
জাক রুবোর কবিতা –ভাষান্তর – অরিত্র চ্যাটার্জি
জাক রুবো (Jacques Roubaud), প্রখ্যাত ফরাসি কবি, উপন্যাসিক ও গণিতবিদ। জন্ম ডিসেম্বর, ১৯৩২, ফ্রান্সের রোন উপত্যকায়। প্রখ্যাত ওলিপো (OULIPO) আন্দোলনের এক বিশিষ্ট সদস্য, এই কবি প্যারিস নানতের (Paris Nanterre) বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘকাল। একই সাথে গণিত ও ফরাসি সাহিত্য দুটি আলাদা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করার মত বিরল কৃতিত্বও রয়েছে তাঁর। এযাবৎ বিভিন্ন লেখালিখি সংক্রান্ত প্রায় কুড়িটি বই প্রকাশিত। ১৯৮৩ সালে তাঁর স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর, স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে সাতটি খণ্ডে তিনি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ইংরাজিতে অনূদিত তার কয়েকটি খণ্ড, দ্য গ্রেট ফায়ার ইন লন্ডন, দ্য লুপ এযাবৎ তাঁর শ্রেষ্ঠ গদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। স্ত্রীর সাথে কাটানো প্রিয় স্মৃতি, তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী দৈনন্দিন জীবনের শোক, শূন্যতা ও বিরহ নিয়ে ১৯৯০ সালে প্রকাশ পায়, তাঁর একটি কবিতার সংকলন, সামথিং ব্ল্যাক (Some thing Black)। বইটি থেকে কয়েকটি লেখার অনুবাদ প্রচেষ্টা এইখানে করা হল।
—————————————————————————————————————
সকালবেলা [In the morning]
পরিজের মত আমার মাথাটার ভেতর একটা অহেতুক মৃত্যু বাসা বেঁধে আছে
ধোঁয়া লেগে লেগে কালচে জইদানার জন্য পাখিগুলো এবার উড়ে গেল
(ঘড়িতে এখন ভোর চারটে বেজে, ঘড়িতে এখন পাঁচটা)
পা থেকে মাথা পর্যন্ত একে একে সেজে উঠছে গাছগুলো
আর বাটির মধ্যে গলে যাচ্ছে কালো কাদার কয়েকটা টুকরো বদ্বীপ
ঈষদুষ্ণ, আমি ওদের গলাধঃকরণ করি –
ওই চার্চ, ওই বালি আর অস্থির হাওয়া
দু’আঙুলের সাহায্যে আমি এগিয়ে যাই আরেকটা লাইন
যদি পারতাম, চাইতাম আমাদের শরীরদুটো খাঁজে খাঁজে জুড়ে যাক
তোমার দুচোখের ওপর আমার মুখ, এই শূন্যতার পরিবর্তে ।
ভালোর জন্যই [For good]
যা হয়েছিল তা ভালোর জন্যই। তবু তার মনখানি বিক্ষিপ্ত
যেন বড় বেশি এলোমেলো হয়ে রয়েছে।
অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তোমার জমে যাওয়া মুখ ওই ধুলো মাখা সূর্যটাকে খুলে দিলে
সে দেখতে পায় সেখানে একটা কালো বিন্দু প্রবেশ করল।
হাল না ছেড়ে তবু তুমি অপেক্ষা কর, নিজের মন মত হলে
তুমি হয়ত অপেক্ষা করতে পার এক পৃথিবী
আর এভাবেই শতাব্দীগুলো আসলে পার হয়ে যায়।
এটার মানে সে এখন বোঝে; নিজেকে ভাঙা, কেটে টুকরো করা
আর অনেকখানি যন্ত্রণা
তা সে দেখতে পায়। আর নিমেষে আগামী আটশখানা রাত
এক অনবরত আর্তনাদে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
পর্নোগ্রাফি [Pornography]
স্মৃতি কি কখনো অশ্লীল হতে পারে?
তাহলে যা কিছু প্রকাশ্যে আনা যায় না, বা যার সাথে কোন তৃতীয় ব্যক্তির যোগসাজশ নেই এরকম সবকিছুই অশ্লীল বলতে হবে, কারণ যে স্মৃতি লিখে রাখা হয়নি, কাউকে বলা হয়নি কিংবা দেখানো হয়নি কোথাও, তার কামনা উদ্রেক করার কথা নয়।
না, মৃতদের প্রতি আমার কোন যৌন আকাঙ্ক্ষা নেই। নেই তোমার শবদেহের প্রতি কোন আকর্ষণ। যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা কী আমি তা জানিনা। তুমি মারা গেছ, আমি দেখেছি। একটা শবদেহ হিসাবে তোমাকে কখনো দেখিনি।
তবু বড় ইচ্ছে হয়।
আর কোন স্মৃতি এত বেশি অন্ধকার নয়
যা কিছু বাস্তব, তার প্রতি এরা এত হিংস্র
যেন এক একটা বিধ্বংসী আগুন, দিনের আলোয় আমি তাতে ঝাঁপ দেই
তুমি শ্বাস নাও, খানিক নড়াচড়া কর
তবু কী প্রচণ্ড এই নীরবতা …
চিত্রল উপন্যাস [Photo-novel]
এই উপন্যাসে সেই অ্যাডভেঞ্চারগুলো রাখা হয়েছে, যেগুলো তাদের ঘটার সময়েই বলা হয়েছিল।
এই সীমাবদ্ধতার অর্থ কিংবা গুরুত্ব কোনটাই এখানে আড়াল করা হচ্ছে না। বরং, স্পষ্ট করে জানানো হচ্ছে আবারও, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে ঠিক তাদের বলার সময়েই।
কিন্ত তার মানে এটা একটা খবরের কাগজ নয়।
কারণ, যা বাস্তব, তাকে আর কিছুতে নির্ণয় না করেও এখানে তার কথা বলা যেতে পারে। ওই খবরের কাগজের পাতা, তারিখের ফাঁকফোকর, কিংবা অনুশোচনা, এর কোনটাই এখানে নেই।
এই উপন্যাসটা একজনকে নিয়ে, একটা লোক। তার কোন নাম নেই। এছাড়া রয়েছে তার যুবতী স্ত্রী। সে মৃতা।
সম্ভাব্য অনেককটি জগতে একইসাথে আমাদের এই উপন্যাসটা ঘটছে। তার কয়েকটিতে, মেয়েটি এখনো জীবিত।
উপন্যাসটির কাল, বর্তমান। এই উপন্যাসের প্রতিটি সম্ভাব্য জগতের কাল, বর্তমান।
সময়, শব্দ এমনকি গন্ধ, স্বাদ এই সবকিছু এখানে লেখা হয়েছে আলো দিয়ে, আর মেঘ। আর কিছু না হোক, অন্তত এই ব্যাপারটা উপন্যাস রচনার সমস্ত সীমাবদ্ধতার প্রতি একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য।
যখন আর একটাই জগত শুধু পড়ে থাকে, যেখানে সে মেয়েটিও আর বেঁচে নেই, তখন এই উপন্যাসটা শেষ হয়ে যায়।
যেমন, আলো [Light, for example]
যেমন, আলো। অন্ধকার।
জানলার শার্সি।
বন্ধ মুখ। ক্রমশ জিভের কাছে খুলে যায়।
জানলা। সারি দিয়ে টাঙ্গানো।
স্তন। হাতের ঘনিয়ে আসা।
আরও নিচে। ভেতরে।
মেলে দেয়
জানুর ওপর। তার বিভাজিত ঠোঁট।
সেখানে একটা বাতি। ভিজে।
চোখ উপচে পড়ে ।
অনুবাদক পরিচিতি
অরিত্র চ্যাটার্জি – জন্ম ১৯৯৪। বড় হয়ে ওঠা উত্তর কলকাতার উপকণ্ঠে। পেশায় যন্ত্রবিদ, আগ্রহী জীববিজ্ঞানে, বর্তমানে বিড়লা ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (BITS, Pilani)-র, হায়দ্রাবাদ ক্যাম্পাসে সহকারী অধ্যাপক। ভালবাসেন বেড়াল, পুরোনো চিঠি ও নস্টালজিয়া সংক্রান্ত যা কিছু, জীবনকে সিনেমার ফ্রেমে দেখতে এবং অবসরে তার নিজস্ব ম্যাজিক খুঁজে বেড়াতে। কবিতা বা যাবতীয় লেখালেখি আসলে তাঁর কাছে স্বপ্ন লেখার চেষ্টা। প্রকাশিত কবিতার বই, “সার্কিস পারজানিয়ার ডায়েরি” (২০২১) ।