ্ছিলনা। গতবার বাড়ি থেকে আসার সময় মা হরলিক্সের বড় ডিব্বা দিয়ে দিয়েছিল। সে দুদিন সেই হরলিক্স খেয়ে আর নাড়ু মুড়ি খেয়ে রইল। তার মন আশা করেছিল অন্তত বিতস্তা আসবে। তার খোঁজ করতে করতে আসবে। সেইই একমাত্র জানে এই এলাকাতে যে রুদ্র থাকে সেকথা । বাড়িটা খোঁজ করলে পাবে হয়ত। দুদিন জ্বর আর দুর্বলতায় অচৈতন্য হয়ে সে ভাবছিল সে মরে যাচ্ছে। তার মা জানতেও পারলোনা। মা হয়ত এই দুপুরে শুয়ে তার কথাই ভাবছে। ছোড়দিদিভাই টিউশানি পড়াচ্ছে বাড়িতে বাচ্ছাদের। দাদারা এসময় বাড়িতে থাকেনা। দুনেই ছোটখাটো ব্যবসা করছে কীসব। সে মায়ের চোখের জল টের পাচ্ছে আর ভাবছে এই জন্মে তো হলনা মা, পরের জন্মে আবার তোমার কোলে আসব আর সারাজীবন তোমাকে নিয়েই থাকবো।
প্রায় দেড়দিন এভাবে থাকার পর সে টের পেল কেউ তার ঘরের দরজাটা খুলছে। কারোর গলার আওয়াজ। দোতলার বৌদি কি তার সাড়াশব্দ না পেয়ে এলেন দেখতে ? সে বুঝতে পারছেনা। শুধু এটুকু বুঝছে সে বেঁচে আছে। অল্প কিছু পরেই সে দেখে মুখের ওপর ঝুঁকে আছে তার ছোড়দিদি—অঝোরে কাঁদছে তার দিদি আর বলছে তাকে— ভাই, এ কী হাল হয়েছে তোর ? কী হয়েছে তোর ?
সে দিদিকে দেখেও হাসতে পারছেনা, উত্তর দিতে পারছেনা। এত দুর্বল সে । দিদি দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে অল্প কিছু পরেই ফিরে এসে তাকে বলে—ওঠ,আস্তে করে ওঠ। পারবি। ঠিক পারবি। আমি জল দিচ্ছি তোকে। ততক্ষণে দোতলা থেকে বৌদি আর বৌদির শাশুড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। মাসীমা তাড়াতাড়ি মিছরির জল গুলে এনেছেন। সে খাচ্ছে আর ভাবছে তাকে বেঁচে যেতেই হবে। হবেই। বৌদি গালে হাত দিয়ে বলছে—কদিন সাড়া পাইনি বটে। আমরা ভাবছি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। এমনিতেই তো সারাদিন থাকেনা। মাসীমা তাকে একটা বড় গ্লাসে দুধ এনে দিলেন। দিদি বলল—খেয়ে নে। আমি রিক্স দাঁড় করিয়েছি। বড় রাস্তা অব্দি গিয়ে ট্যাক্সি নিচ্ছি। সূর্যমামার বাড়ি যাব চল।
সে শুনছে কিন্তু ভাল বুঝতে পারছেনা। জলের পরে দুধ খেয়ে তার ভাল লাগছে। বৌদি পাশের বাড়ির ছেলেটিকে ডেকে আনে। সে তাদের সঙ্গে আরেকটা রিক্স ধরে যায় , গিয়ে ট্যাক্সি ডেকে দেয় ।
সূর্যমামা তাদের বড়মামার বন্ধু। বাড়ি দমদম। তিনি সব দেখে শুনে অবাক। একটা জলজ্যান্ত ছেলে অসুখ হয়ে মারা যাচ্ছে আর তার বন্ধু বান্ধব প্রতিবেশী কেউ জানেনা অব্দি ! ছি ছি ! ছোড়দি কাঁদতে কাঁদতে বলে— মা দুদিন ধরে শুধু ভাইকে স্বপ্ন দেখছিল। আমরা কোনোদিন ওর বাড়িওলার ঘরে ফোন করিনা। ওরা নাকি পছন্দ করেনা। তাই দুদিন ফোন করছি, বলে কিনা— ওর কোনো খোঁজ নেই। ও কে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি রিজার্ভেশন ছাড়াই টিকিট কেটে চলে এলাম মামা। আমার মনে হচ্ছিল ওর বিপদ হয়েছে ।
সূর্যমামা ওর খাটের পাশের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে বলছিলেন—আর চিন্তা নেই। ডাক্তার যা যা ওষুধ বলেছে সব পাওয়া গেছে। স্টার্ট হয়ে গেছে, দুদিনে চাঙ্গা হয়ে যাবে। ইয়ং ছেলে।
দিদি কৃতজ্ঞ চোখে বসে থাকে। তবে তার পাশ থেকে নড়েনা। মামাই শেষে বলে— তুমি নিজে রেস্ট নাও মিতালী। ও সুস্থ হয়ে যাবে। মাকে ফোন করে দাও।
প্রায় দিন সাতেক লেগেছিল তার উঠে দাঁড়াতে। ডাক্তার বলল— চরম ম্যালনিউট্রেশন ও হয়েছে। ম্যালেরিয়া সেরে গেল। কিন্তু দুর্বলতা কমছেই না। ছোড়দি তার বাসায় এসে থেকে গেল একমাস। সামান্য টাকায় তার খাওয়ার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করল। দুবেলা ভাতের ফ্যান খাওয়ালো তাকে। রোজ দুটো করে ডিমসেদ্ধ। মাঝে মাঝে জ্যান্ত মাছ। সে বেশ ফিট হল। দিদিকে ট্রেনে উঠিয়ে হেঁটে হেঁটে শিয়ালদাহ থেকে ফেরার সময় সে ভাবল—ঠিক সময়ে কে পাঠালো তবে দিদিকে ? আর একদিন দেরি হলেই তো সে মরে যাচ্ছিল ? এভাবে তাকে মৃত্যু দর্শন করিয়ে সেই অজানা লোকটা কী বোঝাতে চাইছে তাকে ?
কী লাভ হল এতে লোকটার ? তাকে এত কষ্ট দিয়ে ? মা দিদিকে এত চিন্তায় ফেলে ? কিন্তু লাভ যে কিছু হল সে সেটা পরে বুঝল। তাকে একমাস না দেখতে পেয়ে বিতস্তা আর অপেক্ষা করেনি। নতুন সম্পর্কে ঢুকে গেছে তাদের সিনিয়র মন্ত্রদার সঙ্গে। সে অবাক হয়ে দেখল তার একটুও কষ্ট হলনা। সে যেন নিশ্চিন্ত হল। তার মূল কাজ থেকে সে যে ক্রমশ সরে যাচ্ছিল তারজন্য তার গ্লানি থেকে সে রেহাই পেল। ঘরে ফিরে দিদির বানিয়ে যাওয়া মুড়ির মোয়া খেতে খেতে সে একা একাই খুব হাসল আর সেই অজানা লোকটাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল।
কিন্তু অভাব এবং দারিদ্র আর তার সঙ্গে এত স্বপ্ন তাকে বারবার ট্র্যাপে ফেলছিল যেন। সে নানারকম যোগাযোগ করতে করতে এক প্রোডিউসারের দেখা পেল। তার বন্ধু দুর্জয় তাকে নিয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের কাছে। ভদ্রলোক বাঙালি। হোটেলের ব্যবসা। কিন্তু ফিল্ম করতে চান। ভদ্রলোক নাকি জ্যোতিষও করেন। নিজের একমাত্র ভালো জামা আর জিন্সের প্যান্ট পরে গেল রুদ্র। তাকে তো যেকোনো শর্তেই পৌঁছতে হবে তার নিজের স্বপ্নে। ভদ্রলোক বাড়িতে নয়, নন্দন চত্বরে দেখা করবেন বললেন। তারা হলদিরামে গিয়ে বসল। ভদ্রলোককে খুব বুদ্ধিমান মনে হলেও ঝানু গোছের দেখতে লাগল। কিন্তু প্রোডিউসারের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তার কী লাভ ? সে তার প্রোজেক্টের কথা জানলো। সেই নিয়ে তার রিসার্চের কথাও। ভদ্রলোক এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। টাকা দেবেন। চল্লিশ হাজার দেবেন তিনি। কাল বা পরশুই দশ দেবেন। তবে এটা ফিল্ম হবেনা, চ্যানেলে জমা পড়বে। নিজেদের খরচে শ্যুট হবে। পরে চ্যানেল কিনে নেবে । হিসেবমত চ্যানেল অন্তত ষাট হাজারে কিনবে। ওনার লাভ ওটাই। আর ওই চল্লিশের মধ্যেই রুদ্রকে সব সারতে হবে। সে জানলো দিল্লি যাওয়ার দরকার হতে পারে। মাণ্ডি হাউসে যেতে হবে। প্রোডিউসার যাঁর নাম শ্যামল আচার্য , তিনি জানালেন এরমধ্যেই সব সারতে হবে। এর বেশি উনি দেবেন না।
রুদ্র রাজি হল। হতেই হত। যা পাওয়া যায়। ভদ্রলোক এক গ্লাস লস্যি খেতে খেতে যাওয়ার আগে বললেন—এর আগে তিন জন এসেছে নানা প্রোজেক্ট নিয়ে। কিন্তু তিনি এগোননি। অথচ রুদ্রকে তিনি একবার দেখেই ফাইনাল করলেন। কেন জানেন ?
—কেন ? রুদ্র অবাক হয়ে জানতে চায় ।
দুর্জয় পাশ থেকে বলছিল— রুদ্রর প্রোজেক্টটা খুব ভালো। অপরাধ জগত নিয়ে এরকম কাজ যেকোনো চ্যানেল লুফে নেবে।
আচার্য্য নামের লোকটা ঝানু মুখে হাসছিল—বলল—নাহ, সেসব জন্য না। অনেক ভালো প্রোজেক্টও তো ধ্যাড়ায়।
–তবে ? রুদ্র কৌতূহলী হচ্ছিল।
— তোমার পা। পায়ের আঙুল।
—-মানে ? সে জুতোর অভাবে চপ্পল পরেই ঘোরে। তাই অল্প লজ্জিত হল।
—-তোমার পায়ের আকৃতি আর আঙুলের গড়ন বলে দিচ্ছে তুমি আজ এখানে এসে বসে আছ একটা সামান্য আয়ের জন্য, কিন্তু আজ থেকে ঠিক দশ বছর বাদে তোমার সঙ্গে পাঁচ মিনিট দেখা করার জন্য লোকে এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়াবে ।
রুদ্রর অল্প শিহরণ হয়েছিল। কিন্তু সে বিশেষ অবাক হয়নি। সে তো জানেই তাই হবে। এসব না হলে তো তার জীবন বৃথা। তবে এই প্রথম তার নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন অন্য কারোর মুখ থেকে সে শুনছে । তাই সে হাসল ।
ভদ্রলোক চলে গেলে দুই বন্ধু হ্যাংলার মত ছোলে বাটোরা খেল। ওরকম বড়লোকি লস্যির গ্লাস হাতে বসে বসে হলদিরাম থেকে কেউ বেরিয়ে যায় নাকি !
উনি কিন্তু সত্যিই কথা রাখলেন। দুর্জয় যোগাযোগ করতেই ওকে ডেকে ওর হাতে দশ হাজার টাকা দিলেন। টাকাটা চোখে দেখে রুদ্রর মনে হচ্ছিল প্রথম তাকে কেউ বিশ্বাস করছে। সে দুই রাত জেগে পুরো প্রোজেক্ট রেডি করল। দুর্জয় সেটা দেখে অবাক। —তুই আঁকলি ? তুই এত ভালো আঁকিস ?
—-হ্যাঁ। আর কে করে দেবে ?
—-এ তো ব্যাপক রে। তুই আর কী কী পারিস ? ভালো অভিনয় করিস, ভালো ছবি তুলিস আবার এত ভালো আঁকিস ? এ তো সত্যজিত রায় শুনেছি এভাবে এঁকে এঁকে পিকচার বোর্ড করতেন ওনার ফিল্মের জন্য ।
—আমিও সেটাই ফলো করেছি । ওঁকেই। আমিও আঁকতে পারি। ভাবলাম ঐভাবে করা থাকলে কাজ অর্ধেক হয়ে গেল।
—বাপরে বাপ। নাহ ওই আচার্য লোকটা মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছে। তুই অনেকদূর যাবি। দশ বছর পর তোকে দেখতে আমাদেরই এয়ারপোর্টে লাইন দিতে হবে।
—শোন, ওসব জ্যোতিষ না বাজে কথা। আমি যে কাজের স্বপ্নে মশগুল থাকি সেটা অভিজ্ঞ মাত্রই বুঝবে । তাইই ওসব বললেন।
তাদের কাজ এগোচ্ছিল। দুদিনের জন্য দিল্লি যাওয়ার খরচ ম্যানেজ করতে হল তাকে। খুব সামান্য টাকা সে নিয়ে পুরোটাই রাখা থাকল দুর্জয়ের ব্যাংক একাউন্টে। তার একাউন্টেও সে রাখলনা। দুজনে দিল্লি গেল। মাণ্ডি হাউসে জমা দিয়েই ফিরবে ভেবেছিল। কিন্তু মান্ডি হাউস জমা নিতেই আজ না কাল না পরশু করে ঘোরালো প্রায় সাতদিন। এদিকে খাবার পয়সাও শেষ। দুদিন দুজনে পাঁউরুটি খেয়ে থাকল। তার এসব ভাল মতই অভ্যাস আছে। কিন্তু দুর্জয় বড়লোকের ছেলে। সে মুখ শুকিয়ে রইল। হাতে যা টাকা তা দিয়ে কোনোমতে ট্রেনের টিকিট হচ্ছে। নিউ দিল্লি স্টেশন প্রায় হেঁটে গিয়েই সেদিনের টিকিট পেলনা। পেল দুদিন পরের।
তো এই দুদিন খাবো কী ? শেষে কি ভিক্ষে করতে হবে রুদ্র ?
রুদ্ররও ক্ষিদেতে অবস্থা খারাপ। তবু সে হাল ছাড়েনা। হাতের সামান্য টাকা দিয়ে একটা অটো ভাড়া করে দুজনে আসে ইন্ডিয়া গেটের কাছে। পথে অটোওলাকেই জিজ্ঞেস করে কিনে আনে বড় চার্ট পেপার আর দু দুটো সিক্স বি পেন্সিল। দুর্জয় এই কদিনেই রুদ্রর নানারকম খ্যাপামির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে। সে খুব আশা করেছিল আজ টিকিট পেয়ে যাবে। আর একদিন মুড়ি চিঁড়েতে পেট ভরাতে হবে। কিন্তু বাড়ি গিয়েই গরম ভাত, চব্য চোষ্য। রুদ্র অবশ্য জানে কাল গিয়েও ভাত জুটলে নিজেকেই রাঁধতে হবে। তবে বাসাতে সম্ভবত চাল ডাল আর আলু আছে। তেল নেই। কিন্তু সেসব পরের কথা। এখন দুদিনের ক্ষিদের কী হবে ? অটোওলাকে ইণডিয়া গেটের সামনে ছেড়ে দেয়। দুর্জয় তার নিজের লাগেজ নিয়ে রুদ্রর পিছন পিছন হাঁটে। রুদ্রর হাতেও একটা কমদামী লাগেজের ব্যাগ। ভারতবর্যষের মানুষেরা চারিদিকে ঘুরছে। সবাইই প্রায় আইসক্রিম খাচ্ছে। কারোর কারোর হাতে বুড়ির চুল। সময়টা ছিল মার্চ মাস। দিল্লির আবহাওয়া তখন অতি মনোরম। দুর্জয়ের কান্না পাচ্ছিল। তার বাবা সরকারি অফিসার। মাছ ছাড়া সে ভাত খেতে শেখেনি। রুদ্রর মত হতদরিদ্রর পাল্লায় পড়ে সে মারা যাচ্ছে। রুদ্র তাকে এক জায়গায় বসতে বলে। সে বসে । আর রুদ্র নিজের হাতের সাদা চার্ট পেপার বোর্ডে আটকে তাকে আঁকতে থাকে। কী ভেবেছে এই ছেলেটা নিজেকে ? পিকাসো না ভ্যান গগ ? ওর আঁকা দেখে লোকে মুগ্ধ হয়ে পয়সা ঢালবে ?
অল্প কিছু পর দেখা যায় রুদ্রর ছবি আঁকা দেখতে দুটো বাচ্ছা ভিড় করেছে। তাদের ডাকতে এসে দাঁড়ায় তাদের মা আর আন্টি। শেষে এসে যায় তাদের নানা নানী। নানা তখন তারিফ শুরু করে বলছে—বাহ বেটা, তেরা হাতোমে জাদু হ্যায় …মেরা ভি তসবীর বানাও ।
রুদ্র যেন এরকম একটা ডাকের অপেক্ষাই করছিল। সে জানায় তসবীরের দাম পঞ্চাশ হবে। ফ্যামিলিটাকে দেখেই বোঝা যায় মালদার। নানা হাসতে হাসতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু তিনি মাটিতে বসতে পারেন না। তাই তাদের গাড়ি থেকে তার চেয়ার আনা হল। রুদ্র অবিকল এঁকে দিল মোটাসোটা হাসিমুখের নানাকে। অবিকল উঠে এল তাঁর মুখের সরস কৌতুক টুকু। তিনি হাসতে হাসতে পঞ্চাশ টাকা দিয়েই নিজের স্ত্রীকে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। বলতে থাকলেন তাঁর এই ঊনআশি বছর জীবনে এত ভাল তসবীরোয়ালা তিনি আর দেখেননি। কবে তাঁরা আছেন কবে নেই দুজনের ছবিই আঁকা থাক। আর তাই দেখেই বায়না জুড়ল বাচ্চা দুটো। দুরন্ত বাচ্ছাদের একাধিক বা সরে যাওয়া দাঁড়িয়ে পড়া, লাফিয়ে ওঠার মধ্যেই রুদ্র তাদের স্কেচ করে ফেলল যথাযথ। তখন সলাজ হেসে আবদার জুড়ল বাচ্ছাদের মা আর পিসি। ততক্ষণে রুদ্রকে ঘিরে একটা ভিড় জমে গেছে। সেদিন রাত নটার মধ্যে রুদ্র হাতে এগারোশ টাকা হল। সে অন্যদের আবদার সরিয়েই তখন উঠে পড়ল।
কর্ণট প্লেসে গিয়ে দুজনে আগে ভাতের হোটেল খুঁজল। বাঙালি কিছু না পেয়ে ভাত সহ সাউথ ইণদিয়ান থালি খেল পেট ভরে। গরম রসম দিয়ে সেদিন ভাত মেখে খেতে খেতে রুদ্রর মনে পড়ে যাচ্ছিল উত্তরবঙ্গের চা বাগানের গন্ধ, সারা দুপুর এলোমেলো খেলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলে মায়ের ভাত মেখে খাইয়ে দেবার স্বাদ। দুর্জয় তাকে বলেই ফেলল— রুদ্র , তোর জীবনে অনেক কিছু নেই। তোর বাবা নেই, যথেষ্ট টাকাও নেই এইরকম মিডিয়া জবে দৌড়োনোর জন্য। কিন্তু ওপরওলা তোকে অন্যদিকে পুষিয়ে দিয়েছে রে। তোর যা আছে তা আর কারোর নেই। তুই পারবি।
এইসব সংকটে সে জেরবার হচ্ছিল। দিল্লি থেকে ফিরে আচার্য্য এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন। বললেন, ওঁর বাড়ির একতলাটা ফাঁকা আছে। দুটো ঘর, রান্নাঘর সব আছে। রুদ্র ওখানে এসে থাকতে পারে বিনা ভাড়াতেই। যতদিন কাজ চলবে রুদ্র ওখানে থাকার সুযোগ পাবে। রুদ্রর কাছে এই প্রস্তাব সেইসময় ছিল খুব লোভনীয়। সে সাতদিনের মধ্যেই চলে এসেছিল। টাকা বাঁচানো এবং রোজগার এই দুইই তখন তার একমাত্র লক্ষ্য। সে ভেবেছিল তার দরজা খুলে যাচ্ছে । এভাবেই সে লক্ষ্যের পথে পৌঁছে যাচ্ছে। হয়ত সে ভুল ভেবেছিল বা হয়ত ঠিক। সাফল্য নামের বস্তুটার গায়ে তো এরকম হাজারো ক্লেদ। যে সেই কাদা ঝাড়তে পারবে সেইই তো পাবে সেই আশ্চর্য গোলক। এই সন্তরণ, এই সাঁতার কাটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। যেটা ঠিকভাবে করতে পারলে সে সেই নীল রং্যের পাথরের মত সফলতাকে ছুঁতে পারবে।
তাদের দিল্লিতে জমা দেওয়া প্রোজকেটের কোনো খবর না আসায় সে বাংলায় জমা দিল একই প্রোজেক্ট অন্য এক চ্যানেলে। তখন সে মরীয়া হয়ে উঠেছে প্রোজেক্টকে বার করে আনায়। যে যেখানে রেফারেন্স দিচ্ছে সে দেখা করছে লোকের সঙ্গে। তার মাত্র দুখানা জিন্স আর দুখানা জামা অধিক ব্যবহারে খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে, কিন্তু সে প্রোজেক্ট বার করতে পারছেনা। নিজের অনভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পারছেনা ঠিক কাকে ধরলে বা কী পদ্ধতিতে কাজ হবে।
কেউ বলছে টাকা খাওয়া, কেউ বলছে –তোর সুন্দরী গার্ল ফ্রেন্ড নেই ? দু একদিন ডিনারে যা ।পটে যাবে। কিন্তু এসব তার নেইও, থাকলেও সে পারতোনা। সে বুঝতে পারছে। কিন্তু সে স্থির বিশ্বাস রাখছে ভালো মানুষ আছে, যে তার কাজের মূল্য বুঝবে।
সে পাগলের মত স্যরের কাছে যাচ্ছে। স্যরও তাকে বলছেন—গোটা পৃথিবীটা তো পচে ধ্বসে যায়নি। তোমাকেই সঠিক মানুষ খুঁজে নিতে হবে।
সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। বাড়ি ফেরা মাত্রই প্রোডিউসার আচার্য এসে তার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সে ইতিমধ্যেই কুড়ি হাজার খরচা করে ফেলেছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এরমধ্যেই একদিন দুঃসংবাদ নিয়ে এল তার আরেক বন্ধু বিমলেন্দু। যেহেতু রুদ্রর নিজের কোনো টেলভিশন নেই সে জানতও না। বিমলেন্দু নিজেও প্রোজেক্ট বার করার জন্য চ্যানেলের দোরে দোরে ঘুরছে। কিন্তু তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো তাই তার এত চাপ নেই। সে রুদ্রর স্ট্রাগলটা জানত। সে এসেই আগে রুদ্রকে খানিক গালাগাল দিল—শালা, টিভি নেই, ফোন নেই , ভালো একটু জুতো অব্দি কিনিসনি, তোকে কি চ্যানেল গণণা করে কাজ দেবে ?
রুদ্র হাসে। জানে এই গালাগালের মধ্যে দিয়ে বিমলের ভালবাসাটা। হাসতে হাসতে বলে— সব করে ফেলব। বিমল তখন জানায়—ঠিক তার প্রোজেক্টের কনসেপ্ট নিয়েই নতুন এপিসোড শুরু হচ্ছে সেই বাংলা চ্যানেলেই, যেখানে রুদ্র কাজ জমা দিয়েছে তিন মাস আগে।
রুদ্র এই খবরে সত্যিই ভেঙে পড়ে। তবে কাকে বিশ্বাস করবে সে ? প্রোডিউসারের একটা টাকাও সে নিজে নেয়নি, প্রোজেক্ট রেডি করতে , জমা দিতে খেয়ে না খেয়ে কাজ করেছে। এত ভালো আইডিয়া ছিল। ক্রাইমের ওপর বাংলা কোনো চ্যানেল তো এর আগে কাজ করেইনি। সে লালবাজার থেকে ফরেন্সিক সব জায়গায় গিয়ে রিসার্চ নামালো। তবে ? এখন সে কী করবে ?
দুর্জয় সে আর বিমলেন্দু পরের দিনই মিটিং করল অন্য এক বাংলা চ্যানেলের লোকের সঙ্গে। দেখা গেল সেখানে এটা করা যেতেই পারে, কিন্তু টাকা লাগবে অনেক বেশি। টাকা দিলে সে বার করে দেবে প্রোজেক্ট।
শ্যামল আচার্য সব শুনলেন কিন্তু কিছুতেই টাকা দিতে আর রাজি হলেন না। স্পষ্ট বললেন—কাজ যখন হয়নি, আমি যে টাকা দিয়েছি সেটা ফেরত দাও নিজে রোজগার করে। আর ততদিন এখানেই থাকতে পারো।
সে অদ্ভুত সংকটে পড়ে গেছিল। বুঝতে পারছিল সে কার্যত বন্দী হয়ে আছে এখানে। সেইসময় আনন্দীর সঙ্গে তার আলাপ। এক বন্ধুর রেফারেন্সে আনন্দী আর তার বন্ধু চয়নিকা একদিন দুপুরে এল তার দমদমের আস্তানায়। সেদিনই আনন্দীকে দেখে তার মনে হয়েছিল এই মেয়েই যেন সে যে পাশে থাকলে সে দৌড়তে পারবে অনেকদূর।

ছয়
আনন্দী —মনে আছে আনন্দী ? মাত্র তো দুবছর আগের কথা।কিন্তু মনে হচ্ছে কতদিন হয়ে গেল বুঝি। সে তখন ওরকম হন্যে হয়ে ঘুরছে কোন এক কাজের আশায় সেইসময় তাকে একজন একটা স্ক্রিপ্ট বানাতে দিল। চারটে গল্প নিয়ে। সে একজন সাহিত্যের ছাত্র খুঁজছিল , আনন্দী জুটে গেল। মাত্র সাতদিনেই আনন্দী তার অবস্থান শুনে অবাক। আনন্দী নিজে তখন এক প্রাইভেট স্কুলে বাংলা পড়ায়। দিব্যি মাইনে পায়। কিন্তু সে ফিল্মের জন্য কিছু করতে চায়। তাইই সে এসেছিল। একদিন দুপুরে ময়দানে বসে সে রুদ্রর জীবনের সব গল্প শুনলো। সব । আর অবাক হল। সে দৃঢ় ভাবে বলল—প্রোজেক্ট ক্যান্সেল হতেই পারে, চুরিও যেতে পারে, মাঝপথে বন্ধও হতে পারে। এগুলো খুব কমন। কিন্তু ঐ প্রোডিউসার তোমাকে বাড়িতে প্রায় আটক করে রেখেছেন কেন ? ওনাকে ফেস কর। পরিষ্কার বল—তুমি নিজের মত স্বাধীন জায়গায় থেকে কাজ করবে। আর আরও কিছু টাকা দিলে তুমি এই প্রোজেক্টটাই বার করতে পারবে। তা যদি নাও হয় তুমি অন্যভাবে পরে ওনার টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু ওখানে থেকে গেলে তুমি তো অন্য কাজ খুঁজতেই পারবেনা। অন্য যেকোনো কাজে ঢুকতে পারছোনা।
রুদ্র এসব জানত। সব জানত। কিন্তু বয়স্ক এবং সিনিয়র একটা লোকের সঙ্গে সে লড়তে পারছিলনা। একটা অলক্ষ্য লড়াই অবশ্য চলছিলই।
অবশেষে অনেক লড়াই করে সে বাড়ি বদল করেছিল। আনন্দী দেখে দিয়েছিল রামগড়ে সেই ওয়ান রুম ফ্ল্যাট। ততদিনে আনন্দী তার কিছু দায়িত্ব তুলে নিয়েছে কাঁধে। সে বুঝেছে রুদ্রর একটু সাপোর্ট চাই মাত্র। কিছুটা পাশে থাকলেই রুদ্র উঠে যাবে নিজের সিঁড়িতে।
করোল বাগ স্টেশনের ওভার ব্রীজের সিঁড়তে বসে বসে এসব সাত পাঁচ ভাবছিল রুদ্র। রবিবার মানেই তার কাছে চিন্তা। কীভাবে কাটাবে ? দেড় মাস হয়ে গেল অফিসে। সে কিছুটা ধাতস্থ। তার ভুল হিন্দী শুধরে গেছে। তার হাতে একটা ফোনও এসেছে। এখন সে ইচ্ছে করলেই তার ছানা বুম্বুমের গলা শুনতে পায়। কিন্তু আনন্দী তাকে বুঝেশুনেই ফোন করতে বলেছে। মেটিরনিটি লীভ এবং তার পরেও জয়েন না করার অনিশ্চয়তার দরুণ আনন্দীর চাকরিটা গেছে। কিন্তু সে পুরোদমে সরকারী অন্য চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুদ্র বুক পকেটে ফোন রেখে মনে করে কাছেই আছে তার বউ আর বাচ্ছা। সে বলে বাড়ি আসবে। কিন্তু তার ছুটির কথাতেই কৃষ্ণদাসন চোখ কপালে তোলে এবং নতুন নতুন কাজের ভার দিয়ে দেয়। আর তারমধ্যে কাজ করে সেই প্রথম দিনে শোনা সন্তোষ কুমারের ঘটনার ভয়। আনন্দীকে বাচ্ছা কোলে নিউ দিল্লি রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার সেই দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক।
পরে শুনেছিল সন্তোষ নাকি নিজের আগের মেস ছেড়ে একটা অন্য জায়গায় ছিল। মদ খেয়ে নেশা করে পড়ে থাকত। পুলিশ ওকে খুঁজে পায়। কৃষ্ণদাসনকে কিছু টাকা দিতে বাধ্য করে আর বউ সমতে বাড়ি পাঠায়। কিন্তু প্রসেঞ্জিত বলে, ছেলেটা খুব ভালো ডিজাইন করত। ও আবার ভালো জায়গায় কাজ পেয়ে যাবে। প্রসেনজিতের কথায় ফোন বার করে টাইম দেখে রুদ্র। হ্যাঁ, এবার উঠতে হবে। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই সন্ধে ছটা বাজবে। আজও করোলবাগের একটা বাঙালি মিষ্টির দোকানে বসে শিঙাড়া আর রসগোল্লা সহযোগে প্রসেনের কবিতা পাঠ আছে। সে শুনবে।
রবিবার দুপুর হলেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। বিশ্বাস লজের মালিককে বলে রেখেছে সিঙ্গল ঘর পেলেই যেন তাকে দেয়। এই ব্যানার্জিদা লোকটা পর্ণে আসক্ত। যখন তখন ঘরের মধ্যে নীল ছবি চলছে। খুব বিরক্ত হচ্ছে সে। কিন্তু কিছু বলারও নেই।
করোল বাগ এলাকাটা বিচিত্র। মনে হয় গোটা ভারতবর্ষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-সমস্যা এই একটা এলাকায় গাদাগাদি করে ঢুকে পড়েছে। কত মানুষ—দুঃখী—দরিদ্র অথচ লড়াকু মানুষ সারাদিন এখানে ব্যস্ত। এখানে যেন কারোর কোনো সময় নেই। সবাইই দৌড়চ্ছে। রুদ্রর খুব ভালো লাগে এত মানুষ দেখতে। এরচেয়ে প্রাণবন্ত আর কীই বা হতে পারে ?
প্রসেন ফোন করছে। সে জানায়—আসছে। কিন্তু প্রসেন তাকে জানতে চায়—কোথায় আছে সে এখন ? রুদ্র হেসে বলে— ওভারব্রীজের ওপর থেকে রেল দেখছি। প্রসেনও হাসে—বলে ওখানেই থাকো। আমি আসছি। কী ছেলে! এসেও পড়ে। এসে পাগলের মত বলে—আজ আর কবিতা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছেনা। তোমার সঙ্গে একটু আড্ডা দিই। আর কতদিন যে ট্রেন যাওয়া আসা দেখিনি।
দুজনে প্ল্যার্টফর্মে বসে বসে অনেক গল্প করে। দুজনের জীবনের অনেক গল্প। আর জানতে পারে রুদ্র, প্রসেন একজনকে খুব পছন্দ করে। প্রায় দেড়বছর ধরে সে প্রেমে পড়ে আছে। মেয়েটা তাদের অফিসের। ঊড়িষ্যার মেয়ে, পিয়ালী। রুদ্র তো আকাশ থেকে পড়ে। সে তো কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। প্রসেন হাহা করে হাসে—তুমি তো সারাদিন মাথা গুঁজে কাজ কর। বুঝবে কীভাবে ?
—-কিন্তু মেয়েটা কি তোমাকে পছন্দ করে ? বেশ ঘ্যাম নিয়ে তো থাকে দেখেছি।
—-হ্যাঁ, ওই ঘ্যামটাই আমার ভালো লাগে। আমি এবার ভ্যালেন্টাইনে পারফিউম আর ফুল দিয়েছিলাম। নিয়েছিল। কিন্তু কিচ্ছু বলেনি
—-সেও তবে অনেকগুলো মাস হয়ে গেল। আর এগোলো না কেন ?
—–হুম। সেটাই। স্পষ্ট করে বলতে ভয় পাচ্ছি। সেদিন চা খেতে গিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল বারণ করি। বলতে ভয় পেলাম।
—-দিল্লিতেই কি বাড়ি ?
—-হ্যাঁ, ও ছোট থেকেই এখানে। আমার মত গ্রামের থেকে আসেনি।
—- তাতে কী ? আমাদের গ্রাম আছে বলেই আমরা এত খুশি, সুখী। নয়ত এই ভিড়ভাট্টায় সারাজীবন কাটাতে হত, না ?
প্রসেনের সঙ্গে প্রায় সাড়ে আটটা অব্দি আড্ডা দিয়ে সে আরেকটু হাঁটে। তখন আনন্দীর ফোন আসে।
আজ আনন্দীর মন একটু ভালো মনে হল। কাজের মেয়েটা বাজার ভালো পারেনা, আনন্দীই করছে। তবে ছেলেটা আজকাল ছাড়তেই চায়না। অল্প সময় বাইরে গেলেও আঁকড়ে থাকে। সে পরের সপ্তাহ থেকে কদিন গিয়ে মায়ের কাছে থাকবে বলে ভেবেছে। মা ছোট বোনের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আর তখন নিজের পড়াশোনার প্রস্তুতি সে ভালো করে নিতে পারবে। তাকেও চাকরি পেতেই হবে। কিন্তু রুদ্র কবে আসবে ?
এই একটা প্রশ্নয় এসেই রুদ্র খুব একটা উত্তর খুঁজে পায়না। সে চুপ করে থাকে। আমতা আমতা করে বলে—আসব ।
ফোন রেখে দেওয়ার সময় মা হবার পরে আনন্দীর মুখের ভাবটা তার মনে পড়ে। আনন্দীর গায়েও তখন অন্যরকম গন্ধ।
সে বড়দিদিকেও ফোন করল। দিদির বিয়ে হয়েছে তাদের এলাকাতেই। সেও অনেক দিন হল। ভাগ্নার বয়সই এখন দশ । মা এখন বড়দিদির কাছেই থাকে বেশিরভাগ সময়ে। বড় জামাইবাবু প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। বড়দির মোটামুটি সাজানো সংসার। ছোড়দি একটা সর্বশিক্ষার স্কুলে চাকরি পেয়েছে । তার বিয়ে হয়েছে বা বলা ভালো ছোড়দি নিজেই করেছে পাড়ার এক দাদাকে। সে যে ঠিক কী করে কেউই বুঝতে পারেনা। ছোড়দি স্কুল ছাড়া বাকি সময় টিউশান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একজনের রোজগারে সংসার চলছে। নিষ্কর্মা স্বামীকে নিয়ে দিনরাত অশান্তি আছে ছোড়দির। মায়ের নার্সিং কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । মায়ের কেনা এক টুকরো জমিতে বাড়ি করেছে দুই দাদা। মায়ের গলা শুনলে আজও তার বুকের রক্ত চলকে ওঠে। কিন্তু মায়ের ওপর চাপা এক অভিমানও সে বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছে রোজ। সে আশা করেছিল সে দিল্লি আসছে শুনে মা নিজের থেকেই কলকাতায় আনন্দীর কাছে এসে থাকতে চাইবেন। তার ছেলের ভার নেবেন। কিন্তু মা সে ব্যাপারে কিছুই বলেন না। সে বোঝে আনন্দীর শহুরে জীবন, পড়াশোনা এসবকেই মা অতটা সহ্য করতে পারেন না বা গ্রহণ করতে পারেন না। ঠিক কারণটা সে বোঝেনা। বা তার জীবনে মায়ের অবদানই সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ থেকে যাবে, চরম অসুবিধার মধ্যে হয়ত মায়ের ওইটুকুই আশা ছিল। কিন্তু আনন্দীও তো তার পাশে দাঁড়িয়েছে মায়ের মত দিদিদের মত রক্ষাকবচ নিয়ে। সেটাই কি ধাক্কা লাগে মায়ের এবং দিদিদের ?
সে জানেনা। তার কষ্ট হয়। এই হৈ হট্টগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে সেই অজানা লোকটার উদ্দেশ্যে বলে—দুর্জয়ের বলা কথাগুলোই । তাকে অনেক কিছু দেয়নি লোকটা, কিন্তু যা দিয়েছে সেও তো কম না। এত ভালবাসা, স্নেহ এসব কি তার পাওয়ার কথা ছিল ?

সাত
একটা ধাঁ চকচকে সেমিনার রুমে তার সঙ্গে আলাপ হল প্রোফেসর মিত্রর। স্নেহাশীষ মিত্র। আনন্দীর লোকটাকে খুব ভালো লেগে গেল। সে তার পিএইচ ডি গাইডের সঙ্গে এসেছিল সেমিনারটায়। অরুন্ধতীদি খুব মা মা টাইপ। আনন্দীকে প্রায় সব জায়গায় গাইড করেন। শুধু কাজের ব্যাপারেই নয়, বাইরের জগতে যে কীভাবে পা রাখতে হয় সেসব ব্যাপারেই।
সে অনেকদিন পর আজ সেজেছে। একটা হাল্কা গোলাপী তসর আর কালো ব্লাউজ। রুদ্র দিল্লি যাবার পর কার্যত সে ভুলে গিয়েছিল তার নিজের জীবনটা ঠিক কীরকম। সে সারাদিন বুমের জন্য রাত জাগছিল। দিনেও তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকছিল। নিজের যত্ন তার করার প্রশ্নই ওঠেনি, কিন্তু বাচ্ছাটাকে সুস্থ রাখাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিল। এখন মায়ের কাছে সে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল।
স্নেহাশীষ মিত্র তার চেয়ে প্রায় বছর দশেকের বড়, কিন্তু খুব ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিনেই। তাকে তিনি ফোন নম্বরও দিলেন। তখনই জানিয়ে রাখলেন পরের মাসে কল্যানীতে একটা সেমিনার আছে উইমেন স্টাডিজের ওপরই। আনন্দী ইচ্ছে করলে পেপার দিতে পারে। আনন্দী রাজি হল। সে দেবে। তাকেও এগিয়ে যেতে হবে সামনে। নয়ত সে মানসিকভাবে অস্থির হচ্ছে ক্রমশ। আনন্দী বাইরে চা খেতে আসে স্নেহাশীষের সঙ্গে। লোকটা সুপুরুষ, একটা হাল্কা সৌরভ আছে যেন তার চারিদিকে। এক একটা মানুষকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর কোনো ক্লেদ তাকে যেন স্পর্শ করতে পারছেনা। এর কাছে আছে যেন মুশকিল আসানের চাবিকাঠি। এ লোকটা ঠিক তাই। ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে আনন্দী ওঁর সঙ্গে চা খেল, প্রায় সোয়া এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে গল্প করল। সেইসময়টায় সে রুদ্র যে দূরে আছে ভুলে গেল। ছোট্ট ছানাটা যে মায়ের কাছে কী করছে ভুলে গেল। বুকের মধ্যে ঘটতে থাকা অনবরত ধুকপুকানি কমে গেল। তার নিজেকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর মত ঝরঝরে লাগছিল। চারপাশের সুবেশা ছেলেমেয়েদের দেখে দেখে তার নিজেকে নিয়ে লজ্জা লাগছিল। সে আরেকটু ফিট হতে পারত। তার বহুদিনের পার্লার না যাওয়ার ছাপ চুলে ত্বকে মুখে সর্বত্র। সদ্য মাতৃত্বের একটা দায়িত্ব লেপ্টে আছে তার গায়ে মুখে। সব নিয়ে নিজেকে তার খুব জড়ভরত মনে হচ্ছিল। সে কোনোদিন নিজের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সে শুধু দেখেছে যেকোনো পোশাক, যেকোনো রং তাকে মানিয়ে যায়। তাই সে সবকিছু পরে অনায়াসে ঘুরত। জিন্স আর সাদা টিশার্ট বা সাদা শার্ট ছিল তার একসময়ের প্রিয়তম পোশাক । রুদ্র তাকে পরে শিখিয়েছে নানারকম সাজগোজ করতে। রং নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। সে কিছুটা তাই করেওছিল। কিন্তু ছানা হওয়ার পর যতদিন যাচ্ছে সে মোটা হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে কী করবে বুঝতেই পারছেনা। প্রথমে তার প্রায় দুমাস ব্লিডিং হল। সে সাংঘাতিক এনিমিক হয়ে পড়ল। তখন সে ভয়ে সবকিছু খাওয়াদাওয়া শুরু করল। তার অনিয়মিত বাজার করার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সে দিনে দুটো করে ডিম খেয়ে শরীর কিছুটা সারালো। তার ওপর রাতের পর রাত জেগে যে কাহিল হয়ে হজমের অসুবিধে থেকে শুরু করে নানারকম সমস্যার কবলে পড়ল। ছেলেটার দিকে পূর্ণ মনযোগ দিতে দিতে সে নিজেকে ভুলে যেতে বাধ্য হল। নিজের আজীবন জ্বর জ্বালাও হয়নি তার। কিন্তু ইদানীং নানা উপসর্গ লেগে থাকছিল। তবু সে লড়াই করছে। সে হারবে না। সে প্রথমে ভেবেছিল রুদ্র দিল্লি যাবে আর তার ছমাসের মধ্যে তারা চলে যাবে, কিন্তু এখন সে ভাবছে তাকে নিজের কাজটাও করতে হবে। সে কলকাতায় হোক বা দিল্লিতে। সারাজীবন সে সংসার করে কাটাবে কীভাবে ?
স্নেহাশীষের সঙ্গে কথা বলে তার হাল্কা লাগছিল। নিজের স্বপ্ন গুলো ফিরে ফিরে আসছিল। সে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরল। কারণ তাকে দ্রুত ফিরতে হবে। প্রায় পৌনে আটটা বাজছে। ছেলেটা কী করছে কেজানে !
বাড়ি ফিরে জামা কাপড় না ছেড়ে হাত ধুয়ে ছেলেকে কোলে নিতেই তার কী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। তার মা তো অবাক ! এ ছেলে তো এতক্ষণ হাসাহাসি করছিল রে ! একবারও কাঁদেনি। তোকে দেখেই—
আয়া সুশীলা মাসি বলল—না গো কাকীমা , বারবার চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। খুঁজছিল মাকে ।
আনন্দী জোরে হাম্পা খেয়ে ভুলিয়ে রাখে ছেলেকে। ইস।কী পবিত্র গন্ধ ওর শরীর জুড়ে ! বেশ কিছুটা আদর খেয়ে ছেলে ফোকলা দাঁতে খিলখিল করে হাসে। আনন্দী ওকে রাতের বোতলের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তারপর নিজে জামাকাপড় ছাড়ে। রাতের খাবার খায় । আর ছেলের সঙ্গে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়ে।
শুয়ে শুয়েই ভাবে মা-বাবার এইতো ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাট। এরমধ্যে সে একটা ঘর দখল করে আছে। বাবার পড়াশোনা ইত্যাদিও অসুবিধে হচ্ছে। মা একটু নিজের মত টিভি দেখে রাত অব্দি সেও হচ্ছেনা। বাবা যেহেতু ঐ ঘরেই শুচ্ছে এবং তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ছে তাইই। তার খুব খারাপ লাগে। মায়ের কাছে থাকার সে নিজের সুবিধাগুলোই ভাবছে, এঁদের অসুবিধাটা নিয়ে সে মাথাই ঘামাচ্ছেনা। সে ঠিক করে আর দুটো দিন থেকে ফিরে যাবে রামগড়ে তার নিজের বাসায়। যত কষ্টই হোক, তার নিজের লড়াইটা তাকে নিজেকেই লড়তে হবে।
রাতে আধোঘুমে সে ভাবে কী কী পদ্ধতিতে তাকে টাকা রোজগার করতে হবে। সে এখন টিউশান পড়াতে পারবেনা । পুরোনো স্কুল তাকে কন্ট্রাক্টে নিতে পারে। কিন্তু বুমকে ফেলে সে কীভাবে জয়েন করবে ? আর সেটা করলে তার রিসার্চের কী হবে ? আজকের উজ্জ্বল সারাটাদিন তার মাথায় ঘোরে। সে বুঝতে পারেনা কী করবে ?
রুদ্রর ওপর এরকম সময়ে তার অসম্ভব রাগ হতে থাকে। রুদ্র তাকে বিপদে ফেলে নিজের কেরিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে এই সমস্ত কথা তার মনে হতে থাকে। সে ভেবেছিল রুদ্রকে দিল্লিতে ছাড়তে পারলে সে এই মুহূর্তে একটা মহান ত্যাগের আনন্দ পাবে। ভেবেছিল নিজের অসীম ক্ষমতায় সে সামলে নেবে বাকি সব। ভাবতেই পারেনি সেই ত্যাগের মূল্য এতরকম ভাবে তাকে দিতে হবে। রুদ্র যে কবে কলকাতায় আসবে সেটাই তারা জানেনা। কারণ আসা যাওয়ার খরচা ইত্যাদি তো আছেই, আর আছে দশ দিনের ছুটি পাওয়ার ব্যাপার। যেটা তার অফিস তাকে কিছুতেই দেবেনা।
চোখের জলের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে আনন্দী। আর একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। পাটুলির জলের ধারে সে আর রুদ্র ঘুরছে । সঙ্গে একটা চার পাঁচ বছরের ছেলে। ওমা ! কী কালো ছেলেটা। চোখ দুটো বড় বড় আর কী সুন্দর ! সে পরে আছে একটা লাল জামদানি , আর রুদ্র নীল জামা । কী সুন্দর ঘুরছে তারা সুখী দম্পতির মত ! কিন্তু ওই ছেলেটা কে ? ঘুমের মধ্যেই তার হাসি পায় । তার বুমবুম ? এতবড় হল কবে ? আর কী পাকা !
কবে কবে তার জীবনে এমন দিন আসবে ঠাকুর ? চোখের জলেই ঘুম ভাঙে আনন্দীর। দেখে স্নেহাশীষ মেসেজ করছে তাকে। তখন রাত প্রায় আড়াইটে।
আট
অফিসে একদিন ধুন্ধুমার হয়ে গেল। যে অশান্তিকে রুদ্র ভয় পায়, সেটাই হল। এবং যা হল সেটা কিছুটা তার অনভিজ্ঞতা আর বোকামির জন্যই। অফিসে এখন দুজনই মহিলা। দুজনেই ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং করে। একজন পিয়ালী , ঊড়িষ্যার মেয়ে, অন্যজন শিল্পা। চণ্ডীগড়ের মেয়ে। পিয়ালী মাঝে মাঝে রুদ্রর সঙ্গে হাই হ্যালো করে। রুদ্র জানে প্রসেন ওকে পছন্দ করে, তাই সেও ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু শিল্পা কাজ ছাড়া একেবারেই কথা বলেনা। খুব স্লিম এবং লম্বা মেয়েটির সাজপোশাক, আদব কায়দা খুব ফ্যাশনেবল। সে বসের খুব ক্লোজ হওয়ারও চেষ্টা করে। মাঝে মাঝেই যখন তখন সে বসের ঘরে যায় এবং একমাত্র তখনই তাকে হাসতে দেখা যায়। বাকি সময় সে অত্যন্ত গম্মভীর। রুদ্র একেবারেই অন্যদের ব্যাপার নিয়ে ইন্টারেস্টেড না, তবু তারও শিল্পার ব্যবহারের এই তফাতটা খুবই নজরে পড়ে।
চা খেতে গিয়ে বালন আর প্রসেন এই নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করে। তাদের কথা থেকেই শুনেছে কৃষ্ণদাসন নিজে বিবাহিত। দুটো বাচ্ছা আছে ছোট ছোট। আর লোকটা কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। তবে লোকটা শিল্পাকে এত গুরূত্ব দেয় কেন কে জানে ! প্রসেন হাসতে হাসতে পরে তাকে বাংলায় বলছিল—গায়ের রং এর জন্য। বস কুচকুচে, শিল্পা গোড়ি গোড়ি। আর দক্ষিণ ভারতের ছেলেদের উত্তর ভারতের মেয়েদের ব্যাপারে বেশ দুর্বলতা থাকে।
শিল্পা একটা একাউন্ট হ্যান্ডেল করছিল যার সব ডিজাইন রুদ্র সামলাচ্ছিল। রুদ্র প্রাণ মন দিয়ে কাজ করে, কিন্তু অতিরিক্ত পারফেকশন করতে গিয়ে ডেড লাইন মিস করে। তাই এবার সে আগে থেকেই চাপ নিয়েছিল সঠিক সময়ে কাজ ডেলিভারী করবে এবং তার সেরা কাজটাই করবে। প্রায় আটটা ডিজাইন ছিল বিভিন্ন বিষয়ের, সে প্রায় সবগুলোই ঠিকভাবে পাঠায় এবং ক্লায়েন্ট এপ্রুভও করে দেয়। কিন্তু একটা ডিজাইন তার নিজেরই মনের মত হয়না। সে শিল্পাকে বলে মাঝের শনি রবি যদি তাকে দেয় ক্লায়েন্ট তবে সে নামিয়ে দেবে।
অনেক কথাবার্তা ফোনাফুনির পর শিল্পা রবিবার সন্ধের মধ্যে ডেলভারী দিতে হবে এই কথা স্থির করে। শনিবার অফিসে এসে সারাদিন কাজ করে যেটা সে পাঠায় ক্লায়েন্ট তার অনেক কারেকশন দিয়ে দেয়। আবার রবিবার সে অফিসে আসে একা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল যেতে তার কাছেই ক্লায়েন্টের ফোন আসে। সে নিজেই কথা বলে ক্লায়েন্টকে মেইল করে দেয় ফাইনাল কাজ আর বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে লজে ফিরে যায়।
পরেরদিন সোমবার এগারোটায় অফিস ঢুকেই দেখে ধুন্ধুমার। অসভ্যের মত চিৎকার করছে শিল্পা। কেন তাকে না জানিয়ে রুদ্র কাজ ডেলিভারী করে দিয়েছে এটাই বিষয়। তার হয়ে বলার চেষ্টা করছে বালন। কিন্তু শিল্পার মেজাজের কাছে কেউই কিছু বলতে পারছেনা। রুদ্র মনে মনে একটু ভয়ই পেয়ে যায়। তার এখন প্রতিমুহূর্তে চাকরি নিয়ে ইনসিকিওরিটি। তাছাড়া সে নিজেই বুঝতে পারছেনা কী এমন অপরাধ সে করেছে । সে তো কাজটা দিতে পেরেছে। সেটাই সবচেয়ে বড় নয় কি ? সে শিল্পাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, যে ক্লায়েন্ট নিজে তাকে ফোন করেছে বলেই সে ডিরেক্ট ক্লায়েন্টকে কাজটা পাঠিয়েছে। তাছাড়া সানডে বলেই সে শিল্পাকে ডিস্টার্ব করেনি। তাতে শিল্পা অফিসের একঘর লোকের সামনে তাকে যা নয় তাইই শুনিয়ে দেয়। কৃষ্ণদাসন তখনো আসেনি। রুদ্র কাউকেই কিছু না বলে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। এত সব অকারণ অপমান মুখ বুজে তার সহ্য করতে ইচ্ছেই করেনা কিন্তু সে নিজে কোনো ঝামেলা বাড়াতে চাইছেনা আর উল্টোদিকের মানুষটা একজন মহিলা—এই দুই কারণে সে চুপ করল। শিল্পা তার অসভ্যের মত চিৎকার অবশেষে থামালো। তার অল্প পরেই বস এল। রুদ্র জানে ফোনেই যা যা কমপ্লেইন করার হয়ে গেছে, তাই সে অপেক্ষা করল বসের ডাকার জন্য। হয়ত তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়াই হবে , তাকে ফিরে যেতে হবে। নাহ। ফিরবে সে আর না। এখন সে যুদ্ধ শিখে গেছে আরেকটু বেশি। সে পনের দিনের মধ্যেই কাজ জোটাবে এই শহরে। হেরে ফিরে সে যাবেনা।
রুদ্র মাথা গুঁজে কাজ করে আর অপেক্ষা করে বসের ডাকার। নারীজাতি সম্পর্কে চিরকালই তার অশেষ শ্রদ্ধা। মা আর দিদির ঘেরাটোপে সে বড় হয়েছে। এরপরেও সে বিচিত্র নারী দেখেছে কিন্তু এত নির্লজ্জ, অসভ্য মেয়ে দেখেনি। প্রায় অকারণে রুদ্রকে মেয়েটা অপমান করল। একটা দুটো কথা বলেই যেটা মিটিয়ে নেওয়া যেত। প্রায় বিকেলের দিকে বস তাকে ডাকে। ততক্ষণে অফিসে সবাই আবার সাধারণ কথা কাজে মেতে উঠেছে। রুদ্র বালন আর প্রসেনের সঙ্গে চা খেয়েও এসেছে। ওদের দুজনেরই বক্তব্য –রুদ্র চুপ করে থাকল কেন ? ভাল করে মেয়েটাকে ঝাঁঝিয়ে দিতে পারত ! রুদ্র বলে –সে আসলে হতভম্ব হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল সঠিক সময়ে কাজটা সে দিয়ে শিল্পার কথা রাখতে পেরেছে। ক্লায়েন্টের কাছে দেওয়া কথাটা রাখা গেছে, এরজন্য তাকে ধন্যবাদ দেবে শিল্পা। রবিবার রাত আটটায় সে নিজের থেকে শিল্পাকে ফোন করেনি, বস্তুত তার মনেও আসেনি। বালন একটু চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে। সবসময় খুব গভীর ভাবে ভাবে । সে বলে—মনে হচ্ছে দাদা শিল্পা চায়নি কাজটা তুমি ঠিক সময়ে দাও। কিছু তো আছে ইসমে। বাতমে ক্লিয়ার হবে । প্রসেনও বালনের কথায় সায় দেয়। তারপর বলে—এসব পাঞ্জাবি মেয়েরা ছোট ছোট স্বার্থের জন্য না খুনও করতে পারে। আমার আগের অফিসে ছিল নয়না বলে একটা মেয়ে। কাজের দরকার হলে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে তোমার পাশে। আর একটু ইগোতে লাগলেই তোমাকে খুন করতে বাকি রাখবে।
বিকেলে কৃষ্ণদাসন তাকে ডেকে সকালের কথার ধার দিয়েও গেলেন না। বরং তাকে বোঝালেন যে টেলিভিশন এডটার জন্য তার প্রায় বছর দুই অপেক্ষা করছিল সেটা কনফার্মড আগেই হয়েছিল। এখন এডভান্স এসে গেছে। রুদ্র যেন ওই একাউন্টটা নিজেই পুরো হ্যান্ডেল করে। মাসখানেকের মধ্যে এই শ্যুটিং, এডিটিং শেষ করতে হবে। তারপর রুদ্র বাড়ি ঘুরে আসতে পারে।
রুদ্র নতুন কাজ পেয়ে খুশি হয়। শ্যুটিং তো তার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এক মাস ! তার মন দমে যায়। তার বুম্বুম তো রোজ বড় হচ্ছে। আনন্দী একটা খাম পাঠিয়েছে বুমবুমের ছটা ছবি দিয়ে। সেই ছবি সে ব্যাগে রেখে দিয়েছে, যখন তখন দেখছে আর তার চোখে জল ভরে আসছে। আনন্দীর ওপর তাও সে রাগ করেছে , কেন সে নিজের ছবি পাঠায়নি ! আনন্দী বলছে—সে ইদানীং খুব মোটা হয়ে গেছে, দেখতেও বাজে হয়ে গেছে। তার ছবি এখন দেওয়ার মত নয়।
ক্যামেরা হাতে নিজেকে দেখার দুর্দান্ত সাধ তাকে কত দূরে এনে ফেলেছে সবার থেকে ! তবে এই একমাস পর সে বাড়ি যাবেই । যেতেই হবে তাকে । তাতে চাকরি যায় যাক । এই একমাস আবার ব্রতের মত কাজ। মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের এডের জন্য অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে । সে অফিসের পর খুশিখুশি গলায় প্রসেনকে বোঝাচ্ছিল এড ফিল্ম আর টেলি ফিল্ম বানানোতে যে তফাত। এডের স্টোরিটা ওই সেকেন্ড গুণে গুণে বলে দিতে হবে। প্রায় কোনো সংলাপের সুযোগ নেই। কিন্তু টেলিফিল্মে ক্যামেরা এক জায়গায় দুমিনিটও দাঁড়াতে পারে। প্রসেন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। তারপর বলল—তুমি ওই গতের ডিজাইনার নয় কিন্তু বন্ধু। তোমার আইডিয়াজ একেবারে আলাদা। তুমি এই ছোট অফিসে পড়ে থেকোনা।
সে হাসে। কে তাকে বড় অফিসে ডেকে চাকরি দেবে ? দিল্লির বড় বড় অফিস বাড়িগুলোর দিকে সে মাঝে মাঝেই লোভীর মত তাকায়। তার তো পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে ইচ্ছে করে । সে পারবে ? সেদিন প্রসেনের নেহেরু প্লেসে কী কাজ ছিল। অফিস ফেরত একটা অটো ভাড়া করে সে এসেছে। রুদ্রর ও তো ঘরে ঢোকার তাড়া নেই। রুমে ফিরলেই দেখবে মোটাসোটা মাঝবয়সী ব্যান্যার্জীবাবু একটা ছোট প্যান্ট পরে শুয়ে শুয়ে পর্ন দেখছে। যত দেরি করে ফেরা যায় তাইই ভালো। তাই সেও এসেছে প্রসেনের সঙ্গে । নেহেরু প্লেসের মার্কেট দেখে রুদ্র হাঁ। এটা নাকি এশিয়ার বৃহত্তম কম্পিউটার মার্কেট। এখানে সবচেয়ে সস্তায় সবচেয়ে ভাল কম্পিউটার সার্ভিসিং হয়, কেনাও যায়। প্রসেন ওর নিজস্ব পিসিটা সারাতে দিয়েছিল। রুদ্র মার্কেট ঘুরতে ঘুরতে ভাবে কবে সে নিজের মেশিন কিনবে । দুজনে ম্যাংগো কুলফি খায়, আবার দহিবড়াও। জায়গাটা খুব পছন্দ হয় রুদ্রর । ফেরার সময় অটোতে উঠে তার মনে হতে থাকে কোনোদিন যদি নিজে অফিস খুলতে পারে, এই জায়গায় ভাড়া নেবে। সে নিজের অসম্ভব স্বপ্নকে লুকিয়ে হাল্কা চালে প্রসেনকে বলে –এসব জায়গায় আমাদের অফিসের মত অফিস হলে কত ভাড়া হয় ?
প্রসেন বলে—খুব বেশিই । প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার হবে !
বাপরে। তার মাইনে এখন চল্লিশ , যেটা নিয়ে সে প্রথমে আপ্লুত হলেও ঠিক তিনমাসের মাথায় বুঝতে পারছে এই টাকায় কলকাতা আর দিল্লির সংসার চালানো কী অসম্ভব ! তবু কেন কে জানে একটা স্বপ্ন তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সে নিজের অফিসের স্বপ্ন দেখে। অটো থেকে নামার সময় অবশ্য তার বেজায় হাসি পায়। কীসব যে সে ভাবছে ! এই মাত্র কদিন আগে আনন্দী সন্তান সম্ভবা শুনে সে একা গোলপার্ক মিশনের সামনে বসে কাঁদছিল। না পারার যন্ত্রণা। স্ত্রী সন্তান পালনের উপযুক্ত টাকা না রোজগার করতে পারার অসীম বেদনা তাকে কাবু করে ফেলেছিল। গোলপার্কের এস টি ডি বুথ থেকে একে ওকে ফোন করে একটা সেলসের চাকরি জোগাড় করেছিল। আট হাজার টাকা মাইনে। কিন্তু আনন্দী কিছুতেই সেই কাজ নিতে দিলনা।
নয়

এক একজন মানুষের মধ্যে কী একটা থাকে পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হয় এই লোকটা তার সব মুশকিল আসান করে দিতে পারবে। স্নেহশীষের পাশে দাঁড়িয়ে আনন্দীর মন এখন ঠিক তাই ভাব। তার ছোট থেকে বড় হওয়ায় যত যত দুঃখ, না পাওয়া, ক্ষিদে, কষ্ট সব এসে কেমন ডাকাডাকি করছে এই লোকটার পাশে এসে দাঁড়ালে। এ কি প্রেম ? রুদ্রর সঙ্গে তো তার এমনটা হয়নি! রুদ্রকে দেখলে তো তার চিরকাল মনে হতে থাকে , আহা এই ছেলেটার কেউ নেই। এরজন্য তাকে বুক পেতে দিতেই হবে। তাছাড়া রুদ্রর স্বপ্নের মোহে সেও পড়ে গেছে। তারও জেদ চেপে গেছে রুদ্রকে সফল হতেই হবে। কিন্তু আজকাল সে বুঝতে পারছে টাস্কটা সহজ না। সে নিজের সমস্ত বঞ্চিত চাহিদার কান্নাকাটি শুনতে পারছে আজকাল। তার একটা টানাপোড়েনের যন্ত্রণা হচ্ছে খুব।
কল্যানীর সেমিনারের পরে আজ আবার যাদবপুর। নাহ, আজ কোনো সেমিনার নেই। সে এমনিই বুমকে মায়ের কাছে রেখে এসেছে যাদবপুর। স্নেহাশীষ ফোন করেছিল তাকে আসতে বলে। সে এসেছে অফিসিয়াল কোনো কাজে। ক্যান্টিনে দুকাপ চা হাতে সে বসে আছে স্নেহাশীষের উল্টোদিকে। আর শুনছে কত গল্প। স্নেহাশীষও যে কেন তার কাছে এতকথা বলছে ! তার নিজের প্রোফেশনাল ঝামেলার কথা, তার বিদেশ থেকে প্রোজেক্ট অসমাপ্ত রেখে আসার কথা আর ফাইনালি নিজের পরিবারের কথা। আনন্দী লোকটাকে স্পর্শ করতে পারছিল যেন। বাইরে যে সফল ঝকঝকে ইমেজ তার ভেতরে আসলে একটা কান্না আছে। পরিবারের কথা বলতে গিয়েই অল্প গুটিয়ে যাচ্ছিল স্নেহ। সে এতক্ষণ কথা বলার পর অল্প থেমে জিজ্ঞেস করছিল আনন্দীর কথা। আনন্দীর ছোটবেলার কথা। হাসতে হাসতে বলছিল—তুমি কিন্তু আমার থেকে ঠিক চোদ্দ বছরের ছোট। আনন্দী হাসছিল, বলছিল—কথা বলার সময় কই মনে হচ্ছেনা তো আমি এত ছোট ! আপনি এত বড় !
—কী মনে হচ্ছে তবে ? স্নেহাশীষের ফর্সা মুখের রং লাল হচ্ছিল
—-মনে হচ্ছে আপনি আমার কতদিনের বন্ধু !
—–হুম। এটাই সেই ছেলেমানুষী। আমার বয়সে এলে কিছুতেই কাউকে এত সহজ করে বলতে পারতেনা ! এই সারল্যটা তোমার বয়সেই মানায় ।
এবার আনন্দী লজ্জা পায়। সে দেখে অনেক অনেকদিন পর দুটো স্নেহময় চোখ তাকে স্পর্শ করে আছে। স্নেহাশীষ উঠে দুকাপ কফি আর একপ্লেট চিকেন পকোরা আনে। এসে বসে বলে—বল, তোমার বরের কথা শুনি।
আনন্দীর হঠাত মনে হল ঐ হঠাত উঠে কফি আনতে যাওয়ার মধ্যে মনটাকে যেন প্রস্তুত করলেন ভদ্রলোক। তিনি কি তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন ? রুদ্রর কথা তাইই শুনতে চাইছেন ?
সে ঠিক করল রুদ্রর কথা সংক্ষেপেই বলবে। এরকম সন্ধেবেলায়, ক্যাম্পাসে আলো জ্বলে আছে চারিদিকে তখন যে তার সত্যিই রুদ্রর জন্যে খুব মনখারাপ করে। কোথায় কতদূরে কোন এক অফিসে বসে রুদ্র ঘাড় গুঁজে কাজ করছে হয়ত। সেই সকালে দুটো ভাত খেয়ে এসেছে। পয়সা বাঁচানোর জন্য বাইরে কিছুই খাচ্ছেনা হয়ত। লজে ফিরেই খাবে যাহোক।
সে স্নেহাশীষকে রুদ্রর সঙ্গে দেখা হওয়া অব্দি রুদ্রর এই স্বপ্নের পিছনে দৌড়নো অব্দি সব বলে। কতক্ষণ বলে তার মনে থাকেনা। ক্যাম্পাসে বেশ ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে লোক কমে আসে। যখন আনন্দীর ফোনে তার মা ফোন করে তখন তার খেয়াল হয়। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। বুম ঠিক আটটায় খায়। তখন মাকে না দেখতে পেলে ছটফট করবে। সে গোলাপী ওড়নাটা তুলে নিয়ে বসে বলে—এবার আমাকে উঠতে হবে।
আর যাকে বলে সে এক অদ্ভুত চোখে তখন তার দিকে তাকিয়ে। দুপুর থেকে যে লোকটার সঙ্গে সে আড্ডা দিচ্ছিল এ যেন সে নয় ! অন্যরকম গভীর চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহাশীষ। আনন্দী একটু লজ্জা পায়। তারপর বলে—উঠবেন না ? কী ভাবছেন ?
স্নেহ অল্প হেসে বলে— তুমি রুদ্রকে এত ভালোবাসো ? আমাকে যদি কেউ এভাবে বাসত !
রাতে বুমে পাশে শুয়ে একা ঘুমনো অব্দি স্নেহাশীষের কষ্টে জড়ানো ওই কথাগুলো মনে পড়ছিল আনন্দীর।

(ক্রমশ)
————————————————————————–

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes