
তিরন্দাজির পথে, জেন- অষ্টম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
'জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।
অষ্টম পর্ব
গুরুজি একদিন বলেছিলেন এবার আমাদের নতুন কিছু শিখতে হবে। আমার আনন্দের সীমা নেই, কারণ ধরে নিয়েছিলাম সব থেকে কঠিন পর্ব তা হলে আমরা পেরিয়ে এসেছি। গুরুজি মৃদু হেসে একটা প্রবাদবাক্য বলেছিলেন, ‘একশো মাইল হাঁটতে হলে নব্বই মাইল-কে অর্ধেক হিসাবে ধরতে হয়… তোমাদের নতুন অনুশীলন হবে নিশানার দিকে তাক করে তির ছোড়া।’ গুরুজির কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম।
এতদিন একটা খড়ের আঁটিকে চাঁদমারি ধরে আমরা তির ছুড়ে এসেছি, দুটো তিরকে পর পর শোয়াল যতটা হয় প্রায় ততটা দূরত্বে খড়ের আঁটি রাখা থাকত। এখন চাঁদমারি ষাট ফুট দূরে একটা উঁচু দেওয়ালের উপর রাখা, দেওয়ালে বালির বস্তা ঠেস দেওয়া। সুন্দর টালির চালের বড় হল-ঘর, চালাঘরের মতো অনেকটা। পর পর দুটো হল-ঘর, একটায় তিরন্দাজরা তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে, আরেকটায় চাঁদমারি রাখা। দুটো হল উঁচু কাঠের পাটাতন দিয়ে ঘেরা, বাইরের জগতের আঁচ প্রবেশ করতে পারে না সেখানে।
গুরুজি আমাদের একবার হাতেকলমে দেখিয়ে দিলেন। তারপর একইভাবে তির ছোড়ার নির্দেশ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। চাঁদমারির দিকে তড়িঘড়ি করে তির ছুড়ে দেওয়া নয়; বদলে চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকা। এটাই তাঁর চাওয়া। বাঁশের হিলহিলে তিরগুলি লক্ষ্যের দিকে উড়ে গেল বটে, কিন্তু চাঁদমারিতে বিঁধল না। এমনকি বালির বস্তাগুলোর কাছাকাছিও গেল না, ঠিক তার আগে মুখ থুবড়ে পড়ল।
গুরুজি এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘তোমাদের তির ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছে না কারণ সেগুলি এখনও লক্ষ্যভেদ করার আধ্যাত্মিকতা অর্জন করেনি। তোমাদের ভাবতে হবে লক্ষ্য অনেক অনেক দূরের একটা জিনিস। যাঁরা দক্ষ তিরন্দাজ তাঁরা জানেন তিরের শক্তি লুকিয়ে থাকে তার ভেতর ঢুকে যাওয়া আধ্যাত্মিকতার মধ্যে। যে তিরন্দাজ তিরের মধ্যে সে আধ্যাত্মিকতা প্রবেশ করিয়ে দিতে পারেন তিনি শক্তপোক্ত তিরের বদলে হিলহিলে তির দিয়েও বেশি দূরে পৌঁছে যেতে পারেন। এমনকি ধনুকের উপরও এটি নির্ভর করে না; নির্ভর করে জীবনীশক্তি আর মনযোগের উপর। তিরের মধ্যে থেকে আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শক্তি বের করে আনার জন্য তোমাদের অন্যরকমভাবে অনুশীলন করতে হবে। কোনও দক্ষ নর্তককে দেখেছ? অনেকটা তার মতো হয়ে উঠতে হবে তোমাদের। ঠিক মতো শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন করে এটা করলে তোমাদের ভেতর থেকে সঠিক জিনিসটা বেরিয়ে আসবে। এ জিনিস মুখস্ত করে হয় না, বরং প্রতি মুহূর্তে এটিকে নির্মাণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়… একজন নর্তক আর তাঁর নাচ, তাঁর শিল্প যেমন একাকার হয়ে যায় একটা সময়…। অনুশীলনকে দেবতার কাছে নাচের মাধ্যমে শ্রদ্ধার্ঘ জানানোর পর্যায়ে নিয়ে যাও, দেখবে তোমাদের আধ্যাত্মিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটছে তখন। ’
আমি বুঝতে পারছিলাম না তিরন্দাজির মতো একটা বিষয়ের মধ্যে আমি কীভাবে নৃত্যের কুশলতা আনব, কীভাবে নাভিবিন্দু থেকে সেটিকে জাগ্রত করব। তির ছুড়ে যাচ্ছিলাম, তির অনেকটা বেশি যাচ্ছিল’ও; কিন্তু এখনও লক্ষ্যভেদ করতে আমি অক্ষম। মাঝে মাঝে ভাবতাম গুরুজিকে জিজ্ঞেস করি কেন তিনি আমাদের ঠিকঠাক চাঁদমারি ফুঁড়ে দেবার কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছেন না। বারবার মনে হচ্ছিল চাঁদমারি আর তিরের ফলার মধ্যে নিশ্চয় কোনও একটা সম্পর্ক আছে, আছে নির্দিষ্ট কোনও একটা কোণ থেকে লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যার ফলে লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব হয়।
গুরুজিকে একদিন বলেছিলাম বিষয়টা; গুরুজি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ঠিক বলেছ, অবশ্যই সেটা আছে। তুমি নিজেই সেটা খুঁজে পাবে একদিন, কিন্তু এটা মনে রেখো, তুমি যদি প্রতিটা তিরেই লক্ষ্যভেদ করো তবে তোমাকে আর সাধক বলা যাবে না। তখন তুমি হাততালি পাবার জন্য যারা তির ছুড়ে ভেলকি দেখায় তাদের মতো হয়ে যাবে। যারা পেশাদার, যারা শুধু ক’বার লক্ষ্যভেদ করতে পারল সেটা গুনে চলে তাদের কাছে লক্ষ্য ওই এক-টুকরো কাগজ। তিরন্দাজির মহান ঐতিহ্যে এই ধূর্তামির কোনও স্থান নেই। তিরন্দাজের কাছে থেকে কিছুটা দূরে রাখা একটা লক্ষ্যকে ভেদ করাই তিরন্দাজির আসল লক্ষ্য নয়; আমাদের ঐতিহ্য ওই লক্ষ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না। তিরন্দাজি শুধু জানে এক পরম লক্ষ্যের কথা, যাকে কোনও যান্ত্রিক উপায়ে ধরাবাঁধা উপায়ে ছোঁয়া যায় না। তিরন্দাজিতে একেই ‘বুদ্ধ’ নাম দেওয়া হয়েছে।’
গুরুজির কথাগুলি যেন কোন অতল থেকে উঠে আসছিল, গুরুজি হাতে তিরধনুক তুলে নিয়েছিলেন; আমাদের বলেছিলেন তাঁর চোখের দিকে তাকাতে।
দেখেছিলাম তিনি যখন তির ছুড়ছেন তাঁর চোখ-দু’টি প্রায় বোজা; তিনি যে তাকিয়ে রয়েছেন লক্ষ্যের দিকে সেটাও প্রায় বোঝা যাচ্ছিল না।
গুরুজিকে মেনে আমরাও লক্ষ্যের দিকে বেশি নজর না দিয়ে তির ছুড়তে শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে আমি তাকিয়েও দেখতাম না ছোড়া তির কোথায় গিয়ে লাগছে। যদি এক-আধবার তির লক্ষ্যভেদ করেও ফেলত আমি উৎসাহিত হতাম না; কারণ আমি বুঝে গেছিলাম এসব ঝড়ে বক মরার মতো বিষয়। ফকিরের কেরামতি নেই কিছুই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অন্ধকারে তির ছুড়ে যাওয়া আমার পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার হতাশা গ্রাস করতে শুরু করেছিল। গুরুজি আমার অস্থিরতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু একদিন আমি আর সহ্য করতে পারলাম না; বলেই ফেললাম আমি আমার চরম সীমায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।
গুরুজি আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি নিজে বেশি চাপ নিয়ে ফেলছ। তোমার মাথায় ওই লক্ষ্যভেদ করার চিন্তাটাকে দূর করে দাও, মনে রেখো একটা তিরও যদি লক্ষ্যে না-বেঁধে তবুও তুমি তিরন্দাজির গুরু হয়ে উঠতে পারো। তির গিঁথে ফেলা শুধু বাইরের লোক’কে দেখানোর একটা ভেলকি; কিন্তু নিজের মধ্যে থেকে সব অহং আত্মগরিমা উদ্দেশ্য মুছে ফেলাই একজন তিরন্দাজের প্রকৃত কাজ। তিরন্দাজিতে দক্ষতার নানা স্তর আছে, যেদিন তুমি শেষ সীমায় পৌঁছাবে সেদিন বুঝতে পারবে তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী।’
‘আপনার কথার এই অংশটাই আমার মাথায় ঢুকছে না’, আমি বলেছিলাম, ‘অন্তরের প্রকৃত লক্ষ্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছি, সেটাকে যে বিদ্ধ করাই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সেটাও… কিন্তু যে এক-টুকরো কাগজকে বিদ্ধ করতে হয় সেটা সচেতনভাবে লক্ষ্য না করে একজন তিরন্দাজের পক্ষে কীভাবে করা সম্ভব মাথায় ঢুকছে না। তার উপর আপনি বলছেন এই লক্ষ্যভেদ আসলে অন্তরের প্রকৃত লক্ষ্যভেদের বাহ্যিক রূপ…।’
গুরুজি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘আসলে তুমি একটা ভুল ধারণার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছো। তুমি মনে করছো, এ বিষয়টা কোনও রকমে বুঝে গেলে তোমার সুবিধা হবে, কিন্তু মনে রেখো এই বিষয়টা সমস্ত ‘বোঝা’র বাইরে। মনে রেখো, প্রকৃতি’তে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমাদের ওই তথাকথিত বোঝার বাইরে থাকে। কিন্তু সেগুলি আমাদের কাছে এতটাই ‘সত্য’ যে আমরা তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি, তারা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। একটা জিনিস আমাকে প্রায়ই অবাক করে দেয়, ধাঁধাঁ ধরিয়ে দেয় মনে; তোমাকে বলা দরকার। মাকড়শা তার নিজের আনন্দে জাল বুনে চলে, সে ধারণাও করতে পারে না যে একদিন তাতে পোকামাকড় এসে ধরা দেবে। আবার পোকা রোদ্দুরে নাচতে নাচতে একদিন জালে ধরা পড়ে, ধরা পড়ার আগে সে জানতেও পারে না যে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। কিন্তু ভেবে দেখো, মাকড়শা আর পোকা – দু’জনের মধ্যেই ‘তিনি’ খেলা করে বেড়াচ্ছেন, নৃত্য করে চলেছেন। ঠিক একইভাবে তিরন্দাজকে লক্ষ্য ভেদ করে যেতে হবে, এর থেকে বেশি কিছু বলতে আমি অক্ষম।’
এই উদাহরণ আমাকে গভীর চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, যদিও আমি যে খুব ভাল ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম তা নয়। আমার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিলই, তিরন্দাজিতে মন বসাতে পারছিলাম না ঠিকঠাক। মনে মধ্যে হাজার প্রশ্ন, গুরুজিকে করা দরকার। তিনি যা বলেছেন তা নিয়েও আমার অনেক প্রশ্ন রয়েছে। একদিন বলেই ফেললাম, ‘আপনি বহু বছর ধরে অনুশীলন করছেন, তিরধনুক আপনার কাছে জলভাত। আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও যদি আপনি তির ছোড়েন, যদি লক্ষ্যের দিকে না-তাকিয়েও ছোড়েন তবুও লক্ষ্যভেদ করতে আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন এ কথাটা?’
গুরুজি আমার প্রশ্নের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, আমি যে কথায় কথায় প্রশ্ন করে ফেলি সেটাও জানেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারি না বিষয়টা। তোমার কথার মধ্যে কিছুটা সত্যতা আছে। আমি লক্ষ্যের দিকে এমনভাবে মুখ করে তাকাই যে আমি না-চাইলেও তাকে দেখতে পাই। কিন্তু জানি তাকিয়ে দেখাই সব নয়, সেটা প্রায় কিছুই নয়; আমি লক্ষ্যটিকে না-দেখেও দেখতে পাই সেটাই সব থেকে বড় কথা।’
‘তা হলে তো আপনি চোখ বাঁধা অবস্থাতেও লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন…।’
‘আজ সন্ধ্যায় আমার কাছে একবার এস… তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
আমি তাঁর উলটো দিকে একটা কুশনের উপর বসেছিলাম, গুরুজি আমাকে চা দিয়েছিলেন কিন্তু একটাও কথা বলেননি। আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ বসেছিলাম। গনগনে আঁচে কেটলিতে জল ফুটছে, শুধু তার শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। গুরুজি অনেকক্ষণ পর উঠে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। যেখানে তির ছোড়া অভ্যাস করা হয় সে হলটা চড়া আলোয় আলোকিত।
গুরুজি লক্ষ্যের কাছে একটা ছোট্ট প্রদীপ রাখতে বললেন, প্রদীপের শিখা ছুঁচের মতো সরু, হিলহিলে। শিখা জ্বলছে কিন্তু লক্ষ্যের গায়ে এতটুকু আলো পড়ছে না। এতটাই কম আলো যে আমি লক্ষ্যের চারদিকে গোল দাগটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না, যদি শিখাটা না থাকত লক্ষ্যটাকে খুঁজেও পেতাম না।
গুরুজির ‘নৃত্যময়’ তিরন্দাজির পর্ব শুরু হয়েছিল। গভীর অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তাঁর প্রথম তিরটা উড়ে গেল। শব্দ শুনে বুঝতে অসুবিধা হল না যে তির ঠিক জায়গায় বিঁধেছে। দ্বিতীয় তিরটাও একইভাবে বিঁধল। আমি লক্ষ্যের কাছে গিয়ে আলো জ্বালালাম। অবিশ্বাস্য একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম – প্রথম তিরটা লক্ষ্যের মাঝখানে কালো দাগে গিয়ে বিঁধেছে আর দ্বিতীয় তিরটি প্রথম তিরটির লেজের কাছে গিয়ে ঠোক্কর খেয়ে কালো গোলের মধ্যে বিঁধে গেছে। দুটো তির এমনভাবে গেঁথে আছে যে আমি সেগুলিকে আলাদা আলাদা করে ওপড়াতে সাহস পেলাম না; গোটা স্ট্যান্ডটাকেই গুরুজির কাছে নিয়ে এলাম। গুরুজি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, বললেন, ‘প্রথম তিরের লক্ষ্যভেদ করা এমন কিছু নয়, কারণ এতদিন ধরে তির ছুড়তে ছুড়তে অন্ধকারেও আমি নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করতে পারি। এটা হতেই পারে, লুকোছাপার কিছু নেই। কিন্তু লক্ষ করো, দ্বিতীয় তিরটিও প্রথমটিকে বিঁধেছে। এখানেই আমার কিছু বলার আছে, আমি জানি যে লক্ষ্যভেদ করেছে সে ‘আমি’ নয়। ‘তিনি’ নিজেকে নিজেই লক্ষ্যভেদ করেছেন। এসো, আমরা এই লক্ষ্যের কাছে নত হই, ঠিক যেভাবে আমরা নত হই বুদ্ধের কাছে…।’
গুরুজি তাঁর তির দিয়ে যেন আমাকেও ভেদ করে ফেললেন, রাতারাতি আমার মধ্যে এক ধরণের পরিবর্তন এল। আমি এখন আর তির নিয়ে বেশি ভাবি না, তারা লক্ষ্যভেদ করতে পারলাম কি না তা নিয়েও। গুরুজিও আমাকে সাহায্য করছিলেন, তিনি লক্ষ্যের দিকে নজরই দিচ্ছিলেন না। বদলে তাকিয়ে থাকছিলেন আমার দিকে, কতটা সাবলীলতায় আমার মধ্যে থেকে তির ছুটে যায় তার দিকে। প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন এটিই পদ্ধতি, আমাকে নিজের কাছেই নিজেকে বারবার প্রমাণ দিতে হবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এই পদ্ধতি তিরের লক্ষ্যভেদ করার থেকে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তিনি এভাবেই ছাত্রদের মধ্যে তাঁর দর্শন বুনে দিতে পেরেছিলেন, আমি এতদিন বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এবার বিশ্বাস করতে শুরু করলাম লক্ষ্য আর তিরন্দাজের মধ্যে এ সংযোগ রীতিমতো বাস্তব একটা ব্যাপার। আরেকটা সাহায্য গুরুজি এ সময়ে করেছিলেন, তিনি আত্মিক সংযোগের বিষয়টি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি যদি বারবার লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হতাম তিনি আমার ধনুক নিয়ে কয়েকটা তির ছুড়তেন। পার্থক্য চোখে লাগার মতো, দেখে মনে হত তাঁর ধনুক ধরাই আলাদা। ধনুক যেন তাঁর হাতে পোষা পাখির মতো কথা বলছে। এটা যে শুধু আমার ক্ষেত্রেই হত তা নয়। তাঁর বহুদিনের শিষ্য, অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আসা শিষ্য সবাই এটা মেনে নিত। তারা বরং অবাক হয়ে যেত যে এ বিষয়টা নিয়ে আমি প্রশ্ন করছি দেখে।
অসি-যোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এক, তাঁরাও মনে করেন তাঁদের তলোয়ারের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কর্মকারের শ্রম। কর্মকারের আত্মিক সংযোগ তলোয়ারকে পৃথক করেছে। তাঁদের অভিজ্ঞতা আরও রোমাঞ্চকর, তাদের হাতে যে তলোয়ার খেলা করে তা যে শুধু তাদের দক্ষতা মেনে করে এমনটা তারা ভুলেও ভাবে না।
একদিন তির ছুড়ছি, হঠাৎ গুরুজি চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই তো… এই তো… এই তো ‘তিনি’ ছুটে গেলেন তোমার ধনুক থেকে; লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে প্রণাম জানাও।’
লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে আমি উচ্ছ্বাস গোপন করতে পারলাম না, গুরুজি বললেন, ‘এই ছোড়াটা একদম ঠিকঠাক হয়েছে। এটা একটা শুরু; কিন্ত আজ আর বেশি করতে হবে না। না হলে পরের তিরেই তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে, তোমার শুরুর আনন্দ মাটি হয়ে যাবে।’
তারপর থেকে আমি মাঝেমাঝেই ঠিকঠাক তির ছুড়তে পারছিলাম, লক্ষ্যভেদও হচ্ছিল। আবার অনেক তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল, এটাও ঠিক। কিন্তু চোখেমুখে তৃপ্তির বিন্দুমাত্র চিহ্ন ফুটে উঠলেই গুরুজি রেগে যেতেন, বলতেন, ‘কী ভেবেছ তুমি? বারবার বলেছি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে মন খারাপ করবে না। তা হলে একটা লক্ষ্যভেদ করে তোমার এত আনন্দ কিসের? আনন্দ-বেদনার এই বোধ থেকে তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে, তিরন্দাজি এটাই শেখায়। নিজেকে মুক্ত করতে হবে, দুটোকে এক করে দেখতে হবে। যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারো তো ভাববে তুমি নয়, অন্য কেউ সেটা করেছে। কিন্তু তোমাকে নিরন্তর অনুশীলন করে যেতেই হবে। তোমার ধারণাই নেই যে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ…।’
এই সময়টায় আমি জীবনের সব থেকে কঠিন পর্ব পেরিয়ে ছিলাম, তাঁর কঠোর শৃঙ্খলা আর অনুশাসন মাঝেমাঝে মানতে পারতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম এই শিক্ষা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। নিজের সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকা হাজারো ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, মনসংযোগ আর নষ্ট হত না সহজে।
একদিন একটা লক্ষ্যভেদের পর গুরজি আমার কাছে এসে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা তুমি কি বুঝতে পারো যখন আমি বলি ‘তিনি’ ছুটে গেলেন, ‘তিনি’ লক্ষ্যভেদ করলেন তখন আমি আসলে কী বলতে চাই?’
‘আমি আর কিছু নতুন করে বুঝতে চাই না গুরুজি, আমার কাছে সব কিছু কেমন যেন ঘেঁটে যাচ্ছে। সাধারণ জিনিসও আপনার থেকে শুনলে অসহায় লাগে। সে কি ‘আমি’ যে ধনুক তুলে ধরি? না কি ধনুকই আমাকে তুলে ধরে চরম অবস্থার দিকে নিয়ে যায়? আমি কি লক্ষ্যভেদ করি? না লক্ষ্যই আমাকে ভেদ করে যায়? আমি যখন শারীরিক অস্তিত্ব দিয়ে ‘তাঁকে’ অনুভব করি তখন সেটা কি আসলে আধ্যাত্মিক? না কি যখন আত্মার চোখ দিয়ে অনুভব করি তখন সেটা শারীরিক? তির ধনুক লক্ষ্য অহং – সব আমার কাছে এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, আমি আর তাদের আলাদা করতে পারি না। এমনকি পৃথক করার ইচ্ছাও চলে গেছে আমার। কারণ আজকাল যখন ধনুক তুলি তির ছুড়ি সব কিছু আমার কাছে স্বচ্ছ আর সরল হয়ে আসে… ভীষণ স্বচ্ছ আর সরল…।’
গুরুজির মুখে প্রসন্নতা, তিনি বললেন, ‘এবার সত্যি সত্যিই ধনুকের ছিলা তোমার আত্মার ভেতর প্রবেশ করেছে।’