
জগাদার গবেষণাপাতা:তৃতীয় পর্ব
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
মনোবিজ্ঞানে সৃষ্টিশীলতার প্রণালীতে যে যে পদক্ষেপগুলি থাকে,তার একটি হলো 'ইনকিউবেশন'।এই সময়ে শিল্পীর জীবনে তেমন কোনও সৃষ্টির স্ফূরণের দেখা মেলে না।বরং সে স্বাভাবিকের থেকে নীরব হয়ে পড়ে অনেকটাই।কখনও মনে হয়,এ হলো তার অলসতা।অথচ যন্ত্র দিয়ে সেই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কর ভিতরে পৌঁছোলে দেখা যাবে,তার মস্তিষ্ককোষগুলি অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে রয়েছে।এ কী করে সম্ভব?!আসলে এই সময়ে শিল্পীর সৃষ্টি তার রূপ নিতে থাকে তার মনে মনে।বড় ইমারত গড়বার আগে আর্কিটেক্টের নিখুঁত পরিমাপে তৈরি ব্লুপ্রিন্টের মতো।মজার কথা এটাই যে ভিতরভিতর এই প্রক্রিয়া যে ঘটছে,একথা স্রষ্টা নিজেই জানে না।পুরো ঘটনাই ঘটতে থাকে তার অবচেতনে।
ডিরেক্টর্স ব্লক বনাম অস্তিত্বর চতুষ্কোণ
এক একটা সময় আসে।কলম থেমে যায়।থেমে যায় ক্যামেরাও।এদিকে সময় বয়ে চলে।সেই ছেলেবেলায় শোনা ছড়ার নদীর মতোই।সম্পাদক খচে বোম লেখকের ওপর।দর্শক খচে অগ্নিশর্মা ডিরেক্টরের ওপর।কিন্তু মানুষটির হেলদোল নেই।সে মাঝসমুদ্রর নিস্তরঙ্গ ডলড্রামে উদ্দশ্যহীন নাবিকের মতো তাকিয়ে আছে।শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এই যে একটা থিট্রিকাল পজ বা নাটকীয় নিঃশব্দতা,এটাই হল সমালোচকদের কাছে হীরের খনির মতো।কেন এই কথা বলছি?কারণ এই সময়টায় শিল্পের বাইরে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনব্যবচ্ছেদের জন্য স্ক্যালপেল শানিয়ে তোলবার সুযোগ পায় গবেষক।তার গভীর অন্বেষণ তখন শিল্প নয়।শিল্পী স্বয়ং।বিখ্যাত ফরাসী চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়াঁ যেমন তার আত্মজীবনীর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন,”আমাকে আমার সব বন্ধুরা আত্মজীবনী লিখতে বলছে…..তাদের কাছে আমি এতোদিন আমার ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের মাধ্যমে যে সৃষ্টির মুক্ত প্রকাশ দেখিয়েছি তাই যথেষ্ট নয়।তারা এবার সৃষ্টি নয়,স্রষ্টাকে জানতে চায়।”এই ঘটনা অনেকটা উপাদেয় খাবার খাবার পর,তার রেসিপি পরখ করার মতো।অনেকটা ঈশ্বরসন্ধানের মতোও বটে।ঈশ্বরকে অবতার তৈরি করে রক্তমাংসে নির্মাণ করে খানিক নিজের অসহায়তাকে জয় করার মতো।মনকে বোঝানো।যতোই তুমি জিনিয়াস হও বাপু,জগার দরবারে তোমাকে আসতেই হবে।আর জগার দরবার হলো দুঃখের দরবার।সেখানে শুধুই আয়না সাজানো।
এই বিষয়ে লিখতে গিয়েই মনে পড়ে গেল আরেক বিখ্যাত চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস’ ছবির এক দৃশ্যর কথা মনে পড়ে গেল।এই ছবিতে আটটা ছোট্ট অনুনাটিকা রয়েছে।তার একটির নাম ‘সুরঙ্গ'(টানেল)।ইয়োশিতাকা সুশি সেখানে এক নিঃসঙ্গ যুদ্ধফেরত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করছেন।সৈনিকটি একটি সুরঙ্গপথের দিকে এগিয়ে চলেছে একা।পথ আগলে রয়েছে এক ক্ষ্যাপা কুকুর।সে এই কামড়ায় কি সেই কামড়ায়।কুকুরের কামড় থেকে বাঁচতে নায়ক চলে আসে সুরঙ্গপথের অপর প্রান্তে।সেখানে আসবার পর সে শুনতে পায় তাকে অনুসরণ করছে কারো বুটের শব্দ।তারপর হঠাৎ চমকে উঠে দেখে সে।এক রক্তশূন্য ফ্যাকাশেদর্শন তরুণ সৈন্য বেরিয়ে আসছে সুরঙ্গপথ থেকে।সৈনিকটি মৃত।অথচ সে জানে না সে মৃত।সে তার বাড়িতে ফিরতে চায়।তার নিজস্ব গ্রামে।তার বাবা মায়ের কাছে।কথক তাকে বাস্তব বোঝাতে চায়।পারে না।সেই সৈনিক নাছোড়বান্দা।সে ফিরে যাবেই।অবশেষে তাকে হুকুমের ঢঙে সেই কেন্দ্রীয় চরিত্র ঘরে ফিরে যেতে বলে।সেই সৈনিক চলে গেলে এইবার তার পিছুপিছু পুরো একটা প্লাটুন সৈন্যদল সুরঙ্গপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে।তারা অপেক্ষা করে।সেই নিঃসঙ্গ তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা সৈনিকটির আদেশের অপেক্ষা।বাকরুদ্ধ হয়ে আসে তার।এই পুরো ব্যাটিলিয়ন যে অতীত।মৃত।অবশেষে একসময় তারাও ফিরে যায় অন্ধকারে।সেই উন্মাদ হিংস্র কুকুরটি ফিরে আসে আবার।চিত্রসমালোচক এরিক সান জুয়ান কুরোসাওয়ার এই দৃশ্যটিকে আত্মজৈবনিক হিসেবে দেখেছেন।এই মৃত সৈনিকদের সম্মুখিন হওয়া যেন তাঁর সারা জীবনের সৃষ্টির সম্মুখিন হওয়া।তবে কি ওই খেঁকি কুকুরটি তার আত্মসমালোচক সত্তার প্রকাশ?এই প্রসঙ্গে বলি কুরোসাওয়া এই সিনেমাটি তৈরি করবার পাঁচ বছর আগে “রান” সিনেমাটি করে তার চিত্রপরিচালক জীবনের থেকে অবসর ঘোষণা করেছিলেন।কিন্তু সেই পাঁচ বছরের নিস্তব্ধতা ফিরিয়ে এনেছে তার স্বপ্নগুলোকে।এ কী করে সম্ভব হলো?
মনোবিজ্ঞানে সৃষ্টিশীলতার প্রণালীতে যে যে পদক্ষেপগুলি থাকে,তার একটি হলো ‘ইনকিউবেশন’।এই সময়ে শিল্পীর জীবনে তেমন কোনও সৃষ্টির স্ফূরণের দেখা মেলে না।বরং সে স্বাভাবিকের থেকে নীরব হয়ে পড়ে অনেকটাই।কখনও মনে হয়,এ হলো তার অলসতা।অথচ যন্ত্র দিয়ে সেই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কর ভিতরে পৌঁছোলে দেখা যাবে,তার মস্তিষ্ককোষগুলি অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে রয়েছে।এ কী করে সম্ভব?!আসলে এই সময়ে শিল্পীর সৃষ্টি তার রূপ নিতে থাকে তার মনে মনে।বড় ইমারত গড়বার আগে আর্কিটেক্টের নিখুঁত পরিমাপে তৈরি ব্লুপ্রিন্টের মতো।মজার কথা এটাই যে ভিতরভিতর এই প্রক্রিয়া যে ঘটছে,একথা স্রষ্টা নিজেই জানে না।পুরো ঘটনাই ঘটতে থাকে তার অবচেতনে।এই অসম্ভব ঘটনাটির চালিকাশক্তি নানা রকম হতেই পারে।অবসাদ,বিচ্ছেদ,আত্মতুষ্টি,কামনার পূর্ণতা প্রভৃতি।এতো কিছুর ভিতরেও সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল যে চালিকাশক্তিটি,তার নাম অস্তিত্বসংকট ও নিঃসঙ্গতার হাতছানি।মাঝেমাঝে ভাবি আমি।এই যে শহরে আবাসনে এত বসতবাড়ির স্কোয়ারফিট নিয়ে দরাদরি কামড়াকামড়ি।যদি কোনও একদিন এক একজন মানুষকে এক একটি উপগ্রহ দিয়ে দেওয়া হয়,তাহলে কি সে ভালো থাকবে?হয়তো না।কীভাবে থাকবে?জীর্ণ,অভুক্ত হলেও মানুষের মূল সংকটের জায়গা হল তার নিঃসঙ্গতা।দক্ষিণ ভারতের এক সাততারা হোটেলের ডিস্কোথেকে গেছি।সেখানে ডিজে পার্টি হচ্ছে।অথচ ঘরে কোনও আওয়াজ নেই।পিনপড়া নিস্তব্ধতা।কীকরে?প্রথমে থতমত খেলেও পরে বুঝলাম।ঘরে আপনমনে নৃত্যরত প্রতিটি তরুণতরুণীর কানে কানঝিনুক গোঁজা।সেখানে তার পছন্দ মতো গান বাজছে।নিজের পছন্দর গান নিজে শোনো।অন্যকে জ্বালিও না।ভাবখানা এমনই।অথচ বার্ষিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে সেই রাজ্যই দেশে তরুণবয়সের আত্মহত্যার নিরিখে প্রথম তিন জনের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে বসে আছে।অস্তিত্বসংকট বনাম নিঃসঙ্গতার ভয়ের দ্বৈরথের আশ্চর্য বিবরণ পাই আকিরা কুরোসাওয়ার আত্মজীবনীর একাংশে।সেই বর্ণনাও তার ছায়াছবির চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।
দিনটা ১৯২৩ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর।পুরো জাপান সেদিন টলে উঠেছিল ভয়ানক ভূমিকম্পে।কুরোসাওয়ার তখন মাত্র তেরো বছর বয়স।তবু অতোটুকু বয়সেই সে ইমারতের খসে পড়া দেখতে পেল স্বচক্ষে।প্রথমে বোঝেনি সে।পায়ের নীচে পাটির সামান্য থরথর কাঁপা ছাড়া কিছুই ছিল না তেমন।কুরোসাওয়া তখন তার এক সমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে খেলছিলেন।হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই ভয়ানক ঘটনার সামনে হতবাক বালকটি আবিষ্কার করেছিল,তার নিজের বসতবাড়ির অর্ধেক ততোক্ষণেষভেঙে পড়েছে।প্রথমেই তার মনে বিষাদ এল না।এল দর্শন।পৃথিবীর বুকে সে একা।তার পরিবার ওই ধ্বংসস্তূপের নীচে অতীত।কুরোসাওয়া লিখছেন,”আমি আমার ছেড়ে যাওয়া বন্ধুর কাছে ফিরে এসে দেখলাম সে একটা রাস্তার পোস্ট আঁকড়ে সপরিবার দাঁড়িয়ে আছে।সবাইই রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে জমায়েত করে রয়েছে।আমি বুঝলাম এই পরিস্থিতিতে আমার আর তেমন কিছু করবার নেই।আমি ঠিক করলাম আমি আমার সেই বন্ধুর কাছেই থেকে যাব।”কুরোসাওয়ার পরিবার সে যাত্রায় অক্ষত থেকেছিল ঠিকই।কিন্তু বহু বছর বাদে স্বপ্ন নিয়ে সিনেমাটি করতে গিয়ে প্রথম অনুনাটিকায় কুরোসাওয়া সেই একাকী নিঃসঙ্গতার ভয় ও তার থেকে উৎপন্ন রামধনুর অস্তিত্বর কথা দেখিয়েছেন।একজন প্রকৃত শিল্পীর জীবনে,লেখকের জীবনে,বা একজন চিত্রপরিচালকের জীবনে এই ‘ব্লক’ আসাটা অত্যন্ত জরুরি।কে বলতে পারে তার এই নিস্তব্ধতা আসলে তার আরেক যুগান্তকারী সৃষ্টির প্রস্তুতিপর্ব নয়?সৃষ্টিশীলতার চতুষ্কোণে এই স্তব্ধতার মধ্যবিন্দুর উপস্থিতি অতএব অনস্বীকার্য।
(ক্রমশ)
চিত্র-সৌজন্য – অভিরুচি চট্টোপাধ্যায়