ছোটগল্প <br />  প্রতিভা সরকার

ছোটগল্প
প্রতিভা সরকার

সহোদরা

কোশ্চেন পেপারকে তখন আমরা বলতাম প্রশ্নপত্র। তাই হাতে নিয়ে অঙ্ক পরীক্ষার দিন বিকেলে দু বোন বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে বাবার সামনে এসে দাঁড়াতাম। প্রত্যেকটা অঙ্কের পাশে ফাউন্টেন পেনের নিবে উত্তর লেখা। তাতে নাকি হাতের লেখা ভালো হয়! উত্তরগুলো হাতের ঘামে একটু ধেবড়ে যেত। বাবা রেগে যেত, এটা পাঁচ না ছয় কী করে বুঝব! বোন সুবিধে হবে বুঝলে পাঁচকে ছয় বানিয়ে দিতে দ্বিধা করতো না। বাবা তো বুঝতই, আমিও ওর জালিয়াতি ধরে ফেলতাম। খাতা পেন নিয়ে অঙ্ক কষে মিলিয়ে দেখতে দেখতে বোনের দিকে চোখ বড় করে তাকাত বাবা, এটাকে দিয়ে কিসসু হবে না। গবেট একটা।

আমি খুব আনন্দ পেতাম। আমার একশতে একশই বাঁধা। ওর ষাট ওঠে কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ, আনন্দ পেতাম, খুশি হতাম, কারণ একটু বড় হবার পর আমার হিংসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বোনের গায়ের রঙ আর ফিগার। শুটকো মুলোর মতো ভাঁজ ফেলা চামড়া, রোগা চেহারা আর কালো রঙ নিয়ে আমি তখন পাড়ার সেরা কুচ্ছিত মেয়ের শিরোপা পাবার জন্য প্রস্তুত। আমি আমার কালো মায়ের মতো,গায়ের রঙের জন্য যার শ্বশুর বাড়িতে হেনস্থার শেষ ছিল না।

আর বোনের সবকিছুতে বাবা বসে আছে! টকটকে গৌরী সে, নাক চোখ মুখ, ভরা কন্ঠা, এমনকি লালচে পাতলা ঠোঁটের জন্যও সবাই তার প্রশংসা করে। আমি জ্বলে মরি। আমি দেখেছি ওকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে হাসিমুখ করে দেখতে। সেই হাসিতে আমার জন্য তাচ্ছিল্য ছিল না আমি জানি, কারণ ও তো দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকা আমাকে দেখতেই পায়নি, দেখলে ওভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসত না। কিন্তু কিছু তো একটা ছিল, যাতে আমার মাথায় আগুন ধরে যেতো। এই হাসিটাই আর কার মুখে দেখেছি ভাবতে গিয়ে আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠা জোড়া এক দৌড়বীরের ছবি চোখে ভেসে উঠল। গলায় স্বর্ণপদক। আয়নায় বোন যেন ঐরকমই সেরা ফর্মে থাকা এথলিট, পৃথিবীটাকে পায়ের নিচে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম। আমার গায়ের রঙ এইরকম কালো কেন, মা! বোন তো কতো ফর্সা! মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, তুই হয়েছিস আমার মতো। তাতে কী। কালো জগতের আলো। মায়ের কোঁকড়া চুল থেকে ভাপ ওঠার মতো নারকেল তেলের গন্ধ উঠতো,আর কথাগুলো বিশ্বাস করতে গিয়ে আমার চোখ রোদ পড়া টিনের চালের মতো ঝলমল করতো।

কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্য! একসঙ্গে দুজনে বেরলে সবাই বোনকে দেখত। আমি টের পেতাম। অচেনা কেউ হলে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করত, তোমার আপন বোন! আমার কান ঝাঁ ঝঁ করত। কারণ নিন্দেমন্দ, তাচ্ছিল্য, অনুকম্পা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধির দরকার হয় না। গলার স্বরে, তাকানোর কায়দাতেই বোঝা যায়। আমিও বুঝতাম। রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম। আমার কোলবালিশে বোনের ঘুমন্ত পা এসে পড়লে লাথি মেরে সরিয়ে দিতাম।

বোনকে সঙ্গে নিয়ে চৌপথি পার হয়ে মদনমোহন বাড়ি যাবার সময়, কতো সাইকেল ঘষটে থেমে যেতো, আশেপাশে বড়রা নেই দেখলে তীক্ষ্ণ সিটি উড়ে আসতো। আমি জানতাম কোনটারই উদ্দিষ্ট আমি নই। আসল লোক তো আমার বোন, হাতে পুজোর থালা নিয়ে সবুজ ফ্রকে মরালীর মতো যে ভেসে চলেছে। তবু তো তখন সে মাত্র ক্লাস এইট। রাস্তায় কারো দিকেই তাকাতো না ও। তবুও আমার নিচু হয়ে ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে সিটিওয়ালাদের দিকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করত। শালা শুয়োরের বাচ্চারা। এইটুকু মেয়েকে দেখে ছোঁকছোঁক! ঘরে মা বোন নেই! নিশঃব্দে মুখ খারাপ করতে করতে ভুলে যেতাম, আমিও কিন্তু তখন সবে ক্লাস নাইন।

আর একটু বড় হবার পর স্বাভাবিকভাবেই এই দমচাপা হিংসে ভিসুভিয়াস হয়ে গেল। অনবরত ছোটখাটো অগ্নুৎপাত লেগেই আছে, কবে যে সশব্দে গোটাটাই ফেটে পড়বে কেউ জানে না। ততোদিনে বোনও সব বুঝে ফেলে ঝগড়া করতে শুরু করেছে। কখনো হাতাহাতিও লেগে যেত। নখের আঁচড়, মুঠোয় ওপড়ানো কয়েকটি চুল, আনতাবড়ি লাথি,কয়েকটা কিল চড়, তারপর সব শান্ত হতো। মা সবসময় আশংকায় থাকতো এই বুঝি আবার শুম্ভ নিশুম্ভে লড়াই লেগে গেল।

আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরে কাঠের বাড়ি ছিল ঘনশ্যাম সাহাকাকার। কাঠের বাড়ি মানে যার বাড়ি সে তখন ও তল্লাটে বড়লোক। মজবুত শালবল্লার খুঁটির ওপর সার সার মোটা তক্তা পাশাপাশি পেতে ঘরের মেঝে। মাটি থেকে অন্তত এক মানুষ ওপরে। মেঝেতে লাফালে ধুপধাপ আওয়াজ হতো। লম্বা ঘরের মাঝে মাঝে কাঠের পার্টিশন দেওয়া, ফলে এক সারিতে তিনটে ঘর। মাথায় ঢালু টিনের ছাউনি। উল্টো দিকে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর, ডানদিকে গোয়ালঘর, মুনিষদের ঘর। কুয়ো বাথরুম। আরো দূরে পায়খানা। বাড়িটায় খুব লক্ষ্মীশ্রী ছিল। গোবর ছড়া দিয়ে রোজ উঠোন লেপা হতো। উঠোনের বাঁ কোণে একটা স্থল পদ্মের গাছ কোজাগরির দিন গোলাপি হয়ে থাকত।

তখন সবাই বলতো সাহারা খুব বড়লোক হয়। রাধেশ্যামকাকার গম ভাঙাবার মেশিন, তেলের কল, এছাড়া বন্ধকি কারবারে সে নাকি দূরদূরান্তেও এক নম্বর। কাকার একটাই ছেলে, আমার বয়সী। এক ক্লাসে পড়ি কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নেই, দিনরাত সিনেমা দেখা, আড্ডা মারা, এইসব। কাকার ঈশ্বরভক্তি, দিবারাত্রি ইষ্টের নাম মুখে আনবার প্রবণতা তার কপালের ফোঁটা তিলকের মতো সন্তানের নামকরণেও চুইয়ে পড়েছিল, ফলে আমার বন্ধুটির নাম ছিল গোবিন্দ।

এই গোবিন্দ বোনের প্রেমে পড়লো। পড়লো মানে তার আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা রইল না। দিনরাত সে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে সকালে ফুটবল, বিকেলে ক্রিকেট প্র‍্যাক্টিস করে। নাওয়া খাওয়ার সময় কী ক’রে ম্যানেজ করে কে জানে! কিন্তু পাশের বাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে আমাদের বাড়ির উঠোন যেখান থেকে দেখা যেত, বাদবাকি সময়েও সে সেখানে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াতো, ব্যায়াম করতো। অনেক সময় চুপ করে উদাস চোখে এমনি তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছি।

আমার যেন দায়িত্ব কর্তব্য অনেক বেড়ে গেল। একে তো অপমানের জ্বালা, আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে, আমি সেই ক্লাসের সেরা ছাত্রী, তবু আমায় প্রোপোজ করল না, আবার আমারই ছোট বোনের দিকে হাত ! আমি বোনের ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করলাম। কলপাড়ে গিয়ে একটু দেরি হলেই, এই তুই কোথায় গেলি রে, ব’লে হাঁকডাক তো ছিলোই, তারপর শুরু হলো লুকিয়ে নজর রাখা। বোন কখনো ওদিকে তাকায় কিনা, তাকিয়ে হাসে কিনা, এইসব। আমার সামনে এসব করে না বলে, আড়ালেও করবে না তার ঠিক কী! হিংসে তো ছিলই, এবার সন্দেহ জুড়ে যাওয়ায় আমি চেষ্টা করেও আর স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখতে পারলাম না।

আমাদের সেই মফস্বলে সিনেমা হল ছিল একটাই, আর পঞ্চাশ পয়সার টিকেট কাটলেই তার লেডিজে ঢুকে পড়া যেতো। রোজ বিকেলে তারস্বরে মাইকে গান বাজিয়ে লোক ডাকা শুরু হতো। দুটো গানই ঘুরে ফিরে বেশি বাজানো হতো, দুটোই লতা মঙ্গেশকারের, নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা… আর আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন…। গান দুটো বাজতে থাকলে ঘড়ির দিকে না তাকালেও বোঝা যেতো বিকেল নেমেছে, একটু পরেই মানসাই নদীর ঢেউয়ের নীচে সূর্য অস্ত যাবে। মেয়েমহলে কালো গোড়া কষার ফিতে দিয়ে চুল এঁটে বাঁধার ধুম পড়ে যেত, মা কাকিমা ব্যস্ত থাকলেও জ্ঞাতি পিসিরা আর আমরা দুই বোন বাড়ির লম্বা বারান্দায় বসে খুব হা হা হি হি করতাম। রাস্তা থেকে সে বারান্দার দূরত্ব মেরেকেটে পনের হাত হবে। সিনেমা হলের মাইকে গান শুরু হলেই ইদানিং গোবিন্দ সাইকেলে সে রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। বোনেরই উচিত ছিল উঠে ঘরের ভেতর চলে যাওয়া, কিন্তু ও এই ভরা আড্ডা ছেড়ে যেতে চাইত না। নির্লজ্জের মতো আরো গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতো। আমি বললে আমার সঙগে ঝগড়া করত, আমার কী ঠেকা! তোর ইচ্ছে হয় তুই যা না। একটা অকারণ রাগ, অপমান, হতাশা আমায় দখল করে নিচ্ছিল, আর ঠেলে দিচ্ছিল একটা চরম সিদ্ধান্তের দিকে। আমি বাবাকে গোবিন্দের ব্যাপারটা জানিয়ে দেব।

ব্যাপার কিছু থাকুক না থাকুক, আমাদের সময় নালিশ করলেই বড়দের মধ্যে তার প্রতিকারের জন্য অস্থিরতা দেখা যেত। যাইই ঘটুক, ধরে নেওয়া হতো মেয়েটিই দোষী, তার চলনে বলনে কোথাও কোনো উস্কানি ছিল। আর বাবার ছিল অমানুষিক রাগ, কর্তৃত্বের উন্মাদ বাসনা। দিদি কি তোর নামে তবে মিথ্যে কথা বলছে, শেষ অব্দি ঐ অশিক্ষিত ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে, আমি সবাইকে মুখ দেখাব কী করে, আজ থেকে বিকেলে বাইরে বসা তোদের দুজনেরই বন্ধ। যেমন আতাক্যালানে মা, তেমন তো মেয়েরা হবে, এইসব আউড়ে আউড়ে মেরেই চলল, যতোক্ষণ না বোন উঠোনে আছড়ে ফেলা একটা নিষ্প্রাণ পেঁয়াজ ভর্তি বস্তার মতো মেঝের ওপর ধপ করে পড়ে যায়। তবে বাবা ঘাবড়ে গিয়ে মার থামায়। আসল ব্যাপারটা কিন্তু মা ছাড়া কেউ বোঝেনি। বোনের চোখেমুখে জল দেবার জন্য রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে কানের কাছে হিসিয়ে উঠে বলে গেল, তোর পেটে এতো হিংসা !

হিংসা ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? বাঁচলেও সে বাঁচা কি মানুষের মতো বাঁচা হয়? হিংসের কারণেই তো যতো উন্নতি। ওর আছে, আমার কেন নেই, এই প্রশ্ন আর আক্ষেপই তো মানুষকে চিরকাল ছুটিয়ে মেরেছে। তাই আরো ভালো, ওর চেয়ে ভালো করব, এই জপতে জপতে দারুণ ভালো রেজাল্ট করে বসলাম। ফার্স্ট তো বটেই, সেকেন্ড গার্লের থেকে অনেক বেশি নম্বর এগ্রিগেটে। ক্লাস টেন। বাবা বললো, ফাইনালে ডিস্ট্রিক্টে যদি ফার্স্ট হোস তবে স্কলারশিপ পাবি। আমাদের সময় বাবা মায়েরা ঐরকমই ছিল। বোর্ডে স্ট্যান্ড করা নয়, সব বিষয়ে লেটার পাওয়া নয়, ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেলেই হবে! তা ঐ আশাতেই জোর লেখাপড়া চালাচ্ছিলাম, দুম করে একটা ঘটনায় প্রায় বোবা হয়ে গেলাম।

সেই মার খাওয়াবার পর থেকে বোনের সঙ্গে সম্পর্ক আর ভালো হয়নি। কথা চলে মা-কে মাঝখানে রেখে, বাবার সামনে স্বাভাবিকতার ভান করি, আসলে কিন্তু আমরা পরস্পরের চোখে চোখ রাখতেও ঘেন্না পাই। ছোটবেলা থেকেই দুজনে একসঙ্গে মণিমেলায় খেলতে যেতাম, যদিও এবছরটাই আমার শেষ বছর, তবু ব্রতচারী শিখতে, কাঠিনাচ নাচতে এখনো ভালো লাগে। কিন্তু এখন যাওয়া আসা সব আলাদা আলাদা, আমি দশহাত আগে, ও দশহাত পিছে। এটা অবশ্য বাবার হুকুম মাথায় রেখে ছক কষে করা, বাবা দেখে ফেললে যেন বলা যায়, একসঙ্গেই যাচ্ছিলাম, এখনই একটু এগিয়ে বা পিছিয়ে গেছি।

সেই সময়টায় মনের অশান্তিতে এবং রাত জেগে পড়ার ফলে আমি আরো শুটকো মেরে যাচ্ছিলাম, চোখের কোলে অন্ধকার,গায়ে যেন আরো কালি ঢালা। সেদিন মণিমেলার মুখ্য সঞ্চালক কিশোরদা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল,

-কী চেহারা বানাচ্ছিস রে! তুই কী কোনো ঝামেলায় পড়েছিস? যাকগে, এবার তো তোর শেষ বছর, লাইব্রেরি থেকে গত বছর খান দশেক বই নিয়েছিলি, দুটো ছাড়া সব ফেরত দিয়েছিস। ঐ বইদুটো কাল আমার চাই।

কিশোরদা মানেই ছ’ফুট হাইট, পতৌদির নবাবের মতো বাজপাখি-নাক, শশি কাপুরের মত এলোমেলো চুল, সারা টাউনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চেহারার ছেলে। কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বললে তার জীবন ধন্য হয়ে যায়। সে যাই হোক, কিশোরদা হোক বা অন্য কেউ, চেহারার খোঁটা দিলে আমার কান গরম হয়ে যায়। মনে হয় বোনের সঙ্গে তুলনা করছে। আমার সমস্ত দুর্ভাগ্যের মূলে ও, আমার নিজের পিঠোপিঠি বোন। কান্না পাচ্ছিল, তবু আমতা আমতা করে বললাম,

কাল ? কাল তো আমি আসব না মণিমেলায়। আমার টিউশন আছে বিকেলে।

না না, মণিমেলায় বই আনা আমি এলাউ করি না, তুই তো জানিস। এখানে সবাই কাড়াকাড়ি করে, এন্ট্রি ছাড়াই বই নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কাল কানুদা স্টক মেলাবে। তুই এক কাজ কর,টিউশন যাবার আগে বইদুটো আমার বাড়িতে দিয়ে যা।

দুপুর তিনটের সময় বই ফেরত দিতে যাব! সাড়ে তিনটের মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছাতে পারব! আমার ইতস্তত করা দেখে কিশোরদা আবার বলে,

আহা, কাউকে তো ডিস্টার্ব করা হবে না তাতে। মা তো নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমোয়। তুই কড়া নাড়লে আমি বইটা নিয়ে নেব। একটা সই মেরে দিয়ে তুই চলে যাবি। একটু দেরি করে গেলে অনিল স্যার কিছু বলেন না, আমি জানি। তুই তো একা নোস, এই মণিমেলারই কতো ছেলেমেয়ে পড়ে ওঁর কাছে।

পরদিন বই দুটো আলাদা করেই নিলাম। টিউশনির বই খাতা ব্যাগে, এদুটো হাতে। যাব আর সই করে ছুট দেব।

বেল বাজাতে কিশোরদা এসে দরজা খুললো,

ও তুই এসে গেছিস৷ একটু বসে যা, আমি আসছি।

কিশোরদা বাইরের দরজা বন্ধ করে ভেতরের দরজা দিয়ে কোথায় যেন উধাও হল। আমি বসে উশখুশ করছি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বোন তো এতোক্ষণ টিউশন ক্লাসে পৌঁছে গেছে, সন্ধেয় আবার বাবার কাছে না লাগায় যে দিদি টিউশনির নাম করে বেড়াতে গেছিলো। হয়ত এখন স্যার প্রথমে সংস্কৃত পড়াবেন বলে বই খুলেছেন, তারপর অঙ্ক। সব যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম আর ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছিল। দু একবার ভেতরের দরজাটার কাছে গিয়ে নিচু গলায় কিশোরদাকে ডাকলামও। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি কাকিমার ঘুম ভেঙে যায়।

শেষ অব্দি বই ফেরতের জাবদা খাতা নিয়ে কিশোরদা এল। এবার ভেতরের দরজাটাও এঁটে দিল। আমি তাকিয়ে আছি দেখে একটু হেসে বলল,

জানিসই তো মা এসময়টায় ঘুমোয়। নে এইখানে সই কর।

কিশোরদাকে লাগছিলো কী, যেন রাজপুত্র ! আকাশ রঙা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামায় সে যেন আমাদের সিনেমা হলের পর্দা থেকে এখুনি নেমে এল আমার কাছ থেকে বই নেবে বলে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে কিশোরদা মৃদু হাসল, তারপর ঘরের পেছনদিকে চলে গেল কী করতে। আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ওর দেখানো জায়গাটা সই করব বলে পেনটা হাতে নিয়ে একটু কুঁজো হয়েছি, আমার কাঁধে কার দুটো হাত এঁটে বসল, আমায় তুলে সোজা দাঁড় করিয়ে দিল। জর্দাপানের গন্ধ ছড়ানো একটা মুখ ঝুঁকে এলো আমার ডানদিকের গালের ওপর, দাড়িওয়ালা চিবুক ঘসতে ঘসতে জিজ্ঞাসা করল,

চেহারা এতো খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন রে! মন খারাপ? আমি মন ভালো করে দেবার ওষুধ জানি কিন্তু।

কিশোরদার গলায় গভীর দরদ। আমার সঙ্গে এতো দরদ ঢালা কথা কেউ কখনো বলেছে কি! কেউ কি তাকিয়ে দেখেছে কখনো? কেউ তো কেউ, এ তো স্বয়ং কিশোরদা, গোটা টাউনের উঠতি বয়সের মেয়েরা যাকে রোজ স্বপ্নে দ্যাখে। তবুও কে জানে কেন, আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল, কেন্নোর মতো এঁকেবেঁকে সরে যাবার চেষ্টা করছিলাম, আরেকজনের লম্বা দাঁড়িয়ে থাকা পেশিবহুল শরীর পিঠের ওপর চেপে এলে যা হয় আর কি! সেই দরদী গলা আমার কানের ওপর গরম ঠোঁট চেপে অনেক কিছু বলছিল, আর আমাকে আস্তে আস্তে টানছিল বিছানার দিকে। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না, শুধু মনে মনে ভেবে যাচ্ছিলাম, তবে কি কিশোরদা আমাকে ভালবাসে? শুনেছি ভালবাসলে তবেই এইরকম করা যায়। সবাইয়ের মধ্যে আমাকেই যদি কিশোরদা বেছে নিল তো আমায় ছেড়ে দিয়ে ও কেবল ভালবাসার কথাই বলুক না কেন! ভালবাসার কাঙাল আমি কান ভরে শুনি।

মোদ্দা কথা, আমি যেন মায়াবী অজগরের গ্রাসে ছিলাম। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম, তার পুঁতির মতো ঝকঝকে চোখে এমন সম্মোহন, শিকার আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই করতে পারে না। সত্যি যেন নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টাও খুব বেশি হতো সেদিন আমার পক্ষে। তাই নিশ্চেষ্ট থেকেও আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিকে, যেদিকে দুর্লভ মণি মাথায় নিয়ে অজগরটা আমায় টানছিলো। খুব অবশ, ঘুম ঘুম ভাব, আমার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসছিলো।

হঠাৎ বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার জোর আওয়াজ। কিশোরদা স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলো। কে কে বলে চিৎকার করল, স্পষ্ট বুঝলাম ওর গলা কেঁপে যাচ্ছে।

উত্তরে আরো জোরে কড়া বেজে উঠল। আমি তখনও ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। টের পাচ্ছি আমার সারা গায়ে অচেনা গন্ধ। জর্দার গন্ধ, নাকি নিষিদ্ধ কামনার বুঝিনি। কিন্তু থরথর করে কাঁপছিল হাত পা। এতোক্ষণের ভালো লাগা, আবেশ, ঝিমঝিম ভাব উধাও হয়ে অনুশোচনা, ভয়ে, লজ্জায় আমার বমি পাচ্ছিল।

দরজাটা একটু ফাঁক করলো কিশোরদা,

-কে ?

ওপাশ থেকে বোনের সরু গলা পেলাম,

দিদিকে বার করে দিন কিশোরদা। আমি কিন্তু বাবাকে খবর পাঠিয়েই এখানে এসেছি।

সব ধানাইপানাইয়ের মুখ বন্ধ করে দিল শেষ বাক্যটি। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। চোখ নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে, মাথা নীচু। বোন আমার হাত টেনে হিড়হিড় করে দৌড়াতে লাগলো স্যারের বাড়ির দিকে। শুধু একবার মাথা ঘুরিয়ে বলল,

বাবা কিন্তু কিছু জানে না। তুইও কিছু বলিস না। ওটা না বললে ও তোকে ছাড়তো না। বলে দিত, তোর দিদি এখানে আসেনি তো। ঐ লোকটা যে ঐরকম তুই জানতিস না ?

কাল মাঠে তোদের কথা কানে এসেছিল। তোর ওপর প্রচন্ড রেগে থাকায় কিছু বলিনি। কিন্তু এতো দেরি হচ্ছে দেখে…

একবার মনে হল ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু স্ট্যান্ডটায় ওঠার মুহূর্তে কে যেন আমাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছে। সারা মাঠের লোক মুখে আঙুল পুরে সিটি বাজাচ্ছে, ফেটে পড়ছে টিটকিরিতে। দ্যাখ দ্যাখ, ঐ কেলে শুঁটকি মাছটাকে দ্যাখ, বামন হয়ে ওর চাঁদ ধরবার ইচ্ছে হয়েছিল! রাগে ক্ষোভে চোখ বুজে আসে আমার, কী দরকার ছিল বোনের কিশোরদার বাড়ি ছুটে যাবার !

পরক্ষণেই নিজের বিকট চিন্তায় নিজেই শিউরে উঠি, বোন না গেলে আজ কী হতো!

ছুটতে ছুটতেই আর একটা ভাবনা মাথায় ঢুকে পড়ে। আড়ি পেতে শুনে বোন জানতো যে আমি কিশোরদার বাড়ি বই ফেরত দিতে যাচ্ছি, কিন্তু এরকম যে হতে পারে সেটা ও জানলো কিভাবে ! তবে কী… তবে কী…ওর সঙ্গেও কখনো, কোনোদিন… ।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (14)
  • comment-avatar
    পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় 4 years

    সুন্দর লেখা। মানুষের জটিল মন লেখায় উঠে এসেছে।

    • comment-avatar

      অনেক ধন্যবাদ কবি! আপনার মন্তব্য মূল্যবান।

  • comment-avatar
    সুদেষ্ণা 4 years

    ভালো,ভালো…অনেক কথা জমে রইলো।

  • comment-avatar
    যশোধরা 4 years

    সাইকোলজিকাল টুইস্টের গল্প। চিরকালীন মধ্যবিত্ত নস্টালজিয়ায় চোবান। কেয়াবাৎ

  • comment-avatar
    Amit sarkar 4 years

    অসাধারণ লেখা।

  • comment-avatar
    Ishita Bhaduri 4 years

    খুব ভালো লাগল। এক নিঃশ্বাসে শেষ লাইন অবধি এলাম…

  • comment-avatar
    Sayantani 4 years

    আপনার গল্প পড়ার নেশা হয়ে যাচ্ছে দিদি। খুব ভাল লাগল।

  • comment-avatar
    কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় 4 years

    চমৎকার একটি গল্প । অনেক চেনা ছবি । বউকে হোয়াটস্যাপ করে গল্পটা পাঠালাম । দুই বোনকে নিয়ে উত্তম পুরুষে লেখা গল্প । পরতে পরতে গল্পের অভিমুখ বদলে বদলে যাচ্ছে । অঙ্ক পরীক্ষার উত্তর আমরাও টুকে আনতাম প্রশ্নপত্রে । তখন সুলেখা কালির যুগ , ফলে ধেবড়ে তো যেত, আর তার সুযোগ নিতাম আমি । খুব অমনোযোগী ছিলাম তো পড়াশোনায় । বাবা ট্রান্সলেশন ও ধরতো , ভয়েস চেঞ্জ , এখানেও এক একবার এক
    একটা উত্তর দিতাম , যেটা ঠিক বলতো সেটাই পরীক্ষার খাতায় লিখেছি এমন দাবী করতাম । আর ওই কালো ফিতে দিয়ে মাকে চুল বাঁধতেও আমি দেখেছি , নারকেল তেলের গন্ধ আমি চিনি – সব মিলিয়ে আপনার লেখায় রূপ -রঙ -স্পর্শ – ঘ্রাণ নিয়ে হাজির আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল কাহিনী নিজে হাত ধরে পাঠককে টেনে এনে দেখাচ্ছে মনস্তত্বের পরতে পরতে পড়ে থাকা এক অপূর্ব ঐশ্বর্যময়ী লেখিকার লিখন ভঙ্গিমা ।

    • comment-avatar

      ধন্যবাদ কল্পর্ষি। জীবনের দেখা শোনা অভিজ্ঞতার টুকরোগুলি গুণীজনের আদর পেলে বড় ভালো লাগে।

  • comment-avatar
    প্রজ্ঞাপারমিতা 4 years

    মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করুক পাঠক।অসামান্য লেখনী।

  • comment-avatar
    Swapna Mukherjee 4 years

    গল্পটি চেনা । কিন্তু তোমার লেখনীর গুণে অন‍্য মাত্রা পেল । একদমে পড়ে ফেললাম ।

  • comment-avatar
    Soma Banerjee 4 years

    মুগ্ধ! অপূর্ব লেখা।

  • comment-avatar
    দীপক ঘোষ 4 years

    রবীন্দ্রনাথের দুই বোন আছে । জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীরও দুইবোন নামে গল্প আছে। দুই বোন নিয়ে আপনার গল্পটিও অসামান্য । উত্তম পুরুষে লেখা চরিত্রটি যেন চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে । ছোট বোন নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অতি সক্রিয় । বড় বোনের দোলাচল, সত্যি কথা জানার কৌতূহল সারাজীবন কুরে কুরে খাবে । খেতেই থাকবে ।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes