
ধারাবাহিক উপন্যাস
কবরপুরাণ
হিন্দোল ভট্টাচার্য
নতুন উপন্যাস। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে সাত দিন অন্তর। লেখকের এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। যেখানে গল্প একটি ছদ্মবেশ। কাহিনি একটি মায়াবী পোশাক।
‘তার পর, তো যুদ্ধ শুরু হলো। সে যে কী ভীষণ যুদ্ধ! আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল, সমুদ্রে তুফান উঠল। ঘনঘন বজ্রপাত হতে লাগল। শোঁশোঁ করে বাতাস বইতে শুরু করল চারিদিকে। বানরসেনাদের তাণ্ডবে লঙ্কার সেনারা প্রায় পর্যুদস্তই হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখনই শুরু হলো এই মহাযুদ্ধের সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায়। আকাশে মেঘের আড়াল থেকে মেঘনাদ যুদ্ধ শুরু করলেন। ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে পড়ল বানরসেনাদের মধ্যে। রাম ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না প্রথমে, যে কোথা থেকে কে যুদ্ধ করছে। তার পর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হলো। তখন যুদ্ধের শেষ প্রহর। সেই দিনের যুদ্ধে আপাতত জিতলেন মেঘনাদ।”
এই পর্যন্ত বলে তিলকেশ্বর একটু থেমে তাকালেন বাইরের তীব্র রোদের দিকে। তিলকেশ্বর। এই নামটা বেশ অদ্ভুত। আসলে গ্রামের একটি স্কুলের মাস্টারমশাই। গৌড় থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি গ্রাম সিংহপুর। সেখানকার উচ্চমহাবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। তবে অবসর নেবেন আর এক মাসের মধ্যে। অর্থাৎ বয়স ষাট। কিন্তু দেখতে সত্তরের কাছাকাছি। তিলকেশ্বরের নাম তিলকেশ্বর কেন,এ বিষয়ে এলাকার সকলের মনে প্রচুর কৌতূহল। নানা লোকে নানা কথা বলে। কেউ কেউ বলেন তিল থেকেই আতিলোকেশ্বর। আবার কেউ কেউ বলেন, আসলে কেউ হয়তো নাম দিয়েছিলেন ত্রিলোকেশ্বর। সেটাই তিলকেশ্বর হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তিলকেশ্বরবাবুকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলেন, নামে কী এসে যায়। আমার মা যা উচ্চারণ করতেন, তা-ই আমার নামের বানান। এখন এই নামের যে অর্থ তোমরা কল্পনা করার, তা করে নিতে পারো।
তিলকেশ্বর এরকমই। মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে গিয়ে শুরু করেছিলেন ছাত্রছাত্রীদের রামায়ণের গল্প বলা। কিন্তু তার মধ্যে মিশে ছিলেন তিনি নিজে। তাঁকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই যে আপনি আপনার রামায়ণ শোনাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের কচি মাথায় তো রামায়ণের গল্প বলতে আপনার গল্পই গেঁথে যাবে।
তিলকেশ্বর চুপ করে বললেন, ভাই, রামায়ণ তো গল্পই। না হয় এটা আমার গল্প। সব গল্পই বলতে বলতে ইতিহাস হয়ে যায়। মানুষের স্মৃতি উদ্ধার করতে পারে না কোনটা ইতিহাস নয় আর কোনটা ইতিহাস। কিন্তু আসলে তো এগুলি সাহিত্য। না হয় আমার গল্প হলো।
তিলকেশ্বর অকৃতদার। গ্রামের উচ্চমহাবিদ্যালয়ে পড়িয়ে বাড়ি ফেরেন। স্বপাকে খান। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতোই তিনি নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট। শোনা যায়, সাতের দশকে তরুণ বয়সে বেশ কয়েকবার ধরাও পড়েছিলেন। তখন তাঁর বাবা মা বেঁচে। ছোটোভাইটার আরও কম বয়স। সেই সময় পুলিশ তাকে বারবার তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অত্যাচারও হয়েছে অনেক। আর সেই অত্যাচারের ফলে তিনি হারিয়েছেন বাঁ হাতের আঙুলগুলোর শক্তি।
তিলকেশ্বরের ঈশ্বরবিশ্বাসী বাবা এবং মা-এর প্রার্থনার কারণেই হোক অথবা ঘটনাক্রমিকতার প্রভাব, তিলকেশ্বর প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যে প্রাণে বেঁচে গেছেন, এই বিষয়টি অনুভব করতে করতেই তিনি একটা সময় একদম চুপ করে যান। যে ব্যক্তিকে দেখা যেত সব বিষয়ে মুখর, সেই ব্যক্তি আর কোনও বিষয়েই খুব একটা থাকেন না। এমন চলছে প্রায় চল্লিশ বছর। সময়ের নিয়মে হারিয়েছেন সকলকেই। পুরোনো আমলের সেই বাড়িতে পড়ে আছেন তিনি একা। ভাই তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন সেই ক্যালিফোর্নিয়ায়। সুবীর। তাঁর স্ত্রী মৌ, তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে। কেউই গত কুড়ি বছরে আর বিশেষ আসেন না এদেশে। দু বছর আগে পুজোর সময়ে এসেছিলেন সুবীর। ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ব্যস্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকা বললেই যে এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব মনের মধ্যে জেগে উঠত আগে তিলোকেশ্বরের, এখন আর তা নেই। আমেরিকা মানেই এখন সে জানে প্রবল ভাবে দুঃখের একটা দেশ। তিলকেশ্বরের সামনে দেখতে দেখতে এই বাংলাও যে ছোটো ছোটো আমেরিকা হয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারে। সেদিন চায়ের দোকানে বসে পাড়ার নির্মলেন্দুবাবু বলছিলেন, ” আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে…” তিলকেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, – এই সব তৃতীয় বিশ্বের ধারণা আর দুহাজার তেইশে চলে না। এখন সব বিশ্বই একটা সুতোয় চলে এসেছে।
‘কী সব যে বলছ তুমি বুঝতে পারি না মাঝেমাঝে’
তিলকেশ্বর নিজেও যে বুঝতে পারেন এমনটা নয়। আগে মনে হতো এই পৃথিবীটা জটিল। এখন মনে হয়, পৃথিবীটা জটিল নয়, আমাদের মনটাই জটিল। আকাশের পাখিগুলো কি উড়তে উড়তে মুঘল যুগে চলে যায়? তিলক মানে তিলকেশ্বরের ডাক নাম, বুঝতে পারে না, যাবে নাই বা কেন? বরং আজকাল প্রত্যেক পাখি দেখলেই তার মনে হয় সময়ের এক প্রান্ত থেকে উড়তে উড়তে চলে এসেছে।
পাখিদের মৃত্যু হয় না।
পাখিরা অবিনশ্বর। পাখিদের মৃত্যু হলে তবুও পাখিরা থেকে যায়।
কিন্তু একদিন সত্যিই পাখিদের মৃত্যু হলে, এ পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিলক জানে, তার মাথার ভিতরে মাঝেমাঝে হানা দেয় ভূত।
এ ভূত যেমন তেমন ভূত নয়।
এই শহরের মধ্যে, আধা-শহরের মধ্যে কত যে লাশ ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়, তার ইয়ত্তা নেই।
চোখের সামনে সব কিছুই পালটে গেছে তার। প্রথমে মোবাইল নিতে না চাইলেও এখন মোবাইল নিয়ে আর ল্যাপটপ নিয়ে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই হয়েছে বেশি।
একাকী, পুরোনো বাড়ির ভাঙা বারান্দাতে বসেই সে এখন চলে যেতে পারে আফ্রিকার জঙ্গলে।
ভিডিও কলে কথা বলতে পারে সুবীর আর সুদেষ্ণার সঙ্গে।
আর লিখতে পারে নিজের আগডুব আগডুম কথা। যে কথাগুলো আগে প্রায় কেউই শুনত না।
চোখের সামনে মৃত্যুর একাধিক ঘটনা নিয়ে লিখতে লিখতে সে নিজেই বুঝতে পেরেছিল, মৃত্যু একটা ক্ষণিকের আশ্চর্য ট্রানস্ফর্মেশন।
যে বদলে যাওয়ার কোনও ফিরে আসা নেই।
কিন্তু শহর গ্রাম মানুষের মতো মরে না। শহরের লাশের উপর গড়ে ওঠে আরো একটা শহর। লোকে এই সিংহপুর গ্রাম সম্পর্কে বলে বহুদিনের পুরোনো। কত শতাব্দী আগে থেকে যে এই গ্রাম রয়েছে, তা কেই বা জানে!
কিন্তু এই গ্রাম যে কতবার মারা গিয়েছে, তার খবরই বা কে রাখে! পৃথিবীও আসলে মরে যায়। বারবার। তা না হলে হিরোশিমার পরেও বেঁচে থাকত না। তার নবজন্ম হয়। একই জন্মে কত বার মরে যাওয়া। কত বার জন্ম নেওয়া।
এত স্মৃতি কি থাকে আমাদের?
যেমন এই গ্রামেরই মনে নেই হয়তো একটা সময় গোটা গ্রামটাই পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। তখন এখানে জমিদার রাজ। জমিদার রাজনারায়ণ সিংহ। যাঁর অত্যচার ইংরেজদেরকেও হার মানাবে।
তিলকেশ্বরের মাস্টারমশাই শ্রীগুরু পণ্ডিত বলতেন, বিদেশি শাসকদের চেয়ে যখন দেশের শাসকরা হাতে ক্ষমতা পায়, তখন তার অত্যাচার সীমাহীন হয়ে পড়ে। তার পর তিনি বলেছিলেন, আসলে শাসকের কোনও সাদা-কালো চামড়ার পার্থক্য নেই রে। শাসকের কোনও ধর্মও নেই। শাসক হলো শাসক।
শ্রীগুরু পণ্ডিতকে হত্যা করেছিল সাত দশকের কমিউনিস্টরা। যারা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তখন চামড়া তুলে নিয়েছিল মানুষের। সিংহপুর গ্রাম পরিচিত ছিল নকশালদের ঘাঁটি হিসেবে।
এক রাতে গ্রাম পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়।
কিন্তু সিংহপুর গ্রাম তাতেও মরে যায়নি। লোকে বলে, সিংহপুর গ্রাম আসলে সিংহপুর গ্রামের ভূত।
অন্ধকার এই পোড়ো বাড়িতে বসে বসে তিলকের মাঝেমাঝে মনে হয়, সে আসলে একটা ভূতের গ্রামে বুড়ো হচ্ছে। পুকুরের ভূত, জলার ভূত, আমগাছের ভূত, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের ভূত, ভূতের বিয়ে হচ্ছে অন্য পেত্নীর সঙ্গে। ভূতেদের জন্য হাইরোড, পোস্ট অফিস। এমনকি ভূতেদের জন্য ভোট।
এই ভয়েই হয়তো বাইরে থেকে খুব একটা কেউ আসে না সিংহপুর গ্রামে।
এই দুহাজার তেইশ সালে এসেও, খুব গভীর রাত্রিবেলা মনে হয় জেগে উঠেছে একশ বছর বা দুশ বছর আগের গ্রাম।
তিলক বুঝতে পারে, এ গ্রাম আসলে বারবার জন্ম নিয়েছে। বারবার মরে গেছে।
গভীর রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন তিলক। আকাশে চাঁদ। কেমন বিষণ্ণ হয়ে লটকে আছে। যেন সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারছে না। কিন্তু চলে গেলেই ভালো হতো, এমনটাই মনে হয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একলা অন্ধকার পুরোনো বাড়িটার দিকে তাকালেই এমন একটা মায়া আসে তিলকের মনে।
তিলক আর একটু দূরে চলে যায়।
গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে। সেখানে একটা কবরখানা আছে। পুরোনো কবরখানা। মুসলমানদের কবরখানা। যদিও গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম। আশেপাশের যে সব গ্রাম, সেখানেও মুসলমান খুব একটা নেই। হয়তো চার পাঁচটা গ্রামের পর যে টাউন, সেখানে মুসলমান থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁদের এই কবরখানার কাছে এলে তিলকের মন কেঁপে ওঠে।
ঝোপঝাড়ে ভর্তি কবরখানা। অদ্ভুত একটা শ্যাওলার গন্ধ চারিদিকে। গ্রামের লোক খুব একটা এদিকে আসে না। তিলক ছোটোবেলা থেকেই দেখছে এই পরিত্যক্ত কবরখানাটিকে। এই এলাকার কোনও উন্নয়ন হয়নি। কবরখানা নিয়ে কারো কোনও কৌতূহল নেই। ভিতরে একটা ভাঙাচোরা মাজারও রয়েছে। কিন্তু ঝোপঝাড় ভেদ করে সেই মাজারের কাছে যায়নি কেউ। সাপ-খোপে ভর্তি। এই অন্ধকার রাতে তিলকেরও মন কেঁপে উঠছিল। এত মানুষের কবর রয়েছে যখন, তখন নিশ্চয় একটা সময় এরা জীবিতই ছিলেন।
কোথায় ছিল তাঁদের বাড়ি? তাঁদের উত্তরপুরুষেরাই বা কোথায় গেলেন?
এ প্রশ্নের উত্তর শ্রীগুরু পন্ডিতও দিতে পারেননি।
শুধু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, সব ইতিহাস জানা যায় না তিলক। কিছু কিছু ইতিহাস একেবারেই হারিয়ে যায়।
তুমি শুধু তাকে খুঁজে যেতে পারো।
(ক্রমশ)
লেখাটি ভালো লাগলে, আবহমানের জন্য আপনার ইচ্ছেমতো অবদান রাখতে পারেন
এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে ফোন পে-র মাধ্যমে।
এই অবদান একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়। ফোন পে বা গুগল পে- 9051781537
স্ক্যান করার জন্য কিউ আর কোড–
আরম্ভ চমৎকার। শহর গ্রামের শবের উপর গড়ে ওঠে নতুন শহর ও গ্রাম। সেও মরে, জন্মায়। হিন্দোল প্রকৃত ঔপন্যাসিকের মেজাজে শুরু করেছেন। পড়ে যাব।