দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রের কবিতা <br /> ভাষান্তর ও ভূমিকা- হিন্দোল ভট্টাচার্য

দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রের কবিতা
ভাষান্তর ও ভূমিকা- হিন্দোল ভট্টাচার্য

দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রে (ডি আর বেন্দ্রে বা দা রা বেন্দ্রে) বিংশ শতাব্দীতে কন্নড় ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি। কন্নড় ভাষার অন্যতম মহৎ কবি হিসেবে স্বীকৃত। কন্নড় সাহিত্যের 'নবোদয়' আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এই কবি। কন্নড় ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পূর্বতন বম্বে প্রেসিডেন্সি নামে খ্যাত উত্তর কর্নাটকের ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের প্রথমদিককার কিছু কবিতা ইংরেজি থেকে অনূদিত হল। ভাষান্তর ও ভূমিকায় হিন্দোল ভট্টাচার্য।

দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রে (ডি আর বেন্দ্রে বা দা রা বেন্দ্রে) বিংশ শতাব্দীতে কন্নড় ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি। কন্নড় ভাষার অন্যতম মহৎ কবি হিসেবে স্বীকৃত। কন্নড় সাহিত্যের ‘নবোদয়’ আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এই কবি। কন্নড় ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পূর্বতন বম্বে প্রেসিডেন্সি নামে খ্যাত উত্তর কর্নাটকের ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে জন্ম এই কবির গীতিকবিতা দক্ষিণ ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। উত্তর কর্নাটকে প্রচলিত ধারোয়া কন্নড় বা দেশি কন্নড় ভাষাকে তিনি তাঁর কবিতার মধ্যে, গানের মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন। সেই ভাষাতেই লিখতেন। আঞ্চলিক ভাষাকে এভাবে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত এক ভাষার আঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার করাও খুব একটা দেখা যায় না। ২৬ অক্টোবর, ১৯৮১ সালে তাঁর প্রয়াণ হয়।

প্রথম জীবনে তিনি অম্বিকাতনয়াদত্তা নামে লিখতেন ( অম্বিকা, তাঁর মায়ের নাম। দত্তার অর্থ পুত্র)। এই নামটিকে তিনি ‘ বিশ্বজনীন এবং অন্তরের স্বর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কবিতার মেদুর রোমান্টিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মৃত্যু ও সময়চেতনার এক অপূর্ব মিশেল। তাঁর প্রেমের কবিতাও নিজেকে খোঁজার এক দুর্ভেদ্য পথে এগিয়ে গিয়েছে। কাব্যভাষায় এক পুরাতনী আঞ্চলিক স্বর লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালের কন্নড় এবং মারাঠি কবিতায় দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। আর একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। তিনি ছিলেন ঋষি অরবিন্দের শিষ্য। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বেন্দ্রে ১৯৭৩ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান তাঁর ‘নাকু তাঁতী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। কর্নাটকের ‘কবিকুলতিলকা’ হিসেবে অধিক পরিচিত এই কবি ১৯৬৮ সালে পদ্মশ্রী এবং ৬৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান।

এই কবির প্রথম পর্যায়ের কিছু কবিতা এখানে অনূদিত হল। কবিতাগুলি ইংরেজি ভাষায় তাঁর অনুবাদগুলি থেকেই অনূদিত। কন্নড় ভাষা না জানার জন্য বর্তমান অনুবাদক ইংরেজি ভাষা থেকেই অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি অনুবাদক- অধ্যাপক মাধব কে আজ্জমপুর। ইংরেজিতে অনূদিত ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের ব্যবহার বাংলায় অনুবাদের সময় সমধর্মী ছন্দে অনুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, অন্ত্যমিল অনেক সময়ই তেমন ভাবে রক্ষা করা যায়নি।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই তিন দশকের কথা খেয়াল রেখেই অনূদিত কবিতার ভাষাকে তেমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও, কর্নাটকের উত্তরের কন্নড় ভাষার কথ্য আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য এই সব অনূদিত কবিতাগুলির মূল কবিতাগুলিতে রয়েছে। অনুবাদে তার এক শতাংশও ধরা যায়নি বলেই বিশ্বাস।

ফলত, এই অনুবাদগুলি বেন্দ্রের কবিতাগুলির সম্পর্কে একটি আভাস দিতে পারে। কিন্তু তার সত্তাকে ফুটিয়ে তুলছে কিনা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তবে, পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতার পরবর্তী পর্যায়ের কবিতাগুলি অনুবাদের একটি চেষ্টা করা হবে। কন্নড় ভাষা এবং বাংলা ভাষা জানেন, এমন কোনও ব্যক্তির সাহচর্যের খোঁজও চলবে।


দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেন্দ্রের কবিতা

তখন – এখন

তোমার পায়ে রাখব বলে আমি
এনেছিলাম সুগন্ধী এক ফুল;
শুধু তোমার জন্য রাখা বলে
গন্ধ আমি শুঁকিনি তার, তাই
আকাঙ্খা ছিল অন্তরালে ঢাকা।

ফুলের গায়ে আকাঙ্খার পোকা
গন্ধটিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল
তোমার পায়ে ফুলটি রাখা মাত্র
ভিতর-বাইরে শুকিয়ে গেল সেটি।

এসেছি আজও একটি ফুল নিয়ে
তোমার পায়ে রাখব ব’লে আমি
আবার সেই আকাঙ্খাটি এল
মধুর সেই গন্ধটিকে পাওয়ার।

যখনই এল এমন অনুভব
তৎক্ষণাৎ গন্ধ শুঁকে নিয়ে
ফুলটি রেখে দিলাম তার পায়ে,-
বুকের মধ্যে আনন্দভৈরবে।

গন্ধ তার চতুর্দিকে ব্যাপ্ত!

গানের মর্ম

কবি

আমার গান শুনতে শুনতে তন্ময় হয়েছিলে
আমিও তোমার গান শোনবার জন্য বসেছিলাম
প্রতিধ্বনির ভিতর আমি আনন্দ-অনুভবে
দেখেছিলাম তোমার চোখে নৃত্যরতা ছন্দ।

রসিকা

তোমার নতুন কবিতা তুমিই রচনা করেছিলে
নৃত্যরতা আমার চোখের ছন্দে-তালে-লয়ে
বসন্তের জন্মলগ্নে কোকিল কি গান গায় না?
যে গান গেয়েছ, তা তোমার নয়, একান্তই আমার।

কবি

সুখ-দুঃখের যে রস চুঁইয়ে পড়ে, তার নাম হর্ষ!
প্রতিটি হৃদয়ে বেজে ওঠে এই ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি
গানের মর্ম ভুলে গিয়েছিলে তোমার সন্ধানেই
আমার কণ্ঠ আজ তো শুধুই তোমারই বংশীধ্বনি


মুহূর্তের গান

এই তো তার ঝিনুক
দ্যাখো সূর্য কত আলো

কুয়াশাঘন রাস্তা
অন্ধকার
হাঁটছে

এই তো তার পূজায়
কোনও পৌরোহিত্য নেই
ঘরের মাঝে ঘর
তার আড়ালে ছায়া
তার শরীরে
আত্মা

তোমার বুকে রক্ত
কেউ সাঁতার কেটে যাচ্ছে
কেন যাওয়ার কথা বলব
তুমি এসো নতুন করে
আমি অন্ধ

এক মুহূর্ত পাব
তুমি এক মুহূর্তে বোল
এই জীবন যদি পাব
তবে ঠিক কী বলা উচিত
রং
ধূসর হয়ে যাচ্ছে

ধূসর যদি একা
তবে রং দিও আলপনায়
আমি ছন্দ শুনি আলোয়
আলো পাতায় চুমু খাচ্ছে
তোমায় দেখব বলে লিখি
সব
ছন্দ


বিষের গাছ

বন্ধুর উপর ছিলাম ক্রুদ্ধ
ক্রোধকে বললাম, ক্রোধ শান্ত হল
শত্রুর উপর ক্রুদ্ধ ছিলাম
ক্রোধকে বললাম, শান্ত হও, শান্ত হল না সে

ভয়ের গাছের চারায় দিলাম জল
দিন ও রাতে ভিজিয়ে দিলাম তাকে চোখের জলে
দিলাম মৃদু হাসির রোদ্দুর
মৃদু মৃদু ছদ্মবেশী স্বপ্ন দিলাম তাকে

দিন ও রাত্রি মিলিয়ে বড় হতেই লাগল সে
যতদিন না তার শাখায় জন্ম নেয় এক উজ্জ্বল আপেল
আমার শত্রুর হাতে ঝলমল করে সেই ফল
একথা সে জানে যে ফলটি আসলে আমার

আর আমার বাগান থেকে চুরি যায়
যখন রাত্রি তর অবগুণ্ঠন খুলে দেয়
সকালে আমি দেখে আনন্দ পাই
গাছের তলায় আমারই শত্রুর দেহটি শুধুই প’ড়ে।

অদম্বারা

অদম্বারা গাছে
ফল ধরে, ফুল ধরে না
ফলের মধ্যেই
ফুল আর মধু ঘর বাঁধে

আমি এক অতিথি ফল;
আমারও ফুল নেই, রয়েছে একটি মধু-জরায়ু
অতিথি ফলের রং লাল, যেন গরিমা।
মধু থাকে তার জেতার অহংকারে।

আমি সেই অদম্বারার উপাসক,দত্তা
দা রা ব্রেন্দে
কেউ কেউ দেখেছে সেই মধুর পরাগ
তাদের সত্তা আকাশ, যেমন আমার রসিকা।

সমালোচকেরা
ধরে ভুল-ভ্রান্তি-ত্রুটি।
এমনকী আমার ভাল দিকগুলি দোষের হয়ে যায়।
সেই সব সমালোচকেরা আমার ফলে বারবার পোকা ঘাঁটে
তাদের জন্য আমার মেধা হয়তো একটু বেশিই
যেন চার নম্বর লেখা কোনও ব্যায়ামবীরের কসরৎ
এমন ভাবে ভাবাই তাদের বিধি
এমন ভাবে বাঁচাই তাদের বিধি

তরঙ্গগীত

পূজায় বসেছে সমুদ্র, তার চরণে পূজার থালা
মানবজীবন ধুয়ে দিয়ে যায় ধুলো আর আলপনা।

পূজায় তোমার ঢেউগুলি আসে, মন্ত্র যেন বা ছন্দ
কত হৃদয়ের কান্না রয়েছে কত জীবনের বাষ্প।

তরঙ্গ তুমি তরঙ্গ আমি তরঙ্গ আলো অগ্নি
তরঙ্গ মহাকাল বুনে যায় জায়মান এক শিল্প।

সন্ন্যাসী কেউ নয় মহাকাল, সংসারী কেউ নয়
পূজায় বসেছে সমুদ্র, তার অন্তরাত্মা মুক্তো।

সৃষ্টি-লয়

ধোঁয়ার মেঘের মতো, ছিন্নভিন্ন, অপসৃয়মান,
যে আকৃতি পরিচিত, তা হারিয়ে যায়, আর একটি ধূসর
জেগে ওঠে, ছড়িয়েও পড়ে, যেন বা আকার তার, যায়
হারিয়েই, স্বপ্নের ভিতর তারই, শূন্যতাটুকুই ভরে ওঠে অন্ধকারে
আকার-আকৃতি নেই, গভীর এবং ঘন মন তার, সময়ও হারায়
অজানায়, স্থির যেন, মন তার নিজের দিকেই ফিরে আসে
কী এই বিশ্ব, যা রয়েছে চতুর্দিকে? সৃষ্টি করা হয়নি এমন
এই দৃশ্য, এই ছবি! যদি দৃশ্য না হই, তবে কি রয়েছি আমি?
কীই বা রয়েছে ? ধীরে পরিব্যাপ্ত এক নীরবতা ছাড়া?

যেন মৃতপ্রায় এক শরীর ফিরে পাচ্ছে প্রাণবায়ু, চারিদিকে
অন্ধকার তার, সাড়া দিচ্ছে ধীরে ধীরে ধীরে, পবিত্র নদীর থেকে জাত
নুড়িপাথর, কৃষ্ণের বাঁশির সুর যেন শরীরের প্রতি অঙ্গে
এনে দিচ্ছে ছন্দ আর সে কী নাচ, যেন সে ময়ূর
তার পালকের গায়ে গায়ে খোলা আছে চোখ!
যেন বা বিপত্নীক যুবা ফিরে পেয়েছে তার তরুণীটিকে
তার মন আজ যেন সুখী গৃহকোণ।


কাউকে আর বলব না

আর কাউকে বলব না
না, না, আর কাউকেই বলব না ( গুঞ্জন)

ডানাওলা ঘোড়ার পিঠে চড়ার কথা বলব না
দুদিকে তার ডানা ঝেড়ে ওড়ার কথাও বলব না
দুলতে দুলতে আমরা যাব অনেক দূরে হারিয়ে
কাউকে আমরা বলব না
না, কাউকে আমরা বলব না

যুগের পর যুগ ধরে আমরা শুধুই উড়ব
সব ফুল ফুটবে তার, সব ফলই যে পাকবে
কী আনন্দে আমরা সবাই উঠব মেতে উৎসবে
কাউকে আমরা বলব না,
না, কাউকে আমরা বলব না

হাত ধরাধরি করে আমরা গাইব নাচব
চিবুক ছুঁয়ে থাকব
দ্বৈতগান গাইব আমরা ময়ূরসুরে, ছন্দে
কাউকে আমরা বলব না,
না, কাউকে আমরা বলব না

বলব না আর আমরা তখন হয়ে যাব নাগ-নাগিনী
ফণা দুলিয়ে মাথা তুলিয়ে অঙ্গ কেঁপে উঠবে
ফুলের মধ্যে, ঘাসের মধ্যে, হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে
কাউকে আমরা বলব না
না, কাউকে আমরা বলব না

ঘুমিয়ে পড়ব আমরা গভীর, শরীর থেকে শরীরে
আনন্দের এক কুহকী মায়া ঘিরে
পৌঁছে যাব অজানা এক দেশে
আমরা থাকব আড়ালে, আর দেখতে কেউই পাবে না

কাউকে আমরা বলব না,
না, কাউকে আমরা বলব না

নির্বাণ

শরণাগত কি সমর্পণের
ভাষা বুঝেছিল বলে
একদিন সব মায়া ছেড়ে চলে যায়?

শরণাগত কি মায়াকাননের
ফুল থেকে আনে মধু?
কারা ডানা ঝাপটায়?

তোমার প্রেমের গানে
আমি তো শুধুই লয় তাল আর
মাত্রা বহুস্বর
গান কি শুধুই সুর?

গান কি শুধুই কথা?

আমাদের শূন্যতা
নয় কি তোমারও গান?

শরণাগত কি নীরব শূন্য?
বিস্মৃত এক পাখি?

কোথা থেকে এসে কে কোথায় যায়
কতদূর? কতদূর?

রসিকা

আমার আর তোমার হৃদয় — যেন সমুদ্রের ব্যবধান
সব গান, যেন জঙ্গলের গভীর বেদনা
যদি প্রত্যেকে তাদের চোখের জলে ডুবে যেত
হৃদয় আর খুঁজে পেত কি তার প্রণয়ের সঙ্গীকে?

যখন মন ডুবুরীর মতো ডুব দেয়, কে তখন
মুক্তোগুলিকে বেঁধে দেয় প্রাণের সঙ্গে?
সূঁচের চেয়েও তীক্ষ্ণ আর সুতোর চেয়েও সূক্ষ্ম
শব্দ কি পারে যে কথা বলতে চাই, তা বলতে?

সুগন্ধী ফুল দিয়ে গাঁথা মালার মতো
যেন সুর বাতাসে ভেসে পাড়ি দিয়েছে অনির্দিষ্ট
আমিও পাঠাব, রসিকা, পাঠাব আমার আনন্দের দীর্ঘশ্বাস
আমার হৃদয়ের এই সব কথা যা তোমায় ছুঁয়ে থাকবে

কাগজের নৌকো

এই কাগজের নৌকোগুলি ভাসিয়ে দেব আমি
যেমন ভাবে শৈশবে সব ভাসিয়ে দেওয়া হতো
যতক্ষণ না মেঘে-ঢাকা পড়া সূর্য উঁকি মারে
(বাড়ির সব আবর্জনার উপরে ভাসে আলো)
কাদাজলের সংসারে সেই আলোর বন্ধন
হ্রদের সঙ্গে কালভার্টের মিলন হয়ে যেত
স্রোতের টানে নিয়তি হোক বিধি
বৃষ্টি আর বাতাসে ভেসে নৌকো ভেসে যাক
হিসেবনিকেশ করার যারা করুক খাতা লিখে
আমি বরং দেখব কেমন নাচে আলোর রেখা

পোশাক যেমন, তেমন হৃদয়, ভেঙে যায়, মুছে যায়
খিদে তৃষ্ণার অন্ধকারে প্রাণবায়ু নিভে গেলে
রূপকথাসম অট্টালিকায় দেখি শুধু নীল আলো
নদীপথ সব বানভাসি, কোথা থেকে যেন ভেসে আসে
জুঁইফুল, তার গন্ধসমেত, যেন আকাশের খাঁজে
মনের ভিতরে রূপ পেয়েছে জীবনের কারুকাজ
জন্ম নিয়েছে বলেই পৃথিবী স্বর্গীয় দীপাধার।

আশীর্বাদ

মন্থর সেই পদক্ষেপের গতি আরও মন্থর, তার দুচোখেই
ছায়া পড়ে আছে নির্জন একাকীর
(শরীরের থেকে মুছে গেছে তার নবীন সুপ্রভাত)
যৌবন মুছে গেছে, স্বাভাবিক, রক্তে বিষাদ শীত
দ্রুত বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, বৃদ্ধ সে, নিরালায়
উড়ন্ত পাখি দেখে দেখে তার পালকের সংখ্যাই
তাহার জীবন, গুনে যাওয়া যেন, ঢেউ, ওঠে আর নামে
ফাঁকা মন্দিরসম আমাদের হৃদয় এখন শূন্য
মধুর ধ্বনির নেই ঠিকানাই, চতুর্দিকেই আজ
তোমার হাতের ছায়া দেখি ক্রমে দিগন্ত অভিমুখী

বোন তুমি, যেতে দাও, ক্লান্ত দিনটিকে যেতে হবে
চিৎকার করা বায়সপক্ষী যেন বাধা দেয় না কো
এই নাটকের শেষের অঙ্কে বন্ধন যেন ছিঁড়ে
কেউ না আসেন, তুমি মৌমাছি, শোষণ করেছ মধু
বসন্ত হোক, সূর্যে হাওয়ায়, ছুঁয়ে যাক প্রাণবায়ু
ধ্রুবতারামুখী জীবন তোমার আকাশেই বাঁধো ঘর।

গুমা

শান্ত হও অশ্রু, ওই, এল বলে গুমা, কাছেই এসেছে
কী চোখ কী বলব শোন, কী লাল লকলকে জিভ, যেন বা আঁধারে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে শাড়ি, পা টিপে পা টিপে আসে, ছদ্মবেশে পাছে
কেউ না ধরতেও পারে, শান্ত হও অশ্রু, তুমি কেঁদো না এপারে
শুনেই সে আসবে চলে, যদি শুনতে পায় কান্না, চলে আসবে ঠিক।
তখন কী হবে মাগো, চোখ বন্ধ করো, ঘুম আসুক নয়নে, দেখো না , দেখো না
তার দুর্বষহ মুখ, অকল্যাণ হবে, ওই এল সেও, পদধ্বনি থেকে বুঝে নিক
সকলেই, শান্ত হও, গুমা এসে গেছে ওই, অশ্রু, তুমি আর কেঁদো না কো।

গুমা, তুমি চলে যাও, ঘুমিয়ে পড়েছে সেও, যেন অলৌকিক।
জলের ঘূর্ণিতে যেন মাছ ডুবে গেছে ঠিক নিজস্ব ভাষায়।
মন তার বিশ্রামেই, শিশুর শ্বাসের মতো তার প্রাণবায়ু
পাতার ভিতর দিয়ে উড়ে যায়, উন্মাদিনী, প্রাণের অধিক
স্বপ্নের ভিতর তার কোন সে নারীর কাছে ধীরে ধীরে যায়
সেখানেও, তাকে দেখো, গুমা, যেন, অশ্রু তার খুঁজে পায় আয়ু।

কে?

কে ওই মাটির মতো
নীরবেই ঘুরে যায় পায়ের তলায়
এখানে দাঁড়িয়ে থাকি
অহংকারে
পায়ের তলায় তাকে রেখে।

আগুন গিলে আলো বমি ক’রে
কে সে রয়েছে একা দাঁড়িয়ে আঁধারে?
তত সে মিলিয়ে যাচ্ছে, যত সে উজ্জ্বল
একাই দাঁড়িয়ে আছে, মাটিকে টলানো যায়নি।

হাজারো লক্ষ তারা ফুটে ওঠে
রাতের শরীর খুঁটে খায়
নক্ষত্রের কাছে তারা ক্ষুদ্র বিন্দুসম
সকলকে যেন বেঁধে রেখেছে সুতোয়

ভোর, গোধূলি, আলো ও আঁধার
খেলা করে পরস্পর, হাতে হাত ধরে
সূর্যের দিকে এগিয়ে দেয় সময়
যুগের পর যুগ, রাস্তার পর রাস্তা

চিরন্তনের আমিও এক পথিক
খোঁজ করছি সেই চিরজীবিতের
খুঁজেই যাব চিরজীবন, যতক্ষণ না আমি
ছায়ার মতো মিলিয়ে যাই জীবনেরই ভিতর

পাখিটা উড়ছে, তুমি কি দেখেছ?

রাতের পর রাত, দিনের পর দিন
উপরে-নীচে, এখানে-সেখানে, সর্বত্র
হাওয়ায় পাক খেয়ে দূরে কিংবা কাছে
চোখের পলক ফেলার আগেই
পাখিটা উড়ছে, দেখেছ কি তুমি তাকে?

পালকের রং ধূসর কালো
আলোর ভিতরে বিদ্যুৎ যেন
কার ইশারায় উড়ছে?

হাওয়ার ভিতর পাক খেতে খেতে
গোধূলির রং মেখে নিয়ে তার
উড়ান অব্যাহত

পাখিটা উড়ছে, দেখেছ কি তুমি?
তোমার-আমার দুঃখকে নিয়ে
পাখিটা উড়ছে, পাখিটা উড়ছে
সময়ের পাশে আকাশের পাশে
পাখিটা উড়ছে, অন্ধকারেই

তুমি কি দেখেছ? দেখেছ কি তুমি?

শৃঙ্গারকাব্য

কত আদর করতে পার
কত আলোয় অসমাপ্ত
তোমার গানের ছন্দে রসিকা
কত পাখির বিবাহ হল

আঁধারঘরে জল আসে না
ঋতুও হয় হননকারী
তোমারও ঠোঁটে বিষ ছুঁয়েছি
আলোয় এসো, আদর করো

আমরা অভিশপ্ত পাখি
ঘর খুঁজেছি এক হৃদয়েই
জীবন থেকে ছিটকে এসে
লেগেছে তির, অসংযত

গানেই তবে আদর করো
গানেই চলো বাঁধি কুটীর
সুরে পাতায় গন্ধর্ব
এই শরীরে আড়াল করো

রসিকা এই অসমাপ্ত
গানের কাছে কাব্য রাখি
তোমার আমার মায়াবী ঘর
রসিক ছাড়া দোর খোলে না

বসুন্ধরার প্রথম সন্তান

দেখেছ কি খোলা চোখে
বসুন্ধরার প্রথম সন্তান?

উপরে আকাশ
হাসে তার
দাঁত ঝলমল
করে ওঠে
শস্য সবই তো
আদি কৃষকের খাদ্য
মাটির ভিতরে
আবার জন্ম নেয়
বীজ
প্রতিটি সন্ধ্যা
স্নানের মতোই সুন্দর
চোখের জল
প্রশ্বাসেরই তো খাদ্য!
খিদের রাজ্য
শুরু হয় এইবেলা
বুকের ভিতরে
বাসা বাঁধে নিশাচর।
মনের মধ্যে বুকে হেঁটে যায়
অশান্ত উভচর
যেন গিরিগিটি
চোখে তার শুধু মৃত্যু
সমস্ত ঋণ আটকে রয়েছে গ্রীবায়।
তবুও তবুও
আসবে না যম
প্রতি প্রশ্বাসে
জীবন মানেই মৃত্যু

শরীরের সাথে
প্রকৃতির আছে তন্তু
তার ভিতরেই
জাল-বোনা হাড়
অন্ধকারের ভিতরে
অন্ধকার
সমস্ত কিছু
দুলছে
বেঁচে থাকা প্রিয়
যুদ্ধ
তাহার শব্দ
ক্রমশ বাড়ছে, ক্রমশ
আর্তনাদ
মৃত্যুর আলো
কবে যে আসবে, বলো।
কবে কবে কবে কবে
ঘুমের ভিতর
অস্ফূট তার
ডাক শোনা যাবে
অন্ধ
যেন বা ঝড়ের
পূর্বাভাসের
শব্দ

মনে রাখবে, না ভুলে যাবে?

মনে রাখবে, না কি
ভুলে যাবে আমাদের ঠিক?
মনে রাখার অধিক
প্রিয়, প্রিয়তমা
দেখা হবে কি আবার, মিলন
আমার-তোমার?

বলেছিলাম
আমরা টিয়াপাখি
হৃদয়ে ফাঁকি
গরাদে পালক প’ড়ে।
আলোর মতোই
স্নিগ্ধ
অক্ষরেই
মুক্তোসম এ পৃথিবী
বন্য এবং একা
ফেলে রাখবেই? হবে না কি
আর দেখা?

আমাদের স্মৃতি
তবু কাঁপে
যেন স্পর্শ
সৌন্দর্য
নামের পাখিটি
মত্ত এমন হর্ষে
যুগ চলে যায়
বয়স গড়ায়
আসবে কি তুমি
কখনওই আর
জমিতে যেমন কর্ষণ?

রাত্রে আমরা
ছায়ায় মিলেছি এখানে
এই মিলনের
আনন্দে জ্বলে অগ্নি
রক্ষা করো হে বিপদভঞ্জন
পাথরের থেকে এসো বেরিয়েই
এসো হাত ধরো স্নেহে
রক্ষা করো হে এই রাত্রিতে
রক্ষা করো হে ত্রাতা


ভালবাসার মুখোস

ঘন-বিনুনী করেছ তুমি মেয়ে
তোমার জন্য এনেছি দ্যাখো
সুগন্ধী মালা আর
ভালবাসার মন-ভোলান মুখোস

তেমন ভাবে পরলে
মাথার চুলে ওই মালাটি
তেমন ভাবে বাঁধলে
আমার কাছে আসবে ফিরে
আমারই ভালবাসা

প্রিয়া, ঘন চুলের ভিতর তুমি
গোপনে বেঁধো মালা
আমার চোখে পড়বে আলো
পড়বে তারই আভা

যারা বলার, বলবে কথা
যারা শোনার শুনবে

ভালবাসার মুখোস তোমায়
আড়াল করে রাখবে

মৃত্যু দিয়ে ঢাকা

ইংরেজি অনুবাদ- মাধব কে আজ্জমপুর

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (8)
  • comment-avatar
    Shyamashri Ray Karmakar 5 years

    সমৃদ্ধ হলাম

  • comment-avatar
    Shuvodeep Nayak 5 years

    খুব সুন্দর কাজ হয়েছে । অনুবাদ খুব ভাল । এই কাজগুলো আবহমানের তথা সামগ্রিক সাহিত্যের একটা অ্যাসেট হয়ে থাকবে । ধীরে ধীরে পড়লাম সবগুলোই । অনবদ্য কাজ ।

  • comment-avatar
    Gouranga sribal 5 years

    কবিতাগুলি পড়লাম। বেশ ভালো লাগল।

  • comment-avatar
    Anup Sengupta 5 years

    দারুণ অনুবাদ।

  • comment-avatar
    Tilottama Basu 5 years

    ভিন্ন ধারার একটি কাব্যজগতের সন্ধান পেলাম । চমৎকার অনুবাদ । খুব ভাল লাগল ।

  • comment-avatar
    Debasish Tewari 5 years

    অসাধারণ পারিপাট্য ও আভিজাত্যে মোড়া কবিতাগুলি আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করল। এ-কবির কবিতা আগে কখনও পড়া হয়নি। এবারে পড়তে পারলাম হিন্দোলদার অনুবাদের সুবাদে। ঋদ্ধ হলাম।

  • comment-avatar
    Debasish Tewari 5 years

    কবিতাগুলো অসাধারণ পারিপাট্য ও আভিজাত্যে মোড়া। আদ্যপান্ত খুব ভালো হয়েছে।এ-কবির কবিতা আগে কখনও পড়া হয়নি, হিন্দোলদার অনুবাদের সুবাদে সেটা সম্ভব হল।ঋদ্ধ হলাম।

  • comment-avatar
    Debasish Tewari 5 years

    কবিতাগুলো অসাধারণ পারিপাট্য ও আভিজাত্যে মোড়া। আদ্যপান্ত খুব ভালো হয়েছে।এ-কবির কবিতা আগে কখনও পড়া হয়নি, হিন্দোলদার অনুবাদের সুবাদে সেটা সম্ভব হল।ঋদ্ধ হলাম।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes