
তাপস দাস-এর গল্প
বাঁশি
‘ও রে, আমার ধনু পাগল হই গেসে রে।‘
শাশুড়ির এমন মড়া কান্নার মতো কথা শুনে কেলোবউ পড়নেতে নেমে থ। ঝকঝকে রুপোর মতো চাঁদ বাতাবিনেবু গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। আ মরণ! গায়ে যেন কাঁটা দেয়। কী রূপ লেগেসে গো তার গায়! কেলোবউয়ের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝিলিক মারে।
শাশুড়ির ওপর মেজাজ দেখাতেই কেলোবউ তক্তপোশ থেকে নেমেছিল। ঝিমুচ্ছিল একটু। তার গায়ে গতরে ব্যথা হয়েছে। সারাটা দিন বিলে ধান কাটতে হয়েছে তাকে। এক বিঘের ধান সবে সে কেটেছে। এখনও দু-বিঘে বাকি। ধান কাটতে কাটতে এলোচুলের কাছে কাস্তে রেখে ঢোলকলমি গাছের সাদা সাদা ফুলের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেলোবউ। শালিক পা ঠুকরাতেই জেগে উঠেছিল সে। সূর্য তখন পশ্চিমে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছে। দূরে ঘন সবুজ গাছপালা হেমন্তের কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হলুদ রঙের বিলে এখানে ওখানে ধানের আঁটি পড়ে আছে। নুয়ে আছে পাকা ধান। সোনার মতো রঙ তাদের। জেগে উঠতেই চমকে উঠেছিল কেলোবউ। বেলা যে গেল! এমনি এমনি তারে তো হরিহর মাইতি টাকা দেয় না! ধানের আবার শিষ যদি পড়ে থাকে মাঠে তিনি দাঁতের ফাঁকে ফিচ করে কটাক্ষের হাসি হেসে বলবে, ‘ও কেলোবউ, তোমার আক্কেল আচে? গোলায় ধান ওঠপে না এবার বুঝতে পেরেচি। শুধু শুধু নাড়ার গাদা দেবার জন্যি এই পয়সার ছেরাদ্দ করার কোনো মানে হয়?’ কোমর ধরে গিয়েছিল, তবু কেলোবউ কাস্তে চালিয়েছে যতক্ষণ না সুর্য বাবলা বনে লাল থালা হয়ে ডুবে না যায়। নড়তে পারছিল না ভরসন্ধেতে। এই ঘর-সংসার তার যেন একার দায়। তার গতর যতক্ষণ ততক্ষণ ভাত, তাকে দু-মুঠো দেওয়ার কেউ নেই। ধনু যেন বৈরাগী সেজে বসে আছে। অথচ শাশুড়ি শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, ‘নিজের গতর না থাকলি, সন্ধেবাতি দেবা হোক বা না-হোক মন খারাপ করতি নেই। অমঙ্গল যা হবার হয়ি গেসে। ঘরে যেন কালসাপ ঢুকেসে।‘ কেলোবউয়ের ইচ্ছ করছিল তখন শাশুড়ির মুখ ইট দিয়ে থেঁতো করে দিতে। কোনোরকমে পুকুরে নেয়ে কাচা একখান কাপড় পরে আঁচল গলায় জড়িয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ ধরিয়েছিল। শাশুড়ি ফ্যালফ্যাল করে তার কেলোবউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। আহা! কী গড়ন, যেন কালো পাথরে খোদাই করা পেতিমা!
কেলোবউ চাঁদের থেকে চোখ ঘুরিয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল। মালা জপছে সে। কী মিথ্যে! কী মিথ্যে! কাঁচা কাঁচা মিথ্যে কথা বলেন মালা জপতে জপতে। একদিন তো না-পেরে সে বলেছিল, ‘যখন মিথ্যে কথা বলবেন, মালার থলে থেকে হাত বের করে নেবেন।‘ আর যাবে কোথায়! ওই খোঁড়া শাশুড়ি প্রায় লাফ মেরে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে বলেছিল, ‘মাগি, আমারে তুই মিথ্যেবাদী বলিস? ওলাউঠো হবে তোর, মুখে পোকা পড়বে, এই বলে দিলুম!’ অনেক শুনেছে এসব কথা কেলোবউ। এখন তার আর গায়ে লাগে না। সে হাসে।
পড়নেতে গোবর দিয়েছিল আজ সকালে কেলোবউ। শুকিয়ে খটখটে। এখনও গোবর গোবর গন্ধ আছে। সেখানেই বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় সে বলল, ‘কী হয়েচে মা?’
শাশুড়ি শুনেও শুনল না। তারপর ঝেঁকে উঠল বলল, ‘বলি, কানে কি শুনতি পাও না?’
‘কী শুনতে পাইনি, মা?’
শাশুড়ি এবার কেলোবউয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘বকুলতলা থেকি কীসের আওয়াজ ভেসি আসতেসে শুনতি পাসসো না? আমার ধনু। আর তোমার সোয়ামি। সে পাগল হই গেসে গো।‘
খিলখিল করে হেসে উঠল কেলোবউ। বলল, ‘ক্যানিং থেকে ওই আড়বাঁশি কিনে এনেছিল আপনার ছেলে। ওই নিয়ে তো ক’মাস পড়ে আছে। মোটে সুর আসে না। শুধু ফুঁ দেয়। অত সোজা!’
বলে কেলোবউ আর একবার হাসতে গিয়ে শাশুড়ির রাগ অনুমান করে চুপ করে গেল।
বউমার চোখে চোখ রেখে শাশুড়ি বলল, ‘চৈতন্য তার মা আর বিষ্ণুপিয়ারে ছেড়ি চলে গিইল, বৌমা। শুনেচ বাপমার মুখে। ধনু আমার পেটের সন্তান। ওরে আমি চিনি যেমন ওর বাপকে চিনতাম।‘
কেলোবউয়ের ভারি মজা হল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ওই বাঁশি নিয়ে আর কোথায় যাবে? অমন অঁ…অঁ…অঁ আওয়াজ শুনে লোকে পাগল বলে তাড়া করবে। রাধা আর এয়েচে!‘
মুখে কাপড় চাপা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছিল কেলোবউ।
ভালো লাগল না শাশুড়ির। বলল, ‘ওর বাপ অমন ছিল। মোটে ঘরে রাখতি পারতাম না। বিড়ির গুদামে গে বসি থাকত সে। তারা বিড়ি বেঁধে পয়সা তুলত ঘরে আর ধনুর বাবা বাঁশি শুনিয়ে বিড়ি বকশিস পেত। একদিন দেখি মুখে তাড়ির গন্ধ। তারা বাঁশি শুনে তাড়ি খাইয়েছিল ধ্নুর বাবাকে। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল আমার। দিলুম বাঁশি ভেঙে। আর বাঁশি কেনেনি ধনুর বাবা। তবে তারপর যা হইল আমি আর কেঁদে পথ পাইনে।।‘
‘কী হল মা তারপর?’
বৌমার ন্যাকা ন্যাকা ইচ্ছে দেখে শাশুড়ির হাড়-পিত্তির জ্বলে গেল। বলল, ‘কী হল আবার! যাত্রা দলে চলি গেল। আষাঢ় মাসে শুধু ঘরে থাকত। শীতকাল হলি আর ঘরে ফিরত না। এখানে ওখানে রামযাত্রা করি বেড়াত।‘
‘বাবা তালি শিল্পী ছিল বলো?’
‘হ, সেটাই তো কাল হল একদিন?’
‘কী কাল হল মা?’
শাশুড়ি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে জপের মালা নিয়ে মিনতিদের বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার আগে বৌমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, ‘তুমি মেয়েছেলে তো মন্দ না, কাটা ঘায় নুনের ছিটে দাও।‘
পুকুরঘাটের জলে গোল হয়ে পুর্ণিমার চাঁদ দুলছে। কানে ভেসে আসছে ধনুর অবিরাম বাঁশিতে ফুঁ ফুঁ আওয়াজ। কেলোবউয়ের মনটা দুলে উঠল। কী এমন সে বলেছে যে শাশুড়ি রাগ করে চলে গেল! বাতাস এখন থেকেই কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। শীত আর পড়তে ক’টা দিন। নদী-নালা, খাল-বিল, গাছপালার দেশ। এখানে শীত আগে এসেই হাজির হয়। কেলোবউয়ের ভালো লাগে না। বড্ড শীত করে তার। খড়ের চালের ঘরে পিছনের দেওয়াল কিছুটা ভাঙা। সেখান থেকে গল গল করে কনকনে বাতাস ঢোকে। তার বর ধনুর সেদিকে হুঁস নেই। ধান কাটে, ধান ভাঙে, হাটে পড়ে থাকে, মদ খায়। তারপর কোলকাতায় যাওয়া শুরু করল। এখন আবার বাঁশি কিনে এনেছে। মনটা কেমন টনটন করে ওঠে কেলোবউয়ের। আজ চার বছর তাদের বিয়ে হয়েছে। এখনও সে পেটে একটা সন্তান ধরতে পারেনি। লোকে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, বলে, ‘ও কেলোবউ খবর আচে নাকি?’ ধনুর সেদিকে খেয়াল আছে? কার দোষ? তার না ধনুর? তার হবেই না। বলে কেলোবউ নিজের ভরাট বুকের দিকে তাকায়। জোছনায় তার লাল রঙের শাড়ি কটকট করছে। উপচে পড়ছে তার ভেতরটা যেন। ধনুর দোষ ধরা পড়বে, তাই বলে ডাক্তার দেখাবে না সে? কেলোবউ পুকুরের জলে আর চাঁদ দেখতে পায় না। সে সরে গেছে। সে এখন নারকেল গাছের পাতার আড়ালে।
শাশুড়ি ভূতের মতো কেলোবউয়ের পিছনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘মরণ দশা, তুই এখনও বসে আছিস এখানে? তুঁষে আগুন দিবিনে? বলি আজ কি ভাত না খেই ঘুমোব?’
‘তাই ঘুমোবে? শুধু তোমারটাই দেখো, না?’
‘কেন তুই কি খাস নে? জাবনা চেবাস গোরুর মতো!’
‘আমারে এমনি করে বলে কী পাও তুমি? বাপের ঘরে চলে যাব। আর আসব না।‘
‘আসবি নে আসবি নে, ধনু কি আমার কুকুর-বেড়াল? আবার বে দেবো তারে।‘
আর কি বলার থাকে কেলোবউয়ের। চোখ তার জলে ঝাপসা হয়ে আসে। তার বাপ তাকে আদর করে নাম রেখেছিল মানি। মান তো নেই। বরং তার কালো রংটাই তার সব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র ধনু ছাড়া কেউ তাকে সে নামে ডাকে না। অভিমান হয় কেলোবউয়ের। একটা গোটা গ্রাম তাকে কেলোবউ বলেই চেনে। তার গায়ের রংটাই তার সব কিছু ঢেকে দিল। ধনু যখন মানি বলে ডাকে তখন তার কানে খচ করে লাগে। মনে হয় সে-ও কেলো বলে কিছু একটা বলুক না কেন। সেটাই মানাবে বেশি।
চোঙায় ফুঁ দিতে দিতে চোখে জল এল কেলোবউয়ের। হঠাৎ তুঁষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। মাটির হাঁড়িতে ভাত ভুটছে। সে হাতা দিয়ে ঘেঁটে দিতেই ফ্যান উথলে উঠল। আর তার বুকে কেমন যেন দুপ দুপ আওয়াজ হতে থাকল। শিরশির করছে তার সমস্ত শরীর। কী যেন উথলে উঠছে তার ভেতরেও। দাউ দাউ আগুনের মধ্যে চোখ মেলে আছে কেলোবউ। শুনতে পাচ্ছে ধনু আর অঁ অঁ আওয়াজ করছে না। কীসের যেন সুর বাজাচ্ছে তার বাঁশিতে। ভাঙা ভাঙা, ছাড়া ছাড়া। বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সে সুর। কেটে কেটে যাচ্ছে। ভালোভাবে শোনা যায় না।
টেমির এক চিলতে হলদেটে আলোয় এনামেলের থালায় ভাত আর ও-বেলার ডয়রা কলার চচ্চড়ি নিয়ে বসল শাশুড়ি। হাত তার কাঁপছে। তামাটে হাতের অজস্র শিরা উপচে পড়েছে যেন।
শাশুড়ি লম্বা লম্বা আঙুলে ভাত আর চচ্চড়ি খানিকটা মেখে মুখে গ্রাস তুলল না। কেলোবউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানিস কেলোবউ, মদ্দালোক কী চায়?’
ভারি মজা হওয়ার কথা কেলোবউয়ের। অন্যদিন হলে সুর করে বলত সে, ‘কী চায় মা?’ আজ আর তার তেমন কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না। সারাদিন বিলে পড়েছিল। কাল ভোর হতেই নাড়া বইতে হবে তাকে। আজ সারাদিন তার তলপেটে কীসের যেন ব্যথা। কঁকিয়ে উঠবে এমনও নয়। মাঝে মাঝে ব্যথাটা চলে যাচ্ছিল। যেতেই কী যেন নেই তার মনে হচ্ছিল কেলোবউয়ের। বরং ব্যথাটাই ভালো। সে টের পাচ্ছে নিজেকে।
শাশুড়ি কেলোবউয়ের বেজার মুখখানা দেখে ফোকলা গালে ভাত আর চচ্চড়ি মাখা একটা বড়োসড়ো গ্রাস তুলল। ধীরে ধীরে চিবোতে চিবোতে কথা বলার ফাঁক খুঁজছিল সে। গলা দিয়ে ভাত নামছিল ফুলে ফুলে। শাশুড়ির এমন ধারার লোভ দেখানো খাওয়া দেখে কেলোবউয়েরও খিদে পায়। কিন্তু আজ পেল না। তাকিয়ে থাকল শাশুড়ির কাঁপা কাঁপা আঙুলের দিকে।
‘মদ্দালোক চায়,’ বলে কী যান ভাবল শাশুড়ি। তারপর বলল, ‘চায়, ধারালো কথাবাত্তা, চোখ নাড়ানি আর বাঁকা হাসি।‘
থাকতে পারল না কেলোবউ। সে খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, ‘তুমি এসব জানলে কী করে?’
‘দুর, আমি ছাই জানতাম না কি? ধনুর বাবা তো এইসব বলেনি। কী হল, একদিন ছিনেমা দেখতে গিইলাম দুটো বিল আড় দে। মাঠে চট দিয়ে ঘিরে টিকিটের ছিনেমা। অনেক লোক। বিলে নাড়ার ওপর বসে ধনুর বাবা আমারে একটা বাদামের ঠোঙা ধরিয়ে দিল। সে খেলো না। আমার তখন বয়স কম। স্বামী খায় না আমি কী করি খাই। বসে থাকলাম হাতে ঠোঙা নে। ছিনেমা চল্ল।‘
বলে শাশুড়ি আবার গ্রাস তুলল মুখে। কেলোবউ জানে অনেক সময় নেবে সে মুখ খালি করে আবার কথা বলতে। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি খাও, আমি গোরুর জাবনা কেটে দিয়ে আসি।‘
‘আরে শোন না!’
‘বলো।‘ তাকিয়ে থাকল কেলোবউ।
ফিক ফিক করে ফোকলা দাঁতে হেসে গড়িয়ে পড়ল শাশুড়ি। কেমন মায়া হল কেলোবউয়ের। বর নেই। সেই কবে থেকে ছেলেটাকে ঝড় ঝাপটায় বড়ো করেছে। কত বয়স তখন তার, যখন আর ফিরল না রামযাত্রার রাম?
এবার সামলে নিয়ে শাশুড়ি বলল, ‘ধনুর বাবা আমার ডান হাতটা খপ করে চেপে ধরিল। ফিস ফিস করে বলিল, তোকে এমন হতে হবে।‘ তখন কী যেন নাম তার? নায়িকা, বুইলি, গান গাচ্ছে আর ধনুর বাবা আমার ডান হাতটা ছেড়ে দে হাঁ করে তাকিয়ে আচে।‘
‘তারপর রামযাত্রায় চলে গেল তাই তো?’
‘কেলোবউ, ঠিক ধরেছিস। ওর নেশা ছিল। শিল্পী হবে। চলি গেল।‘
‘তাতে তোমার কান্নার কী হল, ভালোই তো, স্বামী শিল্পী হলে তো মান বাড়ে?’
শাশুড়ির পিচুটি ভরা চোখে তখন জল টপাচ্ছে। বৌমার কথা শুনে সে বোধহয় লজ্জা পেল। বলল, ‘বউ, মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের কাছে হারতি চায়? তুই পারবি হারতি?’
কেলোবউ ‘আসছি’ বলে সরে পড়ল। এই দুঃখটুকু মানুষটার একার। তাকে দেখলে কেউ সে দুঃখের জোর কমে যায়। কিন্তু কেলোবউয়েরও মন খারাপ হয়ে গেল। ধনু তাকে পচ্ছন্দ করে না। কিছু বলে না। তার মুখের হাসি কে যেন কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। কেমন অন্ধকার লাগে তার দিকে তাকালে। যেন এতটুকু সুখ নেই তার, আলো নেই। যেন সে মরে পড়ে আছে। কিন্তু কেনো দুঃখী, কীসের দুঃখ, অতশত কেলোবউ খবর রাখে না। রাখতেও চায় না। জোন না দিলে পেটে খিল দিতে হয়। হাভাতে মানুষ তারা। সে সারাদিন খাটে, রাত এলে ঘুমিয়ে পড়ে, এই তার জীবন। অত কে ভাববে কার মনে কী দুঃখ? ভাতের দুঃখের কাছে সব দুঃখ যে হার মানে!
কেলোবউ নিজেই অবাক হল। কখন সে ফণীমনসা গাছের বেড়া রেখে নদীর দিকে যাওয়ার ধুলোর পথে চলে এসেছে। দাঁড়াল সে বিভূতি মাইতির গোয়ালের ধারে এসে। ওই দেখা যায় জোছনায় ধবধবে সাদা নদী। ওখানেই বকুলতলা। সেখান থেকেই বাঁশির সুর ভেসে আসছে ধনুর।
নদীতে জোয়ার না ভাটা? জোয়ার হবে। ভরাট পাত্রের আওয়াজ আলাদা। নদীর ভরা বুক তেমন। নদীর চরে কুলকুল শান্ত আওয়াজ স্রোতের। ওপারে রুপোর থালার মতো চাঁদ দৌড়াচ্ছে মেঘেদের রেখে। সাদা সাদা মেঘ সমস্ত আকাশ ছড়িয়ে আছে।
চরে দুলছে গেঁওয়া গাছে বাঁধা নৌকা। তার কানায় পা ঝুলিয়ে বসে ধনু। সে ওপারের দিকে তাকিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে।
কেলোবউকে দেখে ধনু হাসল। উদাস হয়ে বাঁশি বাজাতে থাকল তারপর।
কেলোবউ অবাক হল। একটু আগেই বাঁশিতে শুধু ফুঁ দিতে শুনেছে সে। যেমন করে সে তুঁষে আগুন জ্বালাতে বাঁশের চোঙায় ফুঁ দেয়। কিন্তু এখন সে বাঁশি অন্যরকম। সুরের সে কিছুই বোঝে না, তবু তার মনে হল নদীর স্রোতে, আকাশে, বাতাসে, জোছনায় ভেসে যাচ্ছে সে সুর। সব যেন এক হয়ে যাচ্ছে। কী মিল!
বাঁশি বাজানো থামাল ধনু। বলল, ‘সে বাঁশিওয়ালা, তার ঘর নেই, সংসার নেই, বাঁশি বাজায় পথে পথে, পাড়ায়, পাড়ায়। তার সুর শুনে যে দু-একটি বাঁশি বিক্রি হয় তাই দিয়ে চাল কেনে, আলু কেনে, গরম ভাত ফোটায়। এসব জেনেছি তার কাছ থেকে বাঁশি কেনার অনেক পরে। তোমরা জানতে আমি ক্যানিং থেকে ট্রেনে চেপে কোলকাতায় কাজে যাই। যেদিন তার দেখা পেয়েছি, সেদিন থেকে আর যেতাম না কোলকাতায়। তার পিছন পিছন ঘুরে বেড়াতাম শিখব বলে। কিন্তু বাঁশি কেনা এক, আর বাজানো আর এক। কিছুতেই সুর তুলতে পারতাম না। আজ হঠাৎ পারলাম। কী করে পারলাম নিজেই জানি নে।‘
কেলোবউ বিলে খাটে, তার মাথায় এই সব গল্প ধরবে কেন? সে বলবে ভেবেছিল, ‘সংসার যে আর আমি একা টেনে পারি নে?’ কিন্তু সে বলল, ‘কাল আবার বিলে নামতে হবে। হরিহর মাইতির দু-বিঘে জমিতে ধান কাটা বাকি আচে। তার ওপর নাড়া তুলে দিতে হবে তার উঠোনে।‘
তারপর ধনুর মুখের দিকে না-চেয়ে কেলোবউ বলল, ‘কাল মাঠে নামবে আমার সাথে, শরীরটা ভালো নেই, পেটে কোথায় যেন ব্যথা করে।‘
তাল কেটে গেল ধনুর। সে বাঁশিওয়ালার কাছে শুনেছে সমুদ্রের কাছে এক ছোট্ট গ্রামে তার বাবা থাকে। সে ঘর বেঁধেছিল সীতার চরিত্রে অভিনয় করে একটি মেয়ের সঙ্গে। তার গানের গলাই নাকি তার বাবাকে পাগল করেছিল। যাত্রার অভিনয় তার জন্যেই শেখা তার। জীবনের শেষবেলায় এসে অভিনয় আর গান নাকি তাদের এখনও বেঁধে রেখেছে। দেখে এসেছে বাঁশিওয়ালা।
ধনু চুপচাপ চেয়ে থাকল নদীর জলে। হাতে তার বাঁশি। সে-ও শিল্পী হবে তার ঘরছাড়া বাপের মতো এই শোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু কাল যে বিলে নামতে হবে, দু-বিঘে থেকে আরও অনেক বিঘের জমিতে ধান কেটে, নাড়ার গাদা দিয়ে তাকে রোজগার করতে হবে। সে অকর্মণ্য আর কতদিন থাকবে! কতদিন তার মানি মদ্দালোকের সঙ্গে মাঠে কাজ করে ইজ্জত খোয়াবে! সংসারের জন্যে তার কিছুই করা হয়নি। ঘরের দেওয়ালে পর্যন্ত মাটির চাপ তোলেনি। শীত আসছে। আবার কনকনে বাতাসে তারা সারারাত কুঁকড়ে থাকবে, ঘুম হবে না। মানি একটা কথাও বলবে না। সকাল হলেই সেই ঠান্ডাতেও মাইতিদের বাড়ি গোবরের মশাল দিতে চলে যাবে। আর সে কি আবার কোলকাতায় যাচ্ছে কাজ করতে এই মিথ্যে ছলনায় বাঁশিওয়ালার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে আর মনের মধ্যে জেগে থাকবে রমলা বলে মেয়েটি যাকে বাঁশিওয়ালা গান শেখায়?
কেলোবউয়ের ঘুম পাচ্ছিল। সে বলল, ‘চল, তোমারে দুটো খেতে দিয়ে আমি আর খাব না, একটু ঘুমোব। মাথাটাও ধরেচে। কাল আবার…‘
চাঁদ তখন অনেক উপরে উঠে গেছে। তার চারপাশে আর মেঘেদের ভিড় নেই। ফুটফুটে জোছনায় চিকচিক করছে নদীর জল।
ধুনু ছুড়ে ফেলে দিল বাঁশিটি নদীর জলে।
আঁতকে উঠল কেলোবউ, বলল, ‘এ কী করলে?’
ধনুর চোয়াল শক্ত। সে বলল, ‘মানি, বাবার নেশাটা আমারও রক্তে ছিল। তাকে মেরে ফেললাম এইমাত্র।‘
বাঁশিটি ভেসে গেল স্রোতে, মিলিয়ে গেল দূরে, তাকে আর দেখা গেল না।
স্কেচ- তাপস দাস
লেখাটি ভালো লাগলে, আবহমানের জন্য আপনার ইচ্ছেমতো অবদান রাখতে পারেন
এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে ফোন পে-র মাধ্যমে।
এই অবদান একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়। ফোন পে বা গুগল পে- 9051781537
স্ক্যান করার জন্য কিউ আর কোড–