ধারাবাহিক উপন্যাস <br />যে আমারে  চায় <br /> প্রথম পর্ব <br />   ঈশা দেব পাল

ধারাবাহিক উপন্যাস
যে আমারে চায়
প্রথম পর্ব
ঈশা দেব পাল

২০২০ সালের মার্চ মাস। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই বিশেষ সময়। ভারত সরকার হঠাত ঘোষণা করল লক ডাউন। নিউ দিল্লিতে আটকে গেল রুদ্র। এক নিম্নবিত্ত পরিবারের যুবক , যে শুধু দু চোখে স্বপ্ন ভর করে পাড়ি দিয়েছিল নিউ দিল্লিতে। অনেক লড়াইয়ের পর শুরু করেছিল নিজের কোম্পানি। কলকাতায় থেকে গেছে তার স্ত্রী আর পুত্র। তাহলে কি বন্ধ হয়ে যাবে রুদ্রর ব্যবসা ? ফিরে আসতে হবে তাকে পরাজিত সৈনিকের মত ? বাড়ি ফেরবার ফ্লাইট ধরার জন্যে কোভিড টেস্ট করাতে গিয়ে দিল্লির নেহেরু প্লেসের এক হাসপাতালের সামনে তার সঙ্গে দেখা হল নাতাশার। বাংলাদেশের বাসিন্দা নাতাশা আটকে পড়েছে দিল্লি এসে, অথচ তার থাকবার জায়গা নেই সেই মুহূর্তে। সুন্দরী যুবতী অথচ প্রায় অপরিচিত মেয়েটিকে রুদ্র কি নিজের ফ্ল্যাটে স্থান দিতে পারবে ? সামাজিকতা এবং দায়িত্ববোধের এই লড়াইকে কীভাবে অতিক্রম করবে রুদ্র ? অথচ সে যে শুধু কাজ চায়। সেই কাজের দেবতাই তাকে বুঝি পথ দেখাবে। ‘ পথ আমারে সে দেখাবে যে আমারে চায়’ এই রবীন্দ্র পংক্তিই যেন তার জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে বারবার। এক সহায় সম্বলহীন বাঙালি যুবকের বাংলার বাইরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জেদের কাহিনিই ‘ যে আমারে চায়’। প্রথম পর্ব।


যে আমারে চায় —

মার্চ, ২০২০
এক
—– নাতাশা না ?
মেয়েটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকাল। হ্যাঁ, নাতাশাই তো। রুদ্র নিজেও কিছুটা অবাক হল।
—-তুমি এখানে ? এখন ?
নাতাশা প্রায় কেঁদে ফেলা গলায় বলে—কোভিড টেস্ট করাতে এসেছি। তুমি রুদ্র ? পিণাকের বন্ধু না ? উফফ। তোমাকে দেখে সাহস পেলাম।
—–হ্যাঁ, আমি রুদ্র । তুমি ইন্ডিয়ায়ে কী করছ ?
—এসেছিলাম একটা কাজে, দিন সাতেক হল। আমার ছেলে এখানে ম্যানেজমেন্ট পড়বে। তার খোঁজ নিতে। পিণাক এত ব্যস্ত থাকে নাটক আর অনুষ্ঠান নিয়ে। তাই আমিই এলাম। আর ঠিক দুদিন পর চলে যাবার কথা ছিল। তারমধ্যেই এতকিছু হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল। এখন শুনছি লকডাউন হবে । তোমাকে দেখে ভরসা পেলাম রুদ্র। তুমি তো এখন বিরাট ব্যাপার। আমি ঢাকায় না ফিরতে পারলে তুমি কিছু এরেঞ্জ করতে পারবেনা ?
এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল রুদ্রর। সে এতবড় ব্যাপার নাকি যে ভারত সরকাররের নিয়ম বদলে বা ভেঙে কিছু পারবে ? সে একজন ব্যবসায়ী মাত্র। সফল ? হয়তো। সে তো সাফল্য বলতে অন্যরকম কিছু বোঝে। তবে তার নিজস্ব অফিস আর তার আণ্ডারে প্রায় দশজন কর্মরত। একে যদি সফল বলা যায় ! দিল্লিতে তার ভাড়া নেওয়া বিরাট ফ্ল্যাট। কলকাতায় তার বা তাদের নিজস্ব দুখানা ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি। এইই হয়ত সাফল্য। যা চোখে দেখা যাচ্ছে। যার তিল তিল করে তাকে করতে হয়েছে।
রুদ্র নাতাশার পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, এখন এত এলোমেলো ভাবে এসেছে, তাও একটা রূপের আলো হয়ে আছে চারিদিকে। ও রুদ্রর ইউনিভার্সিটির বন্ধু পিণাকপানীর বউ। যেসময় ওরা বিয়ে করেছিল তখন হিন্দু –মুসলিম বিয়ের সংখ্যা কমই। তাও দুজনেই বাংলাদেশের বাসিন্দা। সোশ্যাল সাইটে ওদের সংসার-ঘরকন্নার ছবি তারা সবাই দেখেছে।
—-তুমি ফ্লাইটের জন্য টেস্ট করাতে এসেছ ? রিপোর্ট পেলে তবে এজ সুন এজ পসিবল ঢাকায় ফিরে যাও। কারণ সত্যিই লকডাউন হতে পারে। আমিও দিল্লিতে থাকবনা, কলকাতা ফিরে যাব। তাই টেস্টের জন্য এলাম। নয়ত গত সপ্তাহেই বাড়ি থেকে এখানে এসেছিলাম। এখন কাজকর্ম সব বন্ধ।
নাতাশার মুখ আবার ভ্যাবাচাকাময় হয়ে উঠল। রুদ্রও কী বলবে বুঝতে পারছেনা। কোভিড টেস্টের জন্য লাইন খুব ছোট নয়। কিন্তু নেহেরু প্লেসের এই সেন্টারটার সামনে অনেকটা জায়গা। চেয়ারও দিয়ে রেখেছে লম্বা করে।
প্রায় আধ ঘন্টা পর ডাক এল ওদের। আগে নাতাশা, তারপর ও। নাতাশা ইসলাম আর রুদ্র চট্টোপাধ্যায়। দুজনেই জানল রিপোর্ট পরের দিন বিকেলে।
দিল্লি এই মার্চ মাসে চরম সুন্দর। ইঁট কাঠ পাথর ভেদ করে চারিপাশে লাল-হলুদ কৃষ্ণচূড়া, চারিপাশে ডালে ডালে বসন্তের সমাগম।কিন্তু এবারের বসন্ত একেবারে নিঠুর বসন্ত। মহামারীর প্রকোপে কাঁপছে গোটা পৃথিবী। দুমদাম লোক নাকি মারা যাচ্ছে । রুদ্র নাতাশাকে অটোতে তুলে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফেরে কালকাজীর দিকে। ওখানেই ওর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া আছে। অফিস নেহেরু প্লেসে। অনেকদিনই রুদ্র অফিস থেকে একা হেঁটে বাড়ি ফেরে। এই একা একা হেঁটে ফুটপাথে ফুটপাথে ঘুরে বেড়ানো জীবনটাকে তার ছাড়তে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু আজ অফিস বন্ধ। এখন থেকে নাকি অনলাইনেই কাজ চলবে। তবে আর দিল্লিতে থেকে সে কী করবে ? বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু এতদিনের এত প্ল্যান, এত স্বপ্ন সব ভেঙে যাবে ? অনেক কষ্টে সে গড়ে তুলেছে তার ছোট্ট এড এজেন্সি, প্রাইভেট লিমিটেড করিয়েছে , সেসবে জল ঢেলে সে ফিরে যাবে ? অনলাইনে বিজ্ঞাপনের কতটা কাজ করা যাবে ? ক্লায়েন্ট মীট না হলে কীভাবে সব সম্ভব ? সে বুঝতে পারছেনা। ফিরে যাওয়া শব্দটার মধ্যেই তার কাছে একটা তীব্র হেরে যাওয়া ! একেবারে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো দশা থেকে সে আজ ভারতবর্ষের রাজধানীতে গড়েছে নিজের সাম্রাজ্য । এখন দিল্লি এড ওয়ার্ল্ডের লোকজন তাকে একডাকে চেনে। এই দীর্ঘ পথের প্রতিটা দিনের কষ্ট আনন্দ সে বহন করে আজও। সাফল্য বলতে সে কিচ্ছু বোঝেনা। তার সমবয়সীরা, ক্লাসমেটরা, আত্মীয় স্বজনেরা যখন আজকাল তার দিকে মুগ্ধ শ্রদ্ধা কিংবা ঈর্ষা নিয়ে তাকায় তখন সে ভাবে আরো কী কী করতে হবে। তার কাছে কালাম সাহেবের ওই বাণী যে চরম সত্য — স্মল এইম ইজ এ ক্রাইম ।
সে আকাশ ছুঁতে চায়। তার কারণ অন্য কিচ্ছু না। প্রতিদিন যে কটা ধাপ সে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ততটাই শ্বাস পায়। মুক্তির শ্বাস। ছোটবেলা থেকে শ্বাসকষ্ট তার সঙ্গী। বাঁচার নিঃশ্বাস সে সহজে পায়না । সেটাও তাকে অর্জন করতে হয়। ছোটবেলা থেকেই এই তার শাস্তি। আগে সে ভাবত এত লোক চারপাশে, প্রত্যেকে সুস্থ। সে কেন এই ভার পেল ? এখন সে বোঝে। জীবন ধারণের ন্যূনতম নিঃশ্বাস অর্জন করাই ছিল তার আজন্ম শিক্ষা। ট্রেনিং । তাকে জীবনের পথে প্রতিটা ধাপ অর্জন করতে হবে। আর তাইই হাঁটতে হবে। সামনে চড়াই উৎরাই যাই আসুক তাকে সেসব ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে। এই এগিয়ে চলাই তার মন্ত্র। তখন ব্যর্থতাও তাকে আনন্দ দেয়। চরৈবতি চরৈবতি, যত এগোবে তত মধুক্ষরণ হবে –এই মন্ত্র নিয়ে সে এসে মাঝপথ থেকে ফিরে যাবে দিল্লি থেকে ? প্রায় পনের বছর বউ, ছেলেকে ছেড়ে সে থাকল এইজন্য ? রুদ্র নিজকে শান্ত করে পথ হাঁটে। জীবন আর স্বপ্ন কখনো হেরে যায়না। কিছুটা সময় হয়ত দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় তাকে। নিজেকে বোঝায় সে।
চারিপাশে কোকিল ডাকছে। বেলা প্রায় বারোটা, তাতেও। কোকিল কি ঘড়ি ধরে ডাকবে ? এখনো দিল্লির দুপুরের রোদ এত নরম , এত স্নিগ্ধ ! আর মাসখানেক পরেই এইসময় বেরোনো যাবেনা। এত কড়া রোদ উঠে যাবে । কোকিলের ডাক আর মৃদু হাওয়ায় নিজেকে শান্ত করতে করতে নেহেরু প্লেস থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরে রাঘব। অনেক কষ্টের পর, অনেক লড়াইয়ের পর সে একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে আজ দেশের রাজধানীতে এসেছে , এখান থেকে হেরে ফিরে সে যাবেনা। তবে এই করোনা ভাইরাসের ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নিতে হবে ! কতটা সিরিয়াস এ ? নাকি এসবের মধ্যেও কোনো রাজনীতির প্যাঁচ আছে ?
তিনতলায় উঠে তালা খুলে আগে হাত পা ধুয়ে তার বিরাট ড্রয়ই রুমের বড় আরাম কেদারায় কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে ও। ভাবতে হবে, ভাবতে হবে। তবে ক্ষিদেও পেয়ে গেছে বিস্তর। তার এই ফ্ল্যাটটার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল একেবারে সামনে পার্ক আর পার্ক ঘিরে বড় বড় গাছ। তাই সারাদিন পাখির ডাক আর বাচ্ছাদের খেলাধূলার কলকাকলীতে এই ফ্ল্যাটটা মুখরিত হয়ে থাকে। প্রায় তিন কামরার বিরাট এই ফ্ল্যাটে একা থাকাটাই তার একমাত্র বিলাসিতা। সে চিরকাল হাত পা ছড়িয়ে থাকতে ভালোবেসেছে, কিন্তু ঈশ্বর তার জন্য এতকাল দারিদ্রের নামে স্বল্প স্থান নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল এক দেড় কামরার নার্স কোয়ার্টারে। সেখানে সে মায়ের সঙ্গে আর আরও তিন দাদা দিদির সঙ্গে কাটিয়েছে। এক আধ দিন নয়, তার আঠারো বছর বয়স অব্দি ওভাবেই কেটেছে। সে ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করেছে নিজের ভাগ্য নির্ধারণের। কিছুটা হলেও সে কি পারেনি সেই চ্যালেঞ্জ মেটাতে ? এই বড় বাড়ি ছাড়া বাকি জীবন তার সাদা পাতার মত সহজ, সাধারণ। সে প্রায় নিরামিষ খায়। জলখাবারে সে গত সাড়ে তিন বছর ধরে ওটস , দুধ আর কলা খেয়ে আসছে। কখনো আপেল। দুপুরে, রাতে খিচুড়ি। সব সব্জি, সব ডাল। সে নিজে রাঁধে, তাই যেদিন একান্ত সময় পায়না সেদিন মুড়ি, দই। দুবেলা। ব্যস। তার খাওয়া শেষ। সে বড় বড় পার্টি যাওয়ার সুযোগ তার বন্ধু, জুনিয়রদের ছেড়ে দেয়। তার মদ ভালো লাগে, কিন্তু সে খায়না। নিজের অসব পছন্দকে পাত্তা দেয়না।
সে হাত পা ধুয়ে জামা বদলায়। আনন্দী ফোনে তার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে নিয়মের বিধিনিষেধ বলে বলে। তাই হাত ধুয়েও হাতে স্যানিটাইজার দেয়। মাস্ক ফেলে দেয়। জামা ছেড়ে বাড়ির জামা বদলায়।
কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খোলে। গতরাতের খিচুড়ি আছে। বার করে নেয় পাঁপড় আর ডিম। আজ দুপুরে ম্যানেজ হয়ে যাবে। সে সাতদিনের মধ্যে পাঁচদিন নিজের জন্য খিচুড়ি রাঁধে। তার কারণ অন্য কিছুই না, কাজের মাসি সকালে এসে সব কাজ করে ঘর গুছিয়ে গেলেও সে তাকে দিয়ে রান্না করায়না। তার ভালো লাগেনা। সে জানে তার একটু পিটপিটে স্বভাব আছে। ছোটবেলা থেকে অসম্ভব স্ট্রাগল করার সুফল এটাই সে সব কাজ অত্যন্ত ভালো পারে। ব্যবসার কাজে যত চাপই থাকুক না কেন সে নিজেকে খুব ভালো গুছিয়ে থাকতে পারে। আর খাওয়ার ব্যাপারটায় জিহবার ভূমিকাকে পাত্তা না দিয়ে শুধু উপকারের দিকে তাকালেই হল। সে তো প্রয়োজন হলে তিনবেলা উচ্ছেসেদ্ধ খেয়েই পেট ভরাতে পারে। খিচুড়ি তো অমৃত সেখানে। আনন্দী তার এই খিচুড়ি নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। বলে—ইচ্ছে করে তোমার রোজ খেতে ?
সে হাসে। আসলে ইচ্ছে বা অনিচ্ছের ব্যাপারটা তো নিজের হাতে। সে ইচ্ছে করালেই করবে, নয়ত না ! সে জিভ দিয়ে বহুকাল খায়না, প্রয়োজন অনুযায়ী খায়। সে নিজের স্বাস্থ্যের জন্য খিচুড়িতে ভাল চাল-ভাল ডাল, ভাল ঘি, আলু ছাড়া যতরকম সব্জি দেওয়া যায় দিয়ে রাঁধে। ভাল হিং দেয় ফোড়ন। খেতেও তাই মোটেই খারাপ হবেনা। কিন্তু আনন্দী বা বুমবুম কিছুতেই খাবেনা। তাদের মা-ছেলের মুখের খুব তরিবত। তাই কলকাতায় গেলে সে রান্নার ব্যাপারট পুরো ছেড়ে দেয় আনন্দীর কাছে। বেশ এটা ওটা কদিন খায়। দিল্লি এসে আবার সপ্তাহে পাঁচদিন খিচুড়ি।
রুদ্র ঝটপট করে একটা ডিম ফেটিয়ে নেয়। কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই ডিমের ওমলেট বানায়। তারপর ডিশে ঢেলে নেয় গরম খিচুড়ি, ওমলেট আর পাঁপড় ভাজা। তাকে নিজকে আগে শান্ত রাখতে হবে। বিপদে মাথা স্থির রাখার ক্ষমতাটা সে নিজের জীবন দিয়ে শিখেছে। সে জানে নিজে স্থির থাকলে গোটা পৃথিবী তাকে হেলাতে পারবেনা। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ঠিক আঠারো বছর বয়সে সে একটা হাতে আঁকা ম্যাপ আর আটশো টাকা নিয়ে একা এসেছিল কলকাতা। ম্যাপ চিনে চিনে সে খুঁজেছিল পাড়াতুতো এক দাদার মেস, একা গিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে। তারপর থেকে সে এতরকম জীবন দেখেছে যে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে দিল্লিতে এল তার আর অসুবিধে হলনা। এখানকার বিচিত্র জীবনের চাপ সে একা নিয়ে নিল। কিন্তু ময়দান ছেড়ে যাওয়ার কথা সে কখনো ভাবেনি। আজ কি তবে তাই হতে চলেছে ? সে বাধ্য হবে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ কোনো পেশায় ঢুকে যেতে ? সে বুঝতে পারছেনা, কিন্তু বুঝতে তো তাকে হবেই।
আনন্দীর সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলার নির্যাস সে জানে। আনন্দী বলবে , অনেক টাকা তো করলে রোজগার। এবার ছেড়ে দাও। সাফল্য কী তুমি তো বুঝেছে। প্রায় শূন্য অবস্থা থেকে গিয়ে কারোর থেকে এক পয়সা সাহায্য না নিয়ে আজ তুমি নিজের এজেন্সি খুলেছ, তাও দিল্লির মত শহরে। এত বড় বড় ক্লায়েন্ট পেয়েছ। এবার এসব ছেড়ে দিয়ে যদি শান্তিতে বাঁচতে পারো কী ক্ষতি ? আমি তো আছিই । এখন তো আমার স্থায়ী চাকরি।
টিভি চালিয়েও অফ করে দিল। এখন তার নিজের জীবন , হয়তবা গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবন এমন বকবকম শুরু করেছে যে সেটার ভাষা আগে বুঝে টিভির খবরের বকবকানি শোনা ভাল। সংবাদের মূল নির্যাস মোবাইলে পরে দেখে নিলেই হবে।
আনন্দীর মতের সঙ্গে না মিললেও ভাবছিল আনন্দীকে ফোন করে একবার। বউয়ের সঙ্গে হাজার ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও বউ ই প্রধান পরামর্শদাতা যে ! কিন্তু আনন্দীকে ফোনের আগেই নাতাশার ফোন এল। সদ্য সে নাম্বার নিয়েছে আজ। কী হল আবার ?
—-রুদ্র , খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম তো
—-কেন ? কী হল ?
—-খবর দেখনি ?
—-নাহ, কী ব্যাপার বলতো ?
—আজ রাত থেকে ইণ্ডিয়া গর্ভমেন্ট লকডাউন এনাউন্স করেছে। আমি ফিরব কীভাবে ?
—-এইরে, তাই নাকি ? আমারও তো কলকাতায় ফেরার ছিল।
—-আমি যে হোটেলে আছি ওরা ঘর খালি করে দিতে বলছে। এখন যাব কোথায় বলতো ? নাতাশা ভেঙে পড়ে কান্নায়।
—-সেকি !
—হ্যাঁ। কী হবে এবার বলতো ।
—-দাঁড়াও , চিন্তা কোরোনা। আমি দেখছি তোমাকে কোথাও যদি সেট করা যায়
—-কিন্তু কতদিন যে লকডাউন চলবে ! অত টাকাও তো আমার কাছে নেই !
—–আচ্ছা, দেখছি । আমাকে এক ঘন্টা টাইম দাও । আমি বাড়িতে ফোন করে আমার ব্যাপারটা আগে সেটল করি আগে। তুমি চিন্তা কোরো না। দিল্লিতে আমার প্রচুর বন্ধু বান্ধব আছে, কোথাও একটা হয়ে যাবে ।
বিপদে পড়লে রুদ্রর গলা আশ্চর্য রকম শীতল আর আশ্রয়প্রদ হয়ে ওঠে। হয়ত তাতেই আশ্বস্ত হয়ে নাতাশা ফোন রাখল। নাতাশার ফোন রেখে রুদ্র দেখল আনন্দীর তিনটে মিসড কল হয়ে আছে।

লকডাউনের খবরটা শুনে কেমন ভেতরে ভেতরে একটা আনন্দ হল সুহাসের। সে এসি চালিয়ে হাল্কা চাদর নিয়ে কিছুটা ঘুমোলো। এমনিতেই রাত জেগে জেগে কাজ চলছে গত সাতদিন। শেষ রাতে ঘুমোতে যাচ্ছিল। উঠে যেতে হচ্ছিল সকাল নটার মধ্যে। তাই ঘুম কিছুটা জমা ছিলই। সে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমোলো।
যখন উঠল তখন বিকেল। দিল্লির দোয়ারকার এই জায়গাটা খুব শান্ত। এই শান্তির জন্যই এই হাউজিং এ সে এসেই বুক করেছিল। বড় বড় তিনখানা ঘর। দু দুখানা বারান্দা। দুদিকের বারান্দাতেই আবাসনের গাছের হাওয়া উড়িয়ে দেয় এই চারতলায়। সে আর দরিয়া অনেক ঘুরে পছন্দ করে এই ফ্ল্যাট খানা কিনেছে বছর তিনেক হল। তাদের বসার ঘরের বড় দেওয়ালে তার আর দরিয়ার ওয়েল পেন্টিং জুড়ে আছে। মেয়ের ঘরের একটা দেওয়ালে মেয়েকে রং তুলি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কী আশ্চর্য, ভেবেছিল মেয়েটা হিজিবিজি করবে। কিন্তু ফুল পাখি ঘর নদী মিলিয়ে পুরো একটা কম্পোজিশন করে রেখেছে। আজকাল শূন্য ফ্ল্যাটে সে একা প্রায়ই মেয়ের আঁকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মেয়ের ঘরে গিয়ে। আর মেয়ের ঘর ! মাত্র তিন বছরেই যে ঘর তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল ! দরিয়া জানে লকডাউন ? এখনো যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় তার দরিয়ার কথাই মনে পড়ে। মেয়েটা ওর কাছে আছে বলে ? কে জানে ! তবে দরিয়াকে ফোন করতে তার ভাল বা খারাপ কিছুই লাগেনা। তাই যখন মেয়ের সঙ্গে কথা বলার হয় সে ফোন করে। দু একটা কথার বিনিময় হয় অনায়াসে। দরিয়া মেয়েকে ফোন দেয় আর ওই কিছুটা সময়ের জন্য তার ভুবন ভরে ওঠে। সে ভুলে যায় এই প্রায় এগারোশ স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটে সে একা এবং একা। মেয়ের ঘরটা ফাঁকা, একরাশ পুতুল আর টেডি বীয়ার পড়ে আছে শুধু। তার আর দরিয়ার ঘরে এখনো যখন তখন দরিয়ার পারফিউমের গন্ধ ঘুরে বেড়ায়।
সুহাস ফোন খুলে দরিয়ার নম্বর পেল। কিন্তু তারপরই ভাবল দরিয়া এখন আছে হোজাইতে, আসামে। সেখানে দিল্লি শহরের মত আশা করা যায় লকডাউনের এফেক্ট পড়বেনা। দরিয়ার বাড়িতে ওর মা, মামা আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই খাবার দাবার সব স্টক করে রেখেছেন। কদিন ধরেই তো রব উঠছিল লকডাউন হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মাত্র কদিন আগেই হোজাইতে ফিরে গেছেন রুদ্রশঙ্কর, জয়েন করেছেন ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনেছে কাছাকাছিই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে এখন। এই লোকটার জন্যই তাদের বিয়েটা ভেঙে গেল। তবে এ নাকি দরিয়ার খেয়াল রাখে, খুব খেয়াল রাখে তাদের মেয়ে মিট্টিরও। সুহাসের হাসি পেয়ে যায় এসব নানারকম জীবন দেখে। সে দরিয়াকে একটা মেসেজ করল শুধু। সব ঠিক আছে কিনা বোঝার জন্য। তারপর উঁকি দিল নিজের কিচেনে। কী কী আছে দেখা যাক।
দেখা গেল দুরকমের চাল, আর প্রচুর ডাল আছে। সে আলু খায়না। তাই শুধু ডিম আছে। ধুর, এই দিয়ে দিন দুই কেটে যাবে। তারপর অনলাইনে বা অন্যভাবে দেখা যাবে। হ্যাঁ, তেল আছে, ঘী আছে, বাটার আছে। দিল্লিতে পা দেওয়ার পরই তাকে রুদ্রদা শিখিয়েছিল ব্যাচেলার জীবনের আবশ্যিক উপকরণ কী কী ? সুহাস রুদ্রদাকে আদ্যোপান্ত গুরু মানে, সে মনে করে আজ যে তার এই লাখ দুই টাকার মাইনের চাকরি, সেটা শুধু রুদ্রদার গ্রুমিং এর ফল। রুদ্রদা তাকে তৈরি না করলে শুধু ছবি আঁকা শিখে আসামের একটা ছোট্ট জায়গা থেকে এসে দিল্লিতে সে কিচ্ছু করতে পারতনা।
ঘুম ভেঙে উঠে বোঝে বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। মাত্র কদিন আগে অব্দিও দরিয়া ছিল, মিট্টি ছিল। তাদের চারবেলা নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া হত। ছুটির দিনে বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ক্ষিদে পেলে দরিয়া হাল্কা চিঁড়েভাজা বাদাম,চানাচুর দিয়ে মেখে দিত। কিংবা উপমা বানিয়ে দিত। এখন সেসব আর তার জীবনে নেই । সে কিচেনে কিচ্ছু পেলনা। ফ্রিজে পেয়ে গেল ব্রাউন ব্রেড। টোস্টারে ব্রেড বানিয়ে মাখন নিয়ে চা বানিয়ে খেল। নিজেকে বোঝালো এভাবেই ভাল থাকতে হবে। এভাবেই। নাকি কান্না কেঁদে লাভ হবেনা।
টিভি চালিয়ে বুঝল লকডাউনের খবরে ভারতবর্ষ তোলপাড়। সে স্থির হয়ে বসে রইল। তার জীবনে আর নতুন লকডাউন কীসের ? যেদিন ভোরবেলা দরিয়া মিট্টিকে নিয়ে ফ্লাইট ধরল, সে নিজে ড্রাইভ করে ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল, আর ঘুমন্ত মিট্টি ঘুম ভেঙে তার দিকে তাকিয়ে বলল—নেক্সট উইক আসবে বাবা ? সে ঘাড় নাড়ল, সেদিন থেকেই তার জীবনে লকডাউন। যন্ত্রের মত সে অফিস যায় আসে, আর কাজ করে। একমাত্র কাজের সময় সে যন্ত্রের মত থাকতে পারেনা। তার ভিতরের আনন্দ তাকে বাঁচিয়ে রাখে, সে সজীব হয়ে ওঠে। কলিগদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে। আর চোখ আর হাত থাকে কম্পিউটারের মাউসে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই কেটে গেল তার যেন একশ বছর।
নাহ, আজ আর কাজে বসবেনা। অল্প টিভি দেখে রান্না সেরে আবার ঘুমোবে। সব ঘরের লাইট জ্বালিয়ে সে বারান্দায় এসে বসল। সবে সন্ধে হচ্ছে। কিন্তু বাইরের মাঠে বাচ্ছাদের কলরবে ভরে থাকে চারিদিক। আজ কিচ্ছু নেই। কোভিডের ভয়ে বাচ্ছারাও গৃহবন্দী ? ইসস।
চা খাওয়া সেরে কাপটা ধুয়ে রাখতেই রুদ্রদার ফোন
—–তোকে একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিচ্ছি, দিন পনেরর জন্য তোর একটা ঘরে একজনকে রাখতে পারবি ?
—-কে ? কাকে ? কী হয়েছে ?
—–এক মুসলিম ভদ্রমহিলাকে। মুসলিম বললাম বলে কিছু মনে করিস না। আগেই ক্লীয়ার করে রাখলাম।
—-মহিলা ? আমি এখানে একা থাকি আর মহিলাকে কীভাবে রাখব ?
—–আরে, তোর থেকে অন্তত দশ বছরের বড় । আমার বয়সী
—-তাতে কী ? তুমি মাঝে মাঝে কীরকম ছেলেমানুষের মত বল !
—-বুঝেছি, হেসে ফেলে রুদ্র । —দেখি তবে ।
—–রাগ করলে ? দরিয়া জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে।
—-শাল্লা, কবে ডিভোর্স করেছিস, এখনো বউয়ের ভয়ে কাঁপছিস। বল, আমার অসুবিধে আছে, তা না !
সুহাস বোঝে দরিয়ার কথাটা তোলাই এখানে অবান্তর ছিল। ওই যে অফিসের একজন বলেছিল, ডিভোর্সটা সে এখনো রপ্ত করতে পারেনি, ব্যাপারটা তাইই। তার অবচেতনে দরিয়ার ইচ্ছে-অনিচ্ছে-রাগ-ভালবাসা এমন ভাবে বসে আছে, আর সে কিছুই করতে পারবেনা।
—-কিন্তু মহিলা কে ?
—-সে পরে বলব খন। আমার এক বন্ধুর স্ত্রী। লকডাউনে আটকে গেছে বেচারি। রাখছি এখন।
সুহাস কিছুটা সময় ঘুরে বেড়ায় নিজের ফ্ল্যাটে। সত্যিই দিল্লি শহরে সে এতবড় একখানা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে ভাবেনি। বড় বড় তিন খানা ঘর। বড় কিচেন। মডিউলার করে রাখা । সুন্দর বেজ কালার গোটা বাড়িটায়। আর পর্দা গুলো মাল্টিকালারড। বড় দুটো দেওয়াল তাদের পেন্টিং। দরিয়াও অসাধারণ আঁকে। কিন্তু ও কেরিয়ার বেছে নিলনা জীবনে। অথচ সুহাস নিজেই ছিল কেরিয়ার বিমুখ। ভাল করে পড়াশোনা করতনা। সারাদিন শুধু ছবি আঁকত। তারপর আর্ট কলেজ আর পাশ করতেই এক দিল্লির এজেন্সির সন্ধান দিলেন এক স্যর। ততদিনে সহপাঠী দরিয়ার সঙ্গে তার তুমুল প্রেম। তাই ঠিক হল দিল্লি এলে দুজনেই আসবে। একা কেউ না। বাড়িতে বলতেই তাদের বিয়ে দিয়েও দেওয়া হল। মাত্র তেইশ বছর বয়সে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। দিল্লিতে এসে একটা আবাসনের এল আই জি গ্রুপের ছোট্ট ফ্ল্যাটে সংসার শুরু হল। একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা ছিল প্রতিবেশী। তার ওপর জলকষ্ট। কিন্তু তাতেও সে আর দরিয়া সুখে প্রায় চারবছর কাটালো। মিট্টির জন্ম আসামে হতেই সে এখানে রাতারাতি ফ্ল্যাট বুক করল। ছোট্ট মিট্টিকে নিয়ে দরিয়া যখন দোয়ারকার এই ফ্ল্যাটে এসে উঠল তখন সে খুব খুশি ছিল। সেদিনের তার সেই ঝলমলে মুখটা এখনো মনে পড়ে সুহাসের। খুব আনন্দ করে কদিন ছবি আঁকা হল, লাজপত নগরের মার্কেটে গিয়ে ঘুরে ঘুরে পর্দা আর ঘর সাজানোর জিনিস কেনা হল। সব কেমন ছবির মত সুন্দর ছিল। কিন্তু ওই শঙ্কর আসার পরই এলোমেলো হয়ে গেল সব। লোকটা দরিয়ার ছোটবেলার স্যর। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর তিনেকের জন্য পড়াতে এসেছিল। দরিয়া মজে গেল ওতে। আসাম ফিরে যাবার নামে নেচে উঠল। সুহাস তখন মেতে থাকল, মেতেই থাকল নতুন নতুন কাজে, ইন্টারন্যাশনাল ক্লায়েন্টদের তারিফে। এখনো তো তাকে বাঁচিয়ে রাখল কাজই। পত্রিকার পাতা উল্টোতে উল্টোতে হাল্কা ঘুম পেয়ে গেছিল তার। হঠাত দেখল ফোন বাজছে।
—–তুমি গ্রসারি স্টক করেছ ?
—-কে ? দরিয়া ?
—বাব্বা, ফোন নং ভুলে গেছ, গলাটাও ভুলে গেছ।
—নাহ, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । বল। মিট্টি কই ?
—-মিট্টি এখন গান গাইছে। হারমোনিয়াম নিয়ে। নিউজ দেখেছ ? লকডাউন ?
—-হ্যাঁ, দেখলাম তো।
—-এত ক্যাজুয়াল কেন বলতো ? পারলে এখন মার্কেটে গিয়ে গ্রসারি স্টক কর। পাবে কি পাবেনা কেউ জানেনা।
—-দেখছি।
—-বলে দিলাম, নয়ত না খেতে পেয়ে মরবে।
ঠক করে ফোন রেখে দেয় দরিয়া। সন্ধে শেষের কি নিজস্ব কোনো সুর আছে ? কোনো বিশেষ সঙ্গীত ? এত মধুর গানের আওয়াজ ভেসে আসছে কীভাবে ? কোথা থেকে ? সুহাস উঠে টিশার্ট গলায়। নাহ, পাড়ার ফুড মার্টে দেখে আসা উচিত একবার।

——–উপল, তোর বাড়ির চিত্রটা কী রে এখন ?
—-বাড়ির চিত্র মানে ? ওই আগের মতই। দোতলা-একতলা। হিহি।
—-মানে , বউ একতলায় ?
—–বউ আবার কই ? সোহিনী বল। শুনতে বেটার লাগবে ।
—–ওহ, মানে তোরা অফিসিয়ালি ডিভোর্সড ? কবে হল ?
—-গত মাসে দাদা। কিন্তু এ তো যাবে যাবে করে আজও কলকাতা ফিরলনা। এখন দেখ লকডাউন হল। কবে যে ফিরতে পারবে । আমার হাল খারাপ।
—-বুঝেছি, শোন, আমার এক পরিচিত মহিলা খুব বিপদে পড়েছে। ওকে কটা দিন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সোহিনী কি রাজি হবে ? ওর সঙ্গে ? তোদের একতলাটা তো অনেক বড়।
—-তুমি পাগল ? ঐ মা মণসাকে বলবে কে ? একতলায় তো তিন খানা ঘর। তাইই তো ওকে ছেড়ে দিয়েছি। আমি তো দোতলার এই একখানা ঘরে। কিন্তু কেসটা কী ? মহিলাটা কে ? তুমি তো এলোমেলো কারোর জন্য বলবেনা !
—-নাহ, বিপদে পড়েছে রে একজন। আমার এক বন্ধুর বউ। ঠিক আছে দেখছি, অন্য কোথাও। তুই চাপ নিসনা। তবে কোনো অপশন ওপেন হলে জানাস।
রুদ্র ফোন রেখে দিয়ে ভাবে। প্রায় রাত নটা। নাতাশাকে বলেছে প্যাকিং করে নিতে। সে দশটার মধ্যেই যাবে। কিন্তু রাখবে কোথায় ? তার কাছে একমাত্র অপশন তার নিজের এই ফ্ল্যাট। কিন্তু এই ব্যবস্থার অসুবিধে আর ঝুঁকি, আনন্দীর সঙ্গে সারাজীবনের মত ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা —সে ঠিক বুঝতে পারছেনা কী করবে ?
এই রাত নটাতেই আনন্দী এসে পৌঁছল তাদের কলকাতার বাড়ি। পাড়ার মায়ের বাড়ি থেকে বুমকে নিয়ে যখন দরজা খুলল ফ্ল্যাটের তখন ঠিক নটা কুড়ি। চারিদিক কি আজ একটু বেশি স্তব্ধ ? বুম অবশ্য আপনমনে খেলছে। ওর কোনো মাথাব্যথাই নেই যে মা কতবড় টেনশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আনন্দীর একা একাই মনে মনে রাগ হয়ে গেল। সে রুদ্রকে বারবার বলেছিল—এবারে চারিদিকে কীসব গ্ণডগোল চলছে। আমেরিকায় লকডাউন হতে পারে। এখন দিল্লি যেওনা। কিন্তু রুদ্র কাজের নামে এমন করতে থাকে আর মাঝেমাঝেই ভাবে আনন্দী একজন মূর্তিমতী বিঘ্নকারিণী, তাই দু এক কথায় ঝগড়া হবার উপক্রম হলে সে আর কিছু বলেনা। এখন লকডাউনে আটকে থাকো দিল্লিতে, ব্যস।
হাত পা ধুয়ে তার অভ্যাস হচ্ছে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ানোর। আজ সে একটা পেস্তা রং এর তাঁতের শাড়ি আর গোলাপী ব্লাউজ পরেছিল। সে লম্বা , কিন্তু দোহারাও। তবু সবাই বলে শাড়ি পরলে তাকে ভাল লাগে দেখতে। দোলের আগে চুল স্টেপ কাট করেছিল। এখন অল্প ঘেমে সামনের কুঁচি চুলগুলো নেমে এসেছে। চোখের কাজলটাও লেপ্টে গেছে। লিপ্সটিকও প্রায় নেই। তাকে কি খুব খারাপ লাগছে দেখতে ? রুদ্র তো তাকে খুব সুন্দর বলে, গর্জিয়াস বলে । কিন্তু ইন্দ্রনাথ ? সে ও কি ভাবে ? ইন্দ্রদা তার দিকে তাকায় আবার যেন তাকায়না। কী এক রহস্য আছে তার তাকানোতে, দীপ্তিকে গ্রহণ করতে ? তবে কি দীপ্তি এতদিন শুধু একটা ভুল ধারণায় বাঁচছে ?
বাড়ির পোশাক পরে ফ্রিজ থেকে বার করে চিকেন স্টু। সকালের হাতে গড়া রুটি আছে। একবার ভাবে বুমকে অল্প বাটার লাগিয়ে গরম করে দেবে। তারপর ভাবে খাওয়াটা খুব বোরিং হয়ে যাবে। আরও মনখারাপ লাগবে তার নিজের। বুম হয়ত খেয়ে নেবে। তার বাড়িতে এক গোপাল ঠাকুর আছে। তার দিদিমার কাছে পাওয়া। ইন্দ্রদা একবার সেটা দেখে হাসতে হাসতে বলেছিল—এই গোপালদা আবার এখানে কেন ? এইতো দিদিমণি সারাদিন এত বিপ্লবের বাণী দেন , তবে এঁকে পুজো কেন ?
সে অবশ্য ঝটপট উত্তর দিয়েছিল—উনি আমার ফ্যামিলি মেম্বর। ভারতবর্ষের প্রথম বিপ্লবী।
ইন্দ্রদা হেসে তার মুখের দিকে গভীর তাকিয়ে বলেছিল– দিদিমণির যুক্তি এক্কেবারে রেডি।
এসব সময়ে সে গলে যেত। এই সুপুরুষ লোকটাকে মনে হত তার একার। এই সম্পর্কে শরীর তুচ্ছ , আসলে ছিল স্নেহ আর ভালবাসা, শ্রদ্ধা। তার মনে হত এই লোকটা তার কথা দিয়ে তাকে বিচার করেনা। তার ভেতরের নিবেদিত শক্তিকে বুঝতে পারে। সব যুক্তির পরও যে আসলে একজন সাবমিসিভ মানুষ সেটা বোধহয় একজনই বুঝতে পারে।
এখন বুমের হাতে মোবাইলটা খেলতে দিয়ে সে ফ্রিজ থেকে ব্রাউন ব্রেড বার করে। চিকেন স্টুর চিকেন আর সব্জি দিয়ে আর বাটার মেয়োনিজ লাগিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে গ্রীল করে। ব্যস, মা আর ছেলে দুজনেই খুশি। বুম আবার খেতে খেতে বলে—এর সঙ্গে ফিঙ্গার চিপস আর কোল্ড ড্রিংক হলে একেবারে দোকানের মত লাগত মা !
—-ইসস, ছেলের কী তরিবত ! খা, যা দিয়েছি ।পাজি কোথাকার।
খাওয়াদাওয়া হলে রোজই ছেলের সঙ্গে খুনসুটি চলে। যেকোনো একটা বিষয় নিয়ে ছেলেকে রাগিয়ে দিলেই হল। মায়ের সঙ্গে খানিক তর্ক, মাকেও উলটে রাগানো চলবে। তারপর মা কে জড়িয়ে ধরে শেষ হবে –আমার সোনা মা, আমার সোনামায়ের মত আর কেউ হয়না !
আনন্দী প্রায়ই রাতে শুতে যাবার আগে ভাবে, রুদ্র আছে কীভাবে ছেলেকে ছেড়ে ? থাকে কীভাবে ? এখন রাত প্রায় এগারোটা। একবার কি ফোন করবে ? রুদ্রকে ? থাক। যা বলার তো বলেইছে সন্ধেতে। আর লাভ নেই। ও আসতে পারবেনা এখন কলকাতায়। অন্তত পনের দিন অপেক্ষা করতেই হবে। নিশ্চয়ই তার মধ্যে উঠে যাবে লকডাউন।
রুদ্র তখন দিল্লির ফ্ল্যাটে রান্নাঘরে গিয়ে ওমলেট বানাচ্ছে। আজ ব্রেড আর ওমলেট দিয়েই ডিনার সারতে হবে। আজ ডিনার বাইরে থেকে অর্ডার করার মত পরিস্থিতিও নেই গোটা দেশে। তবে অনলাইনে গ্রসারি সে অর্ডার করে আনিয়ে ফেলেছে। কাল সেসব প্যাকেট খুলে দেখা যাবে।
বাইরের ঘরে টিভি চালিয়ে নাতাশা বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সে পড়বে ভাবেইনি। রুদ্রও খুব অস্বস্তিতে আছে। শুধু ভাবছে এই কদিন আনন্দী একটু কম ফোন করলেই ভাল। সে নাতাশার সঙ্গে যে কোনো সম্পর্কেই যুক্ত নেই, হতে চায়ওনা সেটা সে বোঝাতেই পারবেনা। আনন্দী ভুল বুঝবে, আঘাত পাবে। একটা কেলেংকারি হবে । যদিও আনন্দীর জীবনে কেউ কেউ আছে বলেই সে জানে, কিন্তু তার জীবনে আনন্দী অপরিহার্য ভাবে একা। সে দুদিক ব্যালেন্স করতে পারেনা। পারেনা বলেই সে কাজ আর বউ –এই দুদিকও ব্যালেন্স করতে পারেনি। বেছে নিয়েছে কাজকে। আনন্দীর জীবনে অবশ্যম্ভাবীভাবে নেমেছে শূন্যতা। সে নিজের মত জীবন সাজিয়ে নিয়েছে। কিন্তু রুদ্র নিজের কাছে, আনন্দীর কাছে যুক্তি দিয়েছে সবসময় তার কর্মব্যস্ততার ফল তার সংসার পায়। পাবেও। তাই কোনো অপরাধবোধ তাকে কাবু করতে পারেনি। কিন্তু অন্য মহিলার ব্যাপারটা আনন্দী মেনে নেবেনা। তাও যদি সত্যি কিছু হত ! পুরোটাই পরোপকার মাত্র।

জীবন এত অদ্ভুত একটা টেক্সট কেন, যাকে বারবার পড়েও শেষ করা যায়না ! আনন্দীর এখন ছুটি আর ছুটি। সারাদিন সে ভাবছে আজকাল নিজের জীবনের কথা। তার সঙ্গে রুদ্রর আলাপটা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। সিনেমার স্ক্রিপ্টের মত করে। সেইসব চমক জীবন তার জন্য তুলে রেখেছিল। এই লকডাউনে তার কলেজ বন্ধ হয়ে গেল, কোচিং সেন্টারও। সে তাই সময় পাচ্ছে, সারাদিন হাবিজাবি ভাবছে।
তার ডেইলি রুটিনটা এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সে হঠাত করে যেন একটা অনাকাঙ্খিত ছুটিতে ঢুকে গেছে। সব কাজ থেকে তার সাসপেনশন হয়ে গেছে। রুদ্রর দিল্লি থাকার ফলে সে তার সব শূন্যতা একসময় ভরিয়ে নিয়েছিল কাজ দিয়ে , ছেলেকে দিয়ে। তারপরও কি কম একাকীত্ব পড়ে ছিল ? ইন্দ্রনাথ জীবনে আসার পরে কিছুটা কমেছে, কিছুটা আবার বেড়েছেও।
অথচ রুদ্রর সঙ্গে শুরুটা ছিল সিনেমার মত, উপন্যাসের মত। কিন্তু সিনেমাটা যে কখন টেলিসোপ সিরিয়ালের মত একঘেয়ে হয়ে গেল কিংবা উপন্যাসের লেখক যে কখন বদলে কাহিনির টানটান ঘটনার বদলে তাদের দুজনকে দুটো ভিন্ন ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন তা কে জানে ! এই কদিন ধরে আনন্দী সেসব ভাবছে। আজকাল তার সাতভোরে ওঠা নেই আর ! ছেলের স্কুলের গাড়ি চলে আসবে সকাল ছটায়। তাই ভোর পাঁচটা থেকে উঠে আর দৌড়াদৌড়ি নেই। সে ভোরে উঠে আজকাল গান শুনছে, তারপর কিচেনে ঢুকে বাসন ধুয়ে রান্নাঘর আর গোটা ফ্ল্যাট মুছে নিচ্ছে। লোকাল ট্রেন সব বন্ধ। তাই কাজের দিদি আসছেনা। সে নিজেকে বোঝাচ্ছে এইভাবে ঝট করে সে রোগা হয়ে যেতে পারবে। তার বারো বছরের ছেলেও ওয়াইপার দিয়ে তার ঘর মুছে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। আর ব্রেকফাস্টে রোজ নানারকম স্যান্ডুইচ বানাচ্ছে। আর রোজই লাঞ্চ আর ডিনারে চিকেন পোলাও বা চিকেন বিরিয়ানি। একরকম ভাবে সে ভাল লাগাচ্ছে ব্যাপারটা। যেকোনো পরিস্থিতিকে আনন্দ করে সে মেনে নিতে চায়। ছেলেটা সারাদিন গা ঘেঁষে লেপ্টে থাকছে, কত স্কুলের গল্প করছে , তাতেই সে অবাক হয়ে যাচ্ছে। এতদিন তো ছেলে এত কথা বলতনা ! তবে কি বাবাকে প্রায় না পাওয়া আর মাকেও ব্যস্ত দেখে ও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল !
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সে একবার করে ফোন করে রুদ্রকে। আবার রাতে। রাতে রুদ্র নিজেই তাকে ফোন করে। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে। তার রুদ্রর ওপর রাগ আর অভিমান দুইই হয়ে আছে খুব। কিন্তু সে জানে এসব রুদ্রকে বলে কোনো লাভ নেই। রুদ্র কাজ কাজ আর কাজ ইত্যাদি বলে তার কোনো ইমোশনকেই পাত্তা দেবেনা । গোটা পৃথিবী থেমে আছে, এইসময় একা থাকা খুব চাপ হয়ে যাচ্ছে। মনের কোণে যে ভয়টা তার সবসময় লেগে আছে তা হল রুদ্রর র যদি কোভিড হয় ! তা হলে সে তো যেতেও পারবে না ! রুদ্রর ঠান্ডা লেগে যাবার ধাত আছে। তাছাড়া ওখানেও কাজের লোকেরা আসতে পারছেনা। সব কাজ সে একাই করছে। কালকাজীর ঐ অতবড় ফ্ল্যাট , সব ক্লীন রাখতে হচ্ছে। রুদ্র বাইরের খাবার খেতে চায়না, তাই নিজে গভীর রাতে ফিরলেও রাইস কুকারে সেদ্ধ ভাত করে বা খিচুড়ি। রুদ্রর আজকের সফল জীবনের চাপ আর তার পুরনো জীবনের অভ্যাসের তেমন মিল নেই। সে পুরনো লাইফ স্টাইল দিয়ে একটা নতুন জীবনকে সামলাচ্ছে। সে খেতে চায় ভাত ডালসেদ্ধ কিংবা বড়া দিয়ে মোচার ঘন্ট, শিষ পালং এর চচ্চড়ি কিন্তু দিনে আঠারো ঘন্টা কাজ করে ক্লায়েন্টদের প্রেশার সামলায় । আনন্দী বুঝতে পারছে লকডাউনে সমস্যাটা আরও বেড়ে উঠেছে। রুদ্র রান্না , ঘরের কাজ সামলাচ্ছে আবার প্রায় সারাদিন অফিসের কাজে তাকে কম্পিউটারের সামনে বসতেই হচ্ছে। রান্না কাজ সামলে সে কীভাবে কী খাচ্ছে আনন্দী জানেনা। অথচ জিজ্ঞেস করলে কিছুই স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেনা, সব ভাসা ভাসা দিচ্ছে।
ফোনটা প্রথমবার বেজে গেল। আনন্দীর টেনশন হয় একবার না পেলেই। মিনিট দশেক পরে রুদ্র ফোন করল।
—-বল।
—-কী করছিলে ? খেয়েছ ?
—-হ্যাঁরে বাবা, এত জিজ্ঞেস কেন কর দুবেলা ? বাড়িতে সব খাবার আছে, আমি সব খাই।
—- কী খেলে সেটা তো বল
—-খিচুড়ি, ওমলেট।
—-রাতেও তাই ?
—–আবার কী ? রাখ এখন। ক্লায়েন্ট ফোন করছে।
—-উফফ, ওদিকে বাসনের আওয়াজ আসছে। কেউ এসেছে নাকি ফ্ল্যাটে ?
—–আরে না ! লকডাউনে কে আসবে ? আমাদের বাড়ির না, পাশের ভাবীর কিচেনের ।
আনন্দী ফোন রেখে দিয়ে ছেলেকে বলে যায়—সারাদুপুর মোবাইলে গেম খেলবেনা। স্টোরি বুকটা পড়বে কিন্তু।
ছেলে মাকে চটায়না। ভাল ছেলের মত ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে বলে—তুমি শুতে যাও না !
আনন্দী আবারও বলে— গ্যাস জ্বালাবেনা। ক্ষিদে পেলে ফ্রুটস খাবে। আমি একটু পরে উঠিয়ে কিছু বানিয়ে দেব।
সংসার এরকমই। সবাইকে নিয়ে এত চিন্তা , এত পিছুটান ! তারমধ্যেই নিজের ভেতরের বাচ্ছা মেয়েটাও হাঁকুপাঁকু করে তাকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে সময় দেবার কেউ নেই। সেই একলা মেয়েটা আজ পনের বছর ধরে কাঁদে একা একা। কেউ কেউ আসে তার জীবনে অস্থায়ী এক একটা নৌকো নিয়ে, আবার চলে যায় । আনন্দীর একা হলেই আজকাল অভিমান হয়, কার ওপর হয় সে জানেনা।
আনন্দীর ঘুম আসেনা। তার মনে পড়তে থাকে রুদ্রর সঙ্গে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার গল্প। এক নামী প্রাইভেট স্কুলে জয়েন করেছিল সে তখন সদ্য। খুব ইচ্ছা ছিল সিরিয়াল বা সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখবে। কিন্তু নতুন চাকরি সামলে সেসব কিছুই হচ্ছেনা। একদিন গড়িয়াহাটের অটো স্ট্যান্ডে বিতস্তার সঙ্গে দেখা। ও এক্টিং করে। ওকেই দুম করে বলে দীপ্তি, আমি স্ক্রিপ্ট লিখব। কার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় বলতো ? বিতস্তা তখন বলে— দাঁড়া , আমি জেনে বলব। আমি নিজেও ওই পার্টটা ভাল জানিনা। তোর ফোন নং দে।
তখন তো সব ল্যান্ড লাইন। আনন্দী দিয়েছিল। ঠিক পরেরদিন রাতে ফোন এল। বিতস্তা জানালো—আজই এক দাদার সঙ্গে আলাপ হল। সে টেলিফিল্মের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার খুঁজছে। তুই ওর নংটা লিখে নে। ওকেও দিয়েছি তোর ফোন নম্বর।
আনন্দী অবশ্য ইতস্তত করছিল। একেবারে অচেনা কাউকে নিজের ব্যাপারে বলার অস্বস্তি। সে ভাল ছাত্রী। সে চিরকালের ভাল ছাত্রী। এম। এ পাশ করেই এই ভাল প্রাইভেট স্কুলে ভাল স্যালারির চাকরি পেয়ে গেছে। সে শখে লিখতে চায়। তাই যাকেতাকে এপ্রোচ করার ব্যাপারে তার খুব অস্বস্তি।
তবু সে ফোনটা করেছিল। পরেরদিন। রুদ্রর গলায় অবশ্য একটা এমন আন্তরিকতা ছিল সে অস্বস্তি থেকে সরে এসে বলেছিল সে ঠিক কী চায়। রুদ্র বলেছিল দেখা করতে। অনেক কিছু আলোচনার থাকে। সব কথা তো ফোনে হবেনা !
দুদিন পরই রবিবার। ঠিক হল সেদিন সে যাবে রুদ্রর ডেরায়। রুদ্র জানালো এক প্রোডিউসারের বাড়িই সে থাকে আপাতত। সেখানেই আসুক সে।
দুদিন আনন্দী ভেবেছিল। একা যাবে ? সে হয়না। দূর! এসব সিনেমা জগতের লোকজন মোটেই ভাল হয়না। সে চয়নিকাকে ফোন করল। তার খুব ভাল বন্ধু। তার অনেক কাজ, ভুল কাজের সাক্ষীও। চয়নিকা তখন পিএইচডি করছে। এক কথায় বলল—চল, জায়গাটা কোথায় ?
—-দমদম।
—ওহ, তবে তো মেট্রোতে যেতে হবে। দুপুর একটার আগে মেট্রো চলবেনা। বিকেলে বলেছিস তো ?
—-হ্যাঁ, উনি নিজেই সেটা বলেছেন। মেট্রোতে আসবেন তো। তিনটের দিকে আসুন।
তখন বন্ধুরা তারা ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। কারোর স্কলারশিপের টাকা, কারোর টিউশান, আর সে তো তখন মাস মাইনের শিক্ষক। টাকা জমানোর মত আজগুবি ব্যাপার তাদের কল্পনাতেই ছিলনা। আনন্দী একা একাই হাসে। তার বন্ধুরাও ছিল ঠিক তার মত। জীবনটাকে লুটেপুটে খেয়ে নেবার মত !
সেদিন চয়নিকা যখন তাদের যাদবপুরের ফ্ল্যাটে এসে দেখল সে শাড়ি পরছে অবাক হয়ে মা আর বোনের কান বাঁচিয়ে বলল— একিরে, তোর কি স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে অন্য মতলব আছে ? এত সাজছিস কেন ?
সে হেসে ফেলে—তারপর লাজুক হেসে বলে—ধুর তোর অন্য কিছু। রোজ স্কুলে শাড়ি পরতে পরতে একটাও ভাল সালোয়ার পাচ্ছিনা। কুর্তি আছে তো সালোয়ার কোথায় কে জানে। আর ওসব পেলেও ম্যাচিং ওড়না পাচ্ছিনা। অথচ এদিকে একগাদা শাড়ি সব কাচানো রেডি। ব্লাউজ অব্দি ইস্ত্রি করা।
সে একটা ভেজিটেবিল ডাই ইন্ডিগো সুতির শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরল। কানে ছোট দুটো সোনার দুল। হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক। এইই তো ছিল সেই বয়সের সাজ। তারপর দুই বন্ধু মিলে ট্যাক্সি করে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন। তখনো নাম বদলায়নি। এদিকের লাস্ট স্টেশন ওটাই ছিল। দুজনে দমদমে নেমে রুদ্র নামের ছেলেটির কথামত ফোন করল স্টেশনের বুথ থেকে। ছেলেটা তাকে ডিরেকশন দিল। তাকে বলল তারা যেন রিক্স করে আসে বেদিয়াপাড়ার দিকে। সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আনন্দী অবাক হয়ে বলেছিল—কিন্তু আমাদের চিনবেন কীভাবে ? ছেলেটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হেসে বলেছিল—আমি চিনে নেবো। তারা ফোন রেখে হাসাহাসি করছিল—কীভাবে চিনবে রে ? চয়নিকা ফিচেল হাসি হেসে বলেছিল—যেন রাধাকেষ্ট কেস। দেখিলেই চিনিয়া লইবে।
তাদের দুই বন্ধুর প্ল্যান ছিল এখানে কাজ সেরেই যাদবপুরে ক্যাম্পাসে ফিরে আড্ডা দেওয়া। সবাই কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আজকাল তো আড্ডাই হয়না।
সত্যিই রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল। একটা লম্বা ,উস্কো খুস্কো চুল উজ্জ্বল চোখের ছেলে। তারও দূর থেকে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মনে হচ্ছিল এইই হবে। আর ছেলেটাও তাদের রিক্স দেখামাত্রই থামালো। সেদিন রুদ্রর ঘরে স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলা থেকে আন্তর্জাতিক সব ফিল্মের কথা বলল, আর্ট ফিল্ম –কমার্শিয়াল ফিল্ম নিয়ে তর্ক করল তারপর প্রায় রাত আটটায় উঠল যখন বুঝল এবার বারি না ফিরলে দুজনেই বাড়িতে বকুনি খাবে। তখন মোবাইলের যুগ ছিলনা, বাবা মায়ের টেলিপ্যাথিতেই তারা বকুনি, দুশ্চিন্তা টের পেত। কিন্তু রুদ্র যেন আরও কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেই চাইছিল। ফিল্ম ডিরেক্টর বলতে যে ভারিক্কি মানুষ তারা ভেবেছিল, নিদেনপক্ষে ওভারস্মার্ট কাউকে, এ ছেলেটা সেরকম তো নয়ই, বরং অত্যধিক সরল একজন। ছেলেটার সারল্য দেখে আনন্দীর তখনই মনে হতে শুরু করছিল এই ফিল্মের বাজারে এ কীভাবে কাজ করে ?
বাইরে বেরিয়ে চয়নিকা ফিসফিস করে বলেছিল—পাঁচ ঘন্টার ওপর বসে ছিলাম। এক কাপ চাও খাওয়ালো না । উফফ। আনন্দীরও মনে হচ্ছিল—ছেলেটার কী একটা অসুবিধা আছে যেন ওই বাড়িটায়। সে হ্যাপী না। প্রোডিউসারের বাড়ি বলতে যেরকম মনে হয় সেসব কিছুই তো না। সাধারণ আটপৌরে একটা বাড়ি, তার অতি সাধারণ ঘর। সত্যিই তো, চা দিলনা কেন ?
সেদিন আনন্দীকে বিতস্তা রাতে ফোন করে জানতে চেয়েছিল—কাজ হল ? সে মাথা হেলিয়ে বলেছিল—হল। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে খুব অদ্ভুত লাগল, জানিস ? চাল চুলোহীন দরিদ্র একটা ছাপ চেহারায়, গোটা ঘরেও। কিন্তু কী আশ্চর্য স্বপ্নালু চোখ, কী পজিটিভ এনার্জি। হয়ত এ আমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভালো কাজ করতে পারবে ।

নাতাশা বেশ ভোরে উঠে দ্রুত হাতে সেরে রাখছে সব কাজ। রুদ্রর উঠতে বেলা হয়ে যাচ্ছে। গত তিনদিন ধরেই সে দেখছে নাতাশা ভোরে উঠে ঘর পরিষ্কার করে সব গুছিয়ে নিজে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তার নাকি সকাল নটার মধ্যে দুবার চা খাওয়াও হয়ে যায়। রুদ্র তাকে বারবার অনুরোধ করেছে এভাবে সব কাজ একা না সেরে ফেলতে বরং নিজের নাস্তাটা করে রাখতে। কিন্তু নাতাশা রাজি হয়না। রুদ্রর প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে খুব আকুল করে রাখে সেটা বুঝতে পারছে রুদ্র। নাতাশা বাড়িতে জানিয়েছে রুদ্র তার এক বান্ধবীর বাড়ি তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা। কিন্তু খবর পাওয়া গেছে ঢাকার জন্য স্পেশাল বিমান ছাড়বে এরমধ্যে।
রুদ্র প্রথম দুদিন খুব অস্বস্তিতে ছিল। এতবছর সে একা আছে, এখন কোনো ছেলে বন্ধু আসলেও সে বিরক্ত হয় আর অস্বস্তিতে থাকে। সেখানে এ এক যৌবনবতী নারী তায় নাতাশা মারাত্মক সুন্দরী। কিন্তু প্রায় সাতদিন থাকার পর রুদ্রর অস্বস্তিটা চলে গেল। এই মেয়ে যেন তার দিদিদের মত। সাজগোজ করে ঠিকই, কিন্তু নিপুণ সংসারী টাইপ। রুদ্রকে সে আন্তরিক ভাবে যত্ন করে সাজিয়ে খেতে দিচ্ছে। তার সুবিধে হবার মত করে নিজেকে খুব সরিয়ে আলগোছে থাকছে। রুদ্রও মনে মনে কৃতজ্ঞ হল। দু একদিন রাতে খাবার টেবিলে তাদের মধ্যে অনেক গল্প হল। নাতাশাদের দেশের গল্প, নাতাশার ছোটবেলার গল্প। রুদ্রও তার ছোটবেলার গল্প বলল। আনন্দী আর বুমের গল্পও বলল। নাতাশা মনে মনে ভাবল এই ছেলেটা এতটাই প্রতিষ্ঠিত এখন যে বন্ধুমহলে রীতিমত ঈর্ষার সঙ্গে তার প্রসঙ্গ আলোচনা হয়। কিন্তু ছেলেটা যে এত সিম্পল একটা লাইফে থাকে কে বুঝবে ! তাছাড়া সে যে ভেতর বাইরে এত ভদ্র তাইই বা কে বিশ্বাস করবে ! এতদিন ধরে সে একটা অচেনা পুরুষের সঙ্গে আছে তার বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হচ্ছেনা। সে অবাক হয়ে দেখছে রুদ্র একটা এতবড় দামী ফ্ল্যাট নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজের বড় ঘরটায় সে মেঝেতে বিছানা করে শোয়। সেখানে একটা ম্যাট্রেস ছাড়া কিছহু নেই। ম্যাট্রেসের পাশে একটা মাদুরে সে নিয়মিত প্রাণায়াম করে, যোগ ব্যায়াম করে প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে। সে নিরামিষ খায়। খুব বেশি হলে ডিম বা ওমলেট। অধিকাংশ দিন রাতে সে ফল খায়। তার কাজ ছাড়া বাকি জীবনটা অত্যন্ত সরল। এতটাই সরল যে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায়না। নাতাশা খুব নিশ্চিন্তি আর আরাম টের পাচ্ছে , টের পাচ্ছে এই গোটা পৃথিবী সত্যিই কুটুম্ব।
রুদ্র টিভিটা প্রায় চালাতই না। সময়ই পেতনা। এখন দুবেলা টিভি দেখে। আনন্দী নানা সংবাদ দেয়। লকডাউন নিয়ে। সে রীতিমত ট্রমায় আছে। খবরে নাকি দেখাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকেরা দিল্লি মুম্বই থেকে ট্রেন বন্ধ বলে হেঁটে ফিরছে।
নাতাশাও এসব সংবাদে উদ্বিগ্ন হচ্ছে। সে তাও অবাক হয়ে জানতে চাইছে —পরিযায়ী শ্রমিক মানে কী ?
রুদ্র বুঝিয়ে দিচ্ছে। নানা খবরের মধ্যে এটা জানা যাচ্ছে যে কিছু ফ্লাইট চলবে। রুদ্র আগ্রহ নিয়ে পাত্তা লাগাচ্ছে এবং ঠিক দিন তিনেকে মধ্যেই নাতাশার জন্য একটা ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের মধ্যে এখন কোনো ফ্লাইট চলবেনা। স্পেশাল ট্রেনে ওঠার প্রশ্নই নেই। স্টেশনের মারাত্মক ভিড় দেখেই তার শরীর খারাপ লাগছে। আনন্দীও তার জন্য প্রতীক্ষায় পাগল হয়ে আছে, কিন্তু সে অব্দি স্পেশাল ট্রেনে কিছুতেই আসতে দেবেনা।
তবে এত সংকট, এত ভয়, এত কান্নার মধ্যেও রুদ্র শুধু ভাবছে, জীবনে ভালো কিছুই হবে। সবকিছু ওলট পালোট হচ্ছে ভালো কিছুর জন্যে।

নাতাশা ফিরে যেতে পারলে রুদ্র খুব স্বস্তি বোধ করছে। নাতাশা অনেক কিছু ফেলে গেছে। তার সাজগোজের কিছু জিনিস, একটা হিজাব আর ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগ। সে এত টেনসড ছিল যা পেরেছে গুছিয়ে নিয়েছে। রুদ্র নাতাশা যে ঘরে ছিল সেখানে ঢুকে ওর সব জিনিস একটা প্যাকেট করে নিয়ে বাইরের ডস্টবিনে ফেলে এসেছে। এই কদিন সে খুব টেনশনে ছিল। যদি আনন্দী কোনোভাবে টের পায়, বাড়িতে একজন মহিলা আছে কী করবে সে কে জানে !
যদিও আনন্দীর একাধিক পুরুষ বন্ধু আছে , বিশেষ বন্ধুও এসেছে আনন্দীর জীবনে একাধিকবার এবং তাদের সবাইকে সে গ্রহণও করে নিয়েছে একপ্রকার, হাসিমুখেই কিন্তু আনন্দী তার কোনো নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা মেনে নেবেনা। এসব জুলুম আনন্দীই পারে। কিংবা রুদ্র হয়ত বিয়ের পর থেকেই অত্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় সেও কোথায় অপরাধবোধে ভোগে। আনন্দী যেভাবে বন্ধু নিয়ে হৈ হৈ করে বাঁচতে চায়, সেটা পূরণ করা তো সত্যিই তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে নাতাশার নিরামিষ কেসটা জেনে ফেললে খুব ঝুট ঝামেলা হত দূর থেকেই। মহামারীর দাপটের সঙ্গে আর এসব এখন নিতে পারতনা রুদ্র।
বিকেলে উপল ফোন করলে তারা এই নিয়ে খানিক হাসাহাসি করল। উপল তাও ফিচেল হেসে জানতে চাইল—রুদ্রদা, আমাকে সত্যি বোলো, তোমার অন্য কিছু ইচ্ছে হয়নি ? বললে যে খুব সুন্দরী উনি।
রুদ্র হাসতে হাসতে বলল—কিচ্ছু ইচ্ছে হয়নি রে। মেয়েটা সুন্দর ঠিকই, কিন্তু এত মা মা দিদি দিদি টাইপ যে ওরকম ইচ্ছেই হয়না। মুসলিম মেয়ে কিন্তু আমাদের হিন্দু ঘরের ‘ লক্ষ্মী প্রতিমা ’ টাইপ। এই সাত আটদিনে আমাকে এত যত্ন করেছে ! সবাইকে দেখেকি ওরকম ইচ্ছে হয় ?
—-আর যদি হত ? তবে কী করতে ?
—তবে থাকাটা খুব চাপ হত। কিন্তু কিছু করতাম না সেটা নিশ্চিত। ও এমন বিপদে আশ্রয় নিল আর আমি তার এডভ্যান্টেজ নেবো ?
উপল উদাস হেসে বলল— কিন্তু বাইরের কেউ বিশ্বাস করবে বল ? সবাই এসব ক্ষেত্রে একরকম ভাবে। তুমি লাকি, বৌদি তোমাকে ভুল বোঝেনা। আমার বউ তো শুধু ভুল সন্দেহ করে একটা রিলেশান ভেঙ্গে দিল।
—নারে, এটা শুনলে ভুলই বুঝবে। এতটা নিতে পারবেনা। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলনা। নাতাশা যখন কাঁদছিল তখন আমার একটা ধিক্কার আসছিল মনে । শুধু মেয়ে বলে আমি তাকে সাহায্য করতে পারবোনা ? ওর তো জেনুইন সাহায্য দরকার।
—তোমার এই সাহসটার জন্যই তুমি সাকসেস পেয়েছ রুদ্রদা।
সাফল্য ? কেজানে ! সাফল্য মানে যদি হয় দায়িত্ব নেওয়া তবে তাইই। রুদ্র ফোন রেখে আবার ব্যস্ত হয়ে যায় মেশিনে। গত এক মাসে তার প্রায় খান ছয় কাজ শুরু হয়ে সব থেমে আছে। অথচ তার ওপর নির্ভর করে আছে প্রায় পনেরটা ফ্যামিলি। যা টাকা আছে সে তাতে আগামী দুমাস সবার মাইনে দিয়ে দেবে। কিন্তু কাজ থেমে গেলে সব থেমে যাবে। সে চঞ্চল হয়ে নিজের পেন্ডিং সব কাজ সেরে রাখছে। অফিস বন্ধ। তার ডিজনাইনাররা অফিসে আসছেনা বলে বা চারিপাশের পরিস্থিতির জন্যই হয়ত মোটিভেশন হারিয়ে ফেলেছে। তারা প্রায় কাজ মুলতুবিই রেখেছে। তাদের সব কাজ সারছে রুদ্র। তার কাউকে কিচ্ছু অভিযোগ করার নেই, কারোর থেকে কিচ্ছু আশা করার নেই সে শুধু জানে তাকে নিজের কাজ করে যেতে হবে। সে কাজ ছাড়া অন্য কোনো ভাবে কমিউনিকেট করতে পারেনা। গোটা বিশ্ব তাকে আজ বাধা দিলেও সে সেই বাধা ঝেড়ে ফেলবে।
আনন্দী তাকে সময় মেপে তিনবার ফোন করে। তিনবারের ফোনেই মূল কথা হচ্ছে তুমি বাড়ি কীভাবে ফেরা যায় ভাবো। অনেকেই নাকি গাড়ি ভাড়া করে পুলিশের পারমিশান নিয়ে ফিরছে। সেও যদি সেরকম কিছু করে। রুদ্র কখনো হেসে, কখনো রেগে আনন্দীকে বোঝায়। সে রোজ =ই হাসতে হাসতে বলে— আমার কোভিড হবেনা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আর আজকাল সে স্পষ্ট করেই বলছে—এই কাজগুলো ওপেন না হলে সে ফিরবেনা। তাতে তার এমপ্লয়িরা মনোবল হারাবে। তাকে আবার কাজের সচল অবস্থাতেই ফিরতে হবে।
আনন্দী ঝগড়া করে , তারপর ফোন রেখে দেয়। আর উদাস হয়ে ভাবে , রুদ্র কোনোদিন তার কষ্ট বুঝলনা। আজ আঠারো বছর হল তারা সংসার করছে, কিন্তু রুদ্র কোনোদিন বুঝলনা সংসারও তার কাছে কিছু চাইতে পারে। স্ত্রীর মনোবল নিয়ে সে মাথাই ঘামালোনা।
আনন্দী হাল ছেড়ে দিল রুদ্রর দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরা নিয়ে। সে বুমকে নিয়ে কাটাতে লাগল একা।

—-কী চাও তুমি জীবনের কাছে রুদ্র ?
—-কাজ চাই প্রভু, আরও কাজ
—–সাফল্য ?
—–নাহ। আমি শুধু আমার কাজটা করতে চাই ঠাকুর। আমি জানি ঠিক কাজ মানেই সাফল্য আসবেই।
—–কিন্তু নিজের কাজ করার জন্য অনেক আত্মত্যাগ, অনেক স্যাক্রিফাইস
—–আমি রাজি।
—–মা, দিদি, স্ত্রী, সন্তান।
——শুধু বুম , বুম যদি আমার কাজটার গুরূত্ব বোঝে তাহলেই তো হবে।
—–সে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সে কী করবে আজ তুমি জানোনা
——আমি জানিনা ওদের ছেড়ে থাকতে পারবো কিনা। কিন্তু কাজ ছেড়েও তো পারবোনা।
—–তুমি তো কাজ ছেড়ে নেই। তোমার জন্য তো কাজের সমুদ্র আমি রেখেছি রুদ্র।
—–কিন্তু চারপাশ দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ছি।
——তোমার চারপাশ তোমারই সৃষ্টি। তোমার চারপাশে উৎসাহ আছে, হতাশাও আছে। কোনটা নির্বাচন করবে সেটা তোমার সিদ্ধান্ত।
——আমি পারবো ? পারবো আমি ?
—-তুমি তো পেরেছো, তাকাও নিজের অতীতের দিকে। তুমিই পারবে ।
একটা আলো আঁধারি খেলা করছিল ঘরের মধ্যে। রুদ্রর নিজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল । এখন তার বয়স বিয়াল্লিশ। আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর আগের কথা। সে পাড়ি দিয়েছিল মুম্বই। একটা স্বপ্নের খোঁজে। তারো আগে, সে যখন ঠিক আঠারো পাড়ি দিয়েছিল কলকাতায়। আর ত্রিশের পর দু দুবার দিল্লি। একবার প্রোডিউসারের টাকায়, আর একবার ধার করে, আনন্দীকে নিয়ে। প্রথম তিনবার তার হাতে ছিল একটা ম্যাপ, আর অল্প কিছু টাকা। সাতশো বা আটশো। বাকি সব ছিল ভাগ্য। আর পুত্র সন্তানের জন্ম দেবার পর সে যখন একটা চাকরি নিয়ে স্থায়ী ভাবে থাকতে এল দিল্লি, তখন তার কাছে ছিল আনন্দীর একজোড়া দুল বিক্রির টাকা। সেই টাকার প্রতিটা অংশে তার নিজের কান্না লেগে ছিল। আনন্দী অত ভাবেনি দেওয়ার সময়, কিন্তু নিতে তার বুক ভেঙে গেছিল। যতবার তার দিল্লির জীবনে প্রলোভন তৈরি হয়েছে , মদ খাওয়ার, যথেচ্ছ পার্টি করার কিংবা নারীরও, তার আনন্দীর লাল পাথর দেওয়া ওই জোড়া দুলের কথা মনে পড়ে গেছে।
রাত দুটোয় শুয়েছিল রুদ্র। আর ঘুম ভেঙে গেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। তার ঘরে ভারী পর্দা দিয়ে সূর্যের আলো আসার স্থান নেই। তবু মনে হচ্ছিল এক আলোকিত মূর্তি বুঝি দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রর সামনে। চোখ খুললেই যাকে দেখতে পাবে। সে চোখ খুলল। তার মনে হল কেউ ছিল, এক্ষুণি। কিন্তু যে ছিল তার রেশটা রয়ে গেছে।
রুদ্রর খুব আনন্দ লাগছিল। যেন কী ভীষণ একটা খুশির ঘটনা তার জীবনে ঘতে গেল। তার শরীর , মন আনন্দ রসে সিক্ত হয়ে যাচ্ছিল। সে পারবে। সে টের পাচ্ছিল এসব বাধা বিপত্তি কিচ্ছু নেই। তারা ভাবছে তাইই। এইযে অফিস না যেতে হয়ে তার একেবারে একা থাকা কিছুদিন সেটা তার প্রয়োজন ছিল। সে নতুন জাম্প দেবে। তার ক্লায়েন্টদের রেগুলার কাজ কমে গেলে সে অন্যত্র হাত বাড়াবে। তার এমপ্লইয়িদের স্যালারি দেবার বিপুল চাপ থেকে গত সাড়ে তিন বছর সে কমফোর্ট জোনের বাইরে যায়নি মোটেই। এবার সে তাই যাবে। এখন সে নিয়মিত স্যালারি না দিতে পারলেও কাউকে কিচ্ছু জবাবদিহি করার নেই। রুদ্র উঠে পড়ে। ঘরের কাজ সেরে স্নান করে। ওটস আর ফল খেয়ে নেয় আর তারপর কাজে বসে। বসে তো বসেই । বসে সে ভুলে যায় সব। সে এবার ফিল্ম বানাবে। এড ফিল্ম। একটা বড় গ্রুপ তাকে বলেছিল। সে ওইদিকে মন দিতে পারেনি তখন। এখন তার নিজের কিছু প্রস্তুতির সময় পাওয়া গেল এবং শুরু থেকে শুরু করার কিছুটা অবকাশও।
আনন্দী দুপুরের ফোনে রুদ্রকে পায়নি। ভেবেছিল ব্যস্ত আছে, পরে করবে। বিকেল তিনটে অব্দি না পেয়ে সে চঞ্চল হয়ে পড়ে। কালই ফেসবুকে দেখেছে একটি ছেলে হায়দ্রাবাদে একা বাড়িতে কোভিডাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে খাবার জলটুকু অব্দি নেই। ছেলেটি ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে। তার প্রবল কাশির শব্দে প্রতিবেশীরা তার দিক মাড়ায়নি। সে দু একজনকে ফোনে অনুরোধ করেছিল ব্রেড, বাটার আর জল দিয়ে যেতে। কেউ যায়নি। তারপর বাধ্য হয়ে ফেসবুকে লিখতে এখান থেকে পুলিশ দিয়ে ওখানে যোগাযোগ করে তাকে সব পাঠানো হয়। রুদ্রও অসুস্থ হয়ে যায়নি তো ? সে বিকেল পাঁচটা অব্দিও কোনো ফোন না পেয়ে ছটফট করে। তারপর বাধ্য হয়েই ছেলেকে বলে— তুইতো ভালো হিন্দি বলতে পারিস । বাবাইয়ের পাশের বাড়ি ভাবীজীকে কল কর।
সে ফোন ছেলেকে দিয়ে নার্ভাস হয়ে চুপ করে বসে থাকে। ফোন স্পীকারেই দেওয়া ছিল। ভাবীজী অবাক হয়ে বলে— তুমলোগ তো ইধারই থা। গায়া কব ?
ছেলে উত্তর দেয়—নেহি আন্টি, হাম তো কলকাত্তা মে হু। পাপা উধার রহা গয়া। ইসি লিয়ে মাম্মীজী টেনশন কর রহি হ্যায়।
ভাবী ছেলেকে মাকে দিতে বললে আনন্দী ফোন ধরে আর অবাক হয়ে শোনে, রুদ্রর ঘরে নাকি কোন এক লেড়কি আছে। চার পাঁচদিন আগেও ভাবীজী দেখেছে তাকে বারান্দায়। সে ভেবেছিল তার ফ্যামিলি এসেছে।
আনন্দী আকাশ থেকে পড়ে। তবু সে লজ্জা আর অপমান ঢাকতে তাড়াহুড়ো করে বলে—হয়ত বন্ধুদের কারোর ফ্যামিলি হবে। ওখানে আমাদের বাঙালি অনেকেই থাকে।
ভাবী একটু অবাক হলেও কথা বাড়ায়না। বলে —দাঁড়াও। আমাদের বারান্দা দিয়ে তোমাদের বারান্দার দিকে ডাকছি।
পাশাপাশি দুটো বারান্দা। সামনের দিকে। আর পিছনের দিকে একই দেওয়ালের এদিক ওদিক দুটো ঘর। ফোন ধরে রইল আনন্দী। সামনের দিকের বারান্দায় ডেকেও কোনো সাড়া পেলনা ভাবী। তিনিই তখন ভাইয়াকে পাঠালেন নিচে গিয়ে আবার রুদ্রর ফ্ল্যাটে উঠে বেল বাজাতে। রুদ্র বেল বাজার আওয়াজ শুনে খুলে অবাক। আনন্দী শুনতে পায় ভাবী আর ভাইয়া দুজনেই রুদ্রকে বকছে। বউকে ফোন না করার জন্য। রুদ্র উত্তরে হাহা করে হাসছে। বলছে—আমি ফোন করছি ওকে। কিন্তু আমি মরিনি। কাজ করছিলাম ভেতরে।
ভাবীকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিতেই রুদ্র ফোন করে হাসতে হাসতে বলে— তুমি কি পাগল ? সতেরটা মিসড কল। কী ভেবেছিলে ? মরে গেছি ?
আনন্দী তখন ঝরঝর করে কাঁদছে। সে সত্যিই ভেবেছিল রুদ্রর কিছু হয়েছে। কিন্তু সে অবাক হয়ে যায় এটাই ভেবে সকাল থেকে সে ফোনে পায়নি, কিন্তু রুদ্রর ও কি চিন্তা হয়নি তাদের জন্য ? ফোন সাইলেন্ট করে সে এতটা ডুবে গেল ?
রুদ্র তখনো হাসছে। আর বলছে—ওরকম আকাশ কুসুম কল্পনা আমি করিনা। কত কাজ করলাম জানো এই ক ঘন্টায় ।
–খেয়েছ ?
—-নাহ। লাঞ্চ হয়নি। আরে একদিন না খেলে মরবনা। কিন্তু দিনের পর দিন না খেলে কী হবে ? আমি সেইসব দিন যাতে না আসে আমার তিন প্রজন্ম পরেও সেই ব্যবস্থা করছি।
আনন্দী কাঁদতে কাঁদতেই বলে—কিন্তু কোন মেয়ে এসেছে তোমার ঘরে ? ভাবী বলল
—–ওফফফ, কেউ না তো !
—-মিথ্যে বলছ তুমি ? মানে ?
—-আরে ওসব না। একদিন এসেছিল। আমার এক বন্ধুর বউ।
—-কিন্তু ভোরবেলা ওকে দেখেছে ভাবী। রাতে ছিল ?
—-উফ, জেরা কোরোনা। রাতে ছিলনা। ভোরেই এসেছিল। ও আর ওর বর । দুজনেই। আমি কাজ ছাড়া এখন কিচ্ছু বুঝিনা, আর তুমি যত হাবিজাবি প্রশ্ন করছ।
—কবে আসবে রুদ্র ?
—- ঠিক চলে আসব। ডোন্ট ওরি। সব ভালো হবে। একেবারে মন শান্ত রাখো। সব তোমার নিজের কাছে। ভালো থাকা বা না থাকা। এত চঞ্চল হোয়োনা। আমাকে ভরসা রাখো। প্রথমবার আনলক হলেই আমি টিকিট কাটবো।
–তোমার এজেন্সির কী হবে ?
—-আপাতত কলকাতায় হবে। এখান থেকে দুজন অন্তত যাবে। বাকিরা এখানে কাজ করবে।
—-দুটো শহর , সামলাতে পারবে ?
—- সামলাতে তো হবেই। এরপরে পাঁচটা শহরে থাকবে আমার এজেন্সি
—- আগে টিকিট কাটো
—–কাটবো তো। টিকিট দিচ্ছেনা এখনো। আর কদিন যেতে দাও ।
তাদের সংলাপ আবার প্রতিদিনের মত গড়াতে থাকে। টিকিট হচ্ছেনা পাবেনা জেনেও আশ্বাস আর কান্নাকাটি। কিন্তু রুদ্রর স্পষ্ট সরল গলা শুনেই আনন্দীর মনে অন্য মেয়েকে নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ধুয়ে মুছে গেল। সে জানে রুদ্র কিছু এলোমেলো করবেনা। করতে পারেনা।

(ক্রমশ)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes