
ধারাবাহিক উপন্যাস
পৃথা কখন আসবে তৃতীয় পর্ব
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
এই উপন্যাসের প্রায় পুরোটাই লেখা এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ শল্য বিভাগের বিছানায় বসে বা বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোওয়া হয়ে। ট্রামাডল ইনজেকশন নেওয়ার পর ব্যথা একটু কমলে এবং ফের যন্ত্রণা শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়গুলোতে এই উপন্যাসের বাক্য এবং যতিচিহ্নগুলো লেখা। কখনও মাঝরাতে উঠেও নিশ্চুপ হাসপাতালে বসে ভোর অবধি টানা লিখে গেছি। যখনই যন্ত্রণা শুরু হত ওঁরা ইনজেকশন দিয়ে কমানোর চেষ্টা করতেন, যাতে নিশ্চিন্তে লিখতে পারি। হাসপাতালে শুয়েই ডায়রি এবং নোট রাখার শাদা কাগজগুলোতে উপন্যাসটা গুছিয়ে আনার পর ‘অন রিকোয়েস্ট’-এ ডিসচার্জ নিয়ে ঘরে এসে এতে সংযোজন, পরিমার্জন ও ঘষামাজা সেরে ফেলি। কোনও অসুখ নয়, কোনও যন্ত্রণা নয়, আর কিচ্ছু নয়, মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এ উপন্যাস শুধু প্রেমের উপন্যাস।
পৃথা কখন আসবে প্রথম পর্ব— প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে
পৃথা কখন আসবে দ্বিতীয় পর্ব- দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে
তৃতীয় পর্ব
‘হ্যালো!’
‘কে?’
‘তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?’
‘কে?’
‘আমার নাম শুনলে কি তুমি ফোনটা কেটে দেবে?’
‘কে?’
‘আমার নাম শুনলে কি তুমি ফোনটা কেটে দেবে?’
‘কে?’
আমি নাম বললাম। ফোনটা কেটে দেওয়া হল। শাহানা প্রশ্ন করেছিল, কে আমি? আমি কে? আমি এর উত্তর তাকে দিতে পারিনি। অ্যানাস্থেশিয়ার ঘোরে ছিলাম বলে নয়, সচেতনে সজ্ঞানে থাকলেও দিতে পারতাম না। আমি কে? এ তো মস্ত দার্শনিক প্রশ্ন। আমি জানি না আমি কে। আমি এখনও জানি না। আমি শুধু তাকে বলেছি, লোকে আমাকে কী নামে ডাকে, সেই নাম। কিন্তু কে আমি, তার এই প্রশ্নের উত্তর এটা নয়। হতে পারে না।
অনেকদিন আগে শাহানা একবার আমায় জিগ্যেস করেছিল, ‘কে তুমি? তুমি কে?’
‘অন্যের দয়ায় প্রতিপালিত ভিখিরি বিশেষ।’ আমি বলেছিলাম।
বলেছিলাম, ‘ভিখিরি। কিন্তু আমার নিজেকে গরিব বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন করেছিল শাহানা।
‘দীনহীন মনে হয়।’ আমি বলেছিলাম। ‘কিন্তু গরিব মনে হয় না।’
আরও অনেক কিছু বলা যেত হয়ত। বলিনি। যেমন বলা যেত, আমি নিরস্ত্রও নই। বাংলা বর্ণমালা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। এটাই আমার অস্ত্রাগার। আমার ভাষাই আমার সংগঠন। গালিবের কী ছিল? কী ছিল কাফকার? রবীন্দ্রনাথের? কী ছিল ভ্যান গঘের? জীবনানন্দের? আমার কাছে যদি আমার বর্ণমালা এবং আমার ভাষা না থাকত, যদি আর সব থাকত, এমনকী সুস্থ শরীরও যদি থাকত, শুধু এই জিনিসটা না থাকত— আমার নিজেকে লাথখোর ভিখিরির অধম মনে হত। মনে হত কুকুরের বমির পোকা, বেড়ালের পেটের কৃমি। মনে হত আমি নিরস্ত্র। আমি কোথাওই যাই না। কারুর সঙ্গে এখন আর মেলামেশা করি না। যোগাযোগ রাখি না। তাঁরাও রাখেন না। ব্যাপারটা ভাইস ভার্সা। কিন্তু তবুও কিছুতেই এক মুহূর্তের জন্যেও আমার নিজেকে নিঃসঙ্গ, একলা মনে হয় না। আমি স্পষ্ট অনুভব করি, আমার সঙ্গে অসংখ্য মানুষের নিরন্তর উপস্থিতি। কাফকা, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, গালিব, রেনোয়া, রামপ্রসাদ, লালন ফকির, নেরুদা, ভ্যান গঘ— এরকম অসংখ্য বিপন্ন কিন্তু সশস্ত্র মানুষেরা আমার সঙ্গে সবসময় ছায়ার মতো রয়েছেন। আমি টের পাই তাঁদের থাকা। তাঁদের শরীরী উপস্থিতি। আমাকে সুস্থ করে তুলতে, মনের দিক দিয়ে চাঙ্গা রাখতে কাফকা, রবীন্দ্রনাথ, মার্কেজ, হুমায়ূন আহমেদ— এঁরা জান লড়িয়ে দেন। অসংখ্য গল্প, উপন্যাসের চরিত্রেরা তো সঙ্গে সঙ্গে থাকেনই। তাঁদের সঙ্গে চলে আমার আলাপচারিতা। টেলিফোনবিহীন, ইন্টারনেট সংযোগবিহীন সেইসব কথোপকথনে আমি বুঝতে পারি, তথ্য প্রযুক্তি কত অসার। বিজ্ঞান কত জ্ঞানশূন্য। পৃথিবী কত রহস্যময়।
শাহানা আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। এটা যদি এতগুলো বছর বাদে হঠাৎ তাকে ফোন করে ফেলার একটা ব্যাখ্যা হয়, তবে বলতে হয়, মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা এখনও সাবালক হয়নি। কিন্তু মানুষ মানুষকে ফোন করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এতগুলো বছর বাদে একটা মানুষ একজনকে ফোন করেছে— নিজের নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওপ্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়া হল। এটা স্বাভাবিকতা নয়। কোনওরকমের স্বাভাবিকতার পর্যায়েই একে ফেলা যায় না। স্বাভাবিকভাবে কথা শোনার এবং শুনে ঋজুতার সঙ্গে নিজের কথাটুকু সামনাসামনি বলার সৎসাহস ও মেরুদণ্ড যার নেই— নেই যে, সেটা সে নিজেও জানে। নিজেই সবচে’ ভালো জানে। জানে বলেই, এতগুলো বছর বাদেও সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অবিচলিত ভঙ্গি সে অর্জন করতে পারে না— কারণ, নিজের অপরাধবোধ সম্পর্কে আমরা নিজেরা সবচে’ বেশি ওয়াকিবহাল। আর তাছাড়া, কে তুমি? তুমি আর যে-ই হও, তুমি তো বনলতা সেন নও। পাখির নীড়ের মতো দু’খানি চোখ তোমার যদি না-ও থাকে, তবে নিজের দু’খানি চোখ তুলেও তো তুমি কখনও জিজ্ঞেস করোনি— ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ চারিদিকে জীবনের সফেন সমুদ্র থেকে আপন মুদ্রাদোষে আলাদা ও একা হতে থাকা আমাকে তো কখনও দু’দণ্ড শান্তি দাওনি তুমি। তবে? কে তুমি?
এরা কিছু একটা অপারেশনের পরিকল্পনা করছে। ডাক্তার আমাকে বললেন, ‘প্রিপারেশন নিন।’ যিনি বললেন, তিনি একজন অভিজ্ঞ সার্জন। লম্বা হতে হতেও লম্বা না হয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে বেঁটেদের দলে থেকে যাওয়ার মতো তাঁর শারীরিক উচ্চতা। অথচ তাঁকে বেঁটে বলা যায় না, কারণ তাঁকে দেখেই বোঝা যায় তিনি লম্বা হচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে লম্বাও বলা যায় না, কারণ শেষ পর্যন্ত তিনি লম্বা হননি। গায়ের রং পরিষ্কার। ঝিরিঝিরি চুল মাথার ওপরে শুয়ে। সাধারণত হাফ শার্ট গুঁজেই তাঁকে বেশি দেখা যায়। জামাগুলো হয় গাঢ় রঙের। তার ওপরে রাতের তারার মতো ফুটিফুটি প্রিন্ট। প্যান্টের রং স্বাভাবিকভাবেই হালকা। মাস্ক সর্বদা মুখে থাকায় নাক এবং ঠোঁট আমি দেখিনি। কিন্তু মাস্কের ওপর দিয়ে যে চোখ দুটো দেখেছি, সেই চোখ দুটো বড়ই শান্ত। কিন্তু তারা খুব কাছের কিছুর দিকে তাকিয়ে নেই। মনে হবে, যেন অনেক দূরের কিছুকে সে দেখছে অন্তর্ভেদী কিন্তু শান্ত, স্থির ও মৌন ভঙ্গিতে। চোখ দুটো দেখতে তীক্ষ্ণ নয়। কিন্তু নিকটের দিকে তাকিয়েও নিকটকে অতিক্রম করে সুদূরকে দেখার প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যে তীক্ষ্ণ স্থিতধীভাব রয়েছে। কথা বলেন, দুটো কি একটা বাক্যে। তার মধ্যেই পুরো বক্তব্য সমাহিত। আমাকে তিনি বললেন, ‘এলপিজে করা যেতে পারে। আমরা চেষ্টা করে দেখছি। দেখি কী করা যায়।’
সকালে এক্সরে-র জন্যে হলুদ কাগজ দিয়ে গেল। চেস্ট এক্সরে। এরপর এইচআইভি টেস্টের জন্য রক্ত নিল। ইসিজি টেস্ট হল হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই। এমআরসিপি-র জন্যেও হলুদ কাগজ দিয়ে গেল। বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। তার মধ্যেই এক্সরে করিয়ে গেলাম এমআরসিপি সেন্টারে। তারা পরদিন সকাল ৮টায় যেতে বলল। ডালকোফ্লেক্স বলে একটা ওষুধের নাম লিখে দিল। বলল এটা ওইদিন রাতে খেতে।
এর মধ্যে একদিন কানু মিঞা তার হাতের চ্যানেল খুলে ফেলল। চ্যানেলে ব্যথা হচ্ছিল, সইতে পারেনি, খুলে ফেলেছে। পরদিন সকালে তার ছুটি হওয়ার কথা ছিল। পেটে ব্যথা কমে গেছে। ডাক্তার বলেছে, কাল সকালে ছুটি। কিন্তু সকাল হলে দেখল, কোথায় ছুটি! সিস্টাররা জিজ্ঞেস করল, চ্যানেল কোথায়? কানু সত্যি কথা বলল। সিস্টাররা বকাবকি করল একটু। কিন্তু ছুটি হল না। কানুর মনে হল, নিজে হাতে চ্যানেল খুলেছে বলেই তার এই শাস্তি। ডাক্তারের পা ধরে বলছে, স্যার ভুল হয়ে গেছে। জীবনে প্রথমবার হাসপাতালে এসেছি। কী নিয়ম আমি জানি না। আর হবে না ডাক্তারবাবু। আমারে ছুটি দিয়া দ্যান। ডাক্তার বলেন, ওভাবে ছুটি হয় নাকি? বিকেলে হবে। দুপুরে সিস্টার এল ইনজেকশন দিতে। কানু এই গরমে চাদরে হাত ঢেকে বসে আছে, চ্যানেল-শূন্য হাত যাতে দেখা না যায়। সিস্টার ইনজেকশন হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কানু ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছে। শেষে বলল, ‘ইনজেকশন না লাগে। ব্যথা নাই।’ ইতিমধ্যে সিস্টার দেখে ফেলেছে কানুর হাতে চ্যানেল নেই। চ্যানেল কোথায়? কানু আবার সত্যি কথা বলল। আবার বকা খেল। এদিকে বিকেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার এল। কানু মিঞা মাছের ঝোল, ভাত খেল। সন্ধেও হয়ে গেল। গরম বাড়ছে সন্ধের পর থেকে। এখানে পাখা নেই একটাও। কানু অস্থির হয়ে উঠল। ডাক্তার কোথায়? ছুটি কখন হবে? আমি সকালেই কানু মিঞাকে বললাম, আপনি জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান। আপনি চোর না আসামী, যে পুলিশ আপনার বাড়িতে গিয়ে ধরবে? কেউ কিচ্ছু বলবে না। পেটে ব্যথা যখন নেই, বাড়ি যান। কানু যাবে না। বলল, গেটে যদি আটকায়? আমি বললাম, আটকাবে কেন? এত লোক যাচ্ছে, আসছে। কাউকে আটকাচ্ছে? কানু তাও গেল না। অপেক্ষা করতে থাকল বিকেলের জন্য। চুরি তো সে করেনি। তাহলে পালাবে কেন? সন্ধের পরেও যখন ছুটি হল না। কানু তখন অস্থির। একবার নিজের বেডে বসে। একবার বাইরের গেটের দিকে যায়। এর ফাঁকে কানুর মা জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটা দিল ছেলেকে ছাড়াই। বলে গেল, ‘ছেলে আসলে বইলা দিবেন আমি গেছি গিয়া। এই গরমে কায় থাকবে ইটি কোনায়?’ একটু পরে কানু ফিরে দ্যাখে মা নেই। ছুটি নেই। কানু আর কিচ্ছু মানল না। খালি হাতে হাঁটা দিল বাড়ির পথে।
প্রতিদিনই এখানে আমার নতুন বন্ধু হয়। একসময় এই বিছানায় ছিলেন খাগড়াবাড়ির প্রাণবল্লভ চৌধুরী। গালভরা জবরদস্ত নাম শুনে মনে হয় জমিদার। ইলেকট্রিকের কাজ করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর এল কাকরিবাড়ির বাসুদেব রায়। অল্প বয়েসি রাজবংশী যুবক। পেয়ারা গাছ থেকে নামতে গিয়ে বিচিতে চোট পেয়েছিল। এরপর এল পুণ্ডিবাড়ির ৭০ বছরের নারায়ণ সূত্রধর। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। আগে তাঁতের মেশিন বানাতেন। নিশিগঞ্জ, আক্রাহাট, মাঘপালায় যেত তাঁর তৈরি তাঁতযন্ত্র। তাঁর নাতি, ১৪ বছরের গোপাল, নারায়ণবাবু ডাকেন, ‘গুপাল’। সেই গুপালই এই প্রবীণের একমাত্র বন্ধু। বাত, অর্শের জন্যে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ বিলোন নারায়ণবাবু। যদি আপনার দোকানে বেচাকেনা কম হয়, খদ্দেরের ভিড় না হয়, তাহলে তিনি নাভিজলে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ে দেবেন। ভিড় বেড়ে যাবে দোকানে। এমনই দাবি তাঁর। স্ত্রীকে তিনি বলেন বাড়িওয়ালা। আর কথায় কথায় বলেন, ‘কী বইলব দুঃখের কথা, আগুন লাগল কইলকাতায়, পুড়ল শিলিগুড়ি’।
আমার একটা বিছানা পরে বেড নম্বর এক্সট্রা ফোর-এর জিরানপুরের প্রবীরকুমার দত্ত প্রায় দু’ সপ্তাহ থেকে একদিন বাড়ি চলে গেলেন। তাঁকে শিলিগুড়িতে নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজে যেতে বলেছে। কার্ডিওলজিস্ট তাঁকে অপারেশনের সম্মতি দেননি। ভদ্রলোকের সঙ্গে এই কদিন কত গল্প, কত তর্ক হল। এদিন সকালেও কথা বললাম দুজনে। অথচ চলে যাওয়ার সময় একবারও বলে গেলেন না। ভালো লাগল এই স্বাভাবিকতা। বেড নম্বর এক্সট্রা থ্রি-তেও এখন কেউ নেই। এই মুহূর্তে দুটো বিছানা খালি। আমি অপেক্ষা করছি এখানে নতুন মানুষের জন্য। আবার কারও সঙ্গে দুদিনের গল্প, চারবেলার তর্ক, একবেলার খাবার ভাগ করে নেওয়ায় জমজমাট হয়ে উঠবে আমাদের আসর।
সকালে এক জুনিয়র ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অপারেশনটা কি কার্যকর হবে?’ তিনি বললেন, ‘সেটা তো অপারেশনটা না হলে বলা যাবে না। আমরা একটা চেষ্টা করে দেখি। দেখি না কী হয়।’ দেখি না কী হয় মানে? এটা কি একটা অ্যাডভেঞ্চার নাকি?
হাসপাতালের নবম দিনের সন্ধ্যায় তিনি, সেই সুন্দরী নার্স ইনজেকশনের ট্রলি নিয়ে আমার কাছে এলেন। তিনি যখন ইনজেকশন নিয়ে, স্যালাইনের বোতল হাতে একের পর এক রুগির কাছে যান, যেভাবে গভীর মনোযোগে তাঁদের ভেইনে নিডল ঢুকিয়ে চ্যানেল করেন, স্যালাইনের ড্রপ চেক করেন, মাথায় হাত রেখে খোঁজ নেন কে কেমন আছে— মনে হয় এটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোনও দেশে রেড ক্রসের ক্যাম্প। যুদ্ধে আহতদের সেবা করছেন তিনি। বাইরে একের পর এক চলছে বম্বিং। শেল ফাটছে। ধূমকেতুর মতো উড়ে যাচ্ছে রকেট লঞ্চার। শর্ট মেশিনগানের নাগাড়ে আওয়াজে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসপাতালের দেওয়াল। তিনি আশ্বস্ত করছেন সবাইকে। ভয় নেই। ভয় নেই। আছি তো। ত্রস্ত পায়ে যখন তিনি গটগট করে ইনজেকশন আনতে ঢুকে যান নার্স রুমে— মনে হয়, গুলিতে, বোমায় আহতকে ঘুম পাড়িয়ে এখুনিই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবেন তিনি। আর ভয় নেই। ইউনিফর্ম পরে তাঁর এই হেঁটে যাওয়া গুরুতর দায়িত্বশীল এক মানুষের পদক্ষেপ বলে মনে হয়।
আমি বললাম, ‘আপনি যখন ইউনিফর্ম পরে হাঁটেন, আর যখন নর্মাল ড্রেসে হাঁটেন, দুটো হাঁটা যে দু’রকম— এটা কি আপনাকে কেউ কখনও বলেছে? বা আপনি কখনও লক্ষ করেছেন?’
‘ইউনিফর্ম পরে হাঁটাটা একটু কনশাসভাবে হাঁটা?’ তিনি বললেন।
‘একটু স্টিফ।’ আমি বললাম।
‘একটু স্টিফ!’ প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে বললেন তিনি।
পরে ভাবলাম, স্টিফ কি সত্যিই? স্টিফ বোধহয় নয়। স্টিফ বলা হলে সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা হয় এই হাঁটার। এ হাঁটা অনেকটা গর্বোদ্ধত নারীর হাঁটা। কিন্তু একটুও অহংকারী নয়। অত্যন্ত ছন্দোবদ্ধ এবং সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রিত আবেগের প্রতি দায়িত্বশীল হাঁটা।
দু’ তিন দিন আগে বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের কাছে ইয়েলো জেলকোর নিডল ভেঙে যাওয়ায় চ্যানেল থেকে স্যালাইনের ফ্লুইড লিক করছিল। তারপর বেশ কয়েকজন বেশ ক’বার চ্যানেলের চেষ্টা করলেও ভেইন পায়নি। একদিন আগে রাতের রাউন্ডে এসে এক সিস্টার তো গ্রিন জেলকো দিয়ে বাঁ পায়ের পাতাতেও চ্যানেল করার চেষ্টা করলেন। হল না। উলটে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা হল। আমি লক্ষ করিনি তুলোটা ঠিক জায়গায় ধরে রাখা নেই। গল্প করতে করতে প্রবীরদার বিছানার কাছে গিয়েছিলাম তখন। রক্ত পড়ে পায়ের পাতা, মেঝে লাল হয়ে গেল। আমি সিস্টারের কাছে তুলো চেয়ে পায়ের পাতার ওই জায়গায়, যেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে সেখানে চেপে ধরে থাকলাম। ভেইনটা ফুলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। মেঝেয় পড়ে থাকা আমার রক্তগুলো কেউ মুছল না। রক্ত দেখেই প্রবীরদা বলে উঠলেন, ‘ছিঃ!’ সারারাত ধরে জরুরি বিভাগ থেকে রুগি এল ওয়ার্ডে। সবাই আমার রক্ত মাড়িয়ে মাড়িয়ে ঢুকল, বেরিয়ে গেল, চলাফেরা করল। পরদিন সকালে ওয়ার্ড সাফাইয়ের সময় সাফাইকর্মীর ঝাড়ু ও জলে মোছা হল আমার রক্ত। আমি দেখলাম।
এদিন বিকেলে সুন্দরী নার্স এবং একজন নেপালি ব্রাদার এসে আমার বাঁ হাতে কনুই থেকে চার ইঞ্চি নীচে গ্রিন জেলকো দিয়ে চ্যানেল করলেন। চ্যানেলটা করলেন মূলত ওই নেপালি ব্রাদার। এই হাসপাতালে এই নেপালি ভদ্রলোক এবারেরটা নিয়ে আমার তিনবার চ্যানেল করিয়ে দিলেন। প্রথমবার করেছিলেন ডান পায়ের গোড়ালির কাছে বাঁদিকের ডিমের পাশে— পিঙ্ক জেলকো দিয়ে। এরপর করেন বাঁ হাতে ইয়েলো জেলকো দিয়ে। এদিন আবার করলেন। তিনবারই তিনি একবারেই আমার ভেইন পেয়ে গেছেন। এতখানি সূক্ষ্মতা এই হাসপাতালে তো বটেই, অন্য অনেক বড় বড় হাসপাতালেও অনেকের মধ্যেই আমি দেখিনি। কারণ আমার ভেইন অত্যন্ত সরু আর বাঁকা। এর ফলে গ্রিন জেলকোর লম্বা নিডল দিয়ে আমার ভেইনে চ্যানেল করা মুশকিল। একমাত্র সহজ উপায় পিঙ্ক কিংবা ইয়েলো জেলকো। কিন্তু এগুলোর নিডল ছোট হওয়ায় চ্যানেল বেশিদিন টেকে না। প্রতিদিন ইনজেকশনের চাপ নিতে নিতে দু’তিন দিনেই চ্যানেলের নিডল ভেঙে যায়। সুন্দরী নার্স জিজ্ঞেস করলেন ব্যথা আছে কিনা। আমি যখন বললাম আছে, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে পিসিএমের কথা বললেন। আমি বললাম, পিসিএম এখন থাক। ব্যথা আরেকটু বাড়লে ওটা নেওয়া যাবে। এখন বরং ট্রামাডলই নিই। বাঁ হাতে ট্রামাডল ইনজেকশন নিলাম। আইএম। সুন্দরী নার্সকে বললাম, ডাক্তাররা একটা অপারেশনের প্ল্যান করছেন। এটার অপারেশন হয় মূলত স্টেন্ট দিয়ে। সেটা তো এখানে হবে না। এঁরা অন্য কিছু করবেন। এটা যেদিনের কথা বলছি, আমার মনে আছে, সেদিন ছিল শনিবার। এর আগের শনিবার তিনি আসেননি। পরের দিন এসে বলেছিলেন, ‘ছুটি ছিল’। আমি সেজন্যে ভেবেছিলাম এদিন তাঁর দেখা পাব না। কিন্তু পেলাম। দিনটা ভালো হল।
হাসপাতালের বাইরে রুগির পরিজনদের প্রতিক্ষালয়ের পাশে একটা ঘরে এক পাগলি বসে থাকে। তার দু’ চোখে কী যে ধীর এক প্রতিবাদ লেগে আছে, তা ভাষায় বলার নয়। যেন কী এক খরবায়ু এসে ধূসর চুল এলোমেলো করে দিয়ে গেছে, সারা মাথায় যা ছড়িয়ে পড়েছে ভেঙে পড়া পাখির বাসার মতো। শীর্ণ মুখ। তীব্র চোখ। মার খাওয়া শক্ত চোয়াল। পুলিশ সেলের এক পুলিশ কর্মী সেই পাগলির জন্যে দু’ বেলা থালা পেতে ভাত নেন। দুপুরে সাড়ে ১২টায় আর সন্ধে সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে ভাত দেয়। সাধারণত দুপুরে ডাল, ভাত, তরকারি আর মাছ ভাজা। রাতে মাছের জায়গায় ডিম। পাগলির জন্য ভাত নিচ্ছে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। রোজ দু’ বেলা এই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে যে কী ভালো লাগে। দু’ চোখ মেলে দেখি।
আমার লেখার ডায়রির ওপর রাখা ডার্ক চকোলেট। ডাক্তার সন্ধেবেলা রাউন্ডে এলেন। এসে বললেন, ‘ব্যথা হচ্ছে তার মধ্যে আপনি চকোলেট খাচ্ছেন?’ ইনি লেডি ডাক্তার।
‘এটা আমার খুব প্রিয়। ডার্ক চকোলেট।’ আমি বললাম।
‘প্রিয় হলেও আপনার খাওয়া যাবে না।’
বললাম, ‘গতকাল ডাক্তারবাবুরা বলছিলেন অপারেশনের প্ল্যান করছেন।’
ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের পাতা উলটে দেখলেন। অল্প জোরে বিড়বিড় করে বলার মতো করে বললেন, ‘প্ল্যান ফর ওটি।’
আরেকজন পুরুষ ডাক্তার বললেন, ‘এমআরসিপি হয়েছে?’
‘না, কাল হবে।’
‘কাল তো রোববার।’
‘না, হবে।’
‘ল্যাব থেকে বলেছে না এমআরসিপি সেন্টার থেকে বলেছে?’
‘এমআরসিপি সেন্টার থেকেই বলেছে কাল সকালে ৮টায় যেতে।’
লেডি ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ব্যথা এখন একটু কম তো?’
‘হ্যাঁ কম। কিন্তু কিছু খেলে ব্যথা হচ্ছে।’
বাথরুমে যাওয়ার সময় ওদিকের বারান্দায় শুয়ে থাকা এক নতুন পেশেন্ট, বছর তিরিশের একটি ছেলে, আমাকে দাঁড় করিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে?’
এরকম প্রশ্নের উত্তরে আমি সাধারণত বলে থাকি— ‘বাচ্চা হবে’। এখন আর ইয়ার্কিও ভালো লাগে না। লোকজন রসিকতা বোঝে না। বললাম, ‘প্যাংক্রিয়াসে সমস্যা।’
ছেলেটি বলল, ‘প্যান্টে?’
সত্যি কথা বলার এই এক সমস্যা। এরচে’ ‘বাচ্চা হবে’ বলা ভালো। তাকে বোঝালাম, সহজ বাংলায় প্যাংক্রিয়াস কী। কোথায় থাকে। কী তার কাজ। বাথরুম থেকে ফেরার পথে আবার দাঁড় করাল আমাকে। বলল, ‘একটা কথা বলব? রাগ করবা না তো?’
আমি বললাম, ‘আমি জানি তুমি কী বলবে। আমার পায়ের বড় বড় নখের কথা বলবে তো?’
বলল, ‘হ্যাঁ। এটা তাও কতদিনের হবে? এক বছর তো হবেই। এরকম কেন করেছ?’
আমি ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যাতে লোকজন ঘেন্নায় কাছে না আসে। মানুষজন এখন ভালো লাগে না।’
‘একটা সেলফি নেব তোমার পায়ের নখের?’ বলে ছেলেটি বিছানার ওপর রাখা তার স্মার্ট ফোনে ডান হাত রাখল।
আমার এতগুলো লেখা নয়, আমার অন্য কোনও কাজ নয়, আমার কাছে একমাত্র দ্রষ্টব্য হল আমার পায়ের নখ। সেটা এতটাই কৌতূহলোদীপক দ্রষ্টব্য যে, লোকে পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। স্ত্রী তাঁর স্বামীর জামা টেনে বলেন, ‘দেখো কত বড় বড় নখ।’ এতটাই দ্রষ্টব্য যে লোকে মোবাইলে খচ করে ছবি তুলে ফেসবুকে তা পোস্ট করে হাততালি কুড়োতে চায়। আমার লেখা তারা পড়তে চায় না। আমার লেখা বইগুলো পড়তে চায় না। আমার বেহালা বাজনা শুনতে চায় না। আমার কথা শুনতে চায় না। শুধু আমার নখ দেখতে চায়। মেলায় জোড়াশিশু গঙ্গা-যমুনাকে দেখতে ভিড় করার মতো অশ্লীল, মানুষের এ জাতীয় কৌতূহল। সাধু-সন্ন্যাসীরা কেন সারা গায়ে ছাইভস্ম মেখে বসে থাকেন? ন্যাংটো হয়ে ঘোরেন? ল্যাঙোট পরে থাকেন? লম্বা দাড়ি রাখেন? যাতে আপনার-আমার মতো আজেবাজে মানুষ তাঁদের কাছে গিয়ে উৎপাত না করে। তাঁরা চান দূরত্ব। নিরিবিলি। শান্ত নির্জনতা। এতসব পেরিয়েও যাঁরা তাঁর কাছে যাবেন তাঁরা খাঁটি ভক্ত। মানুষ চেনা দায়— কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়, এ কথা সব সাধকই বলেছেন। এটা তাই এক ধরনের স্ক্যানার। বাজে লোক এড়াবার স্ক্যানার। এই স্ক্যান পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে এপারে এলে তবেই সে বসার আসন পাবে। আমরা বেশিরভাগই ওই চেহারা, ওই রূপ দেখে ‘ওরে বাবা গো’ বলে দূরে পালিয়ে আসি। একজন সুন্দরী যুবতি যেমন চট করে সহজে বুঝতে পারেন না, যে পুরুষ তাঁর কাছে এসেছে, সে তাঁর রূপে ভুলে এসেছে নাকি হৃদয়ের টানে বা কাজের গুণে এসেছে। সেজন্যে প্রকৃতি নারীকে প্রবল ধারণশক্তির সঙ্গে দিয়েছেন প্রখর ধারণাশক্তিও। পুরুষের তো নারীর মতো অত প্রখর ধারণাশক্তি নেই। সে কী করবে?
ছেলেটিকে বললাম, ‘না’।
নার্স রুমের সামনে দেখলাম সুন্দরী নার্স দাঁড়িয়ে। চুল খোলা। নার্সের ইউনিফর্ম খুলে ফেলেছেন। কালো রঙের কুর্তি পরে আছেন। নার্স রুমের টেবলের দিকে পিঠ করে চেয়ারের দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দেখে মনে হল, কাজ শেষে বাড়ি ফেরার আগে এরচে’ ভালো শারীরিক ভঙ্গি আর কী হতে পারে! সারাদিন টেবলের দিকে মুখ করে চেয়ারে পিঠ রেখে কাজ করা হয়। দিন শেষে, কাজ শেষে, বাড়ি ফেরার আগে মেয়েটি ঠিক তার উলটো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সিনেমার কোনও চিন্তাশীল পরিচালক তাঁকে বলে দিয়েছেন এইভাবে দাঁড়াতে। আমার দিকে চোখে চোখ হতে ঘাড় নেড়ে ইশারায় বললাম, অবশ্যই কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করে, ‘বাড়ি?’ তিনিও একইভাবে মাথা ডান পাশে কাৎ করে ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিলেন, কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করেই। এরপর আমি কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে বললাম, ‘ফেরার আগে এক সেকেন্ড আসবেন তো আমার এখানে।’ বললেন, ‘আচ্ছা’।
রাত ৮টার দিকে তিনি এলেন। হাসপাতালের এই বিছানায় আমার মাথাটা থাকে নার্স রুমের দিকে। আর পা থাকে পুলিশ সেলের দিকে। নিশ্চয়ই এটা ভেবেচিন্তে অর্থবহ কিছু একটা করার জন্যে করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গেছে। আমার মাথার কাছাকাছি এসে তিনি বললেন, ‘বলো’। সঙ্গে আরেকজন মহিলা। বোধহয় ইনিও নার্স। দুজনেই তখন বাড়ির পথে, হাসপাতাল থেকে বেরুবার রাস্তায়। সুন্দরী নার্স আলাদা করে কিন্তু আমার কাছে এলেন না। যেহেতু ঢোকা-বেরুনোর রাস্তায় বারান্দাতেই পড়ে আমার বিছানাটা— তাই বাড়ি ফেরার পথে যাবার সময় কথামতো দেখা করতে এলেন। আলাদা করে সময় বের করে দিলেন না।
আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার নামটা বলুন তো আগে।’
গলার স্বর, বাচনভঙ্গি এবং চোখের তারায় একটা সন্দেহ এবং প্রশ্ন ঝুলিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার নাম? পৃথা মুখার্জি।’
আমার ডান হাত তখন ডার্ক চকোলেটটার ওপরে। সেটার দিকে না তাকিয়েই আমি তাতে হাত দিয়েছি। আমার মুখ তখন ফেরানো পৃথার দিকে। চোখ তাঁর চোখে। তাঁর চোখ ডার্ক চকোলেটের দিকে যাওয়া আমার ডান হাতের দিকে। আমার ডান হাত যত এগুচ্ছে ডার্ক চকোলেটের দিকে, সেভাবেই তাঁর চোখের দৃষ্টিও আমার হাতের যাত্রাপথ অনুসরণ করে করে সরছে। আমি চকোলেটের প্যাকেটটা হাতে তুলে তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, ‘নিন এটা’।
‘ওমা! সেকী! কেন?’ এই তিনটি শব্দে তিনি তাঁর সাময়িক বিস্ময়কে ধারণ করে বললেন।
‘আরে আপনি চলে যাবেন ক’দিন পর। ফেয়ারওয়েল পার্টি তো দিতে পারব না। এটা রাখুন।’ আমি খুব হড়বড় করে বলে ফেললাম। বলায় একটুও যত্ন ছিল না। নার্ভাস লাগছিল। তাড়াতাড়ি এটুকু বলে ফেলতে পারলেই যেন আমি আমার ব্যক্তিত্বের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শিশুসুলভ আচরণকে আড়াল করে ফেলতে পারব, মনে হচ্ছিল।
‘থ্যাংক ইউ!’ বলে হাত বাড়িয়ে ডার্ক চকোলেটটা নিয়ে কালো কুর্তি পরা মেয়েটি চলে গেল।
এম্নিতে কেউ ডার্ক চকোলেট কি উপহার দেয়? সচরাচর? নানা রকমের ক্যাডবেরি আছে, সেসব দেয় কেউ কেউ। কিন্তু একটু কড়া, একটু তিতো, একটু কম মিষ্টির চকোলেট— এবং ওই ডার্কনেস, অন্ধকার। এসবের কি কোনওই অর্থ নেই? পৃথা কি সেসব টের পাবে কখনও? এটা যদি সাধারণ কোনও চকোলেট না হয়ে, হত যদি কোনও জাদু চকোলেট; যাতে কামড় দিলেই আস্তে আস্তে অন্য এক জগতের গাঢ় অন্ধকার তার ভেতরে ঢুকতে শুরু করবে। নিঃসঙ্গ, অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে যখন টর্চ হাতে বেরিয়ে আসে কোনও একা মানুষ, তখন সেই মানুষের মধ্যেও কি সুড়ঙ্গটি নিজের কিছুটা নিঃসঙ্গতা এবং অন্ধকার পাচার করে দেয় না? নিজের অজান্তে কি সেই মানুষ ছাই দিয়ে সংসারে ওই অন্ধকার এবং খ্যাপাটে নিঃসঙ্গতা বয়ে বেড়ায় না যাবৎজীবন? আপনাদের হয়ত মনে হচ্ছে, ডার্ক চকোলেটের প্রসঙ্গ আছে বলেই আমি এখানে সচেতনভাবে পৃথাকে কালো কুর্তিতে রেখেছি, যাতে এটা একটা অন্য ব্যঞ্জনা পায়। না, এরকম ভাবলে তা আপনাদের ভুল ধারণা। সত্যিই পৃথা সেদিন কালো কুর্তিই পরেছিল। কেন পরেছিল, ওইদিনই কেন পরল, ওইদিনই কেন আমি ডার্ক চকোলেট উপহার দিলাম— জীবনের আরও অনেক কিছুর মতো এসবেরও কোনও উত্তর নেই। এগুলো অমীমাংসিত রহস্য।
আমি জানি না এই হাসপাতালে সহমর্মিতা আর মানবিকতার জন্যে কোনও পুরস্কার চালু আছে কিনা। থাকলে এই নার্স পৃথা মুখার্জি সহমর্মিতার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেতে পারেন। আর মানবিকতার জন্য পেতে পারেন ওই পুলিশ কর্মী, যিনি ইউনিফর্ম পরে সিসিটিভি ক্যামেরাকে আড়াল করে রোজ দু’ বেলা বাড়তি ভাত, ডাল, তরকারি চুরি করেন এক পাগলির জন্য। আমাদের এই ইতরের দেশে চুরি করার জন্য টপ মন্ত্রী জেলে যায়। পাগলির জন্য ভাত চুরি করছে যে পুলিশ, তাকে পুরস্কার দেওয়া হোক।
পরদিন রবিবার সকালে ঠিক ৮টায় কথামতো হাসপাতালের এমআরআই সেন্টারে চলে গেছি। সঙ্গে নিয়ে গেছি সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট এবং প্লেট, ইউএসজি রিপোর্ট, এক্সরে প্লেট, আধার কার্ডের ফোটোকপি। সকাল থেকেই ভয়ানক রোদ। ৮টার সময় এমআরআই সেন্টারে গিয়ে দেখি সেন্টারের বাইরে ইতিউতি কয়েকজন নারী, পুরুষ, প্রৌঢ়, প্রৌঢ়া এবং একজন কিশোর বসে। আমি প্রথমে সেন্টারের ভেতরে গিয়ে বসলাম। সেখানে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। ঢোকার সময় একজন লোক, মাঝবয়েসি, চোখে সানগ্লাসের মতো শাদা চশমা, ধূসর লাল রঙের টি শার্ট, হাঁটু অবধি লম্বা বারমুডা পরা, সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গাগুলোর এককোণে বসে আছেন, তিনি হাত নেড়ে বললেন, ‘ভিতরৎ কাও নাই। কাও নাই।’ আমি তাও ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই ভেতরে কেউ নেই। এসির ঠান্ডায় ভেতরে বসে পড়লাম। হাসপাতালে তো আমাদের বেডের আশেপাশে পাখাও নেই। বাইরে এরকম ভয়ংকর রোদ। এসি-তে বসে আরামই লাগছিল। আমার ডানদিকে একটা ঘর আছে। বাঁ দিকে রিসেপশনিস্টদের চেয়ার, টেবল, কম্পিউটার, খাতা-কলম, কাগজপত্র। তার ওপাশে পাশাপাশি দুটো বাথরুম। একটা স্টাফেদের জন্য আরেকটা রুগিদের জন্য। সামনে এমআরআই-এর ঘর। সব ঘরের দরজাই বন্ধ। একটু পরে ডানদিকের সেই ঘর থেকে খসখস শব্দ শুনলাম। অনেকটা পাপোশে পা ঘষার মতো শব্দ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে শব্দটা হচ্ছে। বন্ধ দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরের আলোয় ছায়ার চলাচল দেখা যাচ্ছে। সেই আলো-ছায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ওই শব্দের রহস্য ভেদ করে ফেলা যায়। আমি বন্ধ দরজার বাইরে এপাশে বসে বুঝতে পারলাম, ঘরটির ভেতরে দরজার বিপরীতে একটি বড় চওড়া জানলা রয়েছে। জানলাটিতে ভারী পর্দা টাঙানো। কিন্তু পর্দাটি পুরো জানলাজুড়ে টাঙানো নয়। কিছুটা ফাঁক আছে। সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে দিনের আলো এসে ঢুকেছে বন্ধ ঘরটিতে। একটু আগেই আমি বাইরে থেকে এসেছি। সেখানে এতটুকু হাওয়া নেই। নিষ্কম্প সব গাছের পাতা। অথচ এই বন্ধ ঘরের খোলা জানলায় আধ-টাঙানো ভারী পর্দা হাওয়ায় দুলছে। তারই নড়াচড়ার খসখস শব্দ শুনছি আমি— যে শব্দকে কারুর পাপোশে পা ঘষার শব্দ বলে মনে হচ্ছে। বন্ধ দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে ওপাশের খোলা জানলার সেই আলো এবং পর্দার ছায়াই হাওয়ায় নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে— যা দেখে মনে হচ্ছে বন্ধ ঘরটিতে পাট ভাঙা নতুন শাড়ি পরে কেউ পায়চারি করছে। দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে যেন সেই মহিলার শাড়ির নীচের অংশের ছায়া দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম, খোলা জানলার বাইরে এসি-র ফ্যান রয়েছে। সেই হাওয়ায় দুলছে সংলগ্ন ভারী পর্দা।
একটু পরে স্টাফেদের ব্যবহারের জন্য বাথরুমের ভেতর থেকে মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল। সঙ্গে কমোডে ফ্লাশ করার শব্দ। কিছুক্ষণ বাদে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অল্প চাপদাড়ির এক যুবক। তিনি বললেন, ‘ঘর এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। একটু বাইরে গিয়ে বসুন। অফিসের লোকজন এখনও কেউ আসেননি। বাইরে অপেক্ষা করুন। সময় হলে ডেকে নেওয়া হবে।’ আমরা প্রত্যকেই সময়ের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। কবে তার সময় হবে। কবে সে আমায় ডেকে নেবে। তার ডাকার সময় কবে হবে। একেকজনের একেক অপেক্ষা। এত বড় হাসপাতালে, এতখানি জীবনে আমার যেমন একটিই ছোট্ট কিন্তু ত্রিশূলের তিনটি ফলার মতো সর্বদা জেগে থাকা একটিই তীক্ষ্ণ অপেক্ষা— পৃথা কখন আসবে। এমআরআই-এর জন্যে কখন আমাকে ডাকবে, কবে রিপোর্ট দেবে, কবে আমার ছুটি হবে এসবের অপেক্ষা কে করে? বিষয়, বাসনা, জগতের তুচ্ছ জিনিস আঁকড়ে পড়ে থাকে ঘোর সংসারী, বিষয়ী মানুষ। সে থাকুক। কিন্তু সাধকের অন্য পথ রয়েছে। বন্ধ দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে আসা আলো-ছায়া দেখে কেউ ভাববে পাপোশে পা ঘষার খসখস শব্দ। কেউ ভাববে তা নয়, এ আসলে বাইরের হাওয়ায় পর্দার নড়ে ওঠা। কেউ ভাববে এসবই মিথ্যে, ওই ছায়া আসলে পাট ভাঙা নতুন শাড়ি পরে কোনও নারীর অস্থির পায়চারি। আমি তাকাব জানলার বাইরে। যে পথে পৃথা আসবে। পৃথা কখন আসবে।
বাইরে শিলান্যাসে দেখলাম বিএমআরসি হাসপাতাল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই এমআরআই সেন্টারটি তৈরি। ১০ই জুলাই, ২০১৮ সালে এর উদ্বোধন করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সানগ্লাসের মতো দেখতে শাদা চশমা পরা সেই লোকটিকে দেখলাম বেশ রাজার ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাবেভাবে, শারীরিক ভাষায় বেশ যেন একটা ফুর্তির ভাব। চারপাশে যতই অভাব, বঞ্চনা, যন্ত্রণা থাক, সব কিছুকে ফুৎকারে তুচ্ছ করার একটা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি তার হাবেভাবে। তিনি বসে আছেন তাঁর ডান পা পাশের বসার জায়গাটির পিঠ হেলান দেওয়ার জায়গায় তুলে। তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে এক কিশোর। তিনি সেই কিশোরের আঙুল টেনে টেনে ফুটিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, বেশ জোরেই, মজা করার মতো নাটুকে ঢঙে— ‘হাসপাতাল মানে জানস? হাইসা বেড়াও আর পাতালে মিশে যাও।’
বাইরে প্রচণ্ড গরম। একটু পরে কাগজপত্র জমা নেওয়ার জন্য ডাক এল। এমআরসিপি-র জন্য হাসপাতালের হলুদ কাগজটি জমা দিলাম। আমার বাঁ হাতের চ্যানেলটি দেখে ওই যুবক বললেন, ‘আপনি ভর্তি আছেন?’ একটু পরে ওঁরা নাম ধরে ডেকে নিলেন। ওয়েট মেশিনে দাঁড়িয়ে ওজন করা হল। শরীরের ওজন এখন দাঁড়িয়েছে ৪৬ কেজি। রিসেপশনের যুবকটি বললেন, ইউএসজি এবং সিটি স্ক্যানের রিপোর্টেরও ফোটোকপি লাগবে। আমি এগুলোর অরিজিনাল কপি এনেছি। ফোটোকপি নেই। শুধু আধার কার্ডের ফোটোকপি আছে। রবিবার বলেই হাসপাতালের বাইরে আশেপাশের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। আউটডোরের উলটো দিকে পাশাপাশি দুটো জেরক্সের দোকান— যার মধ্যে একটি বন্ধ। আরেকটি দোকান খোলা থাকলেও জানা গেল সেই দোকানের মেশিন খারাপ হয়ে রয়েছে। হেঁটে হেঁটে গেলাম হেড পোস্ট অফিসের উলটো দিকে। রবিবারের সকালে গুটিকয় দোকান খুলেছে। পোস্ট অফিসের উলটো দিকের ফুটপাথে একটি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জেরক্স হবে?’ একটি কমবয়েসি ছেলে বলল, ‘হবে।’ আমি কাগজগুলো তার হাতে দিলাম। দোকানটির ভেতরে চোখ রেখে অন্যরকম লাগল। এই দোকানমালিকের অন্যরকম একটি রুচির ছাপ দোকানটিতে রয়েছে। ভেতরে বাঁ দিকের দেওয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড। তাতে কালো মার্কারে আঁকা দুটি মুখের অসমাপ্ত স্কেচ। সামনে একটু উঁচুতে আর্ট পেপারে লেখা, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ মাই কান্ট্রি অ্যান্ড সায়েন্স ইজ মাই রিলিজিয়ন।’ যদিও বিজ্ঞানকে ধর্ম মনে করা আর মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান মনে করা, দুটোই আরেক রকম গোঁড়ামির উলটো পিঠ। এই পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে রয়েছে ছায়াপথ, ধূমকেতু, অনন্ত নক্ষত্রবীথি। এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ? এই কসমসের অধিবাসী যে বিচিত্র জীবজগৎ, সে যদি শুধু পৃথিবীটাকেই নিজের দেশ বলে ভাবে, তাহলে কুয়োর ব্যাং ছাড়া আমি কী ভাবব তাকে? কিংবা কুয়োর জলে পড়ে যাওয়া এক ইঁদুর, যে ওই কুয়োর গোলাকার চক্রপথে ঘুরে ঘুরে ভাবছে এটাই তার কক্ষপথ। এটাই তার বিশ্ব পরিক্রমা। শূন্য থেকে শুরু হওয়া এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি একদিন যেকোনও মুহূর্তে শূন্যেই মিলিয়ে যাবে— তার আবার বিজ্ঞান, ধর্ম, মার্ক্সবাদ। এক ছিল জন্মান্ধ। তাকে কেউ একবাটি পায়েস খাইয়েছে। জীবনে প্রথম পায়েস খেয়ে সে তো মুগ্ধ।
বলে, এটা কী খেলাম? এ তো অপূর্ব!
বলা হল, এটা পায়েস।
পায়েস কী?
দুধ দিয়ে তৈরি হয়।
জন্মান্ধ বলল, আমি তো জন্ম থেকে অন্ধ। দুধ কখনও দেখিনি। সেটা কেমন দেখতে?
বলা হল, দুধ এক তরল পদার্থ, যা শাদা রঙের।
শাদা রংটা কীরকম? আমি তো জন্ম থেকে অন্ধ। শাদা রং কখনও দেখিনি।
বলা হল, শাদা মানে বকের মতো শাদা।
জন্মান্ধ বলে, আরে ধুর, বক আবার কীরকম দেখতে? আমি তো জন্মান্ধ।
বক হল অনেকটা লাঙলের ফলার মতো দেখতে।
জন্মান্ধ বলল, আমি তো কখনও লাঙলও দেখিনি। সেটা কীরকম?
তখন হাত ভাঁজ করে তাকে বোঝানো হল লাঙলের ফলা কীরকম আকৃতির হয়।
জন্মান্ধ তখন সেই ভাঁজ করা হাতটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলল, ও আচ্ছা, দুধ তাহলে এরকম হয়।
এই হল আমাদের বিশ্বকে বোঝার প্রয়াস। আমার বরাবরই মনে হয়, অনেকের কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়ার আছে। শুধু মানুষ নয়। পাখি, গাছ, টিকটিকি, প্রজাপতি, আরশোলা, গঙ্গাফড়িং, উইপোকা, পিঁপড়ে— অনেকের কাছে। ভূমিকম্পের খবর আগেই পেয়ে যায় পায়রা। ঝড়-বৃষ্টি আসার অনেক আগে টের পেয়ে যায় উইপোকা, পিঁপড়ে। মানুষের অনেক আগেই সুনামির খবর পেয়েছিল সমুদ্র উপকূলের হাতিরা। অথচ মানুষের নাকি অনেক বুদ্ধি। সে নাকি অনেক জানে। তার নাকি আছে কত জ্ঞান, বিজ্ঞান, দূরবীন। আসলে আমরা ওদের অনেক পরে এই পৃথিবীতে এসেছি। এসে, ওদের জায়গা দখল করে ওদের সরিয়ে দিচ্ছি। বলা হয়, পরমাণু বোমাও নাকি ধ্বংস করতে পারে না আরশোলাকে। আমাদের সবাইকে ক্ষমা চাইতে হবে এই জঘন্য অশ্লীলতার জন্য। আমাদের ক্ষমা চাওয়ার ছিল অনেকের কাছে। আমরা তা চাইনি।
দোকানের ভেতরে বাঁ দিকে একটা ক্লিপ বোর্ডে বেশ কিছু উদ্ধৃতি, কথা কাগজ দিয়ে সাঁটা। তার মধ্যে একটিতে লেখা, ‘ডোন্ট গেজ, প্লিজ আস্ক।’ এও আরেক বিভ্রান্ত করার মতো কথা। প্রশ্ন আমি কাকে করব? কে উত্তর দেবে? আমি কান কোথায় পাতব? সে কি আমার বুকের ভেতরের ক্রিস্টাল ডোরে নয়? প্রত্যক্ষ না অনুমান, কোন অভিজ্ঞতা আমাকে অনন্তের পথে নিয়ে যাবে, যে পথে পৃথা আসবে, যে পথে অভিজ্ঞতা নয়, বসে আছে অভিজ্ঞান। পৃথা কখন আসবে। এই প্রশ্ন আমি কাকে করব? কে উত্তর দেবে?
ভেতরে কয়েকটি শেলফে কিছু কাটুম কুটুম রাখা। দরজায় দেখলাম দোকানটির নাম লেখা— ‘শিল্পায়ন’। সঙ্গে ইমেল আইডি এবং জয়ন্ত বলে একজনের নামও লেখা। দোকানের ভেতরে মেঝেয় বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর গালে অনেকটা কালো দাড়ি। দেখে মনে হয় বয়স ৫০-এর আশেপাশে। তিনি একটি চিমটে দিয়ে একটি পথকুকুরের কান এবং গায়ের লোম পরিষ্কার করছেন। কুকুরটি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে শুয়ে আছে মেঝেতে। ভদ্রলোক একমনে তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁর নাম প্রসূন মজুমদার। জয়ন্ত আরেকজন। তাঁরা এই দোকানটি চালান। বললেন, ‘এটা একটা ওপেন স্পেস। যার ইচ্ছে হয় আসে। ওই হোয়াইট বোর্ডে ছবি আঁকে বা কিছু লেখে। ওই ছবিটা অসমাপ্ত ছবি। যিনি এঁকেছেন তিনি সম্পূর্ণ করে যাননি। পরে হয়ত কখনও এসে বাকিটা আঁকবেন। বা অন্য কেউও সেটা সম্পূর্ণ করতে পারে। না করলে এভাবেই থাকবে।’ এদের দোকানে দেখলাম, বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এদের আপডেট ডেইলি নিউজ পেপারের এজেন্সি নেওয়া আছে। আমি একটা সেদিনের আপডেট ডেইলি কিনলাম ৫ টাকা দিয়ে। আমি কোথায় থাকি, কী করি জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। শেল্টার ফর আর্বান হোমলেসে আমার থাকা, সর্বস্বান্ত অবস্থা, শারীরিক অবস্থা, বাড়ি এবং স্থায়ী ঠিকানা না থাকা এবং এসবের সঙ্গে আপডেট ডেইলিতে আমার একদা কাজ করার কথা শুনে ভদ্রলোক সপ্রশ্ন সন্দেহে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপডেট ডেইলিতে ছিলেন?’ কারণ আমার বাকি তথ্যগুলো যেগুলো আমাকে একজন ভিখিরি বলে সাব্যস্ত করে, সেগুলোর সঙ্গে আমার এই তথ্যটি অনেকটা বৈপরীত্যমূলক। আমি ভদ্রলোককে বললাম, আমার এই অসুস্থতা আমাকে আপনাদের সভ্য সমাজ থেকে আইসোলেটেড হওয়ার বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা তো চাইলেও বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় গিয়ে থাকতে পারি না। সমাজ, সংসার, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কর্তব্য, দায়িত্ব, সামাজিকতা— এগুলো পায়ে শেকল পরিয়ে রাখে। আমার অসুস্থতা এসব শেকল কেটে দিয়েছে।
যাদের এজেন্সি ওদের নেওয়া, যে সংবাদপত্রের— তারা যে চোর, আপনারা যে চোরের এজেন্সি নিয়ে রেখেছেন সেটা আর ভদ্রলোককে বললাম না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ’১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অবধি আমি আপডেট ডেইলি-র প্রধান কার্যালয় শিলিগুড়িতে নিউজ ডেস্কে সাব-এডিটর হিসেবে চাকরি করেছি। এই দু’ বছরে আমি ওদের সায়েন্স পেজের পাতাগুলো টানা সম্পাদনা করেছি— যে পাতায় বেশিরভাগ লেখাই থাকত আমার নিজের লেখা। কিছু লেখা লিখতেন পত্রিকার তৎকালীন অ্যাসোসিয়েট এডিটর রোশন যোশি, যিনি ২০২০ সালের জুলাই মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় প্রয়াত হন। ইউডি, মানে আপডেট ডেইলি আমাকে ওদের সায়েন্স পেজ সম্পাদনা করার জন্য টাকা দিত। লেখাগুলোর জন্য কিন্তু এক পয়সাও দেয়নি। অথচ লেখার জন্য টাকা দেওয়া সংবাদপত্রের নিয়ম। বিনে পয়সাতেই যদি লিখব তাহলে বেঁচে থাক আমার লিটল ম্যাগাজিন। টাকার কুমির প্রতিষ্ঠানের কাগজে ফ্রি-তে কেন লিখব? লেখক স্বপন গুহনিয়োগী আমাকে নিজে বলেছিলেন একবার, ‘না ভাই, ইউডি-তে লিখব না। ওরা টাকা দেয় না।’ ওই দু’ বছরে কবে, কোন তারিখে, কী কী শিরোনামে, কত শব্দের কটি লেখা ইউডি-র ওই সায়েন্স পেজে বেরিয়েছে— তার সম্পূর্ণ তালিকা করা খাতা আমি জমা দিয়েছিলাম পত্রিকার তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার প্রবাল চ্যাটার্জির কাছে। না, লেখার জন্য আমি আমার প্রাপ্য টাকা পাইনি। এরপরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওরা আমাকে স্যাক করে। ইমেলে পাঠানো চিঠিতে বলে, আন-অথরাইজড লিভের জন্য আমাকে বরখাস্ত করা হল। অথচ আমার নিয়োগপত্রে ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’-এ লেখা ছিল, পত্রিকা দপ্তর যদি আমাকে টারমিনেট করে তাহলে তার আগে তারা আমাকে শোকজ চিঠি পাঠাবে। আমাকে যথাযথ কারণ দর্শাতে হবে। যদি তা সন্তোষজনক না হয়, তাহলে ১৫ দিনের নোটিসে পত্রিকা আমাকে টারমিনেট করতে পারে। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, বকেয়া টাকা না মিটিয়ে তারা একটা চিঠি পাঠিয়ে টারমিনেট করে। এরপর ঠিক সাত মাস বাদে ’২০ সালের অগাস্ট মাসে তারা আমাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এবারে পোস্টিং হয় মালদায়, ইংরেজবাজার শহরে। এই পর্যায়ে আমি ২০২০ সালের অগাস্ট থেকে ২০২১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি অবধি, সাড়ে ন’ মাস চাকরি করি। শিলিগুড়িতে কাজ করার সময়, যেহেতু ওখান থেকে পত্রিকার মূল পাতাগুলো হয়, সেখানে বিজ্ঞানের পাতা ছাড়াও বিশেষ ক্রোড়পত্রের পাতা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খবর এবং পাতা, জেলার খবর এবং পাতা, পোস্ট এডিটোরিয়ালের লেখা এবং সেই পাতা এবং এর সঙ্গে নানাজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ও নানারকমের লেখার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। মালদায় গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লাম শুধু গৌড়বঙ্গে। কিন্তু মালদা খুব হ্যাপেনিং জায়গা। খবরের জায়গা থেকে বলছি। এই সময়ে মালদায় আমি নিউজ ডেস্কের কাজ ছাড়াও বেশ কিছু কপিও করেছি, যার মধ্যে কয়েকটা এক্সক্লুসিভও ছিল। এই কপিগুলোর জন্য এক টাকাও কিন্তু ওরা দেয়নি। ’২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ’২১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি অবধি, এই সাড়ে আট মাসে আমি ওদের অনলাইন নিউজ বুলেটিনের কাজও করে গেছি— যে কাজ শুরু হয়ে যেত ভোর থেকে। আর চলত রাত পর্যন্ত। মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে, রাস্তায় চলতে চলতে, বাজার করতে করতে, এমনকী বিয়ে করতে যাবার সময়েও অনলাইন বুলেটিনের কাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু ইউডি আমাকে এই সাড়ে আট মাস অনলাইন কাজের জন্য আট আনা পয়সাও পারিশ্রমিক দেয়নি। পুরোটাই ফ্রি সার্ভিস।
‘শিল্পায়ন’ থেকে ৭ অগাস্ট, ২০২২-এর আপডেট ডেইলি কিনে জানলাম, ধনকর উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। মমতার মন্ত্রীসভার দু’ নম্বর মুখ, রাজ্যের টপ মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে ক’দিন আগে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢুকে গেছে। দীর্ঘদিন সংবাদপত্র না পড়ার সুফল আমি এভাবেই উপভোগ করলাম। খবরের কাগজ পড়ে কী হয়? কাগজওয়ালাদের বড়লোক করা হয় শুধু। মার্গারেট থ্যাচার, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, যদি কাগজওয়ালারা ভুয়ো খবর ছাপে, আমি তা উপেক্ষা করি। আর যদি সত্য খবর ছাপে, তাহলে তা আমি আগে থেকেই জানি। তাহলে কাগজটা পড়ব কেন? ইউডি দেখলাম ‘ন্যায় চাই’—এই ক্যাপশনে গলা ফাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক বদলিতে দুর্নীতি নিয়ে অন্তর্তদন্তমূলক খবর ছাপতে শুরু করেছে ধারাবাহিকভাবে। যারা চোর মন্ত্রীর খবর ছাপছে, তারা নিজেরাই তো চোর। সেই যে ঋত্বিককুমার ঘটক ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’তে কবে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই হয় চোর, নয় তো বিভ্রান্ত।’
এরপর ২০২১ সালের মে মাসের মাঝখানে আমি হুট করে একদিন ওদের চাকরি ছেড়ে দিই। ঠিক দেড় বছর আগে ’১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওরা আমাকে হঠাৎ করে টারমিনেট করেছিল। অনেকটা সেভাবেই আমি হঠাৎ করে ওদের চাকরি ছেড়ে দিলাম। যেদিন আমি ওদের চাকরি ছাড়ি তার আগের দিনও আমার বাইলাইনে কয়েক কলামজুড়ে কপি বেরিয়েছে। ঠিক যেভাবে আমাকে তাড়ানোর আগে ওরা আমাকে কিছু বুঝতে দেয়নি, একইরকমভাবে ওদের তাড়ানোর আগেও আমি ওদের বুঝতে দিইনি। এই মধুর প্রতিশোধটা নেওয়ার জন্য আমাকে ঠান্ডা মাথায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওদের হাউজে ফিরে গিয়ে সাড়ে ন’ মাস টানা কাজ করতে হয়েছে। ইলেকশন কভার করতে হয়েছে। একের পর এক দায়িত্ব নিয়ে এবং সাফল্যের সঙ্গে টিম ওয়ার্ক করে ওদের বিশ্বাস এবং আস্থা যখন অর্জন করে ফেলেছি— ঠিক তখন এক সকালে আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠালাম। জানি, এতে ওদের কিছুই আসে যায় না। ওরা কোটিপতি পত্রিকা। টাকাপয়সার কোনও লেখাজোখা নেই। কিন্তু ওই যে সুমনের গান— ‘হাতির সামনে পিঁপড়ের দল/হেরে যাবি তবু হামলাই বল।’
বেলা ১১টা নাগাদ আমার এমআরসিপি পরীক্ষা হল। এমআরসিপি-র কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলে মনে হয় বিরাট এক শাদা ডিমের খোলসের ভেতর ঢুকে গেছি। আমার চোখের ওপর সেই ডিমের খোলস উপবৃত্তাকারে আমাকে ঘিরে রেখেছে চারপাশে। এই পরীক্ষায় প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বিকট শব্দে মাথা ধরে যায়। একমনে কিছু চিন্তা করার জন্যে ডিমের খোলসের ভেতর ঢুকে যাওয়ার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। এমআরসিপি-র কেবিনে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চারপাশ থেকে সমস্ত জগৎ মিলিয়ে গেল, থেকে গেল শুধু পৃথার চোখ দুটো— যে চোখ আমার দিকে তাকালে মনে হয় আমিই ফুটে উঠেছি তার চোখে। আমার মধ্যে সবসময় একধরনের স্থগিতভাব কাজ করে। জলের তলায় বিশেষ ফুসফুস নিয়ে ডুবে থাকা এক মানুষ যেন আমি। শক্ত শ্যাওলা পা পেঁচিয়ে রাখে প্রতিক্ষণে। প্রণয়প্রস্তাবের আগে যেমন হয়। স্বপ্নের ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার প্রাক্ মুহূর্তে যেমন হয়। যেন না ভাঙে ঘুম। স্বপ্ন বা ইচ্ছে পূরণের যন্ত্রণা যেকোনও ব্যর্থতার চেয়ে দ্বিগুণ। আমি পৃথার চোখের দিকে তাকাই কারণ সে চোখ আমার আমির দিকে তাকায়। এবং সরাসরি তাকায় দিনের আলোর মতো সহজ করে। আমি কথা বলে ওঠার আগেই আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতিকে টলমল করতে দেখি তার চোখের তারায়, যেখানে দরিয়ার দিশা থমকে আছে। যেভাবে আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষ আয়নার ফ্রেমের মধ্যে থাকা সবটুকু আয়নাকে সমর্পণ করে নিজের শরীর ও তার অবয়ব, আমিও তেমনি আমাকে সমর্পণ করেছি পৃথার দু’ চোখের ভেতর। অন্যরা সবাই কথা বলবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, তাকাবে আড়ে আড়ে। পৃথা তাকাবে সোজা। একদম তির এসে ঢুকবে হৃদযন্ত্রে, যেখানে একমাত্র ঈশ্বরের বৈধ অনুপ্রবেশ। অন্যেরা বলবে, ‘আপনি আগে ভর্তি ছিলেন না?’ কেউ বলবে, ‘কোথায় যেন দেখেছি। চেনা মনে হচ্ছে।’ কেউ বলবে, ‘আমাকে চিনতে পারছেন?’ এসব তারাই বলবে যারা স্বরলিপিতে সোজা আঘাত হানতে পারে না। পৃথা এরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার মেয়েই নয়। সে কথা বলবে মারোয়া রাগের মতো মীড়হীন। সে আমাকে হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই সরাসরি প্রশ্ন করবে, ‘আবার?’ আমি চিনতে পেরেছি কি পারিনি সেসবের পরোয়াই সে করবে না।
এমআরসিপি-র কেবিনের ভেতর শুয়ে আমি ভাবছি পৃথার চোখ দুটোর কথা। কী বলা যায় এই চোখকে? পাখির নীড়ের মতো? না, সেরকম নয়। পৃথার চোখ এক ইডিওগ্রাম— আ রিটন সিম্বল দ্যাট স্ট্যান্ডস নট ফর আ ওয়ার্ড অর সাউন্ড বাট ফর দ্য থিং ইটসেলফ ডায়রেক্টলি। যেন এক লিখিত বর্ণচিত্র। উদাসীনতার এই সময়ে ইতিহাসের গা ঘষটে যাওয়া আমাদের জিভ যখন কাশির ওষুধ চেটে নিতে শিখে ফেলেছে— তখন পৃথার চোখ থেকে আসা আলোক বিন্দু ফাঁসির দড়িটার ফাঁক গলে আরও বহুদূর আলোর কণাদের বিকিরণ করে যাচ্ছে, যাচ্ছে। আমরা সবাই নশ্বর। কিন্তু ওই আলো থেকে যায়। ঘুরতে থাকে আমাদের চারপাশে। অন্ধকার, নিঃসঙ্গ সুড়ঙ্গের পাশে শুয়ে থাকে সেই আলো। এরকম একটা কথা শোনা যায় যে, একমাত্র স্বপ্নেই আমরা নিজেদের দেখতে পাই। আয়নায় কিন্তু দেখতে পাই না। কারণ আয়নায় যেটা দেখি সেটা আমার ইমেজ। কথাটা কে বলেছিলেন জানি না। যিনিই বলে থাকুন, তিনি ঠিক কথা বলেননি। দোষ তাঁর নয়। কারণ তিনি পৃথার চোখ দেখেননি। দেখলে জানতেন, শুধু স্বপ্নে নয়, এ পৃথিবীতে পৃথার চোখের দিকে তাকালেও নিজেকে দেখা যায়। শুধু নিজেকে নয়, নিজের ভেতরটাও দেখা যায় সেই চোখে।
কিছুক্ষণ পরই এমআরআই প্লেট নিয়ে হাসপাতালে আমার বেডে ফিরে এলাম। এমআরসিপি সেন্টারে রিসেপশনের চেয়ারে পরের দিকে একটি মেয়ে এসে বসেছিল। কাগজপত্রের কাজ, রুগিদের নাম ধরে ডাকা— সে-ই করছিল। শিশু, সুন্দরী নারী, পশুপাখি এবং রাস্তাঘাট, গ্রামগঞ্জ ও হাটবাজারের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধুলোমাখা মানুষদের আমি একটু খুঁটিয়েই লক্ষ করি।
মেয়েটি এদিন পরে এসেছে হালকা হলদেটে সবুজ রঙের চুড়িদার। দু’ পায়ে রুপোলি নূপুর। কানে রুপোলি দুল। ঝুমকো নয়। মাথার পেছনে রুপোলি একটা ক্লিপ একরাশ কালো চুলকে আলগা করে ধরে রেখেছে। মেয়েটি এই অল্প সময়ে বেশ ক’বার হাসল। না হাসলে কথা বলার সময়ে সে একটু কাঠ কাঠ ধরনের। অল্প আড়ষ্ট। হাসলে সেই আড়ষ্টতা আলগা হয়ে যায়। বোধহয় অফিসে কাজের মধ্যে আছে বলে একটু কনশাস। কিন্তু হাসার সময়ে সে এই কনশাসনেসের কথা ভুলে যায় কিছুক্ষণের জন্য। হাসলে তার উজ্জ্বল দাঁতগুলো দেখা যায়। দেখা যায় দু’ পাশের সুন্দর গজদন্ত। হাত এবং পায়ের আঙুলের নখে তার উজ্জ্বল নীল রঙের নেলপালিশ। চোখে তার গোল বড় চশমা। মাঝেমাঝেই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে তাকে দুই ভুরুর মাঝখানে নাকের ডগায় চশমা চেপে ধরতে দেখা গেল। এটা হয়ত মেয়েটির মুদ্রাদোষ। অথবা হতে পারে এই চশমা সে নতুন পরছে। এখনও এতে অভ্যস্থ হতে পারেনি। কিংবা নিজের ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনের জন্যেও সে এরকমটা করে থাকতে পারে, যাতে তার চরিত্রে ও চেহারায় একটা সিরিয়াসভাব আসে। মনে হয়, এই মেয়েটির মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় একটি শিশুসুলভ ছেলেমানুষ বাস করে। মেয়েটি চায়, অফিসে সেই ছেলেমানুষি বেরিয়ে না আসুক। সে চায়, লোকে তাকে সিরিয়াসলি নিক।
হাসপাতালে প্রতিদিন একবার সকালের দিকে মাইকে ঘোষণা হয়, ‘বাচ্চাদের ওয়ার্ড থেকে বলছি। যাদের যাদের নাম বলব, তারা বাচ্চা নিয়ে এস। ছুটি আছে।’ এই বলে বাচ্চাগুলোর নাম বলতে থাকে। ইসমাইল হোসেন, সাদিক রহমান, মোনালি বিশ্বাস, দেবাযানী পাল, অভিজিৎ দত্ত, পরমজিৎ দাস, রাজু শেখ, রহমত আলি, রুমা সাহা, শুভজিৎ রায়। একেকদিন একেক জনের নাম। যিনি ঘোষণা করেন সেই সিস্টারের গলাও একদম একটা বাচ্চা মেয়ের মতো আদুরে আর মিষ্টি। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে যাঁরা কাজ করেন, দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করতে করতে, শিশুদের সঙ্গে মিশতে মিশতে তাঁদের মধ্যেও কি কিছুটা শিশুভাব চলে আসে? শিশুরা যেমন চারপাশ থেকে নানা জিনিস অতি দ্রুত তাদের মধ্যে নিয়ে নেয়, তেমনি অত্যন্ত নিঃশব্দে তারা তাদের ভেতরে থাকা বিশুদ্ধ পরাগরেণু ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। যারা তাদের সঙ্গে মেশে, তাদের হাতে তারা তুলে দেয় এই অপার ঐশ্বর্য। যারা সেটা একবার নিয়ে নেয়, তাদের আর শিশুত্ব থেকে মুক্তি নেই। তাদের আর কিছুতেই বড় হওয়া চলে না।
একদিকে বড়রা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরেকদিকে ছোটরা চোখে চশমা এঁটে বড় হতে চাইছে। কী সব ম্যাজিক চলছে চারপাশে। কত আশ্চর্য জিনিস চারপাশে। দুপুরে এবং রাতে হাসপাতালে খাবার দেন এক মহিলা, যাঁর ছেলের নাম পাখা, তিনি মনে করেন আমি তাঁর ছেলের বন্ধু। অথচ আমি পাখাকে চিনি না। তিনি এসে আমার কাছে পাখার গল্প করেন। হয়ত ঘরে গিয়ে পাখার কাছে করেন আমার গল্প। তিনি আমাকে তাঁর ছেলের বন্ধু ভেবে প্রতিদিন মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেন। শরীর কেমন আছে খোঁজ নেন। স্নেহ করে ভালোবেসে দুটো কথা বলেন। তিনি বিশ্বাস করেন আমি তাঁর ছেলে পাখার বন্ধু। আমার একটা বিছানা পরে বেড নম্বর এক্সট্রা ফোরের সেই প্রবীরকুমার দত্ত, যাঁর বাড়ি জিরানপুরে, তিনি তাঁর ভাঙা পা খুলে ব্যাগে ভরে রাখেন বলে বিশ্বাস করেন। আই রুমে আসা এক নতুন রুগি, তাঁর লুঙ্গির সঙ্গে আমার নতুন লুঙ্গির হুবহু মিল দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। এসবের মধ্যে ট্রলি বে-র ভেতরে একটা বেড়াল দুটো ছানার জন্ম দিয়েছে। মা বেড়াল গম্ভীর হয়ে বসে এ-পাশে ও-পাশে লেজ নাড়তে থাকে। আর ছানা দুটো সামনের দু’ পায়ের ছোট্ট থাবা দিয়ে মায়ের নড়তে থাকা লেজটা ধরার ক্লান্তিহীন চেষ্টা করে যায়। কিন্তু কিছুতেই পারে না। তারা ডানদিকে ঝাঁপালে লেজ চলে যায় বাঁ দিকে। তারা বাঁ দিকে ঝাঁপালে লেজ ডানদিকে ঘুরে যায়। কী গণ্ডগোল! মা বেড়াল কিন্তু সামনের দিকে মুখ করে চোখ বুজে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পেছনের এই খেলা সে দেখতে পাচ্ছে না। অথবা সে-ই হয়ত একমাত্র প্রাণি যে এই খেলার একমাত্র নিয়ন্ত্রক এবং অন্তর্যামীসুলভ পরম দর্শক।
মা বেড়ালের খেলা এই একটাই। চুপ করে চোখ বুজে গম্ভীর হয়ে বসে ডানদিকে বাঁ-দিকে লেজ নাড়তে থাকা। আর তার ছানা দুটো সেই লেজ ধরার জন্য জান লড়িয়ে দেবে। কিন্তু ধরতে পারবে না। মা বেড়ালের আদরের ধরনও একটাই। ছানা দুটো তার কাছে এলেই সে চোখ বুজে জিভ দিয়ে চেটে চেটে ভিজিয়ে দেবে একেবারে। ছানা দুটোর খেলার কোনও শেষ নেই। আমার চটির ভেতরে তারা প্রায়ই ঢুকে পড়ে। ছোট ছোট দাঁতে রাবারের স্ট্র্যাপ কামড়ে ধরে থাকে। আরশোলাকে চিৎ করে দূর থেকে তাকে থাবা দিয়ে নাড়তে থাকে। কাছে গিয়ে মুখে নেওয়ার সাহস কিন্তু নেই। কোনওভাবে আরশোলাটা এই চিৎ দশা থেকে মুক্তি পেয়ে সোজা হতে পারলেই এই শিক্ষানবিশ বেড়াল ছানার হাত থেকে ছুটে দৌড়ে পালাতে যায়। বেশি দূর পারে না। ছানা আবার তাকে ধরে ফেলে চিৎ করে দেয়। আরশোলা শূন্যে ঠ্যাং তুলে নড়তে থাকে। হয়ত বলে, বেড়াল, হয় তুই আমাকে খা। নইলে ছেড়ে দে। এভাবে চিৎ করে শুইয়ে রাখিস না। মাঝেমাঝে ছানাদের চলে আর্মি ট্রেনিং। ট্রলি বে-র বাইরে প্রায় ১০-১২-ফুটের উঁচু গ্রিল। ছানারা সেই গ্রিল বেয়ে পাঁই পাঁই করে উঠে যায় ওপরে। তারপর আর নামতে পারে না। ওপর থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে নীচে তাকাতে থাকে। কোনওমতে গ্রিলের দু’ চারটে ধাপ বেয়ে নামতেই একেবারে নীচে ধপাস করে পড়ে। আবার উঠতে থাকে সামনের দু’ পায়ে গ্রিল বেয়ে।
ক’দিন ধরে দেখছি ওই মাদি বেড়ালের বর, মানে ছানা দুটোর বাবাও এখন ওদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে। তিনি একেবারে স্পোর্টসম্যান। সে প্রথমে নিজের পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকাবে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একটা ছানার ওপর। তার ঘাড় কামড়ে চেপে ধরবে। ছানাটা চিঁ চিঁ করতে থাকবে। এই সময় মা বেড়াল রাগি মুখে তাকিয়ে থাকবে পুরুষ বেড়ালটির দিকে। এবারে ছানা আর পুরুষ বেড়াল দুজন দুজনকে পা দিয়ে জড়িয়ে মেঝের ওপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করবে। কখনও ট্রলি বে-তে রাখা বেলচার ওপরে শুয়ে থাকবে পুরুষ বেড়াল। কখনও ছানা দুটোর মতো মাদি বেড়ালের স্তন চেটে চেটে সেও আদর করবে আদর্শ প্রেমিক পুরুষের মতো। পুরুষ বেড়ালটির পাক খাওয়া দেখলে মনে হবে সে যেন এক ছৌ নাচের শিল্পী। ধনুকের মতো গোটা শরীর বাঁকিয়ে এমন করবে যেন একটা একলা ফার্স্ট ব্র্যাকেট। তারপর ওইভাবেই মেঝের ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে ঘুরতে শুরু করবে, ঠিক যেভাবে ছৌ শিল্পীরা দু’ পায়ে লাফিয়ে উঠে পাক খেয়ে ঘোরে।
আমার অপারেশন নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি। অন্যান্য মেডিকেল কলেজে যেভাবে ডাক্তাররা রুগিদের মনিটর করেন, এখানে সেটা সম্ভবত এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। এই হাসপাতাল খুব বেশিদিন হয়নি মেডিকেল কলেজ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। অন্যান্য মেডিকেল কলেজে, সাধারণ হাসপাতালের কথা কিন্তু বলছি না, মেডিকেল কলেজগুলোতে ডাক্তারদের ইউনিট ভিত্তিক রুগির চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের দায়িত্ব নেওয়া হয়। ধরা যাক, মেডিকেল কলেজে সার্জারি বিভাগে পাঁচটি ইউনিট আছে। প্রতি ইউনিটে বেশ কয়েকজন ডাক্তার আছেন। প্রতি ইউনিটের আছে একজন, দুজন সিনিয়র চিকিৎসক, যাঁরা প্রফেসর পর্যায়ে পড়েন। ধরা যাক, আমি সেই মেডিকেল কলেজে পুরুষ সার্জিক্যাল বিভাগে ভর্তি হলাম। এমার্জেন্সিতে ভর্তির সময় আমাকে দেখলেন ইউনিট ফোর-এর চিকিৎসকরা। আমি ওই মেডিকেল কলেজে এই ইউনিটের চিকিৎসকদের অধীনেই চিকিৎসা নেব। অন্য ইউনিটের ডাক্তারবাবুরা সকাল-বিকেল রাউন্ডে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়ে অন্য রুগিকে দেখে যাবেন— কিন্তু আমাকে দেখবেন না। আমি তাঁদের ইউনিটের অধীনে নই।
কিন্তু এই মেডিকেল কলেজে সব ইউনিটের ডাক্তারই আমাকে দেখছেন। আজ ইউনিট ফোর আমাকে দেখলে, কাল দেখছে ইউনিট টু। স্কুল জীবনে একই ক্লাসের বিভিন্ন সেকশনের মধ্যে একটা রেষারেষি যেমন ছিল, একটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন থাকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, লবি— মেডিকেল কলেজে ডাক্তারদের ইউনিটগুলোর মধ্যেও সেটা দেখা যায়। কিন্তু স্কুল জীবনে আমাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে না বলে সেখানকার রেষারেষি একটু চোখে পড়ার মতো। মিনমিনে বদমায়েশি একটু বেশিই সেখানে। আর রাজনৈতিক দলের নেতাগুলো বেশিরভাগই যাকে বলে ‘আংগুঠা ছাপ’, তাই তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব অনেক ন্যাংটোভাবে প্রকাশ্য। নোংরামি, দুর্নীতি, খেয়োখেয়ি, কূটনীতি সেখানে অনেক বেশি। কিন্তু অনেক লেখাপড়া করা ডাক্তাররা উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের স্রোত তাই খুব সূক্ষ্ম। আপাতভাবে চোখেই পড়ে না।
দুদিন আগে সন্ধেবেলা যে দুজন ডাক্তার আমাকে দেখতে এলেন, তাঁদের মধ্যে একজন লেডি ডাক্তার। দেখলাম তাঁরা দুজনেই আমার অপারেশন প্ল্যানিংয়ের ব্যাপারে কিছু জানেন না। আমি বলার পরে লেডি ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের পাতা উলটে দেখলেন। এবং তখন বিষয়টি জানলেন। যে ইউনিটের ডাক্তারবাবুরা আমার ওটি প্ল্যান করছেন, এঁরাও সেই ইউনিটের ডাক্তার হলে এমনটা হত না। এঁরাও জানত ওটি প্ল্যানের কথা।
সেদিনই, এর ঘণ্টাখানেক বাদে ওই দুই ডাক্তার অন্য একজন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমার বেডের সামনে দিয়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে ওই লেডি ডাক্তার সিনিয়রকে বলছেন শুনলাম, ‘প্ল্যান ফর ওটি’। সিনিয়র বললেন, ‘এলপিজে?’ মহিলা ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ, এলপিজে।’ এবার সিনিয়র জিজ্ঞেস করলেন, একটু ব্যঙ্গের সুরে, ‘কে করবে?’ মহিলা ডাক্তার বললেন, ‘জানি না’।
‘কে করবে?’ সিনিয়র ডাক্তারের এই প্রশ্ন করার ধরনের মধ্যে, প্রশ্নের সুরে, চোখের ভুরু তোলায় এমন একটা জিনিস ছিল, যাতে বোঝা যাচ্ছিল সিনিয়র ডাক্তার বলতে চাইছেন, ‘এখানে কে আছে যে এই অপারেশন করবে, এই সেট-আপের মধ্যে?’
এলপিজে হল আমার খুব সম্ভবত হতে যাওয়া অপারেশনটির টেকনিক্যাল নাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সেই দৃশ্যটা— যেখানে আসল ডাক্তার হাজরা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি টেলিপ্যাথির নাম শুনেছেন?’ এর উত্তরে সেই অফিসার বলছেন, ‘টেলিপ্যাথি? নো টেলিপ্যাথি। টেলিফোন ইয়েস। টেলিপ্রিন্টার ইয়েস। টেলিগ্রাম ইয়েস। টেলিগ্রাফ ইয়েস। বাট নো টেলিপ্যাথি।’ আমারও তেমনি বলতে হয়, এলপিজে? নো এলপিজে। এলপিজি ইয়েস। লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস—এলপিজি ইয়েস। বাট নো এলপিজে। হোয়াট ইজ এলপিজে? আমি জানি না।
সন্ধেবেলা এলেন আরেকজন ডাক্তার। ইনি হলেন সেই ডাক্তার যাঁকে আমি দিন কয়েক আগে বলেছিলাম ট্রামাডলের সঙ্গে পিসিএম অল্টারনেট করে চালাতে। আমার কথা শুনে যিনি চোখের তারায় হেসেছিলেন অল্প এবং পিসিএম দেওয়ার কথা লিখে দিয়েছিলেন প্রেসক্রিপশনে। সন্ধেয় তিনি এসে আমার সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখতে চাইলেন। রিপোর্ট দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যথা আছে কিনা। ব্যথা কমেছে এটা জানানোর পাশাপাশি আমি তাঁকে জানালাম এদিন এমআরসিপি টেস্ট হয়েছে। রিপোর্ট ক’দিন পরে দেবে। ডাক্তার বললেন, ‘ব্যথা যখন কমেছে তাহলে আপনাকে ডিসচার্জ করে দিচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে প্ল্যান ফর ওটি ক্যানসেল?’
‘প্ল্যান ফর ওটি? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, আপনার হাতের প্রেসক্রিপশনে দেখুন। সেরকমই তো লেখা আছে।’ আমি বললাম।
প্রেসক্রিপশন দেখে ডাক্তার বললেন, ‘ঠিক আছে। তাহলে থাকুন।’ এই বলে তিনি পুলিশ সেলের রুগিদের দেখতে এগিয়ে গেলেন। তাঁদের দেখে যখন তিনি আমার বেডের সামনে দিয়ে আবার নার্স রুমের দিকে যাচ্ছেন, তখন আমি তাঁকে ডাকলাম। বললাম, ‘একটু কথা বলা যাবে?’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘দেখুন’, আমি বললাম, ‘আমি মেডিকেল সায়েন্সের স্টুডেন্ট নই। এলপিজে কী আমি জানি না। আপনাদের একজন ডাক্তার বলছেন হায়দরাবাদ গিয়ে স্টেন্ট নিতে। কেউ বলছেন ইআরসিপি করাতে। একজন বলছেন ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে ওষুধের ওপর থাকতে। আর ব্যথা হলে হাসপাতালে চলে আসতে। একজন বলছেন পিজিতে এসজিএলডি-তে যেতে। আপনি এখন ছুটির কথা বলছেন। দুদিন আগে আমাকে আরেকজন ডাক্তার অপারেশনের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলে গেছেন। আপনাদের কথাবার্তায় আমি কনফিউজড। একজন ডাক্তার হিসেবে আপনি কী বলেন? আপনার সাজেশন কী? আমার কী করা উচিত?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী সেই যুবা চিকিৎসক বললেন, ‘দেখুন, একেকজন ডাক্তার একেকটা প্রোটোকলে চিকিৎসা করেন। যিনি আপনার অপারেশনের জন্য প্ল্যান করেছেন, তিনি কিছু একটা ভেবে করেছেন। আমি চাইছি আপনাকে ছুটি দিতে। এর বাইরে আমার কোনও পার্সোনাল ওপিনিয়ন নেই।’
এ তো আচ্ছা গ্যাঁড়াকলে পড়া গেল। ‘বেশ’, আমি বললাম। ‘আপনি তাহলে বাকি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে আপনাদের সর্বসম্মত একটা অ্যাডভাইস এনে আমাকে দিন। হোয়াট ইজ টু বি ডান? কী করতে হবে? কোনও একজন চিকিৎসক বা একটা ইউনিটের মত নয়। যেহেতু একাধিক ইউনিটের চিকিৎসক আমাকে দেখেছেন, আমি তাই তাঁদের সর্বসম্মত মতামতটাই জানতে চাই।’
সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী যুবা চিকিৎসক বললেন, ‘আগামী কাল সন্ধেয় রাউন্ডে এসে আপনাকে এটা বলব। আমি সিনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কিন্তু মনে করাবেন আমাকে।’
সেই রাতটা ছিল রবিবারের রাত। রাতে একের পর এক দুর্ঘটনাগ্রস্ত রুগির লাইন লেগেই রইল। এটা আগের রবিবারেও লক্ষ করেছি। শ্রাবণ মাসে শিবভক্তদের একটা হিড়িক পড়ে। রবিবার রাতে তারা যাত্রা শুরু করে। সোমবার ভোরে কোনও শিবমন্দির, কাছেপিঠে যেমন বাণেশ্বর, সেখানে জল ঢালে। অনেকেই নেশাগ্রস্ত থাকে রাতভর যাত্রার সময়। আর অ্যাক্সিডেন্টগুলো তখনই হয়। গেরুয়া গেঞ্জি আর গেরুয়া বারমুডা পরা একের পর এক ভক্তেরা মন্দিরের বদলে হাসপাতালে আসতে থাকে। আমার পরের যে বিছানা দুটো খালি ছিল, সেখানেও নতুন মানুষ এল। এঁরা অবশ্য ভক্তের দলের লোক নন। প্রথমে রাত ৯টা নাগাদ বেড নম্বর এক্সট্রা ফোরে এলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। রাজারহাটে বাড়ি। রাস্তা পেরুতে গিয়ে বাইক মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। বেড নম্বর এক্সট্রা থ্রিতে অনেকটা রাতের দিকে এলেন আরেক মাঝবয়েসি তরুণ। পেটে যন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হলেন তিনি। এঁর বাড়ি চকচকা নীলকুঠিতে। পেশায় গাড়িচালক।
সিটি স্ক্যানের ঘরের সামনে থেকে বারান্দাটা পুলিশ সেল, আই রুম, এক্সট্রা বেড, ট্রলি রাখার জায়গা— এগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হেঁটে এসেছে নার্স রুমের কাছে। সেখান থেকে একেবারে ডানদিকে ঘুরে আবার চলে গেছে সোজা। এবারে তার সঙ্গে চলেছে পুরুষ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ঘর আর ওদিকের বারান্দার বেডগুলো। এই পুরো রাস্তায় দু’ জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। যদি ক্যাপিটাল রোমান লেটারে ‘L’ বর্ণটিকে ভাবা যায়— তাহলে তার উল্লম্ব রেখা এবং আনুভূমিক রেখার কৌণিক বিন্দুতে আমাদের নার্স রুম। আনুভূমিক রেখার ডানদিকের শেষ মাথায় সিটি স্ক্যানের ঘর। ওখানে আছে রাশিয়া। আর উল্লম্ব রেখাটি ধরে সোজা হাঁটতে শুরু করলে বাঁ হাতে পড়বে পুরুষ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ঘরগুলো। কৌণিক বিন্দুতে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, যার মুখ উল্লম্ব রেখার দিকে। আনুভূমিক রেখার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে দ্বিতীয় সিসিটিভি ক্যামেরা— এর মুখ সিটি স্ক্যানের ঘরের দিকে। এই ক্যামেরা পুলিশ সেলের অংশটি পুরোটা কভার করছে। কিন্তু এই ক্যামেরার পেছনেই রয়েছে এক্সট্রা বেড ৪, ৩ এবং ২। এক্সট্রা বেড ৪ থেকে নার্স রুমের দরজা অবধি জায়গাটি সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে নেই। অর্থাৎ আমি সার্ভেইলেন্সের বাইরে বসে এই লেখা লিখছি।
সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারির কথা উঠলে অত্যন্ত চমৎকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। আমরা যখন আপডেট ডেইলিতে জয়েন করি তখন আমাদের নিউজ রুমে ক্যামেরার নজরদারি ছিল না। হঠাৎ একদিন দেখি নিউজ রুমে ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। অ্যাসোসিয়েট এডিটর রোশন যোশি, যাঁকে সবাই ‘স্যার’ বললেও আমি বলতাম ‘রোশনদা’, তিনি বললেন, ‘বুঝলি রে, ভালোই হল’।
‘কী ভালো হল?’
‘এই যে এবার থেকে হাসতে হাসতে শুয়োরের বাচ্চা বলা যাবে।’ রোশনদা বললেন।
কথাটা ঠিকমতো ধরতে পারিনি প্রথমে।
রোশনদাই বোঝালেন, বললেন, ‘বুঝলি না? সিসিটিভি ক্যামেরায় শুধু ভিডিওটা থাকে। অডিও নেই। তাই হাসতে হাসতে শুয়োরের বাচ্চা বললে কেউ ধরতে পারবে না। সবাই দেখবে আমার হাসিমুখ।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘এর কারণটা কী জানিস?’
কীসের কারণ? সেটাও ব্যাখ্যা করলেন তিনিই।
বললেন, ‘এই সিসিটিভি ফুটেজে শুধু ভিসুয়াল থাকে। অডিও থাকে না। তার কারণ হল, কর্তৃপক্ষ জানে তারা বধির। আমাদের কোনও কথা কোনওদিনই তাদের কানে যাবে না। তাই তারা এতে অডিও সিস্টেমটা শুরু থেকেই রাখেনি। খরচ বেঁচে গেছে। আবার এমনও হতে পারে, কর্তৃপক্ষ হয়ত ভাবে আমরা সবাই বোবা। আমাদের আলজিভ কাটা। সেজন্যে তারা শুধু শুধু অডিও রাখার ঝামেলাই করতে যায়নি। ঠিকই করেছে। বোবা লোকের সামনে অডিও রেখে কী হবে। আবার তৃতীয় একটা সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটা হল, হয়ত এই দুটোই সত্যি। কর্তৃপক্ষও বধির এবং আমরাও বোবা।’
শেষমেশ যখন সিসিটিভি ক্যামেরা বসল আমাদের নিউজ রুমে, তখন দেখা গেল একটা বড়সড় গোলমাল হয়ে গেছে ক্যামেরা বসানোয়। পুরো নিউজ রুম, স্পোর্টস সেকশন, নিউজ ইনচার্জের টেবল, সাব এডিটরদের সবক’টা ডেস্ক, অ্যাসোসিয়েট এডিটরের ডেস্ক, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এমনকী প্রুফ সেকশনও এতে কভার করছে। শুধু সাব এডিটরদের একটা রো-তে পাশাপাশি পরপর তিনটে ডেস্ক কী এক অদ্ভুত কারণে ক্যামেরায় আসছে না। সেই তিনটে ডেস্কের একটাতে বসতাম আমি। আমার ডানদিকে পরপর আরও দুজন। আমরা তিনজন গোটা নিউজ রুমে ক্যামেরার সমস্ত নজরদারির বাইরে। কী আশ্চর্য। সেটাই হল কথা। বাসরঘরে কোন ফাঁক দিয়ে যে কালকেউটে ঢুকবে, প্রতিষ্ঠান এখনও তা জানতে পারেনি।
কর্তৃপক্ষ কী ভাবে, প্রতিষ্ঠান কী জানে, আমি জানতে আগ্রহী নই। হাসপাতালে আমার বিছানার উলটো দিকে যে বেড়ালটা দুটো ছানার জন্ম দিয়েছে কদিন আগে— সেই বেড়ালটা সারাদিন গম্ভীর হয়ে চোখ বুজে বসে কী ভাবে, কী চিন্তা করে; কিংবা আমার বেহালার বাক্সে যে ছোট্ট সোনালি মাকড়সাটা কোনওভাবে ঢুকে পড়েছে, সে ওই বাক্সের লাল ভেলভেটের ওপরে সারাটা দিন-রাত বসে বসে কী ভাবে— ওদের চিন্তাজগৎ, ওদের ভাবনা জানতে আমি আগ্রহী। আমি জানতে আগ্রহী, পৃথা কখন আসবে। ক’দিন পর থেকে পৃথার সঙ্গে আর দেখা হবে না। অথবা হয়ত চিরদিন হবে। পৃথা কে? সে কি সেই মেয়েটা যাকে আমি হাসপাতালে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে নার্সের পোশাকে দেখেছি? নাকি সে অন্য কেউ, যাকে আমি আমার ভেতরে তৈরি করেছি। আমিই জন্ম দিয়েছি।
পরদিন সন্ধেবেলা সিনিয়র ডাক্তার এলেন। সঙ্গে সেই সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী যুবা ডাক্তার। সব রিপোর্ট দেখে, আমার কেস হিস্ট্রি শুনে তিনি এখন অপারেশন না করার পক্ষেই মত দিলেন। ক্যালসিফিকেশনটা মেইন প্যাংক্রিয়াটিক ডাক্টে নেই। এর মাপও তুলনায় ছোট, চার এমএম। তিনি বললেন, ‘সাত এমএম পর্যন্ত আমরা নর্মাল বলি। অ্যাবনর্মাল হয় সাত এমএম-এর ওপরে হলে। তখন এলপিজে সার্জারির কথা ভাবা যেতে পারে। এখন ওষুধের ওপরেই থাকুন। ফ্যাটলেস ডায়েট করবেন। অল্প করে খাবেন। ক্রেয়ন চলুক তিন বেলা করে। তারপরেও ব্যথা হবে না তা নয়। মাঝেমাঝেই হবে। তখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এটা টাইম টেকিং ব্যাপার। এখন অপারেশনে যাবেন না।’
(ক্রমশ)
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক